30-08-2023, 10:18 PM
|| মৃতের কুয়ো ||
ছান ছান! ছান ছান! --- নূপুরের শব্দ। ঘুঘুরুঘুউ!! --- ঘুঘু পাখির সাথে প্যাঁচার পরিত্রাণ কর্কশ চিৎকার --- খেরাও!! জঙ্গলের মধ্যে থেকে ভেসে আসছে এক দল শিয়ালের রাক্ষসী হাঁসি আর সবশেষে এই ভৌতিক পরিবেশকে দেশে দেশে ছড়িয়ে দিতে উড়ে গেলো এক ঝাঁক কাকের দল। তাদের ডানা ঝাপটানোর শব্দে কেঁপে উঠলো সমস্ত অঞ্চল। সেই অঞ্চলেই কুয়াশায় ঘেরা বাংলাদেশের বুক ছিঁড়ে প্রায় দেড়শ বছর ধরে ইতিহাসকে সঙ্গী করে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই রাজবাড়ী। যার ডানা দুটো ছেঁটে গেছে অনেককাল আগেই। ডানা ছাড়া এই রাজবাড়ী আজ বিশাল এক ধ্বংসস্তূপের থেকে কম কিছুই নয়। রাজবাড়ীর প্রায় অংশ ধ্বসে পরেছে মাটির উপর। কত কাল যে পরিক্রম করে গেছে তা ওই ধ্বসে পরা ধ্বংসাবশেষের দিকে নজর দিলেই বোঝা সক্ষম। গাছ শ্যাওলা গজিয়ে আজ হয়তো তার মধ্যে খাঁটি নামক বস্তুটাই উধাও পেয়েছে। আবার নূপুরের শব্দ! নূপুর পরা পায়ে আওয়াজ তুলে গোটা রাজবাড়ী হেঁটে চলেছে হয়তো কোনো মেয়ে। মধ্যরাতে যেখানে দেশের সমস্ত মানুষ গভীর নিদ্রায় মগ্ন সেখানে কোন মেয়ে এতো রাতে এই পরিত্যক্ত বাড়ির মধ্যে হেঁটে চলে বেরোচ্ছে তা অজানা। মেয়েটি বা কোথায়? ওই শব্দ কানে রেখে সঠিক পথে এগিয়ে গিয়ে দৃষ্টি রেখেও চোখে বাঁধল না কিছুই। সবই পরিষ্কার, সবই ঠিকঠাক, তবুও আওয়াজ আসে কোথা থেকে? আকাশে চাঁদ উঠেছে, তার জ্যোৎস্নায় পুরো ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজবাড়ীর প্রতিটি কোণা মায়াবী হয়ে উঠেছে। দেখা গেলো পশ্চিমের গগণ ভেদ করে উড়ে আসছে এক গুচ্ছ মেঘ। হঠাৎ-ই বইতে আরম্ভ করেছে হাওয়া। শোঁশোঁ শব্দে কান পাতা বড় দায়। সেই হাওয়ার আঘাতে গাছপালা দুলছে। তারা দুলে দুলে ফেলে দিচ্ছে আলগা হয়ে আসা পাতা। সেই পাতা উড়ে গিয়ে পড়ছে এক গর্তে। গর্তটি পাথর দিয়ে বাঁধানো। দেখলেই বোঝা যায় এযে গর্ত নয়, রাজার কালে তৈরি একটি কুয়ো। যার ভিতরদিক অনেক গভীর, পড়লে বাঁচার সম্ভবনা একদমই নেই। গর্তের অতল তলে ভাসছে জল, তার উপর গিয়ে পড়ছে পাতাগুলো। শোঁশোঁ শব্দ বাতাসকে সাথে নিয়ে বেগ বাড়িয়েই চলেছে। আকাশে মেঘ এসে কখন যে চাঁদটিকে আড়াল করে দিয়েছে বোঝার জো নেই। আচমকা মেঘের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো বৈদ্যুতিক শরনিক্ষেপ! আর মুহূর্তে বেজে উঠলো কর্ণ বিদীর্ণ করা দামাবা গর্জন! সেই আলোক ছটায় মুহূর্তের জন্য দেখা গেলো, কুয়োর কাছে এসে কে জেনো দাঁড়িয়েছে। তার দৃষ্টি হারিয়ে গেছে ওই কুয়োর গভীরে। গভীরে কিছু একটা আছে, হয়তো আছে ইতিহাস। আছে মেয়েটির ইতিহাস। বেশিক্ষণ যেতে না যেতেই আবার বৈদ্যুতিক শরনিক্ষেপ আর সেই বৈদ্যুতিক আলোয়ে দেখা গেলো মেয়েটি উঠে বসেছে সেই কুয়োর পারের উপর। বসে বসে পা দুলচ্ছে আর মাথা দুলিয়ে সঙ্গীত ধরেছে। সে এক অশরীরী সঙ্গীত যা শুনলে গায়ের লোম নিমেষে খাঁড়া হতে বাধ্য। বাধ্য শরীরের শিরদাঁড়া জমাট বেঁধে যেতে-
‘আয় আয় চাঁদ মামা
টিপ দিয়ে যা
আমার কপালে চাঁদ
টিপ দিয়ে যা...’
গানের শেষে সে এক অশরীরী হাঁসি! ভয়ঙ্কর রূপে পাতাল থেকে অশরীরীরা এসে জেনো সেই গানের তালে নৃত্য করতে চায়। খিলখিলে সেই হাঁসি দেহের রক্ত চলাচলকে নিমেষেই ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়। রক্ত হয়ে ওঠে সলিল। উফ! সেই হাঁসি কানের পর্দায় এসে ধূমধাম ধাক্কা মারে, ভেঙে ছিঁড়ে ফেলতে চায় কানের পর্দা! বুকের হৃৎপিণ্ডকে পাঁজর ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসতে বাধ্য করে। সমস্ত ইন্দ্রিয় স্নায়ুতন্ত্রকে চোখের পলকে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলতে চায়, আঃ!! কি ভয়ঙ্কর! কি ভয়ঙ্কর!!! আবার অখিলের বক্ষস্থলে বৈদ্যুতিক শরনিক্ষেপ আর সেই বৈদ্যুতিক তুচ্ছে যা দেখা যায় তা দেখলে যেকোনো সুস্থ মানব দৌড়ে পালানোই আবশ্যক। নয়তো স্নায়ুর উপর এতোটাই চাপ সৃষ্টি করবে যে তাতে তার চেতনা হারানো নিশ্চিত। ওই মেয়ের কুঞ্চিত কেশ হাওয়ার তালে এতোটাই ভয়ঙ্কর ভাবে উড়ে চলেছে যে তাকে সর্ব বিনাশিনী ছাড়া আর কিছুই লাগছে না। তার খিলখিলে হাঁসিতে তার বড় বড় দুটি দাঁত খুবই প্রখরভাবে নয়নপথগামী হবেই। সেই দাঁতের উপর থেকে বেয়ে বেয়ে পড়ছে রক্তের ধারা। তার চোখদুটো সূর্যের মতন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে রক্তবর্ণ হয়ে। সেই দৃষ্টি যাকে তাকে অন্ধ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। পরমুহূর্তেই আবার এক তীব্র বজ্রপাতের সাথে সাথে দেখা গেলো সেই নারী ঝাঁপ দিয়েছে ওই কুয়োয়। ভেসে আসছে তার খিলখিলে হাঁসি! সঙ্গে সঙ্গে আরম্ভ হল বর্ষণ। ভিজে যেতে থাকলো ভাগ্য, এই দৃশ্য এই রাজবাড়ী। আর ওই নারী? সেই নারী অতো সহজে ভিজবে না। হাজার বছর ধরে পাপের সাঁজার জন্য রয়ে যাবে ওই রাজবাড়ীতে। পাপীর বুক চিঁরে রক্ত পান করে নিজের রক্তপিপাসা সমাপ্তি না করা পর্যন্ত সে অমর! তার ঠাই নেই নরক কি স্বর্গে।