11-09-2023, 09:25 PM
(This post was last modified: 11-09-2023, 09:30 PM by Bumba_1. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
আবার ফোনের ঘন্টা বেজে উঠলো এলো নন্দনার মোবাইলে। বলাই বাহুল্য ডক্টর প্রমোদ ফোন করেছে।
- "দেখলে ছবিগুলো?"
- "হ্যাঁ স্যার, দেখলাম .."
- "গতকাল রাতেই বলেছিলাম তোমাকে ছবি তুলে প্রমানস্বরূপ পাঠিয়ে দেবো। আমার যেমন কথা তেমন কাজ। নিশ্চয়ই দেখেছো প্রথম দুটো ফটোগ্রাফের ওই মহিলা এবং আজকে যে মহিলাকে তোমার স্বামী ক্লিনিকে নিয়ে যাচ্ছিলো আবরশন করাতে, সেই দু'জন একই মানুষ। এতে কি প্রমাণ হয়? তোমার ভাসুরের বলা কথাগুলো এবং আমি কালকে তোমাকে যে কথাগুলো বলেছিলাম, সেগুলো সব সত্যি। ফটোগ্রাফ দুটো গত বছরে আমাদের ফ্যাক্টরির অ্যানুয়াল ফাংশনে তোলা। তোমার বরের সঙ্গে অনেকদিন ধরে ওই মহিলার সম্পর্ক রয়েছে। এটা তো গেলো প্রথম প্রমাণ। আর পরের তিনটে ছবির তলায় দেখবে আজকের ডেট দেওয়া রয়েছে। এতে প্রমাণ হয় ছবিগুলো আজকেই তোলা। এবার বলো কি বলবে?"
- "কিছুই বলার নেই স্যার, আপনি আমার চোখ খুলে দিয়েছেন। এতদিন একজন লম্পট, চরিত্রহীন মানুষের সাথে ঘর করছিলাম। সেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি।"
- "শোনো, আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোনো। মাথা গরম করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে যেও না, বা তোমার স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া-টগড়া করতে যেও না এই বিষয় নিয়ে। তুমি একজন গৃহবধূ, চাকরি করো না। তার উপর তোমার সন্তান এখন অনেকটাই বড় হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় তুমি তো সংসার ত্যাগ করতে পারবে না! তাই বলছি, একদম ঠান্ডা মাথায় সিচুয়েশন হ্যান্ডেল করো। তোমার বরের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে ফোনে। ও যে আজ ফিরছে, সেটা আমি তোমাকে বলিনি .. এই কথাই ওকে বলেছি। তাই চিরন্তনের আসার ব্যাপারে তুমি যে কিছুই জানতে না, এরকম একটা ভাব দেখাবে। তা না হলে আমি মিথ্যাবাদী হয়ে যাবো। আর একটা কথা, সব সময় এরকম আরষ্ট হয়ে থাকবে না। বিশেষ করে তোমার হাজব্যান্ডের সামনে তো একদমই নয়। আমি বলছি, তুমি যদি ওর সামনে একটু ফ্রি থাকো, তাহলে এতদিন যা হয়েছে .. হয়েছে। কিন্তু এখন ও তোমাকে কিচ্ছু বলবে না .. মিলিয়ে নিও। আর শোনো, আজ সন্ধ্যেবেলা আমি কিন্তু যাচ্ছি। কি মেনু বানাবে?"
- "সেটা এখনো ঠিক হয়নি। তবে আমার রান্নার হাত ভালো, এ কথা অনেকেই বলে। মালতি দি, মানে আমাদের বাড়িতে যে কাজ করে, সে কাঁচাবাজার করে দিয়ে গেছে। এবার রান্না করার পালা। আশা করি, আপনার ভালো লাগবে।"
- "তাই? আমি তো ওয়েট করতেই পারছি না আর, ভাবছি কখন সন্ধ্যে হবে!"
সেই মুহূর্তে কলিংবেলের আওয়াজ পাওয়া গেলো। বেলের আওয়াজ ফোনের অপর প্রান্তে থাকা প্রমোদও শুনতে পেলো। "ওই বোধহয় চিরন্তন এসে গেছে! যে কথাগুলো বললাম মাথায় রেখো, এখন রাখছি।" এই বলে ফোনটা কেটে দিলো সে।
ভেতর থেকে দরজা খোলার পর চিরন্তন দেখলো ঘরে থাকলে যেরকম নাইটি পড়ে থাকে, সেরকম একটা পাতলা সুতির কাপড়ের হাতকাটা নাইটি পড়ে এক হাতে ফোন আর আরেক হাতে টাওয়েল নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে নন্দনা। প্রত্যেকবার অফিস ট্যুর থেকে ফেরার পর তার স্ত্রীকে দেখে চিরন্তন যেরকম বলে, "ইয়েস আই অ্যাম ব্যাক .." প্রথমে সেই রকমই কিছু বলতে ইচ্ছে করলেও, অফিসে প্রমোদ আর রবার্টের বলা কথাগুলো মনে পড়ে যাওয়াতে চোয়ালটা শক্ত হয়ে গেলো তার। গলা দিয়ে একটাও আওয়াজ বেরোলো না চিরন্তনের।
নন্দনা বারবার চিরন্তনের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখছিলো, ব্যাগের ভেতর থেকে কোনো জিনিস বের করছে কিনা তার স্বামী! কারণ অফিস ট্যুরে সে যেখানেই যাক না কেনো, বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই সেই জায়গার কোনো বিখ্যাত জিনিস .. সেটা জামাকাপড় হতে পারে, কোনো শো-পিস হতে পারে, আবার খাওয়ার জিনিসও হতে পারে, নন্দনাকে উপহার হিসেবে দেয় চিরন্তন। আসলে এবার ভুল ইন্সপেকশন রিপোর্ট সাবমিট করতে গিয়ে ধরা পড়ে জাস্ট হায়দ্রাবাদ থেকে পালিয়ে এসেছে চিরন্তন। তাই গিফট কেনার সময় বা সুযোগ কোনোটাই পায়নি সে। কিন্তু এই ব্যাপারগুলো তো আর তার স্ত্রী নন্দনা জানে না! একদিকে তার মোবাইলে ডক্টর প্রমোদের পাঠানো ওই ছবিগুলোর এফেক্ট, তার উপর বাড়িতে ঢুকে চিরন্তনের এইরকম বডি ল্যাঙ্গুয়েজে, স্বামীর প্রতি নন্দনার সন্দেহটা এবার বিশ্বাসে পরিণত হলো।
ওদিকে চিরন্তন তো জানেনা, তার এখানে আসার খবরটা নন্দনা আগে থেকেই পেয়ে গিয়েছে! তাই বাড়িতে ঢোকার পর তার স্ত্রীর এইরকম ক্যাজুয়াল এটিচিউডটা তার কাছে ভীষণ ইরিটেটিং লাগছিলো। 'তারমানে ওদের বলা কথাগুলোই ঠিক। হয়তো তার অবর্তমানে এখানে এমন কিছু ঘটেছে, যার জন্য তার প্রতি আর নন্দনার আগের মতো আর টান নেই!' কথাগুলো মনে আসতেই মাথাটা গরম হয়ে গেলো চিরন্তনের। বিরক্তিভরে বললো, "এমন একটা ভাব করছো, যেনো আমার আসার খবর তুমি আগে থেকে জানতে!"
"তুমি খবর দিয়েছিলে নাকি আমাকে? তাহলে কে জানাবে?" ঝাঁঝিয়ে উঠে উত্তর দিলো নন্দনা।
- "খবর না দিয়ে এলাম বলে, তোমার খুব অসুবিধা করে দিলাম বলে মনে হচ্ছে!"
- "আমার কি অসুবিধা তুমি করে দিলে আমি জানিনা, তবে তোমার একটা অসুবিধে বা বলা ভালো গলার কাঁটা তুমি কিছুক্ষণ আগে সাফ করে দিয়ে এলে, সেটা আমি জানি।"
- "মানে? কি বলতে চাইছো তুমি?"
- "দ্যাখো, আমি তো 'মানে বই' সঙ্গে করে নিয়ে ঘুরি না! তাই কথায় কথায় মানে বোঝাতে পারবো না। এতদিন পর বাইরে থেকে এসেছো, বিশ্রাম নাও, তারপর স্নান-টান করো। শুধু শুধু বাজে বকছো কেন? তাছাড়া আমারও অনেকটা দেরি হয়ে গেলো, স্নান করতে যেতে হবে। এখনো রান্নার অনেকগুলো পদ করা বাকি রয়ে গেছে। আমি বাথরুমে গেলাম, তুমি পাশের বাথরুমটায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিও।"
নন্দনা আর চিরন্তনের মনে যে তটভূমিহীন প্রবহমান সংশয় রোপণ করা হয়ে গিয়েছে এবং এর ফলে যে অস্থির বিষণ্ণতা সৃষ্টি হয়েছে, তা সহজে মেটার নয়।পরস্পরের মন ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে অভিমানের পসরায়। দু’একটি মুহূর্ত বাতাসে তুলো বীজের মতো দুলতে দুলতে চলে যায় শৈশবের দিকে। অথচ বহুকাল ধরে অপেক্ষা করে থাকা সেই অচিন দীর্ঘশ্বাস বেরোবার পথ পায় না। কতো ঝলমলে উজ্জ্বল সকাল দৃষ্টির বাইরে থেকে যাওয়া আর পরস্পরকে দায়ী করে যাওয়া। বেদনার মেঘ ঢেকেছে আকাশ, পালকের পাখি নীড়ে ফিরে যায়। ভাষাহীন এই নির্বাক চোখ শুধু চেয়ে থাকে আর নীল অভিমান পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় দু'জনের জীবন।
এতদিন এই সিরিজের সমস্ত ঘটনা লেখকের মুখ থেকে আপনারা শুনেছেন। এবার এই কাহিনীর পরবর্তী ঘটনাগুলো শুনবেন সিরিজের অন্যতম প্রধান চরিত্র চিরন্তনের মুখ থেকে।
আজ সন্ধ্যেবেলা আমাদের বাড়িতে ডক্টর প্রমোদ আসছে, এটা আমার স্ত্রীকে জানাতে গিয়ে জানতে পারলাম নন্দনা আগে থেকেই সেই খবর জানে, কারণ ডাক্তারবাবু নিজে তাকে ফোন করে জানিয়েছে। কথাটা শুনে কিছুটা ধাক্কা খেলো আমার মেল ইগো। আমাদের মাস্টার বেডরুম, অর্থাৎ যে ঘরে আমি আর আমার স্ত্রী রাতে শুই, বাড়িতে ফিরে আসার পর থেকে এখনো পর্যন্ত সেই ঘরে ঢোকার ইচ্ছে বা সুযোগ কোনোটাই হয়নি আমার। দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়ার পর পাশের ঘরটাতেই শুয়ে একটা লম্বা ঘুম দিলাম। ঘুম যখন ভাঙলো, লক্ষ্য করলাম বাইরেটা পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম পৌনে সাতটা বাজে। প্রায় পাঁচ ঘন্টা ঘুমালাম আজ। আসলে শরীর আর মনের উপর দিয়ে এত ধকল গেছে! তবে এখন শরীর অনেকটা ঝরঝরে লাগছে।
ঘুম থেকে উঠে দেখলাম আমার রুমের সঙ্গে অ্যাটাচড স্টাডিরুমটাতে বাপ্পা পড়ছে, আগামীকাল ওর ইতিহাস পরীক্ষা। বাড়িতে থাকলে এমনিতে আমি টি-শার্ট আর বারমুডা পড়েই থাকি। ডাক্তারবাবুর আসার অনারে আজ পায়জামা পাঞ্জাবি পড়লাম। ছেলের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটিয়ে ওর পড়াশোনার খবর নিয়ে, ঘর থেকে বেরিয়ে লক্ষ্য করলাম এখনো আমাদের মাস্টার বেডরুমের দরজা বন্ধ। মিনিট পনেরো পর দরজা খুলে লাল পাড়ের সাদা জমির উপর সোনালী জরির কাজ করা একটি জামদানি শাড়ি এবং তার সঙ্গে পাতলা সুতির কাপড়ের টকটকে লাল রঙের একটি স্লিভলেস ব্লাউজ পড়ে বেরোলো আমার স্ত্রী নন্দনা।
বাড়ির বাইরে গেলে আলাদা কথা, কিন্তু বাড়িতে শাড়ি পড়লে নাভির নিচে শাড়ি পরার অভ্যাস নন্দনার বিয়ের আগে থেকেই। বিয়ের পর এই নিয়ে ওকে অনেক বলেও ওর এই অভ্যাসটা পাল্টাতে পারিনি। আসলে এটা যে ও নিজেকে এক্সপোজ করার জন্য করে তা নয়, এটা ওর হ্যাবিট হয়ে গিয়েছে, আর ক্রমে ক্রমে ব্যাপারটার সঙ্গে আমি নিজেও ইউজ টু হয়ে গিয়েছি। অভ্যেসবশত এই দিনও তার অন্যথা ঘটলো না। অত্যন্ত স্বচ্ছ জামদানি শাড়িটার উপর দিয়ে ওর বিশালাকার গভীর নাভিটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। শুধুমাত্র ফেস পাউডার দেওয়া ছাড়া মেকাপহীন মুখে বড় একটি লাল রঙের টিপ, বেশ গাঢ় করে দেওয়া লাল লিপস্টিক, চোখে চশমা আঁটা এবং সিঁথিতে চওড়া করে সিঁদুর পরিহিতা নন্দনার সাবেকি, অথচ অত্যন্ত আবেদনময়ী এই রূপ দেখে ভবিষ্যতে ঘটতে চলা কোনো এক অজানা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার আশঙ্কায় বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো আমার।
