Thread Rating:
  • 40 Vote(s) - 2.4 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Romance স্মৃতি সুন্দরী
#36
প্রায় তিন মাস পর 

দিনটা বাংলা ভাদ্র মাসের শেষের দিকে আর ইংরেজি সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি দিকে । সন্ধ্যা হতে আর দুই আড়াই ঘন্টা বাকি । অফিস আওয়ার শেষ হয়নি বলে এখন খুব একটা জ্যাম না থাকলেও কলকাতার একমুখী রাস্তা গুলো সর্বদা ব্যাস্ত । তেমনি এক রাস্তায় আটকে আছে বিক্রম । বিক্রম আর দিব্যার গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে ঠিক উত্তর কলকাতা এবং দক্ষিন কলকাতার সন্ধিস্থলে। এক্সাইড মোড়ের উত্তর দিকের ট্রাফিক সিগন্যালটার লাল থেকে সবুজে পরিবর্তন হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে বিক্রম । এখনো নব্বই সেকেন্ড বাকি অর্থাৎ দেড় মিনিট । একবার  লাল সিগন্যালটা দেখে নিয়ে সে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসে থাকা দিব্যার দিকে তাকালো ।

যে জিনিসটা ভাবতে তার সবথেকে বেশি ভালো লাগে , ভাবলে এক আলাদা সুখানুভূতি পাওয়া যায় সেটাই সে ভাবতে শুরু করলো । ভাবনাটা হলো কিভাবে ‘ ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন , এই প্রবাদ বাক্য সফল হলো কিংবা ‘ বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা কিভাবে এলো , সেটা । তার এই চিন্তা ভাবনায় দিব্যা হলো ডানা কাটা এক পরী , যেন স্বর্গ থেকে এক অপ্সরা নেমে এসেছে । দিব্যার মত এরকম এক মডার্ণ মেয়ে কিভাবে তার মত এক অভাগার কপালে জুটলো সেটাই বিক্রমের কাছে বিস্ময়কর । এক্ষেত্রে সব বাগধারাই প্রযোজ্য । কারন বিক্রম নিজেকে বাঁদর মনে করে আর দিব্যাকে সেই বাঁদরের গলার মুক্তোর মালা । কিংবা নিজেকে সেই ছেঁড়া কাঁথা আর দিব্যাকে লাখ টাকা ।

কাজ করতো তো সামান্য একটা গ্যারাজে । একদিন হঠাৎ কোন ঠাকুমার ঝুলির গল্পের মতো দিব্যা এলো তার গ্যারাজে স্কুটি ঠিক করাতে । একটা পাইপ লুজ ছিল । সেটা ভালো ভাবে এঁটে দিয়েছিল বিক্রম । তার বদলে সে কোন অর্থ নেয়নি । সেখান থেকেই আলাপ । তারপর ঘনঘন বিক্রমের কাছে আসতে শুরু করলো দিব্যা । তাদের এই আলাপচারিতা ক্রমে ক্রমে জানাজানি তে পরিবর্তন হলো ।

বিক্রম আর দিব্যার এই মেলামেশা দেখে বিক্রমের গ্যারাজের সহকর্মী প্রফুল্ল দা কটাক্ষ করে বলেছিল , “ এ যে চিরদিনই তুমি যে আমার সিনেমা দেখছি । তাও আবার লাইভ ! „

প্রফুল্লদার এই কটাক্ষ বিক্রমের মনে লাগেছিল । তাই সে এই সম্পর্কের একটা নাম দিতে চাইলো । পরের দিন দিব্যা এলে বিক্রম গম্ভীর মুখ করে জিজ্ঞেস করেছিল , “ তুমি এখানে রোজ রোজ আসো কেন ? „

দিব্যা হেসে জিজ্ঞেস করেছিল , “ এ কেমন প্রশ্ন ? আমার আসতে ভালো লাগে তাই আসি । কেন ? আসতে পারি না বুঝি ! „

বিক্রম ভণিতা না করে সোজাসুজি বলেছিল , “ এখানে সবাই আমায় আর তোমাকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু করেছে । চিরদিনই তুমি যে আমার বলে হাসিঠাট্টা করছে । তোমার ভালোর জন্যই বলছি তুমি আর এসো না । „

দিব্যাও ভণিতা না করে বললো , “ আমার তোমাকে ভালো লাগে তাই আমি এখানে আসি । আর তোমার আমার সম্পর্কে বাঁধা দেওয়ার কেউ নেই । আমার শুধু মা আছে । মা এই সম্পর্ক মেনে নেবে । তুমি বলো তোমার কেউ আছে বাঁধা দেওয়ার ? „

বিক্রম বলেছিল , “ আমি অনাথ । „

এরপর বিক্রম আর দিব্যার সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছিল । দুজনের মনের মিল হতে বেশি দেরি হয়নি ।  তারপর মনের মিল এবং মনের মিল থেকে শারিরীক মিলন । এই শারীরিক মিলনের স্থানে এসেই বিক্রমের চিন্তায় ছেদ পড়ে ।

নিজের অতীতের এই সুমধুর স্মৃতি যতোই মিষ্টি হোক না , দিব্যার সাথে তার ওই শারীরিক মিলনের কথাটা তার কাছে তেতো মনে হয় । সেই শারিরীক মিলনের সময়ে বিক্রম এক বণ্য হিংস্র পশুর মত আচরণ করেছিল এটা দিব্যা মুখ ফুটে না বললেও দিব্যার মুখ দেখে বিক্রম ঠিক বুঝতে পেরেছিল । তারপর থেকেই দিব্যার সাথে মিষ্টি মধুর প্রেমের স্মৃতি মনে করে খুশি হলেও শারিরীক মিলনের কথাটা মনে আসতেই সব খুশি যেন তাকে একা ফেলে কোথায় পালিয়ে যায় ।

সেই শারিরীক মিলনের পরে হঠাৎ একদিন দিব্যার তরফ থেকেই এলো সেই অনাকাঙ্ক্ষিত প্রস্তাব , লিভিংয়ে যাওয়ার । তারপর এলো সেই সুখবর .....  

এইসবই ভাবছিল সে ট্রাফিক সিগন্যালে বসে বসে । হঠাৎ পাস থেকে দিব্যার আওয়াজে তার হুঁশ ফিরলো , “ এই চলো ! সিগন্যাল সবুজ হয়ে গেছে তো ! „

বিক্রমের হুঁশ ফিরতেই সে পিছন থেকে দুই তিনটে হর্ণের যান্ত্রিক বিকট কর্কশ আওয়াজ শুনতে পেল । আর সঙ্গে সঙ্গে এক্সালারেটরে পা দিল । গাড়ি চলতে শুরু করলো চৌরঙ্গী রোড ধরে ।

তাকে এই বাড়িতে একা রেখে দিব্যার চলে যাওয়ার পর থেকেই বিদ্যার মন খুব অশান্ত ছিল । এতদিন যে একাকিত্ব তার শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করতো এখন সেই একাকিত্ব তাকে মৃত এক লাশে পরিনত করলো । নিঃশ্বাস প্রঃশ্বাস স্বাভাবিক হলেও সেই প্রঃশ্বাসে যে বিষ মিশে আছে তা বিদ্যা বুঝতে পারে । বুঝতে পারে সেই বিষ বুকের ভিতর প্রবেশ করে এক অসহ্য জ্বালা দেয় । যার থেকে মুক্তি নেই । যতদিন এই নিঃশ্বাস প্রঃশ্বাস চলবে ততদিন এই বিষ বুকের ভিতর নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে । বিদ্যা ভাবে এক না একদিন দিব্যা তো বিয়ে করে ঠিক চলে যেত । না হয় এখনই চলে গেল । তো কি হয়েছে । তারপরেই বিদ্যার মনে এক পুরানো আশঙ্কার মেঘ জমতে থাকে । সে ভাবে এই সম্পর্কের পরিনতিও যদি আগের গুলোর মত হয় । এটাকেও যদি সে একটা খেলায় পরিনত করে । তখন !? না না তাহলে ও লিভিংয়ে যাওয়ার মত সিদ্ধান্ত নিত না ।

