28-09-2023, 10:46 PM
২.৩
আগের দিনের মত আজকেও বিক্রম সকাল সকাল উঠে পড়লো । বিছানা থেকে নেমে ঘরের বাইরে এসে ব্রাশ করার জন্য কলগেট আর ব্রাশ হাতে নিয়ে বাথরুমে ঢোকার আগেই সে উপর থেকে বিদ্যার গানের গলা শুনতে পেল । বিদ্যা রেওয়াজ করছে হারমোনিয়াম বাজিয়ে । বিদ্যার সুরেলা কন্ঠ শুনে সকাল সকাল বিক্রমের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো । মনটা তরতাজা হয়ে উঠলো । সে উপরে ওঠার সিড়িতে বসে বসে হাতে কলগেট ব্রাশ নিয়ে বাসি মুখে বিদ্যার গান শুনতে লাগলো । একটা দুটো তিনটে গান পরপর শুনলো । গান গুলো সে আগে শোনেনি । রবীন্দ্র সংগীত না বোধহয় । বিদ্যা রেওয়াজ বন্ধ করতেই বিক্রম উঠে বাথরুমে ঢুকে গেল ।
গতকাল সকালে দোকানের মালপত্রের হিসাবে সাহায্য করা , দুপুরে স্নানের আগে কলঘরের মেঝে পরিষ্কার করা এবং সন্ধ্যা বেলায় সোনার বালা কিনে এনে দেওয়ার জন্য দিনটা বিক্রমের ভালোই কেটেছিল । দিনটা ব্যাস্ততার মধ্য দিয়েই কেটেছিল । কিন্তু আজ সকালে পান্তাভাত খেয়ে সে ভাবতে বসলো আজ কি করা যায় ? এমনিতেও তার চুপচাপ বসে থাকতে একেবারেই ভালো লাগে না । কিছু একটা না করলে তার কেমন একটা খালি খালি লাগে ।
বিদ্যার রেওয়াজ শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে , এখনো থামেনি । সেপ্টেম্বর মাসের আবহাওয়া খুবই অনিশ্চিত। সকালে কাঠ ফাটা রোদ তো বিকালে অঝোরে বৃষ্টি । আবার সারাদিন অল্প অল্প বৃষ্টি হয়ে রাতে ভ্যাপসা গরম । আবহাওয়া দপ্তরের খবর যেন দু-লাইনের হাস্যকৌতুকের ছড়া। কেউ আগে থেকে সুনিশ্চিত ভাবে বলতে পারবেনা । এখন বৃষ্টির ফোঁটা ইলশেগুঁড়িতে রুপ নিয়েছে । এখন সাতটা বেজে বার মিনিট ।
বাড়ির চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিল বিক্রম । তার চোখ হঠাৎ বিদ্যার দোকানের ছাদে চলে গেল । ছাদ থেকে জল পাস হওয়ার জন্য একটা পাইপ ঠিক কলঘরের ছাদের দিকে মুখ করে আছে , কিন্তু সেই পাইপ দিয়ে জল বার হচ্ছে না । বিক্রম ভাবলো , ‘ বৃষ্টি তো ভালোই হলো । তাহলে ছাদ দিয়ে জল পড়ছে না কেন ? নিশ্চয়ই ওই কাঠগোলাপ গাছের ফুল পাতা পড়ে পাইপের মুখ বন্ধ হয়ে আছে । ‚
বৃষ্টি থামলেই সে উঠোন ঝাঁট দেওয়া ঝাঁটা নিয়ে প্রথমে কলঘরের ছাদে উঠলো , সেখান থেকে দোকানের ছাদে উঠে এলো , ‘ হ্যাঁ যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই । বাড়িতে কোন পরিষ্কার করার লোকও নেই । তাই কাঠগোলাপের ফুল পাতা পড়ে পাইপের মুখ বুঁজে আছে । এমনকি পাতা পচে দোকানের ছাদে মোটা আস্তরন পড়ে আছে । ‚
আর কিছু না ভেবে বিক্রম ছাদ পরিষ্কার করতে শুরু করলো । ঝাঁটা দিয়ে নতুন ঝড়াপাতা পরিষ্কার হলেও পুরানো পচে যাওয়া পাতা পরিষ্কার করা সম্ভব নয় । পাতাগুলো পচে ছাদের সাথে এঁটে মোটা আস্তরণের সৃষ্টি করেছে । কোদাল লাগবে পরিষ্কার করার জন্য।
বৃষ্টি কমে আসার জন্য , ঠিক তখনই বিদ্যা দোকান খোলার জন্য উঠোনে এলো আর উঠোনের অবস্থা দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো । সে দেখলো উঠোনে পচা ফুল পাতা টাল হয়ে পড়ে আছে । আর ছাদে বিক্রম ঝাঁট দিচ্ছে। বিক্রম উপর থেকেই বিদ্যাকে দেখতে পেয়েছিল । আর বিদ্যাকে দেখা মাত্রই তার চোখ চলে গেল বিদ্যার বুকের শাড়ি আর ব্লাউজের সন্ধিক্ষণে। সামান্য হলেও বিদ্যার মহামূল্যবান স্তন বিভাজিকা দৃশ্যমান। আর তা দেখা সম্ভব হয়েছে বিক্রমের ছাদে দাঁড়িয়ে থাকার জন্যেই।
বিক্রমের কোন ইচ্ছা ছিল না বিদ্যার দুই স্তনের মাঝের খাঁজ দেখার । কিন্তু চোখ কারোর কথা শোনে না । তাই বিক্রমের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে তোয়াক্কা না করেই তার চক্ষু দুটো একটু তৃপ্তির জন্য বিদ্যার স্তন বিভাজিকা দেখতে চেয়েছিল । বিদ্যার কিছু বলার আগেই বিক্রম নিজেকে সামলে নিয়ে বললো , “ কোদাল আছে ? „
গতকাল বিক্রমের কলঘরের মেঝে পরিষ্কার করাটা বিদ্যার একেবারেই ভালো লাগেনি । বাড়ির জামাই শশুর বাড়ি এসে কাজ করছে এটা দৃষ্টিকটু দেখায় । কিন্তু তখন বিদ্যা কিছু বলতে পারেনি তাই এখন বিদ্যা আর না বলে থাকতে পারলো না , “ তুমি এসব করছো কেন ? আমি পরে কোন লোককে দিয়ে করিয়ে নেব । „
ছাদ থেকেই বিক্রম যে কথাটা বললো সেটা শোনার পর বিদ্যা যেন বোবা হয়ে গেল । বিক্রম বললো , “ আমাকে যখন আপন করে নিয়েছেন তখন আমাকেও এই বাড়িটাকে আপন করে নিতে দিন । „
বিদ্যা বিক্রমকে বারন করছিল কারন নতুন জামাই বাড়িতে এসেছে দুই দিনও হয়নি , আর তাকে যদি কেউ ছাদ পরিষ্কার করতে দেখে তাহলে লোকে উল্টো পাল্টা ভাববে । কিন্তু এখন বিক্রমের কথা শোনার পর বিদ্যার আর কিছু বলার রইলো না । সে সিঁড়ির তলা দিয়ে ঠাকুর ঘরের পিছনের ঘরে ঢুকে একটা ছোট কোদাল আর দুটো সিমেন্টের বস্তা এনে উঠোনে দাঁড়ালো । উঠোনে দাঁড়াতেই বিদ্যা দেখলো বিক্রম ততক্ষণে ছাদ থেকে নেমে এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে । বিক্রম বললো , “ চলুন সাটার তুলে দিই । „
দোকানের স্যাটার তুলে দেওয়ার আগে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বিক্রম বললো “ যা বৃষ্টি হলো ! আজকে আর রাস্তায় জল দিতে লাগবেনা । „
সাটার তুলে দিয়ে সে আবার ছাদ পরিষ্কার করতে চলে গেল । আর বিদ্যা আপন মনে নিজের মত কাজ করতে লাগলো । কিছুক্ষন পর শবনম এসে দোকানে ঢুকতে ঢুকতে বললো , “ তোমাল জামাই তো খুব কাজেল দিদি । „
শবনমের প্রশংসা শুনে বিদ্যার মনে হলো শবনম যেন তাকেই কমপ্লিমেন্ট দিচ্ছে। কিন্তু এমন মনে হওয়ার কারন বিদ্যার বোধগম্য হলো না । কিছুক্ষন পর বিক্রম দুটো বস্তায় সব নোংরা ভর্তি করে এনে বললো , “ এখানে জঞ্জাল কোথায় ফেলে ? „
বিদ্যা বললো , “ ওইতো গঙ্গার পাশে একটা জায়গা আছে । আর না হলে বাজারের পাশে । „
শবনম উঠে দাঁড়িয়ে বললো , “ চলো । দেখিয়ে দিচ্ছি । „
বিক্রম দুই হাতে দুটো বস্তা নিয়ে শবনমের পিছন পিছন চললো । বিদ্যার দোকানের পাশের গলির ভিতর দিয়ে যেতে যেতে শবনম জিজ্ঞেস করলো , “ দাদা তুমি কি কলো ? „
“ আমি ! কোন ঠিক নেই । যখন যে কাজ পাই সেই কাজই করি „
বিক্রমের কথার অন্তর্নিহিত অর্থ শবনম বুঝতে পারলো না । তাই সে জিজ্ঞেস করলো , “ মানে ? „
বিক্রম এই কোমল মিশুকে মেয়ের সাথে ইয়ার্কি করার সুযোগ হাতছাড়া করলো না । , “ এই এখন যেমন ছাদ পরিষ্কার করলাম । „
“ ধ্যাৎ , ইয়াল্কি মালছো । „
বিক্রম হেসে বললো , “ আমি এখন গাড়ি সাড়াই। গ্যারেজে কাজ করি । „
জায়গাটা গঙ্গার পাশে নয় । গঙ্গার বেশ কিছুটা দূরে রাস্তার উপর । যখন দুজনে জায়গাটায় পৌঁছালো তখন মিউনিসিপ্যালিটির কয়েক জন লোক বড় গাড়িতে ময়লা তুলছে । বিক্রম ময়লার উপর বস্তা খুলে পচা ফুল পাতা ফেলার আগেই এক মিউনিসিপ্যালিটির সাফাই কর্মী বললো , “ একেবারে গাড়িতে ফেলুন । „
বিক্রম বস্তা দুটো গাড়ির পিছনে ময়লা ফেলার জায়গায় ফেলে জিজ্ঞেস করলো , “ এই কাজে কত করে দেয় ? „
লোকটা অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো , “ এই ময়লা পরিষ্কার করতে ? „
বিক্রম মাথা নাড়তে লোকটা বললো , “ দেয় ওই আট নয় হাজার । „
বিক্রম জিজ্ঞাসা করলো , “ খাটনি কেমন ? „
লোকটা বললো , “ হাতের খাটনির থেকে নাকের খাটনি বেশি । „ তারপর লোকটা বিদ্রুপ করে জিজ্ঞেস করলো , “ করবেন নাকি একাজ ? „
বিক্রম লোকটার বিদ্রুপকে পাত্তা না দিয়ে বললো , “ করলে ক্ষতি কি ! টাকাটা একটু বেশি হলে অবশ্যই করতাম । „
শবনম যেন বোবা হয়ে গেল । এই দাদার চরিত্র তো দিব্যা দিদিমণির সাথে একবারেই যায় না । কোথায় দিব্যা দিদিমণি আর কোথায় এই দাদাটা যে অকপটে নিঃসঙ্কোচে বলছে টাকার পরিমাণ আর একটু বেশি হলে মিউনিসিপ্যালিটির সাফাই কর্মী হতে তার কোন বাঁধা নেই । শবনম ভাবলো হয়তো সে দিব্যাকে চিনতে ভুল করেছে । বিদ্যা দিদির মেয়ে তো বিদ্যা দিদির মতোই হবে ।
সময় নিজের মত বয়ে যায়। সে কারোর পরোয়া করেনা । সময় নিজের মত অতিবাহিত হলেও ব্যাক্তি বিশেষে সময়ের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পায় । বিদ্যার কাছে একাকিত্বের মধ্য দিয়ে গত তিন মাস তিন বছরের মত কেটেছে । এখন তার সময় তিন জনের ছোট পরিবার সুখী পরিবারের মধ্য দিয়ে খুব ভালো সুন্দর কাটছে ।
বিক্রম সারাদিন বাড়ির বিভিন্ন কাজ করে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করে কিন্তু কাজ তো সীমিত। তাই সে সকালে বিদ্যার গান শুনে নিজের দিন শুরু করে । তারপর দোকান খুলে দিয়ে চায়ের দোকানে গিয়ে খবরের কাগজ পড়ে । শবনমের সাথে অনেক কথা বলে । তারপর ঘর মুছে , ঝুল ঝেড়ে , বাসন ধুয়ে সময় কাটায় । এক রবিবার তো সে মাংস রান্না করে বিদ্যা আর দিব্যা কে খাইয়েওছে । বিক্রমের হাতের রান্না যতোই ভালো হোক বিদ্যার মতে বিক্রম তার থেকে ভালো রান্না করতে পারেনা । তারই রান্না ভালো ।
