15-08-2023, 09:50 AM
(This post was last modified: 15-08-2023, 09:52 AM by Sanjay Sen. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
|| সহদেবপুরের বিভীষিকা ||
লেখায় :- চন্দ্ররূপ ব্যানার্জী
ইদানিং সহদেবপুরে পাঁচ-পাঁচটা খুনের ঘটনা ঘটে গেছে। সব কটা খুনই খুব নৃশংস ভাবে করা হয়েছে। প্রত্যেকটা লাশই আধ খাওয়া, দেখে মনে হচ্ছে কোনো হিংস্র প্রাণীর কাজ। তাই গোটা এলাকায় একটা আতঙ্কের বাতাবরণ ছড়িয়ে আছে। প্রত্যেকটি খুনের ঘটনাই ঘটেছে রাত ১২টার পর। তাই পুলিশ সারা এলাকা বাসী দের রাত ন'টার পর বাড়ির বাইরে না বেরোনোর নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো যে গ্ৰাম থেকে প্রায় ৩০০ কি.মি -এর মধ্যে কোনো জঙ্গল নেই যে সেখান থেকে কোনো হিংস্র প্রাণী আসবে, এছাড়া পুলিশ গোটা এলাকা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোনো হিংস্র পশুর সন্ধান পায়নি।
সুমন্ত অফিসের কাজে কিছু দিনের জন্য গ্ৰামের বাইরে গেছিল। তাই সে গ্ৰামে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলোর বিষয়ে জানতো না। সুমন্ত গভীর রাতে গ্ৰামের আলপথ দিয়ে একা একাই হেঁটে বাড়ি ফিরছিল । এমনিতেই ট্রেন লেট করার জন্য মেজাজ খিঁচড়ে ছিল। গভীর রাত হওয়ায় রাস্তা শুনশান ছিল।কেউ কোথাও নেই। পথের দুপাশে থাকা চাষের জমি থেকে একটানা ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে। আকাশে গোল থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ ওঠায় রাস্তা-ঘাট পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তাল গাছ গুলো আঁধো-অন্ধকারে এক একটা দৈত্য মনে হচ্ছে। রাত বেশি হওয়ায় সুমন্ত তাড়াতাড়ি পা চালাচ্ছিল । এমন সময় পিছনে একটা খস্ খস্ শব্দে সুমন্ত দাঁড়িয়ে পড়লো।পিছন ফিরে তাকাতে কোনো কিছুই চোখে পড়লো না। মনের ভুল ভেবে আবার হাঁটতে লাগলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আবার খস্ খস্ শব্দের সাথে চাপা গর্জন শুনতে পেল সুমন্ত। ভয়ে ভয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল সুমন্তর ।
চাঁদের আলোয় আশপাশের এলাকা মোটামুটি স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিল। তাই হাত পাঁচেক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাণী টাকে বেশ স্পষ্টই দেখতে পেল সুমন্ত। এরকম বীভৎস পশু বা প্রাণী সে আগে কোনদিন দেখেনি। প্রায় ছয় ফুটের মতো লম্বা সামনের দিকে একটু ঝুঁকে আছে বলে, কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়ালে ছ-ফুট ছাড়িয়ে যাবে। সারা দেহ কালো লোম দ্বারা আবৃত, মুখের আদল টা অনেক টাই নেকড়ের মতো। চোয়ালের ফাঁক দিয়ে ধব্ ধবে সাদা দুটো শ্বদন্ত বেড়িয়ে রয়েছে। চোখ দুটো আগুনের ভাঁটার মতো জ্বলছে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তিমান বিভীষিকা কে দেখে সুমন্ত কয়েক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেল। তারপরই আশপাশ থেকে একটা অজানা আতঙ্ক তাকে চেপে ধরল। কিছুক্ষণের জন্য মা-বাবার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। বড়ো ইচ্ছে করল বাড়ি ফিরে আবার মায়ের কোলে মাথা রেখে শুতে, বাবার সাথে একসাথে খেতে বসে হাসাহাসি করতে। জন্তুটা আস্তে আস্তে সুমন্ত র দিকে এগিয়ে আসছে , সুমন্ত প্রাণ বাঁচাবার একটা শেষ চেষ্টা করল। সামনে পড়ে থাকা একটা লাঠির টুকরো সজোরে ছুঁড়ে মারলো জন্তুটার দিকে। লাঠির টুকরোটা জন্তুটা কে লক্ষ্য করে ছুঁড়লেও সেটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। না: আর সময় নেই জন্তুটা প্রায় চলেই এসেছে, সুমন্ত আর কিছু করার আগেই সে সুমন্তর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। একটা আর্তনাদ শুধু বেড়িয়ে এলো সুমন্তর গলা দিয়ে, যা রাত্রির অন্ধকারের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দিলো। জন্তুটা আরেক টা নতুন শিকার পাওয়ার উল্লাসে উন্মত্ত হয়ে তার তীব্র ধারালো নখের দ্বারা দেহটাকে ছিন্নভিন্ন করতে লাগলো। জনশূন্য রাত্রে এই বীভৎসতার সাক্ষী রইলো কেবলমাত্র প্রকৃতি।
গত রাত্রের আরও একটা খুন পুলিশের দুঃশ্চিন্তা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই একই রকম পদ্ধতিতে খুন করা হয়েছে। এই নিয়ে দু'সপ্তাহে ছটা একই ঘটনা ঘটে গেলো, আর পুলিশ এখনও পর্যন্ত কিছুই করতে পারলো না। এ নিয়ে গ্ৰামবাসীরা থানার সামনে বিক্ষোভ শুরু করে দিয়েছে, তাদের নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে।থানার ভেতরে ও.সি সুভাষ বাবু মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। তিনিও তার প্রায় ২৪ বছরের দীর্ঘ কেরিয়ারে এতটা হতাশ হন নি। এতগুলো খুন হয়ে গেল, কিন্তু তিনি কিছুই করতে পারলেন না। একটা প্যারালাইসিস রুগীর মত তাকে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে। এমন সময় একটা লোক দৌড়ে এসে ও.সি র সামনে এসে দাঁড়ালো। পিছন পিছন কনস্টেবলও এলো। ও.সি কনস্টেবল এর দিকে তাকিয়ে বেশ রাগত স্বরে বললেন,‘ আমি কাউকে আমার কাছে আসতে দিতে মানা করেছিলাম, তবুও এই লোকটি কি করে এলো?’ কনস্টেবল আমতা আমতা করে বলল আজ্ঞে স্যার আমরা অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু আমাদের হাত ছাড়িয়ে আপনার কাছে ছুটে চলে এলো, বলল খুব জরুরি দরকার আছে। সুভাষ বাবু আড়চোখে একবার ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে ইশারায় বসতে বললেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন,‘ তা আপনার কী এমন জরুরি দরকার?’ ভদ্রলোক হাতজোড় করে নমস্কার করলেন তারপর বললেন, ‘আজ্ঞে আমার নাম অব্যয় বিশ্বাস। থাকি কলকাতায়। পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার। গ্ৰামে ইদানিং ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো সম্পর্কে পেপারে পড়ে আপনার কাছে ছুটে এলাম , যদি কোনো সাহায্য করতে পারি।’ সুভাষ বাবু তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন, ‘তা কী রকম সাহায্য করবেন আপনি?’ অব্যয় বিশ্বাস অল্প হেসে বলল ,‘বড়বাবু কাউকে কোনো দিন ছোটো মনে করবেন না। আমি-ই একমাত্র এই রহস্যের সমাধান জানি’। সুভাষ বাবু এবার রেগে উঠে বললেন,‘ কি তখন থেকে আজেবাজে কথা বলে যাচ্ছেন , আসল কথা বললে বলুন নইলে প্লিজ এবার আসুন।আপনার ফালতু কথা শোনার মতো সময় আমার নেই’।
‘আহা: রেগে যাচ্ছেন কেন আমি সত্যিই বলছি রহস্যভেদ করার ক্ষমতা একমাত্র আমারই আছে।’
বড়বাবু বললেন,‘ কেমন?’
অব্যয় বিশ্বাস বলল তবে শুনুন. ‘আচ্ছা আপনারা কি প্রত্যেকটা ডেডবডির আশপাশ টা ভালো করে লক্ষ্য করেছেন?’
—‘হ্যাঁ অবশ্যই, কেন বলুন তো’
—‘পায়ের ছাপ বা লোম পেয়েছেন?’
