12-09-2023, 08:49 PM
দুপুরে খাওয়ার পর কিছুক্ষণ টিভি দেখলো তারপর শুয়ে বিশ্রাম করে নিল । তারপর বিকাল বিকাল দোকান খুললো । শাটার তুলে দেওয়ার সময় সকালের বিদ্যার গয়না বিক্রি করে দেওয়ার কথাটা আর একবার মনে পড়লো । তার মাথাতে এখনো গয়না বিক্রির কথাটা ঘুরপাক খাওয়ার একটা কারন আছে ।
আবাসিক থেকে বার হওয়ার পর বিভিন্ন কাজের সুবাদে বিভিন্ন ধরনের মানুষের সাথে পরিচয় হওয়ার এবং তাদেরকে জানার সুযোগ হয়েছে । তখন রাস্তায় বাসে অনেক মেয়েদের কথোপকথন না চাইতেও সে শুনতে পেত । সেই কথোপকথন গুলোর বিষয়ের মধ্যে একটা সাধারন সর্বজনীন বিষয় হলো গহনা । কার বিয়েতে কে কতো গয়না কিনেছে । কাকে তার স্বামী কতো ভরির , কত গ্রামের গয়না দিয়েছে এসবই মহিলারা খুব উত্তেজিত হয়ে কথা বলতো । সেইসব মেয়েদের খুশীর উচ্ছাস তাদের চোখে মুখে ফুটে উঠতো । এইসব মুখ বিক্রমের চোখ এড়াতো না । তাই এই কথোপকথন গুলো শোনার পর সে সিদ্ধান্ত নেয় যে সে যখন বিয়ে করবে কিংবা যখন তার জীবনসঙ্গী আসবে তখন তাকে সে সোনায় মুড়িয়ে রাখবে ।
এই সিদ্ধান্তের উপরে নির্ভর করে সে নিজের আয়ের একটা ছোট অংশ আলাদা জমিয়ে রাখতো । বিক্রম আবাসিক থেকে বার হওয়ার পর এগারো বছর ধরে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেছে । এই এগারো বছর তার দৈনন্দিন খরচা যৎসামান্য হলেও তার আয় কখনোই যৎসামান্য ছিল না । সে তার আয়ের যে অংশ জমে যেত সেটা বিভিন্ন জায়গায় জমিয়ে রাখতো । এই জায়গা গুলোর মধ্যে যেমন ব্যাঙ্ক এবং পোস্ট অফিস ছিল তেমনই ছিল একটা সোনার বা গহনার দোকান । দোকানটা তাদের আবাসিকের পাশেই । দোকানের মালিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী আবাসিকের ছেলেদের খুব ভালোবাসেন । যখনই আবাসিকের ছেলেদের কাউকে দেখেন তখন মুখ দিয়ে চুক চুক শব্দ করে আফসোসের স্বরে বলেন , “ বেচারার দল । নিজের বাপ মায়ের নামটা পর্যন্ত জানে না এরা । „
বিক্রম দোকান খুলে দিয়ে খাটের উপর বসে ভাবছিল সেই সোনার দোকানে যতো টাকা জমেছে তা দিয়ে কি কিনলে সবথেকে ভালো হবে । আংটি কিংবা সোনার চেইন কেনা যেতে পারে কিন্তু এগুলোতে খরচা কম । বালা দিলে কেমন হয় ? তার চিন্তনের মাঝে ঠিক সকালের তীর্থঙ্কর আর শবনমের মতই এক বয়স্ক বৃদ্ধা মহিলা দোকানের সামনে এসে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো , “ এটাই তোমার জামাই ? „
বিদ্যা সকালের অসম্পূর্ণ ব্লাউজটাতেই কাজ করছিল । মুখ তুলে বললো , “ হ্যাঁ পিসিমা । এসো বসো । দুদিন এলে না যে ? „