প্রথম প্রথম বিক্রমের এই সব কাজ করাতে বিদ্যা বাঁধা দিত , বারন করতো । কিন্তু বিক্রম হাসি মুখে বিদ্যার বারন অগ্রাহ্য করে এই সব কাজ করতো । যখন বিদ্যা দেখলো বিক্রম তার বারন শুনবে না তখন সে নিজেও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। দোকানের কাজে বেশি সময় দিতে শুরু করলো । বিক্রম বাড়ির যাবতীয় এত কাজ করে নিজেকে কখনো কম পুরুষ মনে করেনি । বরং মানুষ হিসেবে নিজেকে সে আরো উন্নত মনে করে ।
এদিকে দিব্যার সময় তো চোখের পলকে কেটে যায়। সারাদিন সিরিয়াল , সিনেমা দেখে কাটিয়ে দেয় । একবার সে তার বান্ধবী সীমার বাড়ি যেতে চেয়েছিল তাই বিক্রম নিজের বাড়িতে ফেলে আসা দিব্যার স্কুটি এনে দিয়েছিল । এখন দিন স্থান একই হলেও তিন জনের তিন রকম সময় কাটে । এইভাবেই দশ বার দিন কেটে গেল ।
এই দশ বার দিনে বিদ্যা এবং বিক্রম দুজনেই দুজনকে গোপনে নিজের অজান্তেই লক্ষ্য করেছে । বিক্রম যে বাড়ির এই কাজ গুলো লোক দেখানোর জন্য করছে না এটা সে বুঝতে পেরেছে । ছেলেটা সত্যি সৎ এবং ভদ্র। বিক্রম লক্ষ্য করেছে বিদ্যার দোকানে এসে কোন খরিদ্দার দামাদামি করেনা । বেশিরভাগই বিদ্যার বাঁধাধরা পরিচিত খদ্দের । আর বিদ্যাও লোক ঠকায়না। ন্যায্য দামেই কাপড় বিক্রি করে । যৎসামান্য মজুরি নিয়ে সে সেলাইয়ের কাজ করে দেয় । এটা কি বিদ্যার সৎ চরিত্রের লক্ষণ নাকি খদ্দের হাতছাড়া হওয়ার ভয় সেটা বিক্রম এখনো বোঝেনি । তবে মনে মনে সে বিশ্বাস করে বিদ্যা সৎ । লোক ঠকিয়ে খাওয়ার মহিলা সে নয় ।
এই কয়দিনে শবনম আর বিক্রমের ভালোই বন্ধুত্ব হয়েছে । এখন বয়স অনুযায়ী শবনম বিক্রমকে তুমি আর দাদা বলে । বিক্রম শবনমকে তুই বলে সম্বোধন করে । আজ সকালে দোকান খোলার কিছুক্ষন পর শবনম আর বিক্রম বসে বসে গল্প করছিল । তাদের কথাবার্তা বিদ্যার কানেও আসছিল । শবনমের তোতলা শব্দ শুনে হেসে বিক্রম জিজ্ঞেস করল , “ তুই এটা কি ইচ্ছে করে করিস ? মানে একজন শুধু মাত্র ‘ র , উচ্চারণ করতে পারে না এরকম তো কোথাও দেখিনি ! „
শবনম বিক্রমের প্রশ্নে বলল , “ শুধু বয়শূন্য ল কেন ! ডয়শূন্য ল , ঢয়শূন্য ল , কোনটাই বলতে পালি না । „
শবনমের কথায় আবার বিক্রম হেসে উঠেছিল । বেশ মজার চরিত্র এই শবনম । মনটা শান্ত পুস্করিনীর মত স্বচ্ছ। রেগে গেলে গাল দুটো এমন ভাবে ফোলায় দেখে মনে হয় যেন আট নয় বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে ।
বিক্রম আর শবনমের বন্ধুত্ব বিদ্যার চোখ এড়ায়নি । সে এই সম্পর্কে কোন বিকৃতি সে খুঁজে পায়না । একটা ছেলে আর মেয়ের মধ্যে যে খাঁটি বিশুদ্ধ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে এটা বিদ্যা বিশ্বাস করে । যদি নারী পুরুষের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক না গড়ে ওঠে তাহলে তো এই জগৎটাই মিথ্যা হয়ে যায়।
আগের দিনের মত আজকেও বিক্রম সকাল সকাল উঠে পড়লো । বিছানা থেকে নেমে ঘরের বাইরে এসে ব্রাশ করার জন্য কলগেট আর ব্রাশ হাতে নিয়ে বাথরুমে ঢোকার আগেই সে উপর থেকে বিদ্যার গানের গলা শুনতে পেল । বিদ্যা রেওয়াজ করছে হারমোনিয়াম বাজিয়ে । বিদ্যার সুরেলা কন্ঠ শুনে সকাল সকাল বিক্রমের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো । মনটা তরতাজা হয়ে উঠলো । সে উপরে ওঠার সিড়িতে বসে বসে হাতে কলগেট ব্রাশ নিয়ে বাসি মুখে বিদ্যার গান শুনতে লাগলো । একটা দুটো তিনটে গান পরপর শুনলো । গান গুলো সে আগে শোনেনি । রবীন্দ্র সংগীত না বোধহয় । বিদ্যা রেওয়াজ বন্ধ করতেই বিক্রম উঠে বাথরুমে ঢুকে গেল ।
গতকাল সকালে দোকানের মালপত্রের হিসাবে সাহায্য করা , দুপুরে স্নানের আগে কলঘরের মেঝে পরিষ্কার করা এবং সন্ধ্যা বেলায় সোনার বালা কিনে এনে দেওয়ার জন্য দিনটা বিক্রমের ভালোই কেটেছিল । দিনটা ব্যাস্ততার মধ্য দিয়েই কেটেছিল । কিন্তু আজ সকালে পান্তাভাত খেয়ে সে ভাবতে বসলো আজ কি করা যায় ? এমনিতেও তার চুপচাপ বসে থাকতে একেবারেই ভালো লাগে না । কিছু একটা না করলে তার কেমন একটা খালি খালি লাগে ।
বিদ্যার রেওয়াজ শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে , এখনো থামেনি । সেপ্টেম্বর মাসের আবহাওয়া খুবই অনিশ্চিত। সকালে কাঠ ফাটা রোদ তো বিকালে অঝোরে বৃষ্টি । আবার সারাদিন অল্প অল্প বৃষ্টি হয়ে রাতে ভ্যাপসা গরম । আবহাওয়া দপ্তরের খবর যেন দু-লাইনের হাস্যকৌতুকের ছড়া। কেউ আগে থেকে সুনিশ্চিত ভাবে বলতে পারবেনা । এখন বৃষ্টির ফোঁটা ইলশেগুঁড়িতে রুপ নিয়েছে । এখন সাতটা বেজে বার মিনিট ।
বাড়ির চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিল বিক্রম । তার চোখ হঠাৎ বিদ্যার দোকানের ছাদে চলে গেল । ছাদ থেকে জল পাস হওয়ার জন্য একটা পাইপ ঠিক কলঘরের ছাদের দিকে মুখ করে আছে , কিন্তু সেই পাইপ দিয়ে জল বার হচ্ছে না । বিক্রম ভাবলো , ‘ বৃষ্টি তো ভালোই হলো । তাহলে ছাদ দিয়ে জল পড়ছে না কেন ? নিশ্চয়ই ওই কাঠগোলাপ গাছের ফুল পাতা পড়ে পাইপের মুখ বন্ধ হয়ে আছে । ‚
বৃষ্টি থামলেই সে উঠোন ঝাঁট দেওয়া ঝাঁটা নিয়ে প্রথমে কলঘরের ছাদে উঠলো , সেখান থেকে দোকানের ছাদে উঠে এলো , ‘ হ্যাঁ যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই । বাড়িতে কোন পরিষ্কার করার লোকও নেই । তাই কাঠগোলাপের ফুল পাতা পড়ে পাইপের মুখ বুঁজে আছে । এমনকি পাতা পচে দোকানের ছাদে মোটা আস্তরন পড়ে আছে । ‚
আর কিছু না ভেবে বিক্রম ছাদ পরিষ্কার করতে শুরু করলো । ঝাঁটা দিয়ে নতুন ঝড়াপাতা পরিষ্কার হলেও পুরানো পচে যাওয়া পাতা পরিষ্কার করা সম্ভব নয় । পাতাগুলো পচে ছাদের সাথে এঁটে মোটা আস্তরণের সৃষ্টি করেছে । কোদাল লাগবে পরিষ্কার করার জন্য।