সাড়ে সাতটা নাগাদ কলিংবেলটা বেজে উঠলো। নন্দনা রান্নাঘরে টুকটাক কাজ করছিলো, ও ওখান থেকে আসার আগেই দরজা খুলে দিয়ে দেখলাম ট্রাউজার আর হাফস্লিভ শার্ট পড়ে দরজার ওপ্রান্তে হাতে একটা ফুলের বোকে নিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ডক্টর প্রমোদ গঞ্জালভেস। দরজাটা খোলার পরেই নাকে একটা গন্ধ এলো। এই গন্ধটা মোটেও ফুলের নয়, স্মেলটা আমার পরিচিত .. ড্রিঙ্ক করে এসেছে প্রমোদ। ওর লাল টকটকে চোখের দিকে তাকিয়ে আরও নিশ্চিত হলাম আমি।
"কই, বৌমা কোথায়?" যেন সে নন্দনার শ্বশুরবাড়ির একজন পরমাত্মীয়, এরকম একটা ভান করে কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে আমাকে সরিয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকে এলো। ততক্ষণে ড্রয়িং রুম আর ডাইনিং স্পেসের মাঝখানের দরজাটার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে নন্দনা। আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে, ওর এই সাবেকি অথচ আবেদনময়ী রূপের ছটায় কয়েক মুহূর্তের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো প্রমোদ। তারপর নন্দনার দিকে এগিয়ে গিয়ে ফুলের বোকেটা বাড়িয়ে দিলো ওর দিকে।
সহজ-সরল নন্দনা বোকেটা নেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই ওর হাত দুটো ধরে নিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে নিজের কাছে ওকে টেনে নিলো প্রমোদ, তারপর মুহূর্তের মধ্যে জড়িয়ে ধরলো ওকে। সবকিছু এত তাড়াতাড়ি ঘটলো যে, আমি তো নয়েই এমনকি নন্দনাও কোনো রিঅ্যাকশনের সুযোগ পেলো না। সর্বসাকুল্যে আমার বউকে সাত থেকে আট সেকেন্ড জড়িয়ে ছিলো প্রমোদ, স্পষ্ট দেখতে পেলাম ওকে বন্ধনমুক্ত করার আগে ওর গালে একবার নিজের নাকটা ঘষে নিলো ডাক্তার। আমার মনে হলো প্রমোদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে ওদের দু'জনের মাঝে গিয়ে দাঁড়াই, কিন্তু আমার ভেতর থেকে কে যেনো আটকে দিলো আমাকে! তবে আজ তো প্রথম নয়, প্রতিবাদ করার বদলে নিজের প্রতি এই অজানা নিষিদ্ধ নিয়ন্ত্রণ .. এটা আগেও বারকয়েক ঘটেছে আমার সঙ্গে। আমি তাড়াতাড়ি করে বাইরের দরজাটা আটকে দিলাম, পাছে কেউ এই অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য দেখে ফেলে!
"শুধুমাত্র তোমার জন্য স্পেশাল অর্ডার দিয়ে গফুরের দোকান থেকে বানিয়েছি ফুলের এই বোকেটা। ফুলগুলো তোমার মতোই তাজা আর সুগন্ধযুক্ত .. হাহাহাহা। যাকে বলে, ঠিক মানুষের হাতে একদম ঠিক উপহার পড়েছে।" নন্দনার উদ্দেশ্যে এই বেহিসাবি কথাগুলো বলে আমার দিকে ঘুরে প্রমোদ বললো, "এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে না থেকে পেগ বানাও, দেখি বৌমা চাটের কি বন্দোবস্ত রেখেছে!"
"হুইস্কি তো নেই স্যার। বিয়ার আছে, চলবে?" মিনমিন করে জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
"নাকের বদলে নরুন পেলাম টাক ডুমা ডুম ডুম। নাই মামার থেকে কানা মামা ভালো, নিয়ে এসো বিয়ার।" প্রমোদের এই উক্তির পর, নন্দনা বললো "চাট আবার কি?"
- "ও কিছু নয় বৌমা। সেদিনকে তোমার ডায়েট চার্ট করে দেওয়া হয়নি, তাই ভাবছি আজ করে দেবো। তা তুমি স্টার্টারে জন্য কিছু বানাওনি? মানে ধরো এই কাবাব বা পকোড়া .. এই ধরনের কিছু?"
"ওমা এই কথা? হ্যাঁ বানিয়েছি তো! চিকেন পকোড়া আর পনির পকোড়া ভাজছিলাম রান্নাঘরে, আপনারা বসুন আমি এখনই নিয়ে আসছি।" কথাগুলো বলে দ্রুত সেখান থেকে চলে গেলো আমার বউ।
বিয়ার আর লেমন সোডা নিয়ে ড্রয়িংরুমে রাখা সোফার উপরে দু'জনে পাশাপাশি বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই নন্দনা পকোড়ার দুটো প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকলো। "একটাতে চিকেন আর একটাতে পনির পকোড়া রয়েছে। আপনারা কাজের কথা বলুন, আমি ততক্ষণ বাপ্পাকে একটু পরিয়ে নিই, কাল ওর পরীক্ষা রয়েছে।" কথাগুলো বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো নন্দনা। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি।
আমার দেওয়া রিসিভ কপিটা সই করাতে এখন প্রমোদ এখানে এসেছে, সেটা ও আমাকে আজ সকালেই বলেছিলো। তাই মালিকের দুই প্রতিনিধি যখন আমার সহায়, তখন এ যাত্রায় খুব ভালোভাবেই বেঁচে গেলাম আমি, এটা মনে করে দাঁত ক্যালাতে ক্যালাতে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, "তাহলে পেপারটা দিন স্যার, সই করে দিই .."
"কিসের পেপার ভাই?" বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো প্রমোদ।
কথাটা শুনে অবাক হয়ে গিয়ে বললাম, "কেনো? সকালে যে পেপারটা আপনাকে দিলাম। মানে ওই রিসিভ কপিটার কথা বলছিলাম .."
"ওটা এখন ওয়েস্টবক্সে। তোমার চাকরি তো অনেক দূরের কথা, আমরাই আর থাকবে কিনা সন্দেহ! আমি আর রবার্ট যার রিপ্রেজেন্টেটিভ হয়ে এই ফ্যাক্টরিতে রয়েছি, সেই ম্যাকেঞ্জি সাহেব এখন দেনার দায় ডুবে নিজের ৪৫% শেয়ার তার অপর পার্টনার ঝুনঝুনওয়ালাকে খুব সস্তায় বিক্রি করে দেওয়ার প্ল্যান করছে। আর এই খবরটা একদম ঘোড়ার মুখের খবর। রবার্টের বাল্যবন্ধু ম্যাকেঞ্জির ভাই ফোন করে জানিয়েছে কথাটা। আর ঝুনঝুনওয়ালার তৈরি করা নতুন বোর্ড যে তোমাকে চাকরিতে রাখবে না, এটা জলের মতো পরিষ্কার। কারণ, তুমি যে আমাদের হয়ে কাজ করো, সেটা এতদিনে সবাই জেনে গিয়েছে।" কথাগুলো অবলীলায় বলে গিয়ে চিকেন পকোড়াতে কামড় দিলো প্রমোদ।
কি শোনার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম আমি, আর কি শুনতে হলো আমাকে! ডাক্তারের মুখে কথাগুলো শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো আমার। "এসব কি বলছেন স্যার? তাহলে আমার কি হবে? বউ-বাচ্চা নিয়ে তো এবার রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে আমাকে!" ধরা গলায় প্রমোদের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বললাম।
"আরে এত ভেঙে পড়ার মতো কিছু হয়নি, আমার পুরো কথাটা আগে শোনো। এটা তো অস্বীকার করা যাবে না, ম্যাকেঞ্জির এই দুরবস্থার জন্য পরোক্ষভাবে আমরাই দায়ী! আমি আর রবার্ট ওর বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে রিজেক্টেড জুটপ্যাকে কোম্পানির সীলমোহর মেরে ফ্রেশ বলে এত বছর ধরে চালিয়ে এসে লক্ষ লক্ষ টাকা কামিয়েছি। আর বিগত এক বছর ধরে কোম্পানির এমপ্লয়ি হওয়া সত্ত্বেও তুমিও আমাদের হয়ে কাজ করেছো এবং আমাদের কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নিয়েছো। তাই তোমার চাকরি চলে গেলে নিজেকে ছাড়া আর কাউকে ব্লেম করতে পারবে না তুমি। তবে এটা একদিন হওয়ার ছিলো, সেটা আমরা জানতাম। তাই নিজেরদের জন্য একটা অল্টারনেটিভ ব্যবস্থা করে ফেলেছি আমরা। রেল স্টেশনের পশ্চিমদিকে ফাউন্ডারির সামনের দু' বিঘা জমিটা ম্যাকেঞ্জির পিছন মেরে বছর খানেক আগেই কিনে নিয়েছিলাম আমরা। ওখানে দুটো বিশাল বড়ো গোডাউন বানানো হয়েছে আর সেই গোডাউনে বাজারে জুটের এই আকালেও প্রচুর কাঁচামাল মজুদ রয়েছে। দ্যাখো, আমরা তো এত কম সময় এবং লোকবল ছাড়া কোনো প্রোডাকশন ফ্যাক্টরি খুলতে পারবো না! আমরা যে কাজটা করবো সেটা হলো, বিভিন্ন জুটমিলকে কাঁচামাল সাপ্লাই দেবো। আমাদের সঙ্গে হার্জিন্দারও পার্টনার হিসেবে থাকবে। পয়সাকড়ির দিক থেকে আমাদের তিনজনেরই ইকুয়াল কন্ট্রিবিউশন রয়েছে। আপাতত সিকিউরিটি গার্ড নিয়ে মোট দশজন ওয়ার্কার রয়েছে ওখানে। আমাদের তরফ থেকে একটা প্রোপজল রয়েছে তোমার জন্য। এখানকার চাকরি তোমার আর থাকবে না, তাই আমরা চাই তুমি জয়েন করো ওখানে আমাদের সাথে। তোমার মনিটারি কন্ট্রিবিউশনের কোনো দরকার নেই। তুমি শুধু ওখানে আমাদের সঙ্গে থাকবে, বিভিন্ন মিটিং অ্যাটেন্ড করবে .. দ্যাট'স অল। তোমাকে আমরা এমপ্লয়ি হিসেবে ওখানে চাইছি না, আমাদের চতুর্থ পার্টনার হিসেবে চাইছি।" কথাগুলো বলে বিয়ারের গ্লাসটা এক চুমুকে শেষ করে টেবিলের উপর রাখলো প্রমোদ।
মাঝ সমুদ্রে অসহায়ের মতো ভেসে যাওয়ার সময় কোনো অবলম্বনকে আঁকড়ে ধরার যদি হঠাৎ করে সুযোগ এসে যায়, তখন যা মানসিক অবস্থা হয়! ডাক্তারের কথাগুলো শুনে আমার মনেরও সেই অবস্থা হলো। তবুও মনে একরাশ সংশয় নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, "কিন্তু আমার কাছে তো সম্পদ বলতে কিছুই নেই, আমাকে কি হিসেবে পার্টনার বানাতে চাইছেন আপনারা?"
"নিজের সোচ কে বড় কর চিরন্তন। বড় কিছু ভাবার চেষ্টা করো। কর্মচারী নয় এবার থেকে মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করো। আর ট্রেজারের কথা বলছো? তোমার কাছে যা আছে, তার থেকে বড় সম্পদ বোধহয় আর এই শহরে কারোর কাছে নেই।" আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে হাসতে কথাগুলো বললো প্রমোদ।
লোকটা যে কখন কি বলে, তার কোনো ঠিক নেই। প্রমোদের এই কথার মানে বুঝতে না পেরে ওকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলাম; ঠিক সেই মুহূর্তে "ন'টা বাজতে চললো, তোমরা কি এখন ডিনার করবে?"ভেতর থেকে নন্দনার গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম।
- "দেখলে ছবিগুলো?"
- "হ্যাঁ স্যার, দেখলাম .."
- "গতকাল রাতেই বলেছিলাম তোমাকে ছবি তুলে প্রমানস্বরূপ পাঠিয়ে দেবো। আমার যেমন কথা তেমন কাজ। নিশ্চয়ই দেখেছো প্রথম দুটো ফটোগ্রাফের ওই মহিলা এবং আজকে যে মহিলাকে তোমার স্বামী ক্লিনিকে নিয়ে যাচ্ছিলো আবরশন করাতে, সেই দু'জন একই মানুষ। এতে কি প্রমাণ হয়? তোমার ভাসুরের বলা কথাগুলো এবং আমি কালকে তোমাকে যে কথাগুলো বলেছিলাম, সেগুলো সব সত্যি। ফটোগ্রাফ দুটো গত বছরে আমাদের ফ্যাক্টরির অ্যানুয়াল ফাংশনে তোলা। তোমার বরের সঙ্গে অনেকদিন ধরে ওই মহিলার সম্পর্ক রয়েছে। এটা তো গেলো প্রথম প্রমাণ। আর পরের তিনটে ছবির তলায় দেখবে আজকের ডেট দেওয়া রয়েছে। এতে প্রমাণ হয় ছবিগুলো আজকেই তোলা। এবার বলো কি বলবে?"
- "কিছুই বলার নেই স্যার, আপনি আমার চোখ খুলে দিয়েছেন। এতদিন একজন লম্পট, চরিত্রহীন মানুষের সাথে ঘর করছিলাম। সেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি।"
- "শোনো, আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোনো। মাথা গরম করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে যেও না, বা তোমার স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া-টগড়া করতে যেও না এই বিষয় নিয়ে। তুমি একজন গৃহবধূ, চাকরি করো না। তার উপর তোমার সন্তান এখন অনেকটাই বড় হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় তুমি তো সংসার ত্যাগ করতে পারবে না! তাই বলছি, একদম ঠান্ডা মাথায় সিচুয়েশন হ্যান্ডেল করো। তোমার বরের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে ফোনে। ও যে আজ ফিরছে, সেটা আমি তোমাকে বলিনি .. এই কথাই ওকে বলেছি। তাই চিরন্তনের আসার ব্যাপারে তুমি যে কিছুই জানতে না, এরকম একটা ভাব দেখাবে। তা না হলে আমি মিথ্যাবাদী হয়ে যাবো। আর একটা কথা, সব সময় এরকম আরষ্ট হয়ে থাকবে না। বিশেষ করে তোমার হাজব্যান্ডের সামনে তো একদমই নয়। আমি বলছি, তুমি যদি ওর সামনে একটু ফ্রি থাকো, তাহলে এতদিন যা হয়েছে .. হয়েছে। কিন্তু এখন ও তোমাকে কিচ্ছু বলবে না .. মিলিয়ে নিও। আর শোনো, আজ সন্ধ্যেবেলা আমি কিন্তু যাচ্ছি। কি মেনু বানাবে?"
- "সেটা এখনো ঠিক হয়নি। তবে আমার রান্নার হাত ভালো, এ কথা অনেকেই বলে। মালতি দি, মানে আমাদের বাড়িতে যে কাজ করে, সে কাঁচাবাজার করে দিয়ে গেছে। এবার রান্না করার পালা। আশা করি, আপনার ভালো লাগবে।"
- "তাই? আমি তো ওয়েট করতেই পারছি না আর, ভাবছি কখন সন্ধ্যে হবে!"
সেই মুহূর্তে কলিংবেলের আওয়াজ পাওয়া গেলো। বেলের আওয়াজ ফোনের অপর প্রান্তে থাকা প্রমোদও শুনতে পেলো। "ওই বোধহয় চিরন্তন এসে গেছে! যে কথাগুলো বললাম মাথায় রেখো, এখন রাখছি।" এই বলে ফোনটা কেটে দিলো সে।
★★★★
ভেতর থেকে দরজা খোলার পর চিরন্তন দেখলো ঘরে থাকলে যেরকম নাইটি পড়ে থাকে, সেরকম একটা পাতলা সুতির কাপড়ের হাতকাটা নাইটি পড়ে এক হাতে ফোন আর আরেক হাতে টাওয়েল নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে নন্দনা। প্রত্যেকবার অফিস ট্যুর থেকে ফেরার পর তার স্ত্রীকে দেখে চিরন্তন যেরকম বলে, "ইয়েস আই অ্যাম ব্যাক .." প্রথমে সেই রকমই কিছু বলতে ইচ্ছে করলেও, অফিসে প্রমোদ আর রবার্টের বলা কথাগুলো মনে পড়ে যাওয়াতে চোয়ালটা শক্ত হয়ে গেলো তার। গলা দিয়ে একটাও আওয়াজ বেরোলো না চিরন্তনের।
নন্দনা বারবার চিরন্তনের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখছিলো, ব্যাগের ভেতর থেকে কোনো জিনিস বের করছে কিনা তার স্বামী! কারণ অফিস ট্যুরে সে যেখানেই যাক না কেনো, বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই সেই জায়গার কোনো বিখ্যাত জিনিস .. সেটা জামাকাপড় হতে পারে, কোনো শো-পিস হতে পারে, আবার খাওয়ার জিনিসও হতে পারে, নন্দনাকে উপহার হিসেবে দেয় চিরন্তন। আসলে এবার ভুল ইন্সপেকশন রিপোর্ট সাবমিট করতে গিয়ে ধরা পড়ে জাস্ট হায়দ্রাবাদ থেকে পালিয়ে এসেছে চিরন্তন। তাই গিফট কেনার সময় বা সুযোগ কোনোটাই পায়নি সে। কিন্তু এই ব্যাপারগুলো তো আর তার স্ত্রী নন্দনা জানে না! একদিকে তার মোবাইলে ডক্টর প্রমোদের পাঠানো ওই ছবিগুলোর এফেক্ট, তার উপর বাড়িতে ঢুকে চিরন্তনের এইরকম বডি ল্যাঙ্গুয়েজে, স্বামীর প্রতি নন্দনার সন্দেহটা এবার বিশ্বাসে পরিণত হলো।
ওদিকে চিরন্তন তো জানেনা, তার এখানে আসার খবরটা নন্দনা আগে থেকেই পেয়ে গিয়েছে! তাই বাড়িতে ঢোকার পর তার স্ত্রীর এইরকম ক্যাজুয়াল এটিচিউডটা তার কাছে ভীষণ ইরিটেটিং লাগছিলো। 'তারমানে ওদের বলা কথাগুলোই ঠিক। হয়তো তার অবর্তমানে এখানে এমন কিছু ঘটেছে, যার জন্য তার প্রতি আর নন্দনার আগের মতো আর টান নেই!' কথাগুলো মনে আসতেই মাথাটা গরম হয়ে গেলো চিরন্তনের। বিরক্তিভরে বললো, "এমন একটা ভাব করছো, যেনো আমার আসার খবর তুমি আগে থেকে জানতে!"
"তুমি খবর দিয়েছিলে নাকি আমাকে? তাহলে কে জানাবে?" ঝাঁঝিয়ে উঠে উত্তর দিলো নন্দনা।
- "খবর না দিয়ে এলাম বলে, তোমার খুব অসুবিধা করে দিলাম বলে মনে হচ্ছে!"
- "আমার কি অসুবিধা তুমি করে দিলে আমি জানিনা, তবে তোমার একটা অসুবিধে বা বলা ভালো গলার কাঁটা তুমি কিছুক্ষণ আগে সাফ করে দিয়ে এলে, সেটা আমি জানি।"
- "মানে? কি বলতে চাইছো তুমি?"
- "দ্যাখো, আমি তো 'মানে বই' সঙ্গে করে নিয়ে ঘুরি না! তাই কথায় কথায় মানে বোঝাতে পারবো না। এতদিন পর বাইরে থেকে এসেছো, বিশ্রাম নাও, তারপর স্নান-টান করো। শুধু শুধু বাজে বকছো কেন? তাছাড়া আমারও অনেকটা দেরি হয়ে গেলো, স্নান করতে যেতে হবে। এখনো রান্নার অনেকগুলো পদ করা বাকি রয়ে গেছে। আমি বাথরুমে গেলাম, তুমি পাশের বাথরুমটায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিও।"
নন্দনা আর চিরন্তনের মনে যে তটভূমিহীন প্রবহমান সংশয় রোপণ করা হয়ে গিয়েছে এবং এর ফলে যে অস্থির বিষণ্ণতা সৃষ্টি হয়েছে, তা সহজে মেটার নয়।পরস্পরের মন ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে অভিমানের পসরায়। দু’একটি মুহূর্ত বাতাসে তুলো বীজের মতো দুলতে দুলতে চলে যায় শৈশবের দিকে। অথচ বহুকাল ধরে অপেক্ষা করে থাকা সেই অচিন দীর্ঘশ্বাস বেরোবার পথ পায় না। কতো ঝলমলে উজ্জ্বল সকাল দৃষ্টির বাইরে থেকে যাওয়া আর পরস্পরকে দায়ী করে যাওয়া। বেদনার মেঘ ঢেকেছে আকাশ, পালকের পাখি নীড়ে ফিরে যায়। ভাষাহীন এই নির্বাক চোখ শুধু চেয়ে থাকে আর নীল অভিমান পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় দু'জনের জীবন।
★★★★
এতদিন এই সিরিজের সমস্ত ঘটনা লেখকের মুখ থেকে আপনারা শুনেছেন। এবার এই কাহিনীর পরবর্তী ঘটনাগুলো শুনবেন সিরিজের অন্যতম প্রধান চরিত্র চিরন্তনের মুখ থেকে।
আজ সন্ধ্যেবেলা আমাদের বাড়িতে ডক্টর প্রমোদ আসছে, এটা আমার স্ত্রীকে জানাতে গিয়ে জানতে পারলাম নন্দনা আগে থেকেই সেই খবর জানে, কারণ ডাক্তারবাবু নিজে তাকে ফোন করে জানিয়েছে। কথাটা শুনে কিছুটা ধাক্কা খেলো আমার মেল ইগো। আমাদের মাস্টার বেডরুম, অর্থাৎ যে ঘরে আমি আর আমার স্ত্রী রাতে শুই, বাড়িতে ফিরে আসার পর থেকে এখনো পর্যন্ত সেই ঘরে ঢোকার ইচ্ছে বা সুযোগ কোনোটাই হয়নি আমার। দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়ার পর পাশের ঘরটাতেই শুয়ে একটা লম্বা ঘুম দিলাম। ঘুম যখন ভাঙলো, লক্ষ্য করলাম বাইরেটা পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম পৌনে সাতটা বাজে। প্রায় পাঁচ ঘন্টা ঘুমালাম আজ। আসলে শরীর আর মনের উপর দিয়ে এত ধকল গেছে! তবে এখন শরীর অনেকটা ঝরঝরে লাগছে।
ঘুম থেকে উঠে দেখলাম আমার রুমের সঙ্গে অ্যাটাচড স্টাডিরুমটাতে বাপ্পা পড়ছে, আগামীকাল ওর ইতিহাস পরীক্ষা। বাড়িতে থাকলে এমনিতে আমি টি-শার্ট আর বারমুডা পড়েই থাকি। ডাক্তারবাবুর আসার অনারে আজ পায়জামা পাঞ্জাবি পড়লাম। ছেলের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটিয়ে ওর পড়াশোনার খবর নিয়ে, ঘর থেকে বেরিয়ে লক্ষ্য করলাম এখনো আমাদের মাস্টার বেডরুমের দরজা বন্ধ। মিনিট পনেরো পর দরজা খুলে লাল পাড়ের সাদা জমির উপর সোনালী জরির কাজ করা একটি জামদানি শাড়ি এবং তার সঙ্গে পাতলা সুতির কাপড়ের টকটকে লাল রঙের একটি স্লিভলেস ব্লাউজ পড়ে বেরোলো আমার স্ত্রী নন্দনা।
বাড়ির বাইরে গেলে আলাদা কথা, কিন্তু বাড়িতে শাড়ি পড়লে নাভির নিচে শাড়ি পরার অভ্যাস নন্দনার বিয়ের আগে থেকেই। বিয়ের পর এই নিয়ে ওকে অনেক বলেও ওর এই অভ্যাসটা পাল্টাতে পারিনি। আসলে এটা যে ও নিজেকে এক্সপোজ করার জন্য করে তা নয়, এটা ওর হ্যাবিট হয়ে গিয়েছে, আর ক্রমে ক্রমে ব্যাপারটার সঙ্গে আমি নিজেও ইউজ টু হয়ে গিয়েছি। অভ্যেসবশত এই দিনও তার অন্যথা ঘটলো না। অত্যন্ত স্বচ্ছ জামদানি শাড়িটার উপর দিয়ে ওর বিশালাকার গভীর নাভিটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। শুধুমাত্র ফেস পাউডার দেওয়া ছাড়া মেকাপহীন মুখে বড় একটি লাল রঙের টিপ, বেশ গাঢ় করে দেওয়া লাল লিপস্টিক, চোখে চশমা আঁটা এবং সিঁথিতে চওড়া করে সিঁদুর পরিহিতা নন্দনার সাবেকি, অথচ অত্যন্ত আবেদনময়ী এই রূপ দেখে ভবিষ্যতে ঘটতে চলা কোনো এক অজানা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার আশঙ্কায় বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো আমার।
সাড়ে সাতটা নাগাদ কলিংবেলটা বেজে উঠলো। নন্দনা রান্নাঘরে টুকটাক কাজ করছিলো, ও ওখান থেকে আসার আগেই দরজা খুলে দিয়ে দেখলাম ট্রাউজার আর হাফস্লিভ শার্ট পড়ে দরজার ওপ্রান্তে হাতে একটা ফুলের বোকে নিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ডক্টর প্রমোদ গঞ্জালভেস। দরজাটা খোলার পরেই নাকে একটা গন্ধ এলো। এই গন্ধটা মোটেও ফুলের নয়, স্মেলটা আমার পরিচিত .. ড্রিঙ্ক করে এসেছে প্রমোদ। ওর লাল টকটকে চোখের দিকে তাকিয়ে আরও নিশ্চিত হলাম আমি।
"কই, বৌমা কোথায়?" যেন সে নন্দনার শ্বশুরবাড়ির একজন পরমাত্মীয়, এরকম একটা ভান করে কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে আমাকে সরিয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকে এলো। ততক্ষণে ড্রয়িং রুম আর ডাইনিং স্পেসের মাঝখানের দরজাটার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে নন্দনা। আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে, ওর এই সাবেকি অথচ আবেদনময়ী রূপের ছটায় কয়েক মুহূর্তের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো প্রমোদ। তারপর নন্দনার দিকে এগিয়ে গিয়ে ফুলের বোকেটা বাড়িয়ে দিলো ওর দিকে।
সহজ-সরল নন্দনা বোকেটা নেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই ওর হাত দুটো ধরে নিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে নিজের কাছে ওকে টেনে নিলো প্রমোদ, তারপর মুহূর্তের মধ্যে জড়িয়ে ধরলো ওকে। সবকিছু এত তাড়াতাড়ি ঘটলো যে, আমি তো নয়েই এমনকি নন্দনাও কোনো রিঅ্যাকশনের সুযোগ পেলো না। সর্বসাকুল্যে আমার বউকে সাত থেকে আট সেকেন্ড জড়িয়ে ছিলো প্রমোদ, স্পষ্ট দেখতে পেলাম ওকে বন্ধনমুক্ত করার আগে ওর গালে একবার নিজের নাকটা ঘষে নিলো ডাক্তার। আমার মনে হলো প্রমোদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে ওদের দু'জনের মাঝে গিয়ে দাঁড়াই, কিন্তু আমার ভেতর থেকে কে যেনো আটকে দিলো আমাকে! তবে আজ তো প্রথম নয়, প্রতিবাদ করার বদলে নিজের প্রতি এই অজানা নিষিদ্ধ নিয়ন্ত্রণ .. এটা আগেও বারকয়েক ঘটেছে আমার সঙ্গে। আমি তাড়াতাড়ি করে বাইরের দরজাটা আটকে দিলাম, পাছে কেউ এই অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য দেখে ফেলে!
"শুধুমাত্র তোমার জন্য স্পেশাল অর্ডার দিয়ে গফুরের দোকান থেকে বানিয়েছি ফুলের এই বোকেটা। ফুলগুলো তোমার মতোই তাজা আর সুগন্ধযুক্ত .. হাহাহাহা। যাকে বলে, ঠিক মানুষের হাতে একদম ঠিক উপহার পড়েছে।" নন্দনার উদ্দেশ্যে এই বেহিসাবি কথাগুলো বলে আমার দিকে ঘুরে প্রমোদ বললো, "এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে না থেকে পেগ বানাও, দেখি বৌমা চাটের কি বন্দোবস্ত রেখেছে!"
"হুইস্কি তো নেই স্যার। বিয়ার আছে, চলবে?" মিনমিন করে জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
"নাকের বদলে নরুন পেলাম টাক ডুমা ডুম ডুম। নাই মামার থেকে কানা মামা ভালো, নিয়ে এসো বিয়ার।" প্রমোদের এই উক্তির পর, নন্দনা বললো "চাট আবার কি?"
- "ও কিছু নয় বৌমা। সেদিনকে তোমার ডায়েট চার্ট করে দেওয়া হয়নি, তাই ভাবছি আজ করে দেবো। তা তুমি স্টার্টারে জন্য কিছু বানাওনি? মানে ধরো এই কাবাব বা পকোড়া .. এই ধরনের কিছু?"
"ওমা এই কথা? হ্যাঁ বানিয়েছি তো! চিকেন পকোড়া আর পনির পকোড়া ভাজছিলাম রান্নাঘরে, আপনারা বসুন আমি এখনই নিয়ে আসছি।" কথাগুলো বলে দ্রুত সেখান থেকে চলে গেলো আমার বউ।
বিয়ার আর লেমন সোডা নিয়ে ড্রয়িংরুমে রাখা সোফার উপরে দু'জনে পাশাপাশি বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই নন্দনা পকোড়ার দুটো প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকলো। "একটাতে চিকেন আর একটাতে পনির পকোড়া রয়েছে। আপনারা কাজের কথা বলুন, আমি ততক্ষণ বাপ্পাকে একটু পরিয়ে নিই, কাল ওর পরীক্ষা রয়েছে।" কথাগুলো বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো নন্দনা। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি।
আমার দেওয়া রিসিভ কপিটা সই করাতে এখন প্রমোদ এখানে এসেছে, সেটা ও আমাকে আজ সকালেই বলেছিলো। তাই মালিকের দুই প্রতিনিধি যখন আমার সহায়, তখন এ যাত্রায় খুব ভালোভাবেই বেঁচে গেলাম আমি, এটা মনে করে দাঁত ক্যালাতে ক্যালাতে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, "তাহলে পেপারটা দিন স্যার, সই করে দিই .."
"কিসের পেপার ভাই?" বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো প্রমোদ।
কথাটা শুনে অবাক হয়ে গিয়ে বললাম, "কেনো? সকালে যে পেপারটা আপনাকে দিলাম। মানে ওই রিসিভ কপিটার কথা বলছিলাম .."
"ওটা এখন ওয়েস্টবক্সে। তোমার চাকরি তো অনেক দূরের কথা, আমরাই আর থাকবে কিনা সন্দেহ! আমি আর রবার্ট যার রিপ্রেজেন্টেটিভ হয়ে এই ফ্যাক্টরিতে রয়েছি, সেই ম্যাকেঞ্জি সাহেব এখন দেনার দায় ডুবে নিজের ৪৫% শেয়ার তার অপর পার্টনার ঝুনঝুনওয়ালাকে খুব সস্তায় বিক্রি করে দেওয়ার প্ল্যান করছে। আর এই খবরটা একদম ঘোড়ার মুখের খবর। রবার্টের বাল্যবন্ধু ম্যাকেঞ্জির ভাই ফোন করে জানিয়েছে কথাটা। আর ঝুনঝুনওয়ালার তৈরি করা নতুন বোর্ড যে তোমাকে চাকরিতে রাখবে না, এটা জলের মতো পরিষ্কার। কারণ, তুমি যে আমাদের হয়ে কাজ করো, সেটা এতদিনে সবাই জেনে গিয়েছে।" কথাগুলো অবলীলায় বলে গিয়ে চিকেন পকোড়াতে কামড় দিলো প্রমোদ।
কি শোনার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম আমি, আর কি শুনতে হলো আমাকে! ডাক্তারের মুখে কথাগুলো শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো আমার। "এসব কি বলছেন স্যার? তাহলে আমার কি হবে? বউ-বাচ্চা নিয়ে তো এবার রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে আমাকে!" ধরা গলায় প্রমোদের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বললাম।
"আরে এত ভেঙে পড়ার মতো কিছু হয়নি, আমার পুরো কথাটা আগে শোনো। এটা তো অস্বীকার করা যাবে না, ম্যাকেঞ্জির এই দুরবস্থার জন্য পরোক্ষভাবে আমরাই দায়ী! আমি আর রবার্ট ওর বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে রিজেক্টেড জুটপ্যাকে কোম্পানির সীলমোহর মেরে ফ্রেশ বলে এত বছর ধরে চালিয়ে এসে লক্ষ লক্ষ টাকা কামিয়েছি। আর বিগত এক বছর ধরে কোম্পানির এমপ্লয়ি হওয়া সত্ত্বেও তুমিও আমাদের হয়ে কাজ করেছো এবং আমাদের কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নিয়েছো। তাই তোমার চাকরি চলে গেলে নিজেকে ছাড়া আর কাউকে ব্লেম করতে পারবে না তুমি। তবে এটা একদিন হওয়ার ছিলো, সেটা আমরা জানতাম। তাই নিজেরদের জন্য একটা অল্টারনেটিভ ব্যবস্থা করে ফেলেছি আমরা। রেল স্টেশনের পশ্চিমদিকে ফাউন্ডারির সামনের দু' বিঘা জমিটা ম্যাকেঞ্জির পিছন মেরে বছর খানেক আগেই কিনে নিয়েছিলাম আমরা। ওখানে দুটো বিশাল বড়ো গোডাউন বানানো হয়েছে আর সেই গোডাউনে বাজারে জুটের এই আকালেও প্রচুর কাঁচামাল মজুদ রয়েছে। দ্যাখো, আমরা তো এত কম সময় এবং লোকবল ছাড়া কোনো প্রোডাকশন ফ্যাক্টরি খুলতে পারবো না! আমরা যে কাজটা করবো সেটা হলো, বিভিন্ন জুটমিলকে কাঁচামাল সাপ্লাই দেবো। আমাদের সঙ্গে হার্জিন্দারও পার্টনার হিসেবে থাকবে। পয়সাকড়ির দিক থেকে আমাদের তিনজনেরই ইকুয়াল কন্ট্রিবিউশন রয়েছে। আপাতত সিকিউরিটি গার্ড নিয়ে মোট দশজন ওয়ার্কার রয়েছে ওখানে। আমাদের তরফ থেকে একটা প্রোপজল রয়েছে তোমার জন্য। এখানকার চাকরি তোমার আর থাকবে না, তাই আমরা চাই তুমি জয়েন করো ওখানে আমাদের সাথে। তোমার মনিটারি কন্ট্রিবিউশনের কোনো দরকার নেই। তুমি শুধু ওখানে আমাদের সঙ্গে থাকবে, বিভিন্ন মিটিং অ্যাটেন্ড করবে .. দ্যাট'স অল। তোমাকে আমরা এমপ্লয়ি হিসেবে ওখানে চাইছি না, আমাদের চতুর্থ পার্টনার হিসেবে চাইছি।" কথাগুলো বলে বিয়ারের গ্লাসটা এক চুমুকে শেষ করে টেবিলের উপর রাখলো প্রমোদ।
মাঝ সমুদ্রে অসহায়ের মতো ভেসে যাওয়ার সময় কোনো অবলম্বনকে আঁকড়ে ধরার যদি হঠাৎ করে সুযোগ এসে যায়, তখন যা মানসিক অবস্থা হয়! ডাক্তারের কথাগুলো শুনে আমার মনেরও সেই অবস্থা হলো। তবুও মনে একরাশ সংশয় নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, "কিন্তু আমার কাছে তো সম্পদ বলতে কিছুই নেই, আমাকে কি হিসেবে পার্টনার বানাতে চাইছেন আপনারা?"
"নিজের সোচ কে বড় কর চিরন্তন। বড় কিছু ভাবার চেষ্টা করো। কর্মচারী নয় এবার থেকে মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করো। আর ট্রেজারের কথা বলছো? তোমার কাছে যা আছে, তার থেকে বড় সম্পদ বোধহয় আর এই শহরে কারোর কাছে নেই।" আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে হাসতে কথাগুলো বললো প্রমোদ।
লোকটা যে কখন কি বলে, তার কোনো ঠিক নেই। প্রমোদের এই কথার মানে বুঝতে না পেরে ওকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলাম; ঠিক সেই মুহূর্তে "ন'টা বাজতে চললো, তোমরা কি এখন ডিনার করবে?"ভেতর থেকে নন্দনার গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম।