27-09-2023, 11:20 AM
|| দ্রোহ ||
কলমে :- ইন্দিরা দাশ
শহরের একটু বাইরে বেশ ফাঁকা একটা জায়গায় একতলা এই বাড়িটা চট করে কারও চোখে পড়ে না। অবশ্য বলা ভাল, তেমন ভাবে খেয়াল করা যায় না। আসলে জায়গাটা একটু বেশীই ফাঁকা। আশে পাশে পাঁচিল দিয়ে ছোট ছোট করে কিছু প্লট ঘিরে রাখা আছে বটে ভবিষ্যতের বাড়ি বা ফ্ল্যাট বানাবার জন্য, কিন্তু আপাতত এলাকাটি কোলাহল মুক্ত। বিয়ের আগে অমিত বলেছিল, " আমার চাকরী বলতে তো এই ফার্মা কোম্পানিতে একটা ছোটখাটো পদ। তো, শহরের বড় জায়গায় বাড়ি ভাড়া নেওয়ার আপাতত ক্ষমতা নেই, তাই এখানেই এই বাড়িতে ভাড়ায় থাকি। বাড়ির মালিক খুব সজ্জন মানুষ। কথাবার্তা খুব ভাল, যদিও এইদিকে খুব একটা আসেন না। আশা করি তোমার কোন সমস্যা হবে না অনন্যা। আমরা আমাদের জীবনটা এখান থেকেই শুরু করতে পারব।"
অনন্যা সেদিন কিছু না বলে আমিতের হাতদুটো ধরে একটু হেসেছিল। তার মনে হয়েছিল, হয়তো স্বপ্ন এমনটাই হয়। বাড়ির নাম রাখা হয় “স্বপ্ননীড়”। এসব প্রায় এক বছর আগের ঘটনা।
সন্ধ্যের পর এই এলাকা এত্ত শুনশান হয়ে যায়। তখন ক্কচিৎ-কদাচিৎ দুএকটা সাইকেল বা বাইকের আওয়াজ ছাড়া বাকি সময়টা ঝিঁঝিঁর ডাকই একমাত্র ভরসা। মাঝে মাঝে মনে হয়, সন্ধ্যের পর যেন এই বাড়ি এক অন্য দুনিয়ার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়।
সেদিন রাত প্রায় দশটার কাছাকাছি হবে। চাবি দিয়ে বাড়ির সদর দরজা খুলে ভিতরে ঢোকে অমিত। বাড়ির ভিতর কোথাও আলো নেই। লোডশেডিং নাকি? ঠিক তাই!! সারা বাড়িটা যেন একটা অন্ধকারের সমুদ্রে ডুবে গেছে। মোবাইলের আলোটাও যেন ফিকে লাগছিল। কিন্তু অনন্যা কোথায়? এতবার তার নাম ধরে ডাকা সত্ত্বেও সে সাড়া দিচ্ছে না কেন? এবারে একটা সন্দেহ জাগে অমিতের মনে। আস্তে আস্তে সে পা বাড়ায় বেড্রুমের দিকে। বাইরে যাওয়ার আগে যেখানে সে অনন্যাকে নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকতে দেখে গেছিল।
কিন্তু বেডরুমে ঢূকে কোন কিছুই যেন ঠাহর করা যাচ্ছে না। এদিকে অমিতের মোবাইলের চার্জ প্রায় শেষ। কিছুক্ষণের মধ্যেই সুইচ অফ হয়ে যাবে। এবং হলও তাই। আর ঠিক তখনই একটা দলা পাকানো অন্ধকার যেন তাকে গিলে খেল। ঘুটঘুটে অন্ধকারের গহ্বরে সে যেন সম্পূর্ণ একা, কেউ কোথাও নেই। কিন্তু সত্যিই কি কেউ নেই সেখানে? অমিত কিন্তু ওর আশেপাশেই কারও উপস্থিতি যেন টের পাচ্ছে, কেউ হয়তো খুব কাছ থেকে তাকে এই অন্ধকারের মধ্যেও লক্ষ্য করে যাচ্ছে। এখুনি হয়তো সে অমিতকে স্পর্শ করবে। কিন্তু সেই অন্ধকারের জালটা ভেদ করে কাউকেই তো দেখা যাচ্ছে না। ভয়টা যেখানে অজানা, আতঙ্কটা সেখানেই সবথেকে বেশী। আচমকাই পট পরিবর্তন, হঠাৎ সেই অন্ধকারের গহ্বর থেকে তারস্বরে এক নারীকন্ঠের বিকট চিৎকার ভেসে আসে আর সাথে সাথেই অমিতের ওপর ঘটে এক অতর্কিত হামলা। সে বুঝতে পারে যে কেউ তাকে পিছন থেকে শক্ত করে চেপে ধরে ডানদিকের কাঁধের কাছে ধারাল কিছু দিয়ে আঘাত করেছে। তীব্র যন্ত্রণায় অমিত চেঁচিয়ে ওঠে কিন্তু কেউ সেটা শোনার নেই। বাইরের রাস্তাঘাট জনমানবহীন। এই আচমকা অসম লড়াইতে অমিত ধীরে ধীরে পরাজয় স্বীকার করতে থাকে এবং একটা সময় পর পুরো দুনিয়ার অজ্ঞাতে “স্বপ্ননীড়” থেকে ভেসে আসা সব চিৎকার, সব গোঙানি ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু অন্ধকারে অতর্কিতে কে-ই বা আক্রমণ করে বসে অমিতকে? সে-ই বা কি করে দেখতে পাচ্ছে চারপাশটা? আর শুধু আক্রমণ করাই নয়, ভয়ঙ্কর সেই ছায়ামূর্তি এরপর মেতে ওঠে এক পৈশাচিক উল্লাসে। অমিতের শরীরের ওপর ঝুঁকে পড়ে ধারালো দাঁত দিয়ে গলার পাশের এক খাবলা মাংস ছিঁড়ে নেয় সে। রক্তে ভেসে যেতে থাকে ঘরের মেঝে। বাইরে তখন রাতের নিস্তব্ধতাকে যোগ্য সঙ্গত দিয়ে যাচ্ছে রাতপাখিদের ডাক। কেউ জানতেও পারছে না স্বপ্ননীড়ের ঘটমান বিভীষিকার কথা। কেটে যায় আরও বেশ কিছুটা সময়। এদিকে ছায়ামূর্তিটা নিজের ক্ষিদে মিটিয়ে ফেলেছে ততক্ষণে। এরপর অমিতের মৃতদেহকে টেনে - হিঁচড়ে সে বের করে নিয়ে যায় ঘরের বাইরে। তার ক্ষতবিক্ষত এবং জায়গায় জায়গায় খাবলানো শরীরটাকে এক প্রকার দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় রাস্তার পাশের ঝোপ জঙ্গলের মধ্যে। এরপর সেই জীবন্ত পিশাচ কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে যায়।
ঘটনার দু’দিন পর,
======
- “তোকে কতবার বলেছিলাম যে বলটা ওই দিকে মারবি না।শুনলি না তো? এখানে খেলতে এসেছি জানতে পারলে মা আমাকে আর আস্ত রাখবে না।”
বছর দশেকের ছেলেটার কথা শুনে তার আরও চারজন খেলার সঙ্গীর মধ্যে একজন বলে ওঠে,
- “তুই ভয় পাচ্ছিস কেন? চল আমরা সবাই যাব বলটা আনতে।”
কথামতো সবাই দল বেঁধে সরু রাস্তার পাশের ওই জংলা জায়গায় গাছপালা সরিয়ে ক্রিকেট বলটা খুঁজতে শুরু করে। সবাই যে যার মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। হঠাৎ ওদের মধ্যে একজনের মর্মভেদী চিৎকারে বাকিরা সেখানে একত্রিত হয়। কিন্তু সেখানে পৌঁছাতেই বাকিদের অবস্থাও তথৈবচ। তীব্র আতঙ্কে আঁতকে ওঠে সকলে।
ঝোপের মধ্যে পড়ে আছে একটা মানুষের বীভৎস মৃতদেহ। সারা শরীরে একাধিক জায়গা থেকে যেন মাংস কামড়ে - খুবলে তুলে নেওয়া হয়েছে। সেটা দেখেই আঁতকে ওঠার মতো। দেখেই মনে হচ্ছে এটা কোন মানুষের দ্বারা সম্ভব নয়। তবে কি? কোন জন্তু? কিন্তু এই এখানে এই রকম ছোটোখাটো ঝোপঝাড়ের মধ্যে কি ভাবে কোন জন্তু আসবে? আর যদি কোন জানয়ারের উপদ্রব হয়েও থাকে তাহলে সেটা কতটা হিংস্র?
এই রকম বহু প্রশ্নের জন্ম দিল এই মৃতদেহ। এখুনি পুলিশকে খবর দেওয়া দরকার। কালবিলম্ব না করে ছেলের দল ছুটল পাড়ার বড়দের খবর দিতে।
========================================
- “দেখুন, আমি সরাসরি কথা বলতে ভালবাসি। তাতে আমাদের সকলের সুবিধা তাই না? আসলে আপনার ভাগ্নীকে আমি বিয়ে করতে চাই। ওকে আমার খুব পছন্দ।”
- “সে তোমার পছন্দ হতেই পারে। তোমার মতো অনেকেরই তো ওকে পছন্দ হয়। কিন্তু তাই বলে তো সবার সঙ্গে বিয়ে দেবো না। ওর মা - বাপ মরে যাওয়ার পর ওর পিছনে কত টাকা খরচ হয়েছে সেটা তোমার ধারণা আছে? ও চাকরি করলে সেই টাকা উসুল করার পর ওর বিয়ে দেওয়ার কথা ভাববো।”
- “আচ্ছা এই ব্যাপার? মানে অনন্যার এখানে থাকার একটাই উদ্দেশ্য, আর সেটা হল আপনাকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করা!! বা বলা ভাল আপনার ঋণ মেটানো!!”
- “হুম।”
- “ আচ্ছা বেশ, আর যদি টাকাটা আমি দিই?
- “মানে? তুমি কি টাকা দিয়ে অনন্যাকে বিয়ে করবে?”
- “হ্যাঁ!”
- “না মানে কতটাকা দিতে পারবে?”
- “আগে আপনাদের হিসাবটা তো শুনি! না মানে ওর পিছনে খরচের পরিমাণটা।”
- “ না মানে… সেটা তো ওই ভাবে পুরোপুরি হিসাব হয় না। তা প্রায় দু চার লাখ তো হবেই……”
- “তবে তাই হোক। চার লাখই ধরলাম। আমি এখন আপাতত পঞ্চাশ হাজার টাকা দেবো। তারপর একটু একটু করে আপনি আপনার টাকা পেয়ে যাবেন সময় মতো।”
- “ঠিক আছে। আমার খরচা ওঠা নিয়ে কথা! তাহলে বল বিয়ের দিন ক্ষন কবে ঠিক করা যায়। আমি কিন্তু কোন অনুষ্ঠান করতে পারব না।”
- (মুচকি হেসে) অনুষ্ঠান করার দরকার নেই। আমি এক কাপড়েই অনন্যাকে নিয়ে যেতে চাই। আর সেটা আজকেই। আপনাদের কোন আপত্তি আছে?”
- “যাকে নিয়ে যাবে তার কোন সমস্যা না থাকলে আমি আটকাবার কে? তোমরা কি আগেভাগে একে অন্যকে চিনতে?”
- “ সে আলোচনা থাক, টাকার জন্য নিজের ভাগ্নীকে একজন অপরিচিতের কাছে এক কথায় তুলে দিতে রাজি হয়ে গেলেন আপনি। আমার মনে হয়না এসব প্রশ্নের উত্তর শুনে আপনার কোন লাভ হবে। আপনি অনন্যাকে ডেকে দিন।”
- “ জ্ঞানটা আমাকে না দিলেও চলবে। এখানে বস, আমি অনন্যাকে ডেকে দিচ্ছি। আর হ্যাঁ, টাকাপয়সার কথাটা যেন মাথায় থাকে।”
- “ নিশ্চয়ই থাকবে। “
উপরের কথোপকথনটি অমিত এবং অনন্যার মামার। অমিত একটি ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানিতে চাকরী করে। কিন্তু ঠিক কি ধরণের কাজ সেটা জানা যায় না। ওদের কোম্পানি অনেক নতুন রকমের ড্রাগস নিয়ে গবেষণা করে। এদিকে অনেক ছোটবেলায় মা - বাবাকে হারানোর পর অনন্যা তার মামার কাছেই মানুষ হয়। পড়াশুনা শেষ করে সে এখন চাকরীর পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছে আর তার সাথে প্রাইভেট টিউশন করে চলেছে নিজের হাত খরচের ব্যবস্থা করার জন্য। এই সময়েই অমিতের সাথে পথচলতি কোথাও আলাপ হয় অনন্যার, সেখান থেকে কথাবার্তা, ভালোলাগা এবং ভালোবাসা। অমিত অনন্যাকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে ওর মামার কাছে আসে। গল্পটা এই পর্যন্ত ঠিক সিনেমার মতো মনে হচ্ছে তাই না? মনে হচ্ছে হয়তো মেয়েটা জীবনে ভালবাসার স্বাদ পাবে। তাই তো? হ্যাঁ, এই সব কিছুই হতে পারতো, কিন্তু হল না। কারণ, বাস্তবটা ছিল বড়ই কঠিন।
ছোটবেলা থেকে অনেক কষ্টের স্মৃতি পিছনে ফেলে অমিতের হাত ধরে পায়ে পায়ে মেয়েটা এগিয়ে গেল সুন্দর এক ভবিষ্যতের টানে। শ্বশুরবাড়িতে পা রাখার পর ঘরে গিয়ে সত্যি সারপ্রাইজড হয়ে যায় অনন্যা। শ্বশুরবাড়ি বলাটা একটু ভুল হবে কারণ অমিতের তিনকুলে কেউ নেই। ছোট্ট একটা বাড়িতে ও একাই থাকে। অমিত নিজের হাতে অনন্যার পছন্দের ছোট বড়ো জিনিস আর অনেক ফুল দিয়ে ঘরটা সাজিয়েছে অনন্যাকে ওয়েলকাম করার জন্য। অনন্যা সত্যি ভীষণ খুশি। প্রতিটা মেয়ে তো এই রকমই একজন জীবন সঙ্গী চায়। ঘরে ঢুকে অমিত অনন্যার হাতের ওপর হাত রেখে বলে,
- “আমার এই একার জীবনে আর শূন্য সংসারে তোমাকে স্বাগত। এখন এই ভাড়া বাড়িতে থাকছি বটে, কিন্তু তুমি পাশে থাকলে আমি একদিন অনেক বড় একটা বাড়ি কিনতে পারব দেখো। যেদিন তোমাকে প্রথম দেখি সেদিন থেকেই আমি মন থেকে স্থির করে ফেলেছিলাম যে তুমি শুধুই আমার….। দেখেছো, আমি একাই বকে যাচ্ছি। আরে তুমি তো কিছু বল?”