বৃদ্ধা মহিলা দোকানে ঢুকে খাটের উপর বসতে বসতে বললো , “ আর বলো না বৌমা । হাঁটুর বাতের কথা তো জানোই । আজকাল বড্ড ভোগাচ্ছে । „ তারপর বিক্রমকে প্রশ্ন করলো , “ তোমার নাম কি ? „
বিক্রম জবাবে বললো , “ আমার নাম বিক্রম । „
বৃদ্ধা বিস্ফোরিত নেত্রে বললো , “ কি অলুক্ষণে কান্ঠ দেখো । দিব্যার বাবার নামও তো বিক্রম । কেউ নিজের বাবার নামের ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়ায় ? কি অনাসৃষ্টি বলো দেখি ! „
বিক্রম বিদ্যা দুজনেই চুপ করে রইলো । এই কথায় কি করবে কি বলবে তা তারা দুজনেই ভেবে পেলোনা । বৃদ্ধা বলে চলেছে , “ তোমাদের শুনলাম বিয়েও হয়নি । কি আজকাল লিভিং ফিভিং করে বেড়াচ্ছো । আমাদের সময়ে তো বিয়ের আগে মুখ দেখা দেখি পর্যন্ত হতো না । কি বাবা তোমাদের যুগ তোমরা বোঝো । „
বিদ্যা মিথ্যাবাদী মিথ্থুক না । তাহলে সে এই সত্য গোপন করে যেত । তার মেয়ে যে বিয়ে না করে একটা ছেলের সাথে লিভিংয়ে গেছে সেটা বলতো না । সে বলে বেড়ায়ও নি । যে জিজ্ঞেস করেছে শুধু তাকেই সত্য কথাটা বলেছে । বৃদ্ধার এইসব কথা শুনতে বিক্রমের একটুও ভালো লাগছিল না । তাই সে উঠে বাড়ি চলে এলো । তার এই আচরণে কে কি মনে করলো তাতে তার কোন কিছু যায় আসেনা ।
বাড়ি এসে ঢুকে দেখলো দিব্যা সেই টিভির সামনেই বসে আছে । সেও তার সন্তানের মায়ের পাশে বসে টিভির হিন্দি ধারাবাহিক দেখতে লাগলো । উশখুশ করে দিব্যাকে বললো , “ তোমার আর তোমার মায়ের দুটো চুড়ি দাওতো । „
“ কি করবে ? „
“ দাও না । দরকার আছে । „
দিব্যা তার আর তার মায়ের দুটো কাঁচের চুড়ি দিয়ে দিল । দিব্যার কাছে থেকে চুড়ি দুটো নিয়ে , বিক্রম তার ব্যাগ থেকে একটা ছোট পকেট খাতা বার করে নিয়ে সেই সোনার দোকানের উদ্দেশ্যে রওনা হলো । বিদ্যার দোকান পেড়িয়ে দশ পনের মিনিট হেঁটে এসে রাজভবনের কাছ থেকে শোভাবাজার গামী একটা বাসে উঠে পড়লো । খালি বাস হওয়ায় একটা উইন্ডো সিট দখল করে বসে পড়লো । বাস চালু হতেই একটা দমকা হাওয়া তার মুখে লাগলো । সন্ধ্যা বেলার শীতল হাওয়া তার মুখে লাগতেই একটা নতুন প্রশ্ন তার মাথায় এসে ঘুরতে লাগলো ।
সে কার জন্য গহনা কিনতে যাচ্ছে ? তার আগত সন্তানের মা দিব্যার জন্য ? নাকি এগারো বছর আগে তার পছন্দ হওয়া এক সুন্দরী যে এখন তার শাশুড়ি সেই বিদ্যার জন্য ? যদি দিব্যার জন্য হবে তাহলে সে এতদিন কেনেনি কেন ? আজকে বিদ্যার গহনা বিক্রি করে দেওয়ার কথা শোনার পরেই তো সে গহনা কিনতে যাচ্ছে । এটা ঠিক যে সে দিব্যার জন্য গহনা কিনতে যাচ্ছে না । সে বিদ্যার জন্যই কিনতে যাচ্ছে । কিন্তু এটা কি ঠিক ? বিদ্যার জন্য তার এই অনুভূতি কি পাপ নয় ?
নিজের মনে এইসব ক্ষুদ্র গভীর অনুভূতির প্রশ্ন উত্তরের খেলা খেলতে খেলতে সে শোভাবাজার সিগন্যালে পৌঁছে গেল । বাস থেকে নেমে হেঁটে দোকান অব্দি যেতে বেশিক্ষণ লাগলো না । দোকানে ঢুকতেই বিশ্বজিৎ জিজ্ঞেস করলো “ অনেক দিন পর এলি যে ? „
“ ওই একটু ব্যস্ত ছিলাম। তাই আসা হয়নি । আজকে কিন্তু টাকা জমা করবো না । „
“ তাহলে ? কিছু কিনবি নাকি ? „
“ হ্যাঁ বালা কিনবো । এই চুড়ি দুটোর সাইজের বালা দেখাও তো । „
“ এতো একই সাইজ । „ বিক্রম এতক্ষণ লক্ষ্য করিনি যে বিদ্যা আর দিব্যার চুড়ির সাইজ একই।
বাসের মধ্যে মনের মধ্যে চলা দ্বন্দের নিস্পত্তির জন্য বিক্রম দুটো আলাদা ধরনের বালা কিনলো । একজোড়া মোটা বালা কিনলো দিব্যার জন্য আর একজোড়া সরু বালা নিলো বিদ্যার জন্য । বালা কেনার পর হিসাব করে দেখলো এখনো যা টাকা আছে তা দিয়ে একটা বড় নেকলেস কিনতে পারবে । হিসাব করে হাতে গয়নার দোকানের ব্যাগ নিয়ে সে বাড়ির উদ্দেশ্যে বাস ধরলো । বাড়ি যখন ঢুকলো তখন রাত নটা বেজে কুড়ি মিনিট। বিদ্যা বললো “ তুমি একটু বসো । দশ মিনিট পরেই আমি দোকান বন্ধ করছি । „
বিদ্যার দোকান বন্ধ করার সময় হয়ে এসেছে । বিক্রম বিদ্যার দোকানের সাটার নামিয়ে দিয়ে তারা বাড়িতে ঢুকে এলো । বিক্রম দরজা পেরিয়ে লিভিং রুমে ঢুকে দেখলো দিব্যা টিভি দেখছে । সে দিব্যার পাশে এসে বসে সোনার দোকান থেকে দেওয়া ব্যাগ থেকে দুটো বালার কৌটো বার করলো । বিদ্যা তখনও রান্না ঘরে ঢোকেনি । বিদ্যা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো । বিক্রম মোটা বালার কৌটোটা খুলে দিব্যার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো , “ এটা তোমার জন্য আনলাম । „
সোনার বালা দেখে দুজনেরই চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসার জোগার। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বালা দুটো খুবই দামী । দিব্যা কৌটোটা ধরলে বিক্রম এবার সরু বালার কৌটোটা খুলে বিদ্যার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো , “ এটা আপনার জন্য । „
বিদ্যা পাথর হয়ে গেল । থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো । বিক্রম হাতে ধরা কৌটোটা আর একটু এগিয়ে দিলে বিদ্যা কাঁপা হাতে কৌটোটা ধরলো । কিছুক্ষন কৌটোর ভিতরে বালা দুটোর দিকে তাকিয়ে থেকে একটা বালা বার করে দেখলো । সুন্দর সূক্ষ কারুকাজ করা ২২k সোনার বালা। বাংলা জোড়া তার খুব পছন্দ হয়েছে । সৌজন্য বশে সে বললো , “ আমার জন্য কেন কিনতে গেলে ? „
“ আর কার জন্য কিনবো ? আপনারা দুজনেই তো আমার পরিবারের একমাত্র সদস্য। „
বিদ্যা তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে । দিব্যা এক দৃষ্টিতে সোনার বালার দিকে তাকিয়ে আছে । তার মুখে খুশির কোন উচ্ছাস নেই । যে উচ্ছাস বিক্রম রাস্তাঘাটে বাসে মেয়েদের আলোচনায় দেখতে পেত । সেই উচ্ছাস দিব্যার মুখে অনুপস্থিত। বিদ্যার খুব রাগ হলো মেয়ের উপর । স্বামী ভালোবেসে সোনার বালা দিচ্ছে আর সে চুপচাপ বসে আছে । বিদ্যা মনে মনে ভাবলো , ‘ একটু বেহায়া হ । জড়িয়ে ধর বিক্রম কে । ‚
