12-09-2023, 08:33 PM
স্মৃতি সুন্দরী ২.২
মেয়েটার কথায় বিক্রমের শুধু হুঁশ-ই ফিরলো না , সে বেঁচেও গেল । বেঁচে গেল তার জীবনে ঘটে যাওয়া সেই ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মত এক সত্য ঘটনার স্মৃতিচারণের হাত থেকে । যা মনে পড়লেই তার বুক কাঁপিয়ে দেয় , গায়ের লোম খাঁড়া হয়ে যায় , হাত পা ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে । দরদর করে ঘামতে থাকে সে । মনে করতে না চাইলেও বারেবারে ফিরে আসে দুঃস্বপ্নের আকারে ।
মেয়েটার কথায় বিদ্যা ঘুরে চাইলো , তারপর হাসি মুখে বললো , “ ও , শবনম , আয় বোস ...
বিক্রম বিদ্যার হাসিটা দেখলো । কিছুক্ষন আগে যখন তীর্থঙ্কর এসেছিল তখনও বিদ্যা হেসেছিল । কিন্তু তখন যেন সেই হাসিটা মেকি লাগছিল । বরং এখন এই শবনম নামের মেয়েটা আসার পর বিদ্যার মুখে যে হাসিটা দেখা দিল সেটাই যেন আসল , কোন ভেজাল নেই এই হাসিতে । বিক্রমের মনে হলো এটাই বিদ্যার খাঁটি হাসি ।
বিদ্যার খাঁটি মিষ্টি হাসি দেখে বিক্রমের মনে এক শীতল মিষ্টি প্রানবন্ত হাওয়া বয়ে গেল । কিছুক্ষন আগে এক ভয়াবহ স্মৃতি তার গলা চেপে ধরে তার শ্বাস রোধের কারন হয়ে দাঁড়িয়েছিল , আর এখন বিদ্যার হাসি যেন তাকে এক তাজা মুক্তো হাওয়া দিয়ে তাকে তরতাজা করে তুললো ।
বিক্রম নবাগত মেয়েটার দিকে তাকালো । বিদ্যার মুখেই মেয়েটার নাম সে শুনতে পেয়েছিল । মেয়েটার নাম ‘ শবনম , । প্রথমেই যেটা বিক্রমের চোখে পড়লো সেটা শবনমের পেট । মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা । বিক্রমের তৎক্ষনাৎ মনে পড়লো গতকাল বিকালে এই মেয়েটাকেই সে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল । বিক্রম ভালোভাবে দেখলো দিব্যার পেটের তুলনায় শবনমের পেট বেশি বড় । শবনমের পেট দেখে সে ধারনা করলো প্রায় ছয় সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা তো হবেই । মেয়েটার পরনে আছে একটা ময়লা নিল রঙের সুতির শাড়ি , তাতে সবুজ ফুল আঁকা আর সবুজ ব্লাউজ । গায়ের রঙটাও তার পড়নের শাড়ির মতই ময়লা । বয়স তেইশ চব্বিশ তো হবেই । চুল খোঁপা করে বাঁধা । নাকে , কানে , গলায় কোন অলংকার নেই । দুই হাতেও কোন কিছু নেই , এমনকি সাধারণ কাঁচের দুটো চুড়িও না । গায়ে অলংকার নামক শৃঙ্গারের অস্তিত্ব না থাকলেও ঠোঁটে এক মন ভোলানো মিষ্টি হাসি লেগে আছে যা তার মুখের সৌন্দর্য কে হাজার গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
শবনম দোকানের ভিতর ঢুকে কিছুক্ষন আগে তীর্থঙ্কর যে টুলটায় বসেছিল সেই টুলে বসলে বিদ্যা বললো , “ ওখানে বসছিস কেন ? তোকে বলেছিনা খাটে বসবি । „
“ না , আমি এখানেই ঠিক আছি দিদি । „
বিদ্যা এবার একটু রাগী স্বরেই বললো , “ খাটে বসতে বলছি । „
শবনম বিদ্যার রাগী কন্ঠের কথা শুনে টুল থেকে উঠে বিক্রমের থেকে একটু দূরে খাটেই বসলো । বিক্রম বুঝলো কেন শবনম খাটে বসতে চাইছিল না । কারন শবনেমর শাড়ি নোংরা । এই এগারো বছরে বিক্রম হরেক রকমের , বিভিন্ন মানসিকতার এবং বিভিন্ন জাতের মানুষ দেখেছে । তাদের সাথে মিশেছে , কথা বলেছে । এই হরেক রকম মানুষের মধ্যে শবনমও একধরনের মানুষ যারা নিজেদের পোষাক পরিচ্ছদ দেখে সমাজে নিজেই নিজেদের একটা স্থান দিয়ে দেয় । এরা বড় কোন বাড়িতে গেলে সোফা কিংবা খাটে বসতে চায় না । কোন নেমতন্ন বাড়িতে গেলে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চায় । সবার শেষে একটা কোনা দেখে খেতে বসে । ঠিক তেমনি শবনমও নিজের ময়লা শাড়ির জন্য বিদ্যার দোকানের খাটের উপর পাতা সাদা পরিষ্কার চাদরের উপর বসতে চাইছিল না । যাতে নিজের শাড়ির জন্য চাদরটা না নোংরা হয়ে যায় !
শবনম খাটে বসলে বিদ্যা তার সেলাই মেশিনের সামনে বসতে বসতে বললো , “ এখন চলে এলি যে বড়ো ! রান্না হয়েছে ? „
মেয়েটা মিষ্টি সুরে বললো , “ লান্না কলিনি । পান্তা ভাত খেয়ে ও কাজে চলে গেছে । ঘলে একা বসে বসে ভালো লাগছিল না তাই তোমাল জামাই দেখতে চলে এসছি । „ তারপর বিক্রমকে উদ্দেশ্য করে সে বললো , “ এই দাদাটাই তোমাল জামাই ! „
বিক্রম মেয়েটাকে ভালো ভাবে দেখলো এবং বুঝলো যে , শবনমেরর বাকি সব ঠিক থাকলেও ‘ র , বর্ণ ঠিক নেই । ‘ র , এর জায়গায় সে ‘ ল , উচ্চারণ করে । শবনমের কথাবার্তা শুনে তার চরিত্রের একটা দিক বিক্রম বুঝতে পারলো । সেটা হলো শবনমের সাহস । কি সুন্দর অকপটে লজ্জা এবং দ্বিধাহীন ভাবে সে বলছে যে সে জামাই দেখতে এসেছে । লজ্জা নেই মানে তাকে কিন্তু কোন ভাবেই নির্লজ্জ বলা যায় না । বরং এই লজ্জাহীনতাই শবনমেরর চরিত্রকে এক দৃঢ়তা প্রদান করছে । শবনমের এই গুনে বিক্রম মুগ্ধ হয়ে গেল ।
“ হ্যাঁ কিন্তু তুই যে সম্পর্কের জগাখিচুড়ী করে দিলি । „ কথাটা বলার পরেই বিদ্যার মুখটা শুকিয়ে গেল । বিদ্যার কথার মানে বুঝতে শবনম এবং বিক্রম দুজনেরই বিন্দুমাত্র সময় লাগলো না । কথাটা হলো শবনম বিদ্যাকে দিদি বলে ডাকে আর এখন বিক্রমকে দাদা বলে ডেকেছে। নিজেকে সামলে নিয়ে ব্যাপারটাকে অতোটাও গুরুত্ব না দিয়ে বিদ্যা বললো , “ বস । তোর জন্য চা আনি । „
“ আমি সকালে চা খেয়েছি । „
“ বোস তো । „ বলে বিদ্যা দোকানের পিছনের দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেল ।
বিদ্যা চলে যাওয়ার পর শবনম বিক্রমকে বললো , “ দাদা তোমায় একটা কথা বলছি । খালাপ ভেবোনা কো । „
কথাটা শুনে বিক্রম একটু হকচকিয়ে গেল । পাঁচ মিনিট ও হয়নি তাদের আলাপের । এইটুকু সময়ের মধ্যে একে অপরকে বলার মত কোন কথা তো তৈরি হতে পারেনা । আর কিইবা এমন এমন কথা যার জন্য সে শবনমকে খারাপ ভাবতে পারে । বিক্রম শবনম কে আশ্বস্ত করে বললো , “ হ্যাঁ বলো না । খারাপ ভাববো কেন ! „
“ তুমি তো দিব্যা দিদিমনিকে নিয়ে চলে গেলে । দিব্যা দিদিমনি যাওয়াল পল দিদি খুব একা হয়ে গেছিল । এই এত্ত বলো বালিতে একা একা থাকা যায় না দাদা । আর দিদি তো তিন মাস একা কাটিয়েছে । „ কথা গুলো বলতে বলতে শবনমের গলায় কিছু একটা আটকে গেল । চোখের কোনায় দেখা দিল মুক্তোর মত স্বচ্ছ শুদ্ধ অশ্রুকণা। যা তার দুই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো । কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার , “ আমি লোজ আসতাম । এসে দিদিল সাথে যতোক্ষন থাকা যায় ততক্ষণ থাকতাম কিন্তু দিব্যা দিদিমনিল জায়গা নিতে পালিনি । তোমাল দুটো পায়ে পলি দাদা , দিদিকে একা ফেলে আর কোথাও যেও না। যদি দিদিল কোন অসুখ বিসুখ হতো তাহলে কে দেখতো বলো তো ? আল্লা দিদিকে লক্ষা কলেছেন ....
কোন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের তোতলা কথা শুনলে অনেকেই হেসে ফেলে কিন্তু এখন শবনমের এই তোতলা শব্দ গুলো শুনতে শুনতে বিক্রম পাথর হয়ে গেল । সে জানে একা থাকার যন্ত্রণা কতোটা । তাই বিদ্যার এতদিনের একাকিত্বের যন্ত্রণা তার মনের সবথেকে কোমল এবং দূর্বল স্থানে গিয়ে আঘাত করলো । বিক্রম কিছু বলবে তার আগেই উঠোন থেকে বিদ্যার চটির আওয়াজ পাওয়া গেল । সেই শব্দ শুনে শবনম নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে দ্রুত চোখের জল মুছে নিল ।
বিক্রমের মনে হলো চা করতে তো এত কম সময় লাগে না । বিদ্যা এসে চা ভর্তি পেয়ালা শবনম কে দিয়ে আবার সেলাই মেশিনের সামনে রাখা চেয়ারে গিয়ে বসলো । তারপর একটা সবুজ রঙের কাপড় ফিতে দিয়ে মেপে কাটতে শুরু করলো । শবনম চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে বিক্রমের মনে থাকা প্রশ্নটা করলো , “ এত তালাতালি কি কলে চা আনলে ? „
বিদ্যা বললো , “ কিছুক্ষন আগে তীর্থঙ্কর এসেছিল , তখন ওর জন্য চা করেছিলাম । অল্প ছিল সেটাই আনলাম । এখনো গরম আছে । তুই না আসলে আমিই চা টা খেয়ে নিতাম । „
শবনম চা খেতে খেতে ইয়ার্কি করে বললো , “ দিব্যা দিদি তো দুধেল মত ফস্সা আর তোমাল জামাই তো কালো ! „
এই কথাটা শুনে বিক্রম আর একটু হলে অট্টহাসি হেসে ফেলতো । কারন সে অতোটাও কালো নয় যতোটা শবনম তাকে বলছে । নিজের হাসিটাকে খুব কষ্ট করে সংবরন করলো বিক্রম । হাসি চাপার জন্য বিক্রম খুকখুক করে কেশে ফেললো ।
বিদ্যা মুখ দিয়ে “ আগে „ শব্দটা বলে চেপে গেল । আর একটু হলে মুখ ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছিল যে ‘ আগে যখন আবাসিকে দেখেছিলাম তখন এতো কালো ছিল না । রোদে পুড়ে এমন হয়েছে । ‚
মুখে আসা কথাটা না বলে বিদ্যা নিজেকে সামলে নিয়ে , শবনমের পাকামি দেখে মুখ ফুলিয়ে চোখ রাঙিয়ে বললো , “ খুব যে আমার মেয়ের বরের দিকে নজর দিচ্ছিস । তোর স্বামি তো আরো কালো । „
বিক্রম এর আগে অনেকবার রাস্তাঘাটে , দোকানপাটে , বাসের মধ্যে দুই মেয়ের কথোপকথন শুনেছে । কিন্তু কখনো তাদের কথাবার্তার বিষয়বস্তু হয়নি । এখন যখন তাকে নিয়ে দুই অসমবয়সী নারী কথা বলছে তখন নিজেকে তার খুব মূল্যবান মনে হলো । দুজনের কথাবার্তা সে খুব উপভোগ করতে লাগলো ।
আরো কিছুক্ষন এদিক ওদিকের কথা বলে শবনম চলে গেল । বললো , “ যাই , ঘল গোছাতে হবে । আমি আসি দিদি । „ বলে সে উঠে চলে গেল । বিক্রম দেখলো দোকানের পাশে কাঠগোলাপ গাছের গা ঘেঁসে যে গলিটা চলে গেছে শবনম সেই গলিতে ঢুকে পড়লো ।
শবনম চলে যাওয়ার পর বিদ্যা একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বললো , “ এই অবস্থায়ও বাড়ির সব কাজ নিজেই করে । কতোবার বারন করেছি । বারন শুনলে হয় ! বলে নাকি ও ওর আম্মিকে কোলে পেটে দুটো বাচ্চা নিয়ে এইসব কাজ করতে দেখেছে । ও কেন পারবে না ? „
কথাটা শুনে বিক্রমের খুব খারাপ লাগলো। সেও যখন কম খরচের জন্য বিভিন্ন বস্তিতে থাকতো তখন এরকম দেখেছে । অল্প বয়স , মাথায় মোটা লম্বা করে সিঁদুর দেওয়া । গর্ভে একজন সন্তান আছে এবং কোলের সন্তান কাঁদছে , সেই অবস্থায় সে বাড়ি ঝাঁট দিচ্ছে । দৃশ্যটা আর একবার মনে পড়ে গেল ।
বিদ্যা আরো বললো , “ শবনম এই চার পাঁচ মাস হলো এখানে এসেছে । „ বিদ্যার কথায় বিক্রম বিদ্যার মুখের দিকে তাকালো । বিদ্যা তার দিকে না তাকিয়ে কাপড় কাটতে কাটতে বলে চলেছে , “ পাশের বস্তিতে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে । ওর বর ট্যক্সি চালায় । মাঝে মাঝেই অকারনে গায়ে হাত তোলে । মেয়েটার জন্য বড্ড মায়া হয় । „
বিক্রম কথাটা না বলে থাকতে পারলো না , “ এই অবস্থায়ও মারে ? মানে বাচ্চা পেটে তবুও ! „
বিদ্যা উদ্রেক প্রকাশ করে মাথা তুলে তার দিকে তাকিয়ে বললো , “ তাহলে আর বলছি কি তোমায় ! কোন বড় কিছু হলে কি হবে বলোতো ? একটা মেয়ের কাছে মাতৃত্বের সুখ তার হৃদয়ের , তার জীবনের কতোটা অংশ জুড়ে থাকে সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না । ভয় হয় খুব । „ একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে আবার বললো , “ ও একবার বলেছিল , আগে যেখানে ছিল সেখানেও নাকি গায়ে হাত তুলতো । ওখানকার লোকেরা তাড়িয়ে দিয়েছে । থাকতে দেয়নি । তাই এখানে চলে এসেছে । „
বিক্রম মুখে কিছু না বললেও তার মনের ভিতর এখন বহু কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছুক্ষন আগে বিক্রম বিদ্যার জন্য শবনমকে কাঁদতে দেখেছিল আর এখন শবনমের জন্য বিদ্যাকে হাহুতাশ করতে দেখলো । চার পাঁচ মাসের মধ্যে দুই ভিন্নধর্মী অসমবয়সী নারী একে অপরকে কতোটা আপন করে নিয়েছে সেটা বিক্রম বুঝতে পারছে ।
এর সাথে সে এটাও বুঝলো যে বিদ্যা তার কাছে এখন খুব সহজ হয়ে গেছে । মেনে নিয়েছে তাকে নিজের জামাই হিসাবে। আর সম্ভবত , না , সম্ভবত না , বিক্রম পুরোপুরি নিশ্চিত যে সেই এগারো বছর আগের ফুলের কথাটা বিদ্যার মনে নেই । তাই সে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো ।
বিক্রম নিজের মনে এইসবই ভাবছিল । ঠিক তখন সে বিদ্যার এক অপরূপ মনমোহিনী রূপের দর্শন লাভ করলো । কাপড় কাটা হয়ে গেলে বিদ্যা পাশ থেকে একটা চশমা বার করে সেটা পড়লো । নীল রঙের একটা আধুনিক চশমা । শুধু একটা চশমা যে কাউকে এতোটা সুন্দর করে তুলতে পারে , কারোর মুখের সৌন্দর্যকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে , সেটা বিক্রম এই প্রথম দেখলো । মনে হলো বিদ্যার এ সৌন্দর্য বাস্তব নয় । কোন স্বপ্নপুরীর মায়াবী সুন্দরী । যা যেকোন পুরুষকে ভুলিয়ে নিজের পিছনে অন্ধের মত ধাওয়া করাতে পারে । বিক্রম নিজের চক্ষু বিস্ফোরিত করে , মুখ হাঁ করে বেশ কিছুক্ষন এই স্বপ্নসুন্দরীর সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিল । বিক্রম দেখলো চশমা পড়া হয়ে গেলে বিদ্যা সবুজ রঙের সুতো সেলাই মেশিনের সূচে পড়িয়ে নিল । তারপর পা চালিয়ে সেলাইয়ে মন দিল । সেলাই মেশিনের আওয়াজে বিক্রম নিজেকে সংবরণ করে আবার রাস্তার দিকে তাকালো ।