–‘আপনি যে দুটি জিনিসের কথা জিজ্ঞেস করলেন সেই দুটি জিনিসেরই সন্ধান আমরা পেয়েছি। এমনকি লোমের ডি.এন.এ টেস্ট করে দেখা গেছে যে সেটা পুরোপুরি নেকড়ের গায়ের লোমের সাথে মিলে যাচ্ছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় পায়ের ছাপ কিন্তু অনেক টা মানুষের আদলের আর এখান থেকে প্রায় ৩০০ কি.মির মধ্যে এমন কোনো জায়গা নেই যে সেখান থেকে কোনো নেকড়ে আসতে পারে।’ অব্যয় বিশ্বাস তার রহস্যময় হাসি হেসে বলল,‘ এটা কোনো নেকড়ের কম্মো নয় যে আপনারা তাকে খুঁজে পাবেন।তবে হ্যাঁ আবার নেকড়ের ই কাজ বলতে পারেন।’
‘মানে? আপনি কী বলছেন এসব আমি বুঝতে পারছি না। নেকড়ের কাজ নয় আবার নেকড়ের ই কাজ।কী বলতে চান পরিস্কার করে বলুন না।’
–‘আচ্ছা আপনি কি ছোটো বেলায় ওয়্যারউলফ্ এর গল্প পড়েছেন বা সিনেমা দেখেছেন?’
–‘হ্যাঁ অবশ্যই, কিন্তু কেন?’
–‘এটা ওরই কাজ।’
–‘আপনি কী আমার সাথে মজা করছেন?’
–‘মজা?’ হা:হা: করে হেসে উঠলো অব্যয় বিশ্বাস। তারপর ই মাথাটা বড়বাবুর মুখের সামনে নামিয়ে এনে বলল,‘ আপনার কি মনে হয় আমি সুদূর কলকাতা থেকে এখানে মজা করতে এসেছি।’
‘কিন্তু এখন কার যুগে এও কি সম্ভব?’
‘ সম্ভব সম্ভব সবই সম্ভব । ও আসলে অভিশপ্ত এক জানোয়ার, বহু বছর পর ওর ঘুম ভেঙেছে। আস্তে আস্তে ও ওর খিদে মেটাবে।’
‘কী বলছেন ! আচ্ছা কোনো কি পথ নেই এই ধ্বংসলীলা বন্ধ করার?’
‘আছে আছে, আর সেই পথ একমাত্র আমিই জানি। ’
‘কী রকম?’
–তবে শুনুন..
‘আপনাকে তো আমি আগেই বলেছি যে আমি পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু আমার পূর্বপুরুষরা ছিলেন জমিদার। তাদের অনেকেই শখের শিকারি ছিলেন। বিশেষ করে আমার ঠাকুরদা তার অব্যর্থ লক্ষ্যভেদের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। জমিদার হওয়া সত্ত্বেও বহুবার তিনি তার প্রজাদের রক্ষার উদ্দেশ্যে নিজের জীবন বাজি রেখে হিংস্র প্রাণীদের মোকাবিলা করেছেন।
একবার গ্ৰামে এক অদ্ভুত কান্ড ঘটতে থাকে। কোনো এক হিংস্র প্রাণীর উপদ্রবে বহু নিরীহ মানুষের মৃত্যু ঘটতে থাকে। প্রজাদের অনুরোধে ঠাকুরদা প্রাণী টিকে হত্যার তোরজোড় শুরু করেন। অবশেষে একদিন জঙ্গলে গাছের উপর মাঁচা বেঁধে শুরু করলেন প্রতীক্ষা। নীচে টোপ হিসেবে দিলেন একটি জ্যান্ত ছাগল। গভীর রাতে সে এলো। ঠাকুরদার মতে তিনি এমন ভয়াবহ প্রাণী জীবনে কখনও দেখেননি। ঠাকুরদা প্রাণী টির মাথা লক্ষ্য করে গুলি চালালেন। গুলিটা গিয়ে মাথায় লাগলোও, কিন্তু প্রাণীটির কিছুই হলো না। সে চকিতে গাছের উপর মাঁচায় বসে থাকা ঠাকুরদার দিকে লাফ দিলো কিন্তু ভাগ্য ভালো থাকায় বাঁ হাতে একটা আঁচড় দেওয়া ছাড়া আর কিছু করতে পারেনি। ঠাকুরদা কোনো রকমে পালিয়ে বাঁচেন। পরদিন সকালে তিনি তার গুরুদেবের আশ্রমে গিয়ে সব কথা খুলে বলেন এবং এর প্রতিকার চান । তাঁর গুরুদেব ছিলেন অত্যন্ত ক্ষমতাশালী একজন সাধু। গুরুদেব তাকে বলেন ও এক অভিশপ্ত দানব, যদি ওকে আটকানো না যায় তবে ও গ্ৰাম কে গ্ৰাম উজাড় করে দেবে। তিনি ঠাকুরদার হাতে একটি পবিত্র ছুরি তুলে দেন এবং বলেন ছুরিটি একমাত্র দানবটির বুকে হৃদপিন্ড বরাবর গেঁথে দিতে পারলেই সে আবার বহুবছরের জন্য ঘুমিয়ে পড়বে। আর হ্যাঁ ছুরিটা মাত্র পাঁচ বারই ব্যবহার করা যাবে। তারপর তার ক্ষমতা শেষ হয়ে যাবে । আমার কাছে ঐ ছুরিটা এখনও রয়েছে।’