অনন্যা লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে নেয়। চোখে তার নতুন স্বপ্নের ভীড়। সত্যিই তো, মা - বাবা মারা যাবার পর এমন করে কেউ ওর কথা ভাবেনি।
এই ভাবেই শুরুর কয়েকমাস যে কিভাবে কেটে যায় অনন্যা বুঝতেই পারলো না। এরপর আস্তে আস্তে একটা একাকীত্ব যেন ওকে ঘিরে ফেলতে থাকে। অমিত সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকে। সেই সময়টা অনন্যার ওই বাড়িতে একা কিছুতেই সময় কাটে না। তাই ও ঠিক করে অমিতকে এবার বলবে যদি আবার পড়াশোনা শুরু করা যায়। মানে চাকরীর চেষ্টা শুরু করার কথা।
একদিন সন্ধ্যের পর অমিত বাড়ি ফিরতেই অনন্যা হাসি মুখে দরজা খোলে। সেটা দেখে অমিতের প্রশ্ন,
- “আজ মনে হচ্ছে আমার বৌ একটু বেশীই খুশি? তা খুশির কারণটা কি আমি জানতে পারি?”
- “আসলে তুমি তো সারাদিন থাকো না। আমি এই বাড়িতে একা একা খুব বোর হয়ে যাই। কতক্ষণ টিভি দেখে সময় কাটাবো বল? তাই ভাবছিলাম আমি আবার পড়াশোনা শুরু করবো আর পাশাপাশি একটা চাকরির জন্যও চেষ্টা করবো। আর তাছাড়া আমি একটা চাকরি পেয়ে গেলে আমাদের দুজনের পক্ষেই তো ভাল বল?”
কথা গুলো শোনার পর অমিতের মুখ থেকে যেন সব হাসি উবে গেল। খুব শান্ত গলায় বলল,
- “ দেখো আমি তোমাকে খুব ভালবাসি। আমি চাই না যে তুমি বাইরে বাইরে থাকো আমার মতো। তাছাড়া আমি যা ইনকাম করি সেটা তে নিশ্চয়ই তোমার কোন অসুবিধা হয় না। ”
অনন্যা মুখ নিচু করে মাথা নেড়ে ‘না’ উত্তর দেয়। তার অনেক কিছু বলার থাকলেও সেগুলো না বলাই থেকে যায়। তারপর অনন্যা অমিতকে আর কিছু বলেনি কখনও। একা লাগলেও নিজের সব ইচ্ছাকে মেরে মানিয়ে নেয়। কেন না মানিয়ে নেওয়া যে সে সেই ছোটবেলা থেকে শিখেছে।
এর মাঝে একদিন অনন্যাকে ডেকে অমিত বলে, “ শোনো! কাল আমার কিছু অফিস কলিগ আসবে সন্ধ্যেবেলা। আসলে বিয়েতে তো কাউকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি, তাই এবারে আর কেউ শুনছে না। সবাই আমার বৌ’টাকে দেখতে চায়।” হালকা খুনসুটি ভরা চালে দু’জনের কথাবার্তা চলতে থাকে। ঠিক হয় দু’দিন পরে শনিবার। ওইদিন সন্ধ্যাবেলা অমিত অফিস থেকে ওর তিনজন কাছের বন্ধুকে নিয়ে বাড়িতে আসবে। একটু খানাপিনা হবে ওই আর কি। অনন্যা শুধু জানতে চাইল, “মাত্র তিনজন বন্ধু কেন? তোমার তো আরও অনেক বন্ধু আছে!” উত্তরে অমিত জানায় যে কাছের বন্ধু বলতে মাত্র এই তিনজনই আছে, বাকিদের সাথে সম্পর্কটা একটু বেশী প্রফেশানাল। সেদিন বেশ রাত জেগে আলোচনা চলতে থাকে আগামী শনিবারের ব্যবস্থাপনা নিয়ে। অনন্যার বেশ ভালোই লাগছিল। অনেক দিন পর বেশ কিছু মানুষের সান্নিধ্যে আসবে সে। বিয়ের পর থেকে মামার কাছেই যা এক - দু’দিন গেছে, এখন আর তা’ও প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে।
শনিবার সন্ধ্যের একটু পরেই বাড়ির কলিং বেলটা বেজে ওঠে। অনন্যা সেদিন বিকেলের পর থেকেই সুন্দরভাবে সেজে অপেক্ষা করছিল অমিতের জন্য। ছুট্টে গিয়ে হাসিমুখে দরজা খুলে দেখে আমিতরা চারজন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। অনন্যা সাথে সাথে সকলকে আপ্যায়ন করে ঘরে নিয়ে আসে। অমিতের তিনজন বন্ধুদের মধ্যে প্রিয়ম এবং সাব্বির ওর সমবয়সী এবং শ্রীধরণ ওদের থেকে বেশ কিছুটা সিনিয়র। তিন জনের সাথেই বেশ ভারী ভারী তিনটে ব্যাগ। ব্যাগগুলো সব বসার ঘরের এক কোনায় রেখে সোফাতে সবাই গা এলিয়ে দেয়। অবশ্য বসার আগে অনন্যাকে ডেকে ওরা গিফটটা দিতে ভোলে না। শ্রীধরণ লোকটা একটু বেশি মাত্রায় গম্ভীর হলেও বাকি দু’জন বেশ আমুদে। ওরা একথা সেকথায় সন্ধ্যেটা পুরো মাতিয়ে রাখল।
এই পর্যন্ত সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। ছন্দপতনটা ঘটল ডিনারের পর। রান্নাঘরের কাজকর্ম সেরে বসার ঘরে এসে অনন্যা দেখে কেউ সেখানে নেই। এমনকি অতিথিদের ব্যাগগুলোও না। তবে কি তারা চলে গেলেন? অমিত তাকে ডাকল না কেন? এরকম ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মনে হল শোবার ঘর থেকে যেন কিছু মানুষের কথাবার্তার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সেদিকে যেতেই অনন্যা বুঝল যে তার মনে হওয়াটাই ঠিক। অমিত তার সব বন্ধুদের নিয়ে ওদের বেডরুমে উপস্থিত হয়েছে। দরজাটা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে সেটা হালকা করে ভেজানো ছিল এখন তা একটু খুলে গেছে। অনন্যা দরজার বাইরে থেকেই শুনতে পেল শ্রীধরণ ভদ্রলোকটি ওদের সকলের সাথে কি সব যেন বলে যাচ্ছে আর অমিত মাঝে মাঝে তার কথার উত্তর দিচ্ছে। কাকতালীয়ভাবে সকলেই দরজার দিকে পিছন ফিরে থাকায় অনন্যার উপস্থিতি কারও নজরে আসল না। কথোপকথন সব ইংরাজিতে হচ্ছিল। যার সারবত্তা ছিল কিছুটা এরকম,
(অমিত) “ আমার কথাটা বিশ্বাস করতে পারেন স্যার। কোন সমস্যা হবে না। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি। এই ড্রাগটা অফিসিয়ালি হিউম্যান ট্রায়ালে নিয়ে গেলে কিছু সমস্যা হতে পারে। রিসার্চ টিম এখনও একশো শতাংশ নিশ্চিত নয়, কিন্তু আমাদের কাছে আর সময়ও নেই। আপনিই তো আগের দিন বলছিলেন যে চীন ইতিমধ্যে এমন একটা ড্রাগের ওপরে ট্রায়াল শুরু করে দিয়েছে। তার আগে আমাদের কাজ শেষ করে ফেলতে না পারলে এত কোটি টাকার ইনভেস্টমেন্ট, এত প্রস্তুতি সব শেষ হয়ে যাবে। এটা আমার ড্রিম প্রোজেক্ট স্যার। এত সহজে তো হার মানা যাবে না। অফিসিয়াল ট্রায়ালের ব্যপারটা পরে আমরা ম্যনাজ করে নিতে পারি। আগে প্রাথমিকভাবে ট্রায়ালটা শুরু তো হোক!! “
(শ্রীধরণ) “ এটা আমারও ড্রিম প্রোজেক্ট অমিত। আমি তোমার আবেগটা বুঝতে পারছি, কিন্তু আমার চিন্তা এর সাইড এফেক্টস নিয়ে। কাল ভেঙ্কটেশ আমার কাছে সেই নিয়েই কিছু সন্দেহ প্রকাশ করেছে। “ইন্টারফেরন এক্স” একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার সেটা সন্দেহ নেই। মানুষের শরীরের ইমিউনিটি সিস্টেমকে এক ধাক্কায় বেশ কয়েকগুণ হাইপার অ্যাক্টিভ করার পরিকল্পনা করছি আমরা। কিন্তু এখন সমস্যা হচ্ছে সেই সাইড এফেক্টস নিয়ে। ভেঙ্কটেশ বলছিল, এই ড্রাগ প্রয়োগের ফলে সাব্জেক্টের মধ্যে এক্সট্রীম লেভেলে ইনসমনিয়া ডেভেলপ করার চান্স খুব বেশী, আর শুধু তাই নয় সাব্জেক্টের শরীরে স্বাভাবিক ব্যথা - যন্ত্রণা এমনকি ক্ষিদে - ঘুমটাও নষ্ট হয়ে যেতে পারে।”
(প্রিয়ম) “ তাহলে এটা তো আর ড্রাগের ট্র্যায়াল থাকবে না, সরাসরি হিউম্যান এক্সপেরিমেন্টের দিকে এগোচ্ছি আমরা। আমার মনে হয় আমাদের আরও অপেক্ষার প্রয়োজন আছে। “
(অমিত) “ কোন প্রয়োজন নেই। এসব ‘হয়তো’, ‘যদি’-কে ধরে বসে থাকলে শুধু সময়টাই নষ্ট হবে, আর কিছু না। একবার ভাবুন স্যার, যদি কোন সমস্যা না হয়, যদি কোন ম্যাসিভ সাইড এফেক্টস দেখা না যায়, তাহলে আমাদের অর্থ সময় সব বরবাদ হবে। এই ড্রাগ আমরা আর মার্কেটে নিয়ে আসতে পারব না। আমি আপনাদের চিন্তাটা বুঝতে পারছি। বাদুড়ের স্যালাইভা এই ড্রাগের প্রধান উপকরণ। আর বাদুড় অনেক রকম বিপজ্জনক ভাইরাসের হোস্ট সিস্টেম হিসাবে কাজ করে। আমি এই সব সংশয়ের কথা বুঝতে পারছি কিন্তু আমার কথাগুলোও একটু বোঝার চেষ্টা করুন। “
(সাব্বির) “ তোমার স্ত্রী কি রাজী হবে? আগে তাকে বোঝাও। “
(অমিত) “ সেটা নিয়ে সমস্যা হবে না। “
(সাব্বির) “ তাহলে কি আজ রাতেই….!! “
এই পর্যন্ত কথাবারতাটা চলতে খুব বেশী হলে তিন মিনিট লেগেছিল। অনন্যা ওর নিজের দিকের ইঙ্গিতটা বুঝতে না পেরে দরজায় টোকা মেরে ঘরে ঢোকে এবং অমিতকে সরাসরি প্রশ্ন করে।
(অমিত) আমার ওপরে কীসের ট্রায়াল হবে? ”
অমিত কিছুক্ষণ অনন্যার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, “তেমন কিছু না, তুমি আসলে আগের দিন বলছিলে যে তোমার শরীরটা আজকাল দুর্বল লাগে তাই ভাবছিলাম একটা ইঞ্জেকশন দেব আজকে। ঠিক হয়ে যাবে। সেটা নিয়েই কথা বলছিলাম।
(অনন্যা) “ আমি কিন্তু সব শুনতে পেয়েছি অমিত। পুরোটা না বুঝলেও এটা বুঝতে পেরেছি যে একটা বেআইনি কাজের মধ্যে ঢুকে পড়েছ তোমরা। “
অমিত আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে এবারে ঝাঁঝালো গলায় উত্তর দেয়, “সব শুনতে পেলে ন্যাকামো করে সময় নষ্ট করছ কেন? তবু যখন জিজ্ঞেস করলে তাহলে বলি শোনো, একটা ড্রাগের ট্রায়াল হবে। এটা ইঞ্জেক্ট করার পর তোমার রক্তের ইমিউনিটি পাওয়ার অনেক বেশি বেড়ে যাবে। তোমার শরীরের যে কোন বড় আঘাত খুব সামান্য বলে মনে হবে, বা মনেই হবে না। এখন এই যে মাঝে মাঝেই শরীর খারাপের কষ্টটা পাচ্ছ সেটা হয়তো আর পাবে না। এটাকে তুমি ড্রাগ না বলে এনার্জি বুস্টার বলতে পারো। “
(অনন্যা) “ কিন্তু আমি কেন? তুমি আমার ওপর কেন ট্রায়াল করবে? ”
অনন্যার সরল মনে প্রশ্ন শুনে অমিত ক্রূরভাবে হেসে উত্তর দেয়, “ আরে তুমিই তো আমার গিনিপিগ। এটা যদি সফল হয়ে যায় তাহলে তো আমাকে আর দেখতে হবে না।” এসব শুনে অনন্যা একপ্রকার স্তব্ধ হয়ে যায়। কোন কথা বলার যেন ক্ষমতা থাকে না ওর। এতবড় ভুল সে কি করে করতে পারে? একটা মানুষকে চিনতে এত ভুল তার হল কি করে? ভয়মিশ্রিত গলায় অনন্যা বলে, “ আমি মামার সাথে কথা বলতে চাই। আমি মামার বাড়ি যাব। এখানে আমি থাকব না। “
এবারে অমিত অনন্যার দিকে কয়েক মুহূর্ত এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকার পর জোরে শব্দ করে হেসে ওঠে। অনন্যা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, “ আমি হাসির কথা কি বললাম তোমাকে? আমি মামার কাছে যেতে চাই কদিনের জন্য। ” এবার অমিতের উত্তর, “কে তোমার মামা? এই আমি ছাড়া এই পৃথিবীতে তোমার আর কেউ নেই অনন্যা। তোমার ওই মামাকে আমি পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে তোমাকে আমার কাছে নিয়ে এসেছি।” এবারে অনন্যার মাথায় যেন একটা বাজ পড়লো।
(অনন্যা) “ কি সব ফালতু কথা বলছ? আমি এই সব বিশ্বাস করি না। আমি এখনই মামাকে জিজ্ঞাসা করবো”
এই বলে অনন্যা নিজের মোবাইল থেকে ওর মামাকে ফোন করলে ফোনের ওপার থেকে কিছুক্ষণ পর উত্তর আসে,
- “হ্যালো, কে?”
- “মামা আমি অনু।”
- “হ্যাঁ বল, এই অসময়ে ফোন করছিস যে?”
- “না আসলে একটা বিষয়ে তোমার কাছে একটু জানার ছিল মামা।”
- “ আমি এখন কাজে খুব ব্যস্ত আছি, তুই বরং পরে ফোন করিস।”
নাছোড়বান্দা অনন্যা এবার প্রশ্নটা করেই ফেলল,
- “মামা তুমি অমিতের থেকে টাকা নিয়েছ?”
- “সংসার করতে গেছিস ওটা কর ভাল করে। সব কথার কৈফিয়ত তোকে আমি দিতে যাবো না।”
- “তার মানে তুমি আমাকে বিক্রি করে দিলে মামা? মা বেঁচে থাকলে করতে পারতে এটা?”
ফোনের ওপার থেকে সোজাসুজি উত্তর এল, “তোর মা বেঁচে থাকলে তো আমি বেঁচে যেতাম। আর আমি তোকে বিক্রি করলাম কোথায়? এত দিন যে তোর পিছনে খরচ করলাম সেটা আমি উসুল করার চেষ্টাও করবো না? তাও তো পুরো টাকাটা আমি এখনও পাইনি। রাখ তো। যত্তসব।”
মোবাইল ফোনটা কান থেকে নামিয়ে নির্বাক অনন্যা শূন্য একটা দৃষ্টি নিয়ে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিঃশব্দে তার দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে। অমিতের সাথে ওই ঘরে উপস্থিত বাকি তিনজন ততক্ষণে সিরিঞ্জ বের করে তৈরী হয়ে পড়েছে। অমিতের সাহায্যে এবারে তারা অনন্যার শরীরে ঢুকিয়ে দেয় সেই অজানা বিষ!! অনন্যা আটাকাবার চেষ্টা করলেও লাভ হয় না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমে চোখদুটো জুড়ে আসে তার।
এই ঘটনার দুদিন পর। রাত তখন প্রায় দেড়টা বাজে। চারদিকে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না। পাশে শুয়ে থাকা অমিতের দিকে ভাল করে চেয়ে দেখল অনন্যা। অমিত অঘোরে ঘুমাচ্ছে। এই সুযোগ এই নরক থেকে মুক্তি পাওয়ার। খাট থেকে নেমে পা টিপে টিপে খুব সাবধানে ঘরের দরজা খুলে বাইরে যায় সে। বাড়ির মূল দরজা খুলতে গিয়ে দেখে সেটা তালা লাগানো। খুব সাবধানে অমিতের মাথার কাছে টেবিলের ওপর রাখা চাবিটা নিয়ে এসে দরজা খুলে বেরিয়ে যায় অনন্যা। আর কোন দিকে তাকানো নয়। বাইরের সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে খালি পায়ে দিশাহারা হয়েই দৌড়াতে থাকে সে। কিন্তু পড়ে থাকা একটা কাচ বা পাথরের টুকরো পায়ে বিঁধে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ে যায় সে। কোন রকম উঠে দাঁড়ালেও বেশি জোরে হাঁটার ক্ষমতা নেই আর। তবুও অনন্যা পা টেনে টেনে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগে। আচমকা অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর বলে ওঠে, “আমার হাতটা ধরো দেখো কষ্ট হবে না।”
একি!! এটা তো অমিতের গলা। সেই রাতে অমিত ওকে রাস্তা থেকে একপ্রকার টেনে হিঁচড়ে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসে এবং মারতে মারতে ঘরের মধ্যে বন্ধ করে দেয়। এরপর থেকে এই ড্রাগ আর অত্যাচার, এই দুটোই যেন অনন্যার সঙ্গী হয়ে যায়। কিছুদিন পর থেকে পুরো ব্যপারটা কেমন একটা গা - সওয়া হয়ে যায় ওর। অত্যাচারটা শুধুমাত্র অভ্যেসের জন্য নয়। ড্রাগের এফেক্টটা পরীক্ষা করার জন্য অমিত এমনিতেই অনন্যাকে নানা রকম ভাবে শারীরিক অত্যাচার করতে থাকে। এবং তার একটা রিপোর্ট নিয়মিত শ্রীধরণের টিমকে দিতে থাকে। এদিকে ড্রাগের প্রভাবে অনন্যার শরীর ভাঙতে শুরু করে একটু একটু করে। এখন চাইলেও তার ঘুম আসে না, ক্ষিদেও তেমন পায় না। তারা সারা শরীর ক্ষত বিক্ষত। দিনের পর দিন না খেয়ে , না ঘুমিয়ে দিন কাটে মেয়েটার।
কিছুদিন পর একটা বিশেষ কাজের জন্য অমিতের বাইরে যাবার প্রয়োজন পড়ে। অবশ্য সেটা দুদিনের জন্য। তাই অমিত ঠিক করে দুদিনের জন্য অনন্যাকে একটু বেশি মাত্রায় ইঞ্জেক্ট করে যাবে। ড্রাগটা এখন ভালভাবেই কাজ করছে। সাবজেক্ট এখন খাবারের ওপরে নির্ভরশীল নয়। ঘুমটাও তার কাছে আর প্রয়োজনীয় নয়। আর তাছাড়া, সাব্জেক্টের শরীরে ব্যথা বেদনার অনুভূতিটাও প্রায় নেই বললেই চলে। প্রাথমিকভাবে ড্রাগের এক্সপেরিমেন্ট সফল বলেই মনে হচ্ছে। এটা অমিতকে নিজে গিয়ে চেন্নাই অফিসে রিপোর্ট করতে হবে। তারপর অফিসিয়াল ট্রায়ালের একটা লোক দেখানো ব্যবস্থাপনা করতে হবে। সেটা অবশ্য প্রিয়ম আর সাব্বির দেখে নেবে। এই দু’দিনের জন্য অনন্যার বরাদ্দ শুধুমাত্র ড্রাগের হাই ডোজ ইঞ্জেকশন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ইঞ্জেকশন দিতে দিতে সে অনন্যাকে বলে,
“আমি দুদিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি। তোমার এই দুই দিনের ডোজ একসাথে দিয়ে গেলাম। কোন অসুবিধা হবে না দেখো। আর যেন দুষ্টুমি করে বাইরে যেও না। যদিও বাড়ির সব চাবি আমি নিয়ে গেলাম। পরশু পর্যন্ত তুমি শুধু বিশ্রাম নেবে কেমন? আমি চলি। ”
অনন্যার যেন কথা বলার শক্তি টুকু হারিয়ে গেছে। একদৃষ্টে অমিতের দিকে তাকিয়ে রইলো। সেটাকে তোয়াক্কা না করে ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে বেরিয়ে যায় অমিত।
তবে কি এবার এই নরক থেকে মুক্তি পাবে অনন্যা? নাকি সেই রাস্তাটা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল?
=============
বেশ কিছুদিন পরের ঘটনা। শহরের একটু বাইরে বেশ ফাঁকা একটা জায়গায় একতলা একটা বাড়িকে নিয়ে মানুষের মধ্যে কৌতূহল আর উত্তেজনা এখন চরমে। বাড়ির মালিক রাধেশ্যাম ঘোষ উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে দেখছেন শুধু। পুলিশি নজর এড়িয়ে ঘরের ভিতরে যাওয়ার কোন উপায় নেই। দু’একজন সাংবাদিককেও দেখা গেল ঘটনাস্থলে। পুলিশের বয়ান অনুযায়ী, পাড়ার কিছু লোকজন বাড়িটির উল্টোদিকে রাস্তার পাশের ঝোপের মধ্যে, একটি ক্ষতবিক্ষত মানুষের মৃতদেহ দেখে থানায় ফোন করে। প্রাথমিক ভাবে পুলিশের সন্দেহ ছিল এই মৃতদেহ এবং ওই বাড়িটার মধ্যে হয়তো কোন যোগসূত্র আছে। তাতে শিলমোহর দেন বাড়ির মালিক রাধেশ্যাম বাবু নিজে। তিনি জানান যে মৃতদেহটি অমিত সরকারের যে কিনা এই বাড়িতে তার স্ত্রী’কে নিয়ে ভাড়ায় থাকতো। ঘটনার পর থেকে অমিতের স্ত্রী অনন্যাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফরেনসিক টিম কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে। বাড়ীর বেডরুমের সর্বত্র শুকিয়ে আছে রক্তের দাগ এবং মেঝেতে পড়ে থাকা টুকরো টুকরো জিনিসগুলো কি মানুষের কাঁচা মাংসের টুকরো?
সেদিন রাতে কি অনন্যাই আক্রমণ করেছিল অমিতকে এবং তারপর তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে ঝোপের মধ্যে ফেলে মাংস খুবলে খেতে শুরু করেছিল? প্রশ্ন তো এখন অনেক!!
অনন্যা কোথায়?
ড্রাগের প্রভাবে যার ক্ষিদে নষ্ট হয়ে গেছিল সে এইভাবে অমিতের শরীর থেকে মাংস খুবলে নিল কেন?
তাহলে কি ড্রাগের কারণে অন্য কোন সাইড এফেক্টের সূচনা হয়েছে যা আগে ধারণা করা যায়নি?
অনন্যার মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কি এখনও অটুট আছে নাকি সেখানেও ড্রাগের প্রভাব দেখা দিয়েছে?
এতগুলো প্রশ্নের উত্তর যে সবথেকে ভালভাবে দিতে পারত, সে হল অমিত নিজে। পুলিশের পক্ষে দীর্ঘ অনুসন্ধান ছাড়া কখনই হয়তো বোঝা সম্ভব নয় যে এই “স্বপ্ননীড়”-এর মধ্যে কি ভয়ঙ্কর এক উন্মত্ততা চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। অনন্যার ওপরে দিনের পর দিন ধরে ভয়ঙ্কর “ইন্টারফেরন এক্স” ড্রাগ প্রয়োগের ফলে ধীরে ধীরে সে এক মানবী থেকে দানবীতে পরিণত হয়েছে। আজ তার শরীরে ঘুম বা ব্যথা - বেদনার মতো কোন অনুভূতিই নেই। সে এক জীবন্ত লাশে পরিণত হয়েছে যেন!! কিন্তু একটাই খটকা এখনও রয়ে গেল। ড্রাগের প্রাথমিক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় তো ক্ষিদে না থাকাটাই প্রধান লক্ষণ ছিল। সেটা কি করে পরিবর্তন হয়ে গেল? এর কোন উত্তর এখনও তো কেউ জানে না। আর অনন্যার এখনকার পরিস্থিতি যদি ড্রাগের অন্তিম পরিণতি হয়ে থাকে, তবে সামনে এখন সমূহ বিপদ।
তবে পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, অনন্যাকে এখন আর কোন স্বাভাবিক মানুষের শ্রেণীতে নিশ্চয়ই ফেলা যায় না। তাকে খুঁজে বার করাটাই এখন পুলিশের প্রথম কাজ। এই শহর অজান্তে এক নরখাদকের জন্ম দিয়ে ফেলেছে যে !! এখুনি তাকে থামাতেই হবে।
|| সমাপ্ত ||