22-10-2023, 11:43 AM
<×><×><×><×><×><×><×><×><×><×><×><×>
দ্য ফ্লাইট ইজ আন্ডার কনট্রোল
<×><×><×><×><×><×><×><×><×><×><×><×>
গাড়ি থামতেই, লাফিয়ে নামলো ভদ্রা। দৌড়ে লিফটে। বোতাম টিপতে গিয়ে দেখলো আঙুল কাঁপছে। উঠে এলো চার তলায়। একদৌড়ে ঘরে। মা … ওমা … মা-আ-আ! কোনো সাড়া নেই তনুর। প্রস্তর মুর্তির মতো একভাবে বসে আছে। দৃষ্টি দেওয়ালের দিকে। দৌড়ে গেলো ভদ্রা। ঝাপিয়ে পড়লো মায়ের বুকে।জড়িয়ে ধরলো। মা-মা-মা-আ-আ! থরথর করে কেঁপে উঠলো সুতনুকা। এতক্ষণের জমা কান্নার স্রোত ভাসিয়ে দিলো মা মেয়েকে। কল্পনা দাঁড়িয়ে পাশে। কাঁদুক, কাঁদলে হালকা হবে। অবরুদ্ধ কান্নার স্রোত, যত বেরিয়ে যায়, ততই মঙ্গল।
✪✪✪✪✪✪
রিসেপশনের ফোন।
- ইয়েস। … এপাশ থেকে ভির।
- ফ্লাইট কনফার্ম, আর্লি মর্নিং 04:30; চেক ইন 02:30; দুটো নাগাদ গাড়ী আসবে। অ্যাওয়েকনিং কল …
- 2 ও'ক্লক শার্প।
শিড়দাঁড়া সোজা করে বসে রইলো। মামণিকে ফোন করি। বিছানা হাতড়ে তুলে নিলো মোবাইলটা। যন্ত্রের মতো ডায়াল করতে,
- ভির! আমি কল্পনা …
- মামণি?
- এতক্ষণ এখানেই ছিলো। ভদ্রা বেবি বেডরুমে নিয়ে গেছে চেঞ্জ করাতে। সেই সকাল থেকে এক পোষাকে …
- একটু দেওয়া যাবে? …
- আমি বলছি … অ্যাভেলেবল হলে রিং ব্যাক করছি।
- ও.কে. অ্যাওয়েটিং। … আবার অন্তহীন প্রতীক্ষা। … এক মনে কল্পনা করার চেষ্টা করছি হলদিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি। … অন্ধকারে একটাই আলো; … বুনু পৌঁছে গেছে। টিভি চলছে। একঘেয়ে ব্রেকিং নিউজ। … ধ্যুত! … ভাল্লাগেনা। … রিমোট … রিমোটটা কোথায় গেলো? … এইতো! … বন্ধ থাক!
অন্তহীন প্রতীক্ষা। ফোনটা বেজে উঠল। বুনু? … ভিডিও কল, ধরলাম,
- ভাইয়া-য়া-য়া, … কি হয়ে গেলো? … বাপি?? … হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো।
- কুল বুনু! কুল! তুই এরকম করলে মামণিকে কে সামলাবে? লক্ষ্মী বুনু আমার। তোকে আর আমাকে স্ট্রং হতে হবে এখন। মামণিকে ভালো রাখার দায়িত্ব এখন আমাদের। হ্যাঁ রে; মামণি কোথায়?
- ঘরে; ঘুমোচ্ছে।
- কিছু খাওয়াতে পেরেছিস? … দিল্লির গেস্ট হাউসে বসে, পরিস্থিতি নিজের কন্ট্রোলে নেওয়ার চেষ্টা করছে ভির। যদিও ভির জানে, ওর বুনু যথেষ্ট ম্যাচ্যিউর; বাট, এখনো ছেলেমানুষ।
- হ্যাঁ! চেঞ্জ করিয়ে এক গ্লাস জুস খাইয়ে দিয়েছি। তারপর একটা ট্যাবলেট … পাশ থেকে কল্পনার গলা,
- ডক্টর বলেছিলেন, রাতে একটা সিডেটিভ দিতে, না হলে ঘুমোতে পারবে না
- ও?কে. কল্পনা। তুমিও তো সারাদিন বাড়ির বাইরে। একবার বাড়ি গিয়ে, চেঞ্জ করে তোমার ছেলেকে নিয়ে চলে এসো। দু' রাত থাকার প্রস্তুতি নিয়ে এসো।
- ছেলেকে নিয়ে এলে ম্যাডামের অসুবিধা হবে না?
- না। আমার মনে হয়, একটা বাচ্ছা ছুটোছুটি করলে, মামণির মনটা একটু ডাইভার্টেড থাকবে। তোমার আয়া, রাতে তোমার বাড়ি পাহারা দিক। সকালে ডেকে নেবে। তাহলে, তুমি মামণি আর বুনুকে, এসকর্ট করতে পারবে। অবশ্য, আমিও থাকবো।
ধীরে ধীরে পরিস্থিতির রিমোট কন্ট্রোল ভিরের হাতে।
- বুনু তুই কিছু খেয়েছিস? চট করে কিছু খেয়ে নে। তুই সুস্থ না থাকলে; মামণিকে সামলাতে পারবি না। এগারোটার আগে আমি পৌঁছতে পারবো না। কল্পনা আন্টিকে, বল অ্যাডমিন সাহেবের ফোন নম্বর, টেক্সট করতে। আমি একটু কথা বলি।
'টুং' করে একটা ম্যাসেজ ঢুকলো।
কল্পনার ম্যাসেজ। একটা ফোন নম্বর। ডায়াল করলাম।
- ………… হিয়ার। হু ইজ ইট?
- ভির। আবীর সেন।
- ওহ! ইয়েস, হ্যাভ য়্যু গট দ্য স্কেডুল ফ্রম ডেলহি? আওয়ার কার উইল এসকর্ট য়্যু ফ্রম ক্যালকাটা এয়ারপোর্ট। দেন, স্ট্রেইট হলদিয়া। পোলিশ ফরম্যালিটিস মাস্ট বি কমপ্লিটেড বাই 12 ও'ক্লক। এভরিথিং ইজ অ্যারেনজড, বাই দ্য স্টাফস। আই থিঙ্ক; দ্য প্রোসিড্যুর, উইল বি কমপ্লিটেড বাই 16:00 ও'ক্লক।
- ও.কে. দেন।
- আর হ্যাঁ। আরেকটা কথা। ডু নট স্কিপ ইয়োর মিল। আই নো, ইট'জ ডিফিকাল্ট। বাট,য়্যু হ্যাভ টু স্টোর এনার্জি ফর টুমরো। হ্যাভ সাম লাইট রিফ্রেশমেন্ট অ্যান্ড টেক আ গুড রেস্ট। ও.কে. বাই দেন। হোপ টু মীট টুমরো নুন। গুন্নাইট।
- গুড নাইট।
ফোনটা পাশে রেখে বসে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর রুম সার্ভিসে ফোন করে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর জ্যুস অর্ডার করে দিল। আধ ঘণ্টা পরে সার্ভ করলো। খেয়ে, হাত-মুখ ধুয়ে, ঘাড়ে জল দিয়ে ফ্রেস হয়ে, আলো নিভিয়ে, বিছানায়।
টান টান সোজা হয়ে শুয়ে, মাথার নিচে হাত দিয়ে, সারা দিনের ঘটনাপ্রবাহের কথা এবং আগামী কালের সম্ভাব্য করণীয় কৃত্য সম্মন্ধে ভাবতে লাগলো। এক সময়, অজান্তেই চোখ বুজে এলো। তলিয়ে গেলো অঘোর ঘুমে।
ফোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙলো। ঘড়ি দেখলো। শার্প 2:00 ও'ক্লক। যান্ত্রিক কুশলতায় প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে এলো। কালকের গাড়িটাই। ড্রাইভার দরজা খুলে দিলো। উঠে বসতে; রওয়ানা দিলো এয়ারপোর্টের দিকে।
✪✪✪✪✪✪
ক্যালকাটা এয়ারপোর্টে যখন ল্যান্ড করলো, ঘড়িতে তখন সাতটা বাজলো। ড্রাইভার দাঁড়িয়ে আছে প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে। ভির এগিয়ে যেতে, ড্রাইভার পার্কিং লট থেকে গাড়ি বার করে নিয়ে এলো এক মিনিটের মধ্যে। ভির উঠে বসতে, মসৃণ ভঙ্গিমায় বেরিয়ে গেলো হলদিয়ার পথে। ফোনটা! বুনুকে একটা ফোন করতে হবে।
- বুনু!
- ভাইয়া!
- মামণি?
- উঠেছে। ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে, বাবির ছবির সামনে বসে আছে।
- স্পিকারে দে, … মামণি! ও মামণি! তুমি ঠিক আছো তো? আমি এসে গেছি। তুমি একদম চিন্তা করবে না। আমি বারোটার মধ্যে পৌঁছে যাবো। একটু কিছু মুখে দাও। না হলে শরীর খারাপ করবে। প্লিজ-জ মামণি। কিছু একটা খাও। … শোকের ওপর দখল নিলো মাতৃত্ব। এতোক্ষণের নীরবতা ভঙ্গ করে মৃদুস্বরে বলে উঠলো,
- আমি ঠিক আছি। তুই সাবধানে আয়। কিছু খেয়ে নিস।
- হ্যাঁ, কোলাঘাট ঢুকছে। আমি খেয়ে নেবো। তুমি জ্যুস বা কফি যেটা খেতে ইচ্ছে করে বুনুকে বলো, বুনু করে দেবে। … ফোনটা কেটে দিয়ে আবার রিং করলো,
- স্পিকারে নেই তো?
- না।
- কল্পনা কোথায়?
- কিচেনে।
- ফোন দে। … ভদ্রা কিচেনে গিয়ে দেখলো কল্পনা ওর ছেলের ব্রেকফাস্ট করছে। ফোনটা ওর হাতে দিয়ে বললো,
- ভাইয়া।
- ভির, বলো,
- ছোটু আছে সামনে?
- না। ডাকবো?
- না। ডাকতে হবে না। স্পিকারে দাও।
- দু'জনেই ভালো ভাবে বুঝে নাও; মামণি অ্যানয়েড হয়, এরম কোনো কাজ করবে না। কিন্তু, ছোটুকে এমনভাবে ব্যবহার করো যে, ছোটু গিয়ে ওর আঈ-কে নালিশ করে। এটা তোমরা দু'জনে যতো বেশী করতে পারবে, ছোটু তত বেশী নালিশ করবে। মামণি; ছোটুর সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে ব্যাস্ত থাকলে পাপাকে নিয়ে চিন্তা করার সময় পাবে না। আমি না পৌঁছানো অবধি এই ড্রিলটা বুদ্ধি করে চালাবে। মামণি যেন বুঝতে না পারে।
ধাবার টয়লেটে একটু ফ্রেশ হয়ে একটা জলের বোতল হাতে দুটো ফ্রুট জ্যুসের ক্যান নিয়ে গাড়িতে উঠে গেল। নষ্ট করার মতো সময় নেই। গাড়ি স্মুথলি হাইওয়ে ধরে নিলো। চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে বসে ডিপ ব্রিদিং করতে লাগলো। নার্ভগুলো টেন্সড হয়ে আছে।
✪✪✪✪✪✪
সাড়ে এগারোটার একটু পরে পৌঁছে; ভির, লিফট ধরে ওপরে। … দৃঢ় পায়ে ঘরে ঢুকলো।
- মামণি!
- ভির!! … দুহাত বাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। ভির দৌড়ে গিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলো। থরথর করে কাঁপছে শরীরটা। আকুল কান্নায় ভেঙে পড়লো। গত চব্বিশ ঘন্টা প্রস্তর প্রাচীরে অবরুদ্ধ স্রোত, ফেটে বেরিয়ে এলো। হাউ হাউ করে কাঁদছে। নিজের শরীরে সাপটে ধরে, মামণির পিঠে হাত বোলাতে পাশে তাকিয়ে দেখলো বুনুর দিকে। দুচোখে জল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইশারায় ডেকে নিতে; দৌড়ে এসে "ভাইয়া-য়া" বলে জড়িয়ে ধরলো। এক হাতে মা; আরেক হাতে বোনকে জড়িয়ে ধরে বাজপড়া তাল গাছের মতো দাঁড়িয়ে রইলো, সংসারের একমাত্র পুরুষ, আবীর সেন।
ছোটুকে কোলে নিয়ে কল্পনা দাঁড়িয়ে পাশে। চোখের ইশারায়; এগিয়ে এসে, ছোটুকে এগিয়ে দিলো সুতনুকাএ দিকে। ছটফটিয়ে ভিরকে ঠেলে আঈ-এর কোলে ওঠার চেষ্টা। মুখ তুলে দেখলো তনু। কান্নার প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ফিরে আসছে স্বাভাবিক পৃথিবীতে। ছোটুকে কোলে নিলো। গালে একটা হামি খেয়ে ছোটু বললো, "ভির পচা। দুষ্টু। আমি বকা দেবো ভিরকে।" আস্তে আস্তে স্বাভাবিকতায় ফিরে আসছে তনু। ছোটুর গালে গাল রেখে বলে উঠলো, "হ্যাঁ বাবা। ভিরকে বকা দাও।" চব্বিশ ঘণ্টা বাদে প্রথম স্বাভাবিক কথা। মাতৃ সত্তা ফিরে পাচ্ছে। ভিরের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, "কিছু খেয়েছিস?"
কল্পনা উঠলো, কফি আর স্যান্ডউইচ দিচ্ছি টেবিলে। তোমরা এসো। মামণির পিঠে হাত দিয়ে ধরে চললো ডাইনিংয়ের দিকে।
কফি খেতে খেতে, অ্যাডমিন সাহেবকে ফোনে ধরলাম,
- স্যার, আমি ভির।
-
…
…
…
…
…
- ইয়েস। আমরা নিচে যাচ্ছি। … মায়ের দিকে ফিরে
- চল, আমরা নিচে যাবো।
ছোটুকে আয়ার কোলে দিয়ে, বুনুকে ধরে কল্পনা এগিয়ে গেছে। মামণিকে জড়িয়ে ধরে, আমিও পা বাড়ালাম। নিচে নেমে সামনে তাকালাম। প্ল্যান্টের অর্ধেক লোক এখানে। কাঁচের গাড়ি থেকে স্ট্রেচার নামিয়ে একটা মেকসিফট প্ল্যাটফর্মে রাখা। এগিয়ে গেলাম মামণিকে নিয়ে।
পরিপূর্ণ সম্ভ্রম বজায় রেখে, ধীর পায়ে মামণি এগিয়ে গেলো। পাশে আমি একহাতে ধরে আছি। একটা বড় সাদা স্থলপদ্মের মালা কেউ ধরিয়ে দিয়েছে মামণির হাতে। এগিয়ে গিয়ে পাপার বুকের ওপর রাখলো। দু'হাতে পাপার গাল দুটো ধরে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। পিঠে রাখা হাতটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। কাঁদছে মামণি। নিঃশব্দে। ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে চোখ থেকে।
মামণিকে এপাশে সরিয়ে আনতেই, বুনুকে আমার কাছে দিয়ে; কল্পনা মামণিকে ধরে পাশেই একটা চেয়ারে নিয়ে বসালো। বুনু, হাতের মালা বাবির বুকের ওপর রেখে বুকের ওপর ভেঙে পড়লো। আমি, বুকের মধ্যে জাপটে ধরে সরিয়ে নিয়ে, মামণির পাশে বসিয়ে দিলাম। ছোটুর আয়া ততক্ষণে ছোটুকে নিয়ে নেমে এসেছে।
আয়ার কোল থেকে ছেলেকে নিয়ে, কল্পনা এগিয়ে গেল। জেম্মা আর জেঠু চলে এসেছে। জেম্মা আগে মালা দিয়ে সরে এসেই কল্পনাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো। হাত বাড়িয়ে ছোটুকে কোলে নিয়ে একহাতে জড়িয়ে ধরলো কল্পনাকে।
কান্নায় ভেঙে পড়লো কল্পনা। দুর্ঘটনার পর থেকে বুকের অতলান্ত কান্না চেপে; দাঁতে দাঁত দিয়ে, সমস্তটা সামলেছে। কারণ ভির বা বড়দা-বড়দি না পৌঁছনো অবধি পরিবারের মাথায় ছাতা ধরার মতো কেউ নেই। মুখ টিপে, ভেতরের কান্না ভেতরেই চেপে রেখে, এতক্ষণ সামলে গেছে সবকিছু।
এখন বড়দির বুকে মাথা রেখে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো। বড়দি ওকে ধরে ধরে এগিয়ে নিয়ে গেল শবদেহের পায়ের কাছে। পায়ের ওপর মাথা রেখে পড়ে রইলো মিনিটখানেক। মাথা তুলে, বড়দির কোল থেকে ছেলেকে নিয়ে, মাথাটা একবার ছুঁইয়ে নিলো পায়ের পাতায়। কেউ জানলো না; এ এক অবুঝ সন্তানের, পিতাকে প্রথম এবং শেষ প্রণাম।