02-09-2023, 11:32 PM
![[Image: Picsart-22-12-06-20-20-08-119.jpg]](https://i.ibb.co/km22qDS/Picsart-22-12-06-20-20-08-119.jpg)
দ্বিতীয় খণ্ড
৩৬তম পর্ব
সুপ্রতিমবাবুর কথা শুনতে শুনতে অভিরূপবাবুর ফর্সা মুখ রাগে লাল হয়ে উঠলো, অভিরূপবাবুকে যারা চেনেন তারাও তার এই রাগী মুখ কখনো দেখেছেন বলে মনে হয় না একটু পরে অভিরূপবাবু গম্ভীর স্বরে বললেন, "সুপ্রতিমবাবু, ওদের আপনি গ্ৰেফতার করেছেন?"
"হ্যাঁ, করেছি কেন কি করবেন?"
"আমি কিছু করবো না এবার নয়, এবার আপনি ওদের যথোপযুক্ত শাস্তির ব্যাবস্থা করুন কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তির ব্যাবস্থা করুন"
"আপনি সত্যি বলছেন?"
"বলছি, এবার নয় এবার আমি আইনের কাজে বাধা দেবো না"
"শুনে খুশি হলাম"
শ্রীতমাদেবী এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়েছিলেন এবার আদিত্যর সামনে এসে দাঁড়ালেন একদৃষ্টিতে চেহারা বদলে যাওয়া নিজের ছেলেকে দেখতে থাকেন আদিত্যও পাল্টা তাকিয়ে থাকে তার মায়ের দিকে, একটা সময় পর শ্রীতমাদেবী কথা বললেন,
"একবারও নিজের মাকে বলা যায় না তাই না? নিজের মায়ের কাছ থেকেও কথা লুকোতে হয়?"
"কেন বলবে? ওর কাছে তো আমরা ওর বাবা মা নই" আদিত্য কিছু বলার আগে অভিরূপবাবু কথা বলেন, "ও তো ভাবছে ওকে আমরা কুড়িয়ে পেয়েছি ও কিভাবে জানবে ও হবার পরে যখন আমি ওকে প্রথম কোলে নিয়েছিলাম তখন ও হেসে উঠেছিল, ছোটোবেলায় যখন কাঁদতো যখন কেউ ওর কান্না থামাতে পারতো না তখন আমি ওকে কোলে নিতেই ওর কান্না থেমে যেত" তারপর অভিরূপবাবুও আদিত্যর কাছে এসে দাঁড়ালেন তারপর বললেন, "তুই তো ভাবিস আমরা তোর বাবা মা নই তাহলে কেন বারবার আমাদের বাঁচাতে ছুটে আসিস? কেন নিজের রক্ত দিয়ে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলি? উত্তর দে"
আদিত্য তবুও চুপ করে থাকে সে কি উত্তর দেবে ভেবে পেল না আসলে অভিরূপবাবু যা জানতে চাইছেন তার উত্তর দেওয়া যায় না, বাবা মায়ের উপরে রাগ অভিমান যতই থাকুক তাদের বিপদে দেখলে কোন সন্তান চুপ করে থাকতে পারে। আদিত্য বা অনি যাই বলা হোক তার বাবা মায়ের উপরে অভিমান থাকলেও তাদের বিপদে দেখে সেও চুপ থাকতে পারেনি।
আদিত্য মুখ না খুললেও অভিরূপবাবু বলতে থাকেন "সন্তানকে হারানোর কষ্ট একমাত্র বাবা মাই বুঝতে পারে আর কেউ না, তোকে হারিয়ে আমাদের কি অবস্থা হয়েছিল তোর কোনো ধারণা আছে? তুই শুধু ফিরে বাইরে থেকে সবাইকে দেখে কিছু না শুনে কিছু না জেনে চলে গেলি, আর এত বছর পরে ফিরেও দূরে থাকলি, নিজের পরিচয় দিলি না। কারণ তুই শুধু নিজের রাগ নিয়ে ছিলি ওটাই তোর কাছে বড়ো হয়েছে আর কিচ্ছু না কিচ্ছু না"
অভিরূপবাবু অনেক কষ্টে কান্নাকে আটকে রেখেছেন কিন্তু শ্রীতমাদেবীর কান্না আটকালো না তিনি আঁচলে চোখ মুছতে লাগলেন আদিত্য আর থাকতে পারলো না সে শ্রীতমাদেবীকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরলো, বহুবছর বাদে নিজের মাকে জড়িয়ে ধরলো এতে শ্রীতমাদেবীর কান্না আরও বেড়ে গেল তিনি নিজের ছেলের বুকে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙে পরলেন।
আদিত্য অভিরূপবাবুর দিকে তাকিয়ে দেখে তিনি অন্য দিকে তাকিয়ে আছেন, নিজের বাবার থেকেও আর দূরে থাকতে পারলো না আদিত্য মায়ের চোখ মুছিয়ে তাকে ছেড়ে বাবার কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো, অভিরূপবাবু এতক্ষণ নিজেকে সামলে রাখলেও আর পারলেন না এবার তিনিও ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পরলেন সাথে আদিত্যর দুচোখ থেকেও এতদিনের জমে থাকা রাগ অভিমান জলের ধারা হয়ে বেরিয়ে আসতে লাগলো।
হটাৎ প্যান্টে টান পড়ায় আদিত্য নীচে তাকিয়ে দেখে পিউ ওকে ডাকছে, আদিত্য হাঁটু মুড়ে তার সামনে বসলে সে তার ছোট্ট হাত দিয়ে আদিত্যর চোখ মুছিয়ে দিতে থাকে বলে, "কেঁদো না মামু মামীর কিচ্ছু হবে না, মামী ভালো হয়ে যাবে"
"কি বললে তুমি আমাকে?"
"মামু, মাম্মা বলেছে তোমাকে মামু বলে ডাকতে তুমি আমার ছোটো মামু হও"
আদিত্য এবার পিউকে বুকে টেনে ওকে জড়িয়ে ধরলো।
"একদিক থেকে ভালো, সবার উপরে রাগ থাকলেও নিজের ভাগ্নির উপরে রাগ নেই" সুনন্দার কথায় আদিত্য ওর দিকে তাকালো কিন্তু কিছু বললো না।
স্বর্ণেন্দু বাবু এবার বললেন, "নিজের বাবা মাকেই নিজের পরিচয় দিসনি সেখানে আমি তো আশাই করতে পারি না যে আমাকে দিবি, আজ তোর সাথে তোর সুপ্রতিম স্যারের খুব ভাব কিন্তু তুই ভুলে গেছিস এই আমি আমি তোকে ওর বাড়ির ঠিকানা দিয়েছিলাম তোকে সাঁতার থেকে শুরু করে সাইকেল চালানো, মাছ ধরা সব আমি আমি শিখিয়েছিলাম, তোকে কাঁধে বসিয়ে আমি পুরো চিড়িয়াখানা ঘুরিয়েছিলাম, তুই বই পড়তে ভালোবাসিস তাই আমি তোকে তোর জন্মদিনে 'ফেলুদা সমগ্ৰ' দিয়েছিলাম"
স্বর্ণেন্দু বাবু আর কিছু বলতে পারলেন না নিজের ভাগ্নেকে জড়িয়ে ধরলেন, তার কথাগুলো সব ঠিক ছোটো থেকেই অনিকেতকে তিনি সত্যিই ভালোবাসতেন অরুণাভ নিজের দরকার ছাড়া মামার কাছে খুব একটা আসতো না আর অনি সে মামার কাছেই আসতে পছন্দ করতো মামার লাইব্রেরী থেকে বই নিয়ে পড়তো মামার বড়ো আদরের ছিল সে তাই তার তো কষ্ট হবারই কথা।
সময় যত বইতে থাকে আদিত্য সহ উপস্থিত সবার মনে উদ্বেগ আশংকার চোরাস্রোত বয়ে যেতে থাকে, সময় আর যেন শেষ হতে চায় না অবশেষে একটা সময় ওটির দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন ডাক্তার আর বেরোনো মাত্র সবাই তাকে ঘিরে ধরলো,সবার মনের জিজ্ঞাসাটা বোধহয় অনুমান করে নিলেন, তিনি বললেন
"কনগ্ৰাচুলেশনস্ মিস্টার আদিত্য আপনি বাবা হয়েছেন আপনার স্ত্রী একটি মেয়ের জন্ম দিয়েছেন, আপনারা একটু পর গিয়ে তাকে দেখতে পারেন"
ডাক্তারের কথা শুনে সবার মুখ খুশীতে উজ্জ্বল হলেও একমাত্র আদিত্যর মুখে কোনো হাসি দেখা গেল না সে জিজ্ঞাসা করলো, "আমার ওয়াইফ কেমন আছে ডক্টর?"
আদিত্যর প্রশ্ন শুনে এবার বাকিদের মুখও গম্ভীর হয়ে গেল তারাও উৎসুক ভাবে ডাক্তারের জবাবের প্রতীক্ষায় তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, ডাক্তার কিছুক্ষণ আদিত্যর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বলেন, "আমার এত বছরের ডাক্তারী জীবনে আমি সবসময়ই দেখেছি যে পেশেন্টের হাজবেন্ড তার সন্তানের খবর শুনে ওয়াইফের কথা একপ্রকার ভুলেই যান পরে জিজ্ঞাসা করেন, কিন্তু এই প্রথম আপনাকে দেখলাম যিনি নিজের সন্তানের থেকেও নিজের ওয়াইফের ব্যাপারে বেশি চিন্তিত, আপনার ওয়াইফের ক্রিটিক্যাল কণ্ডিশনটা কেটেছে কিন্তু এখনো জ্ঞান ফেরেনি, আমরা অবজারভেশনে রেখেছি"
"ভয়ের কিছু নেই তো ডক্টর?" তানিয়া জিজ্ঞেস করলো পরিচয়ের দিন থেকে তার সঙ্গে পিয়ালীর একটা গাঢ় বন্ধুত্ব হয়ে গেছে, ডাক্তার তার কথার জবাবে বললেন, "সেরকম কিছু আশংকা তো করছি না, আপনাদের ভালোবাসা এবং প্রেয়ারের জন্য হোক বা সন্তানের কান্নার আওয়াজ শুনেই হোক উনি আমাদের চিকিৎসায় সাড়া দিতে শুরু করেছেন"
"তাহলে জ্ঞান ফিরছে না কেন ডক্টর?" আদিত্য জিজ্ঞেস করে,
"উনি এখনো ট্রমার মধ্যে আছেন আর শরীরও প্রচণ্ড দুর্বল তাই তবে আমরা আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি ওনার জ্ঞান ফিরে আসবে"
"আমি কি ওকে গিয়ে দেখতে পারি এখন?"
ডাক্তার আরও একবার অবাক দৃষ্টিতে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে থাকেন তারপর বলেন "নিজের সন্তানকে দেখার আগে আপনি ওয়াইফকে দেখতে চান আপনাদের এই ভালোবাসার জন্যই বোধহয় তিনি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন, ঠিক আছে তবে সবাই না যাওয়াটাই ভালো আপনি যেতে পারেন ওনাকে ওটি থেকে শিফট করার পর আপনি গিয়ে দেখবেন"।
আদিত্য ভিতরে গিয়ে দেখে পিয়ালী বেডে চোখ বুজে শুয়ে আছে ওর এক হাতে স্যালাইনের নল সেট করা, আদিত্য বেডের একপাশে রাখা একটু টুলে বসলো তারপর পিয়ালীর একটা হাত নিজের দুহাতের মধ্যে রেখে প্রথমে ওর হাতে একটা চুমু দিল তারপর অচেতন পিয়ালীকে উদ্দেশ্য করেই বলতে থাকে, "প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না প্লিজ, আমাকে ক্ষমা করে দাও আমি তোমাকে প্রোটেক্ট করতে পারিনি কিন্তু প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না, ফিরে এসো আমার কাছে প্লিজ"
আদিত্য এভাবেই পিয়ালীর পাশে বসে থাকলো, বাকীরা গিয়ে আদিত্যর নবজাতিকা মেয়েটিকে দেখে এলেও আদিত্য গেল না তাকে বারবার বলা সত্বেও সে পিয়ালীর কাছ থেকে নড়লো না, কেউ আর কথা বাড়ালো না সবাই বুঝতে পারলো যে এইমুহুর্তে আদিত্যর কাছে পিয়ালীর প্রায়োরিটি বেশী তাই সে যতক্ষণ না জ্ঞান ফিরে পাচ্ছে ততক্ষণ আদিত্য নিজের মেয়েরও মুখ দেখবে না।
আরও প্রায় ঘন্টাদুয়েক পরে পিয়ালীর মধ্যে ধীরে ধীরে জ্ঞান ফেরার লক্ষণ দেখা গেল চোখের পাতা নড়া, হাতের আঙুল নড়া ইত্যাদি আদিত্য তখনও পিয়ালীর একটা হাত চেপে ধরে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, পিয়ালীর হাত ধরে থাকায় ওর আঙুল নড়াটা টের পেল আদিত্য আর সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তারকে ডেকে পাঠালো।
আরো কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার বেশ কিছুক্ষণ ধরে চেক্আপ করার পরে ফাইনালি পিয়ালীর পুরোপুরি জ্ঞান ফিরলো, তার চিকিৎসারত ডাক্তারটিকে দেখে মনে হলো তিনি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন, এবারও অবশ্য প্রথমে আদিত্যই গেল দেখা করতে, সে ঢুকতেই পিয়ালী তার দিকে তাকিয়ে একটা ক্ষীণ হাসি হাসার চেষ্টা করলো, পিয়ালীর কাছে গিয়ে সে প্রথমে তার কপালে একটা চুমু দিল তারপর আস্তে আস্তে বললো,
"আয়্যাম সরি, আমার জন্যই আজ তোমার এই অবস্থা, আমার জীবনের কালো ছায়া তোমার উপরে পরেছে আয়্যাম সরি"
"আদিত্য" অতিকষ্টে ক্ষীণ স্বরে পিয়ালী ডাকে তার স্বামীকে আদিত্য তার দিকে তাকালে সে একইরকম ক্ষীণ স্বরে বলে "আমার বেবী? আমার বেবী কোথায়?"
এই উত্তর অবশ্য আদিত্যকে দিতে হলো না তার আগেই সুনন্দা কেবিনে ঢুকলো সে ঢোকার আওয়াজে আদিত্য এবং পিয়ালী দুজনেই দরজার দিকে তাকালো সুনন্দার কোলে তোয়ালে জড়ানো কিছু আছে, সেটা দেখে পিয়ালী উঠে বসতে চেষ্টা করলো কিন্তু দুর্বল শরীরে পারলো না তখন আদিত্যর দিকে তাকাতে সে আস্তে করে ধরে উঠে বসালো, উঠে বসে সুনন্দার দিকে দুহাত বাড়াতে সুনন্দা শিশুটিকে পিয়ালীর কোলে দিল আর আদিত্যকে বললো, "এবার অন্তত নিজের মেয়ের মুখ দেখ এই শিশুর কি দোষ যে ওর বাবা ওর মুখ দেখবে না?"
সুনন্দার কথা শুনে পিয়ালী আদিত্যর দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো আর আদিত্য অপরাধীর দৃষ্টিতে ওর দিকে, এবার আদিত্য পিয়ালীর কোল থেকে শিশুটিকে নিজের কোলে নিল এক অদ্ভুত অনুভূতি তার সারা শরীর জুড়ে বয়ে চললো তার ঠোঁটে হাসি থাকলেও চোখে জল শিশুটি চোখ বুজে ঘুমিয়ে আছে সে শিশুটিকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে,
"আয়্যাম সরি আমি তখন তোর মুখ দেখিনি এর জন্য তুই দায়ী নোস, আসলে আমি তোর মাকে হারাতে চাইনি তাই তোর মায়ের কাছে আগে এসেছিলাম আমাকে, তোর বাবাকে ক্ষমা করে দে মা, তোর বাবা তোকে খুব খুব ভালোবাসে আমার শ্রীমা"
"দারুণ নামটা দিলি তো" সুনন্দা কথাটা বললো "একটা জিনিস খুব ফর্সা হয়েছে, তোরা দুজনেই ফর্সা তাই কার গায়ের রঙ পেয়েছে বলা মুশকিল"
"এই অনি দা বাইরে এসে দেখ কি শুরু হয়েছে" তানিয়া ভিতরে এসে বললো আদিত্য একটু অবাক হয়ে নিজের মেয়েকে পিয়ালীর কোলে দিয়ে বাইরে এসে যা দেখলো তাতে সে হাসবে না কি করবে ভেবে পেল না সে দেখে তার বাবা, মামা, স্যার এবং অখিল জ্যেঠু পরস্পরের গলা জড়িয়ে নাচতে শুরু করেছে আর জামাইবাবু অর্থাৎ মৈনাক মোবাইলে ভিডিও করছে, এবং তার মা আর মামী তাই দেখে হাসছে। তাকে দেখে পিউ তার সামনে এসে বললো "মামু আমি বোনকে দেখবো কেউ আমাকে ভালো করে দেখতে দিচ্ছে না"
আদিত্য ওকে কোলে তুলে নিল তারপর ওর দুগালে দুটো চুম্বন দিয়ে বললো, "আগে বলবে তো কে তোমাকে দেখতে দিচ্ছে না দিতেই হবে" এই বলে সে পিউকে ভিতরে পিয়ালীর কাছে নিয়ে গেল, বোনকে দেখে তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে, একে একে সবাই কেবিনের ভিতরে আসে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে, সবাই পিয়ালীর সাথে কথা বলছে, বাচ্চাটিকে নিয়ে আনন্দ করছে একসময় আদিত্যর চোখ গেল দরজার কাছে দুটো প্রাণী চুপ করে বসে আছে আর তাদের দিকে তাকিয়ে দেখছে।
আদিত্য নিজের শিশুকন্যাটিকে আবার কোলে নিয়ে ওদের কাছে গেল তারপর ওদের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে ওদের সামনে বাচ্চাটিকে দেখিয়ে বলতে থাকে, "টোবো এতগুলো বছর আমি না থাকলেও আমার কথা শুনে তুই বাবা মায়ের খেয়াল রেখেছিস, আমি ফিরে আসার পরে আমার পাল্টানো চেহারা সত্বেও আমাকে চিনতে ভুল হয়নি তোর, আর বাদশা তুই, তুই না থাকলে হয়তো আমিও বাঁচতাম না তুই আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিস এমনকি আজও তুই না থাকলে আমি পিয়ালীকে আর আমার মেয়েকে বাঁচাতে পারতাম না তোরা দুজনেই আমার খুব কাছের তোরা দুজনেই আমার বন্ধু আমার ভাই আমার ছেলে সবকিছু এতদিন তোরা আমার আর আমার বাবা মায়ের খেয়াল রেখেছিস এবার থেকে তোদের আরও একটা দায়িত্ব বেড়ে গেল তোদের নতুন বন্ধু বা বোন যাই বলিস এবার থেকে তারও খেয়াল রাখতে হবে পারবি তো?"
দুটো পোষ্যই সামনের দুটো পা ভাজ করে উপরে তুলে ধরলো যেন বলতে চাইলো 'অবশ্যই পারবো'।
পিয়ালী সুস্থ হলে হাসপাতাল থেকে তাকে ডিসচার্জ করে দেওয়া হলো শিশু কন্যাকে নিয়ে যখন সে নারায়ণতলা গ্ৰামে ফিরলো তখন সেখানে রীতিমতো উৎসবের আমেজ, অখিলবাবুর সৌজন্যে গ্ৰামের সবাই জেনে গেছে তাদের গ্ৰামের নতুন অতিথির কথা তবে আতুর না কাটা পর্যন্ত কেউ আদিত্যর ঘরে এলো না আর আতুর কাটতেই পুরো গ্ৰামের সবাই হাতে কিছু না কিছু নিয়ে চলে এলো আদিত্য আর পিয়ালীর মেয়েকে দেখতে, কেউই অবশ্য বারণ করলো না, সবাই মেয়েকে দেখছে আর আশীর্বাদ করে যাচ্ছে।
এর মাঝে একদিন মণিদেবী আর সুশান্ত এসে হাজির অভিরূপবাবুর এখানের বাড়িতে তাদের দাবি প্রীতমবাবুকে যেভাবেই হোক জেল থেকে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে, অভিরূপবাবু যথারীতি তাতে রাজী হলেন না তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন প্রীতমবাবু যা করেছেন তাকে ক্রাইম বলে এবং তার যা শাস্তি সেটা তাকে ভোগ করতে হবে, মণিদেবী এবং সুশান্ত রীতিমতো তর্ক করতে শুরু করে এমনকি এটাও বলে যে ক্রাইম তো অরুণাভও করেছে তাহলে শাস্তি তার বাবা পাবে কেন?
উত্তরে অভিরূপবাবু জানান শাস্তি অরুণাভও পাবে সেটা আইনের হাতে হোক বা অন্য কোনো ভাবে আর প্রীতমবাবু ক্রইম করতে গিয়ে হাতেনাতে প্রমাণসহ ধরা পড়েছেন তাই চাইলেও তাকে ছাড়িয়ে আনা যাবে না তিনি আরো জানান অনিকেতকে ফেলে দেবার যে ভিডিওটা সেদিন তারা দেখিয়েছিল সেটা এতবছর লুকিয়ে রেখে তারা যে অরুণাভর থেকে সবরকম সুযোগ সুবিধা নিয়েছে এটা তার বুঝতে বাকী নেই।
একথার পরে অবশ্য তাদের কিছু বলার থাকতে পারে না তবুও তারা আরো একচোট হম্বিতম্বি করে চলে গেল।
আর একদিন খোদ অরুণাভ এসে হাজির তাকে দেখেই অভিরূপবাবু এখান থেকে চলে যেতে বলেন কিন্তু সে উল্টে আদিত্যকে অভিরূপবাবুর পাশে দেখে সে তার উপরে চড়াও হয় আদিত্যই তার বাবাকে তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে এবং এখন তার লক্ষ্য ব্যানার্জী ক্রিয়েশনস্ এর দখল নেওয়া এটাও বলে উত্তরে অভিরূপবাবু তাকে আদিত্যর আসল পরিচয় দেন অর্থাৎ সেই যে অনিকেত সেটা তাকে বলেন এবং ব্যানার্জী ক্রিয়েশনস্ এ তারও সমান অধিকার রয়েছে এটা স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দেন এবং এরপরেও সে যদি বেশি বাড়াবাড়ি করে তাহলে তাকে জেলে দেওয়া হতে পারে এই কথা বলেন ড় এতে অরুণাভ আরও চটে যায় সে আদিত্যকে যাচ্ছেতাই ভাষায় অপমান করতে থাকে কিন্তু আদিত্য চুপ করে তার সব কথা শোনে তারপর শান্ত অথচ স্পষ্ট এবং দৃঢ়ভাবে জানায় চাইলে সে অরুণাভকে জেলে দিতে পারে এটা ঠিক তবে সে দিচ্ছে না কারণ যতই রেগে থাকুন তাকে জেলে দিলে সবথেকে বেশি কষ্ট তাদের বাবা মায়ের হবে আর দুই দুটো ছোটো ছোটো বাচ্চাকে সে তাদের বাবার থেকে দূরে করতে চায় না কারণ যখন অলরেডি তাদের মা নিজের কৃতকর্মের জন্য জেলে আছে।
এরপরেও অরুণাভর হম্বিতম্বি কমছে না দেখে অভিরূপবাবু বাধ্য হয়ে ঘোষণা করেন ব্যানার্জী ক্রিয়েশনস্ এর দুটো ভাগ করে একভাগ তিনি অরুণাভর নামে দেবেন আরেকভাগ অনিকেতের নামে, কিন্তু অনিকেত স্পষ্ট জানিয়ে দেয় ব্যানার্জী ক্রিয়েশনস্ এ তার কোনো আগ্ৰহ নেই, সে অনিকেত ব্যানার্জীর জীবনটা অনেক আগেই পিছনে ফেলে এসেছে এখন সে আদিত্য ব্যানার্জী তাই অনিকেতের অধিকার ছিল এমন কিছুই আর সে চায় না তাই ব্যানার্জী ক্রিয়েশনস্ এর ভাগ করতে হবে না ওটা অরুণাভ এবং তার সন্তানদের জন্যই থাক।
আদিত্যর এই কথা শুনে অভিরূপবাবু অবাক হলেও ছেলের জন্য গর্বে চার বুক ভরে যায় তবে তিনি অরুণাভকে জানিয়ে দেন ব্যানার্জী ক্রিয়েশনস্ সে পাবে সাথে তাদের শহরের বাড়িটা এবং আরও কিছু সম্পত্তিও কিন্তু আর কিছু না গ্ৰামের বাড়ি সহ আরও কিছু অল্প জায়গা সে পাবে না আর সবথেকে বড়ো যেটা সেটা হলো এখন থেকে অভিরূপবাবু আর শ্রীতমাদেবী এই গ্ৰামেই পার্মানেন্টলি থাকবেন অরুণাভ যেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টাও না করে।
এই কথায় অরুণাভ যারপরনাই হতবাক হয়ে যায় সে যাই করুক বাবার জন্য তার মনে ভালোবাসা আছে তাই সে বারবার অভিরূপবাবুকে বোঝাতে চেষ্টা করে যাতে তিনি নিজের সিদ্ধান্ত বদল করে তার সঙ্গে শহরের বাড়িতে গিয়ে থাকেন কিন্তু অভিরূপবাবু তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন শেষপর্যন্ত আদিত্যর কথায় এবং অরুণাভর দুই সন্তানের কথা ভেবে তিনি অরুণাভ এবং তার দুই সন্তানকে মাঝে মাঝে এখানে আসার অনুমতি দেন।
মাস চারেক পরে,
আবার আনন্দ হইহট্টগোল শুরু হয় তবে এবারের কারণ তানিয়া আর দিগন্তের বিয়ে, অবশ্য তাদের বিয়ে আগে থেকেই ঠিক ছিল এবং বাগদান ও আশীর্বাদ হয়ে গিয়েছিল কাজেই দিগন্তর বাবা মা আর দেরী করতে রাজী হচ্ছিলেন না। বলাইবাহুল্য সুপ্রতিমবাবু মেয়ের বিয়ের ভার তার পুত্রসম শিষ্য আদিত্যর কাঁধে দিয়ে একপ্রকার নিশ্চিন্ত হলেন, দিগন্তর সঙ্গে তো আদিত্যর পরিচয় ছিলই এবার তার বাবা মায়ের সঙ্গেও আদিত্যর পরিচয় হলো আদিত্য দেখে খুশি এবং নিশ্চিন্ত হলো যে দুজনেই সজ্জন মানুষ, এমনকি আদিত্য যখন তাদের বললো যে বিয়ের পরে যদি তানিয়া কোনো রকম অন্যায় করে তাহলে দরকারে তাকে ডাকতে সে এসে তাকে শাসন করবে তখন দিগন্তর মা স্পষ্ট জানান সেটা হবে না তানিয়া এখন তাদের ঘরের বউ তাদের মেয়ে কাজেই তাদের বাড়ির মেয়েকে শাসন করার অধিকার শুধুমাত্র তাদের সাথে এটাও জানান তানিয়ার উপরে তাদের পুরো বিশ্বাস আছে যে সে কখনো কোনো অন্যায় করতেই পারে না।
নির্দিষ্ট দিনেই তানিয়া এবং দিগন্তর বিয়ে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হলো কিন্তু ধাক্কাটা এলো রিসেপশনের দিন, ধাক্কাটা এলো আদিত্যর জন্য এবং সেটা এমন যেটা আদিত্য কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি।
তানিয়া এবং দিগন্তের রিসেপশনে অভিরূপবাবু এবং শ্রীতমাদেবী ছাড়াও স্বর্ণেন্দু বাবু সুদেষ্ণা দেবী, সুনন্দা আর মৈনাকেরও নিমন্ত্রণ ছিল আদিত্য আর পিয়ালীর তো ছিলই, দিগন্তর বাবাও যেহেতু পুলিশ অফিসার তাই তার সঙ্গে স্বর্ণেন্দু বাবুর যথেষ্ট পরিচয় আছে আর অভিরূপবাবুকে তো কলকাতার প্রায় সবাই চেনে, আর দিগন্তর সাথে তো আদিত্যর সম্পর্ক একপ্রকার বন্ধুত্বের পর্যায়ে চলে গেছে সে নিজে তার বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে আদিত্য আর পিয়ালীর শ্রীমা অর্থাৎ আদিত্য পিয়ালীর মেয়ে আবশ্য তাদের কাছে নেই সে কখনো সুনন্দার কোলে আবার কখনো শ্রীতমাদেবীর কোলে আবার কখনো অভিরূপবাবু বা স্বর্ণেন্দু বাবুর কাছে মানে সবার কোলেই ঘুরছে।
একসময় দিগন্ত আদিত্য আর পিয়ালীকে ডেকে নিয়ে গেল তার এক বিশেষ বন্ধু এবং তার স্ত্রীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য যারা তার বিয়েতে আসতে পারেন কিন্তু অনেকবার বলায় রিসেপশনে এসেছে।
"আদিত্য এই হলো আমার অনেকদিনের বন্ধু ও ব্যাচমেট নীলাদ্রি, নীলাদ্রি সান্যাল আর এই হলো ওর ওয়াইফ প্রীতি সান্যাল আর এই হলো আমার বন্ধু এবং আমার ওয়াইফের দাদা আদিত্য ব্যানার্জী আর ওর ওয়াইফ পিয়ালী ব্যানার্জী"
হ্যাণ্ডশেকের জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিয়েই আদিত্য স্থির হয়ে যায় একই অবস্থা নীলাদ্রি এবং প্রীতির আদিত্য দেখে প্রীতির পাশে ওর হাত ধরে বছর তিনেকের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে দিগন্ত বলতে থাকে,
"জানো আদিত্য নীলাদ্রি একজন রাফ এণ্ড টাফ পুলিশ অফিসার আর ও এখন নর্থবেঙ্গলের একটা জায়গায় পোস্টেড আছে, ওই এলাকায় এখন ক্রাইম প্রায় নেই একটা সময় প্রচুর ছিল এমনকি হিউম্যান ট্রাফিকিং পর্যন্ত নীলাদ্রি নিজে হাতে ওই দলের হেডকে এনকাউন্টার করে শেষ করে"
"খুব ভালো" ছোট্ট জবাব আদিত্যর তারপর সে আর তাদের সামনে দাঁড়ায় না সেখান থেকে সরে পরে, একটু পরে যে লজে দিগন্তর রিসেপশনের অনুষ্ঠান হচ্ছিল তার ছাদে গিয়ে দাঁড়ায় সে, ছাদের কার্ণিশে দুহাতে ভর দিয়ে দূরে তাকিয়ে থাকে তার চোখের সামনে নর্থবেঙ্গলে কাটানো তার জীবনের আটটা বছরের ছবি ফুটে ওঠে।
"এখানে চলে এলে, কিছু হয়েছে?" আদিত্যর পাশে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে পিয়ালী, শেষ দুজনের সঙ্গে পরিচয়ের সময় আদিত্যর মুখের অবাক ভাব পিয়ালীর দৃষ্টি এড়ায়নি আদিত্য যদিও তার প্রথম প্রশ্নের উত্তর দিল না তবুও সে আবার প্রশ্ন করে "ওই দুজনকে তুমি চেনো তাই না? কে ওনারা?"
এইবার আদিত্য কথা বলে, "ওই মেয়েটি হলো অতীন্দ্র স্যারের মেয়ে মানে আসল আদিত্যর বোন"
"আর তোর কেউ না? তোর বোন না?"
পিছনে প্রীতির পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে চকিতে ফিরে তাকায় সে দেখে প্রীতি দাঁড়িয়ে কাঁদছে ওর পিছনে সেই বাচ্চা ছেলেটি ওর বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে, আদিত্য প্রীতির কথায় কোনো উত্তর দেয় না প্রীতি আবার জিজ্ঞেস করে "কি রে বল আমি তোর কেউ না? আমি তোর বোন না?"
"তুই আমার কাছে চিরকাল আমার বোন হয়ে থাকবি কিন্তু আমি তো তোর দাদা নই"
এবারে আদিত্য কথা বলে, প্রীতি কাঁদতে কাঁদতে বলে, "মানছি আমি একটা ভুল করেছিলাম ভুল না অন্যায় করেছিলাম তাই তুই আমাকে একেবারে পর করে দিলি?"
"পর আমি করেছি?"
"তাই নয় তো কি? আমি যদি তোর নিজের বোন হতাম তাহলে কি এভাবে পর করতি? তাহলে হয়তো কান মুলে গালে দুটো থাপ্পড় মেরে শাসন করতি, কিন্তু আমি তো তোর নিজের বোন না তাই হয়তো সেটা না করে চলে এসেছিস"
"তোকে থাপ্পড় মারার অধিকার কি আমার ছিল? সত্যি বলতো কে কাকে পর করেছে? আটটা বছর আমি তোদের সঙ্গে ছিলাম কখনো তোর এমন মনে হয়েছে যে আমি পরের মতো আচরণ করছি? হয়েছে?"
প্রীতি চুপ করে থাকে তবে তার দুচোখ দিয়ে অবিরাম জল পরছে আদিত্য বলতে থাকে, "তোকে আমি সবসময় নিজের বোন মনে করেছি"
"তাহলে ছেড়ে চলে এলি কেন?"
"কারণ সেখানে আর আমার প্রয়োজন ছিল না"
প্রীতি এবার ছুটে এসে আদিত্যর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে জড়িয়ে তার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলে, "আমার ভুল হয়ে গেছে দাদা আমাকে ক্ষমা করে দে, প্রীতিকে এইভাবে কাঁদতে দেখাটা আদিত্যর জন্যও কষ্টকর হয়ে যাবে উঠলো, একটা সময় পরে সে প্রীতির মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বললো,
"কাঁদিস না তোকে বলেছিলাম না যে তুই কখনো কাঁদবি না"
"আমাকেও ক্ষমা করে দাও আদিত্য" কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা নীলাদ্রি এবার কথা বললো কিন্তু আদিত্য তার কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে বাচ্চা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থাকে নীলাদ্রি সেটা খেয়াল করেই বলে, "ও নীলাভ তোমার ভাগ্নে" তারপর বাচ্চাটিকে বলে "বাবু যাও ওর কাছে, চিনতে পারছো তো ও কে?"
বাচ্চাটি একবার তার বাবার দিকে তাকায় তারপর আদিত্যর দিকে এগিয়ে আসে আদিত্য প্রীতিকে ছেড়ে বাচ্চাটির সামনে বসে বাচ্চাটি বলতে থাকে "আমি তোমার ছবি দেখেছি,মা বলেছে তুমি আমার মামা হও"
"তোমার মা আর কি বলেছে?"
"বলেছে তুমি হারিয়ে গেছো, কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে তুমি?"
"আমি হারাইনি তো আসলে আমি তোমার সাথে লুকোচুরি খেলছিলাম দেখছিলাম যে তুমি আমাকে খুঁজে পাও কি না?"
"আমি তো তোমাকে খুঁজে নিয়েছি এবার আমার গিফট কই?"
"কি গিফট চাও তুমি?"
"চকোলেট অনেক চকোলেট, দেবে?"
"অবশ্যই দেবো তবে এখন তো আমার সঙ্গে নেই আমি পরে তোমাকে অনেক চকোলেট এনে দেবো, ঠিক আছে?" আদিত্যর কথা শুনে বাচ্চাটি একগাল হাসি নিয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরে।
"মায়ের খুব শরীর খারাপ রে দাদা" প্রীতির কথা শুনে আদিত্যর চোখের সামনে উমাদেবীর সদা হাস্যময় ফর্সা সুন্দর মুখখানি ভেসে ওঠে, আদিত্য উঠে প্রীতির দিকে তাকালে সে বলতে থাকে, "খাওয়াদাওয়া ছেড়েই দিয়েছে, ঘুমও ঠিক মতো হচ্ছে না, মায়ের কি হয়েছে কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না সবরকম টেস্ট করে দেখা হয়েছে কিন্তু শরীর খারাপের কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না আমি ছাড়াও আরো অনেক বড়ো বড়ো ডাক্তার দেখেছে কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারছে না, একজন তো বলেই দিল এভাবে চলতে থাকলে মা আর বেশিদিন বাঁচবে না"
"আদিত্য" প্রীতি থামলে নীলাদ্রি বলতে শুরু করে, "আদিত্য তুমি আমাকে ওনাদের দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে এসেছিলে কিন্তু সবাই সব দায়িত্ব পালন করতে পারে না আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম কিন্তু আমি কথা রাখতে পারিনি, আমি ক্ষমাপ্রার্থী"
"একবার যাবি দাদা? চল না একবার মায়ের কাছে। মা কলকাতাতেই আছে" প্রীতি আবার বলে কিন্তু আদিত্য তাও চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে পিয়ালী বুঝতে পারে ওর মনে কিছু নিয়ে একটা দ্বন্দ্ব চলছে তাই সে এগিয়ে এসে তার কাঁধে একটা হাত রাখে আদিত্য বুঝতে পারে সে কি বলতে চায়, আদিত্য জিজ্ঞেস করে "কলকাতার কোথায়?"
ডানলপ থেকে সোজা দক্ষিণেশ্বরের দিকে আসা রাস্তাটা ধরে সোজা এসে দক্ষিণেশ্বর রেল স্টেশনের নীচ দিয়ে বা দিকে একটা ছোটো রাস্তায় কিছুটা গিয়ে একটা আকাশী রঙের বাড়ির সামনে ক্যাবটাকে থামায় প্রীতি, গাড়িটাকে ছেড়ে সবাই নামে সবাই বলতে আদিত্য, পিয়ালী, নীলাদ্রি, প্রীতি আর নীলাভ এবং অবশ্যই প্রীতির কোলে শ্রীমা। এখানে আসার সময় পিয়ালীর কোলে থাকলেও গাড়িতে প্রীতি বলে, "আমি একটু কোলে নেবো?"
উত্তরে পিয়ালী বলে, "এ মা কেন নেবে না অবশ্যই নেবে এই নাও" বলে শ্রীমাকে প্রীতির কোলে দেয় সেই থেকে সে তার নতুন পিসির কোলেই আছে, গাড়ি থেকে নেমে আদিত্য একবার বাড়িটা দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করে "নর্থবেঙ্গল ছেড়ে এখানে?"
"মা কলকাতার মন্দির গুলো দেখতে চাইছিলেন দক্ষিণেশ্বর, কালীঘাট, তারাপীঠ, তারকেশ্বর, বেলুড় মঠ এইসব তাই মাকে নিয়ে এখানে আসি মাসখানেক আগে"
"একটা জিনিস শুধরে দিচ্ছি দক্ষিণেশ্বর আর কালীঘাট বাদে বাকীগুলো কলকাতায় না, টেকনিক্যালি ওগুলো কলকাতার বাইরে"
"আয়" বলে প্রীতি বাড়ির ভিতরে ঢুকলো, পিছন পিছন বাকিরা বেল বাজাতে একজন মহিলা এসে দরজা খুলে দিল, ভিতরে ঢুকে আদিত্য দেখে ড্রয়িংরুমে একটা টেবিলের সামনে চেয়ারে দরজার দিকে পিছন ফিরে বসে আছেন তার অতি পরিচিত এবং তার প্রাণ রক্ষাকারী অতীন্দ্র সিংহ রায়, আদিত্যর অতীন্দ্র স্যার।
বর্তমান অতীন্দ্র সিংহ রায় কে দেখে বোঝার উপায় নেই যে এই লোকটি নর্থবেঙ্গলের একসময়ের দাপুটে জমিদার বংশের লোক এবং নিজেও বর্তমানে নর্থবেঙ্গলের একজন গণ্যমান্য লোক।
স্ত্রীর অসুস্থতায় লোকটার প্রায় পাগল পাগল অবস্থা মুখে কয়েকদিনের না কাটা দাঁড়ি, মাথায় চুল উসকোখুসকো, যারা তাকে চেনেনা তারা তাকে এই অবস্থায় দেখে বিশ্বাসই করবে না যে এই লোকটি নর্থবেঙ্গলের সবথেকে সম্ভ্রান্ত লোক।
স্ত্রী উমার শরীর নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই কম ডাক্তার দেখানো হয়নি এমনকি তাদের মেয়েও ডাক্তার কিন্তু কেউ তার রোগের কারনটা ধরতে পারছে না, এদিকে দিনের পর দিন প্রাণাধিক প্রিয় স্ত্রীকে ষা খেয়ে না ঘুমিয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে দেখছেন অথচ কিছু করতে পারছেন না, যখন উমাদেবী কলকাতার মন্দিরগুলো দেখতে চাইলেন তখন এককথায় রাজী হয়ে গেলেন তিনি উদ্দেশ্য ছিল মন্দির দর্শনের সাথে এখানের বড়ো বড়ো হাসপাতালে চিকিৎসা করানো কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না, একজন ডাক্তার অবশ্য বলেছেন যে তার স্ত্রীর অসুস্থতা যতটা না শারীরিক তার থেকে বেশি মানসিক এর বেশী তিনিও কিছু বলতে পারেননি।
কলকাতায় আসার আগে এজেন্ট মারফত দক্ষিণেশ্বরের কাছে একটা বাড়ি কিনে সেখানেই নিয়ে আসেন কিছুদিন পরে নাতিকে নিয়ে আসে মেয়ে এবং জামাই। এখানে এসে একজন আয়া রেখেছেন যিনি স্ত্রীর দেখাশোনা করবেন আর একজন রান্না এবং ঘরের অন্যান্য কাজ করার জন্য আছে।
ড্রয়িংরুমে বসে স্ত্রীর কথাই চিন্তা করছিলেন অতীন্দ্র বাবু মেয়ে এবং জামাই তাদের এক বন্ধুর বিয়ের রিসেপশনে গেছে, যেতে যদিও চায়নি এমনকি বিয়েতেও যায়নি কিন্তু অতীন্দ্র বাবুই একপ্রকার জোর করে রিসপশনে পাঠিয়েছেন এই বলে যে না গেলে খারাপ দেখায়। কি করবেন কোন ডাক্তার দেখাবেন এই চিন্তাই করছিলেন তিনি এমন সময় তার স্ত্রীর রুম থেকে খাবারের প্লেট হাতে বেরিয়ে এলেন আয়াটি অতীন্দ্র বাবু দেখলেন প্লেটে যেরকম খাবার ছিল সেরকমই আছে অর্থাৎ তার স্ত্রী খাননি, এইসময় কলিংবেল বাজলে তিনি বুঝলেন মেয়ে জামাই ফিরে এসেছে।
আয়াটি অতীন্দ্র বাবুকে বললেন "ম্যাডাম কিছুতেই খেতে রাজী হচ্ছে না স্যার, আমি অনেক চেষ্টা করেছি অনেক বুঝিয়েছি কিন্তু উনি জেদ করে আছেন যে খাবেন না এবার ছোটো ম্যাডাম এলে তো আমাকে বকবেন"
"ওর কথায় কিছু মনে করবেন না" অতীন্দ্র বাবু কথা বলেন "আমারই দুর্ভাগ্য এইসময়ে যে উমাকে খাওয়াতে পারতো সে কাছে নেই"
"তিনি কে স্যার? ডাকুন তাকে ম্যাডামের খাওয়াটা খুব দরকার খাবার না খেলে তো ওষুধও দিতে পারছি না এভাবে চললে তো.."
আয়াটি কথা শেষ করলেন না কিন্তু অতীন্দ্র বাবু বুঝতে পারলেন সে কি বলতে চাইছে তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন "সে কোথায় আছে জানলে কি আর না ডেকে থাকতাম? সেও যদি জানতো তাহলে ঠিক আসতো আর না এলেও তার পা ধরে নিয়ে আসতাম"
"স্যার"
অপ্রত্যাশিত অথচ পরিচিত আওয়াজ শুনে অতীন্দ্র বাবু লাফিয়ে চেয়ার থেকে উঠে পিছনে ফিরলেন, নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি, যাকে তিনি এই কবছরে দিনরাত্রি মনে করেছেন, স্ত্রীর অসুস্থতায় যার অভাব প্রতিনিয়ত অনুভব করেছেন সে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
"আদিত্য" একবার ডেকে প্রায় ছুটে এসে তিনি জড়িয়ে ধরলেন তাকে, যেন স্ত্রীর অসুস্থতার অব্যার্থ প্রতিকার পেয়ে গেছেন এইভাবে অতীন্দ্র বাবু আদিত্যকে আঁকড়ে ধরলেন, আদিত্যও জড়িয়ে ধরলো অতীন্দ্র বাবুকে
"মা কেমন আছে?" আদিত্যর প্রশ্নে অতীন্দ্র বাবু ভেঙে পরলেন, "ভালো নেই একদম ভালো নেই জানিনা আর কতদিন.." অতীন্দ্র বাবুও কথাটা শেষ করতে পারলেন না আদিত্যকে আর কিছু বলতেও হলো না সে এবার জিজ্ঞেস করলো, "কোথায় মা?"
I'm the King of Dark
&
I rule over all Devils

