19-08-2023, 08:06 PM
প্রথম পর্ব
মানুষের জীবন বড়োই অদ্ভুত এবং অনিশ্চিত । গণনা করে ভবিষ্যতের অতল অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা নিয়তির নিষ্ঠুর লেখন সম্পর্কে কখনোই সুনিশ্চিত ভাবে কিছু বলা যায় না । তাই মানুষকে ভালো মন্দ সবকিছুর জন্যই সদাপ্রস্তুত থাকতে হয় । সর্বদা সতর্কতা অবলম্বন করে চললেও ফাঁকফোকর দিয়ে এমন কিছু ঘটতে থাকে বা ঘটে যা আমাদের মানসিক এবং শারীরিক দুই সত্ত্বাকে নাড়িয়ে দিতে সক্ষম । অনেকে আবার এই ঘটনা গুলোকে ‘ জীবনের মোড় , বলতে বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করেন । তো এই জীবনের চলার পথে কখন কোন মোড় কোথা থেকে ঘুরে যায় ! সেটা কেউ বলতে পারে না । সেরকমই একটা বড়ো মোড় ঘুরলো বিদ্যার জীবনে । তবে জীবনের এই পুতুলনাচ খেলায় সে অভ্যস্ত । বিয়ের পর মাত্র ছয় বৎসর সুখে সংসার করে , পনেরোটা বসন্ত সে নিজের ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে , বিধবা বেশে কাটিয়েছে ।
এখন বিদ্যার বয়স চল্লিশ ছুঁইছুঁই । বিদ্যা ৫ ফুট ৫ ইঞ্চির বিধবা রুপসী এক বঙ্গ গৃহবধূ। বয়স চল্লিশ ছুঁইছুঁই হলে কি হবে ! বিদ্যাকে দেখতে লাগে বত্রিশ তেত্রিশ বছরের বঙ্গ তনয়া । মুখে কিংবা শরীরে বার্ধক্যের ছাপ তো দূরে থাক যখন বিদ্যা তার মেয়ের সঙ্গে পাশাপাশি হেঁটে যায় তখন তাদের মা মেয়ের মত তো কখনোই দেখতে লাগেনা । বক্ষ ও কটিদেশ এর মত নারী শরীরের যে একান্ত নিজস্ব অঙ্গ গুলি যা এক নারীকে তুলে ধরে এক অপার্থিব রহস্যময়ী যৌন আবেদনময়ী হিসেবে সেই সব অঙ্গের সৌন্দর্য বিদ্যার শরীরে বর্তমান । স্বভাবে সে মিতভাষী , শান্ত । তার চরিত্রের সবথেকে বড় শক্তি হলো তার কোমলকুসুম হৃদয় ।
বিবিডি বাগে গঙ্গার ঘাটের খুব কাছে আড়াই কাঠা জমির উপর একটা দুই তলা বাড়িতে বিদ্যা তার মেয়েকে নিয়ে থাকে । বাড়িটা বিদ্যার নিজের । আসলে এই বাড়িটা বিদ্যার শাশুড়ির বাপের বাড়ির সম্পত্তি । বিদ্যার স্বামী এই বাড়িটা তার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিল । বাড়ির দুতলায় ওঠার সিড়ির বাম দিকে একটা সুন্দর ঘর আছে , তাকে চিলেকোঠার ঘর বলতে বিদ্যা নারাজ । সেই ঘরেই বিদ্যা থাকে । আর সিড়ির ডান দিকে আছে তিন দিকে প্রায় তিনফুট উঁচু পাঁচিল দেওয়া নেঁড়া বা খোলা ছাদ । এখানে ভেজা কাপড় শোকাতে দেওয়া হয় , এবং শীতকালে লেপ কম্বল গরম করতে দেওয়া হয় । বাড়ির পশ্চিম দিকে সুবিশাল অট্টালিকা না থাকার জন্য এই ছাদ দিয়ে গঙ্গার জলে স্টিমার , নৌকা আর ছোট মালবাহী জাহাজের বিচরণ দেখা যায় । আর কিছুদূরে সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকা হুগলি সেতুর মনোরম সৌন্দর্য উপভোগ্য।
বিকাল বেলা এই ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখতে খুব ভালো লাগে বিদ্যার । পড়ন্ত সূর্যের কিরণ গঙ্গার নিল জলে আর আকাশের সাদা তুলোর মত মেঘের মধ্যে বিচ্ছুরিত হয়ে এক অপার্থিব মনমাতানো সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে । এই মনমাতানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে বিদ্যা হারিয়ে যায় অতিতের রঙিন দিন গুলোতে । কত বিকাল সে তার ভালোবাসার মানুষের হাতে হাত রেখে , কাঁধে মাথা রেখে কাটিয়েছে তার গোনাগুনতি নেই । এখন তার জীবন সাদা ক্যানভাসের মত ফাঁকা , কোন রঙ নেই তাতে । তাই সে অতীতের দিনগুলোতে ডুবে গিয়ে কিছু রঙ ধার করে এনে সাদা ক্যানভাসটাকে রঙিন করার ব্যার্থ চেষ্টা করে । চেষ্টা ব্যার্থ হওয়ার পর বিদ্যার মন বিষিয়ে ওঠে , একাকিত্ব এবং নিঃসঙ্গতা চারদিক থেকে ঘিরে ধরে তার শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করে ।
সময়টা বাংলা জৈষ্ঠ্য মাসের একেবারে শেষের দিকে আর ইংরেজি জুন মাসের মাঝামাঝি । দিনের বেলায় প্রখর রোদ আর কাঠফাটা গরমে এই কল্লোলিনী তিলোত্তমার বাসিন্দারা হাঁসফাঁস করছে । সুধুমাত্র দুই পেয়ে বাসিন্দা ছাড়াও চার পেয়ে প্রানী আর পাখিদেরও অবস্থা শোচনীয় । সারাদিন সূর্য তার উষ্ণ কিরণের মাধ্যমে নিজের তেজ দেখানোর পর বিকালের দিকে মিঠে উষ্ণহীন রঙিন কিরণ ছড়িয়ে দিয়েছে আকাশে । যেন সারাদিনের কর্মকান্ডের জন্য সে বিকাল বেলায় ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছে ।
প্রতিদিনের মত আজও বিকালবেলায় দুপুরে স্নানের পর মেলে দেওয়া শাড়ি , সায়া ব্লাউজ তুলতে এলো বিদ্যা । ছাদে এসে বিদ্যা শুকিয়ে যাওয়া শাড়িটা তুলে হাত নিল , ঠিক তখনই গঙ্গার বুক থেকে এক কোমল শীতল হাওয়া ধেয়ে এসে বিদ্যার আঁচল উড়িয়ে তার মনকে শান্ত কোমল করে তুললো । কোন এক অমোঘ ঘোরে সে ছাদের কার্নিশের দিকে যেতে শুরু করলো । হাতে সুধুমাত্র শুকিয়ে যাওয়া সুতির শাড়িটা নিয়ে সে দাঁড়ালো কার্নিশে হাত দিয়ে । গঙ্গার মৃদুমন্দ বাতাস এসে বিদ্যার একরাশি ঘন কালো চুলকে উড়িয়ে দিতে চাইলো । বিদ্যাও তার খোঁপা খুলে চুলগুলোকে উড়তে দিল । এই একরাশি ঘন কালো কেশ বিদ্যার মতোই স্বাধীন হতে চায় । যত্ন চায় , আদর চায় , ভালোবাসা চায় । চল্লিশ ছুঁই ছুঁই এই বঙ্গ ললনার কালো হরিণ চোখ গঙ্গার জল আর নিল আকাশের মধ্যে পাল্লা দিয়ে রঙের খেলা দেখতে লাগলো । কিছুক্ষনের মধ্যেই সে এই মনমাতানো সৌন্দর্যে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লো ।
তন্দ্রা কাটলো খুব কাছে এক বাড়ি থেকে আসা শাঁখের আওয়াজে । তৎক্ষণাৎ বিদ্যার মনে পড়লো যে সন্ধ্যা দেওয়া হয়নি । তাই সে বাকি কাপড় গুলো তুলে নিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো । নিজের শাড়ি শায়া গুছিয়ে আলনায় সাজিয়ে রেখে দিল । দুপুরে নিজের ভেজা কাপড় শুকাতে দেওয়ার পর দিব্যার শুকিয়ে যাওয়া কাপড় গুলো সে নিচে নামিয়ে এনে গুছিয়ে রেখেছিল । নিজের কাপড় গোছানো হয়ে গেলে বিদ্যা নিচে নেমে লিভিংরুম , রান্নাঘর এবং বাকি দুটো ঘরের লাইট জ্বালিয়ে ঠাকুর ঘরে ঢুকলো । সব ঘরের আলো জ্বালানো হয়ে গেলে বিদ্যা গোপালের সিংহাসনের কাছে এসে বসে পবিত্র মন নিয়ে শাঁখ বাজিয়ে চারটে ধূপকাঠি ধরিয়ে সন্ধ্যা দিল ।
সন্ধ্যা দেওয়া হয়ে গেলে শুধুমাত্র দুটো ধূপকাঠি গোপালের সামনে রেখে আর দুটো হাতে নিয়ে বাড়ির বাইরে চলে এলো । বাইরে আসার আগে অবশ্য সে দুটো বেডরুম আর রান্নাঘরের লাইট বন্ধ করে দিল । উঠোনে এসে ধূপকাঠি দুটো তুলসী তলায় দিয়ে দিল । তারপর বাড়িতে ঢোকার বড় লোহার গেট পেরিয়ে রাস্তায় চলে এলো । বিদ্যাকে বড় লোহার গেট খুলে বাড়ির বাইরে আসতে দেখে রাস্তার ওই পাশের একটা সাইকেল সারাইয়ের দোকান থেকে এক বছর পঁয়ত্রিশের লোক বেরিয়ে এলো ।
বাড়ির উঠোনের পরেই লোহার গ্রিল সংলগ্ন বিদ্যার শাড়ির দোকান । এই দোকানে শাড়ি বিক্রি করে এবং সেলাইয়ের কাজ করে বিদ্যা একা হাতে দিব্যাকে লেখাপড়া শিখিয়ে নার্সিং পড়িয়েছে । দোকানের সামনে এসে প্রনাম করে শাটারের চাবির ফুটোয় চাবি ঢুকিয়ে দিল । ঠিক তখনই সেই লোকটা এসে ভারী শাটার তুলে দোকান খুললো । গত ছয় সাত বছর ধরে লোকটা বিদ্যাকে দোকান খোলায় সাহায্য করছে । লোকটা এই সাহায্য নিঃস্বার্থভাবে করলেও বিদ্যা প্রতিবছর পূজার সময় লোকটাকে এক জোড়া ভালো জামা কাপড় দেয় ।
শাটার তুলে দিয়ে লোকটা ইশারায় বললো ‘ রাতে দোকান বন্ধ করার সময় সে এসে শাটার নামিয়ে দেবে । ‚
ইশারা করার কারন হলো লোকটা মূক ও বধির । বিদ্যা এক মুখ হাসি নিয়ে বললো , “ হ্যাঁ ডাকবো । „
লোকটা চলে গেলে বিদ্যা দোকানে ঢুকে লাইটটা জ্বালিয়ে দিল । ভালো ভাবে ঝাঁট দিয়ে দুটো ধুপ ধরিয়ে দক্ষিন দিকের দেওয়ালে নতুন পুরানো পাঁচটা বাংলা ক্যালেন্ডারে ছাপা রাধা কৃষ্ণ , গণেশ , মা কালির সামনে ধূপদুটো গুঁজে দিল । তারপর রোজকার মত পুরানো পায়ে চালানো সেলাই মেশিনের সামনে বসে পড়লো ব্লাউজ সেলাই করার জন্য । কালকের মধ্যে দুটো ব্লাইজ দিতে পারলে নিশ্চিন্ত ।
একাগ্র মনে সেলাই করতে করতে যখন সেলাইয়ের কাজ শেষের মুখে তখন বিদ্যা দিব্যার স্কুটির আওয়াজ শুনতে পেল । মুখ তুলে দেখলো তার মেয়ে বাড়ি ঢোকার বড় লোহার গ্রিলটা খুলছে । উত্তর দিকের দেওয়ালে একটা ঘড়ি টাঙানো আছে । তাতে তাকিয়ে দেখলো সাতটা বাজে ।
দিব্যার বাবার পছন্দের অভিনেত্রী ছিল দিব্যা ভারতী । এতোটাই পছন্দ ছিল যে তার একমাত্র মেয়ের নাম সেই অভিনেত্রীর নামেই রাখার সিদ্ধান্ত নেয় । দিব্যা রায় । বিদ্যা নাম রাখার সময় বলেছিল , “ বাঙালি মেয়ের নাম দিব্যা ! „
দিব্যার বাবা তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে রসিকতার ছলে বললো , “ কেন ! হতে পারে না বুঝি ! „
“ হবে না কেন ! হতেই পারে । তবে এর থেকেও তো ভালো ভালো নাম আছে । „
