18-09-2023, 09:00 AM
|| অ্যারোমা ||
লেখা :- জাকিয়া হাসান
আজকাল মাঝেই মাঝেই অদ্ভুত অদ্ভুত গন্ধ পায় নিধি। একটু পর পরই গন্ধগুলো ধ্বক করে এসে নাকে ধাক্কা দেয়। ভিরের বাসে, ট্রামে, মেট্রোতেই হোক আর ক্লাসরুমেই হোক বলা নেই কওয়া নেই একেবারে ঠিক যেন বিনা নিমন্ত্রনে এসে যাওয়া বেহায়া অতিথির মতো পিছু নেয় ওর । আর ওটা এতো তীব্র আর ঝাঁঝালো যে কেমন জ্বালা করে উঠে নাকটা। কখনো অনেকটা হসপিটালের ভেতরে নানান ধরণের কেমিক্যাল আর ওষুধের গন্ধের মিশ্রনে তৈরী কটু গন্ধটার মতো, কখনো রক্ত আর মাংশ পচা গন্ধের অত্যন্ত কদর্য মিশেল। আজ হটাৎ খাওয়ার টেবিলে পাশে এসে দাঁড়াতেই তাজা রক্তের গন্ধটা নাকে এলো তার, ভীষন তীব্র আর গা গুলোনো। টেবিলের উপর সাজানো চিংড়ির মালাইকারী, চিকেন মাসালা, বেগুন ভাজা, ডিমের কষা আর ইলিশ পোলাও। আজ বাড়িতে অলকের অফিসের বস এসেছেন। নাহ.. তিনি আসেন নি আসলে বলা ভালো তাকে বহু কাঠ-খর পুড়িয়ে ঘরে আনতে পেরেছে অলোক অবশেষে। সামনেই তো প্রমোশনের সময়, এসময় বসদের একটু হাতে রাখতেই হয় আপন স্বার্থে। সারা সপ্তাহ নিজের কলেজের ডিউটি সেরে এসে রবিবারের এই ছুটির সারাটা দিন আজ তাই রান্নাঘরের ভেতরেই পার করতে হয়েছে তাকে। ঘেমে নেয়ে একসা হয়ে বের হতেই আবার অলোকের তাড়া ;
:যাও... যাও... দেরী করো না স্নান সেরে কাপড়টা বদলে ফেলো গিয়ে। স্যার এলেন বলে।
সবকিছু ঠিকই চলছিলো শুধু খাবার টেবিলে পরিবেশনের জন্য দাঁড়াতেই সেই কাঁচা রক্তের কুৎসিত
গন্ধে অন্নপ্রাশনের ভাত উগরে ওঠতে চাইলো তার গলা দিয়ে। কোনমতে দায়সাড়া গোছের আলাপচারিতা সেরে নিয়ে, খাবার পরিবেশনের দায়িত্বটা মহুয়ার উপর দিয়ে সে কোনক্রমে পালিয়ে এলো ওখান থেকে ওয়াশরুমের দিকে ছুটলো বমি করতে যাবার জন্য। কিন্তু কি অদ্ভুত ঐ রুমের বাইরে পা রাখতেই গন্ধটা হটাৎই একেবারে ভোজবাজির মতো উবে গেলো যেন।
রাতে শোবার সময় অলোকের গোমড়া মুখ আর অন্যপাশে ফিরে শোয়া দেখেই ও বুঝে গেল, বাবুর রাগ হয়েছে। রাগ ভাঙানোর জন্য বললো ;
: কি হলো শুনছো... সারাটা দিন এতো খাটা-খাটনি করে আয়োজন করলাম। তারপরও এমন মুখটা ভার করে আছ কেন?
: এতোটাই যখন কষ্ট করলে নিধি তাহলে শেষ মুহূর্তে পরিবেশনটা মহুয়াকে দিয়ে না করালেই কি চলছিলো না! স্যার ব্যাপারটা ভালো ভাবে নাও নিতে পারেন।।।
: আরে আর বোলো না, তোমার স্যার কে একটু বুঝিয়ে বোলো হটাৎ করেই তখন ভীষন বমি-বমি পাচ্ছিলো, তাই ফ্রেশ হবার জন্যই..
: কি গো কোন সুখবর আছে নাকি? তাকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়েই উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলো অলোক।
: না গো জানিনা এখনো সেরকম কিছু হলে তো বুঝতাম অন্তত। যদিও আজকাল প্রায়ই এমন হচ্ছে। ভাবছি একবার ডক্টরের কাছে যাবো।
: হ্যাঁ... একদম অবহেলা নয় নিজের প্রতি, পারলে কালই চলে যাও।
:আচ্ছা মশাই যাবো। এখন ঘুমিয়ে পড়ো অনেক রাত হয়েছে সারাদিন যা ঝক্কি গেছে আজ।
----------------------
পরদিন সকাল।
নামকরা গাইনোকোলোজিস্ট ডক্টর এস. কে. মিশ্রের চেম্বারের সামনে বসে আছে নিধি ডাক আসার অপেক্ষায়। একসময় ডাক এলো। ঘরের দরজার সামনে যেয়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই আবার কেমন একটা ব্বিচ্ছিরি গন্ধ নাকে এসে তার স্নায়ুটাকে অবশ করে দিলো যেন। গন্ধটা কেমন তা বর্ণনা দেবার মতো সাধ্যি তার নেই সেটা ঠিক। তবে মনে হচ্ছে কেমন করে যেন একটা পুরো জন্মের পাপ জমে স্তুপ হয়ে আছে এই ঘরটার ভেতর, এক কথায় নারকীয় একটা গন্ধ। ঠান্ডা এসির মাঝেও কেমন যেন গুমোট হাওয়ায় ভাসছে সেই দুর্গন্ধ । কিন্তু সবাই সবার মতো কাজ করে যাচ্ছে এরই ভেতর , কারো মাঝে কোন হেলদোল নেই। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সবার অবাক চোখের সামনে দিয়ে প্রায় ছুটেই পালিয়ে এলো সে সেখান থেকে।
-----------------------
দুপুর তিনটে।
ওর সাথে যা ঘটছে শেষ কটা দিন ধরে অলোক আসলে ওকে সবটা খুলে বলবে ঠিক করে রেখেছিলো নিধি। অলোক ফিরলো ভীষন থমথমে মুখ নিয়ে নির্ধারিত সময়ের অনেকটা আগেই। ওর মুখের দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলো সে। কিছু যে একটা হয়েছে তা তো নিশ্চিত। এক গ্লাস পানি ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে হালকা স্বরে প্রশ্ন করলো ;
: কি হয়েছে? এতো চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?
: জানো নিধি কাল আমাদের এখান থেকে ডিনার সেরে ফেরার পথে একটা মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে সুধীন স্যারের সাথে। একটা লরীর মুখোমুখি ধাক্কায় তার গাড়িটা পুরো উল্টে গিয়েছিলো।মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিলো ঠিকই। আজ দুপুর বারোটায় ক্লিনিক্যালি ডেড ঘোষণা করে দিয়েছে ডক্টররা। কি ভয়াবহ ব্যাপার বলো তো কাল রাত্রেই দুজনে একসাথে বসে খেলাম কতো কি বিষয়ে কথা বলছিলেন মানুষটা নেই....
অলোকের কথাগুলো শুনে এক অন্যরকম দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে রইলো নিধি...
------------------------
দুদিন পর।
টেবিলে রাতের খাবার সার্ভ করছিলো নিধি আর অলোক টেলিভিশনটা বেশ জোর ভলিয়ুমে ছেড়ে দিয়ে শুনছিলো নিউজ আপডেট গুলো। অলোককে ডিনারের জন্য ডাকতে যেতেই শুনতে পেল টেলিভিশনে সংবাদ পাঠিকা তখন পড়ে চলেছে আজকের ব্রেকিং নিউজ "বিখ্যাত গাইনোকোলোজিস্ট এস. কে. মিশ্রকে আজ গ্রেফতার করা হয়েছে তার প্রাইভেট ক্লিনিক থেকে৷ এতোদিন সেখানে মেটারনিটি কেসের নামে জনসেবা করার আড়ালে তার চাইতেও বেশি অবৈধ্য ভাবে মেয়েদের অ্যবরশন করতেন তিনি মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে। আজ সকাল দশটায় এক যুবকের কল আসে থানায়। যুবকটি জানান যে তার ভালোবাসার মানুষটিকে তার জীবন থেকে সরিয়ে নেবার জন্য তার পরিবারের লোকজন তাকে অমুক ক্লিনিকে নিয়ে গেছে, মেয়েটির প্রেগনেন্সির অলরেডি পাঁচ মাসের বেশি হয়ে গেছে। প্রেমিকাকে রক্ষা করার জন্য করা যুবকের সেই আর্তি ভরা কল পেয়ে ক্লিনিকে অভিযান চালায় পুলিশ সদস্যরা। আর সেখান থেকেই মেলে বৈধতার মুখোশের আড়ালে অবৈধ্য কারবারের সব তথ্য-প্রমাণ।
নিজের মুখে হাত চাপা দিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে নিধি।
-----------------------
পরদিন সকাল।
স্নান ঘর থেকে বের হয়ে অফিস যাবার জন্য রেডি হতে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই তীব্র পোড়া একটা গন্ধে স্নায়ু অবশ হয়ে এলো নিধির। পুরো ঘরটাই যেন ছেয়ে গেছে সেই তিক্ত গন্ধে। পাশেই নিজের অফিসের ফাইলে ডুবে আছে অলোক। ও ডাকলো ;
: অ্যাই শুনছো, তুমি কি কোন গন্ধ পাচ্ছো?
: গন্ধ...! কিসের গন্ধ! না তো কোন গন্ধ নেই তো... আমি নামলাম, তুমি রেডি হয়ে নিচে এসো। কাঁধে ব্যাগটা ফেলতে ফেলতে জবাব দিলো অলোক।
------------------------
সেদিন বিকেল।
আজ মেট্রোতে পাশের সিটের যাত্রীটির গতিবিধি বড্ড সন্দেহজনক। কালো চাদরে প্রায় ঢাকা শরীর। কেমন যেন জুবুথুবু হয়ে বসে আছে সেই কখন থেকে। বেশ কিছুক্ষণ খুটিয়ে খুটিয়ে লোকটাকে দেখার পরই হটাৎ ব্যাগের ভেতর রাখা সেলফোনটা ভাইব্রেট করে উঠতে দেখার আগ্রহটা হারিয়ে ফেললো নিধি। কলটা অলোকই করেছে, আজ ওদের আবার একটু বের হবার কথা আছে, অলোকেরই এক বন্ধুর ছেলের জন্মদিন আজ। সেখানেই যেতে হবে তাই মনে করিয়ে দিলো গিফট নেবার ব্যাপারটা। কি নেবে , কি পড়বে এসব নিয়েই টুকটাক কথা হচ্ছিলো অলোকের সাথে। ফোন কেটে পাশের সিটের দিকে তাকাতেই দেখলো সেই সন্দেহজনক যাত্রীটি কখন যেন চুপচাপ নেমে পড়েছে আগের স্টেশনে। তবে নামার সময় ভুলে তার ধুলোমাখা ব্যাগখানা ফেলে রেখে গেছেন শুন্য সিটটিতে। এদিক-সেদিক চোখ ঘুরিয়ে খুঁজলো ন্সে লোকটিকে। তার গচ্ছিত সম্পদটি ফিরিয়ে দেবার আশায় । এমন সময় ট্রেনের কামরায় একটা চাপা অস্থিরতা লক্ষ্য করে অবাক হয়ে গেল নিধি। সবাই কেমন নেমে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করছে একসাথে। বেশ খানিক্ষন এই ছোটাছোটি দেখার পর একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো ;
: এই যে দাদা, আচ্ছা কি হচ্ছে ব্যাপারটা বলুনতো চারপাশে এতো ছোটাছুটি কিসের?
: আরেহ দিদি, আপনি শোনেনি নাকি খবরটা, আজ একটু আগেই শেয়ালদহ পুলিশ স্টেশনে কল করে অজ্ঞাত কেউ নাকি হুমকী দিয়েছে' কিছুক্ষণের মধ্যে এই এলাকায় একটা বোম ব্লাস্ট হবে, পারলে ঠেকাতে। এজন্য এলাকা খালি করতে শুরু করেছে পুলিশ৷ কথাগুলো শুনতেই মুহূর্তের মধ্যে অনেকগুলো দৃশ্য খেলে যায় নিধির চোখের সামনে। সেদিন সন্ধ্যেয় প্রথমে রক্তের গন্ধ তারপর কার অ্যাক্সিডেন্টে সুধীন স্যারের মৃত্যু, তারপর ডক্টরের চেম্বারে পাপের নারকীয় গন্ধের পর ভ্রুণ হত্যার মতো নোংরা কেলেংকারী ফাঁস
হওয়া । আর আজ সকালে নিজের চারপাশে তীব্র পোড়া গন্ধ। হটাৎ খপ করে পাশের সিটের ব্যাগটা তুলে নিয়ে বুকে চেপে ধরে লাফিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়ে নিধি। কানে আসা হালকা টিকটিক শব্দ জানান দিচ্ছে সময়ের স্বল্পতাটুকু। ব্যাগটা বুকে চেপে ধরে দিগবিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে ছুটে বের হলো সে স্টেশন ছেড়ে। যত দ্রুত সম্ভব তাকে পৌঁছাতে হবে কোন একটা ফাঁকা জায়গায় যেখানে ক্ষতির পরিমাণটা অন্তত কিছুটা হলেও সামান্য হবে। আজ সকালে নিজের শরীরে পাওয়া সেই বিদঘুটে পোড়া গন্ধটুকু নাহয় শুধু ওর নিজের হয়েই থাক।
|| সমাপ্ত ||