Thread Rating:
  • 40 Vote(s) - 2.4 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Romance স্মৃতি সুন্দরী
#42
স্মৃতি সুন্দরী ২.১

বিদ্যা আর দোকান খোলেনি । সেই গোলাপ ফুলটা যেমন ছিল তেমনি রেখে দিয়ে সে নিচে নেমে এসেছিল । একজনকে পরশুদিন ব্লাউজ দেওয়ার কথা বলা আছে । তাই সে ভেবেছিল এক ঘন্টার জন্যে দোকান খুলে ব্লাউজের কাপড় মাপ মত কেটে রাখবে । এখন সে ভাবলো থাক , আগামীকাল বানিয়ে নেওয়া যাবে । অসুবিধা হবে না । তাই সে আর দোকান খুললো না ।

কিছুক্ষন মেয়ের সাথে কথা বলে বিদ্যা মেয়ে জামাইয়ের জন্য চা জল খাবার বানিয়ে দিয়েছিল । তারপর রাতের খাবার বানাতে রান্নাঘরে ঢুকে গেছিল । আজ সে একা খাবেনা । একা খেতে হবেনা । গত তিন মাস এই শূণ্যপুরিতে সে একা একাই খাচ্ছে। তিন বেলা কোনদিনও খাওয়া হয়নি । সকাল দুপুর না হলে রাতের বেলা কোন না কোন এক বেলা মিস যেতই । তার গলা দিয়ে খাবার নামতো না যে !

রান্নাঘরেই ছোট ডাইনিং টেবিল রাখা আছে । এখানেই খাওয়া দাওয়া করে সবাই । রাতে খাওয়ার সময় রান্নাঘরে শুধু থালা চামচের আওয়াজ , ভাত চেবানোর আওয়াজ আর সিলিং ফ্যানের আওয়াজ ছাড়া ঘরে আর কোন শব্দের অস্তিত্ব নেই । গোল ডাইনিং টেবিলের তিন দিকে তিন জন বসে রাতের খাবার খেয়ে নিচ্ছিল । ঘরটা ছিল শান্ত নিরব কোলাহলপূর্ণ । দিব্যাই প্রথম নিরবতা ভাঙলো , “ তোমরা দুজনেই ইন্ট্রোভার্ট চরিত্রের । কেউই প্রয়োজন ছাড়া কথা বলো না । তোমাদের জমবে ভালো । „

নতুন জামাইয়ের সামনে মেয়ের কথায় লজ্জা পেয়ে বিদ্যা বিক্রমকে বললো , “ তোমাকে আর এক পিস দেবো ? „

“ না না আমি নিয়ে নেব । এমনিতেও আমার হয়ে গেছে । „

“ এমা ! তুমি তো কিছুই খেলে না । „ বিদ্যা বললো , “ তুমি এই প্রথম আমাদের বাড়িতে এলে কিন্তু আমি মাছ ছাড়া কিছু করতে পারিনি ....

বিদ্যার কথা শেষ হওয়ার আগেই বিক্রম বললো , “ এটাই আমার কাছে রাজভোগের সামিল । আমি অল্পই খাই। এর বেশি কিছু রান্না করলে আমি খেতে পারতাম না । „

এবার বিদ্যা মেয়েকে বললো , “ কাল থেকে তোর আর ডিউটিতে যেতে হবে না । বাড়িতেই থাকবি । কোন খাটাখাটনি করবি না । „

“ উফ্ এক কথা কতবার বলবে তুমি ! আমি মেটার্নিটি লিভ নিয়ে নিয়েছি । কাল থেকে যেতে হবে না । „

এরপর আর কেউ কথা বললো না । খাওয়া হয়ে গেলে সবার এঁটো কাঁটা বিদ্যা নিজের এঁটো থালায় জড়ো করলো । তারপর থালাটা নিয়ে এসে বাইরে উঠোনে এসে দুইবার মিনি মিনি বলে ডাকতেই যেন হাওয়ার ভিতরে থেকেই একটা সাদা কালো মিনি বেড়াল দেওয়ালের উপর এসে দাঁড়ালো। তারপর বিক্রমের গাড়ির ছাদে লাফ কেটে একেবারে বিদ্যার পায়ের কাছে এসে ম্যাও ম্যাও করে ডাকতে লাগলো । বিদ্যার সাইকেলের পাশে একটা প্লাস্টিকের ছোট থালা মত রাখা ছে । সেটাতেই এঁটো কাঁটা গুলো দিয়ে দিল । আর মিনি সেগুলো খেতে লাগলো ।

মিনিকে মাছের কাঁটা এবং এঁটো গুলো দেওয়া হয়ে গেলে বিদ্যা রান্নাঘরে এসে দেখলো বিক্রম ডাইনিং টেবিল থেকে এঁটো বাসন নিয়ে বেসিনে রাখছে বিদ্যা বললো , “ তুমি করছো কেন ? আমি করে নেব । „

বিক্রম হেসে বললো , “ আমার অভ্যাস আছে । আমিই বাড়িতে করি এসব । „

কথাটার মধ্যে যেন বিদ্যা নিজের ব্যর্থতার একটা ঝলক দেখতে পেল । বিদ্যা ভাবলো দিব্যা লিভিংয়ে থাকাকালীন সমস্ত কাজ বিক্রমকে দিয়ে করিয়েছে । হ্যাঁ এ ছাড়া আর কোন অপশন নেই । কারন দিব্যা রান্না করতে পারেনা , ঘর মোছা , ঝাঁট দেওয়া , কাপড় কাচা কিছুই করতে পারেনা । এটাই বিদ্যার ব্যার্থতা । সে তার মেয়েকে সাংসারিক জীবনের নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজ গুলো শেখাতে পারেনি ।

বিদ্যা আর কিছু বললো না । বিক্রমকে বাসন মাজতে দিল । এতদিন যে প্রশ্ন গুলো সে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছিল নিজের লজ্জার মাথা খেয়ে বিদ্যা সেই প্রশ্নগুলোর একটা করেই ফেললো , “ এত তাড়াতাড়ি সন্তান নিয়ে নিলে ! „

বিক্রম কিছু মুহূর্ত নিরব থেকে বললো , “ যেদিন দিব্যা এসে বললো আমি বাবা হতে চলেছি সেদিন কতোটা খুশি হয়েছিলাম আমি বলে বোঝাতে পারবো না । হয়তো ওই মুহূর্তটা আমার জীবনের সেরা মুহূর্ত ছিল । „ তারপর আরো কিছুক্ষন চুপ থেকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো , “ আমি অনাথ আশ্রমে মানুষ হয়েছি । আমি জানি না আমার বাবা মায়ের নাম কি । তাদের দেখতে কেমন । তারা আদেও বেঁচে আছে কি না , আদেও আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ আছে কি না আমি জানি না । তাই দিব্যা যখন বললো আমি বাবা হতে চলেছি তখন ভাবলাম ফাইনালি আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ একজন আসছে । „

বিক্রমের কথা শুনতে শুনতে বিদ্যার চোখে জল চলে এসেছিল । সে যে প্রশ্নটি করেছিল সেটার উত্তর এটা নয় । কিন্তু দিব্যার অন্তঃস্বত্তা হওয়ার কথাটা বিক্রমের কাছে কতোটা মূল্যবান তা তার কথাতেই বোঝা যাচ্ছে ।

বিক্রম থালা বাসন মেজে এক পাশে রাখছে আর বিদ্যা তার পাশে দাঁড়িয়ে ধোয়া থালা বাসন বাটি তুলে রাখছে । বিক্রম পড়ে আছে একটা হাফ হাতা গেঞ্জি। বিক্রমের শক্ত শরীরের বলিষ্ঠ কাঁধ থেকে দুই বাহু শক্ত পেশী নিয়ে গেঞ্জি থেকে বেরিয়ে আছে । বিদ্যার মনে হলো যেন কোন গম্বুজ দাড়িয়ে আছে তার পাশে । সেই গম্বুজের বাইরেটা যতো শক্ত এবং কঠিন তার ভিতরটা ততোটাই কোমল , নরম এবং আন্তরিকতায় ভরা । এমন পুরুষই তো সকল নারী জাতির আকাঙ্ক্ষা। তার মেয়ে একজন পুরুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে পেরেছে এটা ভেবে বিদ্যার মাতৃ হৃদয়গর্বে ভরে উঠলো ।

এতদিন সে যে একটা অমূলক ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করছিল সেটা সে বুঝতে পারলো । এবং তার জন্য কিছুটা লজ্জাও পেল । কিছুক্ষন পর বিদ্যা মাথা নিচু করে আর একটা প্রশ্ন করলো , “ বিয়ে কবে করবে সেটা ভেবেছো ? „

দিব্যার সাথে বিদ্যার সম্পর্ককে সুস্থ স্বাভাবিক সম্পর্ক বলা যায়না । এক মধ্যবিত্ত ঘরের মা মেয়ের সম্পর্ক যতোটা দৃঢ় ও অটুট বন্ধনের হয় তা বিদ্যা আর দিব্যার মধ্যে নেই । তাই যে প্রশ্ন গুলো দিব্যাকে জিজ্ঞাসা করার কথা সেগুলো জামাইকে জিজ্ঞাসা করতে হচ্ছে। দিব্যা কে জিজ্ঞাসা করলে সে এড়িয়ে যেত কিংবা সোজা মুখে উত্তর দিত না । তাই প্রশ্ন গুলো বিক্রমকে জিজ্ঞাসা করা যতোটা সহজ ততোটা দিব্যার কাছে নয় । তাই বিদ্যা বাধ্য হয়ে নিজের মাথা খেয়ে এই সদ্য পরিচিত যুবককেই প্রশ্ন গুলো করতে হচ্ছে ।

“ হ্যাঁ এই নিয়ে আপনার মেয়ের সাথে কথা হয়েছে । ও বললো বেবি আসুক তারপর বিয়ে করবো । „ তারপর হেসে বললো , “ যখন আমাদের বেবি বড় হয়ে দেখবে তার বাবা মায়ের বিয়ের ফটোতে সেও আছে তখন আর সে বলবে না তোমাদের বিয়েতে আমাকে নিয়ে যাওনি কেন ? „

কথাটা শুনে বিদ্যাও মুচকি হেসে ফেললো । হ্যাঁ এটা হয় । সন্তান কয়েক বছর বড় হলে সে বাবা মায়ের বিয়ের অ্যালবাম দেখে জিজ্ঞেস করে --- তোমাদের বিয়েতে আমাকে নিয়ে যাওনি কেন তোমরা ? বলে কেঁদেকেটে বাড়ি মাথায় তোলে ।

বাসন মাজা হয়ে গেলে বিক্রম নিজের ঘরে চলে এলো । এসে দেখলো দিব্যা ফোনে কারোর সাথে কথা বলছে । বিছানায় শুয়ে বিক্রম দিব্যাকে জিজ্ঞেস করলো , “ বাইরে একটা সাইকেল দেখলাম ওটা কার ? „

“ ওটা আমারই ছিল । আমি ওটা চড়ে কলেজে যেতাম। এখন মা ব্যাবহার করে । „

বিক্রম জিজ্ঞাসা করলো , “ কি জন্য ? „

“ মূলত বাজার করতে যায় , মাঝে মাঝে ব্যাঙ্কেও যায় ....

বিক্রম দিব্যার কথা শেষ হওয়ার আগে জিজ্ঞেস করলো , “ এখানে বাজার কোথায় ? „

“ ওই যে আসার সময় একটা চার মাথার মোড় পড়লো না ! মাঝখানে ছোট বিবেকানন্দের মূর্তি আছে । ওখানেই বাজারটা বসে । „

“ ও । „

“ কেন জিজ্ঞেস করছো ? „

“ কালকে বাজার করবো তাই । „

দিব্যা আর কিছু জিজ্ঞাসা করলো না । কিছুক্ষন পরেই সে ঘুমিয়ে পড়লো । থালা বাসন মেজে সমস্ত লাইট বন্ধ করে দরজায় তালা দিয়ে নিজের ঘরে উঠে এসেছিল বিদ্যা । বাসন মাজায় বিক্রম সাহায্য করায় অন্যান্য দিনের থেকে আজকে একটু তাড়াতাড়ি ঘুমাতে চলে এলো সে । বিছানা ভালো ভাবে ঝেড়ে তাতে বসে ভাবলো নাইটি পড়বে কি না । না থাক বলে বিছানায় কোমল শরীরটা এলিয়ে দিল । মাথার ধারে টেবিল থেকে স্বামীর ফটোটা নিয়ে সে বললো তোমার মেয়ে ভালো ছেলেকে বেছে নিয়েছে । খুব সুখে থাকবে ও । দিব্যা মানিয়ে চলবে কিনা জানি না কিন্তু তোমার জামাই ঠিক মানিয়ে নেবে । ছেলেটা খুব ভালো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফটোটা আবার টেবিলে রেখে দিল । বাকি কথা আর সে বললো না । এটা বললো না যে এই ছেলেটাই তাকে এগারো বার বছর আগে গোলাপ দিয়েছিল । এমনকি ছেলেটাকে মনে মনে সে পছন্দও করতো এটাও আর বললো না । লুকিয়ে গেল নিজের স্বামীর থেকে । মশারি টাঙিয়ে লাইট নিভিয়ে সে শুয়ে পড়লো । অনেক দিন পর খুব ভালো ঘুম হলো বিদ্যার ।

বিক্রমের কাকভোরে ওঠার অভ্যাস। এখানেও সেটা বজায় রইলো । উঠলো ছটা বাজার কিছু আগে । দিব্যাকে না জাগিয়ে কোনরকম সাড়াশব্দ না করে বিক্রম ঘর থেকে বেরিয়ে এলো । হাতে তার ব্রাশ আর কোলগেট । বাড়ির ভিতরের বাথরুমে ঢুকে ব্রাশ করে বেরিয়ে এলো । রান্নাঘরে ঢুকে এক বোতল জল খেয়ে বেরিয়ে এলো । দেওয়ালের পেরেকে টাঙানো ঘরের চাবি দিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো । বিদ্যার লেডিস সাইকেলটা নিয়ে মেন গেট খুলে বেরিয়ে গেল বাজার করতে ।

সকালে ঘুম থেকে উঠে বিদ্যা নিজেকে নতুন রূপে আবিষ্কার করলো । এতদিন যে কথাটা তাকে ভাবাইনি সেই কথাটাই তাকে নতুন ভাবে বাঁচার রসদ দিল । কয়েক মাস পর তার নাতি কিংবা নাতনী হবে । আবার তার ঘরে এক শিশুর কান্না , খিলখিল হাসির আওয়াজ শোনা যাবে । এই সুখানুভুতিটাই সে এতদিন উপলব্ধি করতে পারেনি । রাতে ঘুমের সময় কেউ যেন তার নিভু নিভু প্রাণপ্রদীপে নতুন করে বাঁচার জন্য এই উপলব্ধির তেল দিয়ে দিয়েছে । মন হাল্কা তাই আজকে তার খুব গান গাইতে ইচ্ছে করছে । যেমন ভাবা তেমন কাজ । সে খাট থেকে নেমে মশারি গুটিয়ে গুছিয়ে রাখলো । নিচে নেমে ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে আবার উপরে উঠে এলো । খাটের নিচ থেকে টেনে হারমোনিয়াম বার করে তার ধুলা ঝেড়ে নিল । তারপর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা গান গাইতে শুরু করলো ।

বাজার করে ফিরতে ফিরতে প্রায় সাড়ে সাতটা বেজে গেল । মেইন গেট খুলে বাড়ির উঠোনে ঢুকতেই একটা মধুর সুরেলা কন্ঠের গান শুনে বিক্রম থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো । এই স্বর আশপাশের পরিবেশকে হাল্কা করে দিয়েছে । এই কন্ঠ বাতাসে এক মাদকতার সৃষ্টি করছে । বিক্রম উঠোনে দাঁড়িয়ে ভালো ভাবে শুনলো গানটা আসছে ছাদের ঘর থেকে ।  

খোলো দ্বার বধুয়া রয়েছে সে দাঁড়ায়ে
দেখ পরান উছলি যায় রয়েছে সে দাঁড়ায়ে

খোলো দ্বার বধুয়া রয়েছে সে দাঁড়ায়ে

আজ দখিন হাওয়ার সাথে সে হৃদয়ে নাচিয়া যায়
আজ বধুয়া রাখি পাতে কোন‌ স্বপন এলো হায়

খোলো দ্বার বধুয়া রয়েছে সে দাঁড়ায়ে

পিহু পিহু পিহু কাহার বলে যায়
ঐ মনেরই বাঁধনে, অনেক যতনে
রেখেছি ধরিয়া তারে

স্বপন ঘোরে ছুঁইয়া মোরে
বাঁধিবে মায়ারও ডোরে

খোলো দ্বার বধুয়া রয়েছে সে দাঁড়ায়ে
দেখ পরান উছলি যায় রয়েছে সে দাঁড়ায়ে

গান শুনতে শুনতে বিক্রম বিভোর হয়ে গেছিল ।  হ্যাঁ এই সেই গলা যা এগারো বছর আগে সে শুনেছিল । তারপরেই তো বিদ্যাকে নিজের The woman বানিয়ে ছিল সে । সেই কন্ঠের গান শুনে এগারো বছর আগের স্মৃতি আবার তরতাজা হয়ে জেগে উঠলো । চোখের সামনে যেন সেই পুরানো ঘটনা গুলো দেখতে পেল ।

শোভাবাজার রাজবাড়ীর রাস্তা ধরে রাজবাড়ী ছাড়িয়ে আরো কিছুটা যাওয়ার পর একটা পুরানো বড় সাবেকি আমলের দুতলা বাড়ি পড়ে । মাঝখানে উঠোন ফাঁকা রেখে চারিদিকে বর্গাকারে বাড়ি । উপর নীচ মিলিয়ে প্রায় কুড়িটা ঘর আছে এই বাড়িতে । এটাই সেই অনাথ আশ্রম যেখানে বিক্রম জ্ঞান হওয়া ইস্তক আছে । এই অনাথালয়ের নাম “ কুড়িয়ে পাওয়া রত্ন । „  বাড়িটা বড় হলেও প্রায় পঁয়ত্রিশ জন অনাথ আর ছয় জন সদস্য থাকে যারা এই অনাথদের দেখাশোনা করে ।

সিনেমার চরিত্র গুলোর যেমন অনাথকে আপন করে নেওয়ার একটা গুন দেখতে পাওয়া যায় বাস্তব চরিত্র গুলো কিন্তু ঠিক তার উল্টো । দিদি কিংবা দাদার সন্তানদের আপন করে নেওয়ার দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি থাকলেও পর কে আপন করে নেওয়ার ঘটনা সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না । তাই এই আবাসিকের বাচ্চারাও কচি থেকে কিশোর হয়ে যায় কিন্তু ঘর পায় না । কালেভদ্রে এক আধ জন আসে , এসে দেখে চলে যায় । বেশিরভাগ খালি হাতে গেলেও এক দুই জন কোন অনাথকে আপন করে নেয় । তখন সেই অনাথের উপর বাকিদের খুব হিংসে হয় ।

তাদের মধ্যেই একজন বিক্রম । বিক্রমের বয়সি আরো চার জন আছে । এরা সবাই পাশের এক সরকারি কলেজে একসাথে পড়ে । প্রতি বছরেই সরস্বতী পূজায় একটা বড় করে অনুষ্ঠান হয় । বিক্রম তখন উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে বসে আছে । তার বয়স সতেরো হতে আর দুই মাস বাকি । সেই অনুষ্ঠানেই এলো বিদ্যা গান গাইতে । আর মায়ের সাথে এলো নয় দশ বছরের দিব্যা ।

বিক্রমের কোন আগ্রহ নেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে । কিন্তু আবাসিকের নিয়ম সবাইকে থাকতেই হবে । তাই সে আছে । প্রথম প্রথম সে খেয়াল করেনি কিন্তু চারিদিকে দৃষ্টি ফেলতে সে দেখলো সামনের দিকে মাসির পাশেই এক মহিলা বসে আছে । লাল পাড় সাদা শাড়ি , টগর ফুলের মালা খোঁপায় বাঁধা । সৌন্দর্যের এমন নিদর্শন সে আগে কখনো দেখেনি। তাই তার মুখ দিয়ে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এলো , “ এটা কে ? „

প্রশ্নটা তার পাশে বসে থাকা সৈকত আর ভূপেন শুনতে পেল । তারা জিজ্ঞেস করলো , “ কার কথা বলছিস ? „

“ ওই যে লাল পাড় সাদা শাড়ি , মাসির পাশে বসে আছে । „

“ ও । আমাদের মনীষা ম্যামের বান্ধবী । ম্যাম এনেছে গান গাওয়ার জন্য । „ তারপর সৈকত ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো , “ কেন পছন্দ হয়েছে নাকি তোর । „

বিক্রম কিছু বললো না বটে কিন্তু সে ড্যাবড্যাব করে মহিলার দিকে তাকিয়েই রইলো । বিদ্যা কিছুক্ষন পরেই বিক্রমের দৃষ্টি দেখতে পেল । ছেলেটা একভাবে তার দিকেই তাকিয়ে আছে ।

কিছুক্ষন পরেই বিদ্যা মঞ্চে উঠে গান গাইতে শুরু করলো । বিদ্যা গান গাওয়ার সময় বিক্রমের দুই পাশেই বসে ছিল ভূপেন আর সৈকত । তারা কনুই দিয়ে বিক্রম কে খুঁচিয়ে বললো , “ যদি পছন্দ হয় তাহলে বলে ফেল । হ্যাঁ বলে ফেল । পেটে কথা চেপে রাখতে নেই । „

বিক্রম লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো । সেটা দেখে সৈকত আর ভূপেন নিজেদের মধ্যে চোখাচুখি করলো । তারপর বললো , “ যাকে পছন্দ হয় তাকে কি দিতে হয় জানিস ? „

“ কি ? „

“ আরে পাগলা এটাও জানিস না । গোলাপ ফুলরে গোলাপ ফুল । একটা গোলাপ ফুল দিয়ে দে । „

“ গোলাপ ফুল আমি কোথায় পাবো ? „

“ কেন , মোড়ের মাথায় একজন বসে দেখিস নি তুই ? ওখান থেকেই নিয়ে আয় । „

বিক্রম সত্যি সত্যি উঠে চলে যেতে দুজনে অট্টহাসি হেসে উঠলো । বিক্রম আবাসিক থেকে বেরিয়ে মোড়ের মাথায় এলো । একটা ল্যাম্পপোষ্টের তলায় ফুল বিক্রেতা কে দেখতেও পেল । তার সামনে গিয়ে বিক্রম জিজ্ঞেস করলো , “ গোলাপ আছে ? „

“ হ্যাঁ আছে । কটা নেবে ? „

“ একটাই নেব । „

“ তিন টাকা দাও । „

বিক্রম পকেট থেকে একটা পাঁচ টাকার কয়েন বাড়িয়ে দিল । আবাসিকের কারোর কাছেই টাকা থাকার কথা নয় । জামা কাপড় , বই খাতা , থাকা খাওয়া সবই আবাসিক থেকে দেওয়া হয় । তবুও বাচ্চাদের মাঝে মাঝে বাইরের খাবার খেতে ইচ্ছে করে তাই আবাসিকের প্রধান প্রতিভা দেবী আবাসিকের রান্নার মাসির কাছে টাকা দিয়ে রাখেন । কারোর কিছু খেতে ইচ্ছে হলে সে মাসির কাছে থেকে চেয়ে নেয় । পরে সেটা হিসাব করা হয় । অবশ্য কাউকেই পাঁচ দশ টাকার বেশি দেওয়ার নিয়ম নেই । প্রতিভা সমাদ্দার বাইরে খুব গম্ভীর প্রকৃতির আচরণ করলেও ভিতরে তিনিও একজন মা ।

দু টাকা আর একটা গোলাপ নিয়ে সে ফিরে এলো । গোলাপ ফুল তো কিনলো কিন্তু দেওয়ার সাহস তার হলো না ।

বিদ্যা কোন বড় গায়িকা নয় । মণীষা তাকে রিকোয়েস্ট করায় সে এসেছে । তাই মনীষার দায়িত্ব তাকে ছেড়ে আসার । তাই একরকম বিদ্যা বেরিয়ে আসার সময় দিব্যা আর মণীষা ছাড়া কেউই নেই । যখন বিদ্যা একাবারে গেটের কাছে পৌঁছে গেছে তখন বিক্রম বিদ্যার পিছনে গিয়ে বললো , “ এটা আপনার জন্য । „

বিদ্যা পিছন ঘুরতে বিক্রম তার ডান হাতে ধরা গোলাপ ফুলটা এগিয়ে দিয়ে মিষ্টি গলায় বললো , “ এটা আপনার জন্য । „

বিদ্যা ছেলেটাকে চিনতে পারলো । এই ছেলেটাই তাকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে দেখছিল । সে গোলাপ ফুলটা নিয়ে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করলো , “ তোমার নাম কি ? „ গোলাপ ফুলটা নেওয়ার সময় বিদ্যার হাত স্থির থাকলেও তার মন মৃদু মন্দ কেঁপে কেঁপে উঠছিল । কারন বিক্রমের চোখে সে ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছে । হ্যাঁ ঠিক এইভাবেই একদিন দিব্যার বাবা তাকে গোলাপ ফুল দিয়েছিল । সেই দিনও সে গান গেয়েছিল আর মুগ্ধ হয়েছিল সবাই । আর যখন দিব্যার বাবা তাকে গোলাপ দিয়েছিল তখন দিব্যার বাবার চোখও ঠিক এই ছেলেটার মত জ্বলজ্বল করছিল ।

তখন ট্যাক্সির ভিতরে বসে থাকা মণীষা গলায় তীব্র ব্যাস্ততা ফুটিয়ে তুলে বললো , “ এই বিদ্যা ! চল এবার , না হলে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যাবে তো ! „

বিদ্যা তার বান্ধবীর দিকে ফিরে , “ আসছি „ বললো । বিদ্যার ‘ আসছি , বলার সাথে সাথে বিক্রম তার নামটা বললো , “ আমার নাম বিক্রম রায় । „

নামটা শুনে বিদ্যার মৃদু মন্দ কেঁপে ওঠা মনে ঝড় বইতে শুরু করলো। বিদ্যা কিছু না বলে মেয়েকে নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে পড়লো । হাতে তার গোলাপ ফুলটা সযত্নে ধরা ।

বিদ্যার গান শেষ হতেই বিক্রমেরও স্মৃতিমন্থন শেষ হলো । সে বর্তমানে ফিরে এলো । বর্তমানে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত হলেও এই গান তার পুরানো স্মৃতিকে তরতাজা করে তুললো । তার সাথে জেগে উঠলো অধিকার । পুরানো অধিকার যা সে বিদ্যা কে গোলাপ ফুল দিয়ে অর্জন করেছিল । সাইকেলটা রেখে , তার থেকে বাজারের ব্যাগ বার করে ঘরে ঢুকতেই দেখলো দিব্যা হাই তুলতে তুলতে ঘর থেকে বার হচ্ছে। বিক্রম কে দেখে সে বললো , “ মা গান গাইছে । বহুদিন মা গান গায় না । আজ হঠাৎ গাইছে কেন বুঝতে পারছি না...

“ হয়তো তুমি ফিরে এসছো সেই খুশিতে গান গাইছে । „

দিব্যা কোন কথা না বলে গত কালকে আনা ব্যাগ থেকে ব্রাশ আর কোলগেট বার করে বাথরুমে চলে গেল । বিক্রম বাজারের থলিটা রান্নাঘরে রেখে এসে লিভিংরুমের সোফায় এসে বসলো ।

সোফায় বসতেই বিদ্যা সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এলো । কিন্তু এ কে ? কাকে দেখছে বিক্রম ? কাল যে মহিলাকে সে দেখেছে আর এখন যাকে দেখছে তারা যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই নারী । এক রাতেই বিদ্যার চোখের নিচে কালো ছাপ মুছে গেছে । মুখে ক্লান্তির ছাপ নেই । এক রাতেই যেন তার মুখের হারিয়ে যাওয়া জেল্লা ফিরে এসেছে । আর শরীরে যৌবনের ঢেউ খেলেছে । সুডোল পাছা জোড়া , বেঁকে যাওয়া কোমর , মানানসই দুটো নিটোল স্তন , সরু পেলব রসালো ঠোঁট সবই যেন আগের থেকে বেশি যৌবন বহন করছে ।

সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতেই বিদ্যা বিক্রমকে দেখতে পেল । দেখে বিক্রমের উদ্দেশ্যে বললো , “ আমি ঘর ছাট দিয়ে এক্ষুনি চা করছি  । আজ একটু গান গাইতে ইচ্ছে হলো ...

বিক্রম নিজের চোখকে এমনকি নিজেকেও বিশ্বাস করতে পারলো না । সে তো এমন ছিলনা । সে তো কখনোই কোন মেয়ের শরীরের দিকে তাকাতো না । তাহলে আজ হঠাৎ বিদ্যার নারী শরীরের সৌন্দর্য কেন দেখলো ? বিক্রম নিজের এহেন আচরণে স্তম্ভিত হয়ে পড়লো । কিন্তু বিদ্যার করার প্রদুত্তরে কিছু বলতে হয় । তাই সে বললো “ না না ঠিক আছে । আমি শুনছিলাম আপনার গান । খুব ভালো গলা আপনার ...

বিদ্যা বিক্রমের প্রশংসার কোন জবাব না দিয়ে বিদ্যা দরজার কোনায় রাখা ঝাঁটা হাতে নিয়ে উপরে চলে গেল । নিজের ঘর ঝাঁট দিয়ে সিড়ি ঝাট দিতে দিতে সে নিচে নেমে এলো ।

সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠার পর ছেলেদের মনের কামনা একটু বেড়ে যায় । আর সেই কামনা তাদের লিঙ্গের আকার বেড়ে যাওয়া দেখে বোঝা যায় । এখন নিজের জীবনের প্রথম ভালোবাসাকে দেখতে পেয়ে বিক্রমের বুকের কামনা আরো হাজারগুণ বেড়ে গেল । এখন সেই কামনার কারনেই হোক কিংবা পুরানো অধিকারের কারনেই হোক বিক্রমের চোখ বিদ্যার শরীরের আনাচে কানাচে ঘুরতে লাগলো ।

বিক্রম সোফায় বসে বসেই গুরু নিতম্বিনী বিদ্যার পাছার দুলুনি দেখতে পেল । সাধারণত বাঙালি মেয়েদের পাছায় উচ্চতা থাকে না । কিন্তু কয়েকজন ব্যাতিক্রমি হয় । বিদ্যা তাদের মধ্যে একজন । শরীরের সাথে মানানসই পাছা জোড়া তার শারিরীক সৌন্দর্য কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে । না চাইতেও শাড়ি ব্লাউজের উপর দিয়েই বিদ্যার শরীরের খুঁটিনাটি দেখে নিয়ে বিক্রম চোখ নামিয়ে নিল । এবং নিজের এরুপ আচরণে বিস্মিত হলো ।

কিছুক্ষনের মধ্যেই সকালের জলখাবার খেয়ে নিল । বিদ্যা দোকান খোলার আগে দোকানের সামনের রাস্তায় জল ছিটিয়ে একটু ঝাঁট দিয়ে নেয় । বিদ্যা উঠোনের কলঘর থেকে ছোট জল ভর্তি বালতি নিয়ে বার হতেই বিক্রম বললো , “ আমাকে দিন । „

“ আমি পারবো । „

“ আমাকে দিন না । „ বলে বিদ্যার বাঁধা একরকম অগ্রাহ্য করেই বিদ্যার হাত থেকে বালতি নিয়ে বললো , “ রাস্তায় দেবেন ? „

“ হ্যাঁ । „

বিক্রম দোকানের সামনের অংশটুকু জল ছিটিয়ে দিলে বিদ্যা ঝাঁট দিতে শুরু করলো । বিদ্যার ঝাঁট দেওয়া হয়ে গেলে বিক্রম দোকানের শাটারের তালা খুলে শাটার তুলে দিল । বিদ্যা দোকানে ঢুকলে বিক্রম দোকানের ভিতরটা দেখতে লাগলো । দোকানের তিন দিকেই ছোট বড় কাঠের তৈরী শাড়ির তাক । তারমধ্যে আছে অজস্র লাল সবুজ হলুদ গোলাপী নিল কমলা ডোরাকাটা বিভিন্ন রঙের শাড়ি । না , শুধু শাড়ি নয় । প্রথম দেখায় সব শাড়ি মনে হতে পারে কিন্তু এর মধ্যে শাড়ি বাদেও আছে গামছা , তোয়ালে , মশারি , বিছানার চাদর । আর মেঝেতে আছে একটা বড় খাট । খাটটা মেঝে থেকে আট নয় ইঞ্চি উঁচু। খাটে একটা সাদা চাদর বেছানো। বোঝাই যাচ্ছে এই খাটে কাস্টমারদের শাড়ি খুলে দেখানো হয় । প্রায় সব শাড়ি বা জামা কাপড়ের দোকানেই বিক্রম এরকম খাট থাকতে দেখেছে । আর আছে একটা সেকেলের সেলাই মেশিন আর তাতে বসে কাজ করার জন্য একটা উঁচু টুল । মেশিনের পাশে চোখ পড়তে বিক্রম দেখলো সেখানে দুটো কার্ড বোর্ডের বাক্সে সুতোর গুলি ভর্তি । আর ঠিক তার পাশেই আছে থাক থাক কাপড় । নানা রঙের কাপড় । মনে হয় এই কাপড় গুলো দিয়েই ব্লাউজ বানানোর কাজ হয় ।

বিদ্যা দোকানে ঢুকে একটা তাক থেকে পছন্দ মত ব্লাউজের কাপড় বার করতে লাগলো । আর বিক্রম বসলো খাটের উপর । বসতে না বসতেই এক মধ্য বয়স্ক লোক এসে দোকানের সামনে দাঁড়ালো । দাঁড়ালো না বলে থমকে দাঁড়ালোই বলা ভালো । লোকটার দৃষ্টি দোকানের খাটের উপর বসে থাকা বিক্রমের দিকে । একটা অচেনা অজানা লোককে এইভাবে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিক্রম বেশ বিরক্ত হলো । বিক্রম ভালো ভাবে দেখলো লোকটাকে । একটা ফুল প্যান্ট , আর সাদার উপর ঘীয়ে রঙের ডোরাকাটা হাফ হাতা জামা । জামা প্যান্ট দুটোই হাতে বানানো । পায়ে কালো চামড়ার জুতো । লোকটার বয়স আনুমানিক চল্লিশের উপরেই হবে । মাথার চুল ডান দিকে সিঁথে কাটা আর নাকের নিচে একটা হুশুড় মুশুড়ের মত গোঁফ।

লোকটার ভুরু কুঁচকে থাকা চোখের চাহনি দেখে বিক্রম বুঝলো যে লোকটা বলতে চাইছে তুমি কে হে ছোকরা আগে তো এখানে দেখিনি । আর এখানে কিই বা করছো তুমি ?

লোকটার চাহনিতে বিরক্ত প্রকাশ না করে বিক্রম জিজ্ঞেস করলো , “ কিছু বলবেন ? „

বিক্রমের প্রশ্নে লোকটার কিছু বলার আগে বিদ্যা পিছন ঘুরে লোকটাকে দেখলো তারপর হাঁসি মুখে বললো , “ বাইরে দাঁড়িয়ে কেন , ভিতরে আসুন । „

লোকটা বিক্রমের দিকে দৃষ্টি রেখেই ভিতরে ঢুকে কাঠের টুলটায় বসলো । বিদ্যা লোকটার দৃষ্টি বুঝতে পেরে বললো , “ এ হলো আমার জামাই । কালকেই এসেছে । সন্ধ্যাবেলায় । „

এবার লোকটা যেমন মুখ করলো সেটার সাথে কিছুক্ষন আগের চাহনি মিল খায়না । লোকটা হে হে করে হেসে বললো , “ তুমিই আমাদের দিব্যার বর । আরে আগে বলবে তো ! আমি খামোখাই ভাবছিলাম কে না কে বসে আছে । „ তারপর মাথা দুই দিকে নাড়িয়ে বললো , “ এ হে আমারই বোঝা উচিত ছিল ! „

বিক্রম লোকটার এইরকম কথায় কি উত্তর দেবে বুঝতে পারলো না । তাই সে শুধু নমস্কার জানিয়ে নিজের নামটা বললো , “ আমার নাম বিক্রম । „

“ নাম তো আগেই শুনেছিলাম তোমার । চাক্ষুস এই প্রথম দেখছি । সবাই বৌ দেখতে যায় আর আজ আমার জামাই দেখা হলো । „ বলে হে হে করে হেসে উঠলো তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে বললো , “ আমার নামটাই তো বলা হলো না । আমার নাম তীর্থঙ্কর দেবনাথ । সম্পর্কে আমি তোমার খুড়শশুড় হই । ও হে এটা তিলোত্তমার বিয়ের কার্ড । তোমাদের সপরিবারে নেমতন্ন রইলো । „

এতক্ষণ পর বিদ্যা হাসিমাখা মুখে জিজ্ঞেস করলো , “ কবে ঠিক হলো ? „

“ এই তো অগ্রহায়ণ মাসের শেষের দিকে । পনেরোই ডিসেম্বর পড়ছে । আসতে হবে কিন্তু সকলকে । „

“ অবশ্যই আসবো । চা খাবেন ?  „

“ হ্যাঁ হলে মন্দ হয় না । „

বিদ্যা চা বানানোর জন্য উঠে চলে যেতেই তীর্থঙ্কর একটু কেশে নিয়ে মুখে কৃত্রিম গাম্ভীর্য ধারন করে বললো , “ তোমাকে আপন ভেবেই বলছি । তুমি বিয়ে করেছো তুমি বুঝবে । ঘরে বউ না থাকলে ঘরকে ঘর মনে হয় না । আমার স্ত্রী তিন মাস আগে মারা গেছে । „ কয়েক সেকেন্ড বিরতি নিয়ে আবার বললো , “ তোমার শাশুড়িকে আমি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি । হ্যাঁ বা না কিছুই বলেনি । তুমি আর দিব্যা একটু বুঝিয়ে বললে ও ঠিক রাজি হবে । বুঝতেই পারছো ঘরে একজন গৃহিণী না থাকলে চলে না । যতোই জয়েন্ট ফ্যামিলি হোক বড্ড একা একা লাগে । „ বলে তীর্থঙ্কর থেমে গেল । আর তীর্থঙ্করের কথা শুনে বিক্রম কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত হতভম্ব হয়ে বসে রইলো । কিছুক্ষন পরেই বিদ্যা চা নিয়ে এলো । তীর্থঙ্কর সেটা খেয়ে উঠতে উঠতে বললো , “ আমার দোকানে এসো একদিন । আমার কলেজ স্ট্রিটে একটা বইয়ের দোকান আছে । ভালো ডিসকাউন্ট দেব । „

“ হ্যাঁ আসবো । „

বিদ্যা একটা ছোট পেয়ালাতে তে চা আর মেরি বিস্কুট আনলো । তির্থঙ্কর সেটা নিয়ে খেতে শুরু করলো । এক চুমুক চা খেয়ে তীর্থঙ্কর বললো , “ মনীষার খুব আগ্রহ ছিল এই বিয়েতে । শখ করে কয়েকটা শাড়িও কিনেছিল পড়বে বলে । কিন্তু দেখে যেতে পারলো না । শাড়ি গুলোও আলমারিতে পড়ে আছে । সবই কপাল । „

এর উত্তরে বিদ্যা কিংবা বিক্রম কেউই কিছু বললো না । কিন্তু বিক্রম বুঝতে পারলো যে এই লোকটার স্ত্রী মণীষাই হলো তাদের আবাসিকের মণীষা ম্যাম । বিক্রমের মনটা কিছুটা হলেও খারাপ হয়ে গেল । সেই মণীষা ম্যামের খবর সে এতদিন পর পেল তার তার মৃত্যুর পর । চা খেয়ে মেঝেতে পেয়ালা রেখে তীর্থঙ্কর বললো দিব্যা মার সাথে একটু দেখা করে আসছি । „

বিদ্যা বললো , “ ও টিভির সামনে বসে আছে । আপনি যান । „

তীর্থঙ্কর দোকানের পিছনের দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকলো । কিছুক্ষন পর দিব্যার সাথে দেখা করে তীর্থঙ্কর এবার দোকানের পিছনের দরজা দিয়ে না ঢুকে বাড়ির মেন গেট দিয়ে বেরিয়ে আসলো। দোকানের সামনে এসে বিক্রমের উদ্দেশ্যে বললো , “ আমি আসছি বিক্রম । তুমি একবার আমার দোকানে যেও । „ বলে হনহনিয়ে চলে গেল ।

বিক্রম এই লোকটার চরিত্রটা ঠিক বুঝতে পারলো না । কেমন লোক ইনি ? জামাইকে বলছে শাশুড়িকে দ্বিতীয় বিয়ের জন্য রাজি করাতে । আর শেষের ওই দোকানে এসো ডিসকাউন্ট দেব কথাটা এমন ভাবে বললো যেন তুমি তোমার শাশুড়িকে দাও আর ডিসকাউন্টে বই নাও এরকম একটা ডিল করছে ।

বই পড়ার শখ বিক্রমের তেমন নেই । খবরের কাগজ পড়ার শখ আছে কিন্তু সেটাকে বইপোকা বলা যায় না । সব মানুষের বেঁচে থাকার জন্য শরিরের খোরাকের সাথে মনের খোরাকেরও প্রয়োজন। বিক্রমের মনের খোরাক বলতে ছিল একজন কে খোঁজা। আবাসিক থেকে বার হওয়ার পর তার স্মৃতিতে বসবাস করে এমন এক সুন্দরীকে খোঁজাই ছিল তার উদ্দেশ্য ।

বিক্রমের সুখ বর্তমানে নেই । সে বর্তমানে সুখ খুঁজে পায়না । তাই নিজের স্মৃতির মাধ্যমে অতীতের দিনে ডুব দিয়ে সুখ খোঁজে। এটা এখন বদঅভ্যাসে পরিনত হয়েছে সেটা বিক্রমও বুঝতে পারে । কিন্তু কিছুতেই নিজেকে আটকাতে পারেনা । তাই সে চেষ্টা করে সব সময় কোন না কোন কাজ করে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে । কিন্তু এখন তো অঢেল ফাকা সময় । তাই এখনো সে আবাসিক থেকে ছাড়া পাওয়ার পর জীবন সংগ্রামে কিভাবে সংগ্রাম করেছে তারই স্মৃতিতে ডুব দিল । কিভাবে সে এই কলকাতা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ধরনের কাজ করে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে গেছে এবং সেই সংগ্রামে জয়ী হয়েছে সেটাই এখন সে ভাবতে লাগলো ।
[Image: 20220401-214720.png]
[+] 8 users Like Bichitro's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: স্মৃতি সুন্দরী - by Bichitro - 02-09-2023, 09:47 AM



Users browsing this thread: 41 Guest(s)