‘ কিন্তু সবচেয়ে সমস্যার কথা যে ঐ হিংস্র প্রাণী কে কীভাবে একটা ছুরি দিয়ে মারা সম্ভব। কে এই রিক্স টা নেবে।’ চিন্তিত গলায় বলে উঠলেন বড়বাবু।
‘আমি মারব ঐ দানবকে। আমার কোনো পিছুটান নেই বড়বাবু, যদি আমি মারাও যাই চোখের জল ফেলার মতো তিন কুলে আমার কেউ নেই।’
‘না না একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে আমি আপনাকে এই কাজ করতে দিতে পারি না।’
‘কিন্তু বড়বাবু, আপনার সংসার যে আছে । তাই বলছি প্লিজ আমাকেই যেতে দিন।’
‘না অব্যয়বাবু প্লিজ বাচ্চা ছেলের মতন আবদার করবেন না।’
‘ঠিক আছে আমি আর কোনো কথা বলবো না।’
তারপর অব্যয় বিশ্বাস কাঁধের ঝোলা থেকে একটা বড়ো ছুরি বের করে বড়বাবুর টেবিলে রাখল। বলল,‘ ভালো করে শুনুন বড়বাবু, এই ছুরিটা দিয়ে কিন্তু দু'বারই আঘাত করতে পারবেন।কারণ ঠাকুরদা তৃতীয়বারের আঘাতের পর সফল হয়েছিলেন। এই ছুরিটা সোজাসুজি ওর হৃৎপিণ্ডে ঢোকাতে হবে অন্যথায় ও কিন্তু মরবে না। আর হ্যাঁ বারবার কিন্তু বলছি মাত্র দু'বার-ই এই ছুরি ব্যবহারযোগ্য। আচ্ছা নমস্কার, আমি আসি তাহলে বড়বাবু। এই বলে গট্ গট্ করে অব্যয় বেড়িয়ে গেল। ’
বড়বাবু হাঁক পেড়ে কনস্টেবল কে ডেকে নির্দেশ দিলেন তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে যেতে। আজ রাতেই তারা অভিযানে বেরোবেন।
ঘড়ির কাঁটা ১২টার ঘর অনেকক্ষণ পেরিয়েছে। চারিদিক শুনশান। গ্ৰামে এমনিতেই মানুষ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। তারমধ্যে আবার ইদানিং মানুষখেকোর আবির্ভাবে মানুষ রাত্রিবেলা আর ঘর থেকেই বেরোচ্ছে না। যার ফলে রাস্তা ঘাট জনশূন্য হয়ে পড়েছে এর মধ্যেই। সুভাষ তার বাহিনীকে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে। এমন সময় পিছন থেকে একটা আর্তনাদ শুনতে পেয়ে সবাই ঘুরে দাঁড়ালো। না: কিছু ই তো নেই, তবে কে এরকম আর্তনাদ করল। এমন সময় কনস্টেবল রহিমের কথায় সবার সম্বিত ফিরল , স্যার, রামচরণকে তো কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তাই তো সে কোথায় গেল ? মাথায় চিন্তার ভাঁজ পড়লো সুভাষের। এমন সময় আরেক কনস্টেবলের কথায় তারা ধানক্ষেতের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল একটা কালো লোমশ কোনো জন্তু ধানক্ষেতের অন্ধকারে মিশে গেল। সুভাষ চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ ক্যুইক সবাই রেডি হয়ে নাও।’ কিন্তু তার আগেই চকিতে আরেক জন কনস্টেবলের ঘাড় ভেঙে দিলো প্রাণীটা। সবাই চারিদিকে গুলি ছুড়তে লাগল। গোটা বাতাস বারুদের গন্ধে ভরে উঠেছে। সুভাষ হাত দেখিয়ে গুলি ছুড়তে নিষেধ করলেন। ধানক্ষেতের একদিক থেকে খস্ খস্ আওয়াজ পেয়ে সাব ইন্সপেক্টর সুমন সেদিকে গিয়ে দেখতে যেতেই দুটো লোমশ ধারালো নখর যুক্ত হাত তাকে সেদিকে টেনে নিল। মরণের আগের মুহূর্তের চিৎকার করে উঠল সে। সুভাষ নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে ঠক্ ঠক্ করে ভয়ে কাঁপছেন, তার পরনের উর্দি ঘামে ভিজে সপ্ সপ্ করছে। এবার দানবটা আস্তে আস্তে রাস্তায় উঠে এলো। অনেক দিন পর এতগুলো মানুষ একসাথে পাবার উল্লাসে একটা হাড়হিম করা হুঙ্কার দিয়ে উঠলো। এরপর একে একে নিজের ধারালো দাঁত আর নখের দ্বারা সবাই কে ছিন্নভিন্ন করতে করতে সে এগিয়ে আসতে লাগলো বড়বাবুর দিকে।প্রাণীটাকে লক্ষ্য করে অবিরাম গুলি ছোড়া হচ্ছে কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। আস্তে আস্তে সে সুভাষের সামনে এসে দাঁড়াল। সত্যিই এমন বীভৎস প্রাণী তিনি আগে কোনোদিন দেখেননি। মুখের আদলটা অনেকটাই নেকড়ের মতো, সারা শরীর কালো কর্কশ লোমাবৃত। চোয়ালের দু-পাশ বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। চোখদুটো যেন আগুনের ভাঁটা। সামনে নিজের মৃত্যুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। হঠাৎ ছুরিটার কথা মনে পড়তেই সেটা কোমড় থেকে বের করে সোজা দানব টার পেটে ঢুকিয়ে দিলেন সুভাষ বাবু। কিন্তু নাঃ একটা ভুল হয়ে গেছে। ভুলবশত ছুরিটা বুকে না ঢুকিয়ে তিনি পেটে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। প্রবল আক্রোশে দানব টা সুভাষকে এক ধাক্কায় ছিটকে দূরে ফেলে দিল। ছুরিটাও কিছুটা দূরে ছিটকে পড়লো। তারপর দানবটা এক লাফে সুভাষের কাছে গিয়ে তাকে হত্যা করতে উদ্যত হতেই, পিছন থেকে কে যেন বলে উঠলো, ‘ ওরে শয়তান, নরকের কীট, তোর খেলা এইবার শেষ ’... প্রাণীটা পিছন ফিরতেই অব্যয় বিশ্বাস নিখুঁত ভাবে ছুরিটা দানবটার বুকের বাঁদিকে হৃৎপিণ্ড বরাবর গেঁথে দিলো। কিন্তু মৃত্যুর আগেও একটা চরম ক্ষতি করে দিয়ে গেল সে। ধারালো নখের আঘাতে অব্যয় বিশ্বাসের গলার নলিটা ছিঁড়ে দিল । অব্যয় প্রচন্ড যন্ত্রণায় দূরে ছিটকে পড়লো। এদিকে একটা হাড় হিম করা গর্জন করে দানবটা নিস্তেজ হয়ে গেল।সারা দেহটা আস্তে আস্তে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। সুভাষ বাবু অদূরে শেষ নিঃশ্বাস নিতে থাকা অব্যয়ের দিকে ছুটে গেলেন। সুভাষকে দেখে প্রচন্ড কষ্টের মধ্যেও অব্যয় বিশ্বাসের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। তারপর আস্তে আস্তে তার মাথাটা একদিকে হেলে পড়লো। সুভাষ বাবুর দু'চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা গরম জল নেমে এলো। একজন অচেনা, অজানা মানুষ শুধু তাকে নয় এই সমস্ত সহদেবপুরের মানুষকে রক্ষা করলেন। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে থানার পথ ধরলেন তিনি। জনহীন প্রান্তরে কতগুলো মৃতদেহ পড়ে রইল শুধু।
নাঃ এখন অনেক বছরের জন্য শান্তি। নিশ্চিন্তে বাঁচবে সহদেবপুরের মানুষ, যতদিন না দানবের ঘুম আবার ভাঙছে , ততদিন।
|| সমাপ্ত ||