15-10-2023, 05:56 PM
|| শুদ্ধিস্নান ||
লেখা :- আদর্শ মাইতি
" আমার মা বাবাকে ফেরত দাও, আমাদের ধান ফেরত দাও... " কথাগুলো কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বরে ভেসে এলো বছর সাতেকের মেয়েটার দিক থেকে।
উঠোনে ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে টকটকে লাল রঙের ময়লা একটা জামা পরে জমিদারের দিকে হাত বাড়িয়ে কথাগুলো বারবার আওড়াচ্ছে মেয়েটা।
" আমার মা বাবাকে ফেরত দাও, আমাদের ধান ফেরত দাও... আমার মা বাবাকে ফেরত দাও, আমাদের ধান ফেরত দাও... "
নীরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য তাঁর লাঠিয়ালকে জিজ্ঞাসা করলেন, " কে রে মেয়েটা ? তখন থেকে ঘ্যানর ঘ্যানর করছে। "
"বাবু এটাই ওই ভানু আর জবার মেয়ে" উত্তর দিল লাঠিয়াল।
কিছুক্ষণ কটমট করে মেয়েটাকে দেখে নিয়ে নীরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য তাঁর হিসেবরক্ষককে বললেন, "একটা জামা আর কিছু মিষ্টি দিয়ে মেয়েটাকে বিদায় করো।"
আদেশ পাওয়া মাত্রই জমিদারের একুশ বছরের বিশ্বস্ত ভৃত্যটি একবিন্দু সময় অপচয় না করে তড়িঘড়ি একটা নতুন আকাশী রংয়ের ফ্রক আর এক প্যাকেট মিষ্টি মেয়েটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজেই টেনে বাইরে নিয়ে এলেন। বললেন, "আর এই চত্বরে আসবিনা। তোর মা বাপ এখানে নেই, মা দুগ্গার কাছে চলে গেছে। সেখানে গিয়ে খোঁজ কর।" কথাটা শেষ করেই তিনি আবার উঠোনের ভিড়ের মাঝে ঢুকে পড়লেন। আজ গ্রামের মানুষদের মধ্যে নতুন শাড়ি, শাল, জামা, মিষ্টি ইত্যাদি বিলি করা হচ্ছে। এখন তাঁর অনেক কাজ, অযথা সময় নষ্ট করলে চলবেনা। এর মধ্যে এইসব উটকো ঝামেলায় যাতে জমিদারের ওপর আবার কোনো দাগ না পড়ে সেটাও তাঁকেই দেখতে হয়।
বাইরে দাঁড়িয়ে মেয়েটা কিছুক্ষণ ভিড়ের দিকে তাকিয়ে থেকে পিছু ফিরলো। লোকটা বলেছে ওর বাবা মা চলে গেছে মা দুগ্গার কাছে। ওকেও যেতে হবে। কিন্তু কোথায় পাবে মা দুগ্গাকে ? কোথায় তার বাড়ি ? কেমন দেখতে তাকে ?
ওর বাবা মা তো ওকে ছেড়ে কোথাও যায়না। তাহলে এইবার কেমন করে ওকে ফেলে রেখে পালিয়ে গেলো।
ওর অভিমান হলো খুব। ও যে কাল থেকে এই বাড়ি ওই বাড়িতে ভাত খেয়ে কেঁদে কেঁদে বেড়াচ্ছে তাতে কি মা বাবার কিছু এসে যায়না ?
এসব ভাবতে ভাবতে প্যাকেট থেকে বার করে দুটো মিষ্টি খেলো সে। ভীষণ জল তেষ্টা পেয়েছে এইবার। হাতটাও চিটচিট করছে। সামনেই বট পুকুর। কী সুন্দর জল। বট গাছের ছায়ায় জলটা নিশ্চই অনেক ঠান্ডা হয়ে আছে ! ভেবেই গলাটা আরও জল জল করে উঠলো। কিন্তু ও জানে, ওদের তো এই পুকুরে নাম বারণ। একবার ঘাটে এসে বসেছিল বলে ওর মা কি মারটাই না মেরেছিল ওকে। পরে অবশ্য আদরও করেছিল। কোলে নিয়ে হাঁসের ডিম সেদ্ধ করেও খাইয়েছিল সেদিন।
কিন্তু এখন এই তেষ্টায় সে জল পাবে কোথায় ? ওর মা জল আনতে যেত গ্রামের বাইরে মুচিদের পাড়ায়। সে তো এখনও অনেক দূর।
এমনসময় কেউ যেনো বললো, "এই নাও জল খাও।"
ও পিছনে ফিরে দেখলো কাদের একটা নতুন বউ ওর দিকে এক গ্লাস জল বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নতুন বউয়ের মুখে কী সুন্দর হাসি, সিঁথিতে টকটকে সিঁদুর, হয়ে নতুন সুতির শাড়ি।
নতুন বউ গ্লাসটা আরও একটু বাড়িয়ে দিলেন ওর দিকে। ও এইবার জল খেলো। আহ, কত্ত মিষ্টি ঠান্ডা জল।
এক চুমুকে জল শেষ করে গ্লাস ফেরত দিয়ে বললো সে জিজ্ঞাসা করলো, "নতুন বউ ! তোমার নাম কি মা দুগ্গা ?"
"না মা, আমি নলিনী। ওই যে ওই দূরের বাড়িতে থাকি। তুমি মা দুগ্গাকে খুঁজছো?"
" হ্যাঁ, ওই বাড়ির লোকটা বলেছে আমার মা বাবা নাকি তার কাছেই গেছে।"
নতুন বউ চুপ করে গেলো। তার চোখ ছলছল করে উঠলো। সে কোনরকমে গলার স্বর স্বাভাবিক করে বললো, "তোমার খিদে পেলে আমাদের বাড়িতে আসবে।"
এই বলে সে চলে গেলো। নতুন বউদের এসব নিয়ে কথা বলতে শুনলে বিপদ আছে।
তার লাল জামায় জলের বিন্দুগুলো মুছে নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো মেয়েটা। পরশু থেকে বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে। কেউ নেই। শুধু পোষা কুকুরটা আছে। তাই একটু কম ভয় লাগে।
..............
নীরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য তাঁর লোহার সিন্দুক খুলে বসলেন। গোটা সিন্দুক ভরে আছে সোনা, রূপার গহনা আর নোটের বান্ডিলে।
বছরে একদিন দানধ্যান করলে ভাবমূর্তিও বজায় থাকে আর কোষাগারে তেমন চাপও পড়েনা।
এইবার তিনি তাঁর আলমারি থেকে নতুন গামছা, ধুতি, গেঞ্জি আর সবচেয়ে প্রিয় পাঞ্জাবিটা বার করে নিলেন।
এখন বাজে রাত সাড়ে তিনটা। এখন তিনি স্নানে যাবেন বট পুকুরে। প্রতি বছর মহালয়ার দিন ভোর রাতে তিনি স্নানে যান ওই পুকুরেই। তারপর বট গাছের তলায় বাঁধানো চাতালে বসে বস্ত্র পরিধান করে বাড়ি আসেন। কিছুক্ষণ পর বাড়ির সামনে ভিড় জমে গ্রামবাসীর। এই ভিড় জমিদার বাবুর রেডিওতে মহালয়া শোনার ভিড়। এই ভিড় ভোরের শিশিরে মা কে আহ্বানের ভিড়। আজকের দিনটা বড়ই বিশেষ।
আর দেরি করলেন না তিনি। নতুন বস্ত্র কাঁধে ফেলে একহাতে ছড়ি আর একহাতে হ্যারিকেন নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন তিনি। মিনিট দশেকের মধ্যেই বট পুকুরের পাড়ে এসে উপস্থিত হলেন। এই পুকুর গ্রামের মানুষের জন্য প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন তাঁর প্রপিতামহ। তিনি নিজে অবশ্য এই পুকুর শুধুমাত্র খাজনা প্রদানকারী মানুষদের জন্য সীমাবদ্ধ রেখেছেন। যারা খাজনা দিতে পারেনা তারা এর জলস্পর্শ করার সুযোগও পায়না।
নতুন জামা কাপড় আর হ্যারিকেনটা বট গাছের তলায় চাতালে রেখে জলে নেমে এলেন তিনি। পরপর দশটা ডুব দিতে দিতে তাঁর গুরুমন্ত্র উচ্চারণ শেষ করলে তবেই তাঁর স্নান সম্পূর্ন হবে।
সবেমাত্র একটা ডুব দিয়ে উঠে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করবেন এমন সময় শুনতে পেলেন, " আমার মা বাবাকে ফেরত দাও, আমাদের ধান ফেরত দাও... "
পরের ডুব দিয়ে উঠতেই আবার, " আমার মা বাবাকে ফেরত দাও, আমাদের ধান ফেরত দাও... "
এমন করে পাঁচটা ডুব দেওয়ার পর বিরক্ত হয়ে মন্ত্রোচ্চারণ থামিয়ে উঠে এলেন তিনি। চাতালে রাখা হ্যারিকেন এর পাশে বসে মেয়েটা একই খ্যানখ্যানে সুরে একই কথা বলে চলেছে বারবার।
নীরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য আর মাথা ঠিক রাখতে পারলেন না। রাগে তাঁর চোখ লাল হয়ে উঠলো। ভেজা কাপড়ে উঠে এসেই সজোরে মেয়েটার চুলের মুঠি ধরে বললেন, "মা বাবাকে চাই, দাঁড়া তোকে মা বাপের কাছে পাঠাচ্ছি। শালা বছর বছর খাজনা দিবিনা, জমি চাষ করবি, বসে বসে খাবি ! চাবকে তোর বাপের ছাল তুলে নিয়েছি রে মাগী। আর তোর মা ! শালীর গায়ে এমন কালি লাগিয়েছি না, মাগী নিজেই লটকে গেছে শ্মশানের গাছে। যা দেখে আয়, শেয়াল কুকুরে ছিঁড়ে খেলো এতক্ষণে।"
ভট্টাচাজ্জী মশাইয়ের রাগ এখন সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করে গেছে। এইবার চুল মুঠি ধরে মেয়েটার মাথাটাকে চাতালে ঠুকে দিলেন সজোরে। সঙ্গে সঙ্গে ঠং করে আওয়াজ হল। যেমন হয় লোহায় লোহায় ধাক্কা খেলে। জমিদারের বুকটা কেঁপে উঠলো। কিন্তু আবার সেই রাগ জাহির করতে পরপর পাঁচবার মেয়েটার মাথাটা ঠুকে দিলেন চাতালে। আর পরপর পাঁচবারই ঠং, ঠং করে ভোর রাতের শীতল ভারী হওয়া কেঁপে উঠলো।
জমিদার বিস্ফারিত চোখে দেখলেন মেয়েটা হাসছে !
বড়ো বড়ো সাদা সাদা চোখ বার করে হাসছে ! ধবধবে সাদা দাঁতের ফাঁকে লাল টকটকে জিভ বার করে সে হাসছে !
এ হাসি যে কোনো জমিদারি রক্ত শীতল করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। নীরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য আর হাত চালাতে পারলেন না। তাঁর সমস্ত শরীর যেন পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে আসছে ধীরে ধীরে।
তখনই তাঁর চোখে পড়লো বট গাছের পিছনে দুটো উজ্জ্বল চোখ। হিংস্র, জ্বলন্ত দুটো চোখ।
অবয়বটা এগিয়ে আসতেই দেখা গেলো তার বিরাট চেহারা, স্ব দন্ত আর লম্বা লম্বা দুলতে থাকা কেশর।
নীরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য তাঁর যৌবনে বাঘ শিকার করেছেন এক সময়। কিন্তু এই জন্তু শিকার করার মতো নয়।
অতশত ভাববার আগেই, চোখের পলক ফেলবার আগেই জন্তুটা ঝাঁপিয়ে পড়লো তাঁর ঘাড়ের ওপর। বট পুকুরের চাতাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া রক্ত রাঙিয়ে দিল পুকুরের শীতল জল।
এমন বিভীষিকাময় রাতে গ্রামের একটা কুঁড়ে ঘরে ঘুমোচ্ছিল একটা একা মেয়ে। কাঁদতে কাঁদতে বাইরে কারুর অপেক্ষা করতে করতে শিউলি গাছের তলায় তার পোষা কুকুরের ওপর মাথা রেখে শুয়ে আছে সে। তার গায়ে আকাশী রংয়ের ফ্রক। সেই ফ্রক ঢেকে যাচ্ছে ভোরের খসে পড়া শিউলি ফুলের চাদরে। কুঁড়ে ঘরের দুয়ারে যেন আস্ত একটা আকাশ নেমে এসেছে। ভোরের ঠান্ডা হাওয়া মাঝে মধ্যে ঘুম ভাঙিয়ে দিচ্ছে তার। সে ঘুম জড়ানো আধবোজা চোখে দেখতে পাচ্ছে সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। নতুন বউয়ের মতো, নতুন শাড়ি, ঘন কালো চুল বাতাসে উড়ছে। এই বুঝি মা দুগ্গা নিতে এলো তাকে, তার মা বাবার কাছে।
|| সমাপ্ত ||