দিব্যার বাবা বুঝতে পারলো যে তার স্ত্রী মেয়ের জন্য নাম ঠিক করেছে । তাই দিব্যার বাবা জিজ্ঞেস করলো “ তোমার কোন নাম পছন্দ হলে বলো । „
বিদ্যা তার মনের মত একটা নাম বললো , “ উরভি „ ।
স্বামী স্ত্রীতে বেশকিছুক্ষন নাম নিয়ে আলোচনা হওয়ার পর ঠিক হয়েছিল যে যদি মেয়ে সন্তান হয় তাহলে নাম রাখা হবে “ দিব্যা „ আর যদি ছেলে সন্তান হয় তাহলে বিদ্যা নিজের মনের মত রাখতে পারবে । এখন সেইসব কথা মনে পড়লে বিদ্যার বুক ফাটে । বিদ্যা নিজের মেয়ের নাম রাখতে চেয়েছিল উরভি । উরভি দেবী লক্ষ্মীর আর এক নাম । আর আজ সেই মেয়েই মায়ের কথা মেনে চলে না ।
বিদ্যা ঘড়িতে সময় দেখে আবার ব্লাউজ সেলাইয়ে মন দিল । আরো কিছুক্ষন অতিবাহিত হওয়ার পর বিদ্যা বুঝলো যে আজকে আর কেউ গল্পো করতে আসবে না । সন্ধ্যার দিকে আশেপাশের বয়স্ক মহিলারা বিদ্যার শাড়ির দোকানে এসে একত্রিত হয় । বয়স্ক বললে ভুল হবে কারন এই গ্রুপে যেমন চল্লিশ বছরের গৃহবধু পোদ্দার গিন্নি আছে ঠিক তেমন আশি বছরের বিধবা বৃদ্ধা মাধবীলতাও আছে। এরা সাধারণত আসে গল্প গুজব করতে , এর ওর খবর নিতে আর সন্ধ্যার জলখাবার খেতে । এতে বিদ্যা খুশিই হয় । সন্ধ্যার খাওয়াটাও হয় আবার একাকিত্বও কাটে ।
সাড়ে নটার দিকে বিদ্যা বুঝতে পারলো যে আজকে আর কোন খরিদ্দারও আসবে না । তাই সে অন্যান্য কাজ গুছিয়ে দশটা বাজতেই দোকান বন্ধ করে দিল । না হলে দিব্যাকে খেতে দিতে দেরি হবে আর সে বাড়ি মাথায় তুলবে । বিদ্যার দোকান বন্ধ করার তোড়জোড় দেখতে পেয়ে লোকটা এসে শাটার নামিয়ে দিলে বিদ্যা তালা মেরে দিল । লোকটার সাইকেলের দোকান বন্ধ হতে এখনো এক ঘন্টা বাকি । বিদ্যা বাড়ি ঢুকে সাড়ে দশটার মধ্যে রাতের খাবার গরম করে মেয়েকে ডাকলো খেয়ে নেওয়ার জন্য ।
রাতে ভাত আর ফুলকপির তরকারি খেতে খেতে কিছুটা ইতস্তত করে , হুট করে দিব্যা বললো , “ মা , আমি ভাবছিলাম লিভিংয়ে যাবো । „
মেয়ের কথাটা বিদ্যা বুঝতে না পারলেও লিভিং শব্দটার মানে সে জানে । আজকাল নতুন ফ্যাশন উঠেছে । বিয়ের আগে ছেলে মেয়ে একসাথে কিছুদিন থেকে একে অপরকে চিনে নেয় । একে লিভিং বলে । মেয়ের কথা বুঝতে পেরে কিছুটা রুক্ষ স্বরে বিদ্যা নিজের আপত্তি জানালো , “ লিভিং ! এই বয়সে ! বয়স কতো তোর ? „
মায়ের কথায় দিব্যা রেগে গিয়ে বললো , “ আমি এখন ম্যাচিউর হয়েছি আর নিজে ইনকাম করি । সমস্যা কোথায় ? আর তুমি বয়সের কথা বলছো ! তুমি তো আমার থেকেও কম বয়সে বাবার সাথে বিয়ে করেছিলে ! „
মেয়ের অভব্য আচরণে বিদ্যার মন বিষিয়ে গেলেও সে দিব্যার উপর রাগ দেখাতে পারলো না “ তোর বাবা থাকলে কখনো রাজি হতো না ! „
দিব্যা গলায় ঝাঁঝ বজায় রেখে বললো , “ বাবা থাকলে রাজি হতো কি হতো না সে পরের ব্যাপার । বাবা নেই , তুমি আছো । তাই তোমাকে বলছি ? „
বিদ্যা কি বলবে কিছুই বুঝতে পারলো না । এইরকম পরিস্থিতিতে মেয়েকে কি বলে আটকাবে সেটা তার জানা নেই । দিব্যা যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে তখন সে লিভিংয়ে যাবেই । তাই সে বললো , “ লিভিংয়ে গেলে পাড়ার লোকে ছিঃ ছিঃ করবে এর থেকে বরং তুই বিয়ে করে নে ...
মায়ের কথার মাঝে দিব্যা ব্যাঙ্গের হাসি হেসে উঠলো , “ তুমি পারবে আমায় বিয়ে দিতে ? একটা বিয়েতে এখন কত খরচা হয় জানো তুমি ? „
মেয়ের কথায় বিদ্যা গুম মেরে গেল । বিদ্যার পড়াশোনার জন্য ব্যাঙ্ক থেকে এডুকেশন লোন নিয়েছিল সে । যার কিস্তি বিদ্যা এখনো দিয়ে যাচ্ছে । মাকে চুপ করে থাকতে দেখে দিব্যা মায়ের হাতে হাত রেখে বললো , “ ছেলেটা ভালো । শুধু লিভিংয়েই তো যাচ্ছি । কোন সমস্যা হবে না । „
মায়ের এই দূর্বলতা সম্পর্কে দিব্যা ওয়াকিবহাল। একটু ভালো ভাবে কথা বললেই বিদ্যা দূর্বল হয়ে পড়ে । এই সুযোগটাই দিব্যা নিতে চাইলো । বিদ্যা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞাসা করলো , “ ওর নাম কি ? কি কাজ করে ? „
“ ওর নাম বিক্রম । আর ও গাড়ি ঠিক করে , মানে গাড়ির ম্যাকানিক । একটা গ্যারাজে কাজ করে „
বিক্রম নামটা শুনেই বিদ্যার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো , দৃঢ় কন্ঠে সে বলে উঠলো “ না। কখনোই না । একজন গ্যারেজ ম্যাকানিক এর সাথে কখনোই না । „ বিদ্যা আপত্তি জানালেও সে কিসের জন্য আপত্তি জানালো সেটা বিদ্যা নিজেই বুঝতে পারলো না । ওর আপত্তি কি বিক্রমের কাজের জন্য নাকি বিক্রমের নামের জন্য ?
মাকে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে প্রায় রাজি করিয়ে এনেছিল দিব্যা । তাই হঠাৎ মায়ের আপত্তি মানতে পারলো না সে , “ আমি অনুমতি চাইছি না । আমি বলছি । „ ভাতের থালা সরিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে দিব্যা বলে চললো , “ আমার কোন সিদ্ধান্তে তুমি কখনো রাজি হয়েছো ! এই জন্য তোমার সাথে আমার কথা বলতে একদম ইচ্ছা করে না । বাবা থাকলে আমার সাথে তুমি এমন করতে পারতে না । „ বলে থালায় আধখাওয়া ভাত রেখে উঠে চলে গেল দিব্যা ।
মেয়ের কথায় বিদ্যা পাথর হয়ে গেল । গলায় কিছু একটা দলা পাকিয়ে এলো । কথা বলতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার , “ ভাতের উপর রাগ করিস না । খেয়ে যা । „ এই কথাটাও বিদ্যা বলতে পারলো না ।
মেয়ে চলে যাওয়ার পরও বিদ্যা কিছুক্ষন বসে রইলো । খাবার আর গলা দিয়ে নামবে না , এমনিতেও তার খাওয়া হয়ে এসেছিল , তাই সে উঠে পড়লো । এঁটো থালাবাসন মাজতে মাজতে বারবার বুকটা মুছড়ে উঠছিল । অশ্রু ভেজা শিক্ত চোখে রাতের বাকি কাজ শেষ করে , সে উপরে দুতলায় নিজের বেডরুমে চলে এলো ।
বিছানায় নিজের কোমল ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিতেই এতক্ষণের আটকিয়ে রাখা অশ্রু বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে এলো । বিদ্যা ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো । খাটের পাশে একটা টেবিলে রাখা তার স্বামির ফটোর দিকে তাকিয়ে বিদ্যা তার সমস্ত অভিযোগ জানাতে লাগলো , “ কেন তুমি আমায় একা ফেলে চলে গেল ? তুমি আমায় কথা দিয়েছিলে আমরা সারাজীবন একসাথে থাকবো । তুমি তোমার কথা রাখোনি । কেন আমায় একা ফেলে চলে গেলে ? তোমার মেয়ে আজও আমায় দোষী ভাবে ...
ফটো উত্তর দেয়না । দিতে পারেনা । বিদ্যার স্বামীর ফটোও কোন উত্তর দিল না । উত্তর না পেলেও বিদ্যা নিজের মনের কথা গুলো তার মৃত স্বামীর উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো , “ ও লিভিংয়ে যেতে চায় । তুমি বলো আমি এতে কিভাবে রাজি হতে পারি ? আমি কি কখনও ওর খারাপ চেয়েছি ? আমি ওর মা । আমি তো ওর সবসময় ভালো চাই । তবুও ও কেন বোঝেনা ? ....
কেঁদে নিজের মন হালকা করলে নাকি ভালো ঘুম হয় । কিন্তু বিদ্যার ঘুম হলো না । মেয়ের চিন্তায় তার ভালো ঘুম আসেনি । সকালে দিব্যাকে ডিমটোস্টের ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দিয়ে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলো , “ ছেলেটার বাড়িতে কে কে আছে ? „
ডিমটোস্টে কামড় বসিয়ে দিব্যা বললো , “ কেউ নেই । অনাথ । „
বিদ্যার মনটা খচখচ করে উঠলো । এগারো বছর আগের একটা ঘটনার কথা মনে পড়লো । এগারো বছর আগের সেই ছেলেটাই এই ছেলে কিনা সেটা জানার জন্য সে মেয়েকে বললো , “ ছেলেটার কোন ফটো আছে তোর কাছে ? „
দিব্যা কোন কথা না বলে তার স্মার্ট ফোনের গ্যালারি থেকে একটা ফটো বার করে দিল । এটা একটা সেলফি । তাতে দিব্যা আর ছেলেটা আছে । ফোনটার স্ক্রিনে চোখ দিতেই বিদ্যার আর কোন সন্দেহ রইলো না যে এই যুবক ছেলেটাই সেই এগারো বছর আগের কিশোর । নিজের অগোচরেই বিদ্যা ছেলেটার মুখ দেখতে লাগলো । আগের থেকে এখন মুখে একটু কাঠিন্য এসেছে । পুরুষালি কঠিন মুখ , চোখের দৃষ্টিতে অভিজ্ঞতার ছাপ স্পষ্ট । আর মুখের রঙটাও যেন আগের থেকে বেশি চাপা পড়েছে । হুম , দিব্যা বলেছিল ছেলেটা এখন গ্যারাজে কাজ করে । ওইজন্যেই হয়তো রোদে পুড়ে চামড়ার রঙ কালো হয়েছে ।
বিদ্যার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে এইভাবে ছেলেটা তার জীবনে আবার ফিরে আসবে ! কাল ঘুমানোর আগ পর্যন্ত সারাক্ষণ সে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছে যে ছেলেটার যেন তাকে না মনে থাকে । প্রার্থনা এইজন্য যে বিদ্যার মেয়ের লিভিংয়ে যাওয়ায় রাজি হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই । কিন্তু একটা কথা বিদ্যার মনে খচখচ করছে । সেটা হলো ওইবয়সে ছেলেরা অনেক কিছু করলেও সেগুলো তাদের সারাজীবন মনে থাকে । তাই এগারো বছর আগের ঘটনা ছেলেটার মনে থাকতেই পারে ।
দুই দিন পরেই দিব্যা নিজের ব্যাগ গুছিয়ে চলে গেল । মেয়ের যাওয়াটা কোন ভাবেই বিদ্যা আটকাতে পারলো না । এমনিতেও সেদিন রাতেই বিদ্যা বুঝতে পেরেছিল মেয়েকে আটকানো যাবে না । তাই সে ছেলের নাম ঠিকানা পরিচয় দিতে বলেছিল । দিব্যা ফোন থেকে বিক্রমের একটা ফটো দেখিয়েছিল আর তার ঠিকানা একটা কাগজে লিখে দিয়েছিল ।
মেয়ে তার যতোই অবাধ্য হোক , যতোই সে তার অমতে গিয়ে লিভিংয়ে যাক , তবুও বিদ্যা মেয়েকে আশির্বাদ ছাড়া আর কিছুই দিতে পারলো না । মেয়েকে রাস্তা দিয়ে চলে যেতে দেখতে দেখতে বিদ্যা ঠাকুরের কাছে মনে মনে প্রার্থনা করলো , “ হে ঠাকুর মেয়েটা যার কাছে যাচ্ছে সে যেন ওকে সুখী রাখে , আমার কাছে যা পাইনি তা যেন ওর কাছে পায় । „
বিদ্যা বিক্রমের নামটা উচ্চারন করলো না । কারন বিদ্যার মৃত স্বামী নামও তো বিক্রম ছিল ।
মানুষের জীবন বড়োই অদ্ভুত এবং অনিশ্চিত । গণনা করে ভবিষ্যতের অতল অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা নিয়তির নিষ্ঠুর লেখন সম্পর্কে কখনোই সুনিশ্চিত ভাবে কিছু বলা যায় না । তাই মানুষকে ভালো মন্দ সবকিছুর জন্যই সদাপ্রস্তুত থাকতে হয় । সর্বদা সতর্কতা অবলম্বন করে চললেও ফাঁকফোকর দিয়ে এমন কিছু ঘটতে থাকে বা ঘটে যা আমাদের মানসিক এবং শারীরিক দুই সত্ত্বাকে নাড়িয়ে দিতে সক্ষম । অনেকে আবার এই ঘটনা গুলোকে ‘ জীবনের মোড় , বলতে বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করেন । তো এই জীবনের চলার পথে কখন কোন মোড় কোথা থেকে ঘুরে যায় ! সেটা কেউ বলতে পারে না । সেরকমই একটা বড়ো মোড় ঘুরলো বিদ্যার জীবনে । তবে জীবনের এই পুতুলনাচ খেলায় সে অভ্যস্ত । বিয়ের পর মাত্র ছয় বৎসর সুখে সংসার করে , পনেরোটা বসন্ত সে নিজের ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে , বিধবা বেশে কাটিয়েছে ।
এখন বিদ্যার বয়স চল্লিশ ছুঁইছুঁই । বিদ্যা ৫ ফুট ৫ ইঞ্চির বিধবা রুপসী এক বঙ্গ গৃহবধূ। বয়স চল্লিশ ছুঁইছুঁই হলে কি হবে ! বিদ্যাকে দেখতে লাগে বত্রিশ তেত্রিশ বছরের বঙ্গ তনয়া । মুখে কিংবা শরীরে বার্ধক্যের ছাপ তো দূরে থাক যখন বিদ্যা তার মেয়ের সঙ্গে পাশাপাশি হেঁটে যায় তখন তাদের মা মেয়ের মত তো কখনোই দেখতে লাগেনা । বক্ষ ও কটিদেশ এর মত নারী শরীরের যে একান্ত নিজস্ব অঙ্গ গুলি যা এক নারীকে তুলে ধরে এক অপার্থিব রহস্যময়ী যৌন আবেদনময়ী হিসেবে সেই সব অঙ্গের সৌন্দর্য বিদ্যার শরীরে বর্তমান । স্বভাবে সে মিতভাষী , শান্ত । তার চরিত্রের সবথেকে বড় শক্তি হলো তার কোমলকুসুম হৃদয় ।
বিবিডি বাগে গঙ্গার ঘাটের খুব কাছে আড়াই কাঠা জমির উপর একটা দুই তলা বাড়িতে বিদ্যা তার মেয়েকে নিয়ে থাকে । বাড়িটা বিদ্যার নিজের । আসলে এই বাড়িটা বিদ্যার শাশুড়ির বাপের বাড়ির সম্পত্তি । বিদ্যার স্বামী এই বাড়িটা তার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিল । বাড়ির দুতলায় ওঠার সিড়ির বাম দিকে একটা সুন্দর ঘর আছে , তাকে চিলেকোঠার ঘর বলতে বিদ্যা নারাজ । সেই ঘরেই বিদ্যা থাকে । আর সিড়ির ডান দিকে আছে তিন দিকে প্রায় তিনফুট উঁচু পাঁচিল দেওয়া নেঁড়া বা খোলা ছাদ । এখানে ভেজা কাপড় শোকাতে দেওয়া হয় , এবং শীতকালে লেপ কম্বল গরম করতে দেওয়া হয় । বাড়ির পশ্চিম দিকে সুবিশাল অট্টালিকা না থাকার জন্য এই ছাদ দিয়ে গঙ্গার জলে স্টিমার , নৌকা আর ছোট মালবাহী জাহাজের বিচরণ দেখা যায় । আর কিছুদূরে সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকা হুগলি সেতুর মনোরম সৌন্দর্য উপভোগ্য।
বিকাল বেলা এই ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখতে খুব ভালো লাগে বিদ্যার । পড়ন্ত সূর্যের কিরণ গঙ্গার নিল জলে আর আকাশের সাদা তুলোর মত মেঘের মধ্যে বিচ্ছুরিত হয়ে এক অপার্থিব মনমাতানো সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে । এই মনমাতানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে বিদ্যা হারিয়ে যায় অতিতের রঙিন দিন গুলোতে । কত বিকাল সে তার ভালোবাসার মানুষের হাতে হাত রেখে , কাঁধে মাথা রেখে কাটিয়েছে তার গোনাগুনতি নেই । এখন তার জীবন সাদা ক্যানভাসের মত ফাঁকা , কোন রঙ নেই তাতে । তাই সে অতীতের দিনগুলোতে ডুবে গিয়ে কিছু রঙ ধার করে এনে সাদা ক্যানভাসটাকে রঙিন করার ব্যার্থ চেষ্টা করে । চেষ্টা ব্যার্থ হওয়ার পর বিদ্যার মন বিষিয়ে ওঠে , একাকিত্ব এবং নিঃসঙ্গতা চারদিক থেকে ঘিরে ধরে তার শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করে ।
সময়টা বাংলা জৈষ্ঠ্য মাসের একেবারে শেষের দিকে আর ইংরেজি জুন মাসের মাঝামাঝি । দিনের বেলায় প্রখর রোদ আর কাঠফাটা গরমে এই কল্লোলিনী তিলোত্তমার বাসিন্দারা হাঁসফাঁস করছে । সুধুমাত্র দুই পেয়ে বাসিন্দা ছাড়াও চার পেয়ে প্রানী আর পাখিদেরও অবস্থা শোচনীয় । সারাদিন সূর্য তার উষ্ণ কিরণের মাধ্যমে নিজের তেজ দেখানোর পর বিকালের দিকে মিঠে উষ্ণহীন রঙিন কিরণ ছড়িয়ে দিয়েছে আকাশে । যেন সারাদিনের কর্মকান্ডের জন্য সে বিকাল বেলায় ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছে ।
প্রতিদিনের মত আজও বিকালবেলায় দুপুরে স্নানের পর মেলে দেওয়া শাড়ি , সায়া ব্লাউজ তুলতে এলো বিদ্যা । ছাদে এসে বিদ্যা শুকিয়ে যাওয়া শাড়িটা তুলে হাত নিল , ঠিক তখনই গঙ্গার বুক থেকে এক কোমল শীতল হাওয়া ধেয়ে এসে বিদ্যার আঁচল উড়িয়ে তার মনকে শান্ত কোমল করে তুললো । কোন এক অমোঘ ঘোরে সে ছাদের কার্নিশের দিকে যেতে শুরু করলো । হাতে সুধুমাত্র শুকিয়ে যাওয়া সুতির শাড়িটা নিয়ে সে দাঁড়ালো কার্নিশে হাত দিয়ে । গঙ্গার মৃদুমন্দ বাতাস এসে বিদ্যার একরাশি ঘন কালো চুলকে উড়িয়ে দিতে চাইলো । বিদ্যাও তার খোঁপা খুলে চুলগুলোকে উড়তে দিল । এই একরাশি ঘন কালো কেশ বিদ্যার মতোই স্বাধীন হতে চায় । যত্ন চায় , আদর চায় , ভালোবাসা চায় । চল্লিশ ছুঁই ছুঁই এই বঙ্গ ললনার কালো হরিণ চোখ গঙ্গার জল আর নিল আকাশের মধ্যে পাল্লা দিয়ে রঙের খেলা দেখতে লাগলো । কিছুক্ষনের মধ্যেই সে এই মনমাতানো সৌন্দর্যে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লো ।
তন্দ্রা কাটলো খুব কাছে এক বাড়ি থেকে আসা শাঁখের আওয়াজে । তৎক্ষণাৎ বিদ্যার মনে পড়লো যে সন্ধ্যা দেওয়া হয়নি । তাই সে বাকি কাপড় গুলো তুলে নিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো । নিজের শাড়ি শায়া গুছিয়ে আলনায় সাজিয়ে রেখে দিল । দুপুরে নিজের ভেজা কাপড় শুকাতে দেওয়ার পর দিব্যার শুকিয়ে যাওয়া কাপড় গুলো সে নিচে নামিয়ে এনে গুছিয়ে রেখেছিল । নিজের কাপড় গোছানো হয়ে গেলে বিদ্যা নিচে নেমে লিভিংরুম , রান্নাঘর এবং বাকি দুটো ঘরের লাইট জ্বালিয়ে ঠাকুর ঘরে ঢুকলো । সব ঘরের আলো জ্বালানো হয়ে গেলে বিদ্যা গোপালের সিংহাসনের কাছে এসে বসে পবিত্র মন নিয়ে শাঁখ বাজিয়ে চারটে ধূপকাঠি ধরিয়ে সন্ধ্যা দিল ।
সন্ধ্যা দেওয়া হয়ে গেলে শুধুমাত্র দুটো ধূপকাঠি গোপালের সামনে রেখে আর দুটো হাতে নিয়ে বাড়ির বাইরে চলে এলো । বাইরে আসার আগে অবশ্য সে দুটো বেডরুম আর রান্নাঘরের লাইট বন্ধ করে দিল । উঠোনে এসে ধূপকাঠি দুটো তুলসী তলায় দিয়ে দিল । তারপর বাড়িতে ঢোকার বড় লোহার গেট পেরিয়ে রাস্তায় চলে এলো । বিদ্যাকে বড় লোহার গেট খুলে বাড়ির বাইরে আসতে দেখে রাস্তার ওই পাশের একটা সাইকেল সারাইয়ের দোকান থেকে এক বছর পঁয়ত্রিশের লোক বেরিয়ে এলো ।
বাড়ির উঠোনের পরেই লোহার গ্রিল সংলগ্ন বিদ্যার শাড়ির দোকান । এই দোকানে শাড়ি বিক্রি করে এবং সেলাইয়ের কাজ করে বিদ্যা একা হাতে দিব্যাকে লেখাপড়া শিখিয়ে নার্সিং পড়িয়েছে । দোকানের সামনে এসে প্রনাম করে শাটারের চাবির ফুটোয় চাবি ঢুকিয়ে দিল । ঠিক তখনই সেই লোকটা এসে ভারী শাটার তুলে দোকান খুললো । গত ছয় সাত বছর ধরে লোকটা বিদ্যাকে দোকান খোলায় সাহায্য করছে । লোকটা এই সাহায্য নিঃস্বার্থভাবে করলেও বিদ্যা প্রতিবছর পূজার সময় লোকটাকে এক জোড়া ভালো জামা কাপড় দেয় ।
শাটার তুলে দিয়ে লোকটা ইশারায় বললো ‘ রাতে দোকান বন্ধ করার সময় সে এসে শাটার নামিয়ে দেবে । ‚
ইশারা করার কারন হলো লোকটা মূক ও বধির । বিদ্যা এক মুখ হাসি নিয়ে বললো , “ হ্যাঁ ডাকবো । „
লোকটা চলে গেলে বিদ্যা দোকানে ঢুকে লাইটটা জ্বালিয়ে দিল । ভালো ভাবে ঝাঁট দিয়ে দুটো ধুপ ধরিয়ে দক্ষিন দিকের দেওয়ালে নতুন পুরানো পাঁচটা বাংলা ক্যালেন্ডারে ছাপা রাধা কৃষ্ণ , গণেশ , মা কালির সামনে ধূপদুটো গুঁজে দিল । তারপর রোজকার মত পুরানো পায়ে চালানো সেলাই মেশিনের সামনে বসে পড়লো ব্লাউজ সেলাই করার জন্য । কালকের মধ্যে দুটো ব্লাইজ দিতে পারলে নিশ্চিন্ত ।
একাগ্র মনে সেলাই করতে করতে যখন সেলাইয়ের কাজ শেষের মুখে তখন বিদ্যা দিব্যার স্কুটির আওয়াজ শুনতে পেল । মুখ তুলে দেখলো তার মেয়ে বাড়ি ঢোকার বড় লোহার গ্রিলটা খুলছে । উত্তর দিকের দেওয়ালে একটা ঘড়ি টাঙানো আছে । তাতে তাকিয়ে দেখলো সাতটা বাজে ।
দিব্যার বাবার পছন্দের অভিনেত্রী ছিল দিব্যা ভারতী । এতোটাই পছন্দ ছিল যে তার একমাত্র মেয়ের নাম সেই অভিনেত্রীর নামেই রাখার সিদ্ধান্ত নেয় । দিব্যা রায় । বিদ্যা নাম রাখার সময় বলেছিল , “ বাঙালি মেয়ের নাম দিব্যা ! „
দিব্যার বাবা তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে রসিকতার ছলে বললো , “ কেন ! হতে পারে না বুঝি ! „
“ হবে না কেন ! হতেই পারে । তবে এর থেকেও তো ভালো ভালো নাম আছে । „
দিব্যার বাবা বুঝতে পারলো যে তার স্ত্রী মেয়ের জন্য নাম ঠিক করেছে । তাই দিব্যার বাবা জিজ্ঞেস করলো “ তোমার কোন নাম পছন্দ হলে বলো । „
বিদ্যা তার মনের মত একটা নাম বললো , “ উরভি „ ।
স্বামী স্ত্রীতে বেশকিছুক্ষন নাম নিয়ে আলোচনা হওয়ার পর ঠিক হয়েছিল যে যদি মেয়ে সন্তান হয় তাহলে নাম রাখা হবে “ দিব্যা „ আর যদি ছেলে সন্তান হয় তাহলে বিদ্যা নিজের মনের মত রাখতে পারবে । এখন সেইসব কথা মনে পড়লে বিদ্যার বুক ফাটে । বিদ্যা নিজের মেয়ের নাম রাখতে চেয়েছিল উরভি । উরভি দেবী লক্ষ্মীর আর এক নাম । আর আজ সেই মেয়েই মায়ের কথা মেনে চলে না ।
বিদ্যা ঘড়িতে সময় দেখে আবার ব্লাউজ সেলাইয়ে মন দিল । আরো কিছুক্ষন অতিবাহিত হওয়ার পর বিদ্যা বুঝলো যে আজকে আর কেউ গল্পো করতে আসবে না । সন্ধ্যার দিকে আশেপাশের বয়স্ক মহিলারা বিদ্যার শাড়ির দোকানে এসে একত্রিত হয় । বয়স্ক বললে ভুল হবে কারন এই গ্রুপে যেমন চল্লিশ বছরের গৃহবধু পোদ্দার গিন্নি আছে ঠিক তেমন আশি বছরের বিধবা বৃদ্ধা মাধবীলতাও আছে। এরা সাধারণত আসে গল্প গুজব করতে , এর ওর খবর নিতে আর সন্ধ্যার জলখাবার খেতে । এতে বিদ্যা খুশিই হয় । সন্ধ্যার খাওয়াটাও হয় আবার একাকিত্বও কাটে ।
সাড়ে নটার দিকে বিদ্যা বুঝতে পারলো যে আজকে আর কোন খরিদ্দারও আসবে না । তাই সে অন্যান্য কাজ গুছিয়ে দশটা বাজতেই দোকান বন্ধ করে দিল । না হলে দিব্যাকে খেতে দিতে দেরি হবে আর সে বাড়ি মাথায় তুলবে । বিদ্যার দোকান বন্ধ করার তোড়জোড় দেখতে পেয়ে লোকটা এসে শাটার নামিয়ে দিলে বিদ্যা তালা মেরে দিল । লোকটার সাইকেলের দোকান বন্ধ হতে এখনো এক ঘন্টা বাকি । বিদ্যা বাড়ি ঢুকে সাড়ে দশটার মধ্যে রাতের খাবার গরম করে মেয়েকে ডাকলো খেয়ে নেওয়ার জন্য ।
রাতে ভাত আর ফুলকপির তরকারি খেতে খেতে কিছুটা ইতস্তত করে , হুট করে দিব্যা বললো , “ মা , আমি ভাবছিলাম লিভিংয়ে যাবো । „
মেয়ের কথাটা বিদ্যা বুঝতে না পারলেও লিভিং শব্দটার মানে সে জানে । আজকাল নতুন ফ্যাশন উঠেছে । বিয়ের আগে ছেলে মেয়ে একসাথে কিছুদিন থেকে একে অপরকে চিনে নেয় । একে লিভিং বলে । মেয়ের কথা বুঝতে পেরে কিছুটা রুক্ষ স্বরে বিদ্যা নিজের আপত্তি জানালো , “ লিভিং ! এই বয়সে ! বয়স কতো তোর ? „
মায়ের কথায় দিব্যা রেগে গিয়ে বললো , “ আমি এখন ম্যাচিউর হয়েছি আর নিজে ইনকাম করি । সমস্যা কোথায় ? আর তুমি বয়সের কথা বলছো ! তুমি তো আমার থেকেও কম বয়সে বাবার সাথে বিয়ে করেছিলে ! „
মেয়ের অভব্য আচরণে বিদ্যার মন বিষিয়ে গেলেও সে দিব্যার উপর রাগ দেখাতে পারলো না “ তোর বাবা থাকলে কখনো রাজি হতো না ! „
দিব্যা গলায় ঝাঁঝ বজায় রেখে বললো , “ বাবা থাকলে রাজি হতো কি হতো না সে পরের ব্যাপার । বাবা নেই , তুমি আছো । তাই তোমাকে বলছি ? „
বিদ্যা কি বলবে কিছুই বুঝতে পারলো না । এইরকম পরিস্থিতিতে মেয়েকে কি বলে আটকাবে সেটা তার জানা নেই । দিব্যা যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে তখন সে লিভিংয়ে যাবেই । তাই সে বললো , “ লিভিংয়ে গেলে পাড়ার লোকে ছিঃ ছিঃ করবে এর থেকে বরং তুই বিয়ে করে নে ...
মায়ের কথার মাঝে দিব্যা ব্যাঙ্গের হাসি হেসে উঠলো , “ তুমি পারবে আমায় বিয়ে দিতে ? একটা বিয়েতে এখন কত খরচা হয় জানো তুমি ? „
মেয়ের কথায় বিদ্যা গুম মেরে গেল । বিদ্যার পড়াশোনার জন্য ব্যাঙ্ক থেকে এডুকেশন লোন নিয়েছিল সে । যার কিস্তি বিদ্যা এখনো দিয়ে যাচ্ছে । মাকে চুপ করে থাকতে দেখে দিব্যা মায়ের হাতে হাত রেখে বললো , “ ছেলেটা ভালো । শুধু লিভিংয়েই তো যাচ্ছি । কোন সমস্যা হবে না । „
মায়ের এই দূর্বলতা সম্পর্কে দিব্যা ওয়াকিবহাল। একটু ভালো ভাবে কথা বললেই বিদ্যা দূর্বল হয়ে পড়ে । এই সুযোগটাই দিব্যা নিতে চাইলো । বিদ্যা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞাসা করলো , “ ওর নাম কি ? কি কাজ করে ? „
“ ওর নাম বিক্রম । আর ও গাড়ি ঠিক করে , মানে গাড়ির ম্যাকানিক । একটা গ্যারাজে কাজ করে „
বিক্রম নামটা শুনেই বিদ্যার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো , দৃঢ় কন্ঠে সে বলে উঠলো “ না। কখনোই না । একজন গ্যারেজ ম্যাকানিক এর সাথে কখনোই না । „ বিদ্যা আপত্তি জানালেও সে কিসের জন্য আপত্তি জানালো সেটা বিদ্যা নিজেই বুঝতে পারলো না । ওর আপত্তি কি বিক্রমের কাজের জন্য নাকি বিক্রমের নামের জন্য ?
মাকে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে প্রায় রাজি করিয়ে এনেছিল দিব্যা । তাই হঠাৎ মায়ের আপত্তি মানতে পারলো না সে , “ আমি অনুমতি চাইছি না । আমি বলছি । „ ভাতের থালা সরিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে দিব্যা বলে চললো , “ আমার কোন সিদ্ধান্তে তুমি কখনো রাজি হয়েছো ! এই জন্য তোমার সাথে আমার কথা বলতে একদম ইচ্ছা করে না । বাবা থাকলে আমার সাথে তুমি এমন করতে পারতে না । „ বলে থালায় আধখাওয়া ভাত রেখে উঠে চলে গেল দিব্যা ।
মেয়ের কথায় বিদ্যা পাথর হয়ে গেল । গলায় কিছু একটা দলা পাকিয়ে এলো । কথা বলতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার , “ ভাতের উপর রাগ করিস না । খেয়ে যা । „ এই কথাটাও বিদ্যা বলতে পারলো না ।
মেয়ে চলে যাওয়ার পরও বিদ্যা কিছুক্ষন বসে রইলো । খাবার আর গলা দিয়ে নামবে না , এমনিতেও তার খাওয়া হয়ে এসেছিল , তাই সে উঠে পড়লো । এঁটো থালাবাসন মাজতে মাজতে বারবার বুকটা মুছড়ে উঠছিল । অশ্রু ভেজা শিক্ত চোখে রাতের বাকি কাজ শেষ করে , সে উপরে দুতলায় নিজের বেডরুমে চলে এলো ।
বিছানায় নিজের কোমল ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিতেই এতক্ষণের আটকিয়ে রাখা অশ্রু বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে এলো । বিদ্যা ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো । খাটের পাশে একটা টেবিলে রাখা তার স্বামির ফটোর দিকে তাকিয়ে বিদ্যা তার সমস্ত অভিযোগ জানাতে লাগলো , “ কেন তুমি আমায় একা ফেলে চলে গেল ? তুমি আমায় কথা দিয়েছিলে আমরা সারাজীবন একসাথে থাকবো । তুমি তোমার কথা রাখোনি । কেন আমায় একা ফেলে চলে গেলে ? তোমার মেয়ে আজও আমায় দোষী ভাবে ...
ফটো উত্তর দেয়না । দিতে পারেনা । বিদ্যার স্বামীর ফটোও কোন উত্তর দিল না । উত্তর না পেলেও বিদ্যা নিজের মনের কথা গুলো তার মৃত স্বামীর উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো , “ ও লিভিংয়ে যেতে চায় । তুমি বলো আমি এতে কিভাবে রাজি হতে পারি ? আমি কি কখনও ওর খারাপ চেয়েছি ? আমি ওর মা । আমি তো ওর সবসময় ভালো চাই । তবুও ও কেন বোঝেনা ? ....
কেঁদে নিজের মন হালকা করলে নাকি ভালো ঘুম হয় । কিন্তু বিদ্যার ঘুম হলো না । মেয়ের চিন্তায় তার ভালো ঘুম আসেনি । সকালে দিব্যাকে ডিমটোস্টের ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দিয়ে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলো , “ ছেলেটার বাড়িতে কে কে আছে ? „
ডিমটোস্টে কামড় বসিয়ে দিব্যা বললো , “ কেউ নেই । অনাথ । „
বিদ্যার মনটা খচখচ করে উঠলো । এগারো বছর আগের একটা ঘটনার কথা মনে পড়লো । এগারো বছর আগের সেই ছেলেটাই এই ছেলে কিনা সেটা জানার জন্য সে মেয়েকে বললো , “ ছেলেটার কোন ফটো আছে তোর কাছে ? „
দিব্যা কোন কথা না বলে তার স্মার্ট ফোনের গ্যালারি থেকে একটা ফটো বার করে দিল । এটা একটা সেলফি । তাতে দিব্যা আর ছেলেটা আছে । ফোনটার স্ক্রিনে চোখ দিতেই বিদ্যার আর কোন সন্দেহ রইলো না যে এই যুবক ছেলেটাই সেই এগারো বছর আগের কিশোর । নিজের অগোচরেই বিদ্যা ছেলেটার মুখ দেখতে লাগলো । আগের থেকে এখন মুখে একটু কাঠিন্য এসেছে । পুরুষালি কঠিন মুখ , চোখের দৃষ্টিতে অভিজ্ঞতার ছাপ স্পষ্ট । আর মুখের রঙটাও যেন আগের থেকে বেশি চাপা পড়েছে । হুম , দিব্যা বলেছিল ছেলেটা এখন গ্যারাজে কাজ করে । ওইজন্যেই হয়তো রোদে পুড়ে চামড়ার রঙ কালো হয়েছে ।
বিদ্যার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে এইভাবে ছেলেটা তার জীবনে আবার ফিরে আসবে ! কাল ঘুমানোর আগ পর্যন্ত সারাক্ষণ সে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছে যে ছেলেটার যেন তাকে না মনে থাকে । প্রার্থনা এইজন্য যে বিদ্যার মেয়ের লিভিংয়ে যাওয়ায় রাজি হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই । কিন্তু একটা কথা বিদ্যার মনে খচখচ করছে । সেটা হলো ওইবয়সে ছেলেরা অনেক কিছু করলেও সেগুলো তাদের সারাজীবন মনে থাকে । তাই এগারো বছর আগের ঘটনা ছেলেটার মনে থাকতেই পারে ।
দুই দিন পরেই দিব্যা নিজের ব্যাগ গুছিয়ে চলে গেল । মেয়ের যাওয়াটা কোন ভাবেই বিদ্যা আটকাতে পারলো না । এমনিতেও সেদিন রাতেই বিদ্যা বুঝতে পেরেছিল মেয়েকে আটকানো যাবে না । তাই সে ছেলের নাম ঠিকানা পরিচয় দিতে বলেছিল । দিব্যা ফোন থেকে বিক্রমের একটা ফটো দেখিয়েছিল আর তার ঠিকানা একটা কাগজে লিখে দিয়েছিল ।
মেয়ে তার যতোই অবাধ্য হোক , যতোই সে তার অমতে গিয়ে লিভিংয়ে যাক , তবুও বিদ্যা মেয়েকে আশির্বাদ ছাড়া আর কিছুই দিতে পারলো না । মেয়েকে রাস্তা দিয়ে চলে যেতে দেখতে দেখতে বিদ্যা ঠাকুরের কাছে মনে মনে প্রার্থনা করলো , “ হে ঠাকুর মেয়েটা যার কাছে যাচ্ছে সে যেন ওকে সুখী রাখে , আমার কাছে যা পাইনি তা যেন ওর কাছে পায় । „
বিদ্যা বিক্রমের নামটা উচ্চারন করলো না । কারন বিদ্যার মৃত স্বামী নামও তো বিক্রম ছিল ।