Thread Rating:
  • 16 Vote(s) - 3.31 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
ভৌতিক গল্প সংকলন (সমাপ্ত)
#68
[Image: Polish-20230825-092743819.jpg]

|| সেই চোখ ||

লেখা :- অন্নপূর্ণা ঠাকুর চক্রবর্তী

অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছেনা অপর্ণা। হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে গেল মাঝরাতে। সারা শহর এখন ঘুমিয়ে আছে। একটা অলৌকিক পরিবেশ আচ্ছন্ন করে রেখেছে বাড়িটাকে।

খুব গরম লাগছে পলাশের বাহুবন্ধনে। পলাশ ওর যৌবনভরা বুকের ওপর হাত রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে।  যতক্ষণ পেরেছে ওকে উন্মত্তের মতো আদর করে অস্থির করে দিয়েছে।  এসিতে থেকেও অপর্ণা গলে,গলে নিজেকে সংযত রেখেছে ঠোঁট কামড়ে। তারপর ক্লান্ত হয়ে অপর্ণার খোলা শরীরটার ওপর হাত রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে।  ঘরের সংলগ্ন ছোট্ট ব‍্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় অপর্ণা। একটা ঠান্ডা বাতাস এসে ওর সারা শরীর জুড়িয়ে দিয়ে গেল যেন সহসা। এতক্ষণের দুর্বিসহ ক্লান্তি যেন এক নিমেষে শীতল হয়ে গেল।

চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো অন্ধকারে ডুবে গেছে গোটা শহরটা। আকাশে একফালি চাঁদ নিস্তব্ধ যেন। পাশাপাশি কয়েকটা বাড়ি প্রায় এক‌ই রকমের। হঠাৎ পাশের বাড়ির বারান্দায় একবিন্দু আলো লাল হয় জ্বলছে ধক্ধক্ করে। অপর্ণার দৃষ্টি সেদিকে যেতেই এক পুরুষ কন্ঠ শোনা গেল। অপর্ণাকে উদ্দেশ্য করে বললো বোধহয়, আপনি এতো রাতে দাঁড়িয়ে আছেন? অপর্ণা আন্দাজ করে নিয়ে বললো, আমাকে বলছেন! পুরুষ কন্ঠ বললো হ‍্যাঁ আপনাকেই বলছি।

তারপর নিজেই বললো, লোডশেডিং বলেই ঘুম আসছেনা বুঝি? অপর্ণা বললো, ঠিক বলেছেন। ভীষণ গরম লাগছিল তাই বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। আটফুট পার্থক্য মাত্র দুটো বাড়ির মাঝখানে। অন্ধকার ক্রমশ চোখ স‌ওয়া হয়ে যাচ্ছে। অপর্ণা দেখলো এক লম্বাকৃতি পুরুষ একটা পাতলা জামা গায়ে মনে হলো কিন্তু অবয়ব ছাড়া স্পষ্ট কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। শুধু ওই ধকধকে জলন্ত গোলাকৃতি   আলোটা ছাড়া। তার‌ই আলো অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছিল এতক্ষণ!
অপর্ণা ভাবলো ভদ্রলোক হয়তো স্মোক করছেন।
ভদ্রলোক অপর্ণাকে বললো, আপনার স্বামী কি ঘুমোচ্ছে? অপর্ণা বললো হ‍্যাঁ, উনি একটু ঘুমকাতুরে। আমার ঘুম আসছিলনা তাই… ভদ্রলোক যেন একটু হাসলেন। বললেন, আমিও প্রায় সারারাত জেগেই থাকি বলতে পারেন! রাতে আমার ঘুম হয়না। অপর্ণা কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, কোনো অসুখ….! কথাটা শেষ করার আগেই ভদ্রলোক বললেন না,না সেসব কিছু নয়। আসলে আমি রাতে ঠিক ঘুমোতে পারিনা।  

একাই থাকি, সঙ্গী বলতে ওই ছবির ক‍্যানভাস, আর বাবার আমলের এক বৃদ্ধ কেয়ার-টেকার।  আঁকা আমার নেশা। এভাবেই ভালো আছি।

অপর্ণাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনারা তো কদিন হলো ভাড়া এসেছেন এই বাড়িটায় কেমন লাগছে?
অপর্ণা বললো, ঠিকই আছে। ওর অফিসের কাছাকাছি বলেই এখানে আসা।

ভদ্রলোক একটা খোলা হাসি হাসলো এমন উচ্চস্বরে, নিঝুম রাত চিড়ে তাল মিলিয়ে একটা রাতজাগা পাখি যেন সামনে দিয়ে উড়ে গেল এক‌ই রকম বিকট সুরে। জলন্ত আলোটা কিন্তু ধিকধিক করে এক‌ইভাবে জ্বলছে অনেক্ষণ ধরে।

অপর্ণা শিহরিত হয়ে উঠলো। আচমকা একটা ভয়ে বুকটা ধক্ করে উঠলো। অপর্ণা ঘুরে দাঁড়িয়ে ঘরে চলে যেতে উদ্যোগ নিতে যাবে, এমন সময় ভদ্রলোক অদ্ভুত একটা আবেগের কন্ঠে ওর নাম ধরে ডাকলেন। ‘অপর্ণা’ আবেগটা এমন আকর্ষণীয় ছিল,অপর্ণা চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়ালো বিস্ময় হতবাক হয়ে;
অস্পস্ট অবয়ব তখনও ওই জলন্ত একটা আলো ছড়িয়ে মনে হলো ওর দিকেই চেয়ে আছে।
অপর্ণা ভয়ে ভয়ে বললো, আপনি আমাকে চেনেন? ভদ্রলোক বললেন নিশ্চয়ই! তুমি আমার আঁকার প্রেরণা; তোমার ছবিটা এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। তুমি আবার একটিবার আসবে আমার স্টুডিও ঘরে? অসম্পূর্ণ ছবিটা তাহলে সম্পূর্ণ করতে পারবো। ন‌ইলে যে আমার শান্তি নেই, মুক্তি নেই, যন্ত্রণা নিয়ে আজও অপেক্ষা করে আছি। এতদিন পর আমি আবার তোমার দেখা পেলাম।

অপর্ণা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল আমি!! আমি কখনো আপনাকে দেখিনি, চিনিনা! আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। লোকটি বললো, না…আমি বহুদিন অপেক্ষা করে আছি তোমার জন্য! আমি শান্তি পাচ্ছিনা। এমন সময় কারেন্ট এসে গেল। পলাশ বাইরে এসে দাঁড়ায় অপর্ণার পেছনে। পলাশ বললো, এখানে একাএকা দাঁড়িয়ে আছো কেন? চারিদিকে অন্ধকারে ডুবে আছে ভয় করছেনা!! অপর্ণা সামনের বাড়ির বারান্দার দিকে তাকিয়ে বললো, ওইযে ওখানে একজন ছিলেন আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন! কিন্তু আর দেখতে পেলনা সেই অবয়ব ছায়াছায়া মূর্তিটাকে! হয়তো পলাশকে দেখে চলে গেছে।
পরেরদিন ওই এক‌ই সময়ে অপর্ণাকে কে যেন বারান্দায় নিয়ে গেল। দেখল, অন্ধকারে সেই লোকটি দাঁড়িয়ে। অপর্ণাকে দেখে বলল, আমি জানতাম তুমি আসবে আবার।

অপর্ণা যেন অনুগত হয়ে গেল লোকটির কথায়। বললো, আমি সত্যি আপনাকে চিনিনা। লোকটি বললো, আমার সব ছবি তোমাকে নিয়ে। তুমি যদি আমার ঘরে আসো দেখতে পাবে সত্যি বলছি কিনা! অপর্ণা আজো লোকটিকে স্পষ্ট দেখতে পেলনা। অথচ রাস্তার আলোয় সবকিছু মোটামুটি দেখা যাচ্ছে। অপর্ণা বললো, আপনাকে ঠিকমত দেখতে পাচ্ছিনা আমি। লোকটি আবার হেসে বললো, তুমি একবার আমার বাড়ি এসো। আমি অপেক্ষা করবো তোমার জন্য। বলেই চলে গেল। কিন্তু কোথায় কিভাবে ফট করে চলে গেল অপর্ণার বোধগম‍্য হলোনা;
অপর্ণা বিছানায় ফিরে এলো। দেখলো পলাশ বেশ গাঢ়ো ঘুমোচ্ছে। ঘরের নীলাভ আলোটা যেন এক মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। খানিক্ষণ আকাশ পাতাল ভেবেও ছবি আঁকার সঙ্গে নিজে কখনো যুক্ত ছিল কিনা মনে করতে পারলোনা।

একদম ছোট বেলায় ড্র‌ইং করতো, সেতো সব বাচ্ছারাই করে থাকে। তবে…নাহ্ ভাবতে পারছেনা কিছুতেই, ওই লোকটার সাথে কখনো ওর জানাশোনা ছিল কিনা!

ভাবনায় বিঘ্ন হলো হঠাৎ পলাশের বাহু বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে; এরপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পারেনি।
পলাশ অফিসে চলে যাওয়ার পর অপর্ণার সময় কাটে কিছু রান্নাবান্না কিংবা ঘর সাজানো নিয়ে। দুপুরে পলাশের ফোন আসে কিছু খুনসুটি হয় ওর সাথে। তারপর ফেসবুক বন্ধুদের সাথে চ‍্যাটিং করে।
আজ ওসব কিছুই ভালো লাগলোনা অপর্ণার। বারবার ব‍্যালকনিতে যাচ্ছে আর পাশের বাড়িটা দেখছে। মনে হচ্ছে কেউ নেই বাড়িটায়। সারাদিনে কি একবারও ভদ্রলোক বারান্দায় আসেন না!! নিস্তব্ধতায় ভরে রেখেছে যেন বাড়িটাকে। উৎসুক মন বড় বিচিত্র হয় মানুষের। যেখানে রহস্য সেখানেই টান বেশি। অপর্ণার‌ও তাই হলো। অনেকবার মনকে বোঝালো, নাহ্ ও বাড়িতে যাবোনা! তবুও বড্ড আকর্ষণ অনুভব করছে মনেমনে। কি-যেন একটা অদৃশ্য চুম্বকের টান।

সন্ধ‍্যায় পলাশ অফিস থেকে আসার কিছুক্ষণ পর অপর্ণা বললো, এই শোনোনা একটা কথা; পলাশ ওকে জড়িয়ে ধরে বললো, একটা কেন অনেক কথা শুনবো।  চল একটু বাইরে কোথাও ঘুরে আসি।  চটপট সেজে নাও। দারুণ সাজবে কিন্তু, একদম ছবির মত!

অপর্ণা যেন চমকে উঠল বললো, ছবির মত কেন বললে?
পলাশ অপর্ণার গালটা টিপে দিয়ে বললো, আমার বৌকে সকলের চোখে সেরা দেখতে চাই! যেমন শকুন্তলা, উর্বসী, রম্ভা ওদের দেখে কেউ চোখ ফেরাতে পারেনা!

অপর্ণা বললো, শোনো আজ একটু পাশের বাড়ি বেড়াতে যাই চলো। পাশাপাশি থাকি একটু আলাপ পরিচয় করে আসি! তাছাড়া সেদিন রাতে আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা হয়েছে ভদ্রলোকের সঙ্গে।  আমাকে যেতে বলেছেন ওনার বাড়িতে। পলাশকে এর বেশি আর কিছু বললো না অপর্ণা। পলাশ কিছুক্ষণ ভাবলো বিষয়টা, তারপর বললো হঠাৎ গেলে যদি কিছু মনে করে ওরা? অপর্ণা বললো, না-না কিছু মনে করবেনা! ভদ্রলোক একাই থাকেন। বরঞ্চ খুশি হবেন আমরা গেলে।

অগত‍্যা,, পলাশ সুন্দরী স্ত্রীকে আদর করে বললো, চলো তাহলে যাই। তবে বেশীক্ষণ থাকবোনা ওখান থেকে বেরিয়ে হোটেলে খেয়ে আসবো।
অপর্ণা রাজি, দুজনে বেরোবার সময় কাজের মেয়েটিকে বলে গেল রাতে রান্না করতে হবেনা। দেরী হলে তুই খেয়ে নিবি।

ওরা পাশের বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াতেই একজন বয়স্ক ভৃত‍্য গোছের লোক দাঁড়িয়ে ছিল, যেন জানতো ওরা আসবে এমন ভাব করে। ওদের দেখেই বললো, এসো,এসো তোমাদের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছি। অপর্ণা একটু বিস্মিত হয়ে বললো, আমরা আসবো আগে থেকে জানতেন আপনি? বৃদ্ধ ঘাড় নাড়িয়ে পিটপিট চোখে চেয়ে মুখে মিটমিট হাসি হেসে বললো, আমি জানবোনা! আমিতো সেই কবে থেকে অপেক্ষা করে বাড়ি পাহারা দিচ্ছি তোমাদের জন্য বলেই হে,হে,হে করে হাসছে। পলাশকে দেখে বললো, দাদাবাবুর এতোদিনে তাহলে আসা হলো? অপর্ণা হতবাক;  কিন্তু পলাশ সহজ ভাবে চারিদিক চেয়ে চেয়ে দেখতে দেখতে বললো, হ‍্যাঁ…..। এরপর পলাশের আচরণ যেন অপর্ণাকে বিহ্বল করলো। পলাশ যেন অন্য জগতে চলে গেছে! নিজের বাড়ির মত এঘর ওঘর ঘুরে কি একটা খুঁজচ্ছে। অপর্ণা পলাশকে চুপিচুপি বললো, দাঁড়াও বাড়ির মালিককে ডাকতে বলি আগে। যিনি আমাকে আসতে বলেছিলেন! বলেই, অপর্ণা বৃদ্ধকে বললো, আপনার মালিককে বলুন আমরা এসেছি ওনার সঙ্গে দেখা করতে। বৃদ্ধটি অবাক হয়ে বললো, মালিকতো আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে বৌমনি! ততক্ষণে পলাশ একটা পুরনো ফুলদানী দেখিয়ে বললো, এটা একটু ঝাড়পোছ করতে পারনি কেউ? এতো ধুলো জমেছে! বলতে বলতে ঘরের সমস্ত জিনিস দেখে উত্তেজিত হয়ে গিয়ে বলছে, কি নোংরা করে রেখেছে সব। আমি একদম নোংরা পছন্দ করিনা জানোনা? বৃদ্ধ ভৃত‍্যটি অপরাধীর মতো মুখ করে বলছে আমার বয়স হয়েছে আমি এত কাজ করতে পারিনা দাদাবাবু।

পলাশ হঠাৎ দোতলার একটা ঘরের সামনে গিয়ে দরজাটা ঠেলে খুলে দিল। বৃদ্ধটি হাসি মুখে বললো, এইতো দাদাবাবুর পছন্দের ঘরে এসেছে এতদিন পরে একবারে বৌমনিকে সঙ্গে নিয়ে! অপর্ণা দুজনের আচরণে অবাক, বিস্ময়কর  অবস্থার মধ্যে রয়েছে। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। একটা দুর্গন্ধ বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। বহুদিন ব‍্যাবহার হয়নি ঘরটা গুমোট ভ‍্যাপসা নোংরা মনে হলো।  পলাশ মরিয়া ততক্ষণে। অপর্ণা পলাশকে রুখতে পারছেনা। পলাশের যেন সবকিছু চেনা; দরজার পাশে হাত বাড়িয়ে লাইটের সুইচ টিপে দিল, কিন্তু লাইট জ্বললোনা। পলাশ বিরক্ত হয়ে ঘরের একটা কোনে টেবিলের ড্রয়ার থেকে মোমবাতি আর দেশলাই বার করে জ্বালিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘরটা একটা রহস্যময় আলোকিত হয়ে গেল। অপর্ণা দেখলো ঘরের চারিদিকে ক‍্যানভাস ঢাকা দেওয়া কাপড়ে। দুটো টেবিল, একটা ছোট যেখান থেকে পলাশ মোমবাতি নিল, আর‌ও একটা বড় টেবিল তাতে শুকিয়ে যাওয়া রঙের কৌটো, তুলি, প‍্যালেট, ব্রাশ আরো নানান রকম আঁকার সরঞ্জাম। সব‌ই অতি প্রাচীন ধূলো-ময়লার আস্তরণ পরে আছে। অপর্ণার গা-ছমছম করছে এতক্ষণে। পলাশকে ডাকছে পলাশ যেন অন্য জগতে তখন। অপর্ণা বলছে চলো আমরা বেরিয়ে যাই এই বাড়ি থেকে। পলাশ বলছে দাঁড়াও একটু, তোমাকে সেদিন বললামনা আমার একটা ছবি অসম্পূর্ণ রয়েছে! সেটা শেষ করতে হবেতো! এই বলে রঙ তুলিগুলো নাড়াচাড়া করছে। এবার অপর্ণা সত্যিই ভয় পেয়ে গেল। সেই বৃদ্ধ ভৃত‍্যটিকেও আর দেখতে পাচ্ছেনা। পলাশকে যেন নিজের মনে হচ্ছেনা! ভালো করে পলাশের মুখটা দেখতেও পাচ্ছেনা। শুধু একটা লাল গোলাকৃতি আলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।

অপর্ণার গলা শুকিয়ে আসছে বদ্ধ ঘরটার মধ্যে। সন্ধ‍্যেবেলায় বাড়িটা অদ্ভুত রকমের অন্ধকারে গ্ৰাস করে রেখেছে। প্রচন্ড গরমে আর ভয়েতে অপর্ণা ঘেমে গেছে। পলাশকে ভয়ার্ত কন্ঠে ডেকে বলছে, পলাশ চলো আমরা পালাই। মনে হচ্ছে এখানে কোনো অশরীরী আত্মার বাস। আমার খুব ভয় করছে। না এলেই ভালো হতো!

মোমবাতির আলোয় পলাশকে সেদিনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির মতো দেখাচ্ছে যেন। অচেনা পলাশ। হঠাৎ একটা ক‍্যানভাসের ঢাকনা সরিয়ে দিয়ে তার সামনে মোমবাতিটা তুলে ধরতে‌ই অপর্ণা চিৎকার করে উঠলো, না…..কে ইনি কে! এতো আমার‌ই ছবি! নগ্ন অবস্থায় অর্ধেক উপুর করে শায়িত!  চোখে-মুখে কামনার হাসি! পলাশ একটা অবয়ব ছাড়া এখন আর কিচ্ছু নয়। সেই অবয়ব থেকে একটা বিকট হাসিতে সারাঘর ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। অপর্ণা কান্নায় ভেঙে পড়ল। সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে গিয়ে গলায় স্বর বেরোচ্ছেনা কিছুতেই।

পলাশের কন্ঠস্বরটাও বদলে গেছে মনে হলো ভয়ংকর রকমের। পলাশ একটা বীভৎস গলায় বললো, দেখ অপর্ণা, আমার এই ছবিটা এখনো অসম্পূর্ণ রয়েছে। শুধু তোমার জন্য। অপর্ণা বললো, না…আমি ন‌ই অন‍্য কেউ ছিল হয়তো আমার মতো দেখতে! তাছাড়া তুমি তো আমার স্বামী, তুমি কেন বুঝতে পারছোনা এটা আমাদের বাড়ি নয়! চলো আমরা পালাই এই অভিশপ্ত বাড়ির থেকে। পলাশ ততধিক হেসে বললো, না অপর্ণা, এটাই আমার বাড়ি। আমার আত্মা সেদিন তোমাকে বারান্দায় অন্ধকারে দেখে চিনতে পেরেছিল।
শোনো আমি ছিলাম এই বাড়ির এটমাত্র ছেলে। ছবি আঁকা ছিল আমার নেশা। তুমি ছিলে আমার ছবির মডেল। তোমাকে আমি একটা বস্তি থেকে পেয়েছিলাম। প্রায় সত্তর বছর আগে। তোমার রূপে আমি মুগ্ধ হয়ে তোমার বাবার কাছ থেকে অনেক টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছিলাম। তোমার বাবা নেশারু ছিল। টাকার বিনিময়ে মেয়েকে বেচে দিয়েছিল বড়লোক এক লম্পটের কাছে। আমি তোমাকে আলাদা একটা বাড়ি ভাড়া করে রেখেছিলাম আর সেটাই এই বাড়ি! আমি তোমাকে মডেল বানিয়ে ছবি আঁকতাম। তোমার মনে পড়ছে? অপর্ণা কান্নায় ভেঙে পড়ছে অথচ গলায় শুধু গোঙানী ছাড়া কোনো আওয়াজ বেরোচ্ছেনা। পলাশ বলে চলেছে .. সেদিনের সেই বৃষ্টির রাতে তুমি এইভাবে বলে ছবিটার দিকে দেখিয়ে বললো, এই ভঙ্গিতে ছিলে। আমি তোমাকে দেখে নিজেকে স্থির রাখতে না পেরে, তোমার শরীর উপোভোগ করতে উদ‍্যত হ‌ই! তুমি আমাকে বাধা দিতে চেষ্টা কর! আমি তোমার ওই লাবন‍্য মাখা শরীরের সুধারস পান করতে করতে আচ্ছন্ন হয়ে মরিয়া হয়ে গিয়েছিলাম। তুমি আমাকে সেদিন ঘৃণা করে আহত করেছিলে! যখন তোমার ওষ্ঠ আমার অষ্ঠকে উত্তাপ করছিল, তখন তোমার তর্জনীর তীক্ষ্ণ ধারালো নখ আমার এই বাঁ-চোখের মধ্যে গুঁজে দিয়েছিলে। সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখ থেকে রক্ত পড়তে লাগলো। তোমাকে ছেড়ে দিলাম আমার কবল থেকে। তুমি ছুটে ঘর থেকে পালিয়ে গিয়েছিলে। যাবার আগে বলে ছিলে লম্পট;  তোমার মৃত্যু কামনা করছি তোমার মৃত্যু সংবাদ যেদিন পাবো, সেদিন আমার শান্তি হবে। আর কখনো আমাকে পাবেনা। তখন আমার উনত্রিশ বছর তোমার ছাব্বিশ। আমিও বলেছিলাম তুমি যতদূরেই যাওনা কেন, একদিন ঠিক তোমাকে আমি এখানে নিয়ে আসবোই! কেননা আমার ছবিটা এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। এই জনমে না পেলেও পরের জনমে আমি তোমাকে ঠিকই পাবো। এখন আমার উনত্রিশ, তোমার ছাব্বিশ। পলাশ হঠাৎ অপর্ণাকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটের ওপর নিজের ঠোঁট চেপে ধরল। অপর্ণার শরীর প্রায় অবশ হয়ে যেতে লাগলো উষ্ণতায় নয়, শীতলায়। কি সাংঘাতিক ঠান্ডা অধর পলাশের। এরপর অপর্ণাকে বিবস্ত্র করার জন্য জোর খাটাতে ধস্তাধস্তি করছে। অপর্ণা বুঝতে পারছে পলাশের শরীরে কোনো অশরীরী আত্মা ভর করেছে। কিন্তু কি করবে কিছু বুঝতে পারছেনা। পলাশকে কিছুতেই বোঝাতে পারছেনা ওই ছবিটা ওর নয়। হঠাৎ মনে হলো তবেকি ওই ছবির মেয়েটির নাম‌ও অপর্ণা ছিল! পলাশ তো অপর্ণা বলেই ডাকছে! তাহলে আমি কি আগের জন্মে এরকম ছিলাম! কিন্তু আমার তো কিছু মনে পরছেনা! না-না এটা কখনো হতে পারেনা!

হঠাৎ অপর্ণা দেখলো মোমবাতির আলোটা কেঁপে উঠছে থিরথির করে। প্রায় শেষের হয়ে যাবার দিকে! ও কোনোরকমে হাত বাড়িয়ে বাতিটা তুলে নিল নিজের হাতে! এরপর সজোরে ছুঁড়ে মারল ছবিটার ওপর। এতোদিনের পুরনো ক‍্যানভাস শুকনো মরমরে হয়ে গেছে। তাই মোমবাতির আগুনে ধপ করে জ্বলে উঠলো ক‍্যানভাসটা। মুহূর্তের মধ্যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পরপর সমস্ত ছবিগুলো দাউদাউ করে জ্বলছ। তাতেই যেন এক বিস্ময়কর পরিস্থিতি তৈরী হতেই, পলাশের গায়ের জামাটা বাঁদিকটা ধরে গেল। তাই দেখে অপর্ণা পলাশের হাতের কব্জিটা ধরে টানতে টানতে ঘরের বাইরের দিকে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। আশ্চর্য ভাবে পলাশের চোখেমুখে একটা ভয়ের ছাপ পরেছে যেন। দেহ‌ও অনেকটা শিথিল। এই সুযোগে অপর্ণা পলাশকে হিরহির করে টেনে ঘরের বাইরে নিয়ে এলো এবং অনেক কষ্টে বহুক্ষণ চেষ্টার পর একেবারে বাড়ির বাইরে বার করে আনলো।
ততক্ষণে পলাশ আবার যেন আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেছে। উদভ্রান্তের মতো চারিদিকে চেয়ে আছে যেন পৃথিবীটাকে নতুন করে দেখছে! অপর্ণা পলাশকে বললো তুমি ঠিক আছোতো? পলাশ স্বাভাবিকভাবেই বললো কেন আমি তো ঠিকই আছি।

এরপর অপর্ণার ঘুমটা আচমকা ভেঙে যেতেই দেখলো পলাশ ওকে বুকের মধ্যে জাপটে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ঘরের বেডলাইটটা যেন একটা নীল আতঙ্কের সংকেত দিচ্ছে নিস্তব্ধ নিঝুম ভোর রাতে! অপর্ণা ভয়ে পেয়ে পলাশকে আঁকড়ে ধরল চেপে।

পরের দিন রবিবার ছিল। অনেক বেলায় ঘুম ভাঙল দুজনের। কাজের মেয়েটি ডাইনিং হলে চায়ের কাপ রেখে ডেকে বললো, জানো বৌদি-কাল রাতে পাশের ওই বাড়িটায় হঠাৎ আগুন লেগে গেছে! প্রতিবেশীরা দমকলে খবর দিয়ে তবে আগুন নিভিয়েছে। দেখ এখনো পুলিশভ‍্যান  দাঁড়িয়ে বাড়িটার সামনে। একজন বয়স্ক চাকর ছিল সেও ঘুমের মধ্যে আগুনে পুড়ে মারা গেছে।

অপর্ণা অবাক বিস্ময় ছুটে এলো বারান্দায়। দেখলো সত্যিই বাড়িটার অনেকটা পুড়ে গেছে। আবছা আবছা মনে পরছে গতকাল রাতের স্বপ্নের কথা! তবেকি…….!!
ততক্ষণে পলাশ ওর পাশে এসে দাঁড়ায়। এবং আফসোস করে বলে ইস্ বয়স্ক মানুষটা বোধহয় একাই থাকত! এরপর পলাশ বাইরে বেরিয়ে সমস্ত খবর সংগ্ৰহ করে আনলো। বাড়িটায় বহুদিন কোনো লোকজন ছিলনা, ইলেকট্রিক লাইন কেটে দিয়েছে একজন বয়স্ক চাকর গোছের লোক বাড়িটা আঁকড়ে পরে থাকতো। গতকাল রাতে হয়তো মোমবাতির আগুনে একটা ব‌ইয়ের বা অন্য কোনো সামগ্ৰীর ঘর থেকে আগুন ছড়িয়ে পরে গোটা বাড়িটা পুড়ে গেছে। পুলিশ তদন্ত করছে ব‍্যাপারটা।

অপর্ণার অবাক দৃষ্টি পলাশের চোখের ওপর নিবদ্ধ হয়ে আছে।  পলাশের বাঁদিকের চোখটা কেমন যেন লাল হয়ে ফোলা ফোলা লাগছে। তবেকি সেই চোখ……!!

|| সমাপ্ত ||

[Image: Shocked-Open-Asianpiedstarling-size-restricted.gif]

[+] 6 users Like Sanjay Sen's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: ভৌতিক গল্প সংকলন (চলছে) - by Sanjay Sen - 25-08-2023, 11:39 AM



Users browsing this thread: