Thread Rating:
  • 16 Vote(s) - 3.31 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
ভৌতিক গল্প সংকলন (সমাপ্ত)
#88
[Image: FB-IMG-1693800530978.jpg]


|| ক্ষুধার্ত_অন্ধকার ||

লেখা :- ঈশিকা 

        কলকাতার একটি  কলেজের এক্সকারশনে থার্ড ইয়ার জিওগ্রাফি অনার্সের সবাই মন্দারমনি এসেছে। সেখানে একটি প্রাইভেট রিসর্টের বীচ সংলগ্ন এলাকার পাশের লনে চেয়ার নিয়ে জমায়েত হয়েছে সবাই সন্ধ্যেবেলা চা খাওয়ার জন্য। দূরে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে। ফেনাগুলিকে রাতের অন্ধকারেও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে এত দূর থেকে, কিভাবে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। সেদিকে তাকিয়ে ঢেউ গুলির ছড়িয়ে পড়া দেখতে দেখতে ও রাতে সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে সবাই পুরো আড্ডা জমিয়ে ফেলেছে একেবারে। এমনকি শিক্ষার্থীদের সাথে সাথে দুজন অধ্যাপকও রয়েছেন সেখানে। তারা গল্পে অংশগ্রহণ না করলেও হাসিমুখে শুনছেন সবার কথা।
      এমন সময় অর্ডার করা পকোড়া, কফি, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইগুলি চলে আসায় লাফ দিয়ে উঠলো ছটফটে ঝিলাম - " কাম অন গাইস, এই অ্যাটমস্ফিয়ারে একটু হরর না হলে জমে নাকি! মুডই আসবে না। চল সবাই মিলে ফান কিছু করা যাক। কখন থেকে সেই বোরিং কনভারসেশন চলছে।"
         পাশের থেকে ফুটকাটে সিদ্ধান্ত - "সিরিয়াসলি ঝিল, তুই কি এখন এই প্রাইভেট রিসর্টটাকে হন্টেড হাউস করে তুলতে চাস নাকি? তুই আর তোর হরর! বি প্র্যাক্টিকাল।"
              - "শাট আপ সিড! কাওয়ার্ড একটা , যা নিজের রুমে ঢুকে বসে থাক। আমরা আমাদের মত স্পাইন চিলিং হরর স্টোরি নিয়ে আলোচনা করব। ভয় পেলে পালা এখনই।"
                ঝিলামের কথা শুনে ঠোঁট বেঁকিয়ে সিদ্ধান্ত বলে - "প্লিজ ঝিল, সবাই জানে আমাদের দুজনের মধ্যে কে ভীতু! তুই আর লোক হাসাস না।"
               তার কথায় প্রত্যুত্তরে আবার তেড়েফুড়ে কি উত্তর দিতে যাচ্ছিল ঝিলাম, তার আগে বলে উঠলো স্নেহা ঝিলামের বেস্ট ফ্রেন্ড। শুধু শান্তই নয় অত্যন্ত ঠান্ডা মাথার প্রত্যুতপন্নমতি সম্পন্ন। সে জানে ঝিলাম এবং সিড দুজনের মধ্যে প্রায় সাপে নেউলের সম্পর্ক। এখনই হয়তো শুরু হয়ে যাবে দুজনের চিৎকার চেঁচামেচি, তাই এদের থামানো দরকার।
            তাই সে দুজনের মাঝে এসে হাত দুটিকে ছড়িয়ে বললো - "ওয়েট!ওয়েট!ওয়েট! আমরা যদি একটা নতুন গেম খেলি?"
        গেমের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে গিয়েছে ঝিলামের।  সিদ্ধান্তর চোখেও জিজ্ঞাসা। এবার প্রশ্ন করলো দেবাশিষ - " গেম, কেমন গেম?"
             স্নেহা নজর ঘুরিয়ে একবার চারদিকে তাকালো। দেখতে পেল উৎসুকভাবে সবাই তার মুখের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে বলা শুরু করল সে - "ঝিল চায় হরর স্টোরি। আর সিড চাইছে প্র্যাকটিকাল কিছু। তো আমরা যদি কোন প্রাকটিক্যাল হরর গেম খেলি?"
             - "মানে?" কৌতূহলী জিজ্ঞাসা সবার।      
             - "মানে আমরা যদি নিজের লাইফের ঘটা সবথেকে ভয়ংকর ঘটনা আজ শেয়ার করি তাহলে কেমন হয়? এমন কিছু যা ভাবলে এখনো আমাদের গা কেঁপে ওঠে তেমন কিছু!"
