10-06-2019, 07:16 PM
কয়েকবছর কেটে গেলো, নিরলস পরিশ্রমের ফলে কিছু সঞ্চয় হোলো। পার্থ একবার বলেছিলো যে ছাদের ওপর একটা ঘর বানাবে। জানালা গুলো হবে কাঁচের। যাতে ঘরের বাইরের রোদ বৃষ্টি সব ভালো করে বোঝা যায়। আমিও মত দিয়েছিলাম। প্ল্যান ছিলো বিয়ের পঁচিশ বছরে ওই ঘরেই আবার ফুলসজ্জা করবো। কাচের জানালা দেখতে খুব ভালো লাগে। খুব ভালো আলো ঢোকে।
দেরি না করে সে কাজেও হাত দিয়ে দিলাম।
ছাদ ঢালাইয়ের মুখে এক বিপত্তি এসে জুটলো। বাড়িতে পুলিশ হাজির। যা তৈরি করেছি ভেঙ্গে দিতে হবে, এটা বেআইনি নির্মান। ওরা আমাকে থানায় দেখা করতে বলে চলে গেলো।
একা মেয়েমানুষ, মেয়ে তখন বাড়ি নেই। অগত্যা পার্থর এক বন্ধুকে সঙ্গে করে নিয়ে থানায় হাজির হোলাম। কিছুক্ষন অপেক্ষার পর ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের দেখা পেলাম। মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসলাম আমরা দুজন।
আড় চোখে লক্ষ্য করলাম অফিসারটার কুৎসিত নজর আমার বুকের ওপর নির্লজ্জ্য ভাবে ঘোরাফেরা করছে।
অনেক কাকুতিমিনতি তোষামোদেও কাজ হলো না। রাজনৈতিক চাপ আছে নাকি।
আমি মন খারাপ করে ভাবতে শুরু করলাম কে এমন চাপ শৃষ্টি করলো যে রাজনৈতিক লোকজনও আমার পিছনে পরে গেলো।
‘কে চাপ দিয়েছে যদি আমাকে বলেন আমি একটু বুঝিয়ে বলতাম উনাকে’
‘আপনি কি চান যে আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি হোক?’ অফিসার বলে উঠলো। নজর ঘুরে ফিরে আমার বুকের দিকেই বার বার স্থির হয়ে যাচ্ছে। প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে আমার।
এতগুলো টাকা খরচ হয়ে গেছে বলে লোকটার বদামো সহ্য করছি। নাহলে পুলিশ বা যেই হোক না কেন এক চর মেরে উঠে যেতাম।
আমি বুকের ওপর আঁচলটা বার বার ঠিক করতে করতেই বললাম ‘আমি একা মহিলা, হতেই পারে নিয়ম জানিনা ভুল করে ফেলেছি, তাবলে ভেঙ্গে দিতে হবে, এটাও মেনে নিতে পারলাম না। আপনি বললেন, আপনার কথা শেষ কথা এটা তো হতে পারেনা। দেশে আইনকানুন বলে কিছু আছে। চারিদিকে তাকালেই দেখা যায় কতশত বেআইনি ব্যাপার স্যাপার ঘটে চলেছে, তাও আপনাদের নাকের প্রায় ডগাতেই। সেগুলো সেই রাজনৈতিক ব্যাক্তি যখন মেনে নিয়েছেন এটাও মেনে নেবেন। আপনি বলুন আর না বলুন আমি ঠিক খুজে বের করে নেবো।’
আমি যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিনা এ কথাগুলো নির্ভুল ভাবে আমিই বললাম। কিন্তু তার ফলস্বরুপ কেউ যেন ডিউটি অফিসারের মুখে একটা থাপ্পর কষালো। ‘দেখুন আমাদের এত সময় নেই যে খুজে খুজে খুঁত বের করবো, কেউ অভিযোগ করেছে তাই আমরা স্টেপ নিচ্ছি। নিয়ম তো আছে গ্রেফতার করা, আপনি মহিলা বলেই তো সে নিয়ম প্রয়োগ করা গেলো না।’ লোকটির দৃষ্টি এখন আমার মুখের দিকে আমার প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করছে, হয়তো ভাবছে আমি এত কঠিন কথা কিভাবে বলছি।
আমি বিনিত ভাবে বললাম ‘যে অভিযোগ করেছে সে যদি তুলে নেয় তাতে কি আপনার আপত্তি আছে?’
‘হ্যাঁ অনেক কিছুই তো অনেক ভাবে মিটিয়ে নেওয়া যায়’
হয়তো লুকানো কিছু ছিলো কথাটায়, আমি গায়ে নিলাম না। আমাকে এই দুর্যোগ থেকে উদ্ধার হতে হবে।
সামলে নিয়ে বললাম ‘কে যদি সেটা জানাতেন আমার কষ্টটা কম হোতো, জানেনই তো সারাদিন কত পরিশ্রম করতে হয়... তারপর সময় বলতে কিছুই থাকেনা।’
লোকটি আমতা আমতা করে বললেন ‘আসলে লিখিত কোন অভিযোগ নেই...।’
আমি অবাক হয়ে গেলাম ‘মুখের কথায়...’