হঠাৎ দিব্যা সোফা থেকে উঠে মায়ের হাত থেকে কৌটো নিয়ে বললো “ এটা আমার বেশি পছন্দ হচ্ছে । আমি এটা নেবো । „ বলে নিজের হাতে ধরা মোটা বালার কৌটোটা বিদ্যার হাতে ধরিয়ে দিল ।
বিদ্যা আগেই নির্বাক হয়ে গেছিল । এখন তার মাথা কাজ করছে না । তার মেয়ে মোটা বালা ফিরিয়ে দিয়ে সরু বালা পছন্দ করছে । মেয়ের এমন কান্ডজ্ঞান হীনতার কোন কারণ বিদ্যা বুঝতে পারলো না । দিব্যার এই বালা বদলে বিক্রম ও কিছুটা অবাক হলো । তবে সে ভাবলো ‘ হয়তো সত্যি সরু বালা ওর বেশি পছন্দের। ‚
খাওয়ার সময় দিব্যা বললো “ কেন বিয়েটা করছো না বলো তো । „
দিব্যার এমন কথাতে দুজনেই অবাক হলো । সকালে তীর্থঙ্কর তার আর বিদ্যার সাথে দেখা করার পরেই দিব্যার সাথেও দেখা করেছিল । বিক্রমের বুঝতে বাকি রইলো না যে তীর্থঙ্কর যেমন তাকে বিদ্যাকে বিয়ের জন্য রাজি করাতে বলেছিল ঠিক তেমনি সে দিব্যাকেও তার মাকে বিয়ে জন্য কথা বলতে বলেছে । তাই দিব্যা এখন এই কথাটা তুলছে ।
বিদ্যা জামাইয়ের সামনে এই প্রশ্নের কি উত্তর দেবে সেটা বুঝতে পারলো না । তাই সে মেয়ের দিকে তাকালেও কিছু বললো না । তাই দিব্যা আরো দু একবার কথা বলে থেমে গেল । নিঃশ্চুপ মানুষের সাথে বেশিক্ষণ কথা বলা যায়না যে ।
রাতে ঘুমানোর সময় বিদ্যার এক মিশ্র অনুভূতি হলো । আগের রাতের মত শুধু নিশ্চিন্তের ঘুম আজকে হলো না । আজকে দিব্যার মুখে তীর্থঙ্করের বুলির জন্য কিছুটা অসুন্তুষ্ট , বিক্রমের সোনার বালা এনে দেওয়ার জন্য অফুরন্ত খুশি , এবং মেয়ে যে এরকম একটা ভালোবাসার মানুষ পেয়েছে সেটার জন্য মন হালকা করার আনন্দ। সব অনুভূতি মিলে মিশে আজকের ঘুমটাও ভালোই হলো তার ।
আবাসিক থেকে বার হওয়ার পর বিভিন্ন কাজের সুবাদে বিভিন্ন ধরনের মানুষের সাথে পরিচয় হওয়ার এবং তাদেরকে জানার সুযোগ হয়েছে । তখন রাস্তায় বাসে অনেক মেয়েদের কথোপকথন না চাইতেও সে শুনতে পেত । সেই কথোপকথন গুলোর বিষয়ের মধ্যে একটা সাধারন সর্বজনীন বিষয় হলো গহনা । কার বিয়েতে কে কতো গয়না কিনেছে । কাকে তার স্বামী কতো ভরির , কত গ্রামের গয়না দিয়েছে এসবই মহিলারা খুব উত্তেজিত হয়ে কথা বলতো । সেইসব মেয়েদের খুশীর উচ্ছাস তাদের চোখে মুখে ফুটে উঠতো । এইসব মুখ বিক্রমের চোখ এড়াতো না । তাই এই কথোপকথন গুলো শোনার পর সে সিদ্ধান্ত নেয় যে সে যখন বিয়ে করবে কিংবা যখন তার জীবনসঙ্গী আসবে তখন তাকে সে সোনায় মুড়িয়ে রাখবে ।
এই সিদ্ধান্তের উপরে নির্ভর করে সে নিজের আয়ের একটা ছোট অংশ আলাদা জমিয়ে রাখতো । বিক্রম আবাসিক থেকে বার হওয়ার পর এগারো বছর ধরে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেছে । এই এগারো বছর তার দৈনন্দিন খরচা যৎসামান্য হলেও তার আয় কখনোই যৎসামান্য ছিল না । সে তার আয়ের যে অংশ জমে যেত সেটা বিভিন্ন জায়গায় জমিয়ে রাখতো । এই জায়গা গুলোর মধ্যে যেমন ব্যাঙ্ক এবং পোস্ট অফিস ছিল তেমনই ছিল একটা সোনার বা গহনার দোকান । দোকানটা তাদের আবাসিকের পাশেই । দোকানের মালিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী আবাসিকের ছেলেদের খুব ভালোবাসেন । যখনই আবাসিকের ছেলেদের কাউকে দেখেন তখন মুখ দিয়ে চুক চুক শব্দ করে আফসোসের স্বরে বলেন , “ বেচারার দল । নিজের বাপ মায়ের নামটা পর্যন্ত জানে না এরা । „
বিক্রম দোকান খুলে দিয়ে খাটের উপর বসে ভাবছিল সেই সোনার দোকানে যতো টাকা জমেছে তা দিয়ে কি কিনলে সবথেকে ভালো হবে । আংটি কিংবা সোনার চেইন কেনা যেতে পারে কিন্তু এগুলোতে খরচা কম । বালা দিলে কেমন হয় ? তার চিন্তনের মাঝে ঠিক সকালের তীর্থঙ্কর আর শবনমের মতই এক বয়স্ক বৃদ্ধা মহিলা দোকানের সামনে এসে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো , “ এটাই তোমার জামাই ? „
বিদ্যা সকালের অসম্পূর্ণ ব্লাউজটাতেই কাজ করছিল । মুখ তুলে বললো , “ হ্যাঁ পিসিমা । এসো বসো । দুদিন এলে না যে ? „
বৃদ্ধা মহিলা দোকানে ঢুকে খাটের উপর বসতে বসতে বললো , “ আর বলো না বৌমা । হাঁটুর বাতের কথা তো জানোই । আজকাল বড্ড ভোগাচ্ছে । „ তারপর বিক্রমকে প্রশ্ন করলো , “ তোমার নাম কি ? „
বিক্রম জবাবে বললো , “ আমার নাম বিক্রম । „
বৃদ্ধা বিস্ফোরিত নেত্রে বললো , “ কি অলুক্ষণে কান্ঠ দেখো । দিব্যার বাবার নামও তো বিক্রম । কেউ নিজের বাবার নামের ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়ায় ? কি অনাসৃষ্টি বলো দেখি ! „
বিক্রম বিদ্যা দুজনেই চুপ করে রইলো । এই কথায় কি করবে কি বলবে তা তারা দুজনেই ভেবে পেলোনা । বৃদ্ধা বলে চলেছে , “ তোমাদের শুনলাম বিয়েও হয়নি । কি আজকাল লিভিং ফিভিং করে বেড়াচ্ছো । আমাদের সময়ে তো বিয়ের আগে মুখ দেখা দেখি পর্যন্ত হতো না । কি বাবা তোমাদের যুগ তোমরা বোঝো । „
বিদ্যা মিথ্যাবাদী মিথ্থুক না । তাহলে সে এই সত্য গোপন করে যেত । তার মেয়ে যে বিয়ে না করে একটা ছেলের সাথে লিভিংয়ে গেছে সেটা বলতো না । সে বলে বেড়ায়ও নি । যে জিজ্ঞেস করেছে শুধু তাকেই সত্য কথাটা বলেছে । বৃদ্ধার এইসব কথা শুনতে বিক্রমের একটুও ভালো লাগছিল না । তাই সে উঠে বাড়ি চলে এলো । তার এই আচরণে কে কি মনে করলো তাতে তার কোন কিছু যায় আসেনা ।
বাড়ি এসে ঢুকে দেখলো দিব্যা সেই টিভির সামনেই বসে আছে । সেও তার সন্তানের মায়ের পাশে বসে টিভির হিন্দি ধারাবাহিক দেখতে লাগলো । উশখুশ করে দিব্যাকে বললো , “ তোমার আর তোমার মায়ের দুটো চুড়ি দাওতো । „
“ কি করবে ? „
“ দাও না । দরকার আছে । „
দিব্যা তার আর তার মায়ের দুটো কাঁচের চুড়ি দিয়ে দিল । দিব্যার কাছে থেকে চুড়ি দুটো নিয়ে , বিক্রম তার ব্যাগ থেকে একটা ছোট পকেট খাতা বার করে নিয়ে সেই সোনার দোকানের উদ্দেশ্যে রওনা হলো । বিদ্যার দোকান পেড়িয়ে দশ পনের মিনিট হেঁটে এসে রাজভবনের কাছ থেকে শোভাবাজার গামী একটা বাসে উঠে পড়লো । খালি বাস হওয়ায় একটা উইন্ডো সিট দখল করে বসে পড়লো । বাস চালু হতেই একটা দমকা হাওয়া তার মুখে লাগলো । সন্ধ্যা বেলার শীতল হাওয়া তার মুখে লাগতেই একটা নতুন প্রশ্ন তার মাথায় এসে ঘুরতে লাগলো ।
সে কার জন্য গহনা কিনতে যাচ্ছে ? তার আগত সন্তানের মা দিব্যার জন্য ? নাকি এগারো বছর আগে তার পছন্দ হওয়া এক সুন্দরী যে এখন তার শাশুড়ি সেই বিদ্যার জন্য ? যদি দিব্যার জন্য হবে তাহলে সে এতদিন কেনেনি কেন ? আজকে বিদ্যার গহনা বিক্রি করে দেওয়ার কথা শোনার পরেই তো সে গহনা কিনতে যাচ্ছে । এটা ঠিক যে সে দিব্যার জন্য গহনা কিনতে যাচ্ছে না । সে বিদ্যার জন্যই কিনতে যাচ্ছে । কিন্তু এটা কি ঠিক ? বিদ্যার জন্য তার এই অনুভূতি কি পাপ নয় ?
নিজের মনে এইসব ক্ষুদ্র গভীর অনুভূতির প্রশ্ন উত্তরের খেলা খেলতে খেলতে সে শোভাবাজার সিগন্যালে পৌঁছে গেল । বাস থেকে নেমে হেঁটে দোকান অব্দি যেতে বেশিক্ষণ লাগলো না । দোকানে ঢুকতেই বিশ্বজিৎ জিজ্ঞেস করলো “ অনেক দিন পর এলি যে ? „
“ ওই একটু ব্যস্ত ছিলাম। তাই আসা হয়নি । আজকে কিন্তু টাকা জমা করবো না । „
“ তাহলে ? কিছু কিনবি নাকি ? „
“ হ্যাঁ বালা কিনবো । এই চুড়ি দুটোর সাইজের বালা দেখাও তো । „
“ এতো একই সাইজ । „ বিক্রম এতক্ষণ লক্ষ্য করিনি যে বিদ্যা আর দিব্যার চুড়ির সাইজ একই।
বাসের মধ্যে মনের মধ্যে চলা দ্বন্দের নিস্পত্তির জন্য বিক্রম দুটো আলাদা ধরনের বালা কিনলো । একজোড়া মোটা বালা কিনলো দিব্যার জন্য আর একজোড়া সরু বালা নিলো বিদ্যার জন্য । বালা কেনার পর হিসাব করে দেখলো এখনো যা টাকা আছে তা দিয়ে একটা বড় নেকলেস কিনতে পারবে । হিসাব করে হাতে গয়নার দোকানের ব্যাগ নিয়ে সে বাড়ির উদ্দেশ্যে বাস ধরলো । বাড়ি যখন ঢুকলো তখন রাত নটা বেজে কুড়ি মিনিট। বিদ্যা বললো “ তুমি একটু বসো । দশ মিনিট পরেই আমি দোকান বন্ধ করছি । „
বিদ্যার দোকান বন্ধ করার সময় হয়ে এসেছে । বিক্রম বিদ্যার দোকানের সাটার নামিয়ে দিয়ে তারা বাড়িতে ঢুকে এলো । বিক্রম দরজা পেরিয়ে লিভিং রুমে ঢুকে দেখলো দিব্যা টিভি দেখছে । সে দিব্যার পাশে এসে বসে সোনার দোকান থেকে দেওয়া ব্যাগ থেকে দুটো বালার কৌটো বার করলো । বিদ্যা তখনও রান্না ঘরে ঢোকেনি । বিদ্যা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো । বিক্রম মোটা বালার কৌটোটা খুলে দিব্যার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো , “ এটা তোমার জন্য আনলাম । „
সোনার বালা দেখে দুজনেরই চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসার জোগার। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বালা দুটো খুবই দামী । দিব্যা কৌটোটা ধরলে বিক্রম এবার সরু বালার কৌটোটা খুলে বিদ্যার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো , “ এটা আপনার জন্য । „
বিদ্যা পাথর হয়ে গেল । থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো । বিক্রম হাতে ধরা কৌটোটা আর একটু এগিয়ে দিলে বিদ্যা কাঁপা হাতে কৌটোটা ধরলো । কিছুক্ষন কৌটোর ভিতরে বালা দুটোর দিকে তাকিয়ে থেকে একটা বালা বার করে দেখলো । সুন্দর সূক্ষ কারুকাজ করা ২২k সোনার বালা। বাংলা জোড়া তার খুব পছন্দ হয়েছে । সৌজন্য বশে সে বললো , “ আমার জন্য কেন কিনতে গেলে ? „
“ আর কার জন্য কিনবো ? আপনারা দুজনেই তো আমার পরিবারের একমাত্র সদস্য। „
বিদ্যা তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে । দিব্যা এক দৃষ্টিতে সোনার বালার দিকে তাকিয়ে আছে । তার মুখে খুশির কোন উচ্ছাস নেই । যে উচ্ছাস বিক্রম রাস্তাঘাটে বাসে মেয়েদের আলোচনায় দেখতে পেত । সেই উচ্ছাস দিব্যার মুখে অনুপস্থিত। বিদ্যার খুব রাগ হলো মেয়ের উপর । স্বামী ভালোবেসে সোনার বালা দিচ্ছে আর সে চুপচাপ বসে আছে । বিদ্যা মনে মনে ভাবলো , ‘ একটু বেহায়া হ । জড়িয়ে ধর বিক্রম কে । ‚
হঠাৎ দিব্যা সোফা থেকে উঠে মায়ের হাত থেকে কৌটো নিয়ে বললো “ এটা আমার বেশি পছন্দ হচ্ছে । আমি এটা নেবো । „ বলে নিজের হাতে ধরা মোটা বালার কৌটোটা বিদ্যার হাতে ধরিয়ে দিল ।
বিদ্যা আগেই নির্বাক হয়ে গেছিল । এখন তার মাথা কাজ করছে না । তার মেয়ে মোটা বালা ফিরিয়ে দিয়ে সরু বালা পছন্দ করছে । মেয়ের এমন কান্ডজ্ঞান হীনতার কোন কারণ বিদ্যা বুঝতে পারলো না । দিব্যার এই বালা বদলে বিক্রম ও কিছুটা অবাক হলো । তবে সে ভাবলো ‘ হয়তো সত্যি সরু বালা ওর বেশি পছন্দের। ‚
খাওয়ার সময় দিব্যা বললো “ কেন বিয়েটা করছো না বলো তো । „
দিব্যার এমন কথাতে দুজনেই অবাক হলো । সকালে তীর্থঙ্কর তার আর বিদ্যার সাথে দেখা করার পরেই দিব্যার সাথেও দেখা করেছিল । বিক্রমের বুঝতে বাকি রইলো না যে তীর্থঙ্কর যেমন তাকে বিদ্যাকে বিয়ের জন্য রাজি করাতে বলেছিল ঠিক তেমনি সে দিব্যাকেও তার মাকে বিয়ে জন্য কথা বলতে বলেছে । তাই দিব্যা এখন এই কথাটা তুলছে ।
বিদ্যা জামাইয়ের সামনে এই প্রশ্নের কি উত্তর দেবে সেটা বুঝতে পারলো না । তাই সে মেয়ের দিকে তাকালেও কিছু বললো না । তাই দিব্যা আরো দু একবার কথা বলে থেমে গেল । নিঃশ্চুপ মানুষের সাথে বেশিক্ষণ কথা বলা যায়না যে ।
রাতে ঘুমানোর সময় বিদ্যার এক মিশ্র অনুভূতি হলো । আগের রাতের মত শুধু নিশ্চিন্তের ঘুম আজকে হলো না । আজকে দিব্যার মুখে তীর্থঙ্করের বুলির জন্য কিছুটা অসুন্তুষ্ট , বিক্রমের সোনার বালা এনে দেওয়ার জন্য অফুরন্ত খুশি , এবং মেয়ে যে এরকম একটা ভালোবাসার মানুষ পেয়েছে সেটার জন্য মন হালকা করার আনন্দ। সব অনুভূতি মিলে মিশে আজকের ঘুমটাও ভালোই হলো তার ।