10-06-2019, 07:23 PM
ছেলেটার নাম রাহুল।
এখানেও চমক। আমার মাসিক বন্ধ হয়েছে। শরীর মা হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। ডাক্তারও তাতে শিলমোহর লাগিয়ে দিয়েছে। আর পার্থর আমার যত্ন করাটা পাগলামির পর্যায়ে পৌঁছেছে। এরকম এক রাতে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর খেতে খেতে ও বলছিলো ছেলে হলে নাম রাখবো রাহুল, আর মেয়ে হলে নাম রাখবো রিয়া। ছোট্ট অথচ সুন্দর নাম। কথায় কথায় ওর সুন্দর ব্যাখইয়ায় মন ভরে যেত আর মনের ভারও যেন হাল্কা হয়ে যেত। ছোট্ট নাম রাখার কারন হিসেবে বলেছিলো, তাতে পুরো নাম লিখতে সুবিধে হয়। এই ধরো আমার নাম পার্থপ্রতিম ভট্টাচার্য্য। এটা কোন এগ্রিমেন্ট পেপারে পঞ্চাশ বার লিখতে হলে কি ব্যাথা। টাইটেল তো আর চেঞ্জ করতে পারবোনা, তাই নাম ছোট থাকাই বাঞ্ছনিয়। ছেলে মেয়ে অন্ততঃ গালি দেবে না।
মাসের প্রথম দিনেই রাহুল এসে উপস্থিত। সঙ্গি বলতে একটা ট্রলি ব্যাগ। কাধে ঝোলানো একটা ব্যাগ, একটা গিটার, একটা বেহালা, আকার জন্যে একটা স্ট্যান্ড আর গুচ্ছের রঙ তুলি। ব্যাচেলর যাকে বলে আর কি? বিছানা কোথায় জিজ্ঞেস করতে বললো নরম জিনিসে শোয়ার অভ্যেস নেই, কয়েকটা চাদর রয়েছে ব্যাগে। আর থিতু হলে কিনে নেবে।
অনেকদিন পরে বাড়িতে স্থায়ীভাবে কোন পুরুষমানুষ থাকছে। হোক না ভাড়া।
কিছুদিন কেটে গেলো, ওর উপস্থিতিতে অভস্ত্য হতে। যদিও ও রাহুল একদম নিজের মতই থাকে। বাড়িতে কেউ আছে বলে মনেই হয়না। নিচে গেটের আওয়াজ হলে বুঝতে পারি ও কোথাও বেড়োলো বা ঢুকলো। হয়তো সকালে কোথাও চা জলখাবার খেতে যায়। এরপর বেলার দিকে বাড়িয়ে যায় তারপর সেই রাতে ঢোকে। এখনো পর্যন্ত্য রিয়া ওকে দেখতে পায়নি। দুজনের সময় মেলেনা তাই। আর আমরাও ছাদে খুব একটা যায়না।
কিছুদিন আরো কেটে গেলো। আমিও সামলে নিয়েছি নিজের মনের মধ্যে পার্থর ডুপ্লিকেটের প্রভাবটা। নিজেকে খুব ছোট লাগছিলো ওকে দেখে এরকম প্রতিক্রিয়ার জন্যে। ওতো প্রায় আমার মেয়েরই বয়েসি।
পুজোর দিন ঘনিয়ে এসেছে। পাড়ায় পাড়ায় প্যান্ডেলে বাস পরেছে। এ পাড়ার পুজো খুব বড় হয়, সৌজন্যে অনুরাধা অ্যান্ড টিম। তাই এদের প্রস্তুতি অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে যায়। আমার বাড়ির আসেপাশে লাইটের খুটী পোঁতা হয়ে গেছে।
এর মধ্যে একদিন পাড়ার ছেলেরা এসে বায়না করলো যে আমাদের ছাদে ওরা একটা বিশেষ লাইটিং করতে চায়, অনুরাধা বিশেষ করে আমাকে বলতে বলেছে।
ওরা এসে মাপজোকও করে গেলো একদিন।
তার পরেরদিন সকালে দরজায় নক। দরজা খুলে দেখলাম রাহুল। গায়ের থেকে ভুর ভুর করে সিগেরেটের গন্ধ বেরোচ্ছে। হাল্কা হলুদ রঙের সুতির একটা কুর্তা পরেছে, নিচে চাপা জিন্স, সজত্নে লালিত হাল্কা পাতলা দাড়ির দৌলতে একটা কবি কবি, ভাবুক ভাবুক ভাব।
‘ম্যাডাম একটা কথা ছিলো’
‘হ্যা বলো।’
ইতস্তত করছে দেখে বুঝলাম ও কিছু অসুবিধের কথা বলতে এসেছে। তাই ওকে ভিতরে আসতে বললাম।
ঘরের ভিতরে রিয়া এখনো রাতের নাইটী ছারেনি। এই সময় একটা অপিরিচিত ছেলে ঘরে... আমি তাই একটু উচু স্বরেই ওকে ভিতরে আসতে বললাম।
ঢুকে দেখলাম রিয়া ভিতরের ঘরে সেঁধিয়ে গেছে। হয়তো পোষাক বদলাচ্ছে।
সোফায় ও বসেছে আমি ওর উলটোদিকের সোফায় বসেছি।
‘ম্যাডাম বলছিলাম যে, আমি তো পুজোর সময় বাড়ি যাবো না, আর ঘরের সামনেই এরকম লাইটিং... তো একটু অসুবিধে হতে পারে।’
‘ও হোঃ এটা তো ভাবিনি, আর পাড়ার ছেলেরা আবদার করলো।। বুঝতেই তো পারছো সবাইকে নিয়েই তো চলতে হয়। আর কয়েকটা দিনের তো ব্যাপার, আগে বুঝলে আমি ওদের বারন করে দিতাম।’
‘আসলে আমার মনে হয় ওরা কয়েকদিনের মধ্যেই এটা চালু করে দেবে। মাপজোক করার সময় ওদের কথাবার্তা শুনে যা মনে হোলো।’
‘ও তাই নাকি? আসলে এমন একজন অনুরোধ করেছে যে আমি আর নাও করতে পারবো না। তোমার যদি পড়াশুনোর অসুবিধে হয় তাহলে এখানে এসে করতে পারো আমার তো একটা ঘর ব্যাবহারই হয় না।’
‘না পড়াশুনোর ঠিক না, আসলে বেশিরভাগটাই তো কাচের, সারাক্ষন ঘরের মধ্যে আলো নাচানাচি করলে অসুবিধে তো হয়ই। যাই হোক আপনি বলে দিয়েছেন যখন তো আর কিছু করার নেই। আপনাকে অযথা বিরক্ত করলাম। কিছু মনে করবেন না প্লিজ।’
এর মধ্যে রিয়া এসে ঘরে ঢুকলো রাত পোষাক চেঞ্জ করে একটা পাজামা আর কুর্তি পরেছে। রিয়া এই প্রথম রাহুলকে দেখলো। ওর মুখ দেখে মনে হোলো না যে পার্থর সাথে কোন মিল ও পাচ্ছে। না পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কারন ওর জন্মের আগে থেকেই পার্থ গোঁফ রাখা শুরু করে আর দেহও ভারি ছিলো অনেক।
‘নমস্কার।’ রিয়া, রাহুলের উদ্দেশ্যে বললো।
‘নমস্কার।’
আমি রাহুলের সাথে রিয়ার পরিচয় করিয়ে দিলাম। রাহুল উঠতে যাচ্ছিলো, রিয়াই ওকে চা খেয়ে যেতে বললো। সত্যি আমরা এখনো সকালের চা খায়নি। সুবলাকে হেঁকে চা বসাতে বললাম।
‘আমার তো সকাল থেকে তিনবার চা হয়ে গেলো?’