‘আসলে এসব রাজনৈতিক লোকগুলোকে তো বোঝেনই’
‘কে সেই ভদ্রলোক যার আমার বাড়ির দিকে নজর পরলো’
‘ভদ্রলোক না, ভদ্রমহিলা’
রান্নার জিনিসে হাত পরলেই আমার রান্না হয়ে যায়। এই যে তিন চার রকমের পদ রান্না করলাম, সেগুলো কেরিয়ারে গুছিয়ে নিয়ে ডেলিভারি করে এলাম, শুরু থেকে শেষ আর মনে পরছেনা। এতটাই আনমনা ছিলাম।
বুকের ভিতর কেমন করছে যেন। মনে হচ্ছে একা একটা মেয়েমানুষ কত দুর্বল। জীবনে একটা পুরুষ মানুষের দরকার শুধুমাত্র সামাজিক সন্মান, যৌন খিদে মেটানো আর তার সাথে বংশ রক্ষার জন্যেই শুধুমাত্র না। বিপদ আপদে আড়াল করা, বুক চেতিয়ে পরিবারের বিপদে ঝাপিয়ে পরার জন্যেও একজন পুরুষের দরকার।
অনুরাধা ম্যাডাম- নামটা শুনে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। প্রথম সারির কেউ নন উনি। কিন্তু প্রথম সারির সব ক্ষমতাশালি লোকের কাছে এ অনায়াসে পৌছে যেতে পারে। সামান্য গলির সমস্যা মেটানো থেকে রাজনিতি শুরু। যখন যার ক্ষমতা তখন তার দলে। এখন রাজ্যরাজনিতিতে খেলা করেন। গাড়ি এসে নিয়ে যায় দিয়ে যায়। যোগ্যতা ক্লাস এইট ফেল। কিন্তু রুপযৌবন আর কথা বলার ক্ষমতার দৌলতে অনেক দূর পৌছে গেছে।
গুন মাত্র এই তিনটে। আর কুখ্যাত অনেক কারনে। টাকা পয়সার উপর ভিষন দুর্বল। শোনা যায় মেয়েছেলের ব্যাবসাও করে। অনেক সমাজবিরোধি ওর হাতের মুঠোয় সাথে পুলিশও। এই এলাকায় কেউ খুন হলেও পুলিশ আগে ওকে জিজ্ঞেস করে কাকে ধরবে। দুই বিয়ে। শোনা যায় প্রথম স্বামি আত্মহত্যা করেছিলো, যদিও গুজব, উনি নিজেই খুন করেছিলেন, দ্বিতীয় স্বামি ওর হাটুর বয়েসি। এক সময়ে ওর বাড়িতেই মদ আর মেয়েছেলের আসর বসতো। বিরোধি দলের চাপে পুলিশ একবার রেইড করে অনেককে হাতেনাতে ধরে। কিন্তু কাউকে থানায় নিয়ে যাওয়ার আগেই সব ধামা চাপা পরে যায়। আর যারা পুলিশে খবর দিয়েছিলো তাদের পরিবারের কোন না কোন পুরুষ মার খেয়েছিলো বহিরাগত কিছু সমাজবিরোধির হাতে।
এখনো শোনা যায় যে উনার দুটো বিউটি পার্লারের আড়ালে দেহ ব্যাবসা চলে।
এই রকম গুনধারি এক মহিলার নজর আমার ওপর কেন পরলো সেটাই বুঝে উঠতে পারছিনা। একটা চাপা ভয়ে আমার হাত পা কাঁপছে। সারাক্ষন মাথার মধ্যে এই চিন্তা ঘুরে যাচ্ছে।
ভাবছি গিয়ে মুখোমুখি কথা বলবো, কিন্তু কিভাবে উনাকে অভিযোগ তুলে নিতে বলবো। তার বিনিময়ে কি? সঞ্চয় যা ছিলো সব লাগিয়ে ফেলেছি নতুন ঘরটার পিছনে। এখন মাঝপথে কাজ বন্ধ। ভাবছিলাম একটা মেস ভারা দেবো, আর হোম ডেলিভারির ব্যাবসাটা একটু সীমিত করে দেবো। মেয়েটাকে যে একদম সময় দিতে পারিনা।
আরো ভয় লাগছে পার্থর সাথে বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার সময় পার্থর বাড়িতে গিয়ে ও খুব হম্বিতম্বি করেছিলো। আমরা প্রাপ্তবয়স্ক ছিলাম বলে শেষ পর্যন্ত আমাদের আলাদা করতে পারেনি, আর সময়ের সাথে সাথে সেই উত্তেজনা থিতিয়ে পরে।
এখন কি করবো সেটাই ভেবে কুল করতে পারছিনা। আমার অস্থিরতা রিয়ার নজর এড়ালো না। রাতের বেলা পড়া বন্ধ করে আমার পাশে এসে গায়ে হাত দিয়ে বললো। ‘কি হয়েছে মা? থানায় কি কিছু গণ্ডগোল হয়েছে?’
‘নারে সেরকম কিছু না’
‘মা! আমি কিন্তু অনেক বড় হয়ে গেছি। সেই ছোট্ট রিয়া কিন্তু আর নই’
‘তুই যতই বড় হো না কেন, মা বাবার কাছে সন্তান চিরদিন ছোটই থাকে’
‘দিন পাল্টাচ্ছে মা। এখন সন্তানরাও পরিবারের বিপদের সময় পাশে দাড়ায়, অন্য সময় হলে বলতাম না, কিন্তু তোমাকে আমি অনেকক্ষন থেকে দেখছি, এরকম তোমাকে আমি কোনদিন দেখিনি। এমন কি তুমি দেখো আমার কফিতে চিনি দিতেই ভুলে গেছো, এরপরেও তুমি বলছো কিছু না, আমি বাচ্চা। বাবা বেঁচে থাকতে এরকম পরিস্থিতিতে কি তুমি সাহস আর বুদ্ধি দিতে না?’
আমি রিয়াকে সব খুলে বললাম। আমারও যা মত, রিয়ারও তাই। ঠিক করলাম যে রিয়া আর আমি দুজনে মিলে ওর সাথে দেখা করে অনুরোধ করবো।
রিয়া আজ দেরি করে ইউনিভার্সিটি যাবে। সকাল সকাল গিয়ে অনুরাধাকে ধরতে হবে নাহলে ও বেরিয়ে যাবে।
এরকম পরিবেশে অভ্যস্ত না হলে বেশ অস্বস্তি হয়।
কুচ্ছিত দর্শন এক অল্পবয়েসি ছেলে আমাদের অনেক জেরা করলো সাথে রিয়াকে প্রায় এক্সরে করে নিলো। নাড়িমাংসের লোভে চোখগুলো চকচক করছে, আমাকেও ছারছেনা। আমাদের বাইরে বসার ঘরে অনেক দর্শনার্থির সাথে বসিয়ে রাখলো। সবার বসার জায়গাও নেই অনেকে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ছেলেটা আমাদের বসার জায়গা করে দিলো। সেও মরা মাছের মতন চোখ দিয়ে রিয়াকে জরিপ করতে থাকলো উলটোদিকে একটা টুলের ওপর বসে। আমি মনে মনে ভাবছি রিয়াকে কেন নিয়ে এলাম।
রিয়া মোবাইল নিয়ে মশগুল হয়ে রয়েছে। হয়তো ছেলেটার নজর এড়াতে।
‘এটা কি মাইক্রোম্যাক্স?’ ছেলেটা রিয়ার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলো। আমার রাগে গা রি রি করছে, এরকম অসভ্যতা দেখে।
রিয়া গম্ভির ভাবে উত্তর দিলো ‘না সামসাং’
‘ও আমি ভাবলাম... আমার সেটটার মতনই’ ছেলেটা জিনসের পিছনের পকেট থেকে একটা ঝা চকচকে মোবাইল বের করে দেখালো।
রিয়া মাথাটা নাড়লো শুধু, আবার মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো।
‘আপনাকে দেখিনি তো এদিকে’
এবার আমি উত্তর দিলাম ‘ও কম থাকে বাড়িতে, সকালে যায় রাতে ফেরে সারাদিন কলেজ আর কোচিন নিয়েই ব্যস্ত থাকে’
‘আপনি তো স্বরুপদার ভাইয়ের বৌ’ ছেলেটা নিশ্চিত হতে জিজ্ঞেস করলো যেন।
‘হ্যাঁ’ আমি সংক্ষেপে উত্তর দিলাম। মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে তুলে। মনে মনে ভাবছি, দরকার হলে বাড়ি ভেঙ্গে দেবো এদের মুখ লাগতে হবে না তাহলে।
‘স্বরুপদা তো আমাদের পার্টির কর্মি।’
‘তাই আপনি দেখেই চিনতে পেরে গেলেন’ আমি আরো বিরক্তি ভরে উত্তর দিলাম।
‘আমাকে আপনি আপনি বলবেন না। আমি আপনার মেয়ের থেকে হয়তো একটু বড় হবো’ ছেলেটা একটু গদগদ হয়েই বললো। যেন আমাকে ইম্প্রেস করতে চাইছে। ‘দাদা তো হিরোর মত আপনাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছিলো, আপনাকে চিনবো না!’
সবাই ঘুরে আমার দিকে তাকালো যেন অদ্ভুত কিছু দেখছে। আমি লজ্জা পাবো, রাগ দেখাবো কিছুই বুঝতে পারছিনা।
‘লোকের হাড়ির খবর রাখা কাজ নাকি আপনার... নিজের আউকাতটা দেখিয়ে দিলেন তো, ভদ্রমহিলার সাথে কি করে কথা বলতে হয় জানেন না’ রিয়া প্রায় চেচিয়ে উঠলো।
আমি থতমত খেয়ে গেলাম কিংকর্ত্তব্যবিমূর হয়ে।
ভেতর থেকে আরেকটা ছেলে বেরিয়ে এলো, এই ছেলেটার মতনই কুদর্শন। এক কথায় বস্তির ছেলে টাইপের। গায়ের কালো রঙ, কূরুপ ঢাকার জন্যে মানানসই পোষাক পরেছে।
‘এই কে চিৎকার করছে রে?’ ছেলেটা কর্কষ গলায় জিজ্ঞেস করলো।
রিয়া ফুঁসে উঠলো ‘আমি করছি। কেন জিজ্ঞেস করুন?’
ছেলেটা থতমত খেয়ে বসে থাকা ছেলেটার দিকে তাকালো, তারপর সামলে নিয়ে বললো ‘এখানে চিৎকার করবেন না। ভিতর অসুবিধে হচ্ছে। দিদি রেগে গেলে কারোর সাথে দেখা করবেন না। আর তুই এখানে বসে আছিস কেন?’ বসে থাকা ছেলেটার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলো।
‘হ্যাঁ বলুন তো উনাকে এখানে বসে মেয়ে না দেখে কিছু কাজ করতে, যতক্ষন এসেছি ততক্ষন টুলের ওপর জগন্নাথ হয়ে বসে রয়েছে’
আমি ভিষন অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম ছেলেটা তরাক করে টুল ছেরে উঠে দাঁড়ালো ‘আপনি নিজেকে বিশ্বসুন্দরি মনে করেন তাই না’
‘আমি কি মনে করি পরের কথা, আপনি নিজেকে কি ভাবছেন সেটা বড় ব্যাপার।’ আমি রিয়ার হাত চেপে ধরলাম যাতে ও ঠাণ্ডা হয়।
‘থামুন তো আপনার মতন মেয়েছেলে ...আমাকে আমার অউকাত দেখাচ্ছেন’
‘দেখাবো তো। নিজের অউকাত দেখুন, রাজনিতি করেন বলে লোকের ওপর ছরি ঘোরাতে পারছেন নাহলে বিড়ির দোকানও চালাতে পারতেন কিনা সন্দেহ আছে...’
উপস্থিত কয়েকজন রিয়াকে সরাসরি দোষারোপ করতে শুরু করলো মৃদু স্বরে বলতে লাগলো এবার কি দিদি আমাদের আর সময় দেবেন। সবাইকে বের করে দেবেন।
চিৎকার চেচামেচিতে ভিতর থেকে অনুরাধা উঠে এলো।
মনের দন্ধটা কিছুতেই যাচ্ছেনা। এত সহজে সব মিটে যাবে, ঠিক হজম হচ্ছে না। কয়েকদিন ধরে সেই চিন্তাই করছি। এর জন্যে রিয়া আমাকে অনেক কথাও শোনালো, যে চিন্তা করাটা আমার স্বভাব হয়ে গেছে।
চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, চর্চিত শরির দিয়ে যেন গ্ল্যামার চুইয়ে পরছে। রুপের সাথে বয়েস, ব্যাক্তিত্ব আর গাম্ভির্জ্যের সঠিক মিশ্রন। প্রাথমিক দর্শনে এই হোলো অনুরাধা। রাজনিতি না করে টিভি সিরিয়াল বা সিনেমাতে নামতেই পারতো। আগেও ওকে দেখেছি, কিন্তু এখন যেন বেশি সুন্দরি মনে হচ্ছে।
সবাই চুপ করে গেলো। পিন পরা তো অনেক বেশি, তুলো পরলেও যেন আওয়াজ হবে এরকম নিস্তব্ধতা ঘরের মধ্যে।
‘কি হয়েছে এত চিৎকার কেন?’ প্রশ্নটা ছেলেগুলোর উদ্দেশ্যে আর চোখ রিয়ার দিক থেকে ঘুরে আমার দিকে এসে স্থির হোলো। সেই চোখে শাসনের দাপট। আমি কুঁকড়ে গেলাম, সেই ব্যক্তিত্বের সামনে।
রিয়া কিছু বলতে গেলেও আমি ওর হাত চেপে ধরলাম। চোখে আমার আকুতি, অনুরাধার উদ্দেশ্যে।
অনুরাধা উত্তরের অপেক্ষা না করেই ভিতরে চলে গেলো। সাথে ছেলেগুলো।
কয়েক মিনিট সব চুপ। ঘরের বাকি সবাই রিয়াকে জরিপ করে চলেছে, সবার মনেই একটা বিরক্তি সেটা বুঝতে পারছি।
দ্বিতিয় ছেলেটি এসে আমার উদ্দেশ্যে বললো এবং অতিব সন্মানের সাথে ‘আপনাদের ডাকছেন দিদি’
কয়েক মুহুর্ত লাগলো বুঝতে যে আমার উদ্দেশ্যেই সেই ডাক।
বাকিদের মধ্যে একটা গুঞ্জন চালু হোলো। ওরা আমার আগে এসেছে তাই।
ছেলেটা বাকিদের উদ্দেশ্যে বললো ‘আপনারা কালকে আসুন। আজকে দিদি তারাতারি বেরিয়ে যাবে।’
ভিতরের ঘরটাতে আলোআঁধারির খেলা। আমার দুটো ঘর মিলিয়েও এত বড় হবেনা। বড় বড় সোফা রাখা, ঘরের এক কোনে, মাঝে সেন্টার টেবিল। ঘরের মাঝখানে একটা বিড়াট চৌক সেগুন কাঠের টেবিলে অনুরাধা বসেছে। বাইরের আলো ঘরে ঢুকছেনা। যে আলোগুলো জ্বলছে সেগুলো সব বাল্ব, সুদৃশ্য ল্যাম্পহোল্ডার থেকে সেগুলোর আলো সব ছাদের দিকে পরছে। মেঝেতে বা টেবিলে কোন আলো নেই। ছাদ থেকে একটা ঝাড়বাতি ঝুলছে। তিনটে এসি লাগানো। কিন্তু জায়গায় জায়গায় ফ্যান ও রয়েছে।
আমাকে দেখে উচ্ছাসে যেন ফেটে পরলো অনুরাধা ‘আরে শম্পা, তুই এসেছিস বলবি তো? কি ব্যাপার? একদম গৃহকর্তি লাগছে তোকে।’
আমি একটু অবাকই হোলাম। এত বদান্যতা কেন? হাবভাব এমন যেন দুই সইয়ের দেখা হোলো।
‘বাহ্*!! এটি তোর মেয়ে বুঝি। খুব ফুটফুটে হয়েছে। দেখেই বোঝা যায়, তোর থুতনি আর ওর থুতনিতে একই রকম টোল। কি করছিস মা এখন?’
রিয়া উত্তর দিলো ‘এপ্লাইড ফিসিক্স নিয়ে মাস্টার্স করছি’
‘বাহ্*!! শুনেও বুক ভরে যায়।’
আমি মুখে হাসি থাকলেও মনে মনে চিন্তা করে যাচ্ছি এরকম স্পেশাল এটেনশান কেন দিচ্ছেন। সবাইকে চলে যেতে বললেন, এমন হাবভাব করছেন যেন কতজন্ম পরে আবার দেখা...।
অনুরাধা বলে চলেছে ‘এরপর দেশেই চাকরি করবি তো না পয়সার জন্যে বিদেশে চলে যাবি? এখন তো তোরা চাকরি তে ঢুকলেই ছয় অঙ্কের মাইনে, যেটা তোরা কয়েক বছরে অর্জন করবি সেটা অনেক মাউশ সারা জীবনে করতে পারেনা। বিচিত্র এই দেশ। তবুও আমি বড় হয়ে তোকে অনুরোধ করবো এখানেই অনেক ভালো সুজোগ পাবি, মাকে ফেলে নিজের লোকজনকে ফেলে রেখে চলে যাস না। টাকাটাই জীবনের সব না। তোর মা বাবাকে আমি অনেকদিন থেকে চিনি। এমন কি ওদের বিয়ের সময়ও আমাকে জড়াতে হয়েছিলো। মার মুখে শুনেছিস্* সেই গল্প?’ আমার দিকে ঘুরে আমাকে জিজ্ঞেস করলো ‘কিরে বলিসনি ওকে? বাব্বাঃ সেই সময়ে ওদের কি সাহস। আমার তো ভাবতেই হাত পা কেঁপে যায়। বিদেশ বিভুয়ে, টাকা পয়সা, অবলম্বন কিছু নেই তাও... সত্যি তোদের সাহসের তারিফ করতে হয়।’
আমি একটু লজ্জাই পেয়ে গেলাম ‘আমি না ওর বাবাই ওকে এই গল্পগুলো শোনাতো’
‘আহারে মনটা ভিষন খারাপ লাগে, কি এমন বয়েস হয়েছিলো। সুখের সময়টায় রইলো না বেচারা।একা মেয়েদের যে কি কষ্ট...। আমার তো থেকেও নেই সারাক্ষন ওর ওকালতি নিয়ে ব্যস্ত। শরির খারাপ হলে ওষুধ এগিয়ে দেওয়ার কেউ নেই। পার্থর দাদা তো আমাদের পার্টিতেই আছে। মাঝে মাঝেই পার্থকে নিয়ে কথা হয়।’
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিনা যা শুনছি। এরকমও হয়। পার্থই ক্ষণজন্মা, তাই ওর দাদারা ওর জন্যে দুঃখ করে।
রিয়ার উদ্দেশ্যে বললো ‘দ্যাখ বাবা চলে যাওয়ার পরে মা কত কষ্ট করছে, তারপর তুই যদি বিদেশ চলে যাস্* সেটা কিরকম হবে।’ যেন রিয়ার প্লেনের টিকিট কাটা হয়ে গেছে।
আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো ‘তুই তো হোম ডেলিভারির ব্যাবসা করিস?’
আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললাম।
‘শুনেছি অনেকের মুখে। কিন্তু ভাগ্য হয়নি খাওয়ার। আর হবেও না। কোলেস্টরেল, সুগার, প্রেসার কি নেই এই শরিরে। তাই একদম সব সিদ্ধ খাওয়ার বরাদ্দ আমার... জাক গে, বল কি জন্যে এলি মা মেয়েতে’
সুজোগ পেতেই আমি সব খুলে বললাম।
“ও হরি। আমাকে কে যেন এসে বললো ওখানে বাড়ী তৈরি হচ্ছে বিয়ে বাড়ী ভারা দেবে বলে, লোকগুলোও এমন হয়েছে না, কারো ছায়াও যেন সহ্য করতে পারেনা। এই জন্যেই বাঙালি উন্নতি করতে পারলো না এত পরশ্রীকাতর বলে। গুজরাত, মহারাষ্ট্রে পাশাপাশি বাড়ি অথচ একটাই বাউণ্ডারি দেওয়াল। আর আমাদের তো ভাইয়ে ভাইয়ে খুনোখুনি হয়। তোর বাড়ি জানলে... তুই চিন্তা করিস না আর কোন সমস্যা হবেনা।’
নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছেনা। আমার চোখ দিয়ে প্রায় জল বেরিয়ে এলো। আমি অনুরাধার হাত চেপে ধরলাম আবেগে। মুক্তোর মতন দাঁতগুলো বের করে স্মিত হেসে বললো ‘কি শুনেছিলি আমি খুব খারাপ তাই তো... এগুলো গা সওয়া হয়ে গেছে... প্রথম প্রথম খুব রেগে যেতাম, তারপর বুঝলাম কুকুরের কাজ কুকুর করবে, আমার কাজ আমাকে করতে হবে। তাই তো আজ আমি এখানে, আমি বাবা মার একমাত্র সন্তান, বাবা মারা যাওয়ার সময় বলে গেছিলো আমি যেন এমন কিছু করি যাতে আমার নাম সাধারন মানুষের মাঝে থেকে যায়, প্রচুর ঝড় সামলে আজ আমি এতদুর আস্তে পেরেছি, তাইতো আজকে আমি তোকে সাহাজ্য করতে পারছি... এখন মজা লাগে কি জানিস, যারা রটায় তারা কেউ আমার আশেপাশেও নেই।’
আমার চোখ ছলছল করে উঠলো। সত্যিই হয়তো তাই। রাজনিতি করলে তো কতশত রটনা রটে। নিজের মনে মনেই লজ্জিত বোধ হচ্ছে। না জেনেশুনে মানুষটাকে কি না ভাবছিলাম।
ঘরের মধ্যে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর বেজে উঠলো সাথে গোঁ গোঁ করে আওয়াজ। অনুরাধার মোবাইল বেজে উঠলো। মুহুর্তের মধ্যে মুখের চেহারা পালটে গেলো। এতক্ষনের মায়াময়ী মুখটা কাঠিন্যে ভরে গেলো। ফোনটা কেটে দিলো। তারপর ঘুরে আমাদের দিকে হাসি মুখে কিছু বলতে জেতেই আবার ফোনটা বেজে উঠলো।
ফোনটা ধরতেই নিস্তব্ধ ঘরে ওপারের কিছু আওয়াজ ভেসে আসতে থাকলো, সাইকেল রিকশা, সাথে কেউ যেন উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে চাইছে হিন্দিতে। অনুরাধা শুধু বললো ‘আমি পরে ফোন করছি’ ফোনটা কেটে দিলো। বুঝতে পারলাম আমাদের ওঠার সময় হয়েছে।
এত সহজে সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো ভাবতেই কেমন লাগছে। এ কদিন টেনশানে ঠিক করে ঘুমুতে পারিনি। এখন মনে হচ্ছে সমস্যা হলে মানুষ অনেক কিছু শেখে। আজ যেমন সামনে থেকে একজন রাজনিতির মানুষকে দেখলাম।
দেরি না করে সে কাজেও হাত দিয়ে দিলাম।
ছাদ ঢালাইয়ের মুখে এক বিপত্তি এসে জুটলো। বাড়িতে পুলিশ হাজির। যা তৈরি করেছি ভেঙ্গে দিতে হবে, এটা বেআইনি নির্মান। ওরা আমাকে থানায় দেখা করতে বলে চলে গেলো।
একা মেয়েমানুষ, মেয়ে তখন বাড়ি নেই। অগত্যা পার্থর এক বন্ধুকে সঙ্গে করে নিয়ে থানায় হাজির হোলাম। কিছুক্ষন অপেক্ষার পর ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের দেখা পেলাম। মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসলাম আমরা দুজন।
আড় চোখে লক্ষ্য করলাম অফিসারটার কুৎসিত নজর আমার বুকের ওপর নির্লজ্জ্য ভাবে ঘোরাফেরা করছে।
অনেক কাকুতিমিনতি তোষামোদেও কাজ হলো না। রাজনৈতিক চাপ আছে নাকি।
আমি মন খারাপ করে ভাবতে শুরু করলাম কে এমন চাপ শৃষ্টি করলো যে রাজনৈতিক লোকজনও আমার পিছনে পরে গেলো।
‘কে চাপ দিয়েছে যদি আমাকে বলেন আমি একটু বুঝিয়ে বলতাম উনাকে’
‘আপনি কি চান যে আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি হোক?’ অফিসার বলে উঠলো। নজর ঘুরে ফিরে আমার বুকের দিকেই বার বার স্থির হয়ে যাচ্ছে। প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে আমার।
এতগুলো টাকা খরচ হয়ে গেছে বলে লোকটার বদামো সহ্য করছি। নাহলে পুলিশ বা যেই হোক না কেন এক চর মেরে উঠে যেতাম।
আমি বুকের ওপর আঁচলটা বার বার ঠিক করতে করতেই বললাম ‘আমি একা মহিলা, হতেই পারে নিয়ম জানিনা ভুল করে ফেলেছি, তাবলে ভেঙ্গে দিতে হবে, এটাও মেনে নিতে পারলাম না। আপনি বললেন, আপনার কথা শেষ কথা এটা তো হতে পারেনা। দেশে আইনকানুন বলে কিছু আছে। চারিদিকে তাকালেই দেখা যায় কতশত বেআইনি ব্যাপার স্যাপার ঘটে চলেছে, তাও আপনাদের নাকের প্রায় ডগাতেই। সেগুলো সেই রাজনৈতিক ব্যাক্তি যখন মেনে নিয়েছেন এটাও মেনে নেবেন। আপনি বলুন আর না বলুন আমি ঠিক খুজে বের করে নেবো।’
আমি যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিনা এ কথাগুলো নির্ভুল ভাবে আমিই বললাম। কিন্তু তার ফলস্বরুপ কেউ যেন ডিউটি অফিসারের মুখে একটা থাপ্পর কষালো। ‘দেখুন আমাদের এত সময় নেই যে খুজে খুজে খুঁত বের করবো, কেউ অভিযোগ করেছে তাই আমরা স্টেপ নিচ্ছি। নিয়ম তো আছে গ্রেফতার করা, আপনি মহিলা বলেই তো সে নিয়ম প্রয়োগ করা গেলো না।’ লোকটির দৃষ্টি এখন আমার মুখের দিকে আমার প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করছে, হয়তো ভাবছে আমি এত কঠিন কথা কিভাবে বলছি।
আমি বিনিত ভাবে বললাম ‘যে অভিযোগ করেছে সে যদি তুলে নেয় তাতে কি আপনার আপত্তি আছে?’
‘হ্যাঁ অনেক কিছুই তো অনেক ভাবে মিটিয়ে নেওয়া যায়’
হয়তো লুকানো কিছু ছিলো কথাটায়, আমি গায়ে নিলাম না। আমাকে এই দুর্যোগ থেকে উদ্ধার হতে হবে।
সামলে নিয়ে বললাম ‘কে যদি সেটা জানাতেন আমার কষ্টটা কম হোতো, জানেনই তো সারাদিন কত পরিশ্রম করতে হয়... তারপর সময় বলতে কিছুই থাকেনা।’
লোকটি আমতা আমতা করে বললেন ‘আসলে লিখিত কোন অভিযোগ নেই...।’
আমি অবাক হয়ে গেলাম ‘মুখের কথায়...’
‘আসলে এসব রাজনৈতিক লোকগুলোকে তো বোঝেনই’
‘কে সেই ভদ্রলোক যার আমার বাড়ির দিকে নজর পরলো’
‘ভদ্রলোক না, ভদ্রমহিলা’
রান্নার জিনিসে হাত পরলেই আমার রান্না হয়ে যায়। এই যে তিন চার রকমের পদ রান্না করলাম, সেগুলো কেরিয়ারে গুছিয়ে নিয়ে ডেলিভারি করে এলাম, শুরু থেকে শেষ আর মনে পরছেনা। এতটাই আনমনা ছিলাম।
বুকের ভিতর কেমন করছে যেন। মনে হচ্ছে একা একটা মেয়েমানুষ কত দুর্বল। জীবনে একটা পুরুষ মানুষের দরকার শুধুমাত্র সামাজিক সন্মান, যৌন খিদে মেটানো আর তার সাথে বংশ রক্ষার জন্যেই শুধুমাত্র না। বিপদ আপদে আড়াল করা, বুক চেতিয়ে পরিবারের বিপদে ঝাপিয়ে পরার জন্যেও একজন পুরুষের দরকার।
অনুরাধা ম্যাডাম- নামটা শুনে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। প্রথম সারির কেউ নন উনি। কিন্তু প্রথম সারির সব ক্ষমতাশালি লোকের কাছে এ অনায়াসে পৌছে যেতে পারে। সামান্য গলির সমস্যা মেটানো থেকে রাজনিতি শুরু। যখন যার ক্ষমতা তখন তার দলে। এখন রাজ্যরাজনিতিতে খেলা করেন। গাড়ি এসে নিয়ে যায় দিয়ে যায়। যোগ্যতা ক্লাস এইট ফেল। কিন্তু রুপযৌবন আর কথা বলার ক্ষমতার দৌলতে অনেক দূর পৌছে গেছে।
গুন মাত্র এই তিনটে। আর কুখ্যাত অনেক কারনে। টাকা পয়সার উপর ভিষন দুর্বল। শোনা যায় মেয়েছেলের ব্যাবসাও করে। অনেক সমাজবিরোধি ওর হাতের মুঠোয় সাথে পুলিশও। এই এলাকায় কেউ খুন হলেও পুলিশ আগে ওকে জিজ্ঞেস করে কাকে ধরবে। দুই বিয়ে। শোনা যায় প্রথম স্বামি আত্মহত্যা করেছিলো, যদিও গুজব, উনি নিজেই খুন করেছিলেন, দ্বিতীয় স্বামি ওর হাটুর বয়েসি। এক সময়ে ওর বাড়িতেই মদ আর মেয়েছেলের আসর বসতো। বিরোধি দলের চাপে পুলিশ একবার রেইড করে অনেককে হাতেনাতে ধরে। কিন্তু কাউকে থানায় নিয়ে যাওয়ার আগেই সব ধামা চাপা পরে যায়। আর যারা পুলিশে খবর দিয়েছিলো তাদের পরিবারের কোন না কোন পুরুষ মার খেয়েছিলো বহিরাগত কিছু সমাজবিরোধির হাতে।
এখনো শোনা যায় যে উনার দুটো বিউটি পার্লারের আড়ালে দেহ ব্যাবসা চলে।
এই রকম গুনধারি এক মহিলার নজর আমার ওপর কেন পরলো সেটাই বুঝে উঠতে পারছিনা। একটা চাপা ভয়ে আমার হাত পা কাঁপছে। সারাক্ষন মাথার মধ্যে এই চিন্তা ঘুরে যাচ্ছে।
ভাবছি গিয়ে মুখোমুখি কথা বলবো, কিন্তু কিভাবে উনাকে অভিযোগ তুলে নিতে বলবো। তার বিনিময়ে কি? সঞ্চয় যা ছিলো সব লাগিয়ে ফেলেছি নতুন ঘরটার পিছনে। এখন মাঝপথে কাজ বন্ধ। ভাবছিলাম একটা মেস ভারা দেবো, আর হোম ডেলিভারির ব্যাবসাটা একটু সীমিত করে দেবো। মেয়েটাকে যে একদম সময় দিতে পারিনা।
আরো ভয় লাগছে পার্থর সাথে বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার সময় পার্থর বাড়িতে গিয়ে ও খুব হম্বিতম্বি করেছিলো। আমরা প্রাপ্তবয়স্ক ছিলাম বলে শেষ পর্যন্ত আমাদের আলাদা করতে পারেনি, আর সময়ের সাথে সাথে সেই উত্তেজনা থিতিয়ে পরে।
এখন কি করবো সেটাই ভেবে কুল করতে পারছিনা। আমার অস্থিরতা রিয়ার নজর এড়ালো না। রাতের বেলা পড়া বন্ধ করে আমার পাশে এসে গায়ে হাত দিয়ে বললো। ‘কি হয়েছে মা? থানায় কি কিছু গণ্ডগোল হয়েছে?’
‘নারে সেরকম কিছু না’
‘মা! আমি কিন্তু অনেক বড় হয়ে গেছি। সেই ছোট্ট রিয়া কিন্তু আর নই’
‘তুই যতই বড় হো না কেন, মা বাবার কাছে সন্তান চিরদিন ছোটই থাকে’
‘দিন পাল্টাচ্ছে মা। এখন সন্তানরাও পরিবারের বিপদের সময় পাশে দাড়ায়, অন্য সময় হলে বলতাম না, কিন্তু তোমাকে আমি অনেকক্ষন থেকে দেখছি, এরকম তোমাকে আমি কোনদিন দেখিনি। এমন কি তুমি দেখো আমার কফিতে চিনি দিতেই ভুলে গেছো, এরপরেও তুমি বলছো কিছু না, আমি বাচ্চা। বাবা বেঁচে থাকতে এরকম পরিস্থিতিতে কি তুমি সাহস আর বুদ্ধি দিতে না?’
আমি রিয়াকে সব খুলে বললাম। আমারও যা মত, রিয়ারও তাই। ঠিক করলাম যে রিয়া আর আমি দুজনে মিলে ওর সাথে দেখা করে অনুরোধ করবো।
রিয়া আজ দেরি করে ইউনিভার্সিটি যাবে। সকাল সকাল গিয়ে অনুরাধাকে ধরতে হবে নাহলে ও বেরিয়ে যাবে।
এরকম পরিবেশে অভ্যস্ত না হলে বেশ অস্বস্তি হয়।
কুচ্ছিত দর্শন এক অল্পবয়েসি ছেলে আমাদের অনেক জেরা করলো সাথে রিয়াকে প্রায় এক্সরে করে নিলো। নাড়িমাংসের লোভে চোখগুলো চকচক করছে, আমাকেও ছারছেনা। আমাদের বাইরে বসার ঘরে অনেক দর্শনার্থির সাথে বসিয়ে রাখলো। সবার বসার জায়গাও নেই অনেকে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ছেলেটা আমাদের বসার জায়গা করে দিলো। সেও মরা মাছের মতন চোখ দিয়ে রিয়াকে জরিপ করতে থাকলো উলটোদিকে একটা টুলের ওপর বসে। আমি মনে মনে ভাবছি রিয়াকে কেন নিয়ে এলাম।
রিয়া মোবাইল নিয়ে মশগুল হয়ে রয়েছে। হয়তো ছেলেটার নজর এড়াতে।
‘এটা কি মাইক্রোম্যাক্স?’ ছেলেটা রিয়ার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলো। আমার রাগে গা রি রি করছে, এরকম অসভ্যতা দেখে।
রিয়া গম্ভির ভাবে উত্তর দিলো ‘না সামসাং’
‘ও আমি ভাবলাম... আমার সেটটার মতনই’ ছেলেটা জিনসের পিছনের পকেট থেকে একটা ঝা চকচকে মোবাইল বের করে দেখালো।
রিয়া মাথাটা নাড়লো শুধু, আবার মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো।
‘আপনাকে দেখিনি তো এদিকে’
এবার আমি উত্তর দিলাম ‘ও কম থাকে বাড়িতে, সকালে যায় রাতে ফেরে সারাদিন কলেজ আর কোচিন নিয়েই ব্যস্ত থাকে’
‘আপনি তো স্বরুপদার ভাইয়ের বৌ’ ছেলেটা নিশ্চিত হতে জিজ্ঞেস করলো যেন।
‘হ্যাঁ’ আমি সংক্ষেপে উত্তর দিলাম। মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে তুলে। মনে মনে ভাবছি, দরকার হলে বাড়ি ভেঙ্গে দেবো এদের মুখ লাগতে হবে না তাহলে।
‘স্বরুপদা তো আমাদের পার্টির কর্মি।’
‘তাই আপনি দেখেই চিনতে পেরে গেলেন’ আমি আরো বিরক্তি ভরে উত্তর দিলাম।
‘আমাকে আপনি আপনি বলবেন না। আমি আপনার মেয়ের থেকে হয়তো একটু বড় হবো’ ছেলেটা একটু গদগদ হয়েই বললো। যেন আমাকে ইম্প্রেস করতে চাইছে। ‘দাদা তো হিরোর মত আপনাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছিলো, আপনাকে চিনবো না!’
সবাই ঘুরে আমার দিকে তাকালো যেন অদ্ভুত কিছু দেখছে। আমি লজ্জা পাবো, রাগ দেখাবো কিছুই বুঝতে পারছিনা।
‘লোকের হাড়ির খবর রাখা কাজ নাকি আপনার... নিজের আউকাতটা দেখিয়ে দিলেন তো, ভদ্রমহিলার সাথে কি করে কথা বলতে হয় জানেন না’ রিয়া প্রায় চেচিয়ে উঠলো।
আমি থতমত খেয়ে গেলাম কিংকর্ত্তব্যবিমূর হয়ে।
ভেতর থেকে আরেকটা ছেলে বেরিয়ে এলো, এই ছেলেটার মতনই কুদর্শন। এক কথায় বস্তির ছেলে টাইপের। গায়ের কালো রঙ, কূরুপ ঢাকার জন্যে মানানসই পোষাক পরেছে।
‘এই কে চিৎকার করছে রে?’ ছেলেটা কর্কষ গলায় জিজ্ঞেস করলো।
রিয়া ফুঁসে উঠলো ‘আমি করছি। কেন জিজ্ঞেস করুন?’
ছেলেটা থতমত খেয়ে বসে থাকা ছেলেটার দিকে তাকালো, তারপর সামলে নিয়ে বললো ‘এখানে চিৎকার করবেন না। ভিতর অসুবিধে হচ্ছে। দিদি রেগে গেলে কারোর সাথে দেখা করবেন না। আর তুই এখানে বসে আছিস কেন?’ বসে থাকা ছেলেটার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলো।
‘হ্যাঁ বলুন তো উনাকে এখানে বসে মেয়ে না দেখে কিছু কাজ করতে, যতক্ষন এসেছি ততক্ষন টুলের ওপর জগন্নাথ হয়ে বসে রয়েছে’
আমি ভিষন অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম ছেলেটা তরাক করে টুল ছেরে উঠে দাঁড়ালো ‘আপনি নিজেকে বিশ্বসুন্দরি মনে করেন তাই না’
‘আমি কি মনে করি পরের কথা, আপনি নিজেকে কি ভাবছেন সেটা বড় ব্যাপার।’ আমি রিয়ার হাত চেপে ধরলাম যাতে ও ঠাণ্ডা হয়।
‘থামুন তো আপনার মতন মেয়েছেলে ...আমাকে আমার অউকাত দেখাচ্ছেন’
‘দেখাবো তো। নিজের অউকাত দেখুন, রাজনিতি করেন বলে লোকের ওপর ছরি ঘোরাতে পারছেন নাহলে বিড়ির দোকানও চালাতে পারতেন কিনা সন্দেহ আছে...’
উপস্থিত কয়েকজন রিয়াকে সরাসরি দোষারোপ করতে শুরু করলো মৃদু স্বরে বলতে লাগলো এবার কি দিদি আমাদের আর সময় দেবেন। সবাইকে বের করে দেবেন।
চিৎকার চেচামেচিতে ভিতর থেকে অনুরাধা উঠে এলো।
মনের দন্ধটা কিছুতেই যাচ্ছেনা। এত সহজে সব মিটে যাবে, ঠিক হজম হচ্ছে না। কয়েকদিন ধরে সেই চিন্তাই করছি। এর জন্যে রিয়া আমাকে অনেক কথাও শোনালো, যে চিন্তা করাটা আমার স্বভাব হয়ে গেছে।
চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, চর্চিত শরির দিয়ে যেন গ্ল্যামার চুইয়ে পরছে। রুপের সাথে বয়েস, ব্যাক্তিত্ব আর গাম্ভির্জ্যের সঠিক মিশ্রন। প্রাথমিক দর্শনে এই হোলো অনুরাধা। রাজনিতি না করে টিভি সিরিয়াল বা সিনেমাতে নামতেই পারতো। আগেও ওকে দেখেছি, কিন্তু এখন যেন বেশি সুন্দরি মনে হচ্ছে।
সবাই চুপ করে গেলো। পিন পরা তো অনেক বেশি, তুলো পরলেও যেন আওয়াজ হবে এরকম নিস্তব্ধতা ঘরের মধ্যে।
‘কি হয়েছে এত চিৎকার কেন?’ প্রশ্নটা ছেলেগুলোর উদ্দেশ্যে আর চোখ রিয়ার দিক থেকে ঘুরে আমার দিকে এসে স্থির হোলো। সেই চোখে শাসনের দাপট। আমি কুঁকড়ে গেলাম, সেই ব্যক্তিত্বের সামনে।
রিয়া কিছু বলতে গেলেও আমি ওর হাত চেপে ধরলাম। চোখে আমার আকুতি, অনুরাধার উদ্দেশ্যে।
অনুরাধা উত্তরের অপেক্ষা না করেই ভিতরে চলে গেলো। সাথে ছেলেগুলো।
কয়েক মিনিট সব চুপ। ঘরের বাকি সবাই রিয়াকে জরিপ করে চলেছে, সবার মনেই একটা বিরক্তি সেটা বুঝতে পারছি।
দ্বিতিয় ছেলেটি এসে আমার উদ্দেশ্যে বললো এবং অতিব সন্মানের সাথে ‘আপনাদের ডাকছেন দিদি’
কয়েক মুহুর্ত লাগলো বুঝতে যে আমার উদ্দেশ্যেই সেই ডাক।
বাকিদের মধ্যে একটা গুঞ্জন চালু হোলো। ওরা আমার আগে এসেছে তাই।
ছেলেটা বাকিদের উদ্দেশ্যে বললো ‘আপনারা কালকে আসুন। আজকে দিদি তারাতারি বেরিয়ে যাবে।’
ভিতরের ঘরটাতে আলোআঁধারির খেলা। আমার দুটো ঘর মিলিয়েও এত বড় হবেনা। বড় বড় সোফা রাখা, ঘরের এক কোনে, মাঝে সেন্টার টেবিল। ঘরের মাঝখানে একটা বিড়াট চৌক সেগুন কাঠের টেবিলে অনুরাধা বসেছে। বাইরের আলো ঘরে ঢুকছেনা। যে আলোগুলো জ্বলছে সেগুলো সব বাল্ব, সুদৃশ্য ল্যাম্পহোল্ডার থেকে সেগুলোর আলো সব ছাদের দিকে পরছে। মেঝেতে বা টেবিলে কোন আলো নেই। ছাদ থেকে একটা ঝাড়বাতি ঝুলছে। তিনটে এসি লাগানো। কিন্তু জায়গায় জায়গায় ফ্যান ও রয়েছে।
আমাকে দেখে উচ্ছাসে যেন ফেটে পরলো অনুরাধা ‘আরে শম্পা, তুই এসেছিস বলবি তো? কি ব্যাপার? একদম গৃহকর্তি লাগছে তোকে।’
আমি একটু অবাকই হোলাম। এত বদান্যতা কেন? হাবভাব এমন যেন দুই সইয়ের দেখা হোলো।
‘বাহ্*!! এটি তোর মেয়ে বুঝি। খুব ফুটফুটে হয়েছে। দেখেই বোঝা যায়, তোর থুতনি আর ওর থুতনিতে একই রকম টোল। কি করছিস মা এখন?’
রিয়া উত্তর দিলো ‘এপ্লাইড ফিসিক্স নিয়ে মাস্টার্স করছি’
‘বাহ্*!! শুনেও বুক ভরে যায়।’
আমি মুখে হাসি থাকলেও মনে মনে চিন্তা করে যাচ্ছি এরকম স্পেশাল এটেনশান কেন দিচ্ছেন। সবাইকে চলে যেতে বললেন, এমন হাবভাব করছেন যেন কতজন্ম পরে আবার দেখা...।
অনুরাধা বলে চলেছে ‘এরপর দেশেই চাকরি করবি তো না পয়সার জন্যে বিদেশে চলে যাবি? এখন তো তোরা চাকরি তে ঢুকলেই ছয় অঙ্কের মাইনে, যেটা তোরা কয়েক বছরে অর্জন করবি সেটা অনেক মাউশ সারা জীবনে করতে পারেনা। বিচিত্র এই দেশ। তবুও আমি বড় হয়ে তোকে অনুরোধ করবো এখানেই অনেক ভালো সুজোগ পাবি, মাকে ফেলে নিজের লোকজনকে ফেলে রেখে চলে যাস না। টাকাটাই জীবনের সব না। তোর মা বাবাকে আমি অনেকদিন থেকে চিনি। এমন কি ওদের বিয়ের সময়ও আমাকে জড়াতে হয়েছিলো। মার মুখে শুনেছিস্* সেই গল্প?’ আমার দিকে ঘুরে আমাকে জিজ্ঞেস করলো ‘কিরে বলিসনি ওকে? বাব্বাঃ সেই সময়ে ওদের কি সাহস। আমার তো ভাবতেই হাত পা কেঁপে যায়। বিদেশ বিভুয়ে, টাকা পয়সা, অবলম্বন কিছু নেই তাও... সত্যি তোদের সাহসের তারিফ করতে হয়।’
আমি একটু লজ্জাই পেয়ে গেলাম ‘আমি না ওর বাবাই ওকে এই গল্পগুলো শোনাতো’
‘আহারে মনটা ভিষন খারাপ লাগে, কি এমন বয়েস হয়েছিলো। সুখের সময়টায় রইলো না বেচারা।একা মেয়েদের যে কি কষ্ট...। আমার তো থেকেও নেই সারাক্ষন ওর ওকালতি নিয়ে ব্যস্ত। শরির খারাপ হলে ওষুধ এগিয়ে দেওয়ার কেউ নেই। পার্থর দাদা তো আমাদের পার্টিতেই আছে। মাঝে মাঝেই পার্থকে নিয়ে কথা হয়।’
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিনা যা শুনছি। এরকমও হয়। পার্থই ক্ষণজন্মা, তাই ওর দাদারা ওর জন্যে দুঃখ করে।
রিয়ার উদ্দেশ্যে বললো ‘দ্যাখ বাবা চলে যাওয়ার পরে মা কত কষ্ট করছে, তারপর তুই যদি বিদেশ চলে যাস্* সেটা কিরকম হবে।’ যেন রিয়ার প্লেনের টিকিট কাটা হয়ে গেছে।
আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো ‘তুই তো হোম ডেলিভারির ব্যাবসা করিস?’
আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললাম।
‘শুনেছি অনেকের মুখে। কিন্তু ভাগ্য হয়নি খাওয়ার। আর হবেও না। কোলেস্টরেল, সুগার, প্রেসার কি নেই এই শরিরে। তাই একদম সব সিদ্ধ খাওয়ার বরাদ্দ আমার... জাক গে, বল কি জন্যে এলি মা মেয়েতে’
সুজোগ পেতেই আমি সব খুলে বললাম।
“ও হরি। আমাকে কে যেন এসে বললো ওখানে বাড়ী তৈরি হচ্ছে বিয়ে বাড়ী ভারা দেবে বলে, লোকগুলোও এমন হয়েছে না, কারো ছায়াও যেন সহ্য করতে পারেনা। এই জন্যেই বাঙালি উন্নতি করতে পারলো না এত পরশ্রীকাতর বলে। গুজরাত, মহারাষ্ট্রে পাশাপাশি বাড়ি অথচ একটাই বাউণ্ডারি দেওয়াল। আর আমাদের তো ভাইয়ে ভাইয়ে খুনোখুনি হয়। তোর বাড়ি জানলে... তুই চিন্তা করিস না আর কোন সমস্যা হবেনা।’
নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছেনা। আমার চোখ দিয়ে প্রায় জল বেরিয়ে এলো। আমি অনুরাধার হাত চেপে ধরলাম আবেগে। মুক্তোর মতন দাঁতগুলো বের করে স্মিত হেসে বললো ‘কি শুনেছিলি আমি খুব খারাপ তাই তো... এগুলো গা সওয়া হয়ে গেছে... প্রথম প্রথম খুব রেগে যেতাম, তারপর বুঝলাম কুকুরের কাজ কুকুর করবে, আমার কাজ আমাকে করতে হবে। তাই তো আজ আমি এখানে, আমি বাবা মার একমাত্র সন্তান, বাবা মারা যাওয়ার সময় বলে গেছিলো আমি যেন এমন কিছু করি যাতে আমার নাম সাধারন মানুষের মাঝে থেকে যায়, প্রচুর ঝড় সামলে আজ আমি এতদুর আস্তে পেরেছি, তাইতো আজকে আমি তোকে সাহাজ্য করতে পারছি... এখন মজা লাগে কি জানিস, যারা রটায় তারা কেউ আমার আশেপাশেও নেই।’
আমার চোখ ছলছল করে উঠলো। সত্যিই হয়তো তাই। রাজনিতি করলে তো কতশত রটনা রটে। নিজের মনে মনেই লজ্জিত বোধ হচ্ছে। না জেনেশুনে মানুষটাকে কি না ভাবছিলাম।
ঘরের মধ্যে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর বেজে উঠলো সাথে গোঁ গোঁ করে আওয়াজ। অনুরাধার মোবাইল বেজে উঠলো। মুহুর্তের মধ্যে মুখের চেহারা পালটে গেলো। এতক্ষনের মায়াময়ী মুখটা কাঠিন্যে ভরে গেলো। ফোনটা কেটে দিলো। তারপর ঘুরে আমাদের দিকে হাসি মুখে কিছু বলতে জেতেই আবার ফোনটা বেজে উঠলো।
ফোনটা ধরতেই নিস্তব্ধ ঘরে ওপারের কিছু আওয়াজ ভেসে আসতে থাকলো, সাইকেল রিকশা, সাথে কেউ যেন উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে চাইছে হিন্দিতে। অনুরাধা শুধু বললো ‘আমি পরে ফোন করছি’ ফোনটা কেটে দিলো। বুঝতে পারলাম আমাদের ওঠার সময় হয়েছে।
এত সহজে সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো ভাবতেই কেমন লাগছে। এ কদিন টেনশানে ঠিক করে ঘুমুতে পারিনি। এখন মনে হচ্ছে সমস্যা হলে মানুষ অনেক কিছু শেখে। আজ যেমন সামনে থেকে একজন রাজনিতির মানুষকে দেখলাম।