           এই পর্যন্ত শুনেই বলে উঠলো অস্থির চিত্ত কৌশিক - "ধুর এখন কি বসে বসে এসব গল্প করবো নাকি? এর থেকে কোন মুভি দেখলেও কাজে দিত।"
               তাকে সাথে সাথে থামিয়ে দিল সিরিয়াস স্টুডেন্ট নন্দিতা - "গুড আইডিয়াস স্নেহা। আমি রাজি আছি। মুভি দেখার সময় পরেও পাব, কিন্তু এভাবে বন্ধুরা সবাই মিলে একসাথে হয়ে পার্সোনাল এক্সপেরিয়েন্স শেয়ারের সুযোগ আর পাবো না। কলেজ শেষে কে কোন দিকে চলে যাব আর কবে আবার দেখা হবে তাই বা কে জানে।"
                   তার কথা শোনার পর বাকিরাও চুপ হয়ে গেল অদূর ভবিষ্যতের কথা ভেবে। সত্যি তিন বছর বড় কম সময় নয়, একসাথে থিওরি ও প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস করতে করতে সবাই সবার ভালো বন্ধু কখন হয়ে উঠেছে তা তারা নিজেরাই বোঝেনি।
           স্নেহাই প্রথম নিস্তব্ধতা ভাঙলো - "বেশ! প্রস্তাব যখন আমি দিয়েছি, তাহলে আমিই শুরু করব। তারপর কে কি বলবে সেটা ভেবে নে তোরা।"
               এইভাবে একে একে সবাই বলা শুরু করল তাদের জীবনে ঘটা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বাস্তব অভিজ্ঞতার গল্প। কেউ তাদের ছোটবেলায় ঘটা কোন ভুতুড়ে অভিজ্ঞতার কথা, কেউ তাদের জীবনে ঘটা কোন অলৌকিক অভিজ্ঞতার কথা বলল। আবার কেউ নিজের অতি প্রিয় জনকে হারানোর যন্ত্রণার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। এভাবে গল্পের আসর ক্রমেই জমে উঠেছে। আরেক রাউন্ড কফি এবং পকোড়া অর্ডার করে খাওয়াও শেষের দিকে। এমনকি দুজন প্রফেসরের মধ্যে একজন তার নিজের প্রথম কর্মজীবনে ঘটা একটি অভিজ্ঞতা ছাত্র-ছাত্রীদের জানালেন, যার কোন ব্যাখ্যা তিনি আজও পাননি।
               হঠাৎ সিদ্ধান্তর খেয়াল হল বাকি সবাই আলোচনার শুরু থেকে এখনো পর্যন্ত হয় নিজেদের অভিজ্ঞতা বলেছে নয়তো বাকিদেরটা শুনে কিছু অন্তত প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। একমাত্র তখন থেকে মুখে কুলুপ এঁটে বসে রয়েছে প্রতীক।
               তাই সে আচমকা প্রতীকের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো - " এই তোর কি হয়েছে রে প্রতীক, তখন থেকে চুপচাপ বসে আছিস! তোর বুঝি পোষাচ্ছে না এসব?"
           আচমকা এইরূপ আক্রমণের জন্য প্রতীক একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। সে আমতা আমতা করে বলে উঠল - " তা কেন ভাই, তোরা সবাই বলছিলি তাই আমি তোদের কথা শুনছিলাম।"    
           - "আচ্ছা তাই বুঝি বেশ চল, এখন তাহলে তুই বলবি আমরা শুনবো।"
              সিদ্ধান্তের কথা শুনে যেন আরো বেশি ঘাবড়ে গিয়ে বলে উঠল প্রতীক- " আমি, আমি কি বলবো?"
             - "তোর জীবনে ঘটা সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনা।"
        এ কথাটা বলার সাথে সাথে সিদ্ধান্ত লনের মৃদু আলোতেও স্পষ্ট দেখতে পেল প্রতীকের পুরো শরীর যেন নিদারুণ আতঙ্কে শিউরে উঠল। তার সাথেই পুরো মুখ একেবারে রক্তশূন্য ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
         তার এই অস্বাভাবিক পরিবর্তন সিদ্ধান্তের সাথে সাথে নজর এড়ায়নি ঝিলাম ও স্নেহার ও। এবার ঝিলাম এগিয়ে গেল প্রতীকের দিকে - "এই তোর কি ব্যাপার রে, তোর লাইফে ঘটা ইনসিডেন্টের কথা জিজ্ঞেস করাতে তুই এভাবে কেঁপে উঠলি কেন? কি হয়েছে এমন?"
      ঝিলামের এই প্রশ্ন শুনে আরো একবার কেঁপে ওঠে প্রতীক। তারপর কাঁপা কাঁপা গলাতেই বলে - "কি আর হবে! তোদেরও যা ইমাজিনেশন!"      
        - " ইমাজিনেশন! স্পষ্ট দেখছি তুই কাঁপছিস! কি হয়েছে বল তো। এমন কি কিছু ঘটেছিল তোর সাথে যেটা মনে করতেও তুই ভয় পাচ্ছিস, বল নাহলে তোকে ছাড়বো না আমরা।"
       একবার আহত দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে মাথাটা ঝুঁকিয়ে নিল প্রতীক। মৃদুস্বরে বলল - "আমি মনে করতে চাই নারে ওসব। ওই তীব্র আতঙ্ক, ওই চরম যন্ত্রনা আজও আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়।"
        এবার স্নেহা এগিয়ে এসে ঘাড়ে হাত রাখল প্রতীকের, চমকে মুখ তুলে তাকাল প্রতীক। স্নেহা সহানুভূতি ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল - " তুই জানিস, কোন কিছু অন্যদের সাথে শেয়ার করলে মন হালকা হয়! আর আমরা সবাই তোর বন্ধু। বল না আমাদের, হয়তো নিজেরও একটু ভালো লাগবে তোর সব কিছু বলার পর।"
          স্নেহার কথা শুনে কিছুক্ষণ মাথা ঝুঁকিয়ে  একটু ভাবলো প্রতীক। তারপর বাকিদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো সবাই তার দিকে সহানুভূতি ও কৌতূহল মেশানো দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। একটু ইতস্তত করে এবার বলা শুরু করলো সে - " এই ঘটনা আর কখনো আমি মনে করব এ কথা ভাবি নি, কাউকে বলা তো দূরের কথা। এ ঘটনাটাকে আমি একটি দুঃস্বপ্ন ভেবে ভোলার চেষ্টা করে এসেছি এতদিন, কিন্তু ভুলতেও পারিনি পুরোপুরি। আমার কলেজ জীবনে ঘটে যাওয়া এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা যে আজও আমাকে তাড়া করে বেড়ায় প্রতিনিয়ত। আজ আমি তোদের সে কথাই বলতে চলেছি। আমি আমার বাবা-মা কেও এ বিষয়ে সবকিছু খুলে বলতে পারিনি কখনো। এবার শোনার পর বিশ্বাস করা না করা তোদের ব্যাপার।
             
       শোন তাহলে এটা আজ থেকে প্রায় পাঁচ - ছয় বছর আগের ঘটনা, আমি তখন সবে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি। পরীক্ষা দেওয়ার পরে দিব্যি ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছি। রেজাল্ট আউটের দেরি আছে তখনো, আর পরীক্ষাও ভালোই হয়েছে তাই বেশ হালকা মেজাজেই আছি। তোরা জানিস আমার বাড়ি উত্তরবঙ্গে। জলপাইগুড়ির কাছে তোরোল পাড়া বলে একটি মফস্বল জায়গা আছে। আমার বাড়ি সেখানেই, সেখানকারই উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তাম আমি। আমাদের পাড়ায় আমার দুজন খুব ভালো বন্ধু ছিল রাহুল আর মানস। মাধ্যমিকের পরে অ্যাডভেঞ্চার খুঁজে চলেছি তিনজনেই, হঠাৎ আইডিয়াটা দিল মানসই। তোরোল পাড়া পার হয়ে গেলে ধাপগঞ্জ বলে একটি জায়গা পড়ে। সেখানে মেইন রোড দিয়ে যেতে গেলে একটি ব্রিজ পড়ে। আমি হলদিবাড়িতে মামা বাড়ি যাওয়া আসার সময় এই ধাপগঞ্জের উপর দিয়েই গেছি। ওখানে একটি মন্দির আছে। মানস বলছিল মন্দিরের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটির সম্পর্কে, ওই রাস্তা গিয়ে যেখানে উঠেছে সেই জায়গাটি নাকি জঙ্গলে ঘেরা। ওই জায়গাটির নাকি দুর্নাম আছে।" - এই পর্যন্ত বলে থামলো প্রতীক।
               - "দুর্নাম! কেমন দুর্নাম? প্রশ্ন করল স্নেহা।
             একটু চুপ করে থেকে উত্তর দিল প্রতীক -  "তোরা অন্ধকারকে ভয় পাস কি?"
            - " অন্ধকার? তা আচমকা লোডশেডিং হয়ে ঘর অন্ধকার হয়ে গেলে ভয়তো একটু লাগবেই।" আমতা আমতা করে উত্তর দেয় ঝিলাম।
            আচমকা মুখ তুলে ঝিলাম এর দিকে তাকায় প্রতীক এবং ঝিলামের তা দেখে বুকের ভেতরটা কেমন কেঁপে ওঠে । প্রতীকের চোখের দৃষ্টি! ও যে বড় বেশি শীতল! ততোধিক শীতল কন্ঠস্বরে বলে ওঠে প্রতীক - " আমি আলো চলে গেলে যে অন্ধকার হয় তার কথা বলছি না, আমি বলছি আলো থাকা সত্ত্বেও যে অন্ধকার কোনভাবেই দূর হয়না তার কথা।"
         
                     তার কথা শুনে উপস্থিত সকলে চমকে উঠে এর মুখের দিকে চাওয়া চাওয়ি শুরু করল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। একটু ইতস্তত করে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে সিড জিজ্ঞাসা করল -  "মানে?"
           - "মানে তোদের খুলেই বলি তাহলে পুরো ব্যাপারটা। ধাপগঞ্জে ওই জায়গাটায় ভয়ে দিনের বেলাও কেউ পা মাড়ায় না। ওই জঙ্গলের ত্রিসীমানাতেও স্থানীয় মানুষেরা দিনের বেলাতেও পা রাখতে চায় না। তারা মনে করে ওই জঙ্গলে ছায়া শরীরীরা থাকে, তারা ওই জঙ্গলের গাছপালা ঝোপের ভেতর থাকে। সম্পূর্ণ অন্ধকার দিয়েই তৈরি তাদের দেহ। তারা ওই জঙ্গলে প্রবেশকারী মানুষের দেহ দখল করে নেয় আর তারপর" - বলতে বলতে শিউড়ে উঠলো প্রতীক।
                 - "তারপর?" মৃদুস্বরে প্রশ্ন করল স্নেহা।
                - " তারপর? তারপর আর কি! ওই অসহায় মানুষগুলোর কপালে থাকে চরম যন্ত্রণাদায়ক ভয়াবহ মৃত্যু! তাদের শরীরের ভেতরে ঢুকে তাদের শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোকে ভেতর থেকে খুবলে খাওয়া শুরু করে তারা। ওই জঙ্গলেরই গাছতলার নিচে পড়ে থাকে ওই হতভাগ্য মানুষগুলোর ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত বীভৎস বিকৃত মৃতদেহ।"
          এই পর্যন্ত বলে চুপ করলে প্রতীক, চোখে মুখে তার চরম আতঙ্ক ও যন্ত্রণার ছাপ। যেন সে হারিয়ে গেছে ফেলে আসা পুরনো ছেলেবেলার দিনগুলিতেই। অত বছর আগের ফেলে আসা অতীত স্মৃতি এবং অতীতের সেই ঘটনার সাথে জড়িত সেই নিদারুণ ভয় যেন তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে এখনো।
                     হয়তো স্মৃতির পাতায় স্মৃতিচারণার মাধ্যমে হারিয়ে যেতে যেতেই ঝিলামের নরম হাতের ছোঁয়ায় সম্বিত ফিরল তার। ঝিলাম প্রতীকের কাঁধে হাত দিয়ে প্রশ্ন করল - "কি হয়েছিল রে সেদিন?"
                  ঝিলামের দিকে একবার তাকিয়ে বাকি সহপাঠীদের মুখের দিকে তাকালো প্রতীক। দেখল সবাই আগ্রহ সহকারে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে।
             জোড়ে একটা শ্বাস নিয়ে শুরু করলো প্রতীক - " তোদেরকে তো বললামই এটা আমার ১৫-১৬ বছর বয়সে ঘটা একটি ঘটনা। এই বয়সে অভিজ্ঞতা কম থাকে, কিন্তু নিজেকে প্রমাণ করার ইচ্ছে থাকে ষোলো আনা। অ্যাডভেঞ্চারের শখ এই বয়সে সবারই থাকে কম বেশি। তো আমাদের মধ্যেও তখন রোখ চেপেছে অ্যাডভেঞ্চারের। মানসের মামাবাড়ি ওই ধাপগঞ্জে। ওই এলাকায় মন্দিরের পেছনে জঙ্গল নিয়ে মিথ দীর্ঘদিন ধরেই প্রচলিত। ওই বলল যে নিজেদের সাহসী হিসেবে প্রমাণ করার এরকম সুযোগ আর আসবে না। দুপুর বেলা ওই জঙ্গলে ঢুকে আমাদের ওখান থেকে কোন গাছের ডাল ভেঙে আনতে হবে, তবেই আমরা সবাইকে দেখাতে পারব আমরা কতটা সাহসী। যেমন ভাবা সেই অনুযায়ী কাজ। একদিন দুপুরবেলায় সাইকেল নিয়ে বাড়ি থেকে ধাপগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম আমরা থ্রি মাসকেটিয়ার্স। দুপুর গড়িয়ে বিকেলের মুখে এসে দাঁড়ালাম আমরা ধাপগঞ্জের সেই মন্দিরের সামনে। ওর পাশ দিয়ে যাওয়া পায়ে চলা পথটাও চোখে পড়লো আমাদের। ওখানে সাইকেল দাঁড় করিয়ে ওই পথ ধরে হেঁটে জঙ্গলে প্রবেশ করায় মনস্থির করে আমরা এগিয়ে গেলাম।
              ওই পথটি ধরে একটু এগোতেই কেমন যেন একটা অস্বস্তি হওয়া শুরু হলো আমাদের। ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না কিন্তু কেমন একটা অনুভূতি, হয়তো আমাদের অবচেতন মন আমাদের আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সচেতন করছে বা হয়তো অন্য কিছু। একটা অদ্ভুত শীতলতা যেন ধীরে ধীরে আমাদের পুরো শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে, তার সাথে এগনোর সাথে সাথে আমাদের সমগ্র শরীর যেন ক্রমশ ভারি হয়ে উঠছে। ওই পায়ে চলার রাস্তা ধরে এক এক করে চলছিলাম আমরা। সবার প্রথমে ছিল মানস। হঠাৎ করে একটি মোড় ঘুরে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। তার পিছনে থাকা আমরা দুজনই ও দাঁড়িয়ে যেতে বাধ্য হলাম অগত্যা।
      পিছন থেকে আমি জিজ্ঞেস করলাম - " কিরে কি হলো দাঁড়ালি কেন এভাবে?"
      মানস একবার পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে কাঁপা হাতে আঙুল তুলে নির্দেশ করল সামনে, আমরা তাকিয়ে দেখতে পেলাম সামনেই সেই জঙ্গল, আমরা তার সামনেই এসে পড়েছি একেবারে। ওই দিকে তাকিয়ে কেমন গা ছমছম করে উঠল আমাদের। তিনজনেই পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে শঙ্কিত মনে প্রবেশ করলাম জঙ্গলের ভেতরে।
               জঙ্গলের ভিতরটা দিনের বেলাতেও যেন কেমন স্যাঁতস্যাঁতে, আর অন্ধকার। খুব যে গভীর জঙ্গল তাও নয়, গাছগুলো বেশ ছাড়া ছাড়া তাও জঙ্গলের ভেতরটা যথেষ্ট অন্ধকার। আর এই তীব্র শীতলতা! এটা তো শীতকাল নয়, তাও যেন শরীরের ভেতর থেকে উঠে আসছে এই ঠান্ডা। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছি নিজেই বুঝতে পারিনি, হঠাৎ তাকিয়ে দেখি পাশে মানস বা রাহুল কেউ নেই।
                     চেঁচিয়ে ডাকতে যাবো ওদের, হঠাৎ মনে পড়ল মানস এই জঙ্গলে ঢোকার আগে কি বলেছিল। এখানকার মানুষেরা মনে করে যে বা যারা এই জঙ্গলের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে ওই ছায়া শরীরীরা তাদের উপর ক্রুদ্ধ হয়‌। কারণ তাদের এই জঙ্গলে বাইরের মানুষের প্রবেশ তারা একদম পছন্দ করেনা। তখন কথাটা নিয়ে হাসাহাসি করেছিলাম, কিন্তু ওই মুহূর্তে জঙ্গলের ভেতরে দাঁড়িয়ে কথাটা মনে করতে মনে যেন তীব্র আতঙ্ক  চেপে বসলো‌। সামনেই কোথাও হবে ওরা দুজন, এমনি খুজে দেখি, না পেলে ডাকবো না হয় তখন।
              এই ভেবে মনে সাহস সঞ্চয় করে ধীর পায়ে এগোলাম আমি সেই জঙ্গলের ভেতরে। কতক্ষণ যে ঘুরেছি তার ঠিক নেই, অত্যধিক আতঙ্কে ও উৎকণ্ঠায় বোধহয় আমার সময় জ্ঞানও লোপ পেয়েছিল। যত পাগলের মত ওদের খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম ততই আমার মনে তীব্র আতঙ্ক ক্রমশ চেপে বসছিল। এইতো এখানেই তো ছিল ওরা, এইটুকু সময়ের মধ্যে কত দূরে আর যেতে পারে? কিন্তু না কোথাও তাদের চিহ্নমাত্র নেই, শুধু বড় বড় গাছ এবং তাদের নিচের ঝোপঝাড় এবং জমাট বাঁধা অন্ধকার। এ যেন ঐ গাছপালাগুলির ছায়া নয়, তার থেকেও বেশি ঘন কালো কিছু দিয়ে যেন এই অন্ধকার তৈরি হয়েছে।
         সেদিকে তাকালেই অদ্ভুত এক শিরশিরানি অনুভূত হয় গায়ে। শরীর ঠকঠক করে কাঁপছে আমার, এক অস্বাভাবিক শৈত্য অনুভব হচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও হাতের তালু ক্রমশ ঘেমে যাচ্ছে, গলা শুকিয়ে কাঠ। পড়ন্ত বিকেলের আলো ক্রমেই আরো কমে আসছে। মনে হচ্ছে এই জঙ্গলের চারপাশের অন্ধকার যেন এই মুহূর্তে একটি হিংস্র শ্বাপদের মত আমাকে গিলে খাওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। হঠাৎ করেই আরো এক চরম আতঙ্ক আমার মনের মধ্যে চেপে বসলো। কোন দিক দিয়ে যেন ঢুকে ছিলাম আমি, রাস্তা তো ঠিকঠাক বুঝতে পারছি না।রাহুল আর মানসকে খুঁজতে গিয়ে কি আমি নিজেই রাস্তা হারিয়ে ফেললাম নাকি শেষে। হে ঈশ্বর! এখন এই অভিশপ্ত জঙ্গল থেকে বেরোবো কিভাবে?
                    হঠাৎই একটা মর্মান্তিক আর্তনাদের শব্দ ভেসে এলো খানিক দূর থেকে। রাহুলের গলার আওয়াজ না এটা! আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে সেই দিকে দৌড় লাগালাম আমি। কিছুদূর গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম আমি। মেরুদন্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত নামতে শুরু করে দিয়েছে আমার ততক্ষণে। হাত পায়ের তীব্র কাঁপুনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না আমি সোজা হয়ে। ওটা তো রাহুলই! কিন্তু দেখে বোঝা যাচ্ছে ওর শরীরে আর প্রাণের চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। ওর নিষ্প্রান দেহ পড়ে রয়েছে একটি গাছের নিচে আর সেদিকে তাকিয়ে আমার শরীর রীতিমত অসুস্থ লাগতে লাগলো। তাকিয়ে থাকতে পারছি না আমি ওই দিকে! ওর শরীর কেউ যেন ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছে। শরীরের ভিতর থেকে নাড়িভুঁড়ির কিছুটা অংশ বাইরে বেরিয়ে ঝুলছে। চোখগুলো খুবলানো। মুখের কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। রক্তমাখা বিভৎস বিকৃত মৃতদেহ থেকে  বোঝার উপায় নেই যে, এই সেই ছটফটে প্রাণ চঞ্চল ছেলেটি যে কিছুক্ষণ আগে আমাদের সাথে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকেছিল। তীব্র বিবমিষা অনুভব করলেও, শুধুমাত্র মৃত্যু ভয় আমাকে অসুস্থ হওয়ার থেকে বিরত রাখছিল সেই মূহূর্তে।
              চরম আতঙ্কে দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে দৌড় লাগালাম আমি। বেরোতেই হবে আমাকে এই অভিশপ্ত জঙ্গল থেকে যেভাবেই হোক,না হলে রাহুলের পরিণতি আমারও ঘটবে। দৌড়াতে দৌড়াতে দুবার হোঁচট খেয়ে পরলাম, কিন্তু সেই শারীরিক যন্ত্রনাকে উপেক্ষা করে উঠে দাঁড়িয়ে আবার শুরু করলাম দৌড়োনো। থামার উপায় যে নেই আমার!
                   হঠাৎ কিছুদূর দৌড়ানোর পরে কানে এলো চাপা গোঙানির শব্দ। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখি মানস বসে রয়েছে একটি গাছের তলায়। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে রীতিমত অসুস্থ। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। কাছে গিয়ে গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। কথাবার্তাও সম্পূর্ণ অপ্রকৃতিস্থ, বারবার খালি বলছে - 'ওই ছায়া! ওই ছায়া! রাহুলকে জ্যান্ত চিবিয়ে খেয়ে ওর শরীর থেকে ওই ছায়া বেড়িয়ে এলো।'
                 ওকে আমি যতই বলি যে - 'মানস আমাদের এখনই বেরোতে হবে এই জঙ্গল থেকে, রাত্রি নামার আগে।'
          ও ততোই মাথা নাড়ে আর বলে -  'দেবে না, ওরা বের হতে দেবে না আমাদের। ওদের শিকারকে ওরা ছাড়বে না এত সহজে!'
                এদিকে আমি তীব্র আতঙ্কের সাথে দেখতে পাচ্ছি সূর্য ডুবে অন্ধকার নেমে গিয়েছে প্রায়। অনেক কষ্টে ওকে বলে বুঝিয়ে রীতিমতো জোর করেই টেনে তুললাম আমি। ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে চলেছি জঙ্গল থেকে বাইরে বেরোনোর উদ্দেশ্যে। কিছুটা এগোনোর পরে মনে হল আবার একই জায়গায় ঘুরে এলাম আমরা, একটু আগে এখানে এই গামারি গাছটাই তো দেখেছিলাম।
          আমি পথ ভ্রান্ত হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি তখনই মানস সামনের দিকে তর্জনী তুলে ইশারা করলো। ওর দেখানো আঙ্গুলের পথ অনুযায়ী হাটা দিলাম আমরা এবং কিছুদূর এগোনোর পরে বুঝতে পারলাম যে গাছপালা ক্রমশ কমে আসছে, আস্তে আস্তে ফাঁকা জায়গায় এসে পড়ছি আমরা। তারপরে সেই পায়ে চলার পথ থেকে ও দেখতে পেলাম, অবশেষে ধরে প্রাণ আসলো আমার। মানসকে বলতে যাব যে এই যাত্রা অবশেষে বেঁচে গেলাম আমরা, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখি মানস দাঁড়িয়ে রয়েছে জঙ্গলের শেষ সীমানায় মাথা নিচু করে।
       
             থমকে দাঁড়ালাম আমিও, বললাম - 'কিরে তুই দাঁড়িয়ে পড়লি যে ওখানে। শিগগিরই আয়, এই অভিশপ্ত জায়গা যত তাড়াতাড়ি ছাড়া যায় ততই মঙ্গল। চল সামনে লোকালয়ে যাওয়ার পরে যা করার করা যাবে।'
           কিন্তু আমার কথা শোনার পরেও সে সম্পূর্ণ নিরুত্তর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এবার রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম আমি। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম ওর দিকে। ওর গায়ে হাত দিয়ে বললাম - 'কিরে কি হলো, চল শিগগিরই! এত কষ্টে জঙ্গল থেকে বের হতে পারলাম, এখানে আর দাঁড়াস না। এগিয়ে চল সামনে।'
       আমার কথা শুনে ঘোলা চোখে দুর্বল দৃষ্টিতে আমার দিকে একবার তাকিয়ে মানস টলোমলো পায়ে এগিয়ে এলো ওই পায়েচলা পথ ধরে। সামনে মন্দিরে বোধহয় এখন সন্ধ্যা আরতি হচ্ছে কাসর ঘন্টার ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। ওই আওয়াজ শুনেই মানস কেমন যেন অস্থির ভাবে মাথা নাড়তে লাগলো।
          আমি মানসকে বললাম - 'ঐ শোন মন্দিরে আরতি চলছে। তার মানে কেউ আছে, চল এখনই ওনার কাছে গিয়ে সাহায্য চাই। সবকিছু খুলে বলি।' এই বলে আমি মন্দিরের দিকে হাঁটা দিলাম।
         আমার পিছন পিছন মানস ও এগোলো।হঠাৎই একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে মানস পা চেপে বসে পড়ল। আমি আবার দৌড়ে ফিরে এলাম - 'কিরে, কি হলো তোর?'
      ও বিকৃত স্বরে বলে উঠলো- ' পারছিনা! পারছিনা আমি যেতে!' এই বলে আবার পা চেপে ধরল।
           আমি ওকে ধরে তোলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু না ওর শরীর অসম্ভব ভারী হয়ে গিয়েছে। আমি এক চুলও নড়াতে পারছি না ওকে, দুজনেই দরদর করে রীতিমতো ঘামছি। কিন্তু কোনভাবেই ওকে এক ইঞ্চিও সরাতে পারছি না আমি।
       হঠাৎ একটা আলো এসে পড়লো আমাদের মুখে, আমরা তাকিয়ে দেখি যে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পড়া মাঝবয়সী এক ব্যক্তি এসে দাঁড়িয়েছেন মন্দিরের দরজায়। হাতে তার পুজোর থালা এবং সেখানে রাখা প্রদীপের আলোই বিচ্ছুরিত হয়ে  আমাদের চোখে মুখে পড়েছে।
           তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন - ' কে তোমরা? এখন এখানে কি করছো?'
        আমি মানসের দিকে একবার তাকিয়ে ওনার কাছে ছুটে গিয়ে সবকিছু সংক্ষেপে ওনাকে খুলে বলতেই উনি বললেন  - 'নিয়ে এসো তোমার বন্ধুকে ভেতরে।'
      আমি ওনার দিকে একবার তাকিয়ে আবার ফিরে এলাম মানসের কাছে। আবার শুরু হলো ওকে টেনে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা, কিন্তু কিছুতেই ওকে নড়ানো গেল না।
      কিছুক্ষণ তা দেখার পর উনি বলে উঠলেন  - ' তোমার বন্ধুকে তো এভাবে ভেতরে আনা যাবে না! ওর যে এখানে প্রবেশাধিকার নেই।'
                  - 'প্রবেশাধিকার নেই?'  আমার বিস্মিত প্রশ্নের উত্তরে তিনি জবাব দিলেন এবার
- 'না ওর প্রবেশাধিকার নেই এখানে, শুধু এখানে কেন কোন শুদ্ধ পবিত্র জায়গাতেই ওর প্রবেশাধিকার নেই। ও যে অপবিত্র, অশুভ।'
              আমার আহত চোখের দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে উনি বিড়বিড় করে কি কি মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে থালায় রাখা ছোটো একটি ঘন্টা তুলে বাজিয়ে এগিয়ে গেলেন মানসের দিকে। ঘন্টার শব্দ শুনেই মানস কান মাথা চেপে ধরল দুই হাত দিয়ে। তারপর মানসের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি সেই মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতেই থালায় রাখা ফুল বেলপাতা নিয়ে ছুড়ে দিলেন ওর গায়ে। গায়ে যেন জ্বলন্ত সীসে ঢেলে দেওয়া হয়েছে এইভাবে বিকৃত কন্ঠে আর্তনাদ করে উঠল মানস।
       তারপরে আমার হতভম্ব দৃষ্টির সামনে ওর শরীরটা যেন কেউ পিছন দিকে টানতে আরম্ভ করলো। যেই পথ ধরে আমরা এগিয়ে মন্দিরের সামনে এসেছিলাম সেই পথ ধরে কেউ যেন ওর শরীরটাকে  পিছন দিকে ঘষে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মাটির সাথে। ঠিক যেখানে জঙ্গলটা শুরু হয়েছে তার প্রান্তভাগে এসে থেমে গেল ওর শরীর। আর আমার চরম বিস্মিত এবং আতঙ্কিত দৃষ্টির সামনে ওই অন্ধকারের মধ্যেও আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম যে ওর শরীর ছেড়ে বেরিয়ে এলো আরো ঘন কালো নিকষ অন্ধকারে তৈরি মানুষের অবয়বধারী কোন কিছু, যা চার হাতে পায়ে ভর দিয়ে ওই জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে গেল। যাওয়ার আগে শুধু তা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তার রক্ত লাল চোখে আমাদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গেল, সেই চোখের দৃষ্টিতে যুগ যুগ ধরে পুষে রাখা ঘৃণা এবং ক্রোধ প্রকাশ পাচ্ছে।
         আমার ঘোর কাটলো ওই ব্যক্তির কণ্ঠস্বরে। উনি বললেন -  'এবার সব ঠিক আছে, এবার তোমার বন্ধুকে তুমি ভেতরে নিয়ে আসতে পারো। যে অপশক্তি এতক্ষণ ওর শরীরকে আশ্রয় করেছিল সে বেরিয়ে গিয়েছে। ওই অপশক্তি ওর দেহে এতক্ষণ ছিল দেখেই মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে পারছিল না ও। এখন আর ওর প্রবেশে কোন বাঁধা নেই নিয়ে এসো ওকে ধাপচণ্ডী মায়ের চরণে।'
          মানস ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়েছে। ওর অচৈতন্য দেহটা অনেক কষ্টে ওই মন্দিরের ভিতরে নিয়ে আসা হল। দেখলাম ছোট একটি মন্দির তার ভিতরে কোন দেবী মূর্তিও নেই। কথায় কথায় জানতে পারলাম যে উনি এই মন্দিরের পুরোহিত। সকাল এবং সন্ধ্যা মায়ের পুজো এবং আরতির জন্য এখানে আসেন। সামান্য দূরেই ওনার বাড়ি। তবে বিয়ে করেননি, একাই থাকেন।
               ওনার মুখ থেকেই জানতে পারলাম যে উঁচু জায়গাটির উপরে মন্দিরটি অবস্থিত সেটি আসলে একটি ঢিবি। ধাপচন্দ্র নামে এক ধার্মিক ব্যক্তি এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন। কথিত আছে দেবী চণ্ডী নাকি তাকে নরবলি দেওয়ার নির্দেশ দেন এবং না দিলে তাকে নির্বংশ হওয়ার ভয়ও দেখান। কিন্তু তিনি তা দিতে অস্বীকার করেন একে একে তার সমস্ত পরিবার পরিজন এবং ধন-সম্পত্তি সবই শেষ হয়। অবশেষে তিনি নিজেকে বলি দেন এবং সাথে সাথে এই মন্দির ভেঙে মাটির স্তুপে পরিণত হয়। সেই থেকে দেবীর নাম ধাপচন্ডী এবং জায়গাটির নাম ধাপগঞ্জ। এখানে মায়ের কোন মূর্তি নেই, দেওয়ালের গায়ে একটি প্রস্তর খন্ডেই তিনি দেবীরূপে এখানে পূজিতা হন। তিনি আরো বলেন ওই জঙ্গলের মধ্যে যেই সকল  ছায়া শরীরীরা তাদের অশুভ উপস্থিত নিয়ে ঘোরাফেরা করে তাদের এই মন্দিরের সীমানা লংঘন করার ক্ষমতা নেই। এই পবিত্র জায়গায় তারা প্রবেশ করতে পারে না, তাই মানসের শরীরে আশ্রিত ওই অশুভ শক্তি এই মন্দিরে প্রবেশ করতে বাঁধা প্রাপ্ত হয়েছিল। শঙ্খ ঘন্টার পবিত্র ধ্বনি ওরা শুনতে পারে না তাই ওই শব্দ শুনে মানস কান মাথা চেপে ধরেছিল। দেবী মায়ের চরণের ফুল বেল পাতা তিনি মানসের গায়ে ছুঁড়ে দেওয়াতে তার স্পর্শে সেই অপশক্তি মানসের দেহ ছেড়ে জঙ্গলে পুনরায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। তবে তিনি বলেন বিপদ এখনো কাটেনি। ওর শরীরে যে প্রবেশ করেছিল সে তার ক্ষতিকর প্রভাব রেখেই গিয়েছে মানসের শরীরে।  মায়ের সামনে মানসের অচৈতন্য দেহ আগলে বসে থাকতে হবে আমাদের। যদি ভোর হওয়ার আগে মানস সুস্থ হয়, জ্বর নেমে যায় তাহলে এই যাত্রা এই বিপদ থেকে তার মুক্তি। না হলে তাকে বাঁচানো সম্ভবপর হবে না ওনার পক্ষেও। সম্ভব হলে একমাত্র দেবী মায়ের পক্ষেই সম্ভব মানসকে রক্ষা করা।'
             তারপরে শুরু হলে প্রতীক্ষার পালা। ওই মন্দিরে পুরোহিত মশাই ওনার সাথে থাকা মায়ের পুজোয় দেওয়া কিছু ফলমূল আমাকে দিলেন রাত্রে আহার হিসেবে গ্রহণ করার জন্য। এরপর শুরু হলো সারারাত ধরে যমে মানুষে টানাটানি। যত রাত বাড়ে মানসের অবস্থা তত খারাপ হতে থাকে। জ্বর ক্রমশ বাড়তে থাকে, তার সাথে শুরু হয় ভুল বকা। একসময় খিঁচুনিও শুরু হয়।    
           বারবার একই কথা তার - ' চারদিকে এত অন্ধকার, আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না! ওই অন্ধকার আমাকে গিলে খেতে আসছে!'
              এভাবে ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসতে থাকে সে। অবশেষে সেই অভিশপ্ত রাতকে ঘুচিয়ে ভোরের আলো প্রবেশ করলো জানালা দিয়ে। চোখ মেলে তাকালো মানস। পুরোহিত মশাই মানসের গায়ে হাত দিয়ে বললেন জ্বর ছেড়ে গিয়েছে ওর, এই যাত্রায় তোমার বন্ধু বেঁচে গেল।
           তারপর আর অল্প সময়ের অপেক্ষা এবং আমাকে মানসের সাথে সেই মন্দিরে রেখে পুরোহিত মশাই গিয়ে লোকালয় থেকে লোকজন জোগাড় করে এনে রাহুলের মৃতদেহ উদ্ধার করে তা এবং আমাদের দুজনকেও আমাদের বাড়িতে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন গাড়ির ব্যবস্থা করে। ওই লোকজনের মধ্যে মানসের মামাও ছিলেন, তিনিই চললেন আমাদের সাথে নিয়ে। এসেছিলাম তিন বন্ধু অ্যাডভেঞ্চারের শখে, ফেরার সময় আমি এক বন্ধুকে অসুস্থ হিসেবে এবং অপর বন্ধুর মৃতদেহ নিয়ে ফিরে চলেছি। চোখের জল আর বাঁধ মানছে না। জানিনা বাড়ি গিয়ে রাহুলের মা-বাবাকে কি জবাব দেব আর মানসের বাড়িতেই বা কি বলবো।
               এই ঘটনার পরে মানস সুস্থ হলেও পুরোপুরি স্বাভাবিক কোনদিনও হতে পারেনি। সব সময় কিসের তীব্র আতঙ্কে দিন কাটায় সে। আমিও পারিনি ওই ঘটনা পুরোপুরি ভাবে ভুলতে কখনো। জোর করে ভুলে থাকার চেষ্টা করেছি অবশ্যই। আজ আবার তোদের সবার অনুরোধে আমাকে সেই ভয়ংকর স্মৃতির মধ্যে পুনরায় ফিরে যেতে হল। "
          এতক্ষণ প্রতীকের গল্প শুনতে শুনতে সবাই যেন ওর মধ্যেই ডুবে গিয়েছিল, এর ঘোর কেটে স্বাভাবিক হতে সময় লাগলো সবারই।
       সিদ্ধান্ত বলে উঠল - "তারপর?"
         - " তারপর আমার এখানে চলে আসা পড়াশোনার সূত্রে। বলতে পারিস ওখান থেকে পালিয়ে আসার চেষ্টাতেই এখানে আসা। তবে ওই জায়গা রয়েছে এখনো, এখন সেখানে মন্দিরে মায়ের মূর্তি ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু লোক বসতির চাপে ওই জঙ্গল ক্রমে সংকুচিত হয়েছে। তবে ওই জঙ্গলে বসবাসকারী ওই ছায়াশরীরীরা কি সত্যি সত্যি অবলুপ্ত হয়েছে, নাকি তারা ওখানে বসবাসকারী মানুষের ভিড়ে মিশে রয়েছে তাদের হিংস্র রূপ নিয়ে নতুন শিকারের উদ্দেশ্যে তা অবশ্য আমার সত্যিই জানা নেই!

            প্রতীকের গল্প শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও একটা শিরশিরে অনুভূতি রয়ে গেল সবার মনে। সত্যিই কি তারা সুরক্ষিত? যদি এরকম হয় যে তাদের চেনা পরিচিত লোকজনের ভিড়ে শিকারের খোঁজে এখনো ঘুরে বেড়ায় এইরকম অন্ধকারের জীবেরা!
               
|| সমাপ্ত ||

[Image: Shocked-Open-Asianpiedstarling-size-restricted.gif]

[+] 5 users Like Sanjay Sen's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: ভৌতিক গল্প সংকলন (চলছে) - by Sanjay Sen - 04-09-2023, 09:48 AM



Users browsing this thread: