Thread Rating:
  • 16 Vote(s) - 3.31 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
ভৌতিক গল্প সংকলন (সমাপ্ত)
#54
[Image: FB-IMG-1692509569025.jpg]

|| চামড়ির বিল ||

কাহিনি: ত্রিজিৎ কর

-" আস্তে আস্তে উঠুন...এদিকটা বড্ড কাদা।"- লোকটার ফ্যাসফাসে কণ্ঠস্বরে কিঞ্চিৎ চমকেই উঠল হৃষিতা। একে তো শীতকালের এমন নিশুতি রাত, তার মধ্যে চারিদিকে ঘন কুয়াশার আস্তরণ।

হাতে ধরা টর্চের আলোয় সামনেটা আরেকবার ভালো করে দেখল সে। যত দূর চোখ যায় আলকাতরার মতন কালো জল টলটল করছে। শীতকাল বলেই খুব সম্ভবত বিলটা মজে গেছে। জল খুব বেশি হলে কোমর অবধি হবে।

বিলের মাঝে মাঝে এখানে ওখানে জলজ আগাছা ভূতের মতন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আর বিলের মাথার উপর   স্বচ্ছ মেঘ ওড়নার আড়ালে মুখ লুকিয়ে আছে কুমড়োর ফালির মতন চাঁদ।

-" আপনি কি প্রতি রাতেই এখানে থাকেন? কী করে বুঝলেন আমি আসব আজ?"- হৃষিতা কাঁদার উপর অতি সাবধানে পা ফেলে ডিঙির উপর গিয়ে উঠল।

লোকটা এইবার হাতের লন্ঠনটাকে সামলে ধীর পায়ে কাঁদা ডিঙিয়ে একেবারে ডিঙির সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর লন্ঠনখানা ডিঙির উপর রেখেই বলল, " আজ্ঞে, বছরের এ সময়টা অনেকেই এখানে ছুটে আসে। আমরা এদিককার লোকেরা যারা ডিঙি করে এই চামড়ির বিলে শাপলা তুলতে আসি, মাছ ধরতে আসি, তাদের কাছে এসব নতুন না।"

লোকটা একটা কাষ্ঠ হাসি হেসে এইবার ডিঙিতে উঠে পড়ে। তারপর ধীরে ধীরে ডিঙি বাইতে শুরু করে দেয়। ছোট্ট ডিঙিটা অগভীর জলের উপর দিয়েই দুলতে দুলতে এগিয়ে চলে সামনের দিকে।

 প্রথমটা ডিঙির উপর বসে সারা শরীরে কেমন শিহরণ খেলে যায় হৃষিতার। ডিসেম্বর মাসের শেষ দিক। একেই জাঁকিয়ে ঠাণ্ডা পড়েছে। তারমধ্যে এখন প্রায় মধ্যরাত। হাত ঘড়ির রেডিয়ামের ডায়াল জানান দিচ্ছে সময় রাত তিনটে বেজে পাঁচ মিনিট। জলের মধ্যে ছপাত ছপাত শব্দ করে ধীর লয়ে ডিঙি এগিয়ে যাচ্ছে বিলের আরও গভীরে।

-" এই বিলের ব্যাপারে কোথা থেকে জানলেন?"- ডিঙি বাইতে বাইতেই লোকটা ফের প্রশ্ন করল।

হাতে ধরা টর্চের আলোয় এই প্রথমবার লোকটার মুখটা ভালো করে দেখল হৃষিতা। কাঁচা পাকা দাড়ির আড়ালে দুখানা তীক্ষ্ণ গভীর চোখ উঁকি মারছে। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশ তো হবেই। পরনে আধ ময়লা নোংরা জামা আর লুঙ্গি। মাথায় বড়সড় টাক।

প্রথমটা একটু ইতস্তত করল হৃষিতা। তারপর বলল, " অনলাইনে। একটা ফেসবুক গ্রুপ থেকে জানতে পেরেছিলাম।"

-" অনলাইন মানে ওই মোবাইল থেকে জানতে পেরেছেন তাই তো!"

লোকটা যে ফেসবুক, গ্রুপ এসব বুঝবে না সেটা বোঝা উচিৎ ছিল হৃষিতার। সংক্ষেপেই সে উত্তর দিল, " হ্যাঁ, তাই।"

-" ওই মোবাইল আর কি বললেন যেন হ্যাঁ ফেইসবুক, ঐটে হওয়ার পর থেকেই এখানে লোকের আনাগোনা আগের থেকে অনেক বেড়ে গেছে। নইলে সুদূর কলকেতা থেকে অ্যাদ্দুরে এই গণ্ড গ্রামের এক প্রান্তে চামড়ির বিলের কতা কজনই বা জানত! এই তো গত হপ্তা এক মহিলা এসেছিলেন নিজের ছেলের সঙ্গে দেখা করবেন বলে। সে কি তার আকুল কান্না! ফেসবুকে কী একটা পোস্ট না ফোস্ট দেখে এসেছিলেন..."

 হৃষিতা এইবার একটু নড়ে চড়ে বসল। বলাই বাহুল্য সেও এখানে এসেছে এরকমই একটি পোস্ট পড়েই। অকাল্ট চর্চা সম্পর্কিত একটা অত্যন্ত গোপনীয় ' প্রাইভেট গ্রুপে ' এই চামড়ির বিলের কথা সে প্রথম জানতে পারে। এমনিতে কখনই এসব বিষয়ে তার কোনো আগ্রহ ছিল না। কিন্তু মাস ছয়েক আগে ওই ঘটনার পর থেকেই...

 পোস্টটা পড়ে প্রথমটা আজগুবি মনে হলেও কমেন্টগুলো পড়ে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল হৃষিতা। অনেকেই লিখেছে ঘটনাটা নাকি সত্যি। তারা নিজেরা এই বিলে এসে নিজেদের কাছের মানুষদের সাক্ষাৎ পেয়েছেন। কখন কিভাবে আসতে হবে সেসব ব্যাপারেও বেশ কিছু কমেন্ট ছিল।

 এরপরেই কৌতূহলবশত গুগল ম্যাপে জায়গাটা সত্যি আছে কিনা দেখতে গিয়ে চমকে ওঠে হৃষিতা। সত্যিই এই চামড়ির বিল নামে একটা জায়গা আছে! আর সেই পোস্টে উল্লিখিত ঠিকানার সঙ্গে ম্যাপে দেখানো ঠিকানাটাও হুবহু এক...

-" যার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন তার ব্যবহার করা কোনো একখানা বস্তু সঙ্গে এনেছেন তো?"- লোকটা কিঞ্চিৎ রহস্যময় কণ্ঠেই কথাটা জিজ্ঞেস করে।

 হৃষিতা সম্মতি জানায়। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটার প্রথম খোপ থেকে সে এবার একটা ছোট্ট জিনিস বের করে আনে। টর্চের আলো পড়তেই জিনিসটা চকচক করে ওঠে। একটা আংটি।

-" বেশ বেশ। এতেই হবে। যেমন যেমনটা বলে দেব তেমন তেমনটা করবেন তাহলেই এই আংটি যার তাকে ঠিক দেখতে পাবেন।"- ডিঙি বাইতে বাইতেই লোকটির মুখে আবারও একটা রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে।

-" তা আংটিখানা কার জানতে পারি? কার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন এখানে? খুব কাছের মানুষ বুঝি...মনে হচ্ছে যেন অপঘাতে মৃত্যু!"

 হৃষিতা এইবার যেন চমকে ওঠে। তারপর হাতে ধরা আংটিটার দিকে তাকিয়েই কোনোমতে উত্তর দেয়, " হ্যাঁ, খুব কাছের বন্ধু। ছয় মাস আগে সুইসাইড করেছিল। আপনি কি করে বুঝলেন?"

লোকটা এইবার হাসল শুধু, " কম তো লোক নিয়ে আসলাম না। মুখ দেখলেই এখন কিছু কিছু আন্দাজ করতে পারি। তবে একটা কথা বলি শুনুন..."

লোকটার গলার স্বর আচমকাই যেন গম্ভীর হয়ে ওঠে, " অপঘাতের মরা তো। খুব সাবধান থাকবেন কেমন! আগের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি যারা অপঘাতে মরে তারা কিন্তু একা ফিরতে চায় না। ওদের একরকম টান থাকে...বুঝলেন..."

লোকটা কি বোঝাতে চাইল কে জানে, কিন্তু কথাটা শুনেই হৃষিতার সারা শরীরে কেমন যেন চোরা শিহরণ খেলে গেল।

টান...সত্যিই তার প্রতি একটা টান তো আছেই...যেই টানে এত দুর হৃষিতা ছুটে এসেছে! একবার শুধুমাত্র একবার ওকে দেখবে বলে।

ও মানে হৃষিতার সবচাইতে কাছের বন্ধু, পিউ! ওর এত দূর ছুটে আসা আজ রাতে সার্থক হবে তো?

ডিঙিটা প্রায় বিলের মাঝামাঝি চলে এসেছে। এদিকটা জল যে কিঞ্চিৎ বেশি গভীর তা একটু ঠাওর করলেই বোঝা যায়। যতই বিলের ভেতরের দিকে নৌকা এগোচ্ছে ততই চারিদিকে কুয়াশার আস্তরণ ক্রমশ যেন ঘন হচ্ছে। টর্চের আলোতেও সেই কুয়াশা ভেদ করে বেশি দুর দেখা যায় না। জায়গাটা অদ্ভুত ঠাণ্ডা। সারা শরীরে কেমন যেন কাঁপুনি দিচ্ছে হৃষিতার।

-" এই বিলের এমন অদ্ভুত নাম কেন?"- এক মনে চারিদিকটা দেখছিল হৃষিতা। আচমকাই নিজের মনে প্রশ্নটা করে বসল ও।

ডিঙির লোকটা এই প্রশ্ন শুনে আগের মতোই মৃদু হাসল। তারপর বলল, " আজ্ঞে, এ প্রশ্নের উত্তর আমারও ঠিক ঠিক জানা নেই। তবে বাপ ঠাকুরদার কাছে শুনেছি কোন এক সময়ে নাকি এই বিলের জলে মানুষের চামড়া ভেসে থাকতে দেখা যেত।
  বহু বচ্ছর আগে এখানে এই অঞ্চলেই নাকি কোনো এক মহা পাষণ্ড জমিদারের রাজ ছিল। সে সময় কেউ জমিদারের আদেশ অমান্য করলে কিংবা খাজনা না দিলে নাকি গরম লোহার শিক দিয়ে তার চামড়া ছাড়িয়ে এই বিলের জলে ফেলা হত। সেই ভাবে অনেক মানুষের প্রাণ গেছে। ওই থেকেই এই বিলের নাম চামড়ির বিল।"

লোকটা চুপ করতেই হৃষিতার সারা শরীরটা যেন শিউরে উঠল। সত্যিই কি এই বিলের জলে এক সময়ে মানুষের চামড়া ভাসতে দেখা যেত! কথাগুলো ভাবতেই সারা শরীরে যেন অস্বস্তি হচ্ছে হৃষিতার।

 বহু দূরে ঠিক এই সময়ে কোথাও একটা শেয়াল ডেকে উঠল। গভীর রাতের নিস্তব্ধতা ছিন্ন ভিন্ন করা সেই ডাক এই জনমানবহীন মজা খালের বুকে যেন সাবধান বানীর মতন শোনাল।

ঠিক এমনি সময়েই বিলের একেবারে মাঝামাঝি এসে ডিঙিটা স্থির হয়ে গেল। ডিঙ্গির লোকটা এইবার দাড় রেখে অতি সাবধানে হৃষিতার সামনে এগিয়ে এল। তার সামনে আসাতে ডিঙিটা এমনিভাবে দুলে উঠল যেন এক্ষুনি হৃষিতাকে নিয়েই উল্টে পড়বে জলের মধ্যে।

-" চিন্তা নেই। চিন্তা নেই। ডিঙি উল্টাবে না। রাকিব মিঞার ডিঙি এত সহজে উল্টাবে না।" ডিঙির একেবারে মাঝামাঝি এসে লোকটা হৃষিতার মুখোমুখি বসল। লোকটার গায়ে কেমন একটা বুনো গন্ধ।

-" আসল জায়গায় আমরা চলে এসেছি। এইবার আপনাকে নামতে হবে।"- লোকটা শীতল কণ্ঠে এমনভাবেই কথাটা বলল যে হৃষিতার বুকটা এক মুহূর্তের জন্য ছ্যাৎ করে উঠল।

চারিদিকটা আবারও ভালো করে চেয়ে দেখল সে। যত দূর চোখ যায় এখন চারিদিকে কুয়াশা আর কুয়াশা। আর সেই কুয়াশার আস্তরণের নিচে টলটলে কালো জল। এরমধ্যে এই রাতের বেলায় নামতে হবে হৃষিতাকে?

-" এখানে নামব?"

-" হ্যাঁ নামবেন। না নামলে আপনার বন্ধুর দেখা পাবেন কী করে!" - লোকটা যেন কিঞ্চিৎ ক্ষেপে ওঠে, " শুনুন যেমনটা বলছি তেমনটা করবেন। এইটা দুই হাত দিয়ে ধরুন।"

এইবার হৃষিতাকে অবাক করে দিয়েই ডিঙির এক প্রান্তে থাকা একটা ছোট্ট ঝুড়ি সামনে নিয়ে এল লোকটা। ঝুড়িখানা খুলতেই একখানা ছোট্ট পাখির ছানা বাইরে মুখ বের করল। হৃষিতা যদি খুব ভুল না করে তবে এটা ডাহুক পাখির বাচ্চা। এসব জল জায়গায় থাকে এগুলো।

 লোকটা এইবার পাখিটাকে বের করে হৃষিতার সামনেই একটা অদ্ভুত কাণ্ড করল। নিজের বুক পকেট থেকে একটা লাল সুতো মতন বের করে কী একটা মন্ত্র বিড়বিড় করতে করতে সেই পাখিটার গলায় সুতোটা বেধে দিল সে। পাখির বাচ্চাটা এতক্ষণ যেন একপ্রকার ঝিমিয়ে ছিল। এইবার যেন সে চনমনে হয়ে জেগে উঠল। ঠিক যেন কিছু একটা ভিতরে ঢুকেছে তার।

-" সাবধানে ধরুন! হাত থেকে যেন না পালায় এখন।"- লোকটা এইবার পাখির ছানাটা এগিয়ে দেয় হৃষিতার দিকে। হৃষিতাও কোনরকম প্রশ্ন না করে পাখিটাকে হাতে নেয়।

-" কী হবে এটা দিয়ে?"- এইবার হৃষিতা প্রশ্ন করে।

-" এই পাখিই আপনাকে পথ দেখাবে। ওই আপনাকে আপনার বন্ধুর কাছে নিয়ে যাবে বুঝলেন। " লোকটার মুখে একটা রহস্যময় হাসি।

-" মানে?"

-" বলছি শুনুন। আপনি এখন এই ডিঙি থেকে নিচে জলে নামবেন। তারপর আপনার বন্ধুর ওই আংটিটা জলে ফেলে তিনবার তার নাম ধরে ডাকবেন। তারপর ওই পাখিটাকে জলের মধ্যে ছেড়ে দেবেন। তারপর ওই পাখি যেদিকে যাবে, আপনিও তার পিছু পিছু যাবেন। ওই পাখিই আপনাকে আপনার মৃত বন্ধুর কাছে নিয়ে যাবে।"

কথাগুলো দিনের আলোয় শুনলে হয়তো এতটা ভয় লাগত না হৃষিতার। কিন্তু এই মাঝরাতে এই গা ছমছমে ভয়ংকর পরিবেশে কথাগুলো শুনে একটা চাপা অস্বস্তি হচ্ছে ওর বুকে। কোনোমতে ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানাল হৃষিতা।

-" তবে একটা কথা মনে রাখবেন। আপনি যার সঙ্গে দেখা করবেন সে কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এ জগতে আসছে। ওই নির্দিষ্ট সময়ের বেশি তাকে এখানে আটকে রাখা যাবে না।" লোকটার কণ্ঠস্বর ক্রমশ যেন গম্ভীর হচ্ছে।

-" আপনি আপনার বন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর কথা বলবেন কিন্তু নিজের কানটাকেও খোলা রাখবেন। এই ডাহুকের বাচ্চা আপনার প্রহরী। ও আপনাকে প্রহরা দেবে। কিন্তু একটা সময় আসবে যখন ওই পাখি তিনবার মরণ চিৎকার করে উঠবে। ঠিক ওই সময়ে...ওই সময়ে যেই দিকে পাখি ডেকেছিল সেইদিকে আপনাকে ছুটে আসতে হবে। কোনরকম দেরি করা চলবে না। বুঝেছেন?"

 হৃষিতা আবারও নিঃশব্দে ঘাড় নাড়াল। ওর হাতে ধরা পাখিটা পাগলের মতন ছটফট করছে। ঠোঁট দিয়ে ঠোক্কর দিচ্ছে হাতে। যেন নিজেকে ছাড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে সে।

-" মনে থাকে যেন। ওই ডাক শুনে ঠিক সময়ে না ফিরতে পারলে কিন্তু মহা অনর্থ হবে। আমি কিন্তু ফিরে যাব এই বিল থেকে। তারপর যা হবে তার কোনো দায় আমার নয়। আপনি বুঝবেন।"

কথাগুলো বলতে বলতেই লোকটা কেমন যেন অস্থির হয়ে ওঠে। তারপর বলে, " এক মাত্র এই সময়ে চামড়ির বিলে এলেই ওদের সঙ্গে দেখা করা যায়। যারা এই দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে অন্য দুনিয়ায় চলে গেছে..." - লণ্ঠনের মৃদু আলোয় ডিঙিতে বসা লোকটার মুখ আরও যেন রহস্যময় হয়ে ওঠে।

- " আপনি ঠিক বলছেন তো? সত্যিই আমি চাইলেই যোগাযোগ করতে পারব? সত্যিই মৃত মানুষ ফিরে আসবে!"- হৃষিতার চোখে মুখে চাপা উৎকণ্ঠা।

-" আসবে! আসবে! এসময় যে বিল জেগে ওঠে...আপনি যার দেখা করতে চাইছেন সে ঠিক ফিরে আসবেই। শুধু যেটা বললাম মনে থাকে যেন...তিনবার...তিনবার ওই ডাহুকের ডাক শোনার পরেই আপনাকে ফিরে আসতে হবে...নইলে..."

-" নইলে?"

জলের মধ্যে পা রাখতেই সারা শরীরটা শিউরে উঠল হৃষিতার। উফ কি প্রচন্ড ঠাণ্ডা! যেন বরফের চাই ভাসছে জলের মধ্যে।

বিলের প্রায় মাঝামাঝি হলেও জায়গাটায় বেশি জল নেই। মোটে হাঁটুর একটু উপর অবধি জল উঠেছে হৃষিতার। কোনোমতে ধীর পায়ে জলের মধ্যে দিয়ে সামনে এগোচ্ছে ও। দুইহাতে ধরা পাখিটা প্রচন্ড ছটফট করছে। টর্চটা ও ধরে রেখেছে কোনোমতে বগলদাবা করে।

হৃষিতাকে বিলের মধ্যে নামিয়ে ডিঙিখানা কোথায় যে অদৃশ্য হয়ে গেল কে জানে। এখন চারিদিকে যত দূর চোখ পড়ছে কেবল কুয়াশা আর কুয়াশা। এখানে ওখানে জলজ আগাছার ঝোপ। মনে মনে একবার জোরে শ্বাস নেয় হৃষিতা।

তারপর পাখিটাকে কোনোমতে ধরে প্যান্টের পকেট থেকে বের করে আনে আংটিটা। কে জানে আদৌ কোনো কাজ হবে কিনা! সত্যিই কি পিউ ফিরে আসবে? সত্যিই কি আবার এতদিন পর দেখা হবে ওদের?

দেখাই যাক না কী হয়! আংটিটা জলের মধ্যে ছুঁড়ে গেলেই তিনবার সজোরে চিৎকার করে ওঠে হৃষিতা।

-" পিউ....পিউ....পিউ....!"- হৃষিতার চিৎকার নিঃশব্দ রাতের বুক চিড়ে দুর দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে। তারপর বিকট রূপে প্রতিধ্বনিত হয়ে আবার ফিরে আসে হৃষিতার কাছেই,
" পিউ... পিউ... পিউ..."

এইবার হাতে ধরা পাখিটা প্রচন্ড ছটফট করতে শুরু করে। হৃষিতা নিচু হয়ে ওটাকে ছাড়তেই প্রচন্ড চিৎকার করে জলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওটা। পরক্ষণেই তীরের বেগে জলের মধ্যে দৌড় দেয়।

হৃষিতাও তার পিছন পিছন দৌড়াতে থাকে জলের মধ্যে। একবার ডাইনে একবার বায়ে, কুয়াশার মধ্যে পাখিটার পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে কতদূর যে চলে এসেছে হৃষিতা তার খেয়াল নেই। আচমকাই একটা জায়গায় এসে পাখিটা সামনের দিকে তাকিয়ে বিকট স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে। তারপরেই সেটা স্থির হয়ে যায়।

প্রথমটা কিছু বুঝতে না পারলেও পরক্ষণেই ব্যাপারটা খেয়াল করে হৃষিতা। টর্চের আলোয় ও স্পষ্ট দেখে জলের ভিতর কিছু একটা নড়চড় করছে না? হ্যাঁ ঐতো স্পষ্ট মনে হচ্ছে জলের ভিতর কিছু একটা যেন আছে। ওই তো ওর থেকে কয় হাত দূরেই কিছু একটা যেন ক্রমশ জলের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে...

এইবার প্রচন্ড আতঙ্কে হৃষিতার সারা শরীরটা থরথর করে কেঁপে ওঠে। টর্চের আলোয় ও দেখে জলের ভিতর থেকে ক্রমশ মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে আর কেউ নয়, ছয় মাস আগে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করা ওর বান্ধবী, পিউ স্বয়ং!

পিউয়ের সারা মুখ ভয়ংকর ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে, গলায় মোটা দড়ির দাগ, ঠোঁটগুলো শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে...অদ্ভুত ঘোলাটে দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে হৃষিতার দিকে...

হৃষিতা কিছু বলতে যাবে তার আগেই পিউ এক অদ্ভুত হিম শীতল কণ্ঠে বলে উঠল, " এতদিনে তোর আসার সময় হল হৃষু! তোর জন্যই তো সেই কবে থেকে অপেক্ষা করে আছি..."
[+] 1 user Likes Sanjay Sen's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: ভৌতিক গল্প সংকলন (চলছে) - by Sanjay Sen - 20-08-2023, 11:18 AM



Users browsing this thread: