30-09-2023, 08:41 PM
|| বাসা ||
কলমে :- পিয়ালী ঘোষ
অপরাজিতা আরও ভালো করে দেখবার জন্য চশমা পরলেন। মনোযোগ দিয়ে দেখলেন, হাসপাতাল এর বালিশ এর উপর একটি লম্বা লাল রঙের সরু, মিহি, দাগ। প্রথমে বালিশের দাগ ভেবে গুরুত্ব দেন নি, কিন্তু চশমা পরে দেখতে পেলেন দাগটি খুব আস্তে সরে সরে যাচ্ছে। আতঙ্কিত অপরাজিতা দেবী ওয়ার্ড বয়কে বেল বাজিয়ে ডাকলেন এবং দাগটি দেখালেন। সেও খুব অবাক হয়ে বললো, যে কিছুই জানেনা, এরকম প্রথম বার দেখেছে, সে বালিশের ওয়াড় আর বেড শীট বদলে দিচ্ছে এখুনি। তাড়াতাড়ি নতুন শীট আর ওয়াড় সমেত গায়ে চাপা দেওয়ার চাদর আর কম্বলটিও সে বদলে দিলো। দেখতে দেখতে মল্লিকার ফিরে আসবার সময় হয়ে গেল।
..
দেবু আর ওর বাবা,পালিতবাবু, এতক্ষণ স্ক্যান রুমের বাইরে ছিলেন, এবার মল্লিকার স্ট্রেচার এর সাথে রুমের দিকের পথ ধরলেন। রুমে ফিরে মল্লিকাকে বালিশে শুইয়ে দিলো নার্স এবং অ্যাটেন্ডেন্ট মিলে। কিছুক্ষণ পরে একজন টেকনিশিয়ান দৌড়ে এলো স্ক্যান প্লেটস গুলো নিয়ে ড:পাটির এর কাছে। প্লেটসগুলো ভালো করে দেখালো, ডাক্তারকে। উনিও সাথে সাথে ড: ব্যানার্জীকে কল করলেন আর ওনার রুমে আসতে বললেন। দুই স্পেশালিস্ট এ মিলে হতভম্ব হয়ে গভীর আলোচনায় বসলেন। আলোচনা যত বাড়তে থাকলো, ততই ওনাদের মুখের ভাব গম্ভীর হতে থাকলো। টেকনিশিয়ান রিপোর্টও দিয়েছে সাথে, সেটা দেখে ওনারা ঘন ঘন মাথা নাড়তে থাকলেন।
..
পালিতবাবু বারবার অপরাজিতাকে বলতে থাকলেন, বাড়ি গিয়ে একটু রেস্ট নিয়ে আসবার কথা, কিন্তু অপরাজিতা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। মেয়ের অ্যানেস্থেসিয়ার রেশ না কাটা অবধি কোথাও যাবেন না বলে দিলেন। এবার অপরাজিতা খুব ভালো করে গিয়ে মল্লিকার মাথার কাছে বসলেন, আর মোবাইল এর টর্চটা মল্লিকার কান এর কাছ থেকে চুল এর ভিতর অবধি ফেলে ধরলেন। কিছুই চোখে পড়লো না। তাই অন্যদিকে গিয়েও উনি একইভাবে দেখার চেষ্টা করলেন। দেবু আর ওর বাবা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন এভাবে উনি কি দেখছেন? অপরাজিতা জবাব না দিয়ে দেবুকে ডাকলেন, "এই দেবু এদিকে আয় তো, দেখ তো, আমি যা দেখছি তুইও তাই দেখতে পাচ্ছিস কি না?" ..
দেবু তাড়াতাড়ি অপরাজিতার দিকে এগিয়ে গেল, অপরাজিতা উঠে পড়লেন আর দেবু ওনার মোবাইলটা নিয়ে মল্লিকার কানের পাশে আলো ফেলে, ভালো করে দেখে বলে, "হ্যাঁ কাকিমা, দেখতে পাচ্ছি, খুব মিহি একটা সরু লাল দাগ ওর ঘাড়ের কাছ থেকে কান অবধি চলে গিয়েছে, কানের গর্তের ভিতর, মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে সেটা যেন খুব আস্তে সরে সরে যাচ্ছে, কিসের দাগ ঠিক বুঝতে পারছিনা।"
..
