11-08-2023, 09:37 AM
|| প্রান ||
লেখা :- আমি সৌম্য
প্রতি মুহুর্তে পৃথিবীতে ঘটে চলে এমন কিছু ঘটনা যার কোন ব্যাখ্যা যুক্তি বা বুদ্ধি দিয়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। হয়তো আছে তার কারন, কিন্তু সেটা মানুষের সীমিত জ্ঞানের দ্বারা নাগাল পাওয়া যাবে না। এরকম ব্যাখ্যাহীন রহস্যাবৃত ঘটনাকে বোঝানোর জন্য "অলৌকিক" কথাটার ব্যবহার করা হয়। খুঁজে দেখলে হয়তো পাওয়া যাবে প্রায় সবার জীবনেই কখনো না কখনো ঘটেছে এমন কিছু যা তাঁর নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য হয়ে থেকে গেছে।
নিপাট সাদামাটা গৃহবধূ সুমিত্রা তরফদারও কোনদিন ভাবেননি যে এরকম কিছু ঘটবে তাঁদের স্বামী স্ত্রী আর দুই সন্তানের নিস্তরঙ্গ সুখী জীবনে। তাপস তরফদারের জীবনে আমৃত্যু সঙ্গ দিতে এসেছিলেন ছাব্বিশ পুরোতে না পুরোতেই। বছর দশেক কাটিয়ে ছত্রিশে পৌঁছে সুমিত্রা দুই সন্তানের মা এবং একনিষ্ঠ গৃহবধূ হয়ে খুশিই ছিলেন। তাপস ভালো কাজ করেন সরকারি দপ্তরে। মাইনে যথেষ্ট ভালো, ভবিষ্যত তুলনামূলক ভাবে সুরক্ষিত। তাই একটু জেদ করেই দ্বিতীয় সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন সুমিত্রা। স্বামী যদিও একটি সন্তানকে নিয়েই বড় করার পক্ষপাতী ছিলেন।
প্রথমটি ছেলে, পরেরটি মেয়ে। বিয়ের দুবছরের মাথায় অনির্বান বা অনি হয়ে গেছিল। ছত্রিশে এলো সোমশুক্লা। আট বছরের ছোট বড় দু ভাইবোন।
অনি একটু বড় হয়েছে, নিজের প্রয়োজনীয় কাজ বুঝে নিয়ে করতে শিখেছে দেখেই সময়টা বেছেছিলেন তিনি। ছেলে এমনিতেই যথেষ্ট বোঝদার তার বয়সী অন্য বাচ্চাদের থেকে।
কিন্তু মানুষ যা চায় সেভাবে জীবন চলে না। জীবনের চলার একটা নির্দিষ্ট ধারা আছে যেখানে ছন্দপতনটাই নিয়ম। হয়তো সবার ক্ষেত্রে নয়, কিন্তু অনেকের জন্যই এই নিয়ম প্রযোজ্য। সুমিত্রা এবং তাপস সেই নির্দিষ্ট অনিশ্চয়তার দোলাচলের খবরটা রাখতেন না। ফলে প্রথম দুলুনিটা তাঁরা ধরতেই পারলেন না।
সোমশুক্লার তিন মাস বয়সে এসেছিল সেটা। ছেলেকে জন্মের পর থেকেই দুজনের মাঝখানে নিয়ে শুতেন স্বামী স্ত্রী। মেয়ে হতে তাকেও যথারীতি নিজের আরেকপাশে নিয়ে শোওয়া শুরু করলেন তাঁরা।
কচি বাচ্চা মাঝরাতে উঠে কাঁদতো খিদেতে বা কাঁথা ভিজিয়ে ঠান্ডা লাগতো বলে। স্বামী স্ত্রী দুজনেই ভাগাভাগি করে খেয়াল রাখতেন। কিন্তু সমস্যা হলো অনিও উঠে পড়তে লাগলো কাঁচা ঘুম ভেঙে। আর তার একটা স্বভাব আছে ছোট থেকেই যে একবার ঘুম ভেঙে গেলে সহজে আর ঘুম আসেনা তার। স্বাভাবিক ভাবেই পরেরদিন কলেজে গিয়ে ঢুলতো, পড়া ভুলে যেতো ঘুমের ঘোরে।
এরকম দিন কয়েক চলার পর তাপস পাশের একটা ছোট ঘর একদম নতুন করে সাজিয়ে একটা ছোট খাট পাতলেন। অনিকে সেখানে শুয়ে ঘুমানোর অভ্যেস করানো হলো অনেক কাঠখড় পুরিয়ে। সেও যথেষ্ট ছোট এবং এর আগে বাবা মাকে ছেড়ে একলা শোয়নি। ফলে প্রায় মাস কয়েক চেষ্টা করেও সম্পুর্ন সফলতা এলো না।
অনেক দিনই রাতে আচমকা ঘুম ভেঙে উঠে সুমিত্রা দেখেছেন তাঁর পায়ের কাছে জড়োসড়ো হয়ে ঘুমোচ্ছে অনি। কখন উঠে চলে এসেছে নিজের বিছানা ছেড়ে কেউ জানে না। কিন্তু তিনি নিয়ম পাল্টাতে দিলেন না। বাচ্চা থেকে অভ্যেস করাতে করাতেই ঠিক হয়ে যাবে।
অনি একটু চুপচাপ হয়ে গেল হঠাৎ করেই। কিছুদিন পরে এক বিকেলে পাড়ার মাঠ থেকে খেলার পর বাড়ি ফিরে ছেলে পা দেখিয়ে বলল -' দ্যাখো মা, কতটা কেটে গেছে। একটু ওষুধ লাগিয়ে দেবে গো?'
সুমিত্রা বললেন -' আগে ভালো করে পা ধুয়ে আয় বাথরুম থেকে। হাত মুখ ভালো করে ধুবি। বাইরের হাতে বোনকে ধরিস না যেন।'
অনি বাথরুমে যেতেই মেয়ে উঠে পড়ে তেড়ে কাঁদতে শুরু করলো। সুমিত্রা সন্ধ্যার জলখাবার বানাচ্ছিলেন, সব ওইভাবে ফেলে রেখে ছুটলেন মেয়ে সামলাতে। একটু পরেই অনি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল -' ও মা, ওষুধটা লাগিয়ে দাও।' সুমিত্রা কিছু বলার জন্য মুখ ঘোরাতেই নাকে পোড়া গন্ধ পেলেন। তিনি পড়িমড়ি করে ছুটলেন মেয়েকে কোলে নিয়েই। দুধ ফোটাতে দিয়ে গ্যাস নেভাতে ভুলে গেছেন মেয়ের কান্নায়। সেটা সামলানোর আগেই দরজায় বেল বাজলো।
কোনমতে গ্যাসটা নিভিয়ে দরজা খুলে দেখলেন তাপস এসে গেছেন অফিস থেকে।
বরাবরই স্বামী ফিরলে হাতে ব্যাগটা নিয়ে নেওয়া, ফ্যানটা চালিয়ে দেওয়া প্রভৃতি করেন তিনি। সেসব মিটলে তাপস ছেলেকে প্রাইভেট কোচিং সেন্টারে দিয়ে আসলেন। পরেরদিন মেয়েকে নিয়ে ডাক্তারখানায় যাবার একটা পরিকল্পনা করা ছিল সেটা নিয়ে কিছু আলোচনা হলো নিজেদের মধ্যে।
রাতে খাওয়ার পর অনি সামান্য খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নিজের ঘরে ঢুকছে দেখে তাঁর মনে পড়লো ছেলে বার দুয়েক বলা সত্ত্বেও পায়ের ক্ষতে ওষুধটা লাগিয়ে দিতে মনে নেই।
