Thread Rating:
  • 16 Vote(s) - 3.31 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
ভৌতিক গল্প সংকলন (সমাপ্ত)
#55
পিউর কণ্ঠস্বর শুনেই সারা শরীরে একটা অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল হৃষিতার। চারিদিকে যতদূর চোখ যায় কুয়াশা মাখা নিঃশব্দ অন্ধকার। বিলের হিমশীতল জল কামড় বসাচ্ছে ওর পায়ে। 

আর ওর সামনে কয়েক হাত দূরত্বে দাড়িয়ে আছে আজ ছয় মাস আগে আত্ম হত্যা করা ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু! হৃষিতার হাতে ধরা টর্চের আলোটা ওর হৃদপিণ্ডের মতন মুহুর্মুহু স্পন্দিত হচ্ছে। সেই কেঁপে কেঁপে ওঠা আলো কুয়াশার স্তর ভেদ করে গিয়ে পড়ছে পিউর শরীরে!

  হ্যাঁ কোনো ভুল নেই, এই তো পিউ। ওর সারা শরীর বেয়ে টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ছে জল। ভেজা চুলগুলো ঢেকে রেখেছে মুখের বা দিকটা। আর চোখদুটো...চোখ তো কখনও মিথ্যে বলে না! এ তো সেই চোখ যা দেখতে দেখতে বড় হয়েছে হৃষিতা, শুধু আজ চোখদুটোয় এক অদ্ভুত গা শিরশিরে দৃষ্টি। 

-" হৃষু! আমায় দেখে ভয় পাচ্ছিস?" - জলের উপর ছপাত ছপাত শব্দ করে পিউ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে হৃষিতার দিকে।

-" না, ভয় না...কিন্তু তুই সত্যি ফিরে এসেছিস! আ...আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।"- বিলের উপর দিয়ে অতি ধীর লয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। সেই শিরশিরে হাওয়া যেন হৃষিতার ঘাড়ের কাছটায় আঙুল বুলিয়ে দিয়ে গেল। সারা শরীরটা এক লহমায় কেঁপে উঠল ওর। 

-" হ্যাঁ, খুব কষ্ট হয়েছে বিশ্বাস কর ফিরে আসতে...তবু তুই ডাকলি বলেই আসতে হল। তোর ডাকে সাড়া না দিয়ে পারি বল। তুই আমার সেই কবেকার বন্ধু।"- পিউ এগোতে এগোতে হৃষিতার খুব কাছে এসে দাঁড়াল। 

 ওর শরীর থেকে একটা অদ্ভুত ঝাঁঝালো গন্ধ বেরোচ্ছে। গলার কণ্ঠস্বরটাও মাঝে মধ্যে কেমন যেন ঘ্যাসঘ্যাসে হয়ে যাচ্ছে, যেন কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। হৃষিতাই এইবার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল, " পিউ বল দেখি তোর আমার যেদিন প্রথম দেখা সেদিন কী হয়েছিল?"

-" ঝগড়া হয়েছিল। ক্লাস ওয়ান। সেন্ট নিনিয়ানস। তোর হাত লেগে আমার টিফিন পড়ে গেছিল মাটিতে। খুব ঝগড়া হয়েছিল সেইদিন। আমাদের বন্ধুত্ব ঝগড়া দিয়েই শুরু!"- পিউর কণ্ঠস্বর আস্তে আস্তে যেন ধাতস্থ হচ্ছে। 

-" ক্লাস টেনে যে অঙ্কে বেশি পেয়েছিল? তুই না আমি?" 

-" কেউ না। দুজনেই এক। উন আশি। এক নম্বরের জন্য লেটার হয়নি বলে দুজনেই মুখ গোমড়া করে বসেছিলাম সারাদিন।" 

  হৃষিতা টর্চের আলোয় আবারও ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে পিউকে। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় শেষ প্রশ্ন করে, " তিন তিন শূন্য মানে কী বল?" 

 পিউ যেন বহু কষ্টে মলিন হাসি হাসে। তারপর বলে, " ওটা অরিন্দমের কোড নেম। ওর ফোনের লাস্ট তিনটে ডিজিট। অরিন্দম তোর প্রথম প্রেমিক যে তোকে ঠকিয়েছিল বলে ক সারারাত আমার বাড়ি বসে কেঁদেছিলি।" 

-" পিউ তুই সত্যি ফিরে এসেছিস!"- এইবার নিজের চোখের জল আর ধরে রাখতে পারল না হৃষিতা। হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল, " পিউ তুই এমন কেন করলি! সেই ক্লাস ওয়ান থেকে আমরা দুজন বন্ধু। একসঙ্গে ওঠা বসা খাওয়া সমস্ত কিছু। তুই একবারও আমাকে বললি না!" 