রিয়া টোন করার মতন করে বললো ‘আপনি কি নাইট গার্ড দেন নাকি?’
‘নাতো কেন জিজ্ঞেস করছেন?’
‘এখন তো ৭.৩০ টা বাজে। এর মধ্যে তিনবার চা?’
‘সেটা বলতে পারেন, আমি যত রাতেই ঘুমাই না কেন, ভোর ভোর উঠে পরি, কিন্তু চায়ের দোকানে তিন বার চা খাওয়া মানে অনেক চা খেলাম বা অনেক সময় লাগলো সেরকম না, মাটির ভাঁরে চা, এমনিতেই তাড়াতাড়ি ঠান্ডা হয়ে যায়, তারওপর পরিমানে কম। আমার চায়ের নেশা আছে তাই ঘুরতে বেরিয়ে এপাশ ওপাশ চায়ের দোকান দেখলে এক পাত্র চা খেয়ে নি।’
‘ঘোরা মানে প্রাতভ্রমন? এক্সারসাইজ?’ রিয়া কৌতুহলি হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
‘নাঃ সেরকম কিছুই না। সকাল বেলা বাজারের ঘিঞ্জিটা থাকেনা, আর আপনাদের এই ঝিলটা অসাধারন দেখতে লাগে। আগে যেখানে থাকতাম সেখান থেকেও রোজ এখানেই আসতাম। সকালবেলা উঠলে দেখবেন মনটা কেমন সারাদিনের জন্যে তৈরি হয়ে যায়।’
রিয়া কেমন হাঁ করে ওর কথা গিলছিলো ছেলেটার বাচনভঙ্গি খুব সহজ এবং সাবলিল।
‘ম্যাডাম একটা অনুরোধ ছিলো’
নানা হাবিজাবি চিন্তায় দাড়ি টেনে জিজ্ঞেস করলাম ‘কি বলো’
‘আসলে আগের ভাড়া বাড়ির আশেপাশে গা ঘেষাঘেষি করে আর সব বাড়িগুলো ছিলো, তাই অনেকে অব্জেকশান করতো, আমি গীটার বা অন্যকিছু বাজালে। এখানে আশা করি সেরকম সমস্যা হবেনা।’
‘এতে জিজ্ঞেস করার কি আছে? আর সঙ্গিতচর্চাতেও কেউ বাধা দিতে পারে জানতাম না। এখানে সেরকম কোন লোক আছে বলে মনে হয়না। তুমি নিশ্চিন্তে করতে পারো।’
রিয়াও যেন আমার কথারই প্রতিফলন করলো।
আমি আর বসতে পারলাম না। দেরি হয়ে যাচ্ছে। রাহুল রিয়াকে ওদের মুর্শিদাবাদের বাড়ির নানান গল্প করে চলেছে।
কিছুক্ষন পরে রাহুল চলে গেলো কিন্তু ঘরে একটা খুসির ছাপ ফেলে। আমি দেখেছি এক একটা মানুষ খুব সহজেই তার প্রভাব বিস্তার করতে পারে। কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের বলে যায় রাশহাল্কা মানুষ। এরা হাসিখুসি, যেখানেই যায় খুসি বিলোতে চায়, তারা ঘরে এলে মনে হয় যেন সাতজন্মের পরিচিত, মনের মধ্যে ঘরের মধ্যে গোমড়া দুরুদুরু ভাবও এদের প্রভাবে হাল্কা হয়ে যায়। চারিদিক যেন শরতের রোদের আলোয় ঝলমল করে ওঠে। এরপর কি হবে, আবার সেই দিনগত পাপক্ষয় করতে হবে ভাবতে যে বিরক্তি হয় সেটা দূর হয়ে যায়।
এরপর কঠিন জীবন শুরু হবে। বাসন মাজা, সংসারের খুটিনাটী, রিয়ার কলেজ যাওয়ার ঝর, কিন্তু তাও মনে হচ্ছে একটা কথা বলার মত লোক পাওয়াও জীবনে অনেক। সম্পর্ক? সেটা ভাবা যাবে। এত তাড়া নেই।
রিয়ার মনেও কিছু প্রভাব পরেছে বুঝতে পারছি, বহু বহুদিন পরে আমাদের ঘরের মিউজিক সিস্টেমটা বেজে উঠলো। মেয়েলী কন্ঠে রবিন্দ্রসঙ্গিত ‘ভালোবাসি ... ভালোবাসি’
মন বলছে মেয়েকে বলি তাড়াহুরো করিস না। ভালোবাস ক্ষতি নেই, আগে বুঝে নে।
যাকগে। সম্পর্কের তাহলে একটা নাম হোলো।
এরপর রিয়ার পরের প্রস্তাব। মা চলো না কাল থেকে সকালে ঝিলের পার ধরে কিছুক্ষন ঘুরে আসি।
নিজেরই লজ্জা লাগছে। তবু ভালো লাগছে এই ভেবে, মেয়েটা নিজের জন্যে কিছু খুঁজে পেয়েছে। ভুল হলে সামলানোর জন্যে তো আমি আছিই।
মনটা অনেক হাল্কা লাগছে। নিজের মনেই এক অসম সম্পর্কের জাল তৈরি করে ফেলেছিলাম। ভাবছিলাম পার্থই হয়তো ফিরে এসেছে আমার কাছে। নিজের অধিকার বুঝে নিতে চাইছিলাম। তাই নিয়েই তৈরি হয়েছিলো এই মানসিক দ্বন্ধ, ঠিক আর ভুলের দাড়িপাল্লায় বিচার হচ্ছিলো না কোনদিক ভাড়ি। আজ সকালে রিয়াকে দেখে মনস্থির হোলো। ভাবছি কি ভুলভাল ভাবছিলাম। রিয়ারই তো ওকে দরকার।এটা তো ওদের বয়েস, নিজের মনের মতন সঙ্গি বেছে নেওয়ার। সত্যি বলতে ওর তো কেউ নেই। আমিও তো দ্বায়িত্ব সামলাতে সামলাতে ওর থেকে অনেক দূরে সরে গেছি।
লোকের মুখে শুনে জেনেছি, বা কোথাও পরেছি যে এমন সঙ্গীতও আছে যা বৃষ্টী নামিয়ে দেয়, সঙ্গীতের প্রভাবে ফুল ফোঁটে, সঙ্গীতের প্রভাবে অনেক কিছু হয়। মানুষকে কাঁদিয়ে দেওয়ার মতন এরকম সুর আমি শুনিনি। এটাও সঙ্গীতের ক্ষমতা। আমারই বাড়ির চিলেকোঠা থেকে সেই সঙ্গীত ভেসে আসছে। রাহুল বেহালা বাজাচ্ছে। কি বেদনা সেই সুরে। বুকের ভিতর মুচরে উঠছে, গলার কাছটা ভারি হয়ে আসছে। চুপ করে অন্ধকার ঘরে শুয়ে শুয়ে শুনছিলাম। রিয়া নিজের ঘরে ঘুমের কোলে ঢলে পরেছে অনেকক্ষণ।
আর পারলাম না। উঠে বসলাম। বারান্দায় বেতের চেয়ারটার ওপর বসলাম। এই সুর শুনে কি ঘুমোন যায়, কি সাঙ্ঘাতিক উদাস এই সুর। এইটুকু ছেলে কি অদ্ভুত এই সুর বাজাচ্ছে। কিছুই বুঝিনা তবু এতটুকু বলতে পারি, এই সুর অন্তর থেকে উঠে এসেছে, মনের বেদনা যেন বেহালার তারে আছড়ে পরছে। এত ভাড়ি সুর, এই বয়েসে, ব্যাথা না থাকলে, মনের গভিরতা না থাকলে কেউ কি বাজাতে পারে। চুপ করে বসে শুনতে শুনতে কখন ভেসে গেছি কল্পনার সাগরে।
‘ধুর পাগলি, ঠাকুর ভাসানের জন্যে আবার কেউ কাঁদে নাকি? মা চলে যাচ্ছে বলেই তো আসছে বছর আবার আসবে।’ পার্থ আমার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠা পিঠের ওপর স্নেহের হাত বুলিয়ে আমাকে বুঝিয়ে যাচ্ছিলো। আমার মনে হোতো দুর্গা ঠাকুরের ভাসান মানে সব শেষ। মা ছিলো, আনন্দ, খুশি, সুখ, হাসি সবার মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছিলো। মানুষ সারা বছরের কষ্ট ভুলে আনন্দে মেতে উঠেছিলো। ওই কদিন লাগাম ছাড়া, সারাক্ষন পুজো প্যান্ডেলে বন্ধুদের সাথে বসে থাকা, সুযোগ হলেই পার্থর সাথে চোখে চোখে কথা, সুযোগ হলেই পাড়ার বাইরে গিয়ে একটু কথা বলে আসা। মা চলে গেলো, আবার সেই বাবা মার বকা খাওয়া, গৃহবন্দি হয়ে থাকা, আবার চারপাশ অন্ধকার হয়ে যাওয়া। আবার একলা হয়ে যাওয়া।
‘আরে তুমি আর আমি দূরে থাকলেও সঙ্গে থাকবো সেটাই তো আনন্দ।’ মনে ধরেছিলো কথাটা আমার। সত্যি পার্থতো আছে। তাহলে মন খারাপ করছি কেন।
কিন্তু আজকে তো কেউ নেই আমার। রিয়া? সেও তো নিজের জগত নিয়ে ব্যস্ত। আমার তো নিজের কিছু নেই। মহাশুন্যের মধ্যে অবস্থান করছি যেন আমি। মাঝে মাঝে মনে হয় মরে গিয়ে ওর কাছে চলে যাই। আবার দুজনে একসাথে থাকতে পারবো। আবার ভাবি এ কেমন স্বার্থপরের মতন চিন্তাভাবনা। আমি চলে গেলে রিয়ার কি হবে। ও তো কোন দোষ করেনি?
সত্যি গলার কাছটা আটকে আসছে, আর সামলাতে পারলাম না, দুচোখ দিয়ে তিস্তা আর তোর্ষা নেমে এলো। আমি দুহাতে মুখ ঢেকে নিলাম। করুন সুরে বেহালা বেজে চলেছে এখনও। সাথি হারা মন, একাকিত্ব যেন বিশাল হাঁ করে আমাকে গিলতে আসছে। কখন সকাল হবে, আবার জীবন বইতে শুরু করবে। এই অন্ধকার, এই জীবন যেন আমাকে গ্রাস করতে আসছে।
ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেলো। সুবলা এসে দরজা নক করতে ধরফর করে উঠে বসলাম। প্রায় ৭টা বাজে।
‘কিগো দিদি শরীর খারাপ নাকি?’
‘নারে কাল রাতে ঘুমাতে দেরি হয়ে গেছিলো।’
‘সেতো রোজই হয়।’ সুবলা বোঝার চেষ্টা করছে আমার শরীর ঠিক আছে কিনা।
বিছানা থেকে নেমে জিজ্ঞেস করলাম ‘রিয়া উঠেছে?’
‘মেয়ে সকালবেলা হাঁটতে বেরিয়েছে, ওই নতুন দাদার সাথে।’
মনে মনে হাসলাম। এক দিনেই এত পরিবর্তন? যে মেয়েকে ঠেলে ঠেলে তুলতে হয় সে চলে গেলো প্রাতঃ ভ্রমনে।
রিয়া ফেরার পর থেকেই আমি ওর চোখে মুখের ঔজ্জল্য লক্ষ করছি। ভালোও লাগছে আবার ভয়ও হচ্ছে। যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে তো। ওপরের আস্তরনটাই কি মানুষের আসল রুপ? নাও তো হতে পারে। মায়ের মন তাই সাবধানী।
আমাকে কিছু একটা বলার জন্যে উসখুস করছে। আমি বুঝতে পেরেও ওকে সুজোগ দিচ্ছি না। ওর বয়েসে এই চাঞ্চল্যই স্বাভাবিক।
কলেজ যাওয়ার আগে ও রোজ রুটি খায়। আমি সামনে বসি। আমি জানতাম যে ও সু্যোগটা নেবে।
‘মা একটা কথা ছিলো’
‘হুম’
‘তোমারই উপকার হবে।’
‘তোর হবেনা?’ রিয়া একটু থতমত খেয়ে গেলো। কিন্তু তাতক্ষনিক। আবার বক্তব্য পেশ করা শুরু করলো।
‘আজকে সকালে রাহুলের সাথে দেখা হোলো, ঝিলের পাড়ে। অনেকক্ষণ কথা হোলো, একসাথেই বাড়ি ফিরলাম।’
আমি ওর মনের কথা বোঝার চেষ্টা করছি, তার সাথে পরের বাক্যগুলো আন্দাজ করছি। শুধু ছোট করে জিজ্ঞেস করলাম ‘তো?’
‘অনেক কথা জানতে পারলাম ওর সন্মন্ধে। বেচারা একটা কাজ খুজছে। বলছিলো হাতে যা টাকা আছে সেটা দিয়ে আর মাস দুয়েক হয়তো বাড়িভাড়া দিয়ে থাকতে পারবে।’
আমি অবাক ভাবটা লুকিয়ে নির্লিপ্ত ভাবে বললাম ‘কাজ কর্ম না করলে তো জমানো টাকা ফুরিয়েই যাবে’
‘নাগো, ওর সত্যি খুব টানাটানি চলছে, আমি নিজে দেখলাম, চায়ের দোকানে, সিগেরেটের দোকানে ওর খাতা খোলা আছে।’
‘তাতে কি হোলো। বাকিতে খেতে হলে তো খাতা চলবেই!’
‘আমাকে বলছিলো কিছু টিউশানি জোগার করে দিতে?’
‘ও’
‘আমি ভাবছিলাম, অনেক দিনের সখ, তুমি তো জানোই। যদি ওর কাছে শিখি তোমার কোন আপত্তি আছে।’
মায়ের মন ভাবছে, এত তাড়াতাড়ি ঘরে এন্ট্রি কি ঠিক? কিন্তু মুখে বললাম ‘তুই বড় হয়েছিস, সেটা তোর ইচ্ছে। আমি হ্যাঁ বা না বলে কি লাভ?’ পুরোপুরি নিজের ঘারে না নিয়ে, ওকেই কিছুটা দায়িত্ব দিলাম।
‘কালকে থেকেই শুরু করে দি? এখানে এসেই শেখাবে তাহলে’ রিয়া আমাকে আস্বস্ত করতে চাইছে যে ও ওর সাথে একা এক ঘরে বসে কিছু করবেনা।
আমি আনমনে উত্তর দিলাম ‘যা ভালো বুঝিস কর। আমি কোনোদিন তোর ব্যাপারে কিছু আপত্তি করিনি, আজও করবো না। এটা মন থেকে বললাম।’
‘মা একটা জিনিস ভাবছিলাম?’
‘আবার কি?’
‘ওতো আমাদের বাড়িতেই থাকছে... এমন তো হতে পারে যে, ও তোমার হোম ডেলিভারির কাজটা কিছুটা সামলালো তার বিনিময়ে তুমি ওকে মাইনে দিলে বা ভাড়ার সাথে এডজাস্ট করলে...’
কথাটা আমার মনে ধরলো। এই বাড়িতে থেকে ম্যানেজারি করলে সব থেকে ভালো। আমিও মনে মনে ভাবছিলাম এরকম কাউকে রাখার কথা। তবুও রিয়াকে বললাম ‘যে গীটার শেখায়, যে বেহালা বাজায় সে কি, এইসব কাজ উৎসাহ নিয়ে করবে?’
‘ওর একটা কাজ দরকার, মানে আমাকে ও বলছিলো, সেই জন্যে ও মরিয়া। নাহলে ওকে কলকাতা ছেড়ে ফিরে যেতে হবে নিজের পুরানো যায়গায়, যেটা ও চায়না। তাহলে আপত্তি থাকবে কেন? তাছারা এখানে থাকলে আমরা ওর ভাবগতিক বুঝে পেয়িং গেস্ট হিসেবেও রাখতে পারি, মানে খাওয়া দাওয়া নিয়েও ওকে চিন্তা করতে হবেনা। অথচ আমাদেরও ওনেক সুবিধে হবে।’
বুঝলাম মেয়ে অনেকদুর ভেবে নিয়েছে। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনের কথা বুঝতে চাইছি। মানে কতদুর ভেবেছে।
আমার মুখ দিয়ে শুধু বেরোলো ‘বলে দ্যাখ, যদি রাজি হয়, কয়েকদিন তো দেখাই যেতে পারে।’
রিয়া পারলে আনন্দে গেয়ে ওঠে, বুঝতেই পারা যাচ্ছে, মনের ভিতর থেকে উঠে আসা খুসির শ্রোতগুলোকে আটকাতে ওকে প্রচুর বেগ পেতে হচ্ছে।
বেলা হতে, পাড়ার ছেলেরা এসে হাজির ছাদে লাইট লাগাবে। সাথে দেখলাম, অনুরাধার ঘরে দেখা একটা ছেলে রয়েছে। আমাকে দেখে মুখ আড়াল করে নিতে চাইলো। আমিও দেখে না দেখার ভান করলাম। ওরা আজকে লাইট লাগিয়ে আজকের রাতটা টেস্ট করবে, আবার সামনের সপ্তাহ থেকে চালু করে দেবে।
ছাদের দরজা খোলাই ছিলো। আমাকে যেতে হোলো, কারন কোথায় লাগাবে সেটা দেখাবে ওরা। রাহুল এখন বাড়ি নেই। আমি ওদের বললাম, আলোটা যেন ঘরের দিকে কম পরে এমন ভাবে লাগাতে। পুরোপুরি না হলেও অনেকটাই আড়াল হবে আন্দাজ করা গেলো।
এরপর শুধু মিস্ত্রিরা রয়ে গেলো। যাওয়ার সময় একজন আমাকে বিনিত ভাবে বলে গেলো, জিনিসপত্র এলোমেলো না রাখতে। মিস্ত্রির জাত। চুরিটুরি করে নিয়ে গেলে কিছু করার থাকবেনা।
কি আর নেবে। রাহুলের ঘর তো তালা দেওয়া। আমাদের ঘরের বাইরে কয়েকটা জুতো রয়েছে শুধু, তাও চপ্পল। তালা ভেঙ্গে কিছু নিলে তো আর কিছু করার নেই।
ওরাও বললো না না সেরকম সাহস পাবেনা।
মিস্ত্রিগুলো সন্ধ্যে বেলা পর্যন্ত কাজ করলো। যাওয়ার সময় আমাকে বলে গেলো।
রিয়া এখনো ফেরেনি। আজকে ওর ক্লাস আছে, কলেজের পরে তাই দেরি হবে যে আমি জানি।
আমারও প্রায় রান্না শেষ।
রাতে হিসেব লিখতে বসে টুকটাক রিয়ার সাথে একটু কথা হোলো। ওর সারাদিনের দিনলিপি। আজকে ও একটু বেশিই কথা বলছে। অন্য সময় হলে কম্পিউটারে মুখ গুজে রাখে।
‘১১টা বাজে, আমি ঘুমোতে চললাম। আজকে সারাদিন কি ঘুম পাচ্ছে, সেই কাকভোরে উঠেছি’ হাই তুলতে তুলতে বললো।
আমি খাতা থেকে মুখ না সরিয়ে বললাম ‘তো উঠিস না। শরীরে কষ্ট দিয়ে সকালে উঠবি আর সারাদিন ঝিমোবি এটা আবার কিরকম কথা’ আমি ওকে বাজাতে চাইলাম।
‘ওঃ মা তুমি যদি সকালে বেরোতে বুঝতে। আমাদের এই ঝিলটাকে দেখলে মনে হবে রবিন্দ্রসরোবর লেকে এসে বসেছো, কত লোক যে ওখানে সকালের হাওয়া খেতে যায়, গুনে শেষ করতে পারবেনা। তুমি একদিন বেরোলে তোমারও রোজ রোজ বেরোতে ইচ্ছে করবে।’
‘দেখি আগে তোর নেশাটা কেমন চরে। আমার মা টাকে তো আজকে থেকে চিনিনা?’
ঘুমিয়ে পরেছিলাম সারাদিনের ক্লান্তিতে। কতরাত হয়েছে জানিনা গলা শুকিয়ে কাঠ, জল পিপাসায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো। অন্ধকারে সময় দেখতে পাচ্ছিনা, বেহালায় একটা করুন সুর বাতাসে ভেসে চলেছে। এখনও ঘুমোই নি ছেলেটা? সেই তো সকাল বেলা উঠে বেরিয়ে পরে। সারারাত কি ঘুমোয়না?
কান সেই সুরের দিকে। জলের বোতোলটা টেবিলের ওপর রেখে বিছানার ওপর বসলাম। ঘুমটা যেন হঠাত করেই উধাও হয়ে গেলো। ধির পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।
কি এত কষ্ট ছেলেটার? এই সুর কি যে সে বাজাতে পারে, অন্তরের ভিতর থেকে এর উতপত্তি না হলে?
রিয়াকে কি কিছু বলেছে? হয়তো আজ বলেনি, হয়তো বলবে। মা বাবা ছেরে, দুরদেশে পরে রয়েছে, মনের কষ্ট তো হতেই পারে। আর অল্পবয়েসি ছেলে হতেই পারে প্রেয়সি আছে বা ছিলো, তার থেকে দূরে আছে বলে হয়তো এত কষ্ট।
এখানেও চমক। আমার মাসিক বন্ধ হয়েছে। শরীর মা হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। ডাক্তারও তাতে শিলমোহর লাগিয়ে দিয়েছে। আর পার্থর আমার যত্ন করাটা পাগলামির পর্যায়ে পৌঁছেছে। এরকম এক রাতে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর খেতে খেতে ও বলছিলো ছেলে হলে নাম রাখবো রাহুল, আর মেয়ে হলে নাম রাখবো রিয়া। ছোট্ট অথচ সুন্দর নাম। কথায় কথায় ওর সুন্দর ব্যাখইয়ায় মন ভরে যেত আর মনের ভারও যেন হাল্কা হয়ে যেত। ছোট্ট নাম রাখার কারন হিসেবে বলেছিলো, তাতে পুরো নাম লিখতে সুবিধে হয়। এই ধরো আমার নাম পার্থপ্রতিম ভট্টাচার্য্য। এটা কোন এগ্রিমেন্ট পেপারে পঞ্চাশ বার লিখতে হলে কি ব্যাথা। টাইটেল তো আর চেঞ্জ করতে পারবোনা, তাই নাম ছোট থাকাই বাঞ্ছনিয়। ছেলে মেয়ে অন্ততঃ গালি দেবে না।
মাসের প্রথম দিনেই রাহুল এসে উপস্থিত। সঙ্গি বলতে একটা ট্রলি ব্যাগ। কাধে ঝোলানো একটা ব্যাগ, একটা গিটার, একটা বেহালা, আকার জন্যে একটা স্ট্যান্ড আর গুচ্ছের রঙ তুলি। ব্যাচেলর যাকে বলে আর কি? বিছানা কোথায় জিজ্ঞেস করতে বললো নরম জিনিসে শোয়ার অভ্যেস নেই, কয়েকটা চাদর রয়েছে ব্যাগে। আর থিতু হলে কিনে নেবে।
অনেকদিন পরে বাড়িতে স্থায়ীভাবে কোন পুরুষমানুষ থাকছে। হোক না ভাড়া।
কিছুদিন কেটে গেলো, ওর উপস্থিতিতে অভস্ত্য হতে। যদিও ও রাহুল একদম নিজের মতই থাকে। বাড়িতে কেউ আছে বলে মনেই হয়না। নিচে গেটের আওয়াজ হলে বুঝতে পারি ও কোথাও বেড়োলো বা ঢুকলো। হয়তো সকালে কোথাও চা জলখাবার খেতে যায়। এরপর বেলার দিকে বাড়িয়ে যায় তারপর সেই রাতে ঢোকে। এখনো পর্যন্ত্য রিয়া ওকে দেখতে পায়নি। দুজনের সময় মেলেনা তাই। আর আমরাও ছাদে খুব একটা যায়না।
কিছুদিন আরো কেটে গেলো। আমিও সামলে নিয়েছি নিজের মনের মধ্যে পার্থর ডুপ্লিকেটের প্রভাবটা। নিজেকে খুব ছোট লাগছিলো ওকে দেখে এরকম প্রতিক্রিয়ার জন্যে। ওতো প্রায় আমার মেয়েরই বয়েসি।
পুজোর দিন ঘনিয়ে এসেছে। পাড়ায় পাড়ায় প্যান্ডেলে বাস পরেছে। এ পাড়ার পুজো খুব বড় হয়, সৌজন্যে অনুরাধা অ্যান্ড টিম। তাই এদের প্রস্তুতি অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে যায়। আমার বাড়ির আসেপাশে লাইটের খুটী পোঁতা হয়ে গেছে।
এর মধ্যে একদিন পাড়ার ছেলেরা এসে বায়না করলো যে আমাদের ছাদে ওরা একটা বিশেষ লাইটিং করতে চায়, অনুরাধা বিশেষ করে আমাকে বলতে বলেছে।
ওরা এসে মাপজোকও করে গেলো একদিন।
তার পরেরদিন সকালে দরজায় নক। দরজা খুলে দেখলাম রাহুল। গায়ের থেকে ভুর ভুর করে সিগেরেটের গন্ধ বেরোচ্ছে। হাল্কা হলুদ রঙের সুতির একটা কুর্তা পরেছে, নিচে চাপা জিন্স, সজত্নে লালিত হাল্কা পাতলা দাড়ির দৌলতে একটা কবি কবি, ভাবুক ভাবুক ভাব।
‘ম্যাডাম একটা কথা ছিলো’
‘হ্যা বলো।’
ইতস্তত করছে দেখে বুঝলাম ও কিছু অসুবিধের কথা বলতে এসেছে। তাই ওকে ভিতরে আসতে বললাম।
ঘরের ভিতরে রিয়া এখনো রাতের নাইটী ছারেনি। এই সময় একটা অপিরিচিত ছেলে ঘরে... আমি তাই একটু উচু স্বরেই ওকে ভিতরে আসতে বললাম।
ঢুকে দেখলাম রিয়া ভিতরের ঘরে সেঁধিয়ে গেছে। হয়তো পোষাক বদলাচ্ছে।
সোফায় ও বসেছে আমি ওর উলটোদিকের সোফায় বসেছি।
‘ম্যাডাম বলছিলাম যে, আমি তো পুজোর সময় বাড়ি যাবো না, আর ঘরের সামনেই এরকম লাইটিং... তো একটু অসুবিধে হতে পারে।’
‘ও হোঃ এটা তো ভাবিনি, আর পাড়ার ছেলেরা আবদার করলো।। বুঝতেই তো পারছো সবাইকে নিয়েই তো চলতে হয়। আর কয়েকটা দিনের তো ব্যাপার, আগে বুঝলে আমি ওদের বারন করে দিতাম।’
‘আসলে আমার মনে হয় ওরা কয়েকদিনের মধ্যেই এটা চালু করে দেবে। মাপজোক করার সময় ওদের কথাবার্তা শুনে যা মনে হোলো।’
‘ও তাই নাকি? আসলে এমন একজন অনুরোধ করেছে যে আমি আর নাও করতে পারবো না। তোমার যদি পড়াশুনোর অসুবিধে হয় তাহলে এখানে এসে করতে পারো আমার তো একটা ঘর ব্যাবহারই হয় না।’
‘না পড়াশুনোর ঠিক না, আসলে বেশিরভাগটাই তো কাচের, সারাক্ষন ঘরের মধ্যে আলো নাচানাচি করলে অসুবিধে তো হয়ই। যাই হোক আপনি বলে দিয়েছেন যখন তো আর কিছু করার নেই। আপনাকে অযথা বিরক্ত করলাম। কিছু মনে করবেন না প্লিজ।’
এর মধ্যে রিয়া এসে ঘরে ঢুকলো রাত পোষাক চেঞ্জ করে একটা পাজামা আর কুর্তি পরেছে। রিয়া এই প্রথম রাহুলকে দেখলো। ওর মুখ দেখে মনে হোলো না যে পার্থর সাথে কোন মিল ও পাচ্ছে। না পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কারন ওর জন্মের আগে থেকেই পার্থ গোঁফ রাখা শুরু করে আর দেহও ভারি ছিলো অনেক।
‘নমস্কার।’ রিয়া, রাহুলের উদ্দেশ্যে বললো।
‘নমস্কার।’
আমি রাহুলের সাথে রিয়ার পরিচয় করিয়ে দিলাম। রাহুল উঠতে যাচ্ছিলো, রিয়াই ওকে চা খেয়ে যেতে বললো। সত্যি আমরা এখনো সকালের চা খায়নি। সুবলাকে হেঁকে চা বসাতে বললাম।
‘আমার তো সকাল থেকে তিনবার চা হয়ে গেলো?’
রিয়া টোন করার মতন করে বললো ‘আপনি কি নাইট গার্ড দেন নাকি?’
‘নাতো কেন জিজ্ঞেস করছেন?’
‘এখন তো ৭.৩০ টা বাজে। এর মধ্যে তিনবার চা?’
‘সেটা বলতে পারেন, আমি যত রাতেই ঘুমাই না কেন, ভোর ভোর উঠে পরি, কিন্তু চায়ের দোকানে তিন বার চা খাওয়া মানে অনেক চা খেলাম বা অনেক সময় লাগলো সেরকম না, মাটির ভাঁরে চা, এমনিতেই তাড়াতাড়ি ঠান্ডা হয়ে যায়, তারওপর পরিমানে কম। আমার চায়ের নেশা আছে তাই ঘুরতে বেরিয়ে এপাশ ওপাশ চায়ের দোকান দেখলে এক পাত্র চা খেয়ে নি।’
‘ঘোরা মানে প্রাতভ্রমন? এক্সারসাইজ?’ রিয়া কৌতুহলি হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
‘নাঃ সেরকম কিছুই না। সকাল বেলা বাজারের ঘিঞ্জিটা থাকেনা, আর আপনাদের এই ঝিলটা অসাধারন দেখতে লাগে। আগে যেখানে থাকতাম সেখান থেকেও রোজ এখানেই আসতাম। সকালবেলা উঠলে দেখবেন মনটা কেমন সারাদিনের জন্যে তৈরি হয়ে যায়।’
রিয়া কেমন হাঁ করে ওর কথা গিলছিলো ছেলেটার বাচনভঙ্গি খুব সহজ এবং সাবলিল।
‘ম্যাডাম একটা অনুরোধ ছিলো’
নানা হাবিজাবি চিন্তায় দাড়ি টেনে জিজ্ঞেস করলাম ‘কি বলো’
‘আসলে আগের ভাড়া বাড়ির আশেপাশে গা ঘেষাঘেষি করে আর সব বাড়িগুলো ছিলো, তাই অনেকে অব্জেকশান করতো, আমি গীটার বা অন্যকিছু বাজালে। এখানে আশা করি সেরকম সমস্যা হবেনা।’
‘এতে জিজ্ঞেস করার কি আছে? আর সঙ্গিতচর্চাতেও কেউ বাধা দিতে পারে জানতাম না। এখানে সেরকম কোন লোক আছে বলে মনে হয়না। তুমি নিশ্চিন্তে করতে পারো।’
রিয়াও যেন আমার কথারই প্রতিফলন করলো।
আমি আর বসতে পারলাম না। দেরি হয়ে যাচ্ছে। রাহুল রিয়াকে ওদের মুর্শিদাবাদের বাড়ির নানান গল্প করে চলেছে।
কিছুক্ষন পরে রাহুল চলে গেলো কিন্তু ঘরে একটা খুসির ছাপ ফেলে। আমি দেখেছি এক একটা মানুষ খুব সহজেই তার প্রভাব বিস্তার করতে পারে। কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের বলে যায় রাশহাল্কা মানুষ। এরা হাসিখুসি, যেখানেই যায় খুসি বিলোতে চায়, তারা ঘরে এলে মনে হয় যেন সাতজন্মের পরিচিত, মনের মধ্যে ঘরের মধ্যে গোমড়া দুরুদুরু ভাবও এদের প্রভাবে হাল্কা হয়ে যায়। চারিদিক যেন শরতের রোদের আলোয় ঝলমল করে ওঠে। এরপর কি হবে, আবার সেই দিনগত পাপক্ষয় করতে হবে ভাবতে যে বিরক্তি হয় সেটা দূর হয়ে যায়।
এরপর কঠিন জীবন শুরু হবে। বাসন মাজা, সংসারের খুটিনাটী, রিয়ার কলেজ যাওয়ার ঝর, কিন্তু তাও মনে হচ্ছে একটা কথা বলার মত লোক পাওয়াও জীবনে অনেক। সম্পর্ক? সেটা ভাবা যাবে। এত তাড়া নেই।
রিয়ার মনেও কিছু প্রভাব পরেছে বুঝতে পারছি, বহু বহুদিন পরে আমাদের ঘরের মিউজিক সিস্টেমটা বেজে উঠলো। মেয়েলী কন্ঠে রবিন্দ্রসঙ্গিত ‘ভালোবাসি ... ভালোবাসি’
মন বলছে মেয়েকে বলি তাড়াহুরো করিস না। ভালোবাস ক্ষতি নেই, আগে বুঝে নে।
যাকগে। সম্পর্কের তাহলে একটা নাম হোলো।
এরপর রিয়ার পরের প্রস্তাব। মা চলো না কাল থেকে সকালে ঝিলের পার ধরে কিছুক্ষন ঘুরে আসি।
নিজেরই লজ্জা লাগছে। তবু ভালো লাগছে এই ভেবে, মেয়েটা নিজের জন্যে কিছু খুঁজে পেয়েছে। ভুল হলে সামলানোর জন্যে তো আমি আছিই।
মনটা অনেক হাল্কা লাগছে। নিজের মনেই এক অসম সম্পর্কের জাল তৈরি করে ফেলেছিলাম। ভাবছিলাম পার্থই হয়তো ফিরে এসেছে আমার কাছে। নিজের অধিকার বুঝে নিতে চাইছিলাম। তাই নিয়েই তৈরি হয়েছিলো এই মানসিক দ্বন্ধ, ঠিক আর ভুলের দাড়িপাল্লায় বিচার হচ্ছিলো না কোনদিক ভাড়ি। আজ সকালে রিয়াকে দেখে মনস্থির হোলো। ভাবছি কি ভুলভাল ভাবছিলাম। রিয়ারই তো ওকে দরকার।এটা তো ওদের বয়েস, নিজের মনের মতন সঙ্গি বেছে নেওয়ার। সত্যি বলতে ওর তো কেউ নেই। আমিও তো দ্বায়িত্ব সামলাতে সামলাতে ওর থেকে অনেক দূরে সরে গেছি।
লোকের মুখে শুনে জেনেছি, বা কোথাও পরেছি যে এমন সঙ্গীতও আছে যা বৃষ্টী নামিয়ে দেয়, সঙ্গীতের প্রভাবে ফুল ফোঁটে, সঙ্গীতের প্রভাবে অনেক কিছু হয়। মানুষকে কাঁদিয়ে দেওয়ার মতন এরকম সুর আমি শুনিনি। এটাও সঙ্গীতের ক্ষমতা। আমারই বাড়ির চিলেকোঠা থেকে সেই সঙ্গীত ভেসে আসছে। রাহুল বেহালা বাজাচ্ছে। কি বেদনা সেই সুরে। বুকের ভিতর মুচরে উঠছে, গলার কাছটা ভারি হয়ে আসছে। চুপ করে অন্ধকার ঘরে শুয়ে শুয়ে শুনছিলাম। রিয়া নিজের ঘরে ঘুমের কোলে ঢলে পরেছে অনেকক্ষণ।
আর পারলাম না। উঠে বসলাম। বারান্দায় বেতের চেয়ারটার ওপর বসলাম। এই সুর শুনে কি ঘুমোন যায়, কি সাঙ্ঘাতিক উদাস এই সুর। এইটুকু ছেলে কি অদ্ভুত এই সুর বাজাচ্ছে। কিছুই বুঝিনা তবু এতটুকু বলতে পারি, এই সুর অন্তর থেকে উঠে এসেছে, মনের বেদনা যেন বেহালার তারে আছড়ে পরছে। এত ভাড়ি সুর, এই বয়েসে, ব্যাথা না থাকলে, মনের গভিরতা না থাকলে কেউ কি বাজাতে পারে। চুপ করে বসে শুনতে শুনতে কখন ভেসে গেছি কল্পনার সাগরে।
‘ধুর পাগলি, ঠাকুর ভাসানের জন্যে আবার কেউ কাঁদে নাকি? মা চলে যাচ্ছে বলেই তো আসছে বছর আবার আসবে।’ পার্থ আমার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠা পিঠের ওপর স্নেহের হাত বুলিয়ে আমাকে বুঝিয়ে যাচ্ছিলো। আমার মনে হোতো দুর্গা ঠাকুরের ভাসান মানে সব শেষ। মা ছিলো, আনন্দ, খুশি, সুখ, হাসি সবার মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছিলো। মানুষ সারা বছরের কষ্ট ভুলে আনন্দে মেতে উঠেছিলো। ওই কদিন লাগাম ছাড়া, সারাক্ষন পুজো প্যান্ডেলে বন্ধুদের সাথে বসে থাকা, সুযোগ হলেই পার্থর সাথে চোখে চোখে কথা, সুযোগ হলেই পাড়ার বাইরে গিয়ে একটু কথা বলে আসা। মা চলে গেলো, আবার সেই বাবা মার বকা খাওয়া, গৃহবন্দি হয়ে থাকা, আবার চারপাশ অন্ধকার হয়ে যাওয়া। আবার একলা হয়ে যাওয়া।
‘আরে তুমি আর আমি দূরে থাকলেও সঙ্গে থাকবো সেটাই তো আনন্দ।’ মনে ধরেছিলো কথাটা আমার। সত্যি পার্থতো আছে। তাহলে মন খারাপ করছি কেন।
কিন্তু আজকে তো কেউ নেই আমার। রিয়া? সেও তো নিজের জগত নিয়ে ব্যস্ত। আমার তো নিজের কিছু নেই। মহাশুন্যের মধ্যে অবস্থান করছি যেন আমি। মাঝে মাঝে মনে হয় মরে গিয়ে ওর কাছে চলে যাই। আবার দুজনে একসাথে থাকতে পারবো। আবার ভাবি এ কেমন স্বার্থপরের মতন চিন্তাভাবনা। আমি চলে গেলে রিয়ার কি হবে। ও তো কোন দোষ করেনি?
সত্যি গলার কাছটা আটকে আসছে, আর সামলাতে পারলাম না, দুচোখ দিয়ে তিস্তা আর তোর্ষা নেমে এলো। আমি দুহাতে মুখ ঢেকে নিলাম। করুন সুরে বেহালা বেজে চলেছে এখনও। সাথি হারা মন, একাকিত্ব যেন বিশাল হাঁ করে আমাকে গিলতে আসছে। কখন সকাল হবে, আবার জীবন বইতে শুরু করবে। এই অন্ধকার, এই জীবন যেন আমাকে গ্রাস করতে আসছে।
ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেলো। সুবলা এসে দরজা নক করতে ধরফর করে উঠে বসলাম। প্রায় ৭টা বাজে।
‘কিগো দিদি শরীর খারাপ নাকি?’
‘নারে কাল রাতে ঘুমাতে দেরি হয়ে গেছিলো।’
‘সেতো রোজই হয়।’ সুবলা বোঝার চেষ্টা করছে আমার শরীর ঠিক আছে কিনা।
বিছানা থেকে নেমে জিজ্ঞেস করলাম ‘রিয়া উঠেছে?’
‘মেয়ে সকালবেলা হাঁটতে বেরিয়েছে, ওই নতুন দাদার সাথে।’
মনে মনে হাসলাম। এক দিনেই এত পরিবর্তন? যে মেয়েকে ঠেলে ঠেলে তুলতে হয় সে চলে গেলো প্রাতঃ ভ্রমনে।
রিয়া ফেরার পর থেকেই আমি ওর চোখে মুখের ঔজ্জল্য লক্ষ করছি। ভালোও লাগছে আবার ভয়ও হচ্ছে। যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে তো। ওপরের আস্তরনটাই কি মানুষের আসল রুপ? নাও তো হতে পারে। মায়ের মন তাই সাবধানী।
আমাকে কিছু একটা বলার জন্যে উসখুস করছে। আমি বুঝতে পেরেও ওকে সুজোগ দিচ্ছি না। ওর বয়েসে এই চাঞ্চল্যই স্বাভাবিক।
কলেজ যাওয়ার আগে ও রোজ রুটি খায়। আমি সামনে বসি। আমি জানতাম যে ও সু্যোগটা নেবে।
‘মা একটা কথা ছিলো’
‘হুম’
‘তোমারই উপকার হবে।’
‘তোর হবেনা?’ রিয়া একটু থতমত খেয়ে গেলো। কিন্তু তাতক্ষনিক। আবার বক্তব্য পেশ করা শুরু করলো।
‘আজকে সকালে রাহুলের সাথে দেখা হোলো, ঝিলের পাড়ে। অনেকক্ষণ কথা হোলো, একসাথেই বাড়ি ফিরলাম।’
আমি ওর মনের কথা বোঝার চেষ্টা করছি, তার সাথে পরের বাক্যগুলো আন্দাজ করছি। শুধু ছোট করে জিজ্ঞেস করলাম ‘তো?’
‘অনেক কথা জানতে পারলাম ওর সন্মন্ধে। বেচারা একটা কাজ খুজছে। বলছিলো হাতে যা টাকা আছে সেটা দিয়ে আর মাস দুয়েক হয়তো বাড়িভাড়া দিয়ে থাকতে পারবে।’
আমি অবাক ভাবটা লুকিয়ে নির্লিপ্ত ভাবে বললাম ‘কাজ কর্ম না করলে তো জমানো টাকা ফুরিয়েই যাবে’
‘নাগো, ওর সত্যি খুব টানাটানি চলছে, আমি নিজে দেখলাম, চায়ের দোকানে, সিগেরেটের দোকানে ওর খাতা খোলা আছে।’
‘তাতে কি হোলো। বাকিতে খেতে হলে তো খাতা চলবেই!’
‘আমাকে বলছিলো কিছু টিউশানি জোগার করে দিতে?’
