22-10-2023, 08:22 PM
|| দেবীপক্ষ ||
লেখায:- সৌম্যজিত
"কি গো বুড়ি মা! শিউলি ফুলের ঝুড়িটা যে একেবারে ফাঁকা।".......শাকের আঁটিগুলোর ওপর জল ছেটাতে ব্যস্ত বৃদ্ধা কমলিনী কথাগুলো শুনে মুখ তুলে চেয়ে দেখে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় বছর উনিশের একটি মেয়ে। পরনে তার লাল পেড়ে সাদা শাড়ী। তার ডান হাতে ধরা রয়েছে একটি পদ্ম। মাথার উন্মুক্ত কালো কেশরাশি যেন হাঁটু ছুঁয়েছে তার। চাঁদের আলোর মতোই উজ্জ্বল তার মুখশ্রী। তার চোখের স্নিগ্ধ চাহনি যেন সকল বিষন্নতা মোচন করতে সক্ষম। সমগ্র জগতের সুখ শান্তি যেন তার ওই দু ঠোঁট জুড়ে লেগে থাকা এক টুকরো হাসিতেই বিরাজমান। সেই সঙ্গে তার সর্বাঙ্গ থেকে ছড়িয়ে পড়ছে সূর্যের কিরণের ন্যায় এক উজ্জ্বল দ্যুতি।
অপার মহিমামণ্ডিত মুখ খানির দিকে মুগ্ধ নয়নে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বৃদ্ধা কমলিনী বলে ওঠে... "তুমি কে মা? এ গাঁয়ে তো তোমাকে এর আগে কখনও দেখিনি!"
"তুমি আমাকে চিনবে না গো বুড়ি মা। আমি কাত্যায়নী গো। ওই বড়ো মন্দিরের কাছেই আমি থাকি। কিন্তু.... আমি যে খুব আশা করে এসেছিলাম তোমার কাছে বুড়ি মা।".......মেয়েটার কথা শুনে বড্ডো মায়া হয় বৃদ্ধার। 'আহারে! এতো দূর থেকে এসেছে মেয়েটা! তাও কটা শিউলি ফুলের জন্য! আর সে কিনা তাকে এই সামান্য সাহায্যটুকু ও করতে পারছে না!'..... মনে মনে কথা গুলো ভেবে বড্ড ব্যথিত হয় কমলিনী।
"আমার একমাত্র নাতনি জয়া-ই ওই শিউলি ফুল কুড়িয়ে আনত। শিউলি ফুল যে বড় প্রিয় ওর। কিন্তু গত এক মাস ধরে মেয়েটা যে বড্ড অসুস্থ। একবার গ্রামের প্রধানদের বাড়ির ওই বিশাল বাগানটিতে ফুল কুড়োতে গিয়েছিল ও। বেশ কিছুক্ষণ পর উদভ্রান্তের মত ছুটতে ছুটতে এসে সেই যে ঘরে ঢুকল আজ পর্যন্ত সে ওই ঘর ছেড়ে বাইরে বেরোয়নি। কিসের একটা ভয়ে সবসময় কুঁকড়ে থাকে মেয়েটা। কিছু একটা যেন বলতে চায় কিন্তু পারে না। ওর মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা অব্যক্ত ভাষাগুলো আমি কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারি গো মা। বছর পনের বয়স ওর। জন্ম থেকেই বোবা। মা নেই। বাপটাও দিনভর নেশায় ডুবে থাকে। মা হারা মেয়েটার আমি ছাড়া কেউ নেই। আর আমার কাছে ওই আমার একমাত্র পৃথিবী গো মা। আমি কি করব? কার কাছে যাব? কিই বা সামর্থ্য আছে আমার? আমি জানিনা আমার এই নাতনি টা আদৌও কোনোদিন সুস্থ হয়ে উঠবে কিনা।"...... ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে কথাগুলো বলতে বলতে দু চোখ জলে ভরে ওঠে বৃদ্ধার। কাত্যায়নী হাঁটু গেঁড়ে বসে। বৃদ্ধার দু চোখের কোল বেয়ে নেমে আসা অশ্রুধারা মুছিয়ে দিয়ে সে বলে......" চিন্তা কোরো না গো বুড়ি মা। মহামায়ার আশীর্বাদে জয়া সেরে উঠবে গো।" এরপর সে তার হাতে থাকা পদ্ম ফুলটা বৃদ্ধার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে... "এই পদ্মফুল প্রতি রাতে শোবার সময় জয়ার মাথার পাশে রেখে দিও। দেখবে ও দিন কয়েকের মধ্যেই আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। তবে হ্যাঁ! জয়া সুস্থ হওয়ার পর ওই বড়ো মন্দিরে গিয়ে মা কে শিউলি ফুল উপহার দিয়ে আসতে ভুলো না যেন! এবার আমি আসি গো বুড়ি মা। ওদিকে যে আমার মেলা কাজ। ভালো থেকো। মা মহামায়া তোমাদের মঙ্গল করুন।"......কথাগুলো বলে কাত্যায়নী নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়। তার চোখের কোণে তখন জমা হয়েছে ক্রোধের অশ্রুবিন্দু। মায়াময় ওই চোখ দুটির স্নিগ্ধ দৃষ্টি বিলীন হয়ে সেখান থেকে ঝরে পড়ছে রোষের আগুন।
*******************
ভোরের আলো ফুটতে এখনও বেশ কিছুটা সময় বাকি। প্রধানদের বাগানে শিউলি ফুল কুড়োনোর এটাই একমাত্র উপযুক্ত সময়। এরপর দেরি হয়ে গেলে তখন আর ফুল কুড়োনো সম্ভব হবে না। তাই কাল বিলম্ব না করে জয়া অন্ধকারের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু প্রধানদের বাগানের সম্মুখে আসতেই তার বুকটা কেমন যেন কেঁপে ওঠে। তার আরও একবার মনে পড়ে যায় সেই অভিশপ্ত ভোরের কথা। সেদিন যদি সে দেরি না করতো তাহলে হয়তো ওরকম একটা ঘটনার সম্মুখীন হতে হতো না তাকে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে দুরু দুরু বুকে বেড়া দিয়ে ঘেরা বাগানের একটা খোলা অংশ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে জয়া। চারিদিকে তখন অমাবস্যার ঘুটঘুটে নিকষ কালো অন্ধকার। তবে এই অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে জয়ার। বেশ খানিকটা এগিয়ে সে দেখে বাগানের ঘাস জমির ওপর বিছিয়ে রয়েছে শিউলি ফুলের সাদা আস্তরণ। এই অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সেগুলোকে। জয়া দ্রুত হাতে তার শাড়ীর আঁচলে মুঠো মুঠো শিউলি ফুল তুলতে থাকে। পর্যাপ্ত মতো শিউলি ফুল তোলা হয়ে গেলে আঁচলে গিঁট বেঁধে সে উঠে দাড়ায়।........ কিন্তু পেছন ফিরতেই তার সমস্ত শরীরটা যেন ভয়ে হিম হয়ে আসে। পুরোনো ভয়টা আবারও যেন দলা পাকিয়ে বুকের মাঝে এসে জমাট বাঁধে। সে দেখে তার সম্মুখে তখন হাতে লণ্ঠন উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রধানের ছোটো ছেলে রঞ্জন। লণ্ঠনের আলোয় তার বাঁ গালের কাঁচা গোলাকৃতি ক্ষতটা থেকে কষ গড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে এবং তার ঠোঁটের কোণে লেগে রয়েছে একটা ক্রূর বাঁকা হাসি। হেন কোনও অপরাধ নেই যা সে করেনি। গ্রামের মেয়ে-বৌ দের দিকে সর্বক্ষণ কুদৃষ্টি তার, সুযোগ পেলে তাদের সর্বনাশ করতেও ছাড়ে না সে। জয়ার সাথে ঘটে যাওয়া সেদিনের ঘটনার পেছনে এই নরপিশাচেরই হাত রয়েছে। কথা বলতে না পারায় প্রতিবাদটুকুও করতে পারেনি সে। কারোর কাছে প্রকাশ করতে না পারা এই ঘটনার স্মৃতি সর্বক্ষণ অভিশাপের এক কালো ছায়ার মতো বিরাজ করতো তার চারপাশে। তবে মায়ের সেই আশীর্বাদী ফুলের পবিত্র স্পর্শে একসময় তার জীবনে আবারও স্বাভাবিকতার আলো ফুটে ওঠে। সেদিন সে পালিয়ে এসেছিলো ঠিকই। কিন্তু আজ? তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ওই বিভীষিকার হাত থেকে কিভাবে সে নিজেকে রক্ষা করবে? তবে কি তাকে আবারও এক ভয়ঙ্কর সর্বনাশের মুখে পড়তে হবে?
"হাঃ হাঃ হাঃ!! কি রে জয়া? এতদিন পর এলি যে? এতগুলো দিন আমি যে তোর অপেক্ষায় বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম রে। তবে এখন আর আমার শরীরে কোনোরকম ক্লান্তিভাব নেই বরং আছে এক অনিয়ন্ত্রিত পৈশাচিক উত্তেজনা। আমি জানতাম তুই আসবি। আর সে কারণেই তো ওই বেড়ার একটা অংশ আমি অনেক আগে থেকেই ভেঙে রেখেছি।" .......একটা নিষ্ঠুর হাসি হেসে ঠান্ডা গলায় কথাগুলো বলতে বলতে জয়ার দিকে এগিয়ে আসে রঞ্জন। রঞ্জনের আসুরিক রূপ দেখে বুকের রক্ত যেন শুকিয়ে আসে জয়ার। এক পা এক পা করে পেছনে সরতে থাকে সে।
"এ কি ? ভয় পাচ্ছিস কেন জয়া? কোনও ভয় নেই তোর। আমি তো আছি। তোর খেয়াল রাখবো আমি বিশ্বাস কর। তবে তোর কামড়ে যে এতটা বিষ থাকবে তা আমি বুঝতে পারি নি। ক্ষতটা এখনও শুকোয়নি দেখ। তাই এর শোধটুকু যে আজ আমাকে তুলতেই হবে জয়া।"..... কথাগুলো বলে রক্তাভ চোখ দুটোতে লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে রঞ্জন দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসতে থাকে জয়ার দিকে। জয়ার তখন পিঠ ঠেকে যায় একটি গাছের সাথে। একটা অস্পষ্ট চাপা কান্না বেরিয়ে আসে তার কণ্ঠ থেকে। কিন্তু কয়েক পা এগোনোর পরই হঠাৎ রঞ্জন কিছু একটা দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। সে দেখে জয়ার থেকে বেশ কিছুটা দূরত্বে গাছ গাছালির আড়াল থেকে একটা সোনালী আলোর ছটা নির্গত হচ্ছে। ধীরে ধীরে সেই আলো আরও উজ্জ্বল হতে শুরু করেছে। পরক্ষনেই মেঘের গর্জনের ন্যায় গম্ভীর এক ভয়ঙ্কর গর্জন ভেসে আসে তার কানে। রঞ্জন সভয়ে তাকিয়ে দেখে জঙ্গলের অন্ধকার ভেদ করে বেরিয়ে আসছে হলদে-সোনালী রঙের মিশ্রনের ভীমকায় একটা জীব।
সে রজঃগুণের অধিকারী। সেই সঙ্গে প্রচন্ড শক্তি ও উচ্ছাসের প্রতীক। তার চোখ দুটি যেন অসীম বীরত্বের পরিচয় বহন করে। মাথার উপরিভাগ থেকে বুকের তল পর্যন্ত নেমে আসা কেশর রাশি বহন করে তার পুরুষত্বের পরিচয়। তার শরীরের ওই সোনালী দীপ্তি যেন তেজরশ্মির প্রতীক। সে পশুরাজ। সে মা মহামায়ার বাহনকেশরী। এমন একটা অকল্পনীয় দৃশ্যের সম্মুখীন হওয়ার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না রঞ্জন। সে দেখে ভীমকায় এক পুরুষ সিংহ এসে দাঁড়িয়েছে এক মনে মা মহামায়াকে স্মরণ করতে থাকা ভীত জয়ার পাশে। জয়ার ভীত মুখটার দিকে একবার চেয়ে নিয়ে পশুরাজ তার হলুদ চোখ দুটি থেকে হিংস্রতার আগুন ঝরাতে ঝরাতে এগিয়ে যেতে থাকে রঞ্জনের দিকে। পশুরাজের মাথার দিকে চোখ পড়তেই রুপোলি মুকুটটা দেখতে পায় রঞ্জন। মুকুটটা যেন খুব চেনা লাগে তার। ঠিক এরকমই একটা রুপোর মুকুট তো প্রতি বছর বড়ো মন্দিরের মা দুর্গার বাহন কে পরানো হয়ে থাকে। কথাগুলো ভেবে ভয়ে রঞ্জনের সমস্ত শরীরটা যেন এবার আড়ষ্ঠ হয়ে আসতে থাকে। হাতের লণ্ঠনটা মাটিতে পড়ে গিয়ে ততক্ষনাৎ নিভে যায় সেটি। অন্ধকারের মধ্যে দিগ্বিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে সে প্রাণপণে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করে বাগানের বেড়ার ওই ভাঙা অংশটার দিকে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই আকাশ কাঁপানো এক হুঙ্কার ছেড়ে পশুরাজ ঝাঁপিয়ে পড়ে রঞ্জনের ঘাড়ের ওপর। ভীত স্বরে কেবল মাত্র একটা আর্তনাদ করে ওঠে রঞ্জন। ওদিকে ভীত সন্ত্রস্ত জয়া প্রচন্ড ভয়ে তার দু চোখ বন্ধ করে ফেলে। পরমুহূর্তেই পশুরাজের মারণ কামড়ে একটা মট্ শব্দে রঞ্জনের ঘাড় ভেঙে যাওয়ার শব্দটা শুনতে পায় সে। এমনকি তার বিশাল বিশাল থাবার শাণিত নখের আঁচড়ে রঞ্জনের পাঁজরের হাড়গুলো পর্যন্ত ভেঙে যাওয়ার শব্দ ভেসে আসে জয়ার কানে।
বেশ কিছুটা সময় কেটে গিয়েছে। চারিদিক আবারও নিস্তব্ধ। ধীরে ধীরে এবার চোখ মেলে জয়া। দেখতে পায় তার সম্মুখে তখন এসে দাঁড়িয়েছে সেই পশুরাজ। অন্তরের সমস্ত ভয় ভীতি দূরে সরিয়ে রেখে এবার পশুরাজের চোখে চোখ রাখে জয়া। নিজের অজান্তেই যেন তার হাতটা উঠে আসে পশুরাজের কপালের ঠিক মাঝে। পশুরাজও তার মাথা খানিকটা ঝুঁকিয়ে দেয় সামনের দিকে। যেন সে মাথা পেতে স্বয়ং দেবীর কাছ থেকে আশীর্বাদ গ্রহণ করছে। এদিকে রাতের আঁধার কেটে ভোরের আকাশে আলো ফুটতে শুরু করেছে। জয়া লক্ষ্য করে ধীরে ধীরে পশুরাজের শরীরটা যেন বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। দূর থেকে সেইসময় ভেসে আসছে শঙ্খধ্বনি। সেই সঙ্গে মহালয়ার প্রাণ জুড়োনো চণ্ডীপাঠ মন্ত্র। অর্থাৎ সূচনা হয়েছে দেবীপক্ষের। জাগরিত হয়েছেন দেবী দশপ্রহরণ ধারিণী। জয়া আর দেরি করে না। কারণ মা যে স্বয়ং নিজে এসে আবদার করে গেছেন। তাই মায়ের চক্ষুদান পর্ব সারা হলে মা যখন দু'চোখ মেলে সর্বপ্রথম তার প্রিয় শিউলি ফুলগুলোকে দেখবেন তখন মা নিশ্চয়ই তার এই ছোট্ট মেয়েটির ওপর বেশ খুশিই হবেন। আঁচলে বাঁধা শিউলি ফুলগুলোকে বুকে জড়িয়ে ধরে জয়া তখন রওনা দেয় গ্রামের প্রান্তের বড় মন্দিরের উদ্দেশ্যে।
|| সমাপ্ত ||