নিজের মনেই নানা আশঙ্কা , এবং প্রশ্ন উত্তরের খেলা শেষ হওয়ার পর প্রথমেই সে জানতে চাইলো হঠাৎ এই লিভিংয়ে যাওয়ার বুদ্ধিটা সে কোথায় পেল ? মেয়েকে খুব ভালো ভাবে জানে বিদ্যা । তার মেয়ে যে অন্যের দেখাদেখি অনেক কিছু করে সেটা বিদ্যা জানে । এই যেমন নার্সিংএ ভর্তি হওয়া । এটাও তো দিব্যা তার বান্ধবী সীমাকে দেখে করেছে । তাই বিদ্যার মনে হলো এই লিভিংয়ে যাওয়ার বুদ্ধিটাও দিব্যা নিশ্চয়ই কারোর থেকে পেয়েছে । সীমা দিব্যার ছোটবেলার বন্ধু। দিব্যার এমন কথা যা মা হয়ে বিদ্যার আগে থেকে জানার কথা ছিল সেই কথা গুলো সীমা তাকে জানিয়েছে। তাই দিব্যা চলে যাওয়ার পরেই বিদ্যা দিব্যার বেস্টফ্রেন্ড সীমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলো সবকিছু ।

সীমা তো সব শুনে আকাশ থেকে পড়লো , “ কি বলছো কাকিমা ! আমি তো এসবের কিছুই জানি না ! „

সীমার এই বিস্ময়ে বিদ্যাও বিস্মিত হলো । বিদ্যা বুঝতে পারলো যদি সীমা না জানে তাহলে আর কেউই জানবে না । পরের দিন থেকে বিদ্যা সকাল দুপুর রাতে মেয়েকে ফোন করে খবরা খবর নেওয়ার চেষ্টা করতো । প্রথম প্রথম দিব্যা রেগে গেলে এবং বিরক্ত হলেও পরে সে মায়ের ফোনের অপেক্ষা করতে শুরু করলো । দুই দিন পর বিদ্যা নিজের মনে শক্তি সঞ্চয় করে বললো , “ তোর ওকে ফোনটা দে তো । কথা বলবো । „

বিদ্যা অনেক সময় ধরে নিজেকে প্রস্তুত করলেও বিদ্যার মনে এক দ্বিধাবোধ এবং অসংকোচের কাঁটা খোঁচা দিয়ে তাকে মন খুলে কথা বলতে দিচ্ছে না । কিন্তু সেই দ্বিধাটা কি সেটা বিদ্যা বুঝতে পারলো না । বিদ্যা বললো , “ আমি দিব্যার মা বলছি । তোমরা কেমন আছো ? „

“ হ্যাঁ আমরা ভালো আছি । আপনি কেমন আছেন ? „

“ আমিও ভালো আছি । তোমরাও ভালো থেকো , সুখে থেকো । „ বিদ্যা এই আশীর্বাদ টুকু করা ছাড়া আর কিছু বলতে পারলো না ।

এর দেড় দুই সপ্তাহ পরেই বিদ্যা সেই সুখবরটা পেল । জগৎ সংসারে যে খবর সুখবর নামেই পরিচিত সেই খবর ব্যক্তি বিশেষে চিন্তা দুঃশ্চিন্তার কারনও হয়ে ওঠে । দিব্যা অন্তঃসত্ত্বা। বিদ্যা নিজের মনকে বোঝাতে চেষ্টা করলো । এটাই তো হওয়ার ছিল । এটাই তো স্বাভাবিক। প্রাপ্তবয়স্ক দুই নারী এবং পুরুষ একই ঘরে একই খাটে সহবাস করবে আর তাদের মধ্যে কিছুই হবে না এটাই তো অস্বাভাবিক।

এই ঘটনার পর থেকে দিব্যার কাছে তার ফোন করাটা বেড়ে গেল । নিয়মিত খাওয়া দাওয়া করছে কিনা , নিজের এবং সন্তানের যত্ন নিচ্ছে কিনা এসব জানাটা কয়েক ঘন্টা অন্তর অন্তর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো । যখন দিব্যার লিভিংয়ের তিন মাস অতিক্রম হতে যায় বা দিব্যার সন্তান ধারণের তিন মাস হতে যায় তখন বিদ্যা শুনলো দিব্যা এখনো নিয়মিত নার্সিংহোম যাচ্ছে ডিউটির জন্য। এটা আটকানোর জন্য বিদ্যা ঠিক করলো দিব্যাকে তার কাছে এনে রাখবে । কিন্তু দিব্যা আসতে নারাজ । তাই বিদ্যা বিক্রমকে বললো দিব্যাকে এখানে আনার কথা । বিক্রম ও রাজি হয়ে গেল এই প্রস্তাবে । দুজনের জোরাজুরিতেই দিব্যা আবার তার নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল ।

বিক্রমের মন আজ খুব প্রফুল্ল কারন সে এই প্রথমবার শশুড় বাড়ি যাচ্ছে । তাই সে রসগোল্লা , তিন প্রকার সন্দেশ , রাজভোগ আর লেডিগেনি কিনেছে ।  কিন্তু মনের ভিতর প্রফুল্লের থেকেও একটা চাপা দুঃশ্চিন্তা আছে । এই দুঃশ্চিন্তাটা সেদিন থেকেই বিক্রমের মনে জেঁকে বসে আছে যেদিন সে শুনেছে দিব্যার মা অর্থাৎ তার শাশুড়ির নাম বিদ্যা রায় । দুঃশ্চিন্তা মিটে এক নতুন গ্লানিময় অবসাদের জন্ম নিত যদি সে বিদ্যার ফটো দেখতে পেত । কিন্তু দিব্যার ফোনে তার মায়ের একটাও ফটো নেই । লিভিংয়ের প্রথম দিকে একবার বিদ্যার সাথে তার ফোনে কথা হয়েছিল । তখন সে দিব্যার কাছে তার মায়ের ফটো দেখানোর কথা বলেছিল । সবথেকে অবাক হয়েছিল এটা জেনে যে দিব্যার স্মার্ট ফোনে তার মায়ের একটাও ফটো নেই ।

ধর্মতলার রাজভবনের সামনে দিয়ে ডান দিকে ঘুরে এগলি ওগলি দিয়ে বিক্রম একটা সরু গলির মধ্যে ঢুকলো । একে গলি না বলে রাস্তাই বলা চলে । রাস্তাটা বেশি চওড়া না , একটা চার চাকা ঢুকলে কোন ভাবে একটা বাইক পাস দিয়ে যেতে পারে । গলির ভিতর ঢুকে একটা দোকানের সামনে দিব্যা গাড়িটা থামাতে বললো । দিব্যা বললো , “ আমি গেট খুলছি । „ তারপর পাশের একটা দোকান দেখিয়ে বললো , “ এটা আমাদেরই দোকান । „ বলে একটা বন্ধ দোকান দেখিয়ে দিয়ে দিব্যা গাড়ি থেকে নেমে গেল ।

বিক্রম দেখলো দোকানটার উপরে ধুলোয় মোড়া একটা পুরানো বোর্ড টাঙানো । তাতে বড় বড় অক্ষরে লাল কালি দিয়ে লেখা “ রায় বস্ত্রালয় । „ তার নিচে কালো কালি দিয়ে খুদে খুদে অক্ষরে লেখা “ এখানে মহিলাদের যাবতীয় পোশাক পাওয়া যায় । এবং সব ধরনের সেলাইয়ের কাজ করা হয় । „ বোর্ডটা অযত্নে ধুলো পড়ে আছে । দোকানটার ডান দিকে আছে লোহার বড় গ্রিল দরজা । আর দোকানটার বাঁ দিকে ফুটপাতের উপর একটা বিশাল কাঠ গোলাপ গাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে । গাছটার পাশে একটা কম বয়সী মেয়ে দাঁড়িয়ে তার গাড়ির দিকেই তাকিয়ে আছে । বিক্রম দেখলো মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা।

মেয়েটার মুখ ভালো করে দেখার আগেই দিব্যা গেট খুলে দিয়ে সাইডে দাঁড়িয়ে একবার ডাকলো । বিক্রম সুদক্ষ চালকের মত গাড়িটা সেই গেটটা দিয়ে ঢুকিয়ে দিল । কয়েক ফুট ভিতরে ঢুকিয়ে রায় বস্ত্রালয়ের দেওয়ালের গন্ডি পার করে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। দেখলো গাড়ির পিছনে তিন ফুট মত জায়গা আছে যাওয়া আসার জন্য। দিব্যা ততক্ষনে তুলসী তলা পেরিয়ে বাড়ির দরজা খুলে ঢুকতে ঢুকতে বললো , “ এসো । „

বিক্রম দিব্যার পিছন পিছন ঘরে ঢুকলো । দিব্যা বিক্রম কে বসতে বলে , “ মা „ । বলে একবার ডাকলো , “ মা কোথায় তুমি ? „

“ আসছি । „ বলে উপর তলা থেকে এক মহিলা কন্ঠের সাড়া পাওয়া গেল ।

বিক্রম বুঝলো এটা তার শাশুড়ির গলা । শাশুড়ির নিচে আসার আগে সে বাড়ির একতলাটা দেখতে লাগলো । বাড়িটা বেশ পুরানো । নিচের তলাতেই তিন চারটে ঘর আছে । আর বারান্দায় সোফা চেয়ার পেতে ড্রয়িংরুম বানানো হয়েছে । সোফা চেয়ার সব বেশ পুরানো ।

দিব্যার মুখে তার মায়ের নাম শোনার পর বিক্রম নিজের মনকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে এক নামের অনেকে থাকতেই পারে । দিব্যার মা তার বিদ্যা রায় হতেই পারে না । যাকে সে এত হণ্যে হয়ে খুঁজেছে সে এইভাবে তার শাশুড়ি হয়ে ফিরে আসবে এটা তার বিশ্বাস হয়না । কিন্তু নিয়তির হয়তো অন্য কিছু প্ল্যান ছিল । কিছুক্ষন পরেই উপর তলা থেকে যে মহিলা নিচে নেমে এলো তাকে দেখে বিক্রমের পায়ের নিচের মাটি সরে গেল । চোখে অন্ধকার দেখলো । এ কাকে দেখছে সে ! এই তো সেই মহিলা । যাকে সে পাগলের মত হন্যে হয়ে কলকাতায় চষে খুঁজে বেড়িয়েছে । প্রায় এক বছর ধরে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় খুঁজেও যাকে পাইনি সে আজ তার শাশুড়ি। হ্যাঁ এই মহিলাই বিক্রমের The woman .

বিদ্যা সিঁড়ি দিয়ে নেমে ঠাকুর ঘরে গোপালের সিংহাসনে গিয়ে হাতে ধরা ধূপকাঠি গুলো একটা কোনায় গুঁজে দিল । তারপর বাইরে আসতেই দিব্যার ঝাঁঝালো কথায় বিক্রমের হুশ ফিরলো , “ মা কি করেছো নিজের ? একটুও খেয়াল নাওনি নিজের ? „

দিব্যার কথায় এবার বিক্রম ভালো ভাবে দেখতে লাগলো । মাথার চুল রুক্ষ ধূসর , অনিদ্রার জন্য চোখের নিচে কালো দাগ আর অক্ষি কোটরে ঢুকে আছে । মুখে সেই এগারো বছর আগে দেখা লাবণ্য যেন হারিয়ে গেছে ।

দিব্যা শেষ কবে এইভাবে কথা বলেছে সেটা বিদ্যা মনে করতে পারলো না । হয়তো কখনো বলেইনি । এতোটা আন্তরিক তো দিব্যা তার সাথে কখনোই হয়নি । মেয়ের এই ধরনের কথায় এক মায়ের কোমল হৃদয় গলে গেল । বিদ্যা ভাবলো হয়তো এই তিন মাস লিভিংয়ে থাকার পর তার মেয়ের মন পরিবর্তন হয়েছে । লিভিং ও তো এক ধরনের সংসার। যেখানে দুই নরনারী একই ছাদের তলায় থাকে । হয়তো এত গুলো বছর আমি যেটা পারিনি সেটা বিক্রম করে দেখিয়েছে । হয়তো নিজেও মা হতে চলেছে তাই আর এক মায়ের কষ্টটা বুঝতে পারছে । বিদ্যা বললো , “ যার মেয়ে মাসের পর মাস মায়ের খবর নেয় না তার কি অবস্থা হবে বলে ভাবিস তুই ? „

“ তাই বলে তুমি নিজের যত্ন নেবে না । „

বিক্রম বুঝলো পরিস্থিতি উত্তপ্ত। কি করবে সে বুঝতে পারলো না । তাই সে বললো , “ আমি ব্যাগ আনছি । „ বলে বাইরে উঠোনে নেমে এলো । বাইরে এসেই খোলা আকাশে তাকিয়ে একটা বড় গভির দীর্ঘশ্বাস ফেললো , “ হে ঈশ্বর এ কি লীলা তোমার । যাকে এত গুলো বছর নিজের করে পেতে চেয়েছি আজ তাকে তুমি আমার শাশুড়ি বানিয়ে দিলে । „ বলে আর একবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো বিক্রম ।

ঈশ্বরের কাছে নিজের অভিযোগ জানিয়ে সে গাড়ির পিছনের ডিকি খুলে তার মধ্যে থেকে দুটো বড় সুটকেস আর একটা ব্যাগ বার করলো । সুটকেস দুটো দিব্যার আর ব্যাগটা বিক্রমের । জামা কাপড় আর কিছু অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছাড়া কিছুই আনেনি সে । ব্যাগ দুটো বার করে নিচে উঠোনে রাখলো , তারপর ডিকিটায় তালা লাগিয়ে দিয়ে ব্যাগ দুটো নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে এলো । ততক্ষণে মা মেয়ের উত্তপ্ত কথাবার্তা শেষ হয়ে এসেছে । বিক্রমকে সুটকেস আর ব্যাগ হাতে ঢুকতে দেখে বিদ্যা রান্নাঘরের পাশের ঘরটা দেখিয়ে বললো , “ এখানে রেখে দাও । „

বিক্রম সুটকেস আর ব্যাগ হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকলে বাইরে থেকে শুনতে পেল বিদ্যা বলছে , “ আমি দোকান খুলবো । কিছু খাবি তোরা ? „

দিব্যা বললো , “ না আমরা খেয়ে এসছি । তুমি দোকান খোলো । আমি ফ্রেশ হয়ে নিই । „ বলতে বলতে দিব্যা ঘরে ঢুকলো । বিক্রম সুটকেসটা মেঝেতে রেখে দিয়েছিল । দিব্যা একটা সুটকেস খুলে তার মধ্যে থেকে তোয়ালে বার করে নিয়ে বাইরে চলে গেল ।

দিব্যা চলে গেলে বিক্রম নিজের ব্যাগ থেকে একটা ছোট ডায়রি বার করলো । যেটাতে তার সোনার দোকানে জমানো টাকার হিসাব লেখা আছে । ডায়রির কয়েকটা পাতা উল্টিয়ে মাঝখানে রাখা একটা ফটো বার করলো । ফটোটা বেশ পুরানো ।

ফটোটার কথা দিব্যা জানেনা । বিক্রমই তাকে জানাইনি । ফটোটা একটা গ্রুপ ফটো । মোট ছয় জন আছে এই ফটোতে । মাঝে আছে এক মহিলা আর সেই মহিলার ডান দিকে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছেলে । ফটোর মহিলা হলো এগারো বছর আগের বিদ্যা আর তার ডান পাশে দাঁড়ানো ছেলেটা হলো এগারো বছর আগের বিক্রম । কি মনে হতে সে বিদ্যার বাম পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক পুঁচকে মেয়ের মুখ দেখলো । হ্যাঁ এই মেয়েটাই দিব্যা । তখন ওর কত বয়স হবে ! খুব জোর দশ কি এগারো । আর আজ সেই মেয়েটাই তার সন্তানের জননী।

মেয়েকে খাবারের কথা জিজ্ঞেস করে বিদ্যা উপরে নিজের ঘরে চলে এসেছিল । দুপুরে দোকান বন্ধ করে চাবিটা ভুল করে উপরেই নিয়ে চলে এসেছিল । চাবি আনতে উপরে উঠে কি মনে হতে দেওয়াল আলমারির এক তাক থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর গীতবিতান বইটা বার করলো । বিক্রম যখন নিচের তলায় ফটোর বিদ্যাকে দেখতে ব্যাস্ত তখন বিদ্যা সেই গীতবিতান বইটা নিয়ে আনমনে খাটে বসলো । একেবারে বইটার মাঝখানের একটা পৃষ্ঠা খুললো । দুই পৃষ্ঠার মাঝখানে আছে একটা শুকিয়ে যাওয়া গোলাপ ফুল । হ্যাঁ এই গোলাপ ফুলটাই এগারো বছর আগে বিক্রম তাকে দিয়েছিল । আজও সে এই ফুলটা সযত্নে রেখে দিয়েছে । ফুলটা শুকিয়ে ঝরঝরে হয়ে গেছে । একটু নাড়ালেই ধুলো হয়ে যাবে । বিদ্যা ফুলটার উপর আলতো করে নিজের নরম আঙুল স্পর্শ করলো , ঠোঁটে মিচকি হাসি হেসে মনে মনে বললো , ‘ আমিও কিরকম বোকা । এত বছর আগে ও কাকে না কাকে গোলাপ দিয়েছে ! সেটা কি আজও এত বছর পরেও কেউ মনে রাখে ? ,

বিক্রম যদি তাকে চিনতে পারতো তাহলে সে নিশ্চয়ই বলতো আপনাকে চেনা চেনা লাগছে কিংবা আপনি আমাদের আবাসিকে একবার এসেছিলেন। এরকম কোন কিছু ঘটেনি দেখেই বিদ্যা ঠিক করে নিল যে বিক্রমের তাকে মনে নেই , ‘ যাক ছেলেটার যে আমাকে আর মনে নেই এতে ভালোই হলো । দিব্যার জন্য আমাকেও ভুলতে হবে । ‚

বিদ্যা বইটা সাবধানে বন্ধ করে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুচকি হাসলো কতোই বা বয়স হবে তখন বিক্রমের ? ষোল কি সতেরো । ওইটুকু বয়সের কথা সে কি আজও মনে রাখবে ! বিক্রম যেমন তাকে গোলাপ দিয়েছিল তেমন দুষ্মন্তও তো শকুন্তলাকে আংটি দিয়েছিল । দুষ্মন্ত কি মনে রেখেছিল সে কথা ? অভাগা শকুন্তলাই সেটাকে ভালোবাসা ভেবে ভুল করে ছিল ।

ভুলে তো যাওয়া যায় না । এই ভালো খারাপ তেতো মিষ্টি স্মৃতি নিয়েই মানুষ বেঁচে থাকে । আমাকেও বাঁচতে হবে এই স্মৃতি নিয়ে । হোক না স্মৃতিটা মিষ্টি , কিন্তু যদি কেউ জানতে পারে তাহলে তো আমার মেয়ের সংসার গড়ার আগেই ভেঙে যাবে । না না এ হতে দিতে পারি না আমি । কথাগুলো ভাবতে ভাবতে তাঁর মুখটা আমাবস্যার অন্ধকারের মত কালো হয়ে গেল । কেউ জেন সেই মুখের শেষ প্রানবিন্দু টাকে শুষে নিয়েছে । এতক্ষণ কথা গুলো মনে মনে বললেও এবার সে মুখ ফুটে অস্ফুট স্বরে বললো , “ এই স্মৃতিটাও আমার মনের মণিকোঠায় লুকিয়ে রাখবো । কেউ জানতে পারবে না । কেউ না । „ বলে সে ঘরের লাইট বন্ধ করে দিয়ে নিচে নেমে এলো ।
[Image: 20220401-214720.png]
Like Reply


Messages In This Thread
RE: স্মৃতি সুন্দরী - by Bichitro - 25-08-2023, 07:21 PM



Users browsing this thread: 13 Guest(s)