খাটের উপর তার পাশে রাখা একটা পুরানো হিসাবের খাতা ছিল । সে হাত বাড়িয়ে সেটা নিয়ে খুলে দেখতে লাগলো । এক আধ ঘন্টা ধরে খাতাটায় বিভিন্ন হিসাব দেখে বিক্রম খাতাটা আবার রেখে দিল । গোটা কয়েক মাসের হিসাব অনুযায়ী বিদ্যার মাসিক আয় গড়ে পনের হাজারের একটু বেশি। আর বেশিরভাগ আয় হয় সেলাইয়ের কাজ থেকে । দুই জনের সংসারে পনের হাজার টাকায় আরামসে চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু বিক্রমের কেমন একটা লাগলো । বাড়িতে বড় টিভি নেই , বড় ফ্রিজ নেই । এমনকি এই দোকানটাও বেশ পুরানো , কয়েক জায়গায় দেওয়াল ফেটে গেছে । অনেক বছর নতুন রঙ করানো হয়নি । তাহলে টাকা গুলো যায় কোথায় ? কথাটা ভাবতে ভাবতে বিক্রম দোকান বন্ধ করার শাটারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো , “ এই শাটার বন্ধ করতে অসুবিধা হয়না আপনার ? „
বিক্রম যখন খাতা দেখছিল তখন বিদ্যা ব্লাউজ তৈরীতে ব্যস্ত ছিল । এখনো কিছুটা বাকি । সেলাই মেশিন বন্ধ করে চাপা স্বরে বললো , “ অসুবিধা আর নতুন করে কি হবে ! ওই মতিদা আছে , মতিদাই শাটার নামিয়ে দেয় তুলে দেয় । „ বিক্রম অজান্তেই বিদ্যার মনের গভীরে আঘাত করেছে । তাই যে কথাটা সে কাউকে বলে বেড়ায়না সেটাই সে বিক্রম কে বলে ফেললো । সে বললো , “ শাটারে একটা চেন লাগানোর ইচ্ছা ছিল খুব । কিন্তু দিব্যার নার্সিং পড়ার খরচের জন্য ব্যংক থেকে থেকে লোন নিতে হয়েছে । ওর স্কুটি কিনতে গিয়েও সব গয়না বেচে দিতে হয়েছে ... „ শেষ কথাটা বলতে গিয়ে বিদ্যার গলায় কিছু একটা দলা পাকিয়ে এলো তাই কথাটা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল ।
বিক্রম বুঝলো যে বিদ্যা কাঁদছে। তাই সে আর কথা বাড়ালো না । চুপ করে বসে রইলো । দিব্যার যে স্কুটি কেনার জন্য বিদ্যা সব গয়না বেচে দিয়েছে সেই স্কুটি এখন বিক্রমের বাড়ির বারান্দাতে দাঁড়িয়ে আছে ।
বিদ্যা এই কথা গুলো বিক্রমকে বলতে চাইনি । কাউকে সে কখনোই বলতে চায়না । নিজের দুঃখের কথা শুনিয়ে কাউকে দুঃখিত করা বা সহানুভূতি আদায় করা বিদ্যার চরিত্রের গুন নয় । সে চাপা স্বভাবের , মিতভাষী গৃহীনি ।
কথা গুলো বিক্রমকে বলার পর বিদ্যা নিজের আচরণে অবাক হলো । এই কয়েক ঘন্টার আলাপে বিক্রম যে তার মনে এতোটা স্থান দখল করে নিয়েছে সেটা সে বোঝেনি । তাই নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার মনের গভীরে জমে থাকা দুটো কষ্টের কথা সে বিক্রমকে বলে ফেলেছে । কিন্তু কি করে বিক্রম তার মনে এই স্থান দখল করলো সেটাই বিদ্যাকে ভাবিয়ে তুললো । হয়তো কাল রাতে বাসন মাজার সময় বিক্রমের কথা শুনতে শুনতে বিক্রমের উপর একটা দূর্বলতা এসে গেছে । বিক্রমকে সে মন থেকে নিজের জামাই মেনে নিয়েছে । তাই তাকে নিজের পরিবারের একজন সদস্য ভেবে নিজের মনের দূর্বল অনুভূতি থেকেই কথাগুলো সে তাকে বলে ফেলেছে । নিজেকে সামলে নিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে নিয়ে বিদ্যা বললো , “ পরের মাসেই পূজা । এখনো অনেক কাজ বাকি । দোকানে কি কি আছে সেটা গুনে নিয়ে নতুন কাপড় কিনতে হবে । „
বিদ্যার অশ্রু দেখে বিক্রম বিচলিত হয়ে পড়লো । এই মহিলার কিছুটা দুঃখ লাঘব করার জন্য সে উঠে দাঁড়িয়ে বললো , “ আপনি বলুন কিভাবে গুনতে হবে আমি গুনে দিচ্ছি । „
“ তুমি করবে ? „
“ চুপচাপ বসে থাকতে আমার ভালো লাগে না । আপনি বলুন কিভাবে গুনতে হবে , আমি সেইভাবেই গুনে দিচ্ছি । „
বিদ্যা বিক্রমের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো , “ কোন কোন শাড়ি কত পিস আছে সেটা গুনলেই হবে । „ তারপর একটা প্রশ্ন করলো , “ তুমি শাড়ি চেনো তো ? „
“ হ্যাঁ চিনি । „ বলে নিজের শাড়ি সম্পর্কে জ্ঞান দিতে লাগলো , “ সুতি তাঁত সিল্ক বেনারসি ঢাকাই .....
বিদ্যা মুচকি হেসে বললো , “ ঠিক আছে । গুনে এই খাতাটায় লিখলেই হবে । „
বিদ্যার কথা মত বিক্রম দোকানে থাকা সমস্ত শাড়ির হিসাব করলো ।
বিক্রমের শাড়ি গোনা হয়ে গেলে বিদ্যাও তাকে কাপড় গুনতে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো । বিদ্যা রঙ অনুযায়ী কাপড়ের পিস বলতে শুরু করলো আর বিক্রম সেটা খাতায় লিখে রাখতে লাগলো । দিব্যার সাথে লিভিংয়ে থাকার সময় এইভাবে দুজনে মিলে কোন কাজ তারা করেনি । তাই কিছুক্ষন পরেই বিক্রমের মনটা এক অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে উঠলো । তার ঠোঁটের কোনায় এক লজ্জার হাসি দেখা দিলো যা বিদ্যা দেখতে পেল না । বিক্রমের মনে হলো সে যেন তার স্ত্রীকে দোকানের কাজে সাহায্য করছে । প্রায় দুই ঘন্টা ধরে দুইজন দোকানের সমস্ত শাড়ি , বিছানার চাদর , গামছা , তোয়ালে , মশারি , ব্লাউজের কাপড় হিসাব করলো ।
দুপুর বারোটা নাগাদ দুজনে দোকান বন্ধ করে দিয়ে বাড়িতে চলে এলো । বিদ্যা ঘরে ঢুকেই রান্না করতে চলে গেল । আর বিক্রম বাড়িতে ঢুকে দেখলো যে দিব্যা লিভিং রুমে বসে কালকের রাতের হিন্দি সিরিয়ালের রিক্যাপ দেখছে । এটা বিক্রম লিভিং থাকাকালীনই লক্ষ্য করেছে । দিব্যা টিভি দেখার পোকা । যত রাজ্যের হিন্দি সিরিয়াল , রিয়্যালিটি শো , বিগ বস , খাতরো কে খিলাড়ি সে সব দেখে । শুধু টিভির সামনে বসিয়ে দিলেই তার আর কিছু চাইনা ।
বিক্রম দেখলো দিব্যার চুল ভিজে । মানে তার স্নান হয়ে গেছে । তাকেও স্নান করতে হবে । ব্রাশ করা , হাত মুখ ধোয়া , কিংবা এমার্জেন্সি বাথরুম করার জন্য বাড়ির ভিতরের বাথরুম ব্যাবহার করা হলেও স্নান করার জন্য আগাগোড়াই উঠোনের বাথরুম ব্যাবহার করা হয় । বিক্রম সেটাতেই স্নান করার জন্য ঢুকলো ।
বাথরুমে এসে দেখলো দুটো ছোট ছোট ড্রাম আর একটা বড় বালতিতে জল ভর্তি করা আছে । নিশ্চয়ই কোন এক ফাঁকে বিদ্যা এসে মিউনিসিপ্যালিটির জল ভরে গেছে ।
বাথরুমের দরজা বন্ধ করে , কোমরে গামছা জড়িয়ে প্যান্ট খুলতে খুলতে বিক্রম দেখলো বাথরুমের মেঝেতে শ্যাওলা জমে স্যাদলা পড়ে আছে । শ্যাওলা দেখে বিক্রমের মনে হঠাৎ এক দায়িত্ববোধ জেগে উঠলো । পুরুষ হওয়ার দায়িত্ববোধ। এই বাড়ির জামাই সে , সেই অর্থে এই বাড়ির বা এই পরিবারের একমাত্র পুরুষ সদস্য । তাই একটা বাড়ির পুরুষ সদস্যের যা যা করণীয় সবকিছু করার সিদ্ধান্ত সে নিল । বাথরুমের মেঝের স্যাদলা পরিষ্কার করা পুরুষ সদস্যের কাজ কিনা সেটা আলোচনা সাপেক্ষ । কিন্তু সেটা পরে ভেবে দেখা যাবে । আপাতত নিজেকে এ বাড়িতে আরো খাপ খাইয়ে নিতে হবে ।
এটা ভেবেই সে চারিদিকে তাকিয়ে স্যাদলা পরিষ্কার করার জন্য কিছু একটা খুঁজতে লাগলো । বাথরুমের এক কোনায় দুটো নারকেল মালাও পেয়ে গেল । তাতে ছাই রাখা আছে । বিক্রম বুঝলো এই ছাই কালি পড়া হাড়ি কড়াই পরিষ্কার করার জন্য রাখা আছে । দরজা বন্ধ করে দেওয়ার পর বাথরুম একটু অন্ধকার হয়ে গেছিল । বাথরুমের মেঝে আরো ভালো ভাবে দেখার জন্য সে বাথরুমের দরজাটা খুলে দিয়ে আর কিছু না ভেবে ওই দুটো মালার ছাই এক কোনায় ঢেলে দিয়ে সে বাথরুমের মেঝে পরিষ্কার করতে শুরু করলো ।
দিব্যা তখন সোফায় বসে সেলফি তুলতে ব্যাস্ত । সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত নিজের প্রেগনেন্সির আপডেট দেয় সে । বিক্রম এসব কিছুই জানে না । তার যে স্মার্টফোন নেই , দেখবে কি করে ? প্রফুল্লদা একবার বলেছিল স্মার্টফোন কেনার জন্য। কিন্তু বিক্রম রাজি হয়নি । পাউট করে , দুই আঙুল দেখিয়ে সেলফি তুলতে তুলতে স্নানঘর থেকে আসা খসখসের আওয়াজ দিব্যা শুনতে পেল । সেই আওয়াজ বিদ্যাও রান্নাঘর থেকে শুনতে পেল । রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে মেয়ের উদ্দেশ্যে বললো , “ দাঁড়া দেখছি । „
স্নানঘরের দরজায় এসে দাঁড়াতেই বিদ্যার চোখে এক নেশার ছায়া দেখা দিল । বিক্রম খালি গায়ে শুধুমাত্র কোমরে একটা গামছা পড়ে মালা দিয়ে শ্যাওলা পরিষ্কার করছে । বহুদিন পর বিদ্যা কোন পুরুষ মানুষকে অর্ধ উলঙ্গ দেখছে । বিক্রমের প্রশস্ত ছাতির ঘন কালো লোম যা সরু হয়ে পেটের মাঝ বরাবর গিয়ে তার গামছার ভিতর অবধি চলে গেছে । মালা দিয়ে মেঝে ঘষার জন্য তার হাতের পেশি বারবার ফুলে উঠছে । আর তার গামছা পাছার সাথে লেগে আছে , যার জন্য বিক্রমের বৃহৎ গম্বুজের মতো দুটো থাই আর বৃহৎ পাছা বিদ্যার সামনে দৃশ্যমান। বিক্রমকে এই অবস্থায় দেখে বিদ্যার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠলো । হৃৎপিণ্ড ধুকপুকানি বেড়ে গেল । নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা ঝাড়া দিয়ে বিদ্যা ওখান দিয়ে চলে আসলো ।
ঘরে ঢুকে মেয়েকে শুধু বললো , “ ও শ্যাওলা পরিষ্কার করছে । „
দিব্যা শুনলো কি শুনলো না সেটা লক্ষ্য না করেই বিদ্যা আবার রান্নাঘরে ঢুকে পড়লো । রান্না করতে করতে বারেবারেই তার চোখের সামনে বিক্রমের লোমশ প্রশস্ত ছাতি , ফুলে ওঠা হাতের পেশী আর গম্বুজের মতো দুই থাই আর পাছা ভেসে উঠতে লাগলো ।
মেঝে পরিষ্কার করে স্নান করে এসে বিক্রম ঘরে ঢুকলো । জামা প্যান্ট পড়ে সোফায় বসে খবর দেখতে লাগলো । কিছুক্ষন পর রান্না শেষ হয়ে গেলে বিদ্যা স্নান করতে এলো । এসে দেখলো বাথরুমের মেঝে ঝকঝকে পরিষ্কার। নিজের মুখ দেখা যাচ্ছে বললেও বাড়াবাড়ি হবে না । বিদ্যার মনটা এক অদ্ভুত ভালোলাগায় ভরে উঠলো । তার মেয়ে যে একজন ভালো কর্তব্যশীল জীবনসঙ্গী বেছে নিতে পেরেছে সেটা ভেবেই তার মাতৃ হৃদয় গর্বে ভরে উঠলো ।
পাশের বস্তিতে থাকা অন্য মহিলাদের মত বিদ্যা শাড়ি পড়ে স্নান করে না । সে শাড়ি খুলে রেখে তার কোমল অতৃপ্ত নারী শরীরে জল ঢালতে লাগলো । নিমেষের মধ্যে জলে ভিজে তার শায়া ব্লাউজ তার শরীরে লেপ্টে গেল । প্রাচীন কালের সাহিত্যে তখনকার গ্রামের নবযৌবনা কুমারী নারী স্নান করে পরনে শুধুমাত্র একটা শাড়ি জড়িয়ে কোমরে জল ভর্তি কলসি নিয়ে আঁকা বাঁকা পথে বাড়ি ফেরার যে সৌন্দর্য বর্ণনা আছে তা হুবহু বিদ্যার এই স্নানরত সৌন্দর্যের সাথে মিলে যায় । আর তার এই সৌন্দর্য প্রতিফলিত হলো বিক্রমের সদ্য পরিষ্কার করা মেঝেতে । এতদিনের অপরিচ্ছন্ন নোংরা মেঝে পরিষ্কার হওয়ার পর যেন একটু বেশি বেহায়া লম্পট হয়ে উঠলো । বিদ্যার কোমল শরীরের বিভিন্ন খাঁজ , তার ব্লাউজের ভিতর উত্থিত সুডৌল পিন্নোনত স্তন , বৃহৎ কটিদেশের খাঁজে ঢুকে যাওয়া শায়া , তার গভীর নাভী , নরম মাংসল পেট , তার শরীরের উপর বিন্দু বিন্দু জলকণা সবই সেই মেঝেতে প্রতিফলিত হতে লাগলো ।
কালিদাসের মেঘদূত কাব্যে যেমন এক আষাঢ়ের মেঘ অভিশাপ প্রাপ্ত যক্ষের বার্তা তার বিরহী প্রিয়ার কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা আছে ঠিক তেমনি বিক্রমের পরিষ্কার করা মেঝে বিদ্যার এই অপরূপ মনমোহিনী রূপের বর্ণনা বিক্রমের কাছে পৌঁছে দিতে চায় ।
বিদ্যা স্নান করে এসে ঘরে ঢুকলো । তার পরনে একটা সাদা শাড়ি , শাড়ির উপর দেবনাগরীতে কিছু লেখা আছে । আর নীল ব্লাউজ । লম্বা ভেজা চুল শোকানোর জন্য গামছা বাধা । হাতে একটা বালতি । তাতে ভেজা শাড়ি শায়া ব্লাউজ আছে । ঘরে ঢুকে বিক্রমের পাশ দিয়েই বিদ্যা সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল । বিদ্যার ভিজে পায়ের ছাপ দেখতে দেখতে বিক্রমের পুরানো কিছু স্মৃতি মনে পড়লো ।
যখন সে আগে সারাদিন কাজ করতো । তখন রাতে খেয়ে দেয়ে এসে ঘুমানোর পর রোজ একধরনের স্বপ্ন দেখতো । সেই স্বপ্নে তার ছোট একটা বাড়ি আছে । তাতে সে তার স্ত্রী আর সন্তানকে নিয়ে থাকছে । তার স্ত্রী এইভাবেই স্নান করার পর ভেজা চুলে গামছা বেঁধে থাকে । আর যখন সে তার এই স্বপ্নের মধ্যেকার স্ত্রীর মুখটা কল্পনা করতো তখন সেই স্বপ্নের স্ত্রীর মুখের জায়গায় বিদ্যার মুখ বসানোর চেষ্টা করতো । সেই স্বপ্নটার কথাই এখন তার মনে পড়লো ।
মেয়েটার কথায় বিক্রমের শুধু হুঁশ-ই ফিরলো না , সে বেঁচেও গেল । বেঁচে গেল তার জীবনে ঘটে যাওয়া সেই ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মত এক সত্য ঘটনার স্মৃতিচারণের হাত থেকে । যা মনে পড়লেই তার বুক কাঁপিয়ে দেয় , গায়ের লোম খাঁড়া হয়ে যায় , হাত পা ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে । দরদর করে ঘামতে থাকে সে । মনে করতে না চাইলেও বারেবারে ফিরে আসে দুঃস্বপ্নের আকারে ।
মেয়েটার কথায় বিদ্যা ঘুরে চাইলো , তারপর হাসি মুখে বললো , “ ও , শবনম , আয় বোস ...
বিক্রম বিদ্যার হাসিটা দেখলো । কিছুক্ষন আগে যখন তীর্থঙ্কর এসেছিল তখনও বিদ্যা হেসেছিল । কিন্তু তখন যেন সেই হাসিটা মেকি লাগছিল । বরং এখন এই শবনম নামের মেয়েটা আসার পর বিদ্যার মুখে যে হাসিটা দেখা দিল সেটাই যেন আসল , কোন ভেজাল নেই এই হাসিতে । বিক্রমের মনে হলো এটাই বিদ্যার খাঁটি হাসি ।
বিদ্যার খাঁটি মিষ্টি হাসি দেখে বিক্রমের মনে এক শীতল মিষ্টি প্রানবন্ত হাওয়া বয়ে গেল । কিছুক্ষন আগে এক ভয়াবহ স্মৃতি তার গলা চেপে ধরে তার শ্বাস রোধের কারন হয়ে দাঁড়িয়েছিল , আর এখন বিদ্যার হাসি যেন তাকে এক তাজা মুক্তো হাওয়া দিয়ে তাকে তরতাজা করে তুললো ।
বিক্রম নবাগত মেয়েটার দিকে তাকালো । বিদ্যার মুখেই মেয়েটার নাম সে শুনতে পেয়েছিল । মেয়েটার নাম ‘ শবনম , । প্রথমেই যেটা বিক্রমের চোখে পড়লো সেটা শবনমের পেট । মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা । বিক্রমের তৎক্ষনাৎ মনে পড়লো গতকাল বিকালে এই মেয়েটাকেই সে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল । বিক্রম ভালোভাবে দেখলো দিব্যার পেটের তুলনায় শবনমের পেট বেশি বড় । শবনমের পেট দেখে সে ধারনা করলো প্রায় ছয় সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা তো হবেই । মেয়েটার পরনে আছে একটা ময়লা নিল রঙের সুতির শাড়ি , তাতে সবুজ ফুল আঁকা আর সবুজ ব্লাউজ । গায়ের রঙটাও তার পড়নের শাড়ির মতই ময়লা । বয়স তেইশ চব্বিশ তো হবেই । চুল খোঁপা করে বাঁধা । নাকে , কানে , গলায় কোন অলংকার নেই । দুই হাতেও কোন কিছু নেই , এমনকি সাধারণ কাঁচের দুটো চুড়িও না । গায়ে অলংকার নামক শৃঙ্গারের অস্তিত্ব না থাকলেও ঠোঁটে এক মন ভোলানো মিষ্টি হাসি লেগে আছে যা তার মুখের সৌন্দর্য কে হাজার গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
শবনম দোকানের ভিতর ঢুকে কিছুক্ষন আগে তীর্থঙ্কর যে টুলটায় বসেছিল সেই টুলে বসলে বিদ্যা বললো , “ ওখানে বসছিস কেন ? তোকে বলেছিনা খাটে বসবি । „
“ না , আমি এখানেই ঠিক আছি দিদি । „
বিদ্যা এবার একটু রাগী স্বরেই বললো , “ খাটে বসতে বলছি । „
শবনম বিদ্যার রাগী কন্ঠের কথা শুনে টুল থেকে উঠে বিক্রমের থেকে একটু দূরে খাটেই বসলো । বিক্রম বুঝলো কেন শবনম খাটে বসতে চাইছিল না । কারন শবনেমর শাড়ি নোংরা । এই এগারো বছরে বিক্রম হরেক রকমের , বিভিন্ন মানসিকতার এবং বিভিন্ন জাতের মানুষ দেখেছে । তাদের সাথে মিশেছে , কথা বলেছে । এই হরেক রকম মানুষের মধ্যে শবনমও একধরনের মানুষ যারা নিজেদের পোষাক পরিচ্ছদ দেখে সমাজে নিজেই নিজেদের একটা স্থান দিয়ে দেয় । এরা বড় কোন বাড়িতে গেলে সোফা কিংবা খাটে বসতে চায় না । কোন নেমতন্ন বাড়িতে গেলে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চায় । সবার শেষে একটা কোনা দেখে খেতে বসে । ঠিক তেমনি শবনমও নিজের ময়লা শাড়ির জন্য বিদ্যার দোকানের খাটের উপর পাতা সাদা পরিষ্কার চাদরের উপর বসতে চাইছিল না । যাতে নিজের শাড়ির জন্য চাদরটা না নোংরা হয়ে যায় !
শবনম খাটে বসলে বিদ্যা তার সেলাই মেশিনের সামনে বসতে বসতে বললো , “ এখন চলে এলি যে বড়ো ! রান্না হয়েছে ? „
মেয়েটা মিষ্টি সুরে বললো , “ লান্না কলিনি । পান্তা ভাত খেয়ে ও কাজে চলে গেছে । ঘলে একা বসে বসে ভালো লাগছিল না তাই তোমাল জামাই দেখতে চলে এসছি । „ তারপর বিক্রমকে উদ্দেশ্য করে সে বললো , “ এই দাদাটাই তোমাল জামাই ! „
বিক্রম মেয়েটাকে ভালো ভাবে দেখলো এবং বুঝলো যে , শবনমেরর বাকি সব ঠিক থাকলেও ‘ র , বর্ণ ঠিক নেই । ‘ র , এর জায়গায় সে ‘ ল , উচ্চারণ করে । শবনমের কথাবার্তা শুনে তার চরিত্রের একটা দিক বিক্রম বুঝতে পারলো । সেটা হলো শবনমের সাহস । কি সুন্দর অকপটে লজ্জা এবং দ্বিধাহীন ভাবে সে বলছে যে সে জামাই দেখতে এসেছে । লজ্জা নেই মানে তাকে কিন্তু কোন ভাবেই নির্লজ্জ বলা যায় না । বরং এই লজ্জাহীনতাই শবনমেরর চরিত্রকে এক দৃঢ়তা প্রদান করছে । শবনমের এই গুনে বিক্রম মুগ্ধ হয়ে গেল ।
“ হ্যাঁ কিন্তু তুই যে সম্পর্কের জগাখিচুড়ী করে দিলি । „ কথাটা বলার পরেই বিদ্যার মুখটা শুকিয়ে গেল । বিদ্যার কথার মানে বুঝতে শবনম এবং বিক্রম দুজনেরই বিন্দুমাত্র সময় লাগলো না । কথাটা হলো শবনম বিদ্যাকে দিদি বলে ডাকে আর এখন বিক্রমকে দাদা বলে ডেকেছে। নিজেকে সামলে নিয়ে ব্যাপারটাকে অতোটাও গুরুত্ব না দিয়ে বিদ্যা বললো , “ বস । তোর জন্য চা আনি । „
“ আমি সকালে চা খেয়েছি । „
“ বোস তো । „ বলে বিদ্যা দোকানের পিছনের দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেল ।
বিদ্যা চলে যাওয়ার পর শবনম বিক্রমকে বললো , “ দাদা তোমায় একটা কথা বলছি । খালাপ ভেবোনা কো । „
কথাটা শুনে বিক্রম একটু হকচকিয়ে গেল । পাঁচ মিনিট ও হয়নি তাদের আলাপের । এইটুকু সময়ের মধ্যে একে অপরকে বলার মত কোন কথা তো তৈরি হতে পারেনা । আর কিইবা এমন এমন কথা যার জন্য সে শবনমকে খারাপ ভাবতে পারে । বিক্রম শবনম কে আশ্বস্ত করে বললো , “ হ্যাঁ বলো না । খারাপ ভাববো কেন ! „
“ তুমি তো দিব্যা দিদিমনিকে নিয়ে চলে গেলে । দিব্যা দিদিমনি যাওয়াল পল দিদি খুব একা হয়ে গেছিল । এই এত্ত বলো বালিতে একা একা থাকা যায় না দাদা । আর দিদি তো তিন মাস একা কাটিয়েছে । „ কথা গুলো বলতে বলতে শবনমের গলায় কিছু একটা আটকে গেল । চোখের কোনায় দেখা দিল মুক্তোর মত স্বচ্ছ শুদ্ধ অশ্রুকণা। যা তার দুই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো । কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার , “ আমি লোজ আসতাম । এসে দিদিল সাথে যতোক্ষন থাকা যায় ততক্ষণ থাকতাম কিন্তু দিব্যা দিদিমনিল জায়গা নিতে পালিনি । তোমাল দুটো পায়ে পলি দাদা , দিদিকে একা ফেলে আর কোথাও যেও না। যদি দিদিল কোন অসুখ বিসুখ হতো তাহলে কে দেখতো বলো তো ? আল্লা দিদিকে লক্ষা কলেছেন ....
কোন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের তোতলা কথা শুনলে অনেকেই হেসে ফেলে কিন্তু এখন শবনমের এই তোতলা শব্দ গুলো শুনতে শুনতে বিক্রম পাথর হয়ে গেল । সে জানে একা থাকার যন্ত্রণা কতোটা । তাই বিদ্যার এতদিনের একাকিত্বের যন্ত্রণা তার মনের সবথেকে কোমল এবং দূর্বল স্থানে গিয়ে আঘাত করলো । বিক্রম কিছু বলবে তার আগেই উঠোন থেকে বিদ্যার চটির আওয়াজ পাওয়া গেল । সেই শব্দ শুনে শবনম নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে দ্রুত চোখের জল মুছে নিল ।
বিক্রমের মনে হলো চা করতে তো এত কম সময় লাগে না । বিদ্যা এসে চা ভর্তি পেয়ালা শবনম কে দিয়ে আবার সেলাই মেশিনের সামনে রাখা চেয়ারে গিয়ে বসলো । তারপর একটা সবুজ রঙের কাপড় ফিতে দিয়ে মেপে কাটতে শুরু করলো । শবনম চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে বিক্রমের মনে থাকা প্রশ্নটা করলো , “ এত তালাতালি কি কলে চা আনলে ? „
বিদ্যা বললো , “ কিছুক্ষন আগে তীর্থঙ্কর এসেছিল , তখন ওর জন্য চা করেছিলাম । অল্প ছিল সেটাই আনলাম । এখনো গরম আছে । তুই না আসলে আমিই চা টা খেয়ে নিতাম । „
শবনম চা খেতে খেতে ইয়ার্কি করে বললো , “ দিব্যা দিদি তো দুধেল মত ফস্সা আর তোমাল জামাই তো কালো ! „
এই কথাটা শুনে বিক্রম আর একটু হলে অট্টহাসি হেসে ফেলতো । কারন সে অতোটাও কালো নয় যতোটা শবনম তাকে বলছে । নিজের হাসিটাকে খুব কষ্ট করে সংবরন করলো বিক্রম । হাসি চাপার জন্য বিক্রম খুকখুক করে কেশে ফেললো ।
বিদ্যা মুখ দিয়ে “ আগে „ শব্দটা বলে চেপে গেল । আর একটু হলে মুখ ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছিল যে ‘ আগে যখন আবাসিকে দেখেছিলাম তখন এতো কালো ছিল না । রোদে পুড়ে এমন হয়েছে । ‚
মুখে আসা কথাটা না বলে বিদ্যা নিজেকে সামলে নিয়ে , শবনমের পাকামি দেখে মুখ ফুলিয়ে চোখ রাঙিয়ে বললো , “ খুব যে আমার মেয়ের বরের দিকে নজর দিচ্ছিস । তোর স্বামি তো আরো কালো । „
বিক্রম এর আগে অনেকবার রাস্তাঘাটে , দোকানপাটে , বাসের মধ্যে দুই মেয়ের কথোপকথন শুনেছে । কিন্তু কখনো তাদের কথাবার্তার বিষয়বস্তু হয়নি । এখন যখন তাকে নিয়ে দুই অসমবয়সী নারী কথা বলছে তখন নিজেকে তার খুব মূল্যবান মনে হলো । দুজনের কথাবার্তা সে খুব উপভোগ করতে লাগলো ।
আরো কিছুক্ষন এদিক ওদিকের কথা বলে শবনম চলে গেল । বললো , “ যাই , ঘল গোছাতে হবে । আমি আসি দিদি । „ বলে সে উঠে চলে গেল । বিক্রম দেখলো দোকানের পাশে কাঠগোলাপ গাছের গা ঘেঁসে যে গলিটা চলে গেছে শবনম সেই গলিতে ঢুকে পড়লো ।
শবনম চলে যাওয়ার পর বিদ্যা একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বললো , “ এই অবস্থায়ও বাড়ির সব কাজ নিজেই করে । কতোবার বারন করেছি । বারন শুনলে হয় ! বলে নাকি ও ওর আম্মিকে কোলে পেটে দুটো বাচ্চা নিয়ে এইসব কাজ করতে দেখেছে । ও কেন পারবে না ? „
কথাটা শুনে বিক্রমের খুব খারাপ লাগলো। সেও যখন কম খরচের জন্য বিভিন্ন বস্তিতে থাকতো তখন এরকম দেখেছে । অল্প বয়স , মাথায় মোটা লম্বা করে সিঁদুর দেওয়া । গর্ভে একজন সন্তান আছে এবং কোলের সন্তান কাঁদছে , সেই অবস্থায় সে বাড়ি ঝাঁট দিচ্ছে । দৃশ্যটা আর একবার মনে পড়ে গেল ।
বিদ্যা আরো বললো , “ শবনম এই চার পাঁচ মাস হলো এখানে এসেছে । „ বিদ্যার কথায় বিক্রম বিদ্যার মুখের দিকে তাকালো । বিদ্যা তার দিকে না তাকিয়ে কাপড় কাটতে কাটতে বলে চলেছে , “ পাশের বস্তিতে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে । ওর বর ট্যক্সি চালায় । মাঝে মাঝেই অকারনে গায়ে হাত তোলে । মেয়েটার জন্য বড্ড মায়া হয় । „
বিক্রম কথাটা না বলে থাকতে পারলো না , “ এই অবস্থায়ও মারে ? মানে বাচ্চা পেটে তবুও ! „
বিদ্যা উদ্রেক প্রকাশ করে মাথা তুলে তার দিকে তাকিয়ে বললো , “ তাহলে আর বলছি কি তোমায় ! কোন বড় কিছু হলে কি হবে বলোতো ? একটা মেয়ের কাছে মাতৃত্বের সুখ তার হৃদয়ের , তার জীবনের কতোটা অংশ জুড়ে থাকে সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না । ভয় হয় খুব । „ একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে আবার বললো , “ ও একবার বলেছিল , আগে যেখানে ছিল সেখানেও নাকি গায়ে হাত তুলতো । ওখানকার লোকেরা তাড়িয়ে দিয়েছে । থাকতে দেয়নি । তাই এখানে চলে এসেছে । „
বিক্রম মুখে কিছু না বললেও তার মনের ভিতর এখন বহু কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছুক্ষন আগে বিক্রম বিদ্যার জন্য শবনমকে কাঁদতে দেখেছিল আর এখন শবনমের জন্য বিদ্যাকে হাহুতাশ করতে দেখলো । চার পাঁচ মাসের মধ্যে দুই ভিন্নধর্মী অসমবয়সী নারী একে অপরকে কতোটা আপন করে নিয়েছে সেটা বিক্রম বুঝতে পারছে ।
এর সাথে সে এটাও বুঝলো যে বিদ্যা তার কাছে এখন খুব সহজ হয়ে গেছে । মেনে নিয়েছে তাকে নিজের জামাই হিসাবে। আর সম্ভবত , না , সম্ভবত না , বিক্রম পুরোপুরি নিশ্চিত যে সেই এগারো বছর আগের ফুলের কথাটা বিদ্যার মনে নেই । তাই সে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো ।
বিক্রম নিজের মনে এইসবই ভাবছিল । ঠিক তখন সে বিদ্যার এক অপরূপ মনমোহিনী রূপের দর্শন লাভ করলো । কাপড় কাটা হয়ে গেলে বিদ্যা পাশ থেকে একটা চশমা বার করে সেটা পড়লো । নীল রঙের একটা আধুনিক চশমা । শুধু একটা চশমা যে কাউকে এতোটা সুন্দর করে তুলতে পারে , কারোর মুখের সৌন্দর্যকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে , সেটা বিক্রম এই প্রথম দেখলো । মনে হলো বিদ্যার এ সৌন্দর্য বাস্তব নয় । কোন স্বপ্নপুরীর মায়াবী সুন্দরী । যা যেকোন পুরুষকে ভুলিয়ে নিজের পিছনে অন্ধের মত ধাওয়া করাতে পারে । বিক্রম নিজের চক্ষু বিস্ফোরিত করে , মুখ হাঁ করে বেশ কিছুক্ষন এই স্বপ্নসুন্দরীর সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিল । বিক্রম দেখলো চশমা পড়া হয়ে গেলে বিদ্যা সবুজ রঙের সুতো সেলাই মেশিনের সূচে পড়িয়ে নিল । তারপর পা চালিয়ে সেলাইয়ে মন দিল । সেলাই মেশিনের আওয়াজে বিক্রম নিজেকে সংবরণ করে আবার রাস্তার দিকে তাকালো ।
খাটের উপর তার পাশে রাখা একটা পুরানো হিসাবের খাতা ছিল । সে হাত বাড়িয়ে সেটা নিয়ে খুলে দেখতে লাগলো । এক আধ ঘন্টা ধরে খাতাটায় বিভিন্ন হিসাব দেখে বিক্রম খাতাটা আবার রেখে দিল । গোটা কয়েক মাসের হিসাব অনুযায়ী বিদ্যার মাসিক আয় গড়ে পনের হাজারের একটু বেশি। আর বেশিরভাগ আয় হয় সেলাইয়ের কাজ থেকে । দুই জনের সংসারে পনের হাজার টাকায় আরামসে চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু বিক্রমের কেমন একটা লাগলো । বাড়িতে বড় টিভি নেই , বড় ফ্রিজ নেই । এমনকি এই দোকানটাও বেশ পুরানো , কয়েক জায়গায় দেওয়াল ফেটে গেছে । অনেক বছর নতুন রঙ করানো হয়নি । তাহলে টাকা গুলো যায় কোথায় ? কথাটা ভাবতে ভাবতে বিক্রম দোকান বন্ধ করার শাটারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো , “ এই শাটার বন্ধ করতে অসুবিধা হয়না আপনার ? „
বিক্রম যখন খাতা দেখছিল তখন বিদ্যা ব্লাউজ তৈরীতে ব্যস্ত ছিল । এখনো কিছুটা বাকি । সেলাই মেশিন বন্ধ করে চাপা স্বরে বললো , “ অসুবিধা আর নতুন করে কি হবে ! ওই মতিদা আছে , মতিদাই শাটার নামিয়ে দেয় তুলে দেয় । „ বিক্রম অজান্তেই বিদ্যার মনের গভীরে আঘাত করেছে । তাই যে কথাটা সে কাউকে বলে বেড়ায়না সেটাই সে বিক্রম কে বলে ফেললো । সে বললো , “ শাটারে একটা চেন লাগানোর ইচ্ছা ছিল খুব । কিন্তু দিব্যার নার্সিং পড়ার খরচের জন্য ব্যংক থেকে থেকে লোন নিতে হয়েছে । ওর স্কুটি কিনতে গিয়েও সব গয়না বেচে দিতে হয়েছে ... „ শেষ কথাটা বলতে গিয়ে বিদ্যার গলায় কিছু একটা দলা পাকিয়ে এলো তাই কথাটা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল ।
বিক্রম বুঝলো যে বিদ্যা কাঁদছে। তাই সে আর কথা বাড়ালো না । চুপ করে বসে রইলো । দিব্যার যে স্কুটি কেনার জন্য বিদ্যা সব গয়না বেচে দিয়েছে সেই স্কুটি এখন বিক্রমের বাড়ির বারান্দাতে দাঁড়িয়ে আছে ।
বিদ্যা এই কথা গুলো বিক্রমকে বলতে চাইনি । কাউকে সে কখনোই বলতে চায়না । নিজের দুঃখের কথা শুনিয়ে কাউকে দুঃখিত করা বা সহানুভূতি আদায় করা বিদ্যার চরিত্রের গুন নয় । সে চাপা স্বভাবের , মিতভাষী গৃহীনি ।
কথা গুলো বিক্রমকে বলার পর বিদ্যা নিজের আচরণে অবাক হলো । এই কয়েক ঘন্টার আলাপে বিক্রম যে তার মনে এতোটা স্থান দখল করে নিয়েছে সেটা সে বোঝেনি । তাই নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার মনের গভীরে জমে থাকা দুটো কষ্টের কথা সে বিক্রমকে বলে ফেলেছে । কিন্তু কি করে বিক্রম তার মনে এই স্থান দখল করলো সেটাই বিদ্যাকে ভাবিয়ে তুললো । হয়তো কাল রাতে বাসন মাজার সময় বিক্রমের কথা শুনতে শুনতে বিক্রমের উপর একটা দূর্বলতা এসে গেছে । বিক্রমকে সে মন থেকে নিজের জামাই মেনে নিয়েছে । তাই তাকে নিজের পরিবারের একজন সদস্য ভেবে নিজের মনের দূর্বল অনুভূতি থেকেই কথাগুলো সে তাকে বলে ফেলেছে । নিজেকে সামলে নিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে নিয়ে বিদ্যা বললো , “ পরের মাসেই পূজা । এখনো অনেক কাজ বাকি । দোকানে কি কি আছে সেটা গুনে নিয়ে নতুন কাপড় কিনতে হবে । „
বিদ্যার অশ্রু দেখে বিক্রম বিচলিত হয়ে পড়লো । এই মহিলার কিছুটা দুঃখ লাঘব করার জন্য সে উঠে দাঁড়িয়ে বললো , “ আপনি বলুন কিভাবে গুনতে হবে আমি গুনে দিচ্ছি । „
“ তুমি করবে ? „
“ চুপচাপ বসে থাকতে আমার ভালো লাগে না । আপনি বলুন কিভাবে গুনতে হবে , আমি সেইভাবেই গুনে দিচ্ছি । „
বিদ্যা বিক্রমের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো , “ কোন কোন শাড়ি কত পিস আছে সেটা গুনলেই হবে । „ তারপর একটা প্রশ্ন করলো , “ তুমি শাড়ি চেনো তো ? „
“ হ্যাঁ চিনি । „ বলে নিজের শাড়ি সম্পর্কে জ্ঞান দিতে লাগলো , “ সুতি তাঁত সিল্ক বেনারসি ঢাকাই .....
বিদ্যা মুচকি হেসে বললো , “ ঠিক আছে । গুনে এই খাতাটায় লিখলেই হবে । „
বিদ্যার কথা মত বিক্রম দোকানে থাকা সমস্ত শাড়ির হিসাব করলো ।
বিক্রমের শাড়ি গোনা হয়ে গেলে বিদ্যাও তাকে কাপড় গুনতে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো । বিদ্যা রঙ অনুযায়ী কাপড়ের পিস বলতে শুরু করলো আর বিক্রম সেটা খাতায় লিখে রাখতে লাগলো । দিব্যার সাথে লিভিংয়ে থাকার সময় এইভাবে দুজনে মিলে কোন কাজ তারা করেনি । তাই কিছুক্ষন পরেই বিক্রমের মনটা এক অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে উঠলো । তার ঠোঁটের কোনায় এক লজ্জার হাসি দেখা দিলো যা বিদ্যা দেখতে পেল না । বিক্রমের মনে হলো সে যেন তার স্ত্রীকে দোকানের কাজে সাহায্য করছে । প্রায় দুই ঘন্টা ধরে দুইজন দোকানের সমস্ত শাড়ি , বিছানার চাদর , গামছা , তোয়ালে , মশারি , ব্লাউজের কাপড় হিসাব করলো ।
দুপুর বারোটা নাগাদ দুজনে দোকান বন্ধ করে দিয়ে বাড়িতে চলে এলো । বিদ্যা ঘরে ঢুকেই রান্না করতে চলে গেল । আর বিক্রম বাড়িতে ঢুকে দেখলো যে দিব্যা লিভিং রুমে বসে কালকের রাতের হিন্দি সিরিয়ালের রিক্যাপ দেখছে । এটা বিক্রম লিভিং থাকাকালীনই লক্ষ্য করেছে । দিব্যা টিভি দেখার পোকা । যত রাজ্যের হিন্দি সিরিয়াল , রিয়্যালিটি শো , বিগ বস , খাতরো কে খিলাড়ি সে সব দেখে । শুধু টিভির সামনে বসিয়ে দিলেই তার আর কিছু চাইনা ।
বিক্রম দেখলো দিব্যার চুল ভিজে । মানে তার স্নান হয়ে গেছে । তাকেও স্নান করতে হবে । ব্রাশ করা , হাত মুখ ধোয়া , কিংবা এমার্জেন্সি বাথরুম করার জন্য বাড়ির ভিতরের বাথরুম ব্যাবহার করা হলেও স্নান করার জন্য আগাগোড়াই উঠোনের বাথরুম ব্যাবহার করা হয় । বিক্রম সেটাতেই স্নান করার জন্য ঢুকলো ।
বাথরুমে এসে দেখলো দুটো ছোট ছোট ড্রাম আর একটা বড় বালতিতে জল ভর্তি করা আছে । নিশ্চয়ই কোন এক ফাঁকে বিদ্যা এসে মিউনিসিপ্যালিটির জল ভরে গেছে ।
বাথরুমের দরজা বন্ধ করে , কোমরে গামছা জড়িয়ে প্যান্ট খুলতে খুলতে বিক্রম দেখলো বাথরুমের মেঝেতে শ্যাওলা জমে স্যাদলা পড়ে আছে । শ্যাওলা দেখে বিক্রমের মনে হঠাৎ এক দায়িত্ববোধ জেগে উঠলো । পুরুষ হওয়ার দায়িত্ববোধ। এই বাড়ির জামাই সে , সেই অর্থে এই বাড়ির বা এই পরিবারের একমাত্র পুরুষ সদস্য । তাই একটা বাড়ির পুরুষ সদস্যের যা যা করণীয় সবকিছু করার সিদ্ধান্ত সে নিল । বাথরুমের মেঝের স্যাদলা পরিষ্কার করা পুরুষ সদস্যের কাজ কিনা সেটা আলোচনা সাপেক্ষ । কিন্তু সেটা পরে ভেবে দেখা যাবে । আপাতত নিজেকে এ বাড়িতে আরো খাপ খাইয়ে নিতে হবে ।
এটা ভেবেই সে চারিদিকে তাকিয়ে স্যাদলা পরিষ্কার করার জন্য কিছু একটা খুঁজতে লাগলো । বাথরুমের এক কোনায় দুটো নারকেল মালাও পেয়ে গেল । তাতে ছাই রাখা আছে । বিক্রম বুঝলো এই ছাই কালি পড়া হাড়ি কড়াই পরিষ্কার করার জন্য রাখা আছে । দরজা বন্ধ করে দেওয়ার পর বাথরুম একটু অন্ধকার হয়ে গেছিল । বাথরুমের মেঝে আরো ভালো ভাবে দেখার জন্য সে বাথরুমের দরজাটা খুলে দিয়ে আর কিছু না ভেবে ওই দুটো মালার ছাই এক কোনায় ঢেলে দিয়ে সে বাথরুমের মেঝে পরিষ্কার করতে শুরু করলো ।
দিব্যা তখন সোফায় বসে সেলফি তুলতে ব্যাস্ত । সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত নিজের প্রেগনেন্সির আপডেট দেয় সে । বিক্রম এসব কিছুই জানে না । তার যে স্মার্টফোন নেই , দেখবে কি করে ? প্রফুল্লদা একবার বলেছিল স্মার্টফোন কেনার জন্য। কিন্তু বিক্রম রাজি হয়নি । পাউট করে , দুই আঙুল দেখিয়ে সেলফি তুলতে তুলতে স্নানঘর থেকে আসা খসখসের আওয়াজ দিব্যা শুনতে পেল । সেই আওয়াজ বিদ্যাও রান্নাঘর থেকে শুনতে পেল । রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে মেয়ের উদ্দেশ্যে বললো , “ দাঁড়া দেখছি । „
স্নানঘরের দরজায় এসে দাঁড়াতেই বিদ্যার চোখে এক নেশার ছায়া দেখা দিল । বিক্রম খালি গায়ে শুধুমাত্র কোমরে একটা গামছা পড়ে মালা দিয়ে শ্যাওলা পরিষ্কার করছে । বহুদিন পর বিদ্যা কোন পুরুষ মানুষকে অর্ধ উলঙ্গ দেখছে । বিক্রমের প্রশস্ত ছাতির ঘন কালো লোম যা সরু হয়ে পেটের মাঝ বরাবর গিয়ে তার গামছার ভিতর অবধি চলে গেছে । মালা দিয়ে মেঝে ঘষার জন্য তার হাতের পেশি বারবার ফুলে উঠছে । আর তার গামছা পাছার সাথে লেগে আছে , যার জন্য বিক্রমের বৃহৎ গম্বুজের মতো দুটো থাই আর বৃহৎ পাছা বিদ্যার সামনে দৃশ্যমান। বিক্রমকে এই অবস্থায় দেখে বিদ্যার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠলো । হৃৎপিণ্ড ধুকপুকানি বেড়ে গেল । নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা ঝাড়া দিয়ে বিদ্যা ওখান দিয়ে চলে আসলো ।
ঘরে ঢুকে মেয়েকে শুধু বললো , “ ও শ্যাওলা পরিষ্কার করছে । „
দিব্যা শুনলো কি শুনলো না সেটা লক্ষ্য না করেই বিদ্যা আবার রান্নাঘরে ঢুকে পড়লো । রান্না করতে করতে বারেবারেই তার চোখের সামনে বিক্রমের লোমশ প্রশস্ত ছাতি , ফুলে ওঠা হাতের পেশী আর গম্বুজের মতো দুই থাই আর পাছা ভেসে উঠতে লাগলো ।
মেঝে পরিষ্কার করে স্নান করে এসে বিক্রম ঘরে ঢুকলো । জামা প্যান্ট পড়ে সোফায় বসে খবর দেখতে লাগলো । কিছুক্ষন পর রান্না শেষ হয়ে গেলে বিদ্যা স্নান করতে এলো । এসে দেখলো বাথরুমের মেঝে ঝকঝকে পরিষ্কার। নিজের মুখ দেখা যাচ্ছে বললেও বাড়াবাড়ি হবে না । বিদ্যার মনটা এক অদ্ভুত ভালোলাগায় ভরে উঠলো । তার মেয়ে যে একজন ভালো কর্তব্যশীল জীবনসঙ্গী বেছে নিতে পেরেছে সেটা ভেবেই তার মাতৃ হৃদয় গর্বে ভরে উঠলো ।
পাশের বস্তিতে থাকা অন্য মহিলাদের মত বিদ্যা শাড়ি পড়ে স্নান করে না । সে শাড়ি খুলে রেখে তার কোমল অতৃপ্ত নারী শরীরে জল ঢালতে লাগলো । নিমেষের মধ্যে জলে ভিজে তার শায়া ব্লাউজ তার শরীরে লেপ্টে গেল । প্রাচীন কালের সাহিত্যে তখনকার গ্রামের নবযৌবনা কুমারী নারী স্নান করে পরনে শুধুমাত্র একটা শাড়ি জড়িয়ে কোমরে জল ভর্তি কলসি নিয়ে আঁকা বাঁকা পথে বাড়ি ফেরার যে সৌন্দর্য বর্ণনা আছে তা হুবহু বিদ্যার এই স্নানরত সৌন্দর্যের সাথে মিলে যায় । আর তার এই সৌন্দর্য প্রতিফলিত হলো বিক্রমের সদ্য পরিষ্কার করা মেঝেতে । এতদিনের অপরিচ্ছন্ন নোংরা মেঝে পরিষ্কার হওয়ার পর যেন একটু বেশি বেহায়া লম্পট হয়ে উঠলো । বিদ্যার কোমল শরীরের বিভিন্ন খাঁজ , তার ব্লাউজের ভিতর উত্থিত সুডৌল পিন্নোনত স্তন , বৃহৎ কটিদেশের খাঁজে ঢুকে যাওয়া শায়া , তার গভীর নাভী , নরম মাংসল পেট , তার শরীরের উপর বিন্দু বিন্দু জলকণা সবই সেই মেঝেতে প্রতিফলিত হতে লাগলো ।
কালিদাসের মেঘদূত কাব্যে যেমন এক আষাঢ়ের মেঘ অভিশাপ প্রাপ্ত যক্ষের বার্তা তার বিরহী প্রিয়ার কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা আছে ঠিক তেমনি বিক্রমের পরিষ্কার করা মেঝে বিদ্যার এই অপরূপ মনমোহিনী রূপের বর্ণনা বিক্রমের কাছে পৌঁছে দিতে চায় ।
বিদ্যা স্নান করে এসে ঘরে ঢুকলো । তার পরনে একটা সাদা শাড়ি , শাড়ির উপর দেবনাগরীতে কিছু লেখা আছে । আর নীল ব্লাউজ । লম্বা ভেজা চুল শোকানোর জন্য গামছা বাধা । হাতে একটা বালতি । তাতে ভেজা শাড়ি শায়া ব্লাউজ আছে । ঘরে ঢুকে বিক্রমের পাশ দিয়েই বিদ্যা সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল । বিদ্যার ভিজে পায়ের ছাপ দেখতে দেখতে বিক্রমের পুরানো কিছু স্মৃতি মনে পড়লো ।
যখন সে আগে সারাদিন কাজ করতো । তখন রাতে খেয়ে দেয়ে এসে ঘুমানোর পর রোজ একধরনের স্বপ্ন দেখতো । সেই স্বপ্নে তার ছোট একটা বাড়ি আছে । তাতে সে তার স্ত্রী আর সন্তানকে নিয়ে থাকছে । তার স্ত্রী এইভাবেই স্নান করার পর ভেজা চুলে গামছা বেঁধে থাকে । আর যখন সে তার এই স্বপ্নের মধ্যেকার স্ত্রীর মুখটা কল্পনা করতো তখন সেই স্বপ্নের স্ত্রীর মুখের জায়গায় বিদ্যার মুখ বসানোর চেষ্টা করতো । সেই স্বপ্নটার কথাই এখন তার মনে পড়লো ।