 পিউ নিশ্চুপ। কোনো কথা নেই। চামড়ির বিলে মৃদু মন্দ গতিতে বয়ে যাচ্ছে শীতল হাওয়া। হৃষিতা আবারও ডুকরে উঠল, " পিউ একবার...একবার আমাকে তোর সমস্ত সমস্যার কথা বলতে পারতিস। আমি আমার সবটা দিয়ে চেষ্টা করতাম তোকে বের করে আনতে!"

-" সম্ভব ছিল না রে...আমি একটা চোরাবালিতে আটকে গেছিলাম। সেখান থেকে বেরোনো এতটা সহজ ছিল না। বাদ দে না সেসব কথা...যা হয়ে গেছে তা তো আর বদলানো যাবে না..."- পিউর কথায় এক রকম হতাশার সুর।   

 আচমকাই পিউর সারা শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠল যেন। পরক্ষণেই ও বলল, " খুব খিদে পাচ্ছে রে হৃষু, আমার জন্য কিছু খাবার এনেছিস? ওই দুনিয়া থেকে এই দুনিয়ায় আসতে বড় কষ্ট..." 

-" খাবার! না খাবার তো কিছু..."- হৃষিতার বুকটা কেমন কেঁপে উঠল পিউর জন্য। ওর কী সত্যিই প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে? 

-" মনে আছে হৃষু, কাকীর হাতের পায়েস খেতে কী ভালোবাসতাম আমি। তোর জন্মদিনের আগের দিন থেকে তোদের বাড়িতে আমার নিমন্ত্রণ থাকত। কাকিমা কত ভালো ভালো রান্না করত..." 

-" মা খুব ভেঙে পড়েছিল পিউ।"- হৃষিতার গলাটা কেঁপে ওঠে। " তোর চলে যাওয়াটা মা একদম মেনে নিতে পারেনি। সেই ছোট থেকে আমাদের বাড়িতে তোর আসা যাওয়া। মা তোকে আমার বোনের মতই দেখত। সেই তোর খবরটা যখন এল...মা দুদিন কিছু খায়নি জানিস। শুধু বলত মেয়েটা অমন করে চলে গেল...একবারও কাউকে বলল না!" 

  হৃষিতার দুই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জলের ধারা। ইতিমধ্যেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পিউর শরীরটা আরেকবার যেন ঝাকুনি দিয়ে উঠল, " খুব খিদে পাচ্ছে... খুব তেষ্টা পাচ্ছে...এখানে আসলে এতটা কষ্ট হবে বুঝিনি।"

-" সত্যিই তোর খুব কষ্ট হচ্ছে?" -" হৃষিতা খেয়াল করল সত্যিই পিউর শরীরে একটা চাপা অস্বস্তি যেন জমাট বেঁধে উঠছে। 

-" হ্যাঁ হচ্ছে কিন্তু ঠিকাছে। তোর জন্য এটুকু করতেই পারি। এমনিও আজকের রাতটাই তো শেষ রাত।" 

-" কিসের শেষ রাত?"- হৃষিতা যেন অবাক হয়ে প্রশ্ন করে। 

-" তোর আর আমার দেখা হওয়ার বুদ্ধু! আর কখনও কী তোর আমার এভাবে দেখা হবে?"- পিউর কিছু একটা যে সমস্যা হচ্ছে সেটা হৃষিতা বেশ বুঝতে পারছে। কথাগুলো বলতে বলতে কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠছে ও। মাঝে মাঝে গলার স্বর ঘ্যাসঘ্যাসে হয়ে যাচ্ছে। 

-" আমাদের ছোটবেলার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে হৃষু? এক সঙ্গে সেই কলেজে যাওয়া, গল্প করা, আড্ডা দেওয়া। একসাথে দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা। ক্লাস নাইনে প্রথম প্রেমে পড়া। তোর প্রেমিকের চিঠিগুলো আমি এনে দিতাম তোকে..."

