18-10-2023, 07:36 PM
(This post was last modified: 18-10-2023, 07:37 PM by Bumba_1. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
|| হামারি আধুরি কাহানি ||
কাহিনী এবং প্রচ্ছদঃ- বুম্বা
মাঝরাতে হঠাৎ যেন একটা কিসের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম প্রায় পৌনে দু'টো। বাথরুমে যাচ্ছিলাম, কি মনে হলো, কান পাতলাম পাশের দরজায়। ফিসফিস নয়, রীতিমতো স্বাভাবিক গলাতেই কথা বলছে অপর্ণা। কিন্তু কার সঙ্গে? নিঃশ্বাস বন্ধ করে কানটাকে দরজার একেবারে গায়ে ঠেসে নিয়ে দাঁড়ালাম। শুনতে পেলাম কথা বলার ফাঁকে ও মাঝে মাঝে হেসে উঠছে। আবার থামছে, আবার কিছু বলছে, আবার হাসছে। তাহলে কি ঘরের মধ্যে কেউ রয়েছে? নাকি মোবাইলে কথা বলছে? নাহ্ , ভাবতে পারছি না আর। দেখতে ইচ্ছে করছে নিজের চোখে। ও তো আমার পাশেই শুয়েছিলো এতক্ষন! কখন যে নিঃশব্দে উঠে গিয়েছে, খেয়ালই করিনি। নক করবো দরজায়? ডাকবো?
"অপর্ণা .. এই অপর্ণা .. তুমি কি ভেতরে?" আমার গলার আওয়াজ পেয়েই ঘরের ভেতর থেকে আসতে থাকা কথাগুলো হঠাৎ থেমে গেলো। সবকিছু নিঃস্তব্ধ হয়ে গেলো মুহূর্তের মধ্যে। তারমানে, এতক্ষণ ধরে আমি ঠিকই ভাবছিলাম। ঘরের মধ্যে নিশ্চয়ই কেউ রয়েছে। আচ্ছা, আমার গলার আওয়াজ পেয়ে ও কি নামলো বিছানা থেকে? নামার পর ও কি সত্যিই দরজা খুলবে? নাকি কী-হোলে চোখ রেখে দেখতে চাইবে কে ডাকছে বাইরে থেকে?
কে যেন খুব জোরে জোরে ধাক্কা দিয়ে আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিলো। তাকিয়ে দেখি অপর্ণা। তারমানে, আমি এতক্ষণ ঘুমোচ্ছিলাম? এতক্ষণ যা কিছু দেখছিলাম, শুনছিলাম সবকিছুই কি আমার কল্পনা? "কি হয়েছে?" ওকে জিজ্ঞাসা করে জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখি ঘুটঘুটে অন্ধকার। "ও বলছে, ওর দরজার বাইরে নাকি শব্দ হচ্ছিলো .." আমার দিকে তাকিয়ে বললো অপর্ণা।
"কার দরজায়?" অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আমি। "ওই যে, যার দরজায় তুমি এতক্ষণ আঁড়ি পাতছিলে!" আমার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে কথাগুলো বললো অপর্ণা।
ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম ওর দিকে। হাল্কা গোলাপী রঙের একটা নাইটি পড়ে রয়েছে ও। সেবার ডায়মন্ড প্লাজা থেকে আমিই তো কিনে দিয়েছিলাম এটা ওকে। "আমি? কই না তো! আমি তো ঘুমাচ্ছিলাম, তুমিই তো আমাকে ডাকলে! হয়তো ইঁদুর কোনো পোকা বা অন্যকিছু দেখে, তাড়া করতে গিয়ে আওয়াজ করে ফেলেছে। যাও, তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো .. নাকি আমার পাশে শোবে?" খাটের পাশে টেবিলের উপর রাখা বোতল থেকে কিছুটা জল ঢকঢক করে খেয়ে নিয়ে কথাগুলো বলে অপর্ণার দিকে তাকাতে গিয়ে দেখলাম মাঝরাতে একা বসে রয়েছি আমার বিছানায়, কেউ কোত্থাও নেই।
এখন আর চমকে যাই না, কিংবা অবাকও হই না। অপর্ণা চলে যাওয়ার পর থেকে এটা এখন রোজ রাতের ঘটনা। ওইটুকু সময়েই তো ও আসে আমার কাছে, ওইটুকু সময়েই তো ওকে কাছে পাই আমি!
★★★★
অফিস যাওয়ার পথে সেদিন দেখা হলো আরতি বৌদির সঙ্গে। ন'টার শেওড়াফুলি লোকাল .. মোটামুটি ফাঁকাই থাকে। প্রথমে চিনতে পারিনি। দেখি, এক মহিলা বারবার তাকাচ্ছে আমার দিকে। বয়স, আমাদের থেকে বেশ কিছুটা বড়ই হবে, প্রায় চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বা হয়তো পেরিয়ে গিয়েছে। ভালো করে দেখলাম সাজগোজ একটু উগ্র। আমার মনে হলো, বয়সটাকে যেতে দিতে চাইছে না ওই মহিলা। পঁয়ত্রিশ ছত্রিশের মধ্যে আটকে রাখতে চাইছে।
লক্ষ্য করলাম, আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসলো মহিলাটি। কিছুটা অপ্রস্তুতে পড়ে গেলাম আমি। কারণ আমিও তো, ওঁর দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম। তৎক্ষণাৎ নিজের চোখটা সরিয়ে নিয়ে, কয়েক সেকেন্ড পর আবার আড়চোখে ওই দিকে তাকাতেই দেখলাম, মহিলাটি তখনো আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। তবে কি বাজে কিছু? মানে, যেমন হয় এই লাইনে। আর বেশি কিছু না ভেবে, খবরের কাগজটা খুলে ধরলাম আমার মুখের সামনে।
হঠাৎ শুনি, কে যেন ডাকছে আমার নাম ধরে। মুখের সামনে থেকে কাগজটা সরিয়ে দেখলাম ঠিক আমার উল্টোদিকের সিটে এসে বসেছে মহিলাটি। আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললো, "কি রে, তখন থেকে ডাকছি, চিনতে পারছিস না আমাকে? আরে, আমি আরতি বৌদি।" সত্যিই তো! আমরা যে পাড়ায় আগে থাকতাম, আমাদের দুটো বাড়ির পরে ঘোষেদের বাড়ির একতলাটায় ভাড়া এসেছিলো এরা। বছর দুয়েক ছিলো, তারপর কোথায় যেন চলে গেলো। আমরাও নতুন বাড়ি করে এখানে চলে এলাম, ভুলেই গিয়েছিলাম ওদের কথা।
অফিসের তাড়া ছিলো, তবুও হাওড়ায় নেমে বেশ কিছুটা সময় দিতে হলো আরতি বৌদিকে। "তোকে কিন্তু আমি এক দেখাতেই চিনতে পেরেছি। আগের থেকে একটু মোটা হয়েছিস আর দাড়িগোঁফ কমিয়ে ক্লিন শেভড হয়ে গেছিস। তবে যাই বলিস, তোর আগের চেহারাটাই আমার বেশি পছন্দের। লম্বা ছিপচিপে চেহারা, গালে হাল্কা দাড়ি, জিন্সের প্যান্ট আর হাতা গুটিয়ে পড়া পাঞ্জাবি .. এখনো আমার চোখের সামনে ভাসে, জানিস!" দেখলাম, হঠাৎ করেই ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে ক্ষয়ে যাওয়া লিপস্টিকের একটা টিউব বের করে, সেটাকে ঠোঁটের পাতায় ভালো করে লাগিয়ে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলো বৌদি, "তবে শুধু আমার নজর যে তোর উপর ছিলো, তা নয়। তুইও কিন্তু আমাকে .. আচ্ছা, দোলের দিনের ওই ঘটনাটা মনে আছে তোর? ক্লাবের পেছনটায় রঙ মাখানোর ছলে যেভাবে হঠাৎ করে আমার ব্লাউজের ভিতর হাত ঢুকিয়ে বুক দুটো ডলে দিয়েছিলিস। ভাগ্যিস সেই সময় ওখানে কেউ এসে পড়েনি, তাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যেত। ইশ্ , কথাগুলো ভাবলেই আমার শরীরের ভেতরটা এখনো কিরকম যেন শিরশির করে ওঠে .."
"ছাড়ো না বৌদি, অত দিনের পুরনো কথা তুলে এখন কি লাভ? তাছাড়া আমার তখনকার কথা আর সেভাবে কিছু মনেও পড়ে না। তুমি কোথায় যাবে? আমার অফিস ডালহৌসিতে, ওইদিকে গেলে তোমাকে ড্রপ করে দেবো। আসলে আমার একটু তাড়া আছে .." আরতি বৌদিকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে কথাগুলো বললাম আমি।
"না রে, লাভ লোকসানের জন্য আমি কিছু বলছি না। একটু স্মৃতি রোমন্থন করছিলাম। ডালহৌসির দিকে যাবো না, আমি হাওড়া ময়দানের দিকে যাবো। আমার গন্তব্য, না থাক ঠিকানাটা না হয় নাই বা বললাম! তোর মতো তো গর্ব করার মতো কাজ আমি করি না। আজ পরপর দুটো অ্যাপয়েন্টমেন্ট রয়েছে, তবে একটু বেলার দিকে। তাই তোর সঙ্গে দাঁড়িয়ে একটু কথা বলছিলাম।" বৌদির কথাগুলো শুনে, কেন জানি না বোকার মতো প্রশ্ন করে ফেললাম, "কিসের অ্যাপয়েন্টমেন্ট? তুমি কি কোনো ইনসিওরেন্স কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত?"
আমার কথাগুলো শুনে প্রচন্ড জোড়ে হেসে উঠলো আরতি বৌদি। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, "আগে তো তুই ভীষণ চৌকস ছিলিস। এখন এরকম ভোঁতা হয়ে গেছিস কেনো রে? আমাদের ফ্যামিলিতে আর্নিং মেম্বার বলতে তো একমাত্র তোর দাদাই ছিলো! ফ্যাক্টরির এক্সিডেন্টে তোর দাদার হাতদুটো চলে যাওয়ার পর থেকে রোজগার একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। প্রভিডেন্ট ফান্ডের ওই দুটো টাকা দিয়ে আর কতদিন চলবে বল? তাই নেমে পড়লাম এই লাইনে। কোনো ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে নয় বকুরাম, আমি একটা এসকর্ট সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত। প্রেম করে বিয়ে করেছিলাম তোর দাদাকে। কি ভেবে সংসার করতে এসেছিলাম, আর কোথায় পৌঁছে গেলাম! চলি রে, তোর অনেকটা সময় নষ্ট করে দিলাম। চিন্তা করিস না, এরপর থেকে পুরনো কথা আর বলবো না তোর সামনে। এমনকি তোকে দেখলে চিনতেও হয়তো পারবো না। যেটা আমাদের দু'জনের জন্যই হয়তো মঙ্গল।"
আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে হাওড়া স্টেশনের জনস্রোতে মিশে গেলো আরতি বৌদি। কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে, তারপর অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম আমি।
★★★★
রাতে একলা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে নিজের ছায়া দেখছিলাম। পিছনের আলো, সামনের আলো বা পাশের কোনো বাড়ির জানলা থেকে ছিটকে বের হয়ে আসা কোনো আলোর রেখা পড়ে একটা শরীরের অন্তত তিন-চারটে ছায়ার সৃষ্টি হয়। একটা কোনো ছায়া যখন লম্বা হতে হতে অস্পষ্ট হচ্ছে তখন আরেকটা ছায়া স্পষ্ট হয়ে নতুন করে সেই জায়গা দখল করে নিচ্ছে। ছায়া কিন্তু বয়সের চিহ্ন রাখেনা। পঁচিশ কিংবা বাহান্ন .. সবই একরকম।
আরে, কে এটা আমার পাশে? একেবারে আমার মতোই হাঁটা আমার মতোই হাতের এপাশ ওপাশ, মাথা ঘোরানো। কলেজ থেকে ফিরতে থাকা সবে গোঁফ-দাড়ি গজানো কোনো ছেলেই তো মনে হচ্ছে! একেবারে কিচ্ছু না থেকে বড় হতে হতে এসকেএস এর লাস্ট ক্লাস ফাঁকি দিয়ে তাড়াহুড়ো করে হাঁটা সেই ছেলেটা।
কাঁধে চামড়ার ব্যাগ, সঙ্গে একজন কলেজফেরৎ তন্বী। নীলশাড়ি .. কোথাও বৃষ্টি নামবে আচমকা। আর সঙ্গে সঙ্গে ও উধাও হবে এক নিমেষে। যেন কাউকে দেরি করানোর জন্য, যেন কারও আশায় আশায় সে আসছে। শুধু একজন কারও জন্য সব ফেলে যে ট্রেন ধরেছে, বৃষ্টি আজ তাকে সুযোগ করে দিচ্ছে। তার আসার কারণেই তো ভেজা পথঘাট, বন্ধ জানলা। তার জন্য বাতাস হঠাৎ হঠাৎ আছড়ে পড়ছে ওর শরীরে। শাড়ির আঁচল ও যেন সামলাতে পারছে না কিছুতেই।
দরজা ধাক্কা দিতে হলো না, খুললো এমনিতেই। দেখি অপর্ণা বসে রয়েছে বিছানার উপর। ওকে বললাম, "নীল শাড়ি পরা একটি মেয়ে এই এক্ষুনি ..!"
অপর্ণা বললো, "ধ্যাত, শাড়ি আবার কোথায় দেখলে? ইলেভেন টুয়েলভেও তো আমি স্কার্ট পড়েই কলেজে যেতাম। তুমি কি ওর পিছন পিছন .. আচ্ছা দেখলে ওর সঙ্গে কাউকে রাস্তায়?"
"কাকে দেখবো? কোথায়?" অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
"কেনো, তুমিই তো এইমাত্র বললে, যে তুমি নাকি .. ও আমাকে বলেছে, ওর খুব ভয় করছিলো। বৃষ্টির জন্য আটকে গিয়েছিলো কলেজে। ফাঁকা রাস্তায় ও নাকি স্পষ্ট পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলো। অনেক পেছন থেকে খুব জোরে জোরে হেঁটে কেউ যেন ওকে ধরে ফেলতে চাইছে।" খিলখিল করে হেসে উঠে বললো অপর্না।
অপর্ণার কথা শুনে ভাবলাম, তারমানে আমি নিশ্চিত ছিলাম। ওর সঙ্গে একজন কেউ ছিলো। তার মানে আগের দিন রাতেও ওর ঘরে ওই যে ফিসফিস শব্দ, সেখানেও কেউ ছিলো। এবার থেকে আর কড়া নাড়বো না ওর ঘরে, ওকে আর ডাকবো না। শুধু কান লাগিয়ে শুনবো। কিন্তু অপর্ণাকে কিছু বুঝতে দিলে হবে না। আমাকে সব কিছু করতে হবে চুপি চুপি। আচ্ছা আমি কি ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাচ্ছি?
অফিস থেকে ছুতোনাতায় বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে আজকাল, বেরিয়েও পরি। 'এখন কোথায় যাচ্ছি' 'কি দরকারে যাচ্ছি' কেউ জানতে চাইলে, কিছু বলার চেষ্টা করে আর সময় নষ্ট করি না। কোনোমতে সহকর্মীদের প্রশ্নবাণ সামলে বেরিয়ে পড়ি। অপর্ণার কলেজ ছুটির সময় হয়ে গিয়েছে, আগে থেকেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে কলেজের গেটের পাশে। আমার স্থির বিশ্বাস আমার আগে ওখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে কেউ। হয়তো অপর্ণাও ছল করে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে আসবে রাস্তায়। তারপর হয়তো দুজনে হাত ধরে ..! আজ একেবারে কলেজের গেট থেকে ধরতে হবে ওদের। এক মুহূর্তের জন্যও চোখের বাইরে রাখা যাবে না।
দু এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়লে পড়ুক, দুপাশের জানলা দিয়ে যে খুশি মুখ বাড়াক, আমাকে জানতেই হবে কে রয়েছে অপর্নার সঙ্গে। বাঁদিকে মিতুলদের বাড়ি পার হলেই চেনা ঘর, দরমার বেড়া টিনের চাল, পেয়ারা গাছ তলায় লেজ নাড়াতে থাকা কালো কুকুরটা। উঠুন, তারপর উঠোন ছড়িয়ে ডোবা। ডাক পাখির ছানাগুলো একেবারে অদৃশ্য থেকে ডাকতেই থাকবে ''কুবকুব কুবকুব'' করে।
প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে ধরাতে গেলাম। হাত দুটো অসম্ভব কাঁপছে আমার। একটার পর একটা দেশলাই কাঠি নষ্ট হয়ে চলেছে। আচ্ছা, ঘরে ঢোকার আগে অপর্ণা কি তাকাবে একবার আমার দিকে পিছন ফিরে? ওই একটি বারের জন্য চোখের উপর চোখ .. মনের তৃপ্তি হবে আমার। অনেকদিন ধরে, অনেক বৃষ্টি আর বাতাস মাথায় নিয়ে, অনেক রাস্তা পার করে এসেছি আমি। আর টেনে নিয়ে যেতে পারছি না নিজেকে। বুকের ভেতরটা কাঁপতে থাকে আমার। এতদিনের সুখের স্মৃতিগুলো এবার ভুলে যেতে ইচ্ছে করে। এবার বোধহয় তোমার কাছে যাওয়ার সময় হয়েছে আমার।
|| পাঠক বন্ধুদের উদ্দেশ্যে ||
কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও?
তারি রথ নিত্য উধাও।
জাগিছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন
চক্রে পিষ্ট আধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন।
ওগো বন্ধু,
সেই ধাবমান কাল
জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল
তুলে নিল দ্রুতরথে
দু’সাহসী ভ্রমনের পথে
তোমা হতে বহু দূরে।
মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে
পার হয়ে আসিলাম
আজি নব প্রভাতের শিখর চুড়ায়;
রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়
আমার পুরানো নাম।
ফিরিবার পথ নাহি;
দূর হতে যদি দেখ চাহি
পারিবে না চিনিতে আমায়।
হে বন্ধু বিদায়।
কোনদিন কর্মহীন পূর্ণো অবকাশে
বসন্তবাতাসে
অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস,
ঝরা বকুলের কান্না ব্যাথিবে আকাশ,
সেইক্ষণে খুজে দেখো, কিছু মোর পিছে রহিল সে
তোমার প্রাণের প্রানে, বিস্মৃতি প্রাদোষে
হয়তো দিবে সে জ্যোতি,
হয়তো ধরিবে কভু নামহারা স্বপ্নে মুরতি।
তবু সে তো স্বপ্ন নয়,
সব চেয়ে সত্য মোর সেই মৃত্যুঞ্জয় –
সে আমার প্রেম।
তারে আমি রাখিয়া এলাম
অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশ্যে।
পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে
কালের যাত্রায়।
হে বন্ধু বিদায়।
তোমায় হয় নি কোন ক্ষতি।
মর্তের মৃত্তিকা মোর, তাই দিয়ে অমৃতমুরতি
যদি সৃষ্টি করে থাক তাহারি আরতি
হোক তবে সন্ধ্যা বেলা-
পূজার সে খেলা
ব্যাঘাত পাবে না মোর প্রত্যহের ম্লান স্পর্শ লেগে;
তৃষার্ত আবেগবেগে
ভ্রষ্ট্র নাহি হবে তার কোন ফুল নৈবদ্যের থালে।
তোমার মানস ভোজে সযত্নে সাজালে
যে ভাবরসের পাত্র বাণীর ত’ষায়
তার সাথে দিব না মিশায়ে
যা মোর ধূলির ধন, যা মোর চক্ষের জলে ভিজে।
আজও তুমি নিজে
হয়তো বা করিবে বচন
মোর স্মৃতিটুকু দিয়ে স্বপ্নবিষ্ট তোমার বচন
ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায়।
হে বন্ধু বিদায়।
মোর লাগি করিয় না শোক-
আমার রয়েছে কর্ম রয়েছে বিশ্বলোক।
মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই,
শুন্যেরে করিব পূর্ণো, এই ব্রত বহিব সদাই।
উ’কন্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে
সে ধন্য করিবে আমাকে।
শুক্লপখক হতে আনি
রজনী গন্ধার বৃন্তখানি
যে পারে সাজাতে
অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ রাতে
সে আমারে দেখিবারে পায়
অসীম ক্ষমায়
ভালমন্দ মিলায়ে সকলি,
এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।
তোমারে যা দিয়েছিনু তার
পেয়েছ নিশেষ অধিকার।
হেথা মোর তিলে তিলে দান,
করূন মুহূর্তগুলি গন্ডুষ ভরিয়া করে পান
হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম,
ওগো নিরূপম,
হে ঐশ্বর্যবান
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান,
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।
হে বন্ধু বিদায়।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বিদায় বন্ধুরা। ভবিষ্যতে আর দেখা হবে কিনা, সেটা সময় বলবে। বিদায় বেলায় অন্তত একটা তৃপ্তি নিয়ে যাচ্ছি এই ভেবে যে, আমার প্রত্যেকটি থ্রেডের পাশে সমাপ্ত এই শব্দটি লেখা রয়েছে। যাওয়ার আগে নিজের online status on করে দিয়ে গেলাম। তার কারণ, আমার অবর্তমানে কেউ যেন বলতে না পারে .. আমি চলে গিয়েও রয়ে গিয়েছি। ভালো থেকো তোমরা সবাই। আর এই ফোরামকে, বিশেষ করে বাংলা বিভাগটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভালো ভালো গল্প লিখতে থাকো।