বৃষ্টি কমে আসার জন্য , ঠিক তখনই বিদ্যা দোকান খোলার জন্য উঠোনে এলো আর উঠোনের অবস্থা দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো । সে দেখলো উঠোনে পচা ফুল পাতা টাল হয়ে পড়ে আছে । আর ছাদে বিক্রম ঝাঁট দিচ্ছে। বিক্রম উপর থেকেই বিদ্যাকে দেখতে পেয়েছিল । আর বিদ্যাকে দেখা মাত্রই তার চোখ চলে গেল বিদ্যার বুকের শাড়ি আর ব্লাউজের সন্ধিক্ষণে। সামান্য হলেও বিদ্যার মহামূল্যবান স্তন বিভাজিকা দৃশ্যমান। আর তা দেখা সম্ভব হয়েছে বিক্রমের ছাদে দাঁড়িয়ে থাকার জন্যেই।
বিক্রমের কোন ইচ্ছা ছিল না বিদ্যার দুই স্তনের মাঝের খাঁজ দেখার । কিন্তু চোখ কারোর কথা শোনে না । তাই বিক্রমের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে তোয়াক্কা না করেই তার চক্ষু দুটো একটু তৃপ্তির জন্য বিদ্যার স্তন বিভাজিকা দেখতে চেয়েছিল । বিদ্যার কিছু বলার আগেই বিক্রম নিজেকে সামলে নিয়ে বললো , “ কোদাল আছে ? „
গতকাল বিক্রমের কলঘরের মেঝে পরিষ্কার করাটা বিদ্যার একেবারেই ভালো লাগেনি । বাড়ির জামাই শশুর বাড়ি এসে কাজ করছে এটা দৃষ্টিকটু দেখায় । কিন্তু তখন বিদ্যা কিছু বলতে পারেনি তাই এখন বিদ্যা আর না বলে থাকতে পারলো না , “ তুমি এসব করছো কেন ? আমি পরে কোন লোককে দিয়ে করিয়ে নেব । „
ছাদ থেকেই বিক্রম যে কথাটা বললো সেটা শোনার পর বিদ্যা যেন বোবা হয়ে গেল । বিক্রম বললো , “ আমাকে যখন আপন করে নিয়েছেন তখন আমাকেও এই বাড়িটাকে আপন করে নিতে দিন । „
বিদ্যা বিক্রমকে বারন করছিল কারন নতুন জামাই বাড়িতে এসেছে দুই দিনও হয়নি , আর তাকে যদি কেউ ছাদ পরিষ্কার করতে দেখে তাহলে লোকে উল্টো পাল্টা ভাববে । কিন্তু এখন বিক্রমের কথা শোনার পর বিদ্যার আর কিছু বলার রইলো না । সে সিঁড়ির তলা দিয়ে ঠাকুর ঘরের পিছনের ঘরে ঢুকে একটা ছোট কোদাল আর দুটো সিমেন্টের বস্তা এনে উঠোনে দাঁড়ালো । উঠোনে দাঁড়াতেই বিদ্যা দেখলো বিক্রম ততক্ষণে ছাদ থেকে নেমে এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে । বিক্রম বললো , “ চলুন সাটার তুলে দিই । „
দোকানের স্যাটার তুলে দেওয়ার আগে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বিক্রম বললো “ যা বৃষ্টি হলো ! আজকে আর রাস্তায় জল দিতে লাগবেনা । „
সাটার তুলে দিয়ে সে আবার ছাদ পরিষ্কার করতে চলে গেল । আর বিদ্যা আপন মনে নিজের মত কাজ করতে লাগলো । কিছুক্ষন পর শবনম এসে দোকানে ঢুকতে ঢুকতে বললো , “ তোমাল জামাই তো খুব কাজেল দিদি । „
শবনমের প্রশংসা শুনে বিদ্যার মনে হলো শবনম যেন তাকেই কমপ্লিমেন্ট দিচ্ছে। কিন্তু এমন মনে হওয়ার কারন বিদ্যার বোধগম্য হলো না । কিছুক্ষন পর বিক্রম দুটো বস্তায় সব নোংরা ভর্তি করে এনে বললো , “ এখানে জঞ্জাল কোথায় ফেলে ? „
বিদ্যা বললো , “ ওইতো গঙ্গার পাশে একটা জায়গা আছে । আর না হলে বাজারের পাশে । „
শবনম উঠে দাঁড়িয়ে বললো , “ চলো । দেখিয়ে দিচ্ছি । „
বিক্রম দুই হাতে দুটো বস্তা নিয়ে শবনমের পিছন পিছন চললো । বিদ্যার দোকানের পাশের গলির ভিতর দিয়ে যেতে যেতে শবনম জিজ্ঞেস করলো , “ দাদা তুমি কি কলো ? „
“ আমি ! কোন ঠিক নেই । যখন যে কাজ পাই সেই কাজই করি „
বিক্রমের কথার অন্তর্নিহিত অর্থ শবনম বুঝতে পারলো না । তাই সে জিজ্ঞেস করলো , “ মানে ? „
বিক্রম এই কোমল মিশুকে মেয়ের সাথে ইয়ার্কি করার সুযোগ হাতছাড়া করলো না । , “ এই এখন যেমন ছাদ পরিষ্কার করলাম । „
“ ধ্যাৎ , ইয়াল্কি মালছো । „
বিক্রম হেসে বললো , “ আমি এখন গাড়ি সাড়াই। গ্যারেজে কাজ করি । „
জায়গাটা গঙ্গার পাশে নয় । গঙ্গার বেশ কিছুটা দূরে রাস্তার উপর । যখন দুজনে জায়গাটায় পৌঁছালো তখন মিউনিসিপ্যালিটির কয়েক জন লোক বড় গাড়িতে ময়লা তুলছে । বিক্রম ময়লার উপর বস্তা খুলে পচা ফুল পাতা ফেলার আগেই এক মিউনিসিপ্যালিটির সাফাই কর্মী বললো , “ একেবারে গাড়িতে ফেলুন । „
বিক্রম বস্তা দুটো গাড়ির পিছনে ময়লা ফেলার জায়গায় ফেলে জিজ্ঞেস করলো , “ এই কাজে কত করে দেয় ? „
লোকটা অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো , “ এই ময়লা পরিষ্কার করতে ? „
বিক্রম মাথা নাড়তে লোকটা বললো , “ দেয় ওই আট নয় হাজার । „
বিক্রম জিজ্ঞাসা করলো , “ খাটনি কেমন ? „
লোকটা বললো , “ হাতের খাটনির থেকে নাকের খাটনি বেশি । „ তারপর লোকটা বিদ্রুপ করে জিজ্ঞেস করলো , “ করবেন নাকি একাজ ? „
বিক্রম লোকটার বিদ্রুপকে পাত্তা না দিয়ে বললো , “ করলে ক্ষতি কি ! টাকাটা একটু বেশি হলে অবশ্যই করতাম । „
শবনম যেন বোবা হয়ে গেল । এই দাদার চরিত্র তো দিব্যা দিদিমণির সাথে একবারেই যায় না । কোথায় দিব্যা দিদিমণি আর কোথায় এই দাদাটা যে অকপটে নিঃসঙ্কোচে বলছে টাকার পরিমাণ আর একটু বেশি হলে মিউনিসিপ্যালিটির সাফাই কর্মী হতে তার কোন বাঁধা নেই । শবনম ভাবলো হয়তো সে দিব্যাকে চিনতে ভুল করেছে । বিদ্যা দিদির মেয়ে তো বিদ্যা দিদির মতোই হবে ।
সময় নিজের মত বয়ে যায়। সে কারোর পরোয়া করেনা । সময় নিজের মত অতিবাহিত হলেও ব্যাক্তি বিশেষে সময়ের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পায় । বিদ্যার কাছে একাকিত্বের মধ্য দিয়ে গত তিন মাস তিন বছরের মত কেটেছে । এখন তার সময় তিন জনের ছোট পরিবার সুখী পরিবারের মধ্য দিয়ে খুব ভালো সুন্দর কাটছে ।
বিক্রম সারাদিন বাড়ির বিভিন্ন কাজ করে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করে কিন্তু কাজ তো সীমিত। তাই সে সকালে বিদ্যার গান শুনে নিজের দিন শুরু করে । তারপর দোকান খুলে দিয়ে চায়ের দোকানে গিয়ে খবরের কাগজ পড়ে । শবনমের সাথে অনেক কথা বলে । তারপর ঘর মুছে , ঝুল ঝেড়ে , বাসন ধুয়ে সময় কাটায় । এক রবিবার তো সে মাংস রান্না করে বিদ্যা আর দিব্যা কে খাইয়েওছে । বিক্রমের হাতের রান্না যতোই ভালো হোক বিদ্যার মতে বিক্রম তার থেকে ভালো রান্না করতে পারেনা । তারই রান্না ভালো ।
প্রথম প্রথম বিক্রমের এই সব কাজ করাতে বিদ্যা বাঁধা দিত , বারন করতো । কিন্তু বিক্রম হাসি মুখে বিদ্যার বারন অগ্রাহ্য করে এই সব কাজ করতো । যখন বিদ্যা দেখলো বিক্রম তার বারন শুনবে না তখন সে নিজেও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। দোকানের কাজে বেশি সময় দিতে শুরু করলো । বিক্রম বাড়ির যাবতীয় এত কাজ করে নিজেকে কখনো কম পুরুষ মনে করেনি । বরং মানুষ হিসেবে নিজেকে সে আরো উন্নত মনে করে ।
এদিকে দিব্যার সময় তো চোখের পলকে কেটে যায়। সারাদিন সিরিয়াল , সিনেমা দেখে কাটিয়ে দেয় । একবার সে তার বান্ধবী সীমার বাড়ি যেতে চেয়েছিল তাই বিক্রম নিজের বাড়িতে ফেলে আসা দিব্যার স্কুটি এনে দিয়েছিল । এখন দিন স্থান একই হলেও তিন জনের তিন রকম সময় কাটে । এইভাবেই দশ বার দিন কেটে গেল ।
এই দশ বার দিনে বিদ্যা এবং বিক্রম দুজনেই দুজনকে গোপনে নিজের অজান্তেই লক্ষ্য করেছে । বিক্রম যে বাড়ির এই কাজ গুলো লোক দেখানোর জন্য করছে না এটা সে বুঝতে পেরেছে । ছেলেটা সত্যি সৎ এবং ভদ্র। বিক্রম লক্ষ্য করেছে বিদ্যার দোকানে এসে কোন খরিদ্দার দামাদামি করেনা । বেশিরভাগই বিদ্যার বাঁধাধরা পরিচিত খদ্দের । আর বিদ্যাও লোক ঠকায়না। ন্যায্য দামেই কাপড় বিক্রি করে । যৎসামান্য মজুরি নিয়ে সে সেলাইয়ের কাজ করে দেয় । এটা কি বিদ্যার সৎ চরিত্রের লক্ষণ নাকি খদ্দের হাতছাড়া হওয়ার ভয় সেটা বিক্রম এখনো বোঝেনি । তবে মনে মনে সে বিশ্বাস করে বিদ্যা সৎ । লোক ঠকিয়ে খাওয়ার মহিলা সে নয় ।
এই কয়দিনে শবনম আর বিক্রমের ভালোই বন্ধুত্ব হয়েছে । এখন বয়স অনুযায়ী শবনম বিক্রমকে তুমি আর দাদা বলে । বিক্রম শবনমকে তুই বলে সম্বোধন করে । আজ সকালে দোকান খোলার কিছুক্ষন পর শবনম আর বিক্রম বসে বসে গল্প করছিল । তাদের কথাবার্তা বিদ্যার কানেও আসছিল । শবনমের তোতলা শব্দ শুনে হেসে বিক্রম জিজ্ঞেস করল , “ তুই এটা কি ইচ্ছে করে করিস ? মানে একজন শুধু মাত্র ‘ র , উচ্চারণ করতে পারে না এরকম তো কোথাও দেখিনি ! „
শবনম বিক্রমের প্রশ্নে বলল , “ শুধু বয়শূন্য ল কেন ! ডয়শূন্য ল , ঢয়শূন্য ল , কোনটাই বলতে পালি না । „
শবনমের কথায় আবার বিক্রম হেসে উঠেছিল । বেশ মজার চরিত্র এই শবনম । মনটা শান্ত পুস্করিনীর মত স্বচ্ছ। রেগে গেলে গাল দুটো এমন ভাবে ফোলায় দেখে মনে হয় যেন আট নয় বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে ।
বিক্রম আর শবনমের বন্ধুত্ব বিদ্যার চোখ এড়ায়নি । সে এই সম্পর্কে কোন বিকৃতি সে খুঁজে পায়না । একটা ছেলে আর মেয়ের মধ্যে যে খাঁটি বিশুদ্ধ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে এটা বিদ্যা বিশ্বাস করে । যদি নারী পুরুষের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক না গড়ে ওঠে তাহলে তো এই জগৎটাই মিথ্যা হয়ে যায়।