অপরাজিতা বললেন, "কি জানি, কিছুক্ষণ আগে এই একই দাগ আমি ওর বালিশের ওয়াড় এ দেখতে পেয়েছিলাম। খুব রাগ করে ওয়ার্ড বয়কে বকা দিয়ে সব বদলিয়েছি, বেড শীট কম্বল অবধি। কিন্তু এই দাগটা ওর গায়ে আছে সেটা আগে দেখিনি। ডাক্তারকে বলতে হবে বুঝলি ?" দেবুর বাবাও চিন্তিত হয়ে বললেন, "দিদি, আপনি শান্ত হন, একটু পরেই তো স্ক্যান রিপোর্টগুলো এসে যাবে আর ডাক্তাররা নিজেরাই আসবেন এই রুমে, তখন সব কথা হবে না হয়।"
..
বলতে বলতেই ড: ব্যানার্জি আর ড: পাটির একজন নার্স এর সাথে এসে ঢুকলেন রুমে। নার্সকে ড্রিপ বদলে দিতে বলে, তাতে মাইল্ড ঘুমের ইঞ্জেকশান পুশ করতে বললেন। মল্লিকা একটু একটু হুঁশ এলেই, উফফ, আঃআঃ করে ব্যাথার অভিব্যক্তি করছে। তাই ওকে আবার স্ট্র্যাপ করে রাখা হয়েছে। দুই ডাক্তার তখন মল্লিকার মাকে আর পালিতবাবুর সাথে আলাদা করে কথা বলবেন, তাই জানালেন। দেবুকে মল্লিকার পাশে থাকতে আর কড়া নজরদারি করতে বললেন ওনারা। অপরাজিতা দুইজন ডাক্তারকেই জানালেন ওনারা কিছু দেখেছেন আর সেটা ওনারা একবার দুই ডাক্তারকে দেখাতে ইচ্ছুক। দুইজন ডাক্তার অপরাজিতার অনুরোধে মল্লিকার কানের বরাবর লাল দাগটা দেখলেন আর কিছু না বলে অপরাজিতা আর দেবুর বাবাকে নিয়ে আলোচনা করতে চলে গেলেন । নার্সকে নির্দেশ দিয়ে গেলেন যে মল্লিকাকে যেন তৎক্ষণাৎ স্যানিটাইজ করে দেওয়া হয়।
..
সবাই বসলে, কথা শুরু হল। অপরাজিতা ভয়ে, পাংশু মুখে বসেছিলেন, দেখে, ড: ব্যানার্জি বললেন, "আপনাকে দিয়েই শুরু করবো, যেহেতু আপনি মল্লিকার মা। আপনাকে শক্ত হতে হবে আর ঘাবড়ে গেলে বা হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। ট্রিটমেন্ট বহুদিন চলবে। কিওর হবে, কিন্তু শুধু ইঞ্জেকশান বা ট্যাবলেট এ না, সার্জারিও করতে হবে।"
.
ড: পাটির ড: ব্যানার্জির কথার সূত্র ধরে বললেন, "বেশ কিছু টাকার ব্যাপার আছে। আমরা যেহেতু মিস্টার পালিতকে অনেকদিন ধরে চিনি, উনি আমাদের ট্রাস্ট এর প্যানেল এ আছেন, তাই ওনার খাতিরে অনেকটাই ছাড় দেব সার্জারিতে, তবে ওষুধপত্রের টাকা আপনার পুরোটাই লাগবে। আমরা লিস্ট লিখে দিলে আপনি বাইরে থেকেও কিনে দিতে পারেন ডিস্কাউন্টেড রেট এ। আর যেহেতু ব্যাপারটা অনেকদিন এর হয়ে গিয়েছে, আমরা আগামীকাল থেকেই মল্লিকার ট্রিটমেন্ট শুরু করতে চাই।"
..
মল্লিকার মা অধ্যৈর্য্য হয়ে বললেন, "প্লিজ, আমার এবার আতঙ্ক হচ্ছে। কি হয়েছে আমার মেয়ের একটু বলবেন ? আমি যে আর টেনশন নিতে পারছি না।"
পালিতবাবুও বললেন, "হ্যাঁ ডাক্তার একটু তাড়াতাড়ি বলুন না।"
.
ডাক্তার পাটির বললেন, "দেখুন, খুব কমন না হলেও, এইরকম কেস খুব একটা আনকমনও নয়। তবে নর্মালি আমরা ভাবতে পারিনা এরকম হয় বলে, তাই অনেকেই জানেনা।" অপরাজিতা ওনাকে থামিয়ে দিয়ে একটু বিরক্ত হয়েই বললেন, "কি জানেনা? কি আনকমন?"
-- "আপনার মেয়ের মাথাতে পিঁপড়ের বাসা হয়েছে, ম্যাম। আর ওরা.. "
-- "কি হয়েছে? কি হয়েছে বললেন?," অপরাজিতা চেঁচিয়ে ওঠেন।
-- "দেখুন, প্লিজ শান্ত হন, এই নিন, জল খান। আপনি ঠিকই শুনেছেন, আপনার মেয়ের মাথাতে পিঁপড়ের বাসা হয়েছে। ওই যে লাল দাগটা দেখছেন, ওটা একদম এক দুদিনের জন্মানো পিঁপড়ের বাচ্চা, যা এখন ওর শরীর থেকে বেরিয়েছে। তাই ওকে রিপিটেডলি স্যানিটাইজ করতে হবে আর মেডিকেটেড স্প্রে করে রাখতে হবে। তাতে সম্পূর্ণ মুক্ত না হলেও, সার্জারির পরে মুক্ত হবে এই সমস্যার থেকে, সেটা বলতে পারি। আসল ঘাঁটিটা মনে হয় ওর চুল এর মধ্যেই, কিন্তু আরো অনেক বড় কলোনি ওর ব্রেন এর মধ্যে বাসা করেছে। সারাক্ষণ ওর মাথার ভিতরে হাঁটাচলা করছে আর মাঝে মাঝেই কুরে কুরে সেলস আর টিস্যু গুলো খাচ্ছে। বলতে পারেন এটাই ওদের খাদ্য হয়েছে এখন। ওর এই মাথা ব্যাথা আর মাথার ভিতরে সড়সড় করার কারণ এটাই। যেহেতু এতো মাস কেটে গিয়েছে, ওরা রেপ্লিকেট করতে করতে অগুন্তি হয়ে গিয়েছে। অপারেশন করতে হলে মাথা ন্যাড়া করে ফেলতে হবে। অলরেডি ৬ মাস হয়ে গিয়েছে, আর দেরি করা ঠিক হবেনা, ট্রিটমেন্ট তাড়াতাড়ি করতে হবে।"
অপরাজিতা ও পালিতবাবুর মুখে কথা সরেনা। ওনারা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। ঠিক কি হয়েছে সেটা বুঝে উঠতেই ওনাদের সময় লেগে যায়।
..
ডাক্তার পাটির স্ক্যান প্লেটসগুলো ওনাদের দেখান। সাথে বুঝিয়ে বলতে থাকেন, "ব্রেন এর অনেকখানি জুড়ে তৈরী হয়েছে পিঁপড়ের বাসা। ভাগ্য ভালো যে সিস্ট ফর্ম করেনি। তবে ওর সার্জারিটা লাগবে, কারণ ব্রেন এর যে জায়গায় ওরা ঘাঁটি গেড়েছে, সেখানে হয়তো ডিম্ থাকতে পারে, সে ডিম্ রে দিয়ে শেষ করা যায়, কিন্তু তাতেও প্রচুর সেল আর টিস্যু পুড়ে যাবে, এবং সম্পূর্ণ নির্মূল হবে কি না এখনই বলা যাচ্ছেনা। তাই ওখানটা বাদ দিতেই হবে। ফাইনাল ট্রিটমেন্ট এর স্টেজ এ অর্থাৎ কিওর হয়ে যাওয়ার পরেও, ওর কিছু ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটিজ আর স্পিচ ইত্যাদির মধ্যে তফাৎ হতে পারে যা জীবনভর নাও সারতে পারে। আর..."
.. ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে শুনছিলেন অপরাজিতা, তার মাথাতে কিছুই ঢুকছিল না। অবশেষে আর নিতে পারলেন না, উনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন। ওনাকে সুস্থ করতে করতে ড: ব্যানার্জি পালিতবাবুকে বললেন, অপরাজিতাকে বোঝাতে আর ধাতস্থ করতে। প্রয়োজনে, পরিবারের কোনো একজন মহিলাকে ডেকে নিতে।
...
অপরাজিতার জ্ঞান ফিরতে ওনাকে রুমে পৌঁছে দিয়ে, পালিতবাবু কল করে তিনটে হট কফি আনতে বললেন রুমে। অপরাজিতা ছলছল চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন, ওদিকে দেবু ভয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছেনা। পালিতবাবু কফি শেষ করে দেবুকে নিয়ে বাইরে গেলেন আর পুরো ব্যাপারটা খুলে বললেন। দেবপ্রিয়া ভয়ে-শকে চেঁচিয়ে উঠলো, অনেক কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে, এই প্রথম, এতদিনে, বন্ধুর কষ্টে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। এরপর উনি দেবপ্রিয়ার মাকে ফোন করলেন আর পুরো ব্যাপারটা যে অনেক গুরুতর সেটা বোঝাতে চেষ্টা করলেন। মিস্টার পালিত বললেন, "আমি এখুনি বাড়ি পৌঁছে যাবো, বিস্তারিত বাড়ি গিয়ে বলবো। তুমি আমাদের জন্য কিছু রান্না করেছো তো? একটু বসো আর নিজের কিছু জামাকাপড় গুছিয়ে রাখো। আর দেবু আমার সাথে আসছে বাড়িতে।" দেবুর মা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, মিস্টার পালিত থামিয়ে দিয়ে ফোনটা রেখে দিলেন।
..
অপরাজিতার থেকে বিদায় নিয়ে ওনারা বাড়িতে ফিরে এলেন। স্নান খাওয়া সেরে পালিতবাবু নিজের স্ত্রীকে সমস্ত কথা বিস্তারিত বললেন। জয়া কিছুক্ষণ বিশ্বাস করতে পারলেন না, তারপর, বলেন, "কিভাবে হল? মানে এরকম কিভাবে হতে পারে?? শরীরে পিঁপড়ে ঢুকলে টের পাওয়া যায় না বুঝি? কখনো কি মল্লিকাকে কামড়ায়নি?"
-- "যে পিঁপড়েগুলো ঢুকেছে, সেগুলো ঢোকার সময় ছোট ছিল, তাই মল্লিকা কান কুটকুট করলে চুলকেছে হয়তো, কিন্তু বুঝতে পারেনি আসল ব্যাপারটা কি। বা ঘুমের মধ্যে হয়তো বুঝতেই পারেনি কখন পিঁপড়েগুলো ঢুকে গিয়েছে... আর হ্যাঁ, কামড়েছে, অজস্র বার, অনেক পিঁপড়ে কামড়েছে। তখন মল্লিকার মাথা সাংঘাতিক ব্যাথায় ছিঁড়ে গেছে। ও বারবার মাথা বা গলা কেটে ফেলতে চেয়েছে, নাহলে ছুরি দিয়ে মাথাটা খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলেছে। ওর কষ্টটা কি তুমি বুঝতে পারছো জয়া?"
-- "থামো.. থামো, আমি আর শুনতে পারছিনা। আজ যে রাত্রিবেলা ওদের একলা ছেড়ে চলে এলে কোনো ক্ষতি হবেনা?" জয়া জিজ্ঞেস করলেন।
-- "আগামীকাল মেয়েটার মাথার অপারেশন, আমি তোমাকে নিতে এসেছি কেবলমাত্র। আজ রাত্রে আমরা দুজনে ওখানে থাকবো। দেবু ঘুমিয়ে নিয়ে সকালে আসবে হাসপাতালে। সার্জারি সকাল ৯টায়, তার আগেই দেবুকে কিছু জলখাবার নিয়ে পৌঁছে যেতে হবে।" কিছুক্ষন পর, ওনারা দেবপ্রিয়াকে দরজা বন্ধ করতে বলে, সবটা বুঝিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন। হাসপাতালে যখন পৌঁছালেন, তখন বাজছে রাত ১১টা। ওনারা 'ভিসিটর'স লাউঞ্জ' এ বসে অপেক্ষা করতে থাকলেন। জয়া দুটো রুটি আর তরকারি এনেছিলেন, অনেক কষ্টে অপরাজিতাকে একটা রুটি খাওয়াতে পারলেন। একদিনেই অপরাজিতার চোখ মুখ বসে গিয়েছে, ক্লান্তি, উদ্বেগ আর চিন্তা মিলিয়ে চোখমুখের সাংঘাতিক অবস্থা হয়েছে। ঘুমের মধ্যেও মল্লিকার শরীর ব্যাথায় কেঁপে উঠছে থেকে থেকেই। কেমন নেতিয়ে পড়ে রয়েছে মেয়েটা। জয়া ওর দিকে তাকাতেও পারছিলেন না।
..
পরেরদিন সকাল ৮টায় দেবপ্রিয়াও জলখাবার কিনে নিয়ে পৌঁছে গেলো হাসপাতালে। খবর পেয়ে,অপরাজিতার বাড়ির কিছু আত্মীয়রাও এসেছেন। কিন্তু এতজনকে ভিতরে অ্যালাউ করেনি। তারা বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। তারা অদ্ভুত এই অসুখ নিয়ে আলোচনা করছেন চাপা স্বরে। যদিও রক্ত লাগবেনা, তবুও স্ট্যান্ডবাই হিসাবে মল্লিকার ব্লাড গ্রুপ মিলিয়ে ওর নিকটতম দুই মাসতুতো ভাইকে রাখা হয়েছে। সার্জারি ঠিক ৯টায় শুরু হয়ে গিয়েছে। মল্লিকার মাথায় যেটুকু চুল অবশিষ্ট ছিল, তা ডাক্তারের নির্দেশে অপারেশন থিয়েটার এই কেটে একদম প্লাষ্টিক ব্যাগ এ করে নিয়ে গিয়ে ইলেকট্রিক মেশিনে এ জ্বালিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ডাক্তাররা। ক্ষত সেরে গেলেও, ন্যাড়া মাথায় ক্ষত এর দাগগুলো স্পষ্ট আর জায়গায় জায়গায় পিঁপড়ে কামড়ানোর ফলে চামড়া কুরে কুরে তুলে দিয়েছে, ঠিক যেন খুশকির ফ্লেক্স মনে হচ্ছে। ওনারা মাথাটাকে ডিসিনফেক্ট করলেন প্রথমে। তারপর সার্জারি শুরু হল। মাথার ভিতরে ইনস্ট্রুমেন্ট ঢোকাতেই, স্ক্রিন এ ভিতরের অবস্থা দেখে নার্স আর সহযোগী ডাক্তার যতজন ছিলেন, চমকে উঠলেন। একটা পুরো কলোনি তৈরী করেছে পিঁপড়েরা। তারা নড়ছে, যাতায়াত করছে। যে জায়গায় বেশি গভীর বাসা ছিল, ব্রেন এর সেই অংশটা নিপুন ভাবে সরিয়ে দিলেন নিউরোসার্জন ড:পাটির। সকাল ৯টা থেকে ১২টা বাজলো অপারেশন শেষ হতে।
...
অবশেষে ড: পাটির স্টিচ করে দিলেন মল্লিকার স্ক্যাল্প। বাকি ট্রিটমেন্ট ইঞ্জেকশান আর ওষুধে হবে। মল্লিকাকে রিকভারি রুমেই রাখা হবে আপাতত ৪৮ ঘন্টার মত, অবজারভেশন এ রাখতে হবে। তারপর বেড এ দেবেন। ড: পাটির বাইরে এসে মল্লিকার উদ্বিগ্ন পরিজনদের অপারেশন সফল হওয়ার খবর দিলেন। অপরাজিতা একটু ধাতস্থ হলেন এবং এক কাপ চা আর দেবুর আনা জলখাবার খাবেন জানালেন। সবাই একটু নিশ্চিন্ত হলেও, অপরাজিতা বুঝেছেন সামনে বিশাল লড়াইয়ের দিন আসতে চলেছে। তখনও মেয়েকে চোখে দেখেননি তাই ওনার উদ্বিগ্নতা কাটেনি।
..
৬ ঘন্টা পরে মল্লিকার জ্ঞান ফিরলো। ড: পাটির এসে মল্লিকা-মল্লিকা করে ডাকলেন ও মল্লিকার হাসিমুখের সাড়া পেয়ে, বুঝলেন যে মল্লিকা জ্ঞানে ফিরছে। অপরাজিতা আগে দেখতে গেলেন মেয়েকে। ২মিনিটের বেশি সময় দেয়না কাউকেই। মল্লিকাকে হাফ শোয়া করে বসিয়ে রাখা হয়েছে, যেভাবে সচরাচর ব্রেন সার্জারির পরে পেশেন্টকে রাখা হয়। মাথাতে হাত দেওয়াও বারণ। মল্লিকা ওনাকে দেখে এক গাল হাসলো। কিন্তু হাতে পায়ে যথারীতি স্ট্র্যাপিং করাই আছে। মেয়েকে দেখে অপরাজিতার চোখের জল বাঁধ মানলোনা কিছুতেই। ওনার পরে দেবপ্রিয়া ভিতরে গিয়ে মল্লিকার হাত ধরে চুপ করে তাকিয়ে রইলো। অদ্ভুত দেখতে লাগছে, ন্যাড়া মাথা আর মাথায় অনেক ওষুধ লাগানো আর মাথার পিছন থেকে নিয়ে উপর অবধি ড্রেসিং করে টেপ দিয়ে ঢাকা। মল্লিকাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে, আধ শোয়া অবস্থায় মল্লিকা বসে আছে। দেবপ্রিয়া দুই বার মল্লিকা বলে ডাকলো। ওষুধের প্রভাবে মল্লিকা ঘুমিয়ে পড়েছে, দেবপ্রিয়াকে দেখতেও পারলোনা। দেবুর মা আর বাবা কিছুতেই ভিতরে যেতে রাজি হলেন না। ওনারা মল্লিকাকে এইভাবে দেখতে চান না। দেবপ্রিয়া বাইরে এসে নিজের বাবার কাঁধে মাথা রেখে কেঁদেই ফেললো। দিনেরবেলায় আত্মীয়রা একে একে যে যার বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। তারা এই সময় কেউই ছিলেন না, কিন্তু ফোন করে ক্রমাগত দেবু আর জয়ার থেকে খোঁজ নিচ্ছিলেন, কারণ অপরাজিতা কথা বলার মতন অবস্থায় ছিলেন না।
..
পালিতবাবু আর জয়া রাত ৮টার সময় নিজেদের বাড়ি রওনা দিলেন। অপরাজিতা কিছুতেই বাড়ি ফিরতে রাজি হলেন না। বাড়ি যাওয়ার আগে, হাসপাতালের ক্যান্টিন থেকে পালিতবাবু, দেবু আর অপরাজিতার জন্য খাবার কিনে এনে দিয়ে গেলেন। দেবু আজ রাতটা অপরাজিতার সাথে থাকবে এখানে। রুমে একজন অ্যাটেন্ডেন্ট এর থাকার ব্যবস্থা আছে কিন্তু খাবার হাসপাতালের ক্যান্টিন থেকেই খেতে হয়। দেবপ্রিয়া বাইরে ভিসিটর'স লাউঞ্জ এ বসে খেয়ে নিলো। অসম্ভব ক্লান্ত অপরাজিতা, রুমেতে, মেয়ের ফাঁকা বেড এর পাশের সোফাটায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। দেবপ্রিয়া সারা রাত ওনাদের দুজনকেই মাঝে মাঝে গিয়ে নজরদারি করে আসলো।
...
নির্বিঘ্নে কেটে গেল ৪৮ ঘন্টা। মল্লিকাকে ওর রুম এ শিফট করা হলো। সকালে একটু চা খেয়েছেন অপরাজিতা। পালিতবাবু নিজের মেয়েকে ফোন করে সকালেই মল্লিকার আর অপরাজিতার খোঁজ নিয়েছেন আর জলখাবার আর জয়াকে নিয়ে আসছেন সেটা জানিয়েছেন। মল্লিকাকে বেড এ দেখে অপরাজিতা শান্তি পেলেন। ওদিকে দেবপ্রিয়ার বাবা মা এসে পৌঁছালেন আর ড: পাটিরও একসাথে রুমে এসে ঢুকলেন। সব ডিটেলস নার্স এর থেকে জেনে নিয়ে বলেন, "ওষুধের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। ওর বডি রেস্পন্ড করছে। তাড়াতাড়িই রিকভার হয়ে যাবে, চিন্তা করবেন না। তবে সম্পূর্ণ জ্ঞান না ফিরলে ওর কণ্ডিশন কেমন আছে বোঝা যাবেনা। আর তিন সপ্তাহ পর সেলাই শুকিয়ে এলে, ওর রেডিয়েশন শুরু করবো, তবে যতদিন না নির্মূল হচ্ছে ওর ইচিং থাকবে আর সেখানেই আমাদের সাবধানে থাকতে হবে। ও যেন এখন কাঁচা স্টিচ এ যেন হাত না দেয়, একদম চুলকাবেনা। যদিও আমরা কিছুটা ইচিং ইফেক্ট কমাবার ওষুধ দিয়েছি, তবে মাথা ব্যাথা আর ইচিং অনেকদিন থাকবে এখন, কারণ পিঁপড়েগুলো এখনো সম্পূর্ণ রূপে মারা যায়নি, প্রচুরসংখ্যক পিঁপড়ে এখনো বেঁচে, তারা পালাবার চেষ্টাও করছে, যে কারণে খুব অ্যাকটিভিটি বেড়ে যাবে। ওর মাথাতে এখন একটা বিশাল ক্যাওস বা বিশৃঙ্খলা চলছে। আপাতত সময়ের উপর ভরসা করতে হবে।"
...
পালিতবাবু অফিস এ যাবেন তাই ওখান থেকেই বেরিয়ে গেলেন। জয়া, দেবপ্রিয়া আর অপরাজিতা রুমের ভিতরে বসে রইলেন। মল্লিকা ঘুমাচ্ছে দেখে, অপরাজিতাকে অনেক বুঝিয়ে, একটুপরেই দেবপ্রিয়া একটা উবার বুক করে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো। ওনার এবার ঠিক করে একটু ঘুমানো দরকার, নাহলে আগামীদিনের ধকল টানতে পারবেন না। অপরাজিতার এখন অনেক কাজ। পুরো বাড়ি পেস্ট কন্ট্রোল করতে হবে, মল্লিকার বিছানা ফেলে দিয়ে নতুন বিছানা আর খাট এর অর্ডার দিতে হবে। আরও অনেক অনেক কাজ আছে, তাই বাড়ি যাওয়াটা দরকার ছিল।
..
ওদিকে দেবু নিজের মায়ের সাথে রুমের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে, হাতলটা ধরে, দরজা অল্প ফাঁক রেখে কথা বলছিলো, আর মাঝে মাঝেই চোখের জল মুছছিলো, এই ভেবেই, যে কতটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল ড: যামিনী দাস এর কাছে মল্লিকাকে নিয়ে যাওয়া। জয়াও মেয়েকে বোঝাচ্ছিলেন যে সে তো কোনো দোষ করেনি, ভালো ভেবেই সাহায্য করতে গিয়েছিলো। আর এরকম কিছু যে হয়, সেটাই তো কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। ক্রমে ক্রমে দুজনেই কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
..
ওদিকে রুমের ভিতর মল্লিকা চোখ খুললো, আসে পাশে ভালো করে দেখলো, কিছুই চিনতে পারলো না। কেউ কথা বলছে খুব কাছেই, কিন্তু তাদের দেখতে পাচ্ছেনা মল্লিকা। চোখ দুটো কচলিয়ে নিলো। কিন্তু কি আবছা আবছা সব দেখা যাচ্ছে। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেনা কেন? সে কে? এখানে কোথায় আছে? ভালো করে বুঝতে গিয়ে নিজের ড্রিপযুক্ত হাত তুলে দেখলো। কিছু বুঝতে পারলো না। একটা হালকা জ্বালা হচ্ছে মাথার উপরে। মল্লিকা আসতে আসতে হাত তুলে মাথার উপরে রাখলো। কাপড় দিয়ে বাঁধা রয়েছে মাথা। এদিকে মাথাতে একটা যন্ত্রনা, জ্বালা আর অস্বস্তি বেড়েই চলেছে। কিছু বুঝতে পারছেনা সে। কাউকে ডাকবে কি? জোর করে মল্লিকা চেঁচিয়ে উঠলো, "শুনুন, কে আছেন?" কিন্তু আশ্চর্য্য, ঘড়ঘড় শব্দ হল শুধু, গলা দিয়ে এক ফোঁটা আওয়াজ বেরুলো না। মরিয়া হয়ে, মল্লিকা বারবার চেষ্টা করলো, কিন্তু স্তব্ধতা ছাড়া কিছুই বের হলো না গলা দিয়ে। চেষ্টা করলো হাত নাড়তে, কিন্তু স্ট্র্যাপে বাঁধা থাকায়, হাত দুটো নাড়তে পারলো না। অপারেশন এর ফলে মল্লিকার গলার স্বর আর স্মৃতির বেশ কিছুটা হারিয়ে গিয়েছে। ক্ষণিকের তরে অপারেশন এর পরপর স্মৃতি কিছুটা ফ্ল্যাশ করলেও, পরে সেটা বেমালুম চেপে গিয়েছে। সে চিনতেই পারছেনা নিজেকে বা হাসপাতাল এর এই রুমটা। মনে করতে পারছেনা কেন সে এখানে আছে ...
..
এদিকে মাথার জ্বালাযন্ত্রণা বেড়েই চলেছে। চুলকানিও থামছেনা। আর নেওয়া যাচ্ছেনা। মাথার পিছনে ঘাড়ের কাছে একটা কিছু হয়েছে মনে হয়। মল্লিকা অনেকটা জোর লাগিয়ে ইলাস্টিক স্ট্র্যাপ থেকে ডান হাতটা বের করে ফেললো। ওই হাতটি, ক্যানুলা আছে বলে, খুব শক্ত করে বাঁধা হয়নি। হাতটা অনায়াসে বেরিয়ে আসতেই মল্লিকা মাথার উপরে হাত দিলো। আরে, এখানে তো পট্টি বাঁধা ! কেন? কি হয়েছে আমার? এটা কার বাড়ি? আমি নিজেই খুঁজে নেবো, আগে হাতের এই ছুঁচ খুলে ফেলি।" মল্লিকা লিকুইড অ্যান্টিবায়োটিক এর বোতলের ড্রিপটা ক্যানুলা থেকে সরিয়ে দিলো। তারপর ক্যানুলাটা এক টানে খুলে ফেললো। হাত থেকে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এলো। মল্লিকার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই, সেই ব্যাথা অনুভব করার মতন তার ক্ষমতা নেই তখন, কারণ তার মাথা ব্যাথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে আর চুলকানিতে টেকা যাচ্ছেনা। মল্লিকা দুই হাত দিয়ে ব্যান্ডেজ টেনে খুলে ফেললো, ঘাড়ের কাছে করা সদ্য কাঁচা সেলাই ধরে জোরে জোরে চুলকাতে থাকলো। রক্তাক্ত কাণ্ড হলেও মল্লিকা কিছুতেই চুলকানি থামাতে পারছেনা। ক্যানুলার ছুঁচ তুলে খুবলে খুবলে চুলকাতে থাকে মল্লিকা, সাথে প্রচন্ড ব্যাথায় অব্যক্ত চিৎকার করতে থাকে, কিন্তু গলার আওয়াজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, সেই চিৎকার গলার ভিতরেই চাপা পড়ে থেকে যায়। দেখতে দেখতে মল্লিকার স্ক্যাল্পের চামড়া সেলাইয়ের জায়গা থেকে আলাদা হয়ে দুই ধারে ঝুলতে থাকে।
..
সমাপ্তি
======
খাটের ধারে, রক্তাক্ত মল্লিকা, বীভৎস অবস্থায়, স্থানু হয়ে বসে আছে। বাইরে থেকে, দরজা খুলে মল্লিকা ঠিক আছে কি না দেখতে গিয়ে, হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন জয়া ও দেবপ্রিয়া । জয়া দৃশ্য দেখে চেঁচাতেও ভুলে গিয়েছেন আর দেবপ্রিয়া চেঁচিয়ে উঠে ভয়ে নড়তে পারছেনা। দেবপ্রিয়ার চিৎকার শুনে নার্স ডেস্ক থেকে দুজন নার্স দৌড়ে এসে দৃশ্যেও দেখে চমকে উঠেছে। ডাক্তার পাটিরকে কল করেই দুজনে মল্লিকার রক্ত বন্ধ কররার জন্য গজ আর টেপ নিয়ে দৌড়েছে। মল্লিকা শুধু মাথা নিচু করে রয়েছে, হুঁশে আছে কি না বোঝা যাচ্ছেনা।
.
বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গিয়েছে, তাও রক্তে ভেসে যাচ্ছে মল্লিকার পিঠ, জামা, সব। নার্স, ডাক্তার দৌড়াদৌড়ি করছেন। অপরাজিতাকেও হাসপাতাল থেকে কল দেওয়া হয়েছে। দেবু কোনোমতে নিজের বাবাকে কল করে ডাকতে পেরেছে। এই ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হতচকিত। শুধু মল্লিকার হুঁশ নেই, হাত দুটো ক্রমাগত ছেঁড়া স্ক্যাল্পের উপর খুঁচিয়ে চলেছে, মল্লিকা চুলকোচ্ছে, ওর যন্ত্রনাতেও আরাম হচ্ছে ...
==================================
বি:দ্র: ফেইডোল (Pheidole) পিঁপড়ে মানুষের মাথায় বাসা বানাতে পছন্দ করে। খুব রেয়ার হলেও, এই জিনিস ঘটা সম্ভব। তারা আসতে আসতে মাথার চুল খেয়ে নেয় আর অ্যালোপেসিয়া এনে দেয়। কান বা নাক দিয়ে লাল পিঁপড়ে বাসা বানাতে পারে মানুষের শরীরের ভিতর। টেপওয়ার্ম ছাড়াও আরও অনেক রকমের পোকা বা বাগ (BUG) মানুষের চামড়া দিয়ে বা কাল দিয়ে শরীরে বসবাস করে এবং এদের ট্রিটমেন্ট করে শেষ করতে হয়। এ ছাড়া , উকুন, মাছি, বা অন্য নানা পোকা কিন্তু মাথায় বসবাস করতে পারে যদি একবার ঢুকে যায়। শাক, বাঁধাকপি বা এই জাতীয় সব্জি, খুব ভালো করে ধুয়ে খাবেন। Tapeworm একজন লোকের মাথাতে প্রায় ২০ বছর বাসা করেছিল।
|| সমাপ্ত ||