‘ও’
‘আমি ভাবছিলাম, অনেক দিনের সখ, তুমি তো জানোই। যদি ওর কাছে শিখি তোমার কোন আপত্তি আছে।’
মায়ের মন ভাবছে, এত তাড়াতাড়ি ঘরে এন্ট্রি কি ঠিক? কিন্তু মুখে বললাম ‘তুই বড় হয়েছিস, সেটা তোর ইচ্ছে। আমি হ্যাঁ বা না বলে কি লাভ?’ পুরোপুরি নিজের ঘারে না নিয়ে, ওকেই কিছুটা দায়িত্ব দিলাম।
‘কালকে থেকেই শুরু করে দি? এখানে এসেই শেখাবে তাহলে’ রিয়া আমাকে আস্বস্ত করতে চাইছে যে ও ওর সাথে একা এক ঘরে বসে কিছু করবেনা।
আমি আনমনে উত্তর দিলাম ‘যা ভালো বুঝিস কর। আমি কোনোদিন তোর ব্যাপারে কিছু আপত্তি করিনি, আজও করবো না। এটা মন থেকে বললাম।’
‘মা একটা জিনিস ভাবছিলাম?’
‘আবার কি?’
‘ওতো আমাদের বাড়িতেই থাকছে... এমন তো হতে পারে যে, ও তোমার হোম ডেলিভারির কাজটা কিছুটা সামলালো তার বিনিময়ে তুমি ওকে মাইনে দিলে বা ভাড়ার সাথে এডজাস্ট করলে...’
কথাটা আমার মনে ধরলো। এই বাড়িতে থেকে ম্যানেজারি করলে সব থেকে ভালো। আমিও মনে মনে ভাবছিলাম এরকম কাউকে রাখার কথা। তবুও রিয়াকে বললাম ‘যে গীটার শেখায়, যে বেহালা বাজায় সে কি, এইসব কাজ উৎসাহ নিয়ে করবে?’
‘ওর একটা কাজ দরকার, মানে আমাকে ও বলছিলো, সেই জন্যে ও মরিয়া। নাহলে ওকে কলকাতা ছেড়ে ফিরে যেতে হবে নিজের পুরানো যায়গায়, যেটা ও চায়না। তাহলে আপত্তি থাকবে কেন? তাছারা এখানে থাকলে আমরা ওর ভাবগতিক বুঝে পেয়িং গেস্ট হিসেবেও রাখতে পারি, মানে খাওয়া দাওয়া নিয়েও ওকে চিন্তা করতে হবেনা। অথচ আমাদেরও ওনেক সুবিধে হবে।’
বুঝলাম মেয়ে অনেকদুর ভেবে নিয়েছে। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনের কথা বুঝতে চাইছি। মানে কতদুর ভেবেছে।
আমার মুখ দিয়ে শুধু বেরোলো ‘বলে দ্যাখ, যদি রাজি হয়, কয়েকদিন তো দেখাই যেতে পারে।’
রিয়া পারলে আনন্দে গেয়ে ওঠে, বুঝতেই পারা যাচ্ছে, মনের ভিতর থেকে উঠে আসা খুসির শ্রোতগুলোকে আটকাতে ওকে প্রচুর বেগ পেতে হচ্ছে।
বেলা হতে, পাড়ার ছেলেরা এসে হাজির ছাদে লাইট লাগাবে। সাথে দেখলাম, অনুরাধার ঘরে দেখা একটা ছেলে রয়েছে। আমাকে দেখে মুখ আড়াল করে নিতে চাইলো। আমিও দেখে না দেখার ভান করলাম। ওরা আজকে লাইট লাগিয়ে আজকের রাতটা টেস্ট করবে, আবার সামনের সপ্তাহ থেকে চালু করে দেবে।
ছাদের দরজা খোলাই ছিলো। আমাকে যেতে হোলো, কারন কোথায় লাগাবে সেটা দেখাবে ওরা। রাহুল এখন বাড়ি নেই। আমি ওদের বললাম, আলোটা যেন ঘরের দিকে কম পরে এমন ভাবে লাগাতে। পুরোপুরি না হলেও অনেকটাই আড়াল হবে আন্দাজ করা গেলো।
এরপর শুধু মিস্ত্রিরা রয়ে গেলো। যাওয়ার সময় একজন আমাকে বিনিত ভাবে বলে গেলো, জিনিসপত্র এলোমেলো না রাখতে। মিস্ত্রির জাত। চুরিটুরি করে নিয়ে গেলে কিছু করার থাকবেনা।
কি আর নেবে। রাহুলের ঘর তো তালা দেওয়া। আমাদের ঘরের বাইরে কয়েকটা জুতো রয়েছে শুধু, তাও চপ্পল। তালা ভেঙ্গে কিছু নিলে তো আর কিছু করার নেই।
ওরাও বললো না না সেরকম সাহস পাবেনা।
মিস্ত্রিগুলো সন্ধ্যে বেলা পর্যন্ত কাজ করলো। যাওয়ার সময় আমাকে বলে গেলো।
রিয়া এখনো ফেরেনি। আজকে ওর ক্লাস আছে, কলেজের পরে তাই দেরি হবে যে আমি জানি।
আমারও প্রায় রান্না শেষ।
রাতে হিসেব লিখতে বসে টুকটাক রিয়ার সাথে একটু কথা হোলো। ওর সারাদিনের দিনলিপি। আজকে ও একটু বেশিই কথা বলছে। অন্য সময় হলে কম্পিউটারে মুখ গুজে রাখে।
‘১১টা বাজে, আমি ঘুমোতে চললাম। আজকে সারাদিন কি ঘুম পাচ্ছে, সেই কাকভোরে উঠেছি’ হাই তুলতে তুলতে বললো।
আমি খাতা থেকে মুখ না সরিয়ে বললাম ‘তো উঠিস না। শরীরে কষ্ট দিয়ে সকালে উঠবি আর সারাদিন ঝিমোবি এটা আবার কিরকম কথা’ আমি ওকে বাজাতে চাইলাম।
‘ওঃ মা তুমি যদি সকালে বেরোতে বুঝতে। আমাদের এই ঝিলটাকে দেখলে মনে হবে রবিন্দ্রসরোবর লেকে এসে বসেছো, কত লোক যে ওখানে সকালের হাওয়া খেতে যায়, গুনে শেষ করতে পারবেনা। তুমি একদিন বেরোলে তোমারও রোজ রোজ বেরোতে ইচ্ছে করবে।’
‘দেখি আগে তোর নেশাটা কেমন চরে। আমার মা টাকে তো আজকে থেকে চিনিনা?’
ঘুমিয়ে পরেছিলাম সারাদিনের ক্লান্তিতে। কতরাত হয়েছে জানিনা গলা শুকিয়ে কাঠ, জল পিপাসায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো। অন্ধকারে সময় দেখতে পাচ্ছিনা, বেহালায় একটা করুন সুর বাতাসে ভেসে চলেছে। এখনও ঘুমোই নি ছেলেটা? সেই তো সকাল বেলা উঠে বেরিয়ে পরে। সারারাত কি ঘুমোয়না?
কান সেই সুরের দিকে। জলের বোতোলটা টেবিলের ওপর রেখে বিছানার ওপর বসলাম। ঘুমটা যেন হঠাত করেই উধাও হয়ে গেলো। ধির পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।
কি এত কষ্ট ছেলেটার? এই সুর কি যে সে বাজাতে পারে, অন্তরের ভিতর থেকে এর উতপত্তি না হলে?
রিয়াকে কি কিছু বলেছে? হয়তো আজ বলেনি, হয়তো বলবে। মা বাবা ছেরে, দুরদেশে পরে রয়েছে, মনের কষ্ট তো হতেই পারে। আর অল্পবয়েসি ছেলে হতেই পারে প্রেয়সি আছে বা ছিলো, তার থেকে দূরে আছে বলে হয়তো এত কষ্ট।