Thread Rating:
  • 16 Vote(s) - 3.31 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
ভৌতিক গল্প সংকলন (সমাপ্ত)
#45
[Image: FB-IMG-1692254174361.jpg]

|| পালঙ্ক ||

লেখায় :- পার্থ মুখার্জী

ট্রেন থেকে ফুলডিঙা স্টেশনে যে কজন নামলো তার মধ্যে অশোকের পোশাকেই একমাত্র বাবুয়ানির ছাপ বর্তমান। তাই অখ্যাত এই স্টেশনে ইতি উতি ছড়িয়ে থাকা গ্রাম্য মানুষ গুলোর প্রত্যেকেরই নজর গেল অশোকের দিকে। আকাশের মুখ সকাল থেকেই ভার। ফোটা ফোটা জল পরে চলেছে একনাগাড়ে। এ অঞ্চলে অশোকের প্রথম আসা। ছাতা টা মাথায় দিয়ে পকেট থেকে একটা চিরকুট বার করে স্টেশনের কোনে এক চা দোকানিকে দেখিয়ে ঠিকানাটা জেনে নিলো সে ।কিছু কথা বলে সামনের রিকশা স্ট্যান্ড থেকে একটা রিকশা নিয়ে গ্রামের পথ ধরে পৌঁছে গেল মানিকপুর। বেশ গ্রাম্য পরিবেশ। তার ওপর বৃষ্টির কৃপায় সবুজে সবুজ চারিদিক। বৃষ্টির জল আর চোখের জলের মধ্যে এই কিছু দিন কোনটা বেশি তাকে ভিজিয়েছে তা বলা কঠিন।মানিকপুরের চৌমাথায় নেমে সে যখন নদীর ঘাটে যাওয়ার পথ ধরলো তখন বিকালের আলোয় সন্ধ্যার অন্ধকার ভাগ বসাতে শুরু করেছে।কিছুটা পায়ে হেঁটেই ভাঙা চোরা নদী ঘাটে এসে এক জাল গোটাতে থাকা জেলেকে সে ভুবন মজুমদারের বাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞাসা করলো। উত্তরে জেলে হাত তুলে নদীর ধারে এক আধ ভাঙা বেশ বড়ো একটা বাড়ি ইশারায় দেখিয়ে দিলো।
তাহলে এসেই পরেছি! কিছুটা নিশ্চিন্ত হোলো অশোক। দ্রুতপায়ে ভাঙা রাস্তাটা পেরিয়ে বাড়ির গন্ডির মধ্যে প্রবেশ করলো সে। নদীর পারে এমন প্রকান্ড বাড়ি সে শুধু টিভিতেই দেখেছে। মোটা মোটা থাম আর কারুকার্য করা দেয়াল গুলোই বলে  দিচ্ছে যে এককালে বাড়ির মালিক বেশ অবস্থাপন্ন ছিলেন। বৃষ্টির ঝাপ্টা আর নদীর হাওয়ায় চোখ খুলে রাখাই দায়। তাড়াতাড়ি সে উঠে এলো দালানে। আলো আঁধারি মাখা পরিবেশ ভালোই লাগছে তবে মনে শান্তি না থাকলে এসব পরিবেশে কাব্য আসে না তা অশোক বিলক্ষন জানে।দেখে মনে হচ্ছে বাড়ির শেষ অবস্থা চলছে, কিছুটা তার মতোই। তার ও যেমন বাঁচার ইচ্ছা দিন দিন কমে আসছে বাড়িটা দেখেও যেন মনে হচ্ছে ভেঙে পরতে পারলে বেঁচে যায়। রুমালে মুখটা মুছে নিয়ে দরজায় কয়েকবার কড়া নাড়লো সে। ভিতরে কয়েকটা শব্দ জানান দিলো একটু সবুর করলেই দরজা খুলবে। হলোও তাই। এক বয়স্ক বৃদ্ধ কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা খুলেই অশোক কে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঝাপসা চশমার ফাঁক দিয়ে যাচাই করে নিলো। ভাঙা গলায় প্রশ্ন এলো...
কি দরকার ?
ভুবন বাবু আছেন?
আমিই ভুবন।
ও আচ্ছা। নমস্কার।একটা জরুরী দরকারে এসেছি।একটু কথা বলা যাবে ?
হ্যা বলুন।
আসলে অনেক কথা। একটু বসলে ভালো হয়।
নদীর ঘাটে বসবেন?
অশোক সম্মতি জানায়।বৃষ্টিও থেমেছে।
আপনি চলুন আমি আলো টা জেলে আসছি।
অশোক নদীর ঘাটে এসে বসে।মাঝ নদী তে তখন জেলে নৌকা গুলোর লণ্ঠণের আলো জোনাকির মতো লাগছে।
দলছুট পাখী গুলো বাসায় ফেরার নেশায় মত্ত।
বলুন।
চমকে ওঠে অশোক। বৃদ্ধ কখন তার পাশে এসে বসেছে খেয়াল করেনি সে।
শুরু থেকেই বলি।আমার নাম অশোক রায়। বাড়ি মুকুন্দ নগরে। পেশায় একটি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির সেলস ম্যানেজার ছিলাম। চাকরী ছেড়ে ছোটো একটা ওষুধের দোকান করেছিলাম ।স্ত্রী মায়া ও পুত্র বিট্টুকে নিয়ে দিব্যি সংসার জীবন কাটছিলো।কিন্তু কয়েক মাস আগেই একটা দুর্ঘটনায় ছেলেটা মারা গেলো মাত্র ষোলো বছর বয়সে।
দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরলো অশোকের।
মাফ করবেন।বলে জল মুছে নিলো সে।
কাঁধে হাত রেখে শান্তনা দেয় বৃদ্ধ।
বলে চলে অশোক। আসলে দোষ টা আমাদেরই ছিলো।আমরা স্বামী স্ত্রী একটা  অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম ওকে ঘরে রেখে। যদিও আমাদের কাজের মহিলা কমলাদি বাড়ি ছিলো তবুও সন্ধ্যে বেলা কিভাবে ও গ্যাস জেলে ম্যাগি করতে যায় আর সিলেন্ডার বাস্ট করে। কমলাদি  তখন পাশের দোকানে কিছু কিনতে গেসলেন। মুহূর্তে সব শেষ হয়ে যায়। এই দুঃখ বয়ে বেরাতে পারছি না আর।
চাকরীটা ছেড়ে ছিলেন কেন ?
অপ্রস্তুত হয়ে পরে অশোক। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে.. আসলে শুনে থাকবেন কয়েক বছর আগেই কিছু জাল ওষুধ বিক্রির অভিযোগে  বন্ধ হয়ে যায় একটা নামি কোম্পানি। সেই কোম্পানির সাথেই যুক্ত ছিলাম আমি। এক প্রকার কোম্পানির চাপে জোর করেই কিছু টাকার লোভে ওষুধ গুলো বাজারে ছেড়েছিলাম। কিন্তু কিছু মানুষ অসুস্থ হয়ে পরে, শুনেছিলাম মারাও গেসলো একজন। তার পরেই বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ কে টাকা খাইয়ে অবশ্য সব ধামা চাপা দেয়া হয় কোম্পানির পক্ষ থেকে । তার পর থেকেই নিজে ব্যবসা শুরু করি। ছেলেটাকে দেখা শোনা করতে কমলাদি কে রাখি, যদিও উনি নিজেই কাজ চাইতে এসেছিলেন। বেচারির কেউ নেই।কিন্তু আমার পাপে কেন আমার ছেলেটাকে ভুগতে হোলো বলবেন ? আমার স্ত্রী তো শোকে পাথর হয়ে গেছে। বলতে পারেন ওর দোষ কোথায় ? কি নিয়ে বাঁচবো আমরা ?
বুঝলাম,কিন্তু আপনার জাল ওষুধে একজনের প্রাণ গেল, আপনারা দুঃখ হয় না ?
বেশি টাকার লোভে হয়ে গেসলো। সে ঘটনা চাপা পরে গেছে আর কি হবে ভেবে !
এখন আমার কাছে কি চান ?
ছেলেটা মারা যাওয়ার কিছু দিন পর থেকেই বাড়িতে রাতের দিকে নানা আওয়াজ হতে থাকে। বেশির ভাগই ওর ঘর থেকে। ওর মা কয়েকবার স্বপ্নেও ওকে দেখেছে। কিছু বলতে চায় ও।ওর দেখা পেতে অস্থির হয়ে থাকি। কিন্ত কিছুই দেখতে পাই না। ওর আত্মা অতৃপ্ত। কমলাদি তো একদিন রাতে খুব ভয় পেয়েছিলো। ওর মাথার পাশে নাকি কে এসে দাড়িয়ে ছিলো অন্ধকারে। পর দিন সকালেই উনি কাজ ছেড়ে চলে যান আর যাবার আগে আমাকে  ওনার বাপের বাড়ির পাড়ায় আপনার ঠিকানা দেন । বলেন আপনি না কি আত্মার সাথে যোগাযোগ ঘটাতে পারেন।আমার সমস্যা একমাত্র আপনি মেটাতে পারবেন। আমি আমার মৃত ছেলের সাথে যোগাযোগ করে জানতে চাই ওর কি কষ্ট, কি বলতে চায় ও!
বুঝলাম সব। কিন্তু ওসব তো বহু বছর বন্ধ করে দিয়েছি।এই শরীরে আর পেরে উঠি না।বলে ওঠে বৃদ্ধ।
দয়া করে না বলবেন না। অনেক আশা নিয়ে দূর থেকে আসছি।ওর মার অবস্থা আমার চেয়েও খারাপ। বৃদ্ধের হাত দুটো ধরে কেঁদে ফেলে অশোক।
আহা! নিজেকে শক্ত করুন। দেখছি কি করা যায়।এ কাজে বেশ ঝুঁকি।তার আগে আপনাকে ভেবে দেখতে হবে পারবেন কি না।
নিশ্চই পারবো। আপনি শুধু বলুন কি করতে হবে আমায়।
আসলে আত্মার সাথে যোগাযোগ আমি ঘটাই না ঘটায় আমার বাড়ির একটা পুরানো পালঙ্ক।
শুনে আশ্চর্য হয় অশোক। পালঙ্ক মানে খাট ?
আজ্ঞে হ্যা। প্রথমে কেউ বিশ্বাস করে না। অবশ্য না করারই কথা। কিন্তু একবার ওতে শুলেই সব অবিশ্বাস - বিশ্বাস এর গণ্ডী মিলে মিশে এক হয়ে যাবে।
ব্যাপারটা একটু খুলেই বলি.. আমার পিতামহ হরিদেব মজুমদার তার কনিষ্ঠ কন্যাকে কলেরায় হারিয়ে পুরোপুরি ভেঙে পরেন। জমিদারীতে আর মন ছিলো না তার। আমার বাবার উপর সব দায়িত্ব অর্পণ করে  শান্তির খোঁজে এক সন্ন্যাসী সাধুর আশ্রমে চলে যান । নিজের মেয়ের মৃত্যুর দুঃখ ভুলতে দিনরাত সাধুর সেবার কাজে মন দেন।বহুবছর তার সেবা, ভক্তি দেখে সন্ন্যাসী খুব খুশি হয়ে হরিদেব বাবুকে কিছু চাইতে বলেন। কিন্তু তখনও সেই মেয়ের কথাই তার মাথায় চলছে। তিনি তার মৃত মেয়ে কে দেখতে চাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সাধু কিছু ভেবেই পিতামহ কে ডেকে আশ্রমের পিছনের জঙ্গলে নিয়ে যান। মন্ত্র উচ্চারণ করে নিজের হাত দুটো একটা সেগুন গাছে রেখে তাতে কিসব চিহ্ন এঁকে দেন আর বলেন...
এই গাছ কেটে তার কাঠ দিয়ে একটা পালঙ্ক বানাবি। অতি সাধারণ একটা পালঙ্ক। তাতে গদি পেতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখবি। তবে রোজ শুবি না। যেদিন মেয়ে কে দেখতে ইচ্ছা হবে শুবি। শুয়ে ঘুম আসবেই,আর এলেই পরলোকের দরজা খুলে যাবে তোর সামনে। এক অন্ধকার জগতে প্রবেশ করবি ঘুমের মধ্যেই। অনেক চেনা পরিচিতর আত্মা দেখতে পাবি এদিক ওদিক কিন্তু ঘুমের আগে যার কথা মনে করে শুবি তাকেই খুজবি। ঠিক দেখতে পাবি। তার চোখমুখ তোকে বলে দেবে সে ওই জগতে কেমন আছে। তাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করবি না। দূরে দূরে থাকবি।দেখা হয়ে গেলেই বেরিয়ে আসবি ওই জগৎ থেকে। ঘুম ও ভেঙে যাবে সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু কিছু বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে। পালঙ্কের ঘরে কেউ থাকবে না শোবার সময়।রোজ ব্যবহার করবি না। মানুষের শরীরে এতো চাপ নেয়ার ক্ষমতা নেই তাই কয়েকমাসেই শরীর ভেঙে পরবে। মৃত্যু অবধারিত। আর ঘুমের ওষুধ খেয়ে ওতে শুলে তোর নিজের আত্মা ওই জগতে হারিয়ে যাবার খুব সম্ভাবনা থাকবে। শরীর নিথর হয়ে পরে থাকবে আর ঘুম ভাঙবে না। সবচেয়ে যেটা ভয়ের সেটা হোলো কিছু খারাপ আত্মা থাকবে এই সুযোগে তোর অনিষ্ট করার, তারা ভয় দেখাবে, এ জগতে ঢুকতে চাইবে কিন্তু শুধু তোর মেয়ের কথাই ভাবতে থাকবি তাহলে ঠিক এসব এড়িয়ে যেতে পারবি।কি রে খুশি তো ?
হরিদেব বাবু আনন্দে আত্মহারা হয়ে ফিরে আসেন এখানে। তারপর লোক নিয়ে গিয়ে  গাছ কাটিয়ে শহরে নিয়ে গিয়ে সেই পালঙ্ক বানিয়ে আনেন।
তার পর ?অশোকের কৌতূহল বাঁধ মানছে না।
তারপর থেকেই শুরু হয় আমাদের বংশের করুন পরিণতি। পিতামহ মেয়ে কে দেখতে প্রায় রোজই ওতে শুতে থাকেন। কারোর সাথে এই বিষয়ে কোনো আলোচনাই তিনি করতেন না।ওই ঘরে ঢোকার অনুমতি কারোর ছিলো না। ক্রমে তার শরীর ভাঙতে থাকে। ছয় মাসের মধ্যেই তিনি ঘুমের মধ্যেই মেয়ের কাছে চলে যান।এর পর বহু বছর ওটা পরেই ছিলো। আমাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থাও খারাপ হতে শুরু করে। বাবা তখন প্রিয়জন হারাদের ওতে শুতে দেবার জন্য টাকা নিতে শুরু করেন। আমি তখন কলকাতায় মামার বাড়িতে থাকতাম। শুনে ছিলাম বাবা ও নাকি ওতে ঘুমাতে শুরু করে। কিছু দিন পর তিনি ও আর ওঠেন নি। যারা শুতো তারা বার বার ওটাতে শুতে চাইতো। তাই আমিও এক কালে অর্থের বিনিময়ে বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলাম। কিন্তু দিনকাল পরিবর্তন হোলো। বিয়ে করে সংসারী হলাম। মফস্বলে একটা কাজ করতে শুরু করলাম। ওটাকে ভুলেই গেলাম।মেয়ে হোলো।মেয়ের বিয়ে হয়েছিল শহরে ।  শহরেই কাজ কম্মো করে। হপ্তায় কয়েকদিন এসে রান্না বান্না, কেনা কাটা করে দিয়ে যায়।আজ সকালেও রান্না করে দিয়ে গেছে।বৌ মারা গেলেন সিঁড়ি থেকে পরে। যদিও আমার সন্দেহ ওকে কেউ ঠেলে দিয়েছিলো। কারন ওই পালঙ্ক কে ভর করে কিছু অশুভ আত্মা এ জগতে ঢুকতে চাইতো। যারা ঢুকে পরতো তারা এখানেই আসে পাশে অনিষ্ট করতো। রাতের বেলা ওই ঘরে কতো শব্দ শুনতে পাই।
এখনো ? প্রশ্ন করে অশোক।
হ্যা। বাড়ির চারিদিকেই তাঁদের উপস্থিতি টের পাই। গোটা বাড়ি ঠান্ডা হাওয়াতে সির সির করে। অন্ধকারগুলো ধোঁয়াটে লাগে। ছাড়ুন,ভয় পাচ্ছেন না তো?
অশোক ঘাড় নারে।তবে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালে।
এবার বুঝলেন তো কেন আপনাকে সাবধান করছিলাম। অন্ধকার হয়ে গেছে ঘরে চলুন।
বৃদ্ধকে অনুসরণ করে অশোক ঘরে প্রবেশ করে। বেশ ঠান্ডা লাগছে। সারাদিন বৃষ্টিতে প্রকৃতি যেন চারিদিকে ঘুম জড়ানো মায়া সৃষ্টি করেছে।আসে পাশে একটা আওয়াজ নেই। নদীর ওপারে কয়েকটা টিমটিমে আলো মানুষের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।
পুরানো আমলের বাড়ি। ভিতরটা বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে তৈরী ।টিম টিম করে কয়েকটা আলো জ্বলছে। সেই আলোতে অন্ধকার যতটা না দূর হচ্ছে তার চেয়ে বেশি আলো আঁধারি পরিবেশ তৈরী হচ্ছে।নিজের ছায়াতেই চমকে ওঠে অশোক।
আসলে কারেন্টের বিল বাঁচাতে আলো বেশি জ্বালাই না।অসুবিধা হচ্ছে না তো ?
না না, কোনো সমস্যা নেই। আপনাকে কিছু আর্থিক সাহায্য করে যেতে চাই। অনুরোধ করে অশোক।
না না। আপনার সাহায্য হলেই খুশি হবো।আসুন এই ঘরে। দালানের একবারে শেষ ঘর টা খোলে বৃদ্ধ। ওই যে সেই পালঙ্ক।
উঁকি মেরে অশোক দেখার চেষ্টা করে।অল্প আলোতে পালঙ্কটাকে যেন চারপেয়ে কোনো দানব মনে হয় তার।এক দৃষ্টিতে ওটার দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
এই ঘরে আসুন। বৃদ্ধর ডাকে হুঁশ ফেরে অশোকের। পাশের ঘরে গিয়ে একটা পুরানো কাঠের চেয়ারে বসে সে।
কিছু খেয়ে নিন। দূর্বল শরীর নিয়ে এসব কাজ হয় না। একটা থালায় দুটো রুটি আর একটু তরকারি বাড়িয়ে দেয় বৃদ্ধ।
এসবের কি দরকার ছিলো ? আমাকে দিলে আপনি কি খাবেন রাতে ?
সে চিন্তা নেই মেয়ে বেশি করেই রেঁধে রেখে যায়।খেয়ে নিন দেরী না করাই ভালো।
হুম। যা হোক করে দুটো রুটি খেয়ে নেয় অশোক।
খাবার ঠিক ছিলো তো ?জল খেলেন না ?
সাথে জল ছিলো। তবে খাবার বেশ ভালো। মনে হোলো নিজের ঘরেই খাচ্ছি।
তা ভালো।
এবার একটু জিরিয়ে নিন। নটা নাগাদ ওই ঘরে যাবো। আমি কয়েকটা জিনিস গুছিয়ে আসছি। ঘরেই থাকবেন। কোনো আওয়াজ এলে ভয় পাবেন না।বৃদ্ধ বেরিয়ে যায়।
শীত শীত করতে থাকে অশোকের। চোখ জুড়ে আসে ঘুমে। বিট্টুর কথা ভাবতে থাকে সে। হঠাৎ দরজার বাইরে তাকাতেই কে যেন সরে যায়। তার দিকে কি কেউ এতক্ষন তাকিয়ে ছিলো ? দরজার দিকে এগিয়ে যায় সে। দালানের কোনে আবছা ধোঁয়ার মতো কি একটা কুন্ডলী পাকিয়ে রয়েছে।গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে অশোকের। ঘরে ঢুকে আসে সে।বাইরে ঠক ঠক করে দেয়ালে মাথা ঠোকার মতন আওয়াজ আসতে থাকে। ঠান্ডা আবহাওয়া তেও ঘেমে ওঠে অশোক। বৃদ্ধের আগমনে স্বস্তি পায় সে।
আসুন। ভয় লাগে নি তো?
না না। চলুন।পালঙ্কের ঘরে প্রবেশ করে ওরা।
দেখুন ওটাতে শুয়ে নিজের মৃত ছেলের কথা ভাবতে থাকবেন। ওর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ঘুম এসে যাবে ঠিক। তার পর যা দেখবেন সব ঘুম ভাঙার পর মনে রাখার চেষ্টা করবেন। পুরোটাই স্বপ্নের মতো লাগবে, তবে ভয় পেয়ে ছটফট করলে আগেই ঘুম ভেঙে যাবে। আমি সেই ভোরে আসবো। আগে ঘুম ভেঙে গেলে উঠে পাশের ঘরে চলে আসবেন, আমি থাকবো। ঠিক আছে, আমি চলি।
বৃদ্ধ চলে গেলে অশোক আলো নিভিয়ে পালঙ্কে উঠে শুয়ে পরে। অন্ধকার ঘরে নিজের বুকের ধুকপুকুনি নিজেই শুনতে পায় সে। জালনার বাইরে তখন ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের সমবেত সংগীত পরিবেশন চলছে। ব্যাং ডাকছে ঠিক তার ই সাথে তাল মিলিয়ে। কিচ্ছুক্ষণের মধ্যই ঘুমে আছন্ন হয়ে পরে অশোক।
এখন সে একটা অন্ধকার বাড়ির ভিতর দাড়িয়ে আছে। চারিদিকে একটা অদ্ভুত ঝাঁঝালো গন্ধ পাচ্ছে সে। একটু এগোতেই বাড়িটা তার চেনা ঠেকলো। আরে! এটা তো তার নিজের বাড়ি। সে এখানে কি করছে ? রান্না ঘরে দাড়িয়ে আছে সে। ঝাঁঝালো গন্ধটাও চিনতে পেরেছে সে। রান্নার গ্যাস এর গন্ধ। বড়ো তীব্র। রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে গেল সে। কেউ নেই সেখানে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো । পাশের বাড়ির ছাদে কেউ একটা পা ঝুলিয়ে বসে আছে মনে হোলো। আরে ওটা তো কালিপদদা। গত বছরেই গলায় দড়ি দিয়েছিলো পারিবারিক অশান্তি তে। অশোককে দেখতে পেয়েছে সে। বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে আছে তার দিকেই। পছন্দ করেনি তার অনধিকার প্রবেশ। চোখ সরিয়ে নেয় অশোক। ছেলের ঘরের দিকে যায় সে।ঘরের কোনে দাড়িয়ে আছে বিট্টু। ছেলেটার চোখ মুখ বিদ্ধস্ত।এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না অশোক।ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরতে মন চায়। বিট্টু হঠাৎ হাত টা তুলে অশোকের দিকে কিছু একটা দেখাতে চাইছে।কিছুই বুঝছে না অশোক।ওর ইঙ্গিত অশোকের দিকেই। অশোকের বুকের দিকে কিছু একটা দেখাতে চাইছিলো সে।হঠাৎ ছেলের পিছনে আর একটা ছেলের  মুখ আবছা মতো দেখতে পায় সে।এক অদ্ভুত অস্বস্তি অনুভূত হয় তার। পায়ে ঠান্ডা কিছু একটার স্পর্শে ঘুম ভেঙে যায় অশোকের। ঘেমে চান করে গেছে সে। ঘড়ি তে তখন রাত তিন টে। ভোর হতে বাকি। আর একটু যদি ছেলেটাকে দেখতে পেতাম। কিন্তু পায়ে কি ঠেকলো ?পায়ের দিকে তাকায় সে আর তৎক্ষণাৎ একটা কালো হাত যেন পালঙ্কের তলায় ঢুকে যায়।কেউ কি ছিলো ওখানে ?তাহলে কি বৃদ্ধের কথা অনুযায়ী কোনো অশুভ আত্মা রয়েছে এই ঘরে। সাহস সঞ্চয় করে ঝুঁকে পরে পালঙ্কের তলায় তাকায় সে। অন্ধকার কাটাতে মোবাইলের আলো জ্বালে।চমকে ওঠে অশোক। একটা কালো ছায়া ঠিক যেন মানুষের আকৃতির,তার মুখের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। চোখ দুটো যেন প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলছে।ছেলের আত্মার পিছনে যে ছেলেটাকে দেখেছিলো সে একবারে তার মতোই।  গুটি সুটি মেরে রয়েছে খাটের তলায়।যেন শিকার ধরার অপেক্ষা।পালঙ্ক থেকে নামার সাহস সঞ্চয় করতে সময় নেয় সে। একপ্রকার দৌড়েই পাশের ঘরে ঢুকে পরে অশোক । বৃদ্ধ চমকে ওঠে।
কি হোলো আপনার ?
পালঙ্কের নিচে কে একটা...
ওহ! আপনাকে আগেই সাবধান করেছিলাম। আসলে ওই আত্মা টা বোধহয় এই জগতে এসে পরেছে। কদিন হোলো ওই ঘর থেকে টুক টাক আওয়াজ আসতেই থাকে। আপনার কার্য সিদ্ধি হয়েছে তো ?
হা, তা হয়েছে।
যাক নিশ্চিন্ত।
ভোর হতেই অশোক বিদায় নেয়। বাড়ি ফিরে স্ত্রী মায়া কে সব বলে।বিট্টু কি বোঝাতে চাইছিলো কিছুই বুঝতে পারে না দুজনেই। সন্ধ্যে বেলা চা খেতে খেতে হঠাৎ অশোক ভাবে বিট্টু কি তার বুকের দিকে ইঙ্গিত করছিলো না জামার পকেটের দিকে । কিছু একটা মাথায় আসে তার।
মায়া কে ডেকে কালকের জামা টা আনতে বলে। এটা তার পুরানো ওষুধ কোম্পানির জামা। পকেটের ওপর কোম্পানির লোগো আর ছোটো করে কোম্পানির নাম লেখা রয়েছে।
তাহলে কি তোমার পুরানো কোম্পানির সাথে বিট্টুর মৃত্যু জড়িয়ে রয়েছে? প্রশ্ন করে মায়া।
সেটাই তো বুঝতে পারছিনা। বিট্টুর মৃত্যুটা তো দুর্ঘটনা ছিলো। দাড়াও দাড়াও। অশোক মাথা নাড়তে নাড়তে বলে.. কিছু গোলমাল আছে। আমি কাল ওই পালঙ্কে শুয়ে বিট্টুর কাছে যেতে গিয়ে রান্না ঘরে গ্যাস এর গন্ধ পেয়েছিলাম।তাহলে কি ও গ্যাস জ্বালার সময় সিলিন্ডার এর মুখ খোলা ছিলো?বিট্টু কিছু বোঝাতে চাইছে। চট করে ল্যাপটপের সামনে বসে পরে অশোক।
কি হোলো ? ওটা নিয়ে বসলে কেন এখন ?
দেখছি খারাপ ওষুধের জন্য মৃত ছেলেটার ডিটেলস কোথাও পাই কি না।
তোমার ওই সাংবাদিক বন্ধু তপন কে ফোন করো না...
ঠিক বলেছো।
তপন কে ফোন করে অশোক।ছেলেটা সম্পর্কে জানতে চায়।
কিচ্ছুক্ষন পরেই  তপনের ফোন আসে।সে জানায়.. ছেলেটা ছাত্রাবাসে থাকতো। হঠাৎ প্রচন্ড জ্বর আর বমি শুরু হয়। তার পর ওই ওষুধ খেয়ে জ্বর আরও বেরে যায় আর পর দিন রাতেই মারা যায়। ছেলেটার মা সম্পর্কে কিছু তথ্য সে পেয়েছে। ছবিটা অশোককে পাঠাচ্ছে।
কিচ্ছুক্ষন পরে হোয়াটস্যাপে যে ছবিটা আসে তা দেখে হা হয়ে যায় অশোক। এতো কমলা দি। তাহলে কমলা দি কি ছেলের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে তার বাড়িতে পরিচারিকার কাজ নিয়েছিল। ইচ্ছা করে গ্যাস খুলে রেখে দোকানে গেসলো সে।মাথা কাজ করে না অশোকের।নিজের অপরাধের এতো বড়ো দাম দিতে হবে ভাবতে পারে নি অশোক।
পরদিন সকালেই থানায় গিয়ে কমলার নামে অভিযোগ জানায় অশোক। নিজের অপরাধ আর পালঙ্কের ব্যাপারটা সন্তর্পনে এড়িয়ে যায়। তার পর সোজা ফুলডিঙ্গার উদ্দেশ্যে রওনা হয় সে।আজ ও সে শোবে ওই পালঙ্ক তে। ছেলেটা আরও কিছু বলতে চায় কি না জানতে হবে তাকে। বৃদ্ধ ঠিক ই বলেছিলো, ওতে একবার শুলেই বার বার শুতে ইচ্ছা হয়।আসলে মানুষ বিদায় নেয়ার সময় অনেক না বলা কথা থেকে যায়। সে গুলো জানতে বার বার মন চায় শুধু সুযোগ আর আসে না। ওই পালঙ্কের কল্যানে তার সেই সুযোগ এসেছে। বিট্টুর খুনি ধরা পরলে ওর আত্মা শান্তি পাবে।এসব ভাবতে ভাবতেই সন্ধ্যে বেলা মজুমদার বাড়িতে পৌঁছে যায় অশোক।বৃদ্ধ অশোককে দেখে আশ্চর্য হয় না।
জানতাম আপনি আসবেন। যে একবার ওটায় শুতে যায় সে আবার আসে।
শোবার জন্য ছটফট করছে অশোক। বৃদ্ধ বুঝতে পারে।
তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। আগে একটু বসুন। এই নিন জল খান। জলের গ্লাস এগিয়ে দেয় বৃদ্ধ। তাড়াহুড়ো তে আজ আর জল নিয়ে আসে নি অশোক। এক নিঃশ্বাসে জল খেতে খেতে সব কথা বলে সে বৃদ্ধ কে।বৃদ্ধর অভিব্যক্তি দেখে মনে হয় এ সব হবে সে যেন আগে থেকেই জানতো।
বসুন আমি কাজ সেরে আসছি। বৃদ্ধ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কাল থেকেই আর একটা খটকা লাগছিলো অশোকের। সেই দিনের রাতের বৃদ্ধের দেয়া রুটি তরকারির স্বাদ তার খুব চেনা চেনা লাগছিলো।কোথায় যেন খেয়েছিলো !দেয়ালের কোনের তাকে একটা ছবির দিকে নজর গেলো অশোকের। সেই দিন রাতে উত্তেজনায় খেয়াল করে নি সে। মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট অন করে সেটার দিকে তাকিয়ে হা হয়ে যায় অশোক।ছবিটি সম্ভবত মা আর ছেলের। মহিলাটি কমলা আর ছেলেটা সেই যাকে সে বিট্টুর পিছনে আর পালঙ্কের নিচে দেখে ছিলো। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে অশোকের। চোখ বুজে আসছে। এমনটা কেন হচ্ছে ?
চিনতে পারছেন ওদের কে ? বৃদ্ধ এসে দাড়িয়েছে দরজায়। মেয়েটা আমার না মরে বেঁচে আছে শুধু আপনার জন্য। জামাই টা দুঃখ না সইতে পেরে আত্মহত্যা করে। মেয়েটাও করতো হয়তো এই বুড়োর মুখ চেয়েই করে নি।টাকার লোভে জাল ওষুধ গুলো বাজারে ছাড়লেন আর ভাবলেন না তার কি পরিণতি হতে পারে। নাতিটা মুখে রক্ত তুলে যেদিন মরলো সেদিনই আমার মেয়ে ঠিক করেছিলো এর প্রতিশোধ সে নেবে। পুত্র হারানোর কষ্ট কি তা বোঝাবে আপনাকে। তবে মেয়েটা আপনাকে মারতে চায় নি,চেয়েছিলো আপনি যাতে ছেলের আত্মার সাথে দেখা করতে পারেন  তাই এখানে পাঠিয়েছিল। আমিও ভেবেছিলাম আপনার অনুশোচনা আছে নিজের পাপ নিয়ে , কিন্তু দেখলাম আমি ভুল। তাই ভাবলাম আপনার মতো মানুষের ওপর দয়া করা চলে না।সে দিন রাতেও আজকের মতো জলে ঘুমের ওষুধ মিশিয়েছিলাম কিন্তু আপনি জল খান নি। কিন্তু আজ! হো হো করে হেঁসে ওঠে বৃদ্ধ। ফাঁকা বাড়িতে সেই আওয়াজ প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে।নাতিটা বড়ো ভালো ছিলো পড়াশোনায়।ভালোবাসতো আমায়। ওর আত্মা কষ্টে কষ্টে এবাড়িটায় ঘুরে বেরায়। বুকটা ফেটে যায় আমার। ঘুমে আর দাড়িয়ে থাকতে পারছে না অশোক।চলুন ওই ঘরে যাওয়া যাক।পালঙ্কের সঠিক ব্যবহার আজ হবে।
অশোক কে এক প্রকার ধরে ধরেই পাশের ঘরে নিয়ে যায় বৃদ্ধ। যত্ন করে পালঙ্কে শুইয়ে দেয়। ঘরের দরজা বন্ধ করে। অশোক শত চেষ্টাতেও পালঙ্ক থেকে উঠতে পারে না। একটা কালো ছায়া তার পালঙ্কের চারপাশে পায়েচারী করে চলেছে।চোখ গুলো তার প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলছে।ঘুমের মেঘ তার চেতনার আকাশ কালো করে তুলছে একটু একটু করে। শেষ ঘুম অশোকের। একটু একটু করে অন্য জগতে প্রবেশ করলো সে। অন্ধকার থেকে ফেরার রাস্তা নেই। শরীরটা পরে রইলো পালঙ্কে। ভোরের আলো ফোটার আগেই বৃদ্ধ  তার মেয়ের গোপন ঠিকানায় গা ঢাকা দিলো।সে বিলক্ষন জানতো অশোকের খোঁজে দু একদিনেই পুলিশ এ বাড়িতে আসবে।হলোও তাই। দু দিন পরেই অশোকের বডি পাওয়া গেল পালঙ্কে। বাড়ি পরে রইলো। পরে রইলো পালঙ্ক। তবে বেশি দিন নয় পাড়ার কয়েকটা বকাটে চোখরা নেশার টাকা জোগাড়ের জন্য বাড়ির আসবাব একে একে বেঁচতে শুরু করলো। শেষে খাট টা বিক্রির ব্যবস্থা হোলো। এক কাঠগোলা অল্প টাকায় ভালো খাট হাতছাড়া করলো না। পালিশ করে ভালো দামেই বেচলো শহরের এক দম্পতি কে। নতুন বিয়ে করে শহরে ভাড়া এসেছে তারা। বেজায় খুশি ভালো পালঙ্কটা পেয়ে। রাত গুলো দারুন কাটতে চলেছে তাদের।

|| সমাপ্ত ||

[Image: Shocked-Open-Asianpiedstarling-size-restricted.gif]

[+] 5 users Like Sanjay Sen's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: ভৌতিক গল্প সংকলন (চলছে) - by Sanjay Sen - 17-08-2023, 12:11 PM



Users browsing this thread: