25-09-2023, 03:13 PM
|| মড়ক ||
কাহিনী এবং প্রচ্ছদঃ- বুম্বা
সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য তাদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠাটা অত্যন্ত জরুরী। একের অধিক কিংবা নিদেনপক্ষে দু'টি সন্তান হলে, তারা পরস্পরের সঙ্গে এডজাস্ট করতে, নিজেদের কাজ এবং কাজের ফল এই দুটোই ভাগ করে নিতে সক্ষম হয়। কিন্তু একটিমাত্র সন্তান থাকলে, সেক্ষেত্রে সেই সন্তানের লালন-পালন অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে এবং স্বাভাবিক ভাবেই অভিভাবকের দায়িত্বও বেড়ে যায়। একমাত্র সন্তান অনেক সময় একাকীত্বে ভুগতে পারে, তাই তাদের ওপর বিশেষ নজর দেওয়াটাও জরুরি। আবার ছেলেমেয়েদের অত্যধিক নিরাপদে রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলেও হীতে বিপরীত হতে পারে। অন্যদিকে একমাত্র সন্তান হওয়ায় মা-বাবার অধিক স্নেহ-ভালোবাসা তাদের বিপথে চালনা করতে পারে। এমনকি একমাত্র সন্তানের প্রতি অভিভাবকের অত্যধিক প্রত্যাশাও তাদের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
নিজেদের একমাত্র সন্তান থাকলে হয়তো প্রত্যেক মা-বাবাই ওভার প্রোটেক্টিভ হয়ে পড়েন। সন্তানের চলা-ফেরা, ওঠা-বসা থেকে শুরু করে তাদের প্রতিটি কাজে অথবা সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেন তাঁরা। এই যেমন ধরা যাক, সেই সন্তানের বাবা হয়তো ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছিলেন, কিংবা তার মা সঙ্গীতশিল্পী বা নৃত্যশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু সময় ও পরিস্থিতির চাপে পড়ে তা হয়ে উঠতে পারেননি। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা নিজেদের এই স্বপ্নপূরণের গুরুদায়িত্ব সন্তানের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তবোধ করেন। তাঁরা নিজেদের ইচ্ছাপূরণের জন্য সন্তানের ওপর চাপ দিতে থাকেন। এর ফলে দুটো জিনিস ঘটতে পারে। প্রথমতঃ সেই সন্তান মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে। দ্বিতীয়তঃ অভিভাবকের এই সিদ্ধান্তের ফলে তাদের সন্তানের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা দেয়। তারা নিজের ইচ্ছা মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, তাই নিজেদের চারদিকে একটা অদৃশ্য দেওয়াল তুলে দিয়ে পরিবার তথা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
তবে একটা তৃতীয় সম্ভাবনাও থেকে যায়। যেটা আমার ক্ষেত্রে ঘটেছিলো। আমার বাবা এইসব ব্যাপারে মাথা না ঘামালেও, মা চিরকাল আমার বিষয় সমস্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছেন। আমি কোন স্ট্রিম নিয়ে পড়াশোনা করবো, আমার কি কি সাবজেক্ট থাকবে, কেরিয়ার গড়ার ব্যাপারে লক্ষ্যমাত্রা কিরকম হওয়া উচিৎ , এমনকি এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিস কি কি থাকবে .. এই সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতেন আমার মা। গড়পড়তা আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের মতো আমি অবশ্য কখনো হীনমন্যতায় ভুগিনি, আবার কখনো আত্মবিশ্বাসের অভাবও দেখা দেয়নি আমার মধ্যে। তার বদলে আমি সর্বদা এটাই মনে করতাম .. আমার জন্মদাত্রী কখনো আমার ক্ষতি চাইবেন না, অথবা আমার সম্পর্কে ভুল সিদ্ধান্ত নেবেন না। আমাকে উনি আমার থেকে বেশি চেনেন। তাই দেখিনা, ওনার কথা শুনে চললে, আখেরে তো আমার লাভও হতে পারে!
সমাজে আজ আমি একজন সফল ব্যক্তি কিনা বলতে পারবো না বা আমার বলা উচিতও নয়; তবে যারা নিজেদের উপর চাপিয়ে দেওয়া তাদের অভিভাবকের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে না পেরে প্রতিবাদ করেছিলো কিংবা প্রতিবাদ না করতে পেরে ভিতরে ভিতরে গুমড়ে মরেছিলো, তারা আজ হারিয়ে গিয়েছে। তবে আমার বাবা-মায়ের নেওয়া বিশেষ করে মায়ের নেওয়া কিছু সিদ্ধান্ত যে বুমেরাং হয়ে যায়নি, একথা বললে মিথ্যা বলা হবে। এই যেমন, মাধ্যমিকে স্টার মার্কস নিয়ে পাস করার পর আমার ইচ্ছে ছিলো ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করবো। তাই আর্টস নিতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু মায়ের ধারণা ছিলো .. ছেলেরা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করলে আর ছেলে থাকে না, মেয়ে হয়ে যায়। আর কমার্স? সেটা তো * স্তানিরা (পড়ুন অবাঙালি) পড়ে! বাঙালির ছেলে কমার্স নিয়ে পড়তেই পারেনা। অগত্যা সাইন্স নিতে হলো আমাকে। যদিও ছেলেদের আর্টস এবং কমার্স পড়ার ব্যাপারে মায়ের এই ধারণার সঙ্গে আমি একমত নই বরং এই ধারণার তীব্র বিরোধিতা করি আমি। কিন্তু সেই সময় প্রতিবাদ করার মতো ক্ষমতা আমার ছিলো না।
কিছু জায়গায় হোম ইউনিভার্সিটির যেরকম কোটা সিস্টেম চলে (সব জায়গায় মোটেও চলে না, কিছু কিছু জায়গার কথা বলা হচ্ছে)। অর্থাৎ ছাত্র বা ছাত্রীটি গ্রাজুয়েশনে সেই অর্থে ভালো রেজাল্ট না করলেও হোম ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট হওয়ার দরুন মাস্টার্সে চান্স পেয়ে যায়। আমি যে কলেজে পড়তাম, সেই কলেজে এইরকম কোনো সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যেত না। মাধ্যমিকে স্টারমার্কস, অর্থাৎ ৭৫ শতাংশের উপর নম্বর না পেলে সেই ছাত্রটির ভাগ্যে সাইন্স নিয়ে পড়ার সুযোগ হতো না আমাদের কলেজে। তাকে অন্য কোনো কলেজে চলে যেতে হতো।
মাধ্যমিকে স্টার পাওয়ার পর এবং মায়ের ইচ্ছায় সাইন্স নেওয়ার পর সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্যক্রমে ওই কলেজেই রয়ে গেলাম আমি। কলেজ ভালো হওয়ার জন্য হায়ার সেকেন্ডারিতে স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন কলেজের ভালো ভালো সব ছেলেরা ভর্তি হয়েছিলো আমাদের কলেজে। এর ফলে পুরনো বন্ধুদের পাশাপাশি অনেক নতুন বন্ধুও পেয়ে গেলাম আমি। তবে ছিপি (এটা ওর কোডনেম, ওকে এই নামে কেন ডাকা হতো, এটা এখানে আলোচ্য বিষয় নয়) ছিলো আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু।
প্রত্যেক ক্লাসে দেখবেন বুড়োভামের মতো দেখতে দু-একটা ছেলে থাকে .. এরা হলো জন্মবুড়ো। এদের কৈশোর নেই , যৌবন নেই , এরা জাস্ট জন্মেই বুড়ো হয়ে গেছে। সেরকম দু-এক পিস বুড়ো** মাল আমাকে এবং আমার বন্ধুদের চারআনার জ্ঞান দিয়ে বুঝিয়েছিলো যে, ইলেভেনে পড়াশুনা করার দরকার নেই। দীর্ঘদিন ফাঁকি মেরে একদম সেই টুয়েলভে টেস্টের পর পড়াশুনা করলেই হবে। মানে এতদিন ফুলটুস মস্তি! অ্যাকচুয়ালি তারা আমাদের জাহান্নমে যাবার রাস্তা দেখিয়েছিলো, সেটা তখন আমরা বুঝতে পারিনি।
যাইহোক, ইলেভেনের ক্লাস শুরু হওয়ার প্রথম ক'দিন স্বপ্নের মতো কাটতে লাগলো। ক্লাসে যেন বন্ধুদের সঙ্গে গল্প ফুরোতেই চায় না। কি ঢপের চপ পড়াশুনা হচ্ছে, সেই নিয়ে কারোর কোনো মাথাব্যাথা নেই। একদিন নিখিলেশ স্যার ক্লাসে গ্রেটেস্ট ইনটিজর ফাংশন পড়াচ্ছেন, পড়াতে পড়াতে তিনি কথাপ্রসঙ্গে একসময় বললেন, "এটা 'বিউটিফুল ফাংশন' , কারণ এটার গ্রাফ সিঁড়ির মতন দেখতে।" পরেরদিন কোনো এক উজবুককে এই বক্স ফাংশন থেকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করায় সে উত্তর দিলো, ''স্যার , ওই যে কাল বলেছিলেন 'বিউটিফুল ফাংশন' .. এটা তো তাই .." ব্যাস আর যায় কোথায়? দমাদ্দম চপেটাঘাত পড়লো কয়েকটা। ফিজিক্সের সৌগত স্যার অঙ্ক দিয়েছেন ক্লাসে। যার বয়ানে .. একটি ব্যাঙ কুয়োতে পড়ে যাবার গল্প ছিলো। গোটা ক্লাসে বদ ছেলেপিলের দল মাস্টারমশাইকে বারবার প্রশ্ন করে গেলো যে, "স্যার ব্যাঙটার কি হলো? সে কি কুয়ো থেকে উঠতে পারলো? উঠে কোথায় গেলো?" শেষে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে স্যার বলেছিলেন, "তোমাদের ক্লাস আমি আর নেবো না কাল থেকে। হেডস্যারকে বলে সেকশন চেঞ্জ করাবো। কিচ্ছু হবে না তোমাদের দ্বারা।" এইরকম খুনসুটিতে ভরা খুব মজার সময় কাটছিলো আমাদের। কিন্তু, জীবনে সবকিছুই তো ক্ষণস্থায়ী!
দুম করে ইলেভেনের হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষা চলে এলো। আমাদের কলেজের লাইব্রেরিতে যিনি থাকতেন তাঁকে কেউ 'স্যার' বলতো না , সবাই সমর দা বলে ডাকতো। 'দাদা' বললে উনি বেজায় রেগে যেতেন আর পুরনো বছরের প্রশ্ন দিতেন না। কলেজের ফুটবল টিমের অধিনায়ক ছিলাম আমি। ইন্টারকলেজ কম্পিটিশনে ক্লাস এইট থেকেই কলেজকে প্রচুর ট্রফি এনে দিয়েছিলাম। তাছাড়া গানের গলাটাও মন্দ ছিলো না বলে কলেজের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী সঙ্গীতটা গাওয়ার জন্য আমারই ডাক পড়তো বরাবর। তাই আমি পাজির পা-ঝাড়া হলেও, আমার প্রতি খুব একটা বিরূপ হতেন না কলেজের মাস্টারমশাইরা। তার উপর ওই লাইব্রেরিয়ানকে সমর দা থেকে 'স্যার' সম্বোধনে শিফট করে গিয়ে, ওঁর কাছ থেকে পুরোনো দশ বছরের প্রশ্ন জোগাড় করে করে ফেলেছিলাম আমি।
অঙ্কের প্রশ্ন দেখে তো আমার মাথায় হাত! কিছুই বুঝতে পারছি না , এগুলো আদৌ আমাদের সিলেবাসের কিনা, তাও ধরতে পারছি না। সারা বছর ফাঁকি মেরে কাটালে যা হয় আর কি! প্রিয় বন্ধু ছিপিকে ফোন করেকথাগুলো বলাতে ছিপি বললো, "চাপ নেই, একসঙ্গে বসবো। হলে গিয়ে সব নামিয়ে দেবো।" কি নামাবে, কার নামাবে .. কিছুই বুঝতে পারলাম না। ছিপি পরীক্ষার সময় জামার ভেতর একটা সাদা রঙের দাদু গেঞ্জি (হাফ স্লিভ) পরে আসতো। যেখানে লেখা ছিলো .. 'ভগবান আমার সহায়'। যদিও আসল সময়ে ভগবান সহায় হননি কোনোদিন। পরীক্ষার আগের দিন সারারাত জেগে পড়তাম আমি। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতাম না , তবুও পড়তাম , গাঁতিয়ে যেতাম , ভুলে গেলে আবার গাঁতাতাম।
প্রথম পরীক্ষা বাংলা, যে পরীক্ষা আজ অবধি কেউ খারাপ দেয়নি। তারপর বাকি পরীক্ষা থেকেই থরহরি কম্প শুরু হয়ে যেতো সকলের। আমি কেমিস্ট্রিতে খুব দুর্বল ছিলাম। পরীক্ষাহলে আমার সামনে ছিপি বসেছে। আমি কিছুই লিখতে পারছি না। এদিকে ছিপি হুলিয়ে লিখছে পাতার পর পাতা। এতো পাতা নিচ্ছে যে ওকে রাগের চোটে একবার স্বগোতক্তি করে 'পাতাখোর' বলেই ফেললাম! তারপর নিজের রাগ প্রশমিত করে বললাম , "ভাই দেখা একটু , আমি ফেল করে যাবো রে!" ছিপি বললো, "আমি সব বানিয়ে লিখছি।" কেমিস্ট্রিতে আবার বানিয়ে লেখা যায় নাকি? এটা কি হিস্ট্রি নাকি? আমি ছিপির খাতার দিকে চোখ রাখলাম। এমা, এ তো সত্যি বানিয়ে লিখছে! যে প্রশ্ন আসেনি, সেই প্রশ্নের উত্তর লিখছে খাতা ভরাবে বলে! ছিপির হাতের লেখা ছিলো মুক্তোর মতো, দামী বিয়েরকার্ডে যেমন লেখা থাকে। আমাদের কলেজের কেমিস্ট্রির স্যার অঞ্জন বাবু ছিলেন ওর হাতের লেখার ভক্ত। পরীক্ষা শেষ হওয়ার বেশ কিছুদিন পর তিনি একদিন ছিপিকে রাস্তায় ডেকে বললেন, ''তোমার হাতের লেখাটা ভারী সুন্দর। পরীক্ষায় যে প্রশ্ন আসেনি, তুমি তারও উত্তর লিখেছো! আমি কিছু নম্বর সেখানে দিয়েছি তোমাকে।" ছিপি সেবার ৫০ এর মধ্যে ৩৪ পেয়েছিলো। খাতা দেখার পর জানা গেলো এই প্রাপ্ত নম্বরের মধ্যে কুড়ি নম্বর সে পেয়েছিলো এমন প্রশ্নের উত্তর লিখে, যেগুলো পরীক্ষায় আসেনি! "শালা কুত্তা .." ছিপির উদ্দেশ্যে এই উক্তিটা আপনা আপনিই বেরিয়ে এসেছিলো আমার মুখ দিয়ে, তবে এবার স্বগতোক্তি করে নয়।
যাইহোক , এবার অঙ্ক পরীক্ষার খাতা দেখানো দিনের কথা বলা যাক। নিখিলেশ স্যার প্রশ্নপত্র সেট করলে তাও কিছু লেখা যেতো , কিন্তু রাজশ্রী ম্যাডাম প্রশ্নপত্র তৈরি করলে ভয়ে সবার ইয়ের কালি শুকিয়ে যেতো .. পেনের। রাজশ্রী ম্যাডামের তৈরি করা অঙ্কের পেপার ছিলো সাক্ষাৎ যমদূত! দেখতে ওনাকে যতই ফিল্মের হিরোইনদের মতো হোক না কেনো, অঙ্ক পরীক্ষায় এতো কঠিন প্রশ্ন করতেন যে বলার কথা নয়! সোজা অঙ্ক একটাও নেই। কোনোমতে পরীক্ষা দিয়ে ছিপিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, "কি রে, কেমন হলো?" ছিপি বলেছিলো , "কাল দোলার সঙ্গে ব্রেকআপ হয়ে গেলো, তাই পরীক্ষাটাও ভালো হয়নি।" ছিপি আট পেয়েছিলো অঙ্কে। ক্লাসের সবাই মনে করলো, ব্রেকআপের পরে পরীক্ষা দিয়েছে , আট পেয়েছে , এটাই অনেক। হ্যান্ডেল (এটাও একজনের কোডনেম, এর কারণও বলা যাবে না) বললো , "আমারও সিঙ্গেল ফিগার হয়েছে।" সিঙ্গেল ফিগার শুনে আন্দাজ করতে পারেনি কেউ, হ্যান্ডেল পঞ্চাশে এক পেয়েছে। সকলের ধারণা ছিলো এটাই বোধহয় সবথেকে লোয়েস্ট নম্বর হয়েছে। কিন্তু পরীক্ষার খাতা দেখতে দেখতে হঠাৎ লম্বকর্ণের বুকফাটা কান্না শুনে সবাই চমকে উঠলাম। ও কাঁদতে কাঁদতে বলছিলো, "ম্যাডাম আমাকে কিচ্ছু দেয়নি , কিচ্ছু দেয়নি ..'' বেচারা শূন্য পেয়েছিলো।
"তুই তো সবার নম্বর দেখে মজা নিচ্ছিস, তুই নিজে কত পেয়েছিস রে?" ছিপির কথায় করুন করে হেসে খাতাটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। চার পেয়েছিলাম .. পঞ্চাশের মধ্যে। তবে বাকিরা ইলেভেনের হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষায় অঙ্কের প্রাপ্ত নম্বরের ট্র্যাডিশন পরবর্তীতে ভেঙে ফেললেও, আমি ভাঙতে পারিনি। আসল পরীক্ষাতে অঙ্কের ফার্স্ট পেপারেও চার পেয়েছিলাম আমি, একশোর মধ্যে। হ্যাঁ আপনারা ঠিকই ধরেছেন, এখানে বোর্ড এক্সামিনেশনের কথাই বলা হচ্ছে। তবে এই 'চার' পাওয়ার ব্যাপারটা এখন ওপেন সিক্রেট। বর্তমানে এখানে মোটামুটি যারা আমাকে চেনে এবং আমার ফেসবুকে রয়েছে, তারা সকলেই এই বিষয়টা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তবে অঙ্কের ফার্স্ট পেপারে চার পেলেও সেকেন্ড পেপারে সত্তরের উপর নম্বর পেয়েছিলাম আমি। এক্সাক্টলি সংখ্যাটা মনে নেই। আসলে ভালো নম্বর তো মনে থাকে না বা লোকে মনে রাখতে দেয় না! খারাপগুলোই মনে করাতে থাকে বারবার। যাইহোক, ফিজিক্স আর বাংলাতে বিশেষ সুবিধা করতে না পারলেও কেমিস্ট্রি, বায়োলজি এবং ইংরেজিতে লেটার পেয়েছিলাম আমি। কেমিস্ট্রিতে কি করে লেটার পেয়েছিলাম ভগবান জানে! খাতা যিনি দেখেছিলেন, তিনি নিশ্চয়ই নিষিদ্ধ কিছু সেবন করেছিলেন আমার খাতা দেখার আগে। ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথমেটিক্স ছিলো আমার প্রথম তিনটি সাবজেক্ট, আর বায়োলজি ছিলো ফোর্থ সাবজেক্ট। অঙ্কের সেকেন্ড পেপারে সত্তরের উপর পেলেও, ফার্স্ট পেপারে চার পাওয়ার জন্য দুই পেপার মিলিয়ে আশির উপর নম্বর উঠলো না। স্বভাবতই ম্যাথমেটিক্স ফোর্থ সাবজেক্ট হয়ে গেলো আমার।
মার্কশিট নিয়ে বাড়ি আসার পর, আমাকে পিটিয়ে মা আমার শরীরের সমস্ত কলকব্জা ঢিলা করে দেওয়ার প্ল্যান করলেও, বাবার জন্য সেদিন সেটা সম্ভব হয়নি। বাবা বাধা দিয়ে বলেছিলো, "ওকে এখন শুধু শুধু মেরে কি হবে? আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই সবকিছু হয়েছে তোমার জন্য। যে ছেলের অঙ্কের প্রতি এত ভীতি, তার প্রধান সাবজেক্ট ম্যাথামেটিক্স রাখলে এটাই তো হবে! বাকি সাবজেক্টগুলোতে দেখেছো, আমাদের ছেলে কতটা ভালো মার্কস পেয়েছে? দোহাই তোমার, তুমি ওকে এবার ইংলিশ অনার্স নিতে দাও! সায়েন্সের স্টুডেন্ট হয়েও কিন্তু ইংলিশে লেটার পেয়েছে আমাদের ছেলে।"
কিন্তু আমার মাতৃদেবী কোনোদিনই কারোর কথা গ্রাহ্য করেননি। তাই বাবার এই কথাটাও ধোপে টিকলো না। মায়ের ইচ্ছেতেই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত পশ্চিমবঙ্গের একটি প্রথম সারির কলেজে জুলজি অনার্স নিয়ে ভর্তি হলাম আমি। এতদিন আমি পড়াশোনা করতাম ঠিকই, তবে সেটা সাবজেক্টকে ভালোবেসে নয়। কিন্তু কোচ যখন প্রিয় হয়ে যায়, তখন সেই খেলাকে ভালোবেসে নিজেকে প্রমাণ করার একটা তাগিদ চলে আসে। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আমাদের জুলজি ডিপার্টমেন্টের পিকেবির প্রেমে পড়ে গেলাম আমি। নাহ্ , উনি কোনো মহিলা নয়, উনার নাম পীযুষ কুমার বন্দোপাধ্যায়। উনার পড়ানোর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম আমি। সেই থেকেই জুলজি সাবজেক্টের প্রতি ভালোবাসা জন্মায় আমার, তার সঙ্গে ভালো রেজাল্ট করে নিজেকে প্রমাণ করার ইচ্ছেটাও প্রবল হয়ে ওঠে। এরপর আমাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
★★★★
যাক সে কথা, যে গল্পটা বলতে আজ এখানে এসেছি, তার জন্য আবার কলেজজীবনে ফিরে যেতে হবে আমাকে। বাংলা পড়ার জন্য ক্লাস ইলেভেনে আবির বাবুর কাছে প্রাইভেটে ভর্তি হয়েছিলাম। একটা দশ ভাই বারোর ঘরে একগাদা ছেলে পড়াতেন। না না ভুল বললাম, শুধু ছেলে নয়, মেয়েও ছিলো সেই গোয়ালে। স্যার সারাক্ষণই খচে থাকতেন, অবশ্য তার পিছনেও কারণ ছিলো। আমরাও তো কেউ আর ধোয়া তুলসীপাতা ছিলাম না!
যে গোয়ালে আমরা পড়তাম, সেই ঘরের দেওয়ালে কোনো এক সাধুবাবার ছবি দেওয়া ক্যালেন্ডার ছিলো। কিছুদিন পর থেকেই সেই ছবি বদলাতে লাগলো। সাদা দাড়ি ধীরে ধীরে নীল কালিতে নীলবর্ণ ধারণ করতে শুরু করলো। শিল্পীর কালি ফুরিয়ে গেলে , অন্য কেউ কালো কালি দিয়ে দাড়ি কালো করে দিতো। এরপর একদিন সাদা চুল লাল হয়ে গেলো, তারপর পরিবর্তন হয়ে চুল সবুজ হলো (না না, এখানে রাজনীতি ঢোকানোর চেষ্টা করবেন না একদম)। সাধুবাবার কানে একাধিক দুল এঁকে দিলো কেউ, কিংবা ঝুমকো। মাথায় সিংও বাদ গেলো না। ক্যালেন্ডারে 'সোনামণি মেডিসিন' এর উপরের সাদা অংশে নানান কল্পিত কাপেলের নাম :- ঈপ্সিতা + চেঙ্গিস , দেবা + শীলা , দিপু + অর্চিতা।
বয়স্ক আবীর বাবু চোখে ভালো দেখতেন না। অনেকদিন পর সেই বদলে যাওয়া সাধুবাবার ছবি দেওয়া ক্যালেন্ডার দেখে ওঁর প্রায় যায় যায় অবস্থা । তিনি ওটা চেঞ্জ করে কোনো এক দেবদেবীর ছবি দেওয়া ক্যালেন্ডার ঝুলিয়ে দিলেন ওই জায়গায়। দেখে মনে হলো, সেই দেবদেবীর প্রিওয়েডিং ফটোশুটের ছবি! স্যার ভেবেছিলেন, সাধুবাবার ছবি না দিয়ে সাধুবাবার উপরমহল অর্থাৎ সরাসরি দেবদেবীর ছবি দিলে বদমায়েশি করবো না আমরা। কিন্তু , সেখানেও কেউ একজন ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রতিবাদপত্র লিখে দেয় :- "তুমি নেই আমি জানি। তুমি থাকলে আমি অঙ্কে চার আর ফিজিক্সে পাঁচ পেতাম না। তুমি থাকলে শ্রেয়া আমাকে রিজেক্ট করতো না। তুমি থাকলে আমার বাপ আমাকে এক টাকার বেশি পকেট মানি দিতো। তুমি থাকলে এই বুড়োভামেরর কাছে আমরা পড়তে ঢুকতাম না।"
আমরা যখন টুয়েলভে উঠলাম, তখন অনেকেই অনেকের উপর চাপ খেয়েছিলো। সেসব চাপ খুব সাঙ্ঘাতিক। দেবাশীষ রুমির প্রেমে পড়ে সাতবার 'সাথী' নামের বাংলা সিনেমাটা দেখেছিলো। কলেজ শেষে রোজ রুমির বাড়ি ফেরার রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতো ওকে একবার দেখবে বলে। অনির্বাণ কলেজে না গিয়ে সারা দিন গঙ্গার ধারে বসে থেকে একটা সাত টাকার ধোসা আর গোটা কয়েক বিড়ি খেতো। রাজিব শ্রীময়ীকে রাস্তায় দেখলেই সাইকেল থেকে পড়ে যেতো। মৃন্ময় সাইকেল চালাতে পারতো না। চিত্রাকে লাইন মারতো, আর চিত্রা ওকে পাত্তা দিতো না । ফলে, কোনো বন্ধুর সাইকেলে চড়ে প্রায়শই মৃন্ময় জোরে জোরে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরতো।
যদিও আমরা কেউ প্রেম করবো এমনটা ভাবিনি। তবে বাবাই নামে আমাদের এক বন্ধু পরমার সঙ্গে প্রেম করে ফেললো। কলেজে যাওয়া ছাড়া বাবাই সবসময় পায়জামা পাঞ্জাবি পড়তো। এদিকে বাবাইয়ের বাড়ি হেব্বি কড়া। টিউশনি ছাড়া বাইরে বেরোতে দেয় না। পরমার সঙ্গে দেখা করবে বলে টিউশনির ব্যাচ কামাই করতে লাগলো। কামাই করার জন্য একটাই কারণ দেখাতো বাবাই .. 'ওঁর কোনো এক আত্মীয় মারা গেছে'। সুযোগ বুঝে কোনো সময় ওদের নিজের বাড়ি আর মামাবাড়ি যে বিশাল একান্নবর্তী পরিবারের অন্তর্গত .. সে কথা শুনিয়ে রেখেছিলো মাস্টারমশাইকে। ফ্যামিলিতে বেশী মেম্বার মানেই, বেশী ছুটি পাবে। ফলে, এক বছরে কুড়িটা কামাই মানে পাঁচটা মামা , ছয়টা মামী, তিনটে কাকী, দুটো কাকা, একটা দাদু , একটা দিদা, দুটো পিসেমশাইয়ের মৃত্যু সংবাদ দিলেই চলবে। ক্লাস টুয়েলভের শেষের দিকে একদিন বাবাইকে স্যার জিজ্ঞাসা করলেন, "কি রে, আগেরদিন এলি না?" বাবাই দুঃখ দুঃখ মুখ করে উত্তর দিলো, "স্যার আমার বড়মাসি মারা গেছিলেন, তাই আসতে পারিনি।" আবির বাবু কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, "হ্যাঁ রে বাবাই, তোর পরিবারে কি মড়ক লেগেছে গত এক বছর ধরে? তোর মা-বাবা আর তুই ছাড়া বর্তমানে আর কেউ বেঁচে আছে তোদের পরিবারে?"