নিজের ওপরেই একটু লজ্জিত হয়ে তিনি খাওয়ার পর হাতে ওষুধটা নিয়ে ছেলের ঘরে গেলেন। অনি ঘুমিয়ে পড়েছিল। সাবধানে তার পায়ের কাটা জায়গায় মলম লাগিয়ে দিতে সামান্য নড়ে উঠল ব্যাথায় কিন্তু ঘুমটা পুরো ভাঙলো না। ছেলের কপালে একটা চুমু খেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। ঘুমটা ভেঙে গেলে মুশকিল হবে।
তবে চুমুটা খেলেই ভালো করতেন সুমিত্রা। কারন তাহলে তাঁর চোখে পড়তো ছেলের চোখের কোন বেয়ে নেমে গেছে আধশুকনো জলের ধারা। অনি একদম শামুকের মতো গুটিয়ে নিল নিজেকে এরপর থেকে। এতোটাই চুপচাপ হয়ে গেল যে সুমিত্রা মাঝেমধ্যে ভুলেই যেতেন যে বাড়িতে ছেলেটা আছে। মনে হতো কলেজে গেছে বা খেলতে গেছে।
মাসখানেক পর প্রতিবেশী আরেকটি বাচ্চার মায়ের কাছে সুমিত্রা খবর পেলেন অনি ইদানিং মাঠে গিয়ে বসে থাকে বেঞ্চিতে একা। বাকি বাচ্চাদের খেলা দেখে, হাততালি দেয় কিন্তু নিজে খেলতে নামে না। ব্যাপারটা দেখে সেই ভদ্রমহিলা কারন জানতে চেয়েছিলেন। তাতে অনি তাঁকে বলেছে যে আগেরবার তার পা কেটে অনেকদিন ধরে ব্যাথা ছিল, তাই আর ভয়ের চোটে খেলে না সে।'
সুমিত্রার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়লো না যে সেই রাতের পর অনির পায়ে ওষুধ তিনি লাগিয়ে দিয়েছিলেন কি না। তবে যতদুর মনে হয় তিনি ভুলে গেছিলেন সাত সতেরো কাজের মধ্যে। রাতে ভাবলেন ছেলের সঙ্গে কথা বলবেন কিন্তু খাওয়া দাওয়ার পর ছেলের ঘরে গিয়ে দেখলেন সে অকাতরে ঘুমিয়ে পড়েছে। পরেরদিন বলবেন মনে করে ছেলের মাথায় একটু হাত বুলিয়ে বেরিয়ে এলেন সুমিত্রা। আর মনে পড়েনি তাঁর আগামী কয়েক মাসের মধ্যে।
ভালো করে মাথা মুছতে পারতো না অনি, কিন্তু হঠাৎই সে শিখে নিল নিজের মতো করে। সেটাও সুমিত্রার খেয়াল হলো কলেজবাসে ছেলেকে তোলার সময় তার উল্টোদিকে এবড়ো খেবড়ো অপটু হাতে সিঁথি করে চুল আঁচড়ানো দেখে। কলেজবাসটার মিলিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে বড় কান্না পাচ্ছিল তাঁর। মেয়েটাকে জেদ করে না নিলেই বোধহয় ভালো হতো। ছেলেটার অযত্ন হচ্ছে। ঠিক করলেন সামনের রবিবার ছেলেটাকে নিয়ে বেড়াতে যাবেন কোথাও। এতো ছোট মেয়েকে নিয়ে বেরোতে অসুবিধা হয় বলে নিতান্ত দরকার না হলে কোথাও যান নি এই কিছু মাসের মধ্যে। নয়তো মাসে দুয়েকবার ছেলেকে নিয়ে তাঁরা স্বামী স্ত্রী বেড়াতে যেতেন।
সুমিত্রার মাথাতেও এলো না যে অনি ওইভাবে চুল আঁচড়ে কলেজে যাচ্ছে বলে সহপাঠীদের কাছে বিভিন্ন ঠাট্টা তামাশার শিকার হচ্ছে এবং অসহায় ভাবে মুখ বুজে সহ্যও করছে চোখে জল নিয়ে। এই ঘটনার দিন কয়েক বাদেই ছিল রবিবার। সেদিন সকালে তাড়াতাড়ি ওঠার কথা থাকলেও উঠতে পারলেন না সুমিত্রা। মেয়েটা আগের রাতে খুব জ্বালিয়েছে। তাপস এমনিতেই ছুটির দিনে একটু বেলা অবধি ঘুমোন।
প্রায় দশটা নাগাদ ঘুম ভাঙলো সুমিত্রার, তাও একটা বাজে স্বপ্ন দেখে। ঠাকুরের নাম নিয়ে বিছানা ছাড়লেন তিনি। পাশেই ছেলের ঘর। তড়িঘড়ি আগে সেখানে ঢুকলেন। ঘরে ছেলে নেই। এত সকালে ছেলে কোথায় গেল? বাকি ঘরগুলো খুঁজলেন তিনি। কোথাও নেই অনি।
তাপস কে ধাক্কা মেরে তুললেন সুমিত্রা। ঘুমচোখে টলমল করতে করতে তিনিও খুঁজতে শুরু করলেন। অবশেষে দেখা গেল ছাতের দরজা খোলা। ছাতেও নেই ছেলে। কিন্তু আচমকাই কু ডাকলো মায়ের মন। সুমিত্রা বাগানের পেছনের দিকের আলসের কাছে পায়ে পায়ে এগোতে লাগলেন। প্রায় কুড়ি পঁচিশ ফুট নিচে খানিকটা ডাঁই করা ইঁট, মাটি আর রাবিশের ওপরে হাত পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা ছেলের রক্তাক্ত শরীরটা দেখে তিনি ধীরে ধীরে বসে পড়লেন ওখানেই।
পা পিছলে পড়েছে না আত্মহত্যা তার উত্তর আর পাওয়া গেল না। তরফদার পরিবারের কাছে পৃথিবীর গতিবেগ থেমে গেল সেই মুহুর্ত থেকেই। সুমিত্রাকে বাঁচানো যেত না যদি মেয়েটা না থাকতো। অনির জামা কাপড় জাপটে ধরে কিছুদিন কাটলো। ছেলের ঘরটা থেকে তাঁকে বের করার জন্য বহু সাধ্যসাধনা করেও লাভ হলো না। পা গুটিয়ে মেয়েকে নিয়ে ওই খাটেই শোওয়া শুরু করলেন তিনি।
সবথেকে শ্রেষ্ঠ ওষুধের নাম সময়। মানুষের মন কোনকিছুই একটানা একভাবে ধরে রাখতে না পারার একটা সুবিধা হচ্ছে দুঃখ বা যন্ত্রনার অনুভূতিগুলোও সে ধরে রাখতে পারে না চিরদিনের মতো।
একটা গোটা বছর ঘুরে গেল নিজের নিয়মে। অশ্রুও জমাট বাঁধে প্রকৃতির সেই নিয়মেই। সুমিত্রাও মেনে নিতে বাধ্য হলেন যে হারিয়ে ফেলাটাও একটা ঘটনা মাত্র।
এইসময় তাপসকে তাঁর অফিসের কলিগদের মধ্যে কেউ বুদ্ধি দিলেন যে মেয়েকে নিয়ে একবার কালীঘাট মন্দিরে গিয়ে মায়ের পায়ে ছুঁইয়ে আনতে। ছেলেটার যা হবার তো হয়েছে, তা আর ফেরানো যাবে না। অন্তত মেয়েটা যেন মায়ের কৃপায় টিঁকে থাকে। কথাটা খারাপ লাগলো না, তাই এক সুন্দর সকালে তরফদার পরিবার বেরোলেন কালীঘাট মন্দিরের উদ্দেশ্যে।
কলকাতার এই তীর্থস্থান মহাপীঠ হিসেবে প্রসিদ্ধ হবার জন্য কখনোই ফাঁকা থাকে না। বেলা নটার সময় মন্দির চত্বরে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিলেন দুজনে শতাব্দী প্রাচীন অথচ চিরনতুন মাতৃ মন্দিরের উত্তুঙ্গ চূড়ার দিকে।
অগনিত ভক্ত সমাগম, জবার মালায় ঢেকে যাওয়া অগনিত ছোট্ট দোকান থেকে ডাকাডাকি সব ছাপিয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে একটা অদ্ভুত মন ভালো করে দেওয়া ভাব। কয়েক গুন বেড়ে যায় অন্তরের জোর এই পবিত্র ভূমিতে পা দিলেই। দুজনেরই একসঙ্গে মনে হলো এতদিন কেন আসেননি তাঁরা এখানে। এখানে এমন একটা নির্ভরতা আছে যে নিজের থেকে মনের মধ্যে বলে "সব ঠিক হয়ে যাবে"। কি এমন আছে পৃথিবীতে যা এখানে শুদ্ধমনে চাইলে পাওয়া যায় না! আক্ষরিক অর্থেই সবকিছু পাওয়া যায় এই মহাতীর্থে মা কালিকার রাজসভায়।
আগে কোনদিন আসেন নি কেউই, তবু একটিবারের জন্যও মনে হলো না অচেনা। একজন মধ্যবয়সী সেবায়েতের সাহায্য নিলেন তাঁরা। বললেন নিজেদের প্রার্থনার কথা। মানুষটিরও চোখের কোনটা চিকচিক করে উঠলো যেন। তিনি বললেন, 'আপনি নিজের হাতে মেয়েকে মায়ের রাঙা চরনে শুইয়ে দেবেন মা, আমি ব্যবস্থা করে দেবো। এই মেয়েকে যমেও ছুঁতে সাহস পাবে না আর। আর যদি তেমন করে চাইতে পারেন তাহলে যে গেছে সেও ফেরত আসবে ফের আপনার কোলেই। কত দেখলাম এমন।'
সুমিত্রা কম্পিত গলায় বললেন, 'ফেরত আসবে .. সে আমার কোলে! আপনি বলছেন বাবা, সত্যি বলছেন?'
মধ্যবয়সী মানুষটির চোখে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল একঝলক। তিনি হুঙ্কার দিয়ে বললেন -' আলবত ফেরত আসবে, যদি মায়ের কাছে বলতে পারেন। সে তো জগতের মা। মা হয়ে নিজে অন্য মায়ের সন্তান শোক বুঝবে না তো কে বুঝবে?'
সকালের মঙ্গলারতি শেষ হয়েছে অনেক আগেই। এতো সকালে খুব একটা বাইরের পূন্যার্থী যাত্রী নেই। কিছু স্থানীয় মানুষ আছেন। ভিড় বেশি ঠেলতে হলো না তাঁদের। গর্ভগৃহের সিঁড়ি দিয়ে নামতেই সুমিত্রার মনে হলো এরকম নিশ্চিন্ততা তিনি নিজের ছোটবেলায় মায়ের বুকে মুখ গুঁজে পেতেন। সিংহাসনের পেছন দিক থেকে ঘুরছে অল্প কিছু মানুষের সারি। পায়ে পায়ে এগোতে লাগলেন তিনি। যত সামনের দিকে আসছেন তত মাথার মধ্যে কেমন যেন একটা ঘোরের মতো তৈরি হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি মা উঁকি দেবেন সিংহাসন থেকে মুখ বারিয়ে। বড় পাত্রে কর্পূর জ্বালিয়ে আরতি করছেন এক ভক্ত।
বিহ্বল বোবা চোখে তাকিয়ে আছেন তাপস সেদিকে। কর্পূরের কালো ধোঁয়াটা যেন আবছা একটা খাঁড়ার মতো আকার নিচ্ছে মনে হচ্ছে। অবশেষে দুজনে এসে দাঁড়ালেন সামনে কোলে মেয়েকে নিয়ে। প্রায় দেড় মানুষ সমান উঁচু থেকে রাজ রাজেশ্বরী মুখে হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছেন তাঁদের দিকেই তিনটে বিশাল মাপের টানাটানা কমলা রঙের আলো ঝলমলে চোখে। চোখ থেকে যেন উপচে পড়ছে স্নেহ, ভালোবাসা আর শান্তি। একবার সেই চোখের দিকে তাকালেই মন থেকে মুছে যায় যাবতীয় অপ্রাপ্তির বেদনা। কালো মুখে গড়িয়ে পড়ছে এক বিন্দু জলের ফোঁটা মাথার চুল থেকে। যেন সদ্যস্নাত মা বেরিয়েছেন আটপৌরে শাড়ি পরে। একটা জবার মালার সাথে মিশে যাওয়া রঙের বেনারসি জড়ানো শরীরে আটপৌরে ভাবেই। সিঁথিতে সোনার টিকলি নেই, সেখানে টকটক করছে এয়ো স্ত্রীর মতো নতুন সিঁদুর। মেয়েকে হাত বাড়িয়ে মায়ের চরনে ছোঁয়ালেন তাপস। সুমিত্রা আর এই সন্তানের জন্য কিছু চাইলেন না। তাঁর অন্তর বলে দিচ্ছিল মেয়ের জন্য কিছু চাইতে হবে না আর। তিনি মায়ের চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে শুধু বললেন -' যাকে তোমার কাছে নিয়েছো, তাকে ফিরিয়ে দাও মা। আমি যে তাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।'
জবাব এলো না কিছু শুধু তিনটে চোখে আরেকবার আলো ঝলমলিয়ে উঠলো আর মৃদু দুলে গেল বিশাল সোনার নথটা। এক মায়ের কথা আরেক মা বোঝে। এখানেও তার ব্যাতিক্রম হলো না। সুমিত্রা নিঃসন্দেহে বুঝলেন যে তাঁর প্রার্থনা শুনেছেন মা।
বেরিয়ে এলেন দম্পতি মেয়েকে নিয়ে। তার ছোট্ট মুঠোয় চেপে ধরা একটা টাটকা জবা। মায়ের পায়ের কাছে ঠেকানোর সময় ওটাই মুঠো করে ধরেছে সে।
ঠিক একটা বছর পরে কোলজুড়ে এলো সে। আবার ছেলে হয়েছে। দেখতে একদম একই নয়। কিন্তু সুমিত্রা জানেন এ সেই ছেলেই, যাকে তিনি একবার পেয়েও হারিয়ে ফেলেছিলেন। তবে এবার আর হারানোর গল্প নেই। জন্মের সময় কালীঘাটের প্রসাদী ফুল ছিল মাথার কাছে। ছেলেকে নিয়ে মায়ের চরনে ছুঁইয়েও গেছেন।
বগলামুখী মায়ের সামনে বসে ঘটনাটা শুনছিলাম এতক্ষন। নাটমন্দির বন্ধ আজ দেড় বছর ধরে। কালীঘাটের সর্বত্রই মায়ের অবস্থান বিভিন্ন রূপে। আদি গঙ্গার ঘাটের সামনে বগলামুখী মায়ের সামনেটা যেমন পরিস্কার তেমনি শান্ত। হাঁকডাক, ভিড়, ঠ্যালাঠেলি কিছুই নেই। তাই গত দেড় বছর ধরে যখনই আসি এখানেই আসন পাতি। ভদ্রমহিলা বেশ কিছুদিন ধরেই যোগাযোগ করেছিলেন তাঁর জীবনের এই কাহিনীটা শোনানোর জন্যই। শুনছিলাম সেটাই মন দিয়ে। এবার বললাম- ' কিন্তু আপনি বুঝলেন কি করে যে এই আপনার "অনি"।
মৃদু হেসে সুমিত্রা ঘাড় ফিরিয়ে ডাকলেন ছেলেকে -' এই অনি, একবার এদিকে আয় তো বাবা।'
একটি বছর বারোর মেয়ের সঙ্গে উদ্দাম ছুটোছুটি করে খেলছিল দশ বছরের ছেলেটি। মায়ের ডাক শুনে দিদি তাকে চেপে ধরে টেনে আনলো। সুন্দর চেহারা, চোখে মুখে দুষ্টুমি মাখানো। কপালে আর মুখে দু তিন জায়গায় সামান্য গর্ত মতো। খুব ভালো করে তাকালে চোখে পড়ে সেটা।
মা ছেলেকে মৃদু ধমক দিয়ে ব্যাগ থেকে একটা জামা বের করে আগের ঘামে ভিজে যাওয়া জামাটা ছাড়িয়ে দিতে শুরু করলেন। জামাটা খুলতেই চোখ আটকে গেল আমার। বাচ্চাটার বুক আর পেটের কাছে বেশ গভীর ভাবে কিছুটা চামড়া এবড়ো খেবড়ো ভাবে ঢুকে গেছে ভেতর দিকে। বিস্মিত হয়েই বললাম - ' কি হয়েছে ওর এরকম?'
জামা পাল্টানো হয়ে যেতে ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে তিনি স্থির চোখে তাকালেন আমার দিকে, তারপর মৃদু স্বরে বললেন -' জন্মদাগ। ওভাবেই এসেছে।' তাকিয়ে থাকলাম তাঁর দিকে। আমার মন বলছে আরো কিছু শোনা বাকি আছে।
সুমিত্রা এবার বগলা মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন -' আগের বার ছাত থেকে পড়ে শরীরের ওই জায়গাগুলোতেই ইঁট আর রাবিশ ফুটো হয়ে ঢুকে থেঁৎলে গেছিল। মা ওইটুকু দিয়ে পাঠিয়েছেন যাতে চিনতে পারি আর আগের মতো ভুল না করি সেই জন্য। তাই নামটাও আর অন্য দিই নি। "অনির্বান" কথাটার মানেই তো যা নিভে যায় না।'
এবার আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এতক্ষন যা শুনছিলাম সেটা ভালো লাগলেও খুব একটা অচেনা কিছু ছিল না। মায়ের কাছে এরকম সন্তান হারা অনেক মানুষই সন্তান পেয়েছেন। কিন্তু যে গেছে সেই এসেছে এটা আগে কোথাও শুনিনি। এরকম নির্দিষ্ট প্রমান নিয়ে যে কেউ আসে তাও জানা ছিল না আমার।
এক মা চলে গেলেন তাঁর ছেলে মেয়েকে নিয়ে, আরেক মায়ের সামনে শুধু আমি বসে রইলাম সীমাহীন বিস্ময় আঁকড়ে। যদিও ভেতর থেকে কেউ বলে দিচ্ছিল যে এখানে বিস্মিত হবার মতো কিছু নেই। মানুষের সামান্য বুদ্ধিতে আমরা কতটুকু আর জানি। স্বয়ং মহাকাল যাঁর স্বরূপ জানতে পারেন নি সেখানে আমাদের ক্ষমতা কোথায় যে তাঁর মাহাত্ম্যের কার্য কারন ব্যাখ্যা করবো।
বগলামুখী মায়ের দিকে তাকাতেই তাঁর পীত স্মিত মুখে পলকের জন্য যেন ফুটে উঠলো তিনটে বড় বড় কমলা রঙের চোখ। চমকে তাকালাম আবার সেদিকে। কিছু নেই আর। মা বগলামুখী তাকিয়ে আছেন স্বাভাবিক ভাবে। শুধু সামনের বড় প্রদীপের শিখাটা গঙ্গার হাওয়ায় একবার নিভু নিভু হয়েও ফের সতেজে জ্বলতে লাগলো অনির্বান শিখায়।
|| সমাপ্ত ||