   পিউর কথাগুলো শুনতে শুনতে অতীতের রঙিন দিনগুলোর ছবি উড়ে উড়ে আসছিল হৃষিতার চোখের সামনে। সেই ছোটবেলা, সেই বন্ধুত্ব, একে অপরকে একদিনও না দেখতে পেলে হাফিয়ে ওঠা। পিউর সঙ্গে একসঙ্গে কাটানো ওর কিশোরী জীবনের হাজারও স্মৃতি...

  এসব কথাই ভাবতে ভাবতে আর পিউর কথা শুনতে শুনে  কোথায় যেন হারিয়ে গেছিল হৃষিতা। আচমকা ওর সম্বিৎ ফিরল একটা পাখির তীব্র চিৎকারে। এটা সেই ডাহুক পাখির ডাক না? একবার...দুবার...তিনবার! 

  হৃষিতার সারা শরীরে যেন শীতল শিহরণ খেলে গেল। এই পাখি তিনবার ডাক দিলেই তো ওর ফিরে যাওয়ার কথা। তেমনটাই তো বলেছিল ডিঙির লোকটা। তাহলে...

-" পিউ আমায় এবার যেতে হবে রে...তুই ভালো থাকিস..."- হৃষিতা আরও কিছু বলবার আগেই পিউ এইবার এগিয়ে এসে ওর হাতটা চেপে ধরল, " এত তাড়াতাড়ি চলে যাবি হৃষু? আমি এত কষ্ট করে তোর জন্য এলাম। আর কিছুক্ষণ দাড়িয়ে যা প্লিজ..." 

  পিউর কণ্ঠে এমন এক করুণ আর্তি ফুটে ওঠে যে তাকে না করতে পারে না হৃষিতা। আমতা আমতা করেই ও বলে, " কিন্তু ডিঙি ফিরে গেলে আমি যে আর পৌঁছতে পারব না!"

-" কেন পারবি না?"- পিউর গলায় একটা ছদ্ম রাগ ফুটে ওঠে, যেমন রাগ খুব কাছের বন্ধুকে না ছাড়তে চাইলে মানুষ দেখায়, তেমনটাই, " আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তো ভোরের আলো ফুটে যাবে। এখানে অনেক ডিঙি আসে শাপলা ফুল তুলতে। যে কোনো একটা ডিঙ্গিতে উঠে পড়বি।"

  পিউর গলা এইবার আগের থেকে আরও বেশি ঘ্যাসঘ্যাসে শোনায়, " আর কিছুক্ষণ থাক না হৃষু, এই তো শেষবার। আর তো কখনও কিছু চাইতে পারব না তোর কাছে। ভোর হলেই আমায় ফিরে যেতে হবে।" 

  হৃষিতা কী করবে কিছুই ভেবে পায় না। একদিকে পিউর করুণ আর্তি অন্য দিকে ডিঙির সেই লোকটার বলা কথাগুলো। কী করা উচিৎ ওর? সময় যে চলে যাচ্ছে...

-" আমায় ছেড়ে যাস না হৃষু, আর কিছুক্ষণ থাক প্লিজ, খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে তোর সাথে..."- পিউ আগের থেকে অনেকটা সামনে এগিয়ে এসেছে। ওর হাতদুটো বরফের মতন ঠাণ্ডা। 

 পিউর করুণ চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে শেষমেশ হার মানে হৃষিতা। নৌকা ফিরেই যাক বরং। আর কিছুক্ষণ ও না হয় এখানেই থাকল। সত্যিই তো আর তো কোনদিন পিউর সঙ্গে দেখা হবে না। আর এ তো মজা বিল। ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনাও নেই অগত্যা....

 ঘন কুয়াশার মধ্যেই একটা টিমটিমে লণ্ঠনের আলোকে ক্রমশ ছোট থেকে ছোট হতে দেখল হৃষিতা। তারপর একসময় ওর চোখের সামনেই ধোঁয়াটে কুয়াশার পেটের ভেতর কোথায় যেন সেই আলো অদৃশ্য হয়ে গেল। পড়ে রইল শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। 

-" খুব খিদে পাচ্ছে...উফ কি প্রচন্ড তেষ্টা...তোর কাছে কী কিছু নেই হৃষু?"- পিউর শরীরটা এইবার আগের থেকে যেন বেশি ঝাঁকুনি দিচ্ছে। ঠিক যেন ওর শরীরের ভেতর একরকম প্রলয় কাণ্ড চলছে। 

-" না কিছু তো আনিনি...তোর যদি খুব কষ্ট হয় তুই ফিরে যেতে পারিস। তোর শেষবারের মত দেখতে পেয়েছি এই অনেক।"- হৃষিতার এইবার সত্যি কষ্ট হচ্ছে পিউর জন্য। 

-" ফিরব! ফিরব বলে তো আসিনি। তোর কাছে এসেছি তোকে নিতে..."- আচমকাই পিউর কণ্ঠ স্বরটা কেমন যেন বদলে গেল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হল খুব কর্কশ স্বরে কথাগুলো বলে উঠল কেউ। 

-" কী বলছিস পিউ? আ...আ...আমি নিবি বলে এসেছিস মানে?"

 পিউ এইবার মাথাটা পাগলের মত দুলিয়ে খিলখিল করে হেসে ওঠে। ওর আচরণে একটা অস্বাভাবিকতা আসছে আস্তে আস্তে। তাই না?

-" ভয় পাচ্ছিস? নিজের বন্ধুকে ভয় পাচ্ছিস! আমি তো মজা করছিলাম।"- আবারও খিলখিল করে হেসে ওঠে পিউ, পরক্ষণেই আবার বলে, " উফ! গা হাত পা কী চুলকাচ্ছে, কেমন জ্বালা করছে শরীরটা। মনে গায়ের চামড়া ছিঁড়ে উপড়ে ফেলি... এই বিলে এমনিতেও মানুষের চামড়ার তো অভাব নেই।" 

  কে জানে কেন হৃষিতার বুকের ভেতরটা কেমন অস্বস্তি জমাট বেঁধে উঠছে। ওর কী ফিরে যাওয়া উচিৎ ছিল। ও কী ফিরে যাওয়ার ডাক উপেক্ষা করে ভুল করল? পিউর কথাবার্তাও আস্তে আস্তে কেমন যেন অদ্ভুত শোনাচ্ছে ওর। 

-" পিউ...এমন অদ্ভুত কথা বলছিস কেন তুই! আমার খুব ভয় লাগছে..."

 হৃষিতাকে চমকে দিয়েই পিউ সারা শরীর দুলিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতেই কেমন যেন উন্মাদ গ্রস্তের মত বলল, " আসলে খুব খিদে পাচ্ছে রে হৃষু, প্রচন্ড খিদে। কতদিন খাই না...রক্ত রক্ত রক্ত...তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গেল।"

-" রক্ত! তেষ্টা! এসব কি বলছিস তুই পিউ! কী হয়েছে তোর?"- হৃষিতার বুকের ভিতর এইবার একটা অজানা আশঙ্কা ক্রমশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। 

-" পিউ? এই পিউ? তুই..."

-" হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ...আমি পিউ...আমি আমিই পিউ...এতকিছু বললাম তাও বিশ্বাস হল না আমিই পিউ!"- প্রচন্ড কর্কশ স্বরে চিৎকার করে উঠল পিউ। সেই ঘ্যাসঘ্যাসে কণ্ঠস্বরে কোনো কোমলতার ছাপ নেই। তার বদলে এক অদ্ভুত হিংস্রতা! 
  
  পিউর কথা শুনে সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল হৃষিতার। ওর মনে একটু আগেও যেই আশঙ্কাটা উঁকি দিচ্ছিল, এইবার ক্রমশ সেটা জোরালো হচ্ছে যেন।

-" না না মনে মনে তুই য়া ভাবছিস সেটা সত্যিই না। আমি পিউ! আমি সত্যিই পিউ!"- জলের উপর ঝপাং ঝপাং করে পা ফেলে উন্মাদ গ্রস্তের মত হৃষিতার দিকে কেমনভাবে এগিয়ে আসছে পিউ। 

 কেন হৃষিতার ভয় লাগছে? কেন এই মুহূর্তে হৃষিতার বারবার মনে হচ্ছে ওর সামনে যে দাড়িয়ে তাকে হুবহু পিউর মত দেখতে হলেও...

-" হৃষু...ভয় করছে? আমায় তোর ভয় করছে?"- একটা জায়গাতেই দাড়িয়েই এইবার সারা শরীরটা প্রচন্ড জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল পিউর। পরক্ষণেই হৃষিতাকে চমকে দিয়ে নিজের ডান হাতের চামড়ার উপর সজোরে নিজেই নিজের নখ গেঁথে দিল পিউ। 

 কী অদ্ভুত! পিউর নখ গুলো এত বড় বড় আর ধারালো হল কখন? দেখে মনে হচ্ছে কোনো ভয়ংকর হিংস্র জন্তর নখ। কিন্তু একটু আগেও তো।

-" উফ! চামড়া চামড়া...অন্যের চামড়া গায়ে জড়িয়ে রাখতে বড় কষ্ট...বিশেষ করে খিদের সময়!"

 এরপর পিউ যা করল তাতে প্রচন্ড আতঙ্কে সারা শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠল হৃষিতার। ও দেখল ওর চোখের সামনেই পিউ তার নিজের শরীরের চামড়াগুলো টেনে টেনে একটু একটু করে তুলে ফেলছে। আর সেই চামড়ার নিচ থেকে বেরিয়ে আসছে এক ভয়ংকর কুৎসিৎ অবয়ব!

-" পিউ! এ...এসব তুই কী করছিস...তুই সত্যিই পিউ নাকি..."

-" নাকি?"- সেই কর্কশ স্বর আবার ফিরে এসেছে, " নাকি অন্য কেউ?" 

  চামড়ির বিলের নিঃস্তব্ধতাকে খান খান করে একটা শীতল হাসির রেশ ছড়িয়ে পড়ল কুয়াশার বুকে। তারই সঙ্গে বিলের জল টলটল করে উঠল। জলজ গাছেরা মাথা নাড়িয়ে উঠল। দূরে আবার শেয়াল ডেকে উঠল। 

  আর এর সঙ্গে সঙ্গেই হৃষিতা বুঝল ও কত বড় ভুল করেছে! উহু, এ পিউ না! ওর সামনে যে দাড়িয়ে আছে...সে পিউ না...সে পিউ হতেই পারে না...একটু আগেও হুবহু পিউর মত যে দাড়িয়েছিল তার শরীর থেকে চামড়া এখন গলে গলে পড়ছে। 

  ঠিক যেমন সাপ খোলস ছাড়ে তেমনই ওর সামনে দাড়ানো অবয়বটাও আস্তে আস্তে খোলস ছাড়ছে। পিউর খোলস। অবশ্য খোলস তো নয়, বলা ভালো চামড়া। পিউর চামড়া। সেই চামড়ার তলা থেকে বেরিয়ে আসছে এক বিভৎস পৈশাচিক জীব। তার  দুই চোখে তীব্র হিংসা, সারা মুখে ভয়ংকর ক্ষুধা। হে ঈশ্বর! এ কিসের সামনে দাড়িয়ে আছে হৃষিতা!

-" খিদে...বড় খিদে পেয়েছে... কতদিন পর আবার এমন খাবার এসেছে...রক্ত... মাংস..."

  জন্তুটার কর্কশ কণ্ঠস্বরে সারা শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে হৃষিতার। সামান্য পালানোর শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলছে ও। চারিদিক ভরে উঠছে ঝাঁঝালো গন্ধে। এইবার হৃষিতা স্পষ্ট বুঝতে পারছে এইসব আসলে একটা ফাঁদ।

 উহু পিউ আসেনি। পিউ কখনও ফিরে আসেনি এখানে। বরং পিউর রূপ ধরে এসেছিল অন্য কেউ। যে কোনোভাবে পিউ আর ওর সমস্ত স্মৃতিকে আহরণ করেছে। হয়তো ওই আংটিটা থেকেই। 

এই চামড়ির বিলে কোনো প্রেতাত্মা কখনও ফিরে আসে না! আসলে এই চামড়ির বিল অভিশপ্ত। এই বিল এক ভয়ংকর অপশক্তির আস্তানা...যেই অপশক্তি মৃত মানুষদের রূপ ধরে আসে। মৃত মানুষদের ব্যবহার করা বস্তু থেকে সে সংগ্রহ করে সমস্ত স্মৃতি আর তারপর...তারপর নিপুণ ভাবে তৈরি করে এই মারণখেলা যতক্ষণ না শিকার ফাঁদে পড়ছে...

  আর কোনো কিছু না ভেবেই হৃষিতা এইবার পালাতে যায়। কিন্তু কোথায় পালাবে সে! চারিদিকে যে শুধু কুয়াশা আর কুয়াশা। কোথাও কোনো আলো নেই, দুর দূরান্ত যত দূর চোখ যায় শুধু জল আর জল...

 ও কী! জলে ওগুলো কি ভাসছে? টর্চের আলোয় জিনিসগুলো দেখে সর্বাঙ্গ থরথর করে কেঁপে ওঠে হৃষিতার। চামড়া! মানুষের চামড়া...বিশ্রী ঝাঁঝালো গন্ধে চারিদিক ভরে উঠছে ক্রমশ।

 ওই তো পিছনে জলের মধ্যে ছপাং ছপাং শব্দে ও এগিয়ে আসছে। এগিয়ে আসছে। কোনোমতে পালাতে গিয়েই জলের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ল হৃষিতা। ঠাণ্ডা জলে ওর মাথাটা একবার ডুবে গেল পুরো। হাতের টর্চ ছিটকে পড়ল বহু দূরে। জলের বাইরে মাথা তুলে চাইতেই ও দেখল অন্ধকারের মধ্যে সেই ভয়ংকর পৈশাচিক অবয়ব ঠিক ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। 

 এইবার ওটা ওর ঠাণ্ডা হাত দিয়ে হৃষিতার হাতটা চেপে ধরল। হৃষিতা স্পষ্ট টের পেল জলের নিচেই অনেকগুলো ধারালো নখর ওর চামড়া ভেদ করে মাংসের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে ক্রমশ। 

 এইবার ও স্পষ্ট শুনল সেই পৈশাচিক জীবটা ঘ্যাসঘ্যাসে হিম শীতল কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে উঠল, " খিদে... বড় খিদে লেগেছে রে... মানুষের গায়ে চামড়া গায়ে থাকলে যে খেতে পারি না..."

  মধ্যরাতে নিঃস্তব্ধতাকে খানখান করে দিয়ে একটি নারীকন্ঠের ভয়ংকর চিৎকার শোনা গেল। সমগ্র চামড়ির বিল যেন থরথর করে কেঁপে উঠল সেই শব্দে। তারপর সব চুপচাপ।

 রজনী ঢলে পড়ল নৈঃশব্দের কোলে। কেবল বহুদূরে কোথাও একটা মধ্যরাতের শেয়াল ডেকে উঠল। 

// উপসংহার //

-" আর বলবেন না! ওই ফেইসবুক হওয়ার পর থেকেই এখেনে লোকজনের আনাগোনা বেড়ে গিয়েছে। এই তো গত হপ্তায় একটা অল্প বয়েসী মেয়ে এসেছিল। একা একা। ছয় মাস আগে তার কোন বান্ধবী গলায় দড়ি দিয়েছে, তার সঙ্গে দেখা করতে!" 

লণ্ঠনের আলোয় ডিঙিতে বসা লোকটাকে বেশ রহস্যময় লাগছিল অতনুর। একটা চাপা উৎকণ্ঠা নিয়েই ও জিজ্ঞেস করল, " দেখা পেয়েছিল?" 

-" পাবে না মানে! আলবাত পেয়েছিল। এই সময় এই চামড়ির বিল যে জেগে ওঠে। এখনই তো ওরা ফিরে আসে। চিন্তা নেই আপনার বাবাকেও আপনি দেখতে পাবেন। কেবল যেমন যেমনটা বললাম জলে নেমে তেমন তেমনটা করবেন। আর..."

 কথাটা বলতে বলতেই লোকটা থেমে গেল। ওর মুখে জমাট বেধে উঠেছে নিগূঢ় রহস্যময়তা। 

-" আর?"- অতনু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল। ওর হাতে ধরা ডাহুক পাখির ছানাটা রীতিমত ছটফট করছে এইবার। 

-" আর যেইটা বললাম সেটা মনে থাকে যেন। তিনবার। ওই ডাহুক পাখির ডাক ঠিক তিনবার শোনার পরেই আপনাকে ফিরে আসতে হবে কিন্তু। এক মুহুর্তও দেরি করলে চলবে না। নইলে..."

-" নইলে?" 

|| সমাপ্ত ||

[Image: Shocked-Open-Asianpiedstarling-size-restricted.gif]

[+] 6 users Like Sanjay Sen's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: ভৌতিক গল্প সংকলন (চলছে) - by Sanjay Sen - 20-08-2023, 11:21 AM



Users browsing this thread: 1 Guest(s)