09-06-2019, 08:26 AM
কৌসানির পাহাড়ি রাস্তায় আমাদের টয়োটা এগিয়ে চলেছে সাচ্ছন্দে। পুতুল কে সানগ্লাসে ভালই মানিয়েছে।মিতুল এক মনে গালে হাত দিয়ে পাহাড়ের দৃশ্য উপভোগ করছে। আমি ড্রাইভার কে জিজ্ঞাসা করলাম "তুমি এখান কার সবাই কে চেন?"" দিনেশ আমাদের ড্রাইভার। এই দশ দিন আমাদেরই সাথে থাকবে। এবার পুরো চামলি কৌসানি, আর যোগ্য়েস্বর মহাদেভ দর্শন করব।ড্রাইভার বলল "বাবু জন্ম এখনে চিনব না কেন। এত ছোট জায়গা। সবাই সবাই কে চিনি। আমাদের ঘোরার নতুন মাত্র পেল দিনেশ। খুব গরিব কিন্তু সথ ছেলে। নানা জায়গা ঘুরে , দেখতে দেখতে ৭ দিন কেটে গেল। পুতুল আর মিতুলের মুখে হাঁসি দেখে আমিও নিজেকে পরিপূর্ণ বোধ করছিলাম। গন্ধি আশ্রম থেকে ত্রিসুল পর্বত দেখে ফেরার পথে দিনেশ কে প্রশ্ন করলাম "আচ্ছা অশ্বিনী কুমারের আশ্রম টা কত দূর হবে?"
দিনেশ উতসাহের সঙ্গে জবাব দিল যাবেন যাবে ওখানে এইত মাত্র ৫ কিলোমিটার। জানেন স্যার ওখানে গেলে আপনার সব মনের রোগ সেরে যাবে। কি অদ্ভূত জায়গা। অশ্বিনী বাবা থাকেন মা কে নিয়ে। দুজন খুব ভালো মানুষ। গ্রামের সব গরিব দের বিনা পয়সায় অসুধ দেন। সহর থেকে একজন ডাক্তার আসে দেহ্রাদুনের। রোজ ১০০ লোকের ভোজ হয়। থাকা খাওয়া ফ্রি। "মা কে?" দিনেশ বলল আমরা আ কিছু জানি না " সুনেছি অনেক বছর আগে উনি পাগলি হয়ে এসেছিলেন এই খানে।"বাবাই ওনাকে নিজের আশ্রমে স্থান দেন।" তার পর মা সেখানেই থাকেন। আর সবাইকে সেবা করেন। আমি কৌতুহল নিয়ে বললাম "কি হয় সেখানে ?" দিনেশ চেচিয়ে উঠলো "বাবার কোনো ধর্ম নেই , যদিও গেরুয়া পরেই থাকেন। কোনো পুজো পাঠ হয় না। একটা হল ঘর আছে। বলেন ওটা মায়ের ঘর। আর সবাই কে বলেন মাকে সেবা করা মানে ভগবান কে পাওয়া। অনেক বিদেশীরাও অনার কাছে যান।অনেক অনেক লোক যান অনার কাছে।চলুন না স্যার কালকে। আমি মিতুল আর পতুল কে জিজ্ঞাসা করলাম যাবে নাকি ? দুজনেই এক বাক্যে রাজি হয়ে গেল।এনকাউন্টার এর ফাইল ঘটতে ঘাটতে বেশ রাত হলো। GOI এর কনফিডেনসিএল ফাইল তা পড়তে পড়তে এতই বিভোর হয়ে পরেছি পুতুল কে দেখতে পাই নি। সেদিন রাতে ঘুমোতে যাবার আগে পুতুল বলল কি খুজ্য বলত তুমি ? আমাকে কি কিছু লুকিয়ে আচ ?" উত্তর দিতে মন চাইল না। বললাম"কাল অনেক ঘোরা বাকি ঘুমিয়ে পর। আমাদের দীর্ঘশ্বাস পাক খেতে খেতে মিলিয়ে গেল।
অশ্বিনী বাবার আশ্রম এর বৈশিষ্ট হলো আশ্রম যাবার আগে সুন্দর একটা পাহাড়ি ঝরনা। মাতাল হয়ে ছুটে চলেছে পাহাড়ের বুকে আছড়ে আছড়ে। তার বিরাম নেই ব্যথা নেই নেই কোনো অনুসচনো , কার সাথে মিশে মাইল একাকার হয়ে যাবার নেশায় ঝরে চলেছে অবিরাম। লোকে একে মন্দাকিনী বলে। কিন্তু এর আসল লাম জানা নেই।আমরা বাবার আশ্রমে ঢুকে অবাক হয়ে গেলম আমাদের যান্ত্রিক সহরের বাইরে এমন পৃথিবীতেও মানুষ বাঁচে। কি শান্ত পবিত্র এই জায়গা। চার পাশে বড় বড় পাইন গাছ। অফিস তা ছোট ওকে অফিস বলা যায় না। দু ছাড়তে কোয়ার্টার। আর চারি দিকে সুন্দর ফুল।
মায়ের হল ঘরে গিয়ে বসতে সত্যি মনটা জুড়িয়ে গেল। মায়ের কথা মনে পড়ল। আমরা কি চরম সার্থপর।কেউ কাওকে আপন করতে শিখি নি। সারা জীবন সুধু হিসেব করেই কাটিয়ে দিতে হলো আমাদের। এর থেকে চরম বিরম্বনা আর মানুষের কিছু হতে পারে না। একজন এসে চা দিয়ে গেল। চায়ের প্রয়োজন যে অনুভব করছিলাম না তা নয় এমন করে কেউ মনে কথা জেনে নেবে ভাবতেই পারি নি। চা দিয়ে বলল "অশ্বিনী বাবা আসছেন একটু পরে আপনারা বসুন, উনি সবার সাথে দেখা করেন।" মিতুল এর জায়গাটা এত পছন্দ হলো যে বলেই ফেলল বাবা "আর গেস্ট হাউস যাব না, কাল এখানে থেকে পরশু সকালে চলে যাব। পতুল তাতে সায় দিল। মা মেয়ের বায়নার কাছে আমি চিরকাল হেরে এসেছি। কিন্তু আমাকে তো গেস্ট হাউস যেতেই হবে। যদিও গুচবার তেমন কিছুই নেই। তবুও দিনেশ একা সব জিনিস ঠিক নিয়ে আসতে পারবে কিনা? দ্বিধা রয়ে গেল। পুতুল কে বললাম দেখো থাকা না হয় যাবে কিন্তু সব লাগেজ নিয়ে আসতে হবে। আমি না হয় সন্ধ্যায় গিয়ে লাগেজ নিয়ে এসব তার পর পরশু সকাল হলেই এখান থেকে বেরিয়ে যাব। তাতে কারোর আপত্তি হলো না। অশ্বিনী বাবার আশ্রমে জনা দশেক লোক থাকে। তারা ভোগ আর রান্না ছাড়া পরিষ্কার করে রাখার কাজ করে। একটা ট্রাস্ট আছে দেখলাম তার অনেক মেম্বার।
একজন গেরুয়াধারী সুঠাম দীর্ঘকায় ব্যক্তি এসে প্রনাম জানালো। পুরো মুখ জুড়ে কালো একটা চশমা।সেই নাক সেইই মুখ অবিকল।১৮ বছর আগেএর একটা সাদা কালো ছবি। মনের কনে দপ করে ভেসে নিভেগেলো ছবিটা। শান্ত নির্লিপ্ত একজন সন্যাসী। "সুনলাম এখানে থাকতে চান। এখানে আপনাদের কোনো অসুবিধা হবে না। তবে এখানে আপনারা দামী হোটেলের সুখ পাবেন না।এখানে ভোগ হয়। আমরা নিজেরাও সেই ভোগ খাই আর সবাইকে খাওয়াই। মার ঘরে আমরা রোজ সন্ধ্যায় আর সকালে বসি। চা খাবার সাথে সাথে আমরা সুধু গল্প করি। আমার কোনো ধর্ম নেই। আমি কোনো ভগবানের পূজা করি নি।"
কিছুক্ষণের জন্য তাকিয়ে রইলাম। নিজেকে এই লোকটির সামনে বেশ ছোট মনে হলো। আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতে এক মহিলা এসে হাজির হলেন। মনটা আলাদা প্রশান্তিতে ভরে গেল। এত সুন্দর হয় কোনো মহিলা।কোনো ভুসন নেই শরীরে , গেরুয়া সাড়ি , আর ব্লাউস।মার্জিত বেশ ভূসা। মুখে অদ্ভূত এক আবেশ। আমি বিভোর হয়ে চেয়ে রইলাম। বয়স ৫০ হবে।কিন্তু তার চোখের চাহনি তে আমার মনের গ্লানি খুরের ধারের মত কেটে যেতে লাগলো একে একে। কি ব্যাখা হয় জীবনের। নতুন কি ব্যাখা খুঁজে পাব অশ্বিনী কুমারের কাছ থেকে। কি ভাবে যে সময় কেটে গেল বুঝতে পারলাম না। ভোগ ভোগের পর বিশ্রাম, আর তার পর অশ্বিনী কুমার আমাদের নিয়ে গেলেন আবার মায়ের ঘরে। মন চাইল অশ্বিনী কুমারের ঘরটা দেখি। বললাম "আচ্ছা আমি কি আপনার ঘর দেখতে পারি , মনে সাধ জেগেছে।" নিস্পাপ শিশুর মত অস্ফুটে বেরিয়ে আসলো সব্দ গুচ্ছ নিয়ত্রনের কোনো বাধায় মানলো না।অশ্বিনী বাবা স্মিত হাস্যে বললেন এতে আবার এত দ্বিধা কেন ? একজন একটা চাবি হাতে দিয়ে গেল। সেই চাবি হাতে নিয়ে আমায় নিয়ে আসলেন তারই ঘরের সামনে। অন্য কোয়ার্টার এর থেকে ইটা আলাদা ছিল না। ঘরে ঢুকেই প্রচন্ড আত্ম গরিমার আত্মূভিমানের ধাক্কা খেলাম। উঠে দাঁড়াবার সমর্থ ছিল না। একটা বিছানা আর কিছু বই ছাড়া ঘরে কিছুই নেই। আর ঘরের কনে সযত্নে সাজানো একটা পুরনো সেলাই মেসিন , ঢাকা দিয়ে রাখা।
মনের কান্না বড় কান্না। সহজে থামতে চায় না। কেমন যেন মন্ত্রের মত ঘুরে বেড়াচ্ছি। এক প্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্ত . যদি এমন একটা জায়গা পেতাম। মায়ের হল ঘরে বসে বুঝতে চেষ্টা করলাম অশ্বিনী বাবাকে। কি তার জীবন দর্শন। কে সে। কি তার পরিচয়। সত্যি কি সে ত্যাগী।কে এই মা। চায়ের গরম কাপে চুমুক দিতে দিতে পুতুল বাবার পায়ে গড়িয়ে পড়ল। মিতুল কে মা ভালো বেশে ফেলেছেন। মিতুল এমন আন্তরিক হয়ে মাকে জর্য়ে রেখেছে যে আপন হওয়া ছাড়া আমার আর রাস্তা ছিল না। বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম আচ্ছা আপনাকে এখানে যে এত ভালো বসে লোকে কেন? অশ্বিনী বাবা জবাব দিলেন না। মা জবাব দিলেন " এত ভালবাসা নয়। এত বন্ধুত্ব। বিপদে মানুষ মানুষকে ই বন্ধু ভেবে কাছে পায়। এত মানুষ কত নিরুপায় নিসহায় , আপনি তাদের পাশে দাঁড়ান, তাদের দুঃখকে আপন করে নিন তারাও আপনাকে বন্ধু ভেবে নেবে। তখন অশ্বিনী আর আপনার তো কোনো তফাত থাকবে না। " বেপরওয়া কোন ঠাসা আমার অহংকার প্রশ্ন করলো "যদি আপনারা এতই নিস্পাপ হন তাহলে আপনাকে মা বলে আর অশ্বিনী বাবা কে বাবা বলে কেন।আপনারা কি স্বামী স্ত্রী ? "
অশ্বিনী এর মুখে এতটুকু ভাবান্তর হলো না। আমার বুকের ভিতর কোনো এক পাপী আমায় চাবুক মার্চে অবিরত। অন্ধ সয়তানের মুখোশ টেনে ছিড়ে ফেলতে হবে। " স্বামী স্ত্রী কি পরিচয়ে বাঁচে ? মা প্রশ্ন করলেন?" আমায় বকর মত উত্তর দিলাম"সমাজের পরিচয়ে " আমি যে কত হীন তা বুঝতে নিজের বাকি রইলো না। মা বললেন দেখুন "স্বামী স্ত্রী বাঁচে ভালবাসার পরিচয়ে , যে ভালবাসা নির্ভেজাল। যেখানে কোনো উচ নিচের সীমানা নেই, সমাজের কোনো ব্যাখ্যা খাতে না এই ভালবাসায়, ভালো মন্দের কোনো তফাত থাকে না , এ ভালবাসা সবার উপরে , আর মানুষ হয়েই মানুষ কে ভালো বসতে হয়। সমাজ তা কে পরম পবিত্র মর্যাদা দেয়। যে মানুষটার আত্মার সাথে আমি মিশে রয়েছি , যে মানুষটা কে আমার অতীত বর্তমান ভবিস্বত সপে দিয়েছি তার কাছে স্ত্রী মর্যাদা চেয়ে হীন হব?" আমার মুখ থেকে কথা সরল না। কৌতুহল আমাকে তারা করে বেড়াল নির্মম অমানুষ হয়ে। আচ্ছা আপনি চশমা পরে থাকেন কেন? অশ্বিনী বাবা কে প্রশ্ন করলাম সরা সরি।
বেশ খানিক খন নিরব থাকার পর উত্তর দিলেন। আপনার পেশা এমন যে আপনি এ প্রশ্ন না করে পারবেন না তাতে আমি দোষ দেখি না।আসলে কি জানেন " আমরা মানুষ চেনবার চেষ্টা করি মানুষের চোখ দিয়ে। ভেবে দেখুন যদি আমাদের কারোর চোখ না থাকত। কি ভাবে চিনতাম আমরা মানুষ। স্পর্শ করে কথা সুনে।কত টুকু বুঝতাম সামনের মানুষ টাকে। চোখ তো ভুল দেখায়। অন্তর দিয়ে মানুষ দেখুন আরো ভালো করে মানুষ তাকে স্পর্শ করতে পারবেন।চোখের দরকার হবে না।"কালো চশমা খুলে ফেলে বললেন " আমার চোখে দেখে আপনার কি মনে হয় ?" সেই চোখ অবিকল সে চোখ। মোহিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম সেই চোখে। মৃত্যু কে হারিয়ে আসা এমন কঠিন চোখ আমি আগে দেখিনি।সাগরের মত প্রশান্ত , উত্তেজনা নেই, নেই কোনো পাপ , মৃত্যুপুরী থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা উজ্জ্বল ধ্রুবতারার মত প্রজ্বল্যমান দ্যুতি। আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে ফিরিয়ে আনতে পারলাম না আলোক আর রুবি কে। কে বলে বাল্মিকি নেই। আমাদের মধ্যে আমাদের দৈনন্দিনে এমন অনেক বাল্মিকি নিসারে নিজেদের রামায়ন রচনা করে।আমরা উপলব্ধি করা সুযোগ টুকু পাই না।
আমার শরীরের শক্তি টুকু নিগড়ে নিচ্ছে এই অশ্বিনী। আমাকে জিততেই হবে। মা বড়। হ্যান মা এর কাছে হার মানতে হবে অশ্বিনী নামের আলোক কে। জিজ্ঞাসা করলাম আচ্ছা আপনি মায়ের নাম যে এই সভা ঘর বানিয়েছেন মা কি মা কে? মাই কি আপনার সব ? কিছু বলুন। অশ্বিনী বাবা হেঁসে বললেন "ইটা না হয় তোমাদের মা বলুক।" রুবি খিল খিল করে হেঁসে উঠলো। সেই সুন্দর রূপের ছটা, কি অদ্ভূত এদের ভালো বাসা . নিরন্তর ফল্গু নদীর মত বয়ে চলেছে। একে অপরের মধ্যে নাই বা মিশলো।"পুতুল বিরক্ত হয়ে বলল "তোমার না সবটাতে বাড়া বাড়ি। বাবা আপনি কিচু মনে করবেন না ও DIG তো জেরা না করে ওর পোষায় না।
রুবি কিছু জবাব দিল না। ভাবান্তর না করেই বলল তাতে কি . উনি যেই হন আমি তো আমার রাস্তা থেকে সরে আসতে পারব না মা।দেখুন সুশান্ত বাবু " মা হলেন একাধারে জন্মদাত্রী, আবার পালন কারিনী , সেবাময়ী , বন্ধু আবার আমনার জীবন দর্শন।মা সুধু আপনার শরীরের রক্ত মাংশের সৃষ্টি কারিনী নন উনি আপনাকে রূপ দিয়েছেন। ওনার জঠরে বড় হতে হতে অনার মনের রূপের ছটায় আপনি রূপ পেয়েছেন। তার সাথে আপনার সম্পর্ক জন্ম জন্মান্তের। স্ত্রীর উপরে মা, আর মা তিনি যিনি আপনার জীবন হরণ করতে পারেন।আশ্চর্যের বিষয় কি জানেন আপনার কাম শক্তির প্রেপনাও আসে মায়ের থেকে। তার জীবনের প্রতিরূপ আপনি। তার আশা আকাঙ্খার এক মেল বন্ধন আপনি। তার সপ্ন তার ভবিস্বত আপনি। আর দয়া তার করুনা আপনি। তার জীবনের দর্শন আপনি তপস্যাও আপনি আর সমর্পন আপনি। আপনি তাকে দেবী জ্ঞানে পূজা করেন আর আপনি তাকে স্ত্রী রূপে ভালবাসেন।আপনি তাকে কন্যা দান করেন আরাপনি তাকে ভোগ করেন। সেই মা সে সক্তি সেই জননী। সেই আপনার মনের মূলাধার আপনার জীবনী সক্তি। সেই আপনার ভালো , সেই আপনার আলো সেই আপনার আশির্বাদ।"
বাক্ বিহবল হয়ে পরলাম। পুতুল আমার দিকেতাকিয়ে নিজের চোখ মুচল। মিতুলের মন উদাস হয়ে গেছে। রুবির কলে মাথা রেখে সুয়ে আছে। রুবি মিতুলের মাথায় বিলি কেটে দিছে। এমন অন্তরঙ্গ ভালবাসা আমি দেখিনি। অশ্বিনী বাবাকে প্রনাম করতে ইচ্ছা হলো না। কিন্তু স্যালুট করতে ইচ্ছে হলো ৫০ কোটি টাকায় বেছে নেওয়া এমন জীবন স্পৃহা কে। কতোটা পথ চলতে তবে পথিক হওয়া যায়। প্রতিটা সময়ের স্তব্ধতা আমায় ম্লান করে দিল। হয়ত জীবনের মূল স্রোত থেকে ছিটকে আসা দুটো কপোত কপতি অচেনা পৃথিবী কেই আপন করে নিয়েছে। এর থেকে বড় জয় আজ মানুষ পেতে পারে না। যেখানে আইন কেও মাথা নামিয়ে সরে যেতে হয় প্রাপ্য সন্মান জানাবার ভাষায়। দুটো দিন্পেরিয়ে গেল। কোনো কিছু ই আর গোপন নেই।শেষ রাতে ভোগের পর হাসি ঠাট্টা চলতে লাগলো . কেমন ভাবে অবিনী বাবা আর মা কে আপন করে ফেলেছি সে ব্যাখা দিতে পারি নি নিজের মন কে। এই আশ্রমে করে ফিরব তাও অজানা কিন্তু লোভ হয় এমন দুটো মানুষ কে নিজের করে বন্দী করে রাখতে। এরা যে দুষ্প্রাপ, এদের কে কি কেউ কয়েদ করে রাখতে পারে।
রাতে অশ্বিনী বাবা ডাকলেন আমায়। সিগারেট আমি খাই না কিন্তু আশ্রমের বাইরে দাঁড়িয়েই একটা সিগেরেট খেতে মন চাইছিল। কিছুটা দুরে গ্রামের পাহাড়ের কল বেয়ে একটা মুদি খানা . সেখানে কম দামী সিগেরেট রাখে।তারই একটা ধরিয়ে টানতে টানতে গগন বিদারী পর্বত কুল কে দেখতে দেখতে আরষ্ট হয়ে পরলাম। কি বিশাল কি বিরাট অহংকার হীন দাড়িয়ে আছে অক্লান্ত। মানুষের হাজার সভ্যতার সোপান দেখেও মানুষ কে কাছে টেনে নিতে পিচ পা হয় না। অশ্বিনী বাবার কোয়ার্টার এ যেতেই আমায় সাগ্রহে বসতে বললেন। মা আসলেন অন্য ঘর থেকে। রাত ১০ তা হবে নিঝ্হুম। বাবা শান্ত স্বরে বলে উঠলেন " নিয়ে যেতে এসেছেন ? কোনো দিধা নেই।আমার অতীত আমাকে ক্ষমা করবে না , আর ও প্রস্তুত।" মা অশ্বিনী বাবার গায়ে একটা শাল চাপিয়ে দিলেন। এমন অনারম্বর সমর্পনে নিজেকে আরো হীন মনে হলো। যে মানুষটাকে কেউ ১৮ বছর ধরে খুঁজে পায় নি তাকে এভাবে পেয়ে এত দিন পর আমার গর্ব কম ছিল না।হয়ত প্রমোশন তা পাকা হয়ে যেত। মিতুলের ভবিস্বত অনেক অনেক বেশি উজ্বল হয়ে উঠত। কিন্তু পারতাম কি মিতুল কে এমন শিক্ষা দিতে। যারা জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের জীবনের গতি বদলে দেয়, মানুষ কে মানুষ বলে ভালবাসতে সেখায় যারা , দুখ সুখের বাইরে বরিয়ে এসে আলাদা পৃথিবী গড়ে তুলতে পারে তাদের যোগ্য স্থান দেবার অধিকারী আমার ছিল না। মুখ নিচু করে বেরিয়ে আসলাম বাবার ঘর থেকে।
অন্ধকার থাকতে থাকতেই আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।দেহরাদূন থেকে ট্রেন ধরব। অনেকটা পথ। দিনেশ্ বাবা কে ভক্তি ভরে প্রনাম করে আমাদের লাগেজ গাড়িতে তুলতে লাগলো। মিতুল মামনি বলে রুবি কে জড়িয়ে ধরল। রুবির চোখে জল থেকে আশ্চর্য হয়ে গেলআম . ঘন বেদনার বাস্প আমার বুক চিরে গলা টাকে চেপে ধরল। পুতুল বাবা কে প্রনাম করলো। দেখলাম আলোক আমার দিকে তাকিয়ে নিস্পলক। শান্ত , জীবনের কঠিন থেকে কঠিনতম লড়াই কে পাঠ্যে বীরের মত এগিয়ে চলেছে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে। সেটাই আমাদের শেষ গন্তব্য।ভয়হীন এমন চরিত্র কে শ্রধ্যা করতে কুন্ঠা হলো না। আশ্রম পেরিয়ে মন্দাকিনীর কাচা কচি আসতেই শান্ত স্নিগ্ধ বাতাস ঝাপটা মারতে লাগলো মুখে। অনেক খন আগলে রাখা অন্ধ সয়তানের ফাইলটা কোল ভার করে বসে ছিল।পুতুল আমার কাধে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলো "আর কি এটার দরকার আছে?" আমি ওদের দিকে না তাকিয়ে ফাইল হাতে নিয়ে গাড়ির জানলা থেকে ছুড়ে দিলাম মন্দাকিনীর জলরাশির গভীর খাদে। দিনেশ জিজ্ঞাসা করলো " কি হলো স্যার?" আমি বললাম কিছু না "জঞ্জাল "
ঘন কুয়াশা মাখা রাস্তায় গাড়ির আলোর সাথে খেলতে খেলতে হারিয়ে গেলাম এক অনজন পৃথিবীতে। হয় আবার সুযোগ আসবে। হয়ত আবার কৌসানি তে ফিরে আসবো। হয়ত অন্ধ সয়তানের পাপের রাজ্যে এমনঅনেক পদ্মফুল ফুটবে। রুবি মুখটা মনে পরে গেল। যদি এই গ্রামেরই একটা ঘরের মালিক হতাম আমি। যদি পৃথিবীর ধুলো মাখা সহুরে বিষাক্ত হওয়া থেকে স্বাদিহতা পেতাম মুক্তির।ব্যাঙ্কের জমানো টাকার দিকে না তাকিয়ে মনের রাজা হতে পারতাম আলোকের মত।হালকা নিশ্বাস হয়ত ছুয়ে ফেল পুতুলের মনের অন্তসত্বায়। আমার কাঁধে মাথা রেখে পুর্তুল আমার বা হাথ তা জড়িয়ে চোখ বুজিয়ে দিল।
সমাপ্ত
দিনেশ উতসাহের সঙ্গে জবাব দিল যাবেন যাবে ওখানে এইত মাত্র ৫ কিলোমিটার। জানেন স্যার ওখানে গেলে আপনার সব মনের রোগ সেরে যাবে। কি অদ্ভূত জায়গা। অশ্বিনী বাবা থাকেন মা কে নিয়ে। দুজন খুব ভালো মানুষ। গ্রামের সব গরিব দের বিনা পয়সায় অসুধ দেন। সহর থেকে একজন ডাক্তার আসে দেহ্রাদুনের। রোজ ১০০ লোকের ভোজ হয়। থাকা খাওয়া ফ্রি। "মা কে?" দিনেশ বলল আমরা আ কিছু জানি না " সুনেছি অনেক বছর আগে উনি পাগলি হয়ে এসেছিলেন এই খানে।"বাবাই ওনাকে নিজের আশ্রমে স্থান দেন।" তার পর মা সেখানেই থাকেন। আর সবাইকে সেবা করেন। আমি কৌতুহল নিয়ে বললাম "কি হয় সেখানে ?" দিনেশ চেচিয়ে উঠলো "বাবার কোনো ধর্ম নেই , যদিও গেরুয়া পরেই থাকেন। কোনো পুজো পাঠ হয় না। একটা হল ঘর আছে। বলেন ওটা মায়ের ঘর। আর সবাই কে বলেন মাকে সেবা করা মানে ভগবান কে পাওয়া। অনেক বিদেশীরাও অনার কাছে যান।অনেক অনেক লোক যান অনার কাছে।চলুন না স্যার কালকে। আমি মিতুল আর পতুল কে জিজ্ঞাসা করলাম যাবে নাকি ? দুজনেই এক বাক্যে রাজি হয়ে গেল।এনকাউন্টার এর ফাইল ঘটতে ঘাটতে বেশ রাত হলো। GOI এর কনফিডেনসিএল ফাইল তা পড়তে পড়তে এতই বিভোর হয়ে পরেছি পুতুল কে দেখতে পাই নি। সেদিন রাতে ঘুমোতে যাবার আগে পুতুল বলল কি খুজ্য বলত তুমি ? আমাকে কি কিছু লুকিয়ে আচ ?" উত্তর দিতে মন চাইল না। বললাম"কাল অনেক ঘোরা বাকি ঘুমিয়ে পর। আমাদের দীর্ঘশ্বাস পাক খেতে খেতে মিলিয়ে গেল।
অশ্বিনী বাবার আশ্রম এর বৈশিষ্ট হলো আশ্রম যাবার আগে সুন্দর একটা পাহাড়ি ঝরনা। মাতাল হয়ে ছুটে চলেছে পাহাড়ের বুকে আছড়ে আছড়ে। তার বিরাম নেই ব্যথা নেই নেই কোনো অনুসচনো , কার সাথে মিশে মাইল একাকার হয়ে যাবার নেশায় ঝরে চলেছে অবিরাম। লোকে একে মন্দাকিনী বলে। কিন্তু এর আসল লাম জানা নেই।আমরা বাবার আশ্রমে ঢুকে অবাক হয়ে গেলম আমাদের যান্ত্রিক সহরের বাইরে এমন পৃথিবীতেও মানুষ বাঁচে। কি শান্ত পবিত্র এই জায়গা। চার পাশে বড় বড় পাইন গাছ। অফিস তা ছোট ওকে অফিস বলা যায় না। দু ছাড়তে কোয়ার্টার। আর চারি দিকে সুন্দর ফুল।
মায়ের হল ঘরে গিয়ে বসতে সত্যি মনটা জুড়িয়ে গেল। মায়ের কথা মনে পড়ল। আমরা কি চরম সার্থপর।কেউ কাওকে আপন করতে শিখি নি। সারা জীবন সুধু হিসেব করেই কাটিয়ে দিতে হলো আমাদের। এর থেকে চরম বিরম্বনা আর মানুষের কিছু হতে পারে না। একজন এসে চা দিয়ে গেল। চায়ের প্রয়োজন যে অনুভব করছিলাম না তা নয় এমন করে কেউ মনে কথা জেনে নেবে ভাবতেই পারি নি। চা দিয়ে বলল "অশ্বিনী বাবা আসছেন একটু পরে আপনারা বসুন, উনি সবার সাথে দেখা করেন।" মিতুল এর জায়গাটা এত পছন্দ হলো যে বলেই ফেলল বাবা "আর গেস্ট হাউস যাব না, কাল এখানে থেকে পরশু সকালে চলে যাব। পতুল তাতে সায় দিল। মা মেয়ের বায়নার কাছে আমি চিরকাল হেরে এসেছি। কিন্তু আমাকে তো গেস্ট হাউস যেতেই হবে। যদিও গুচবার তেমন কিছুই নেই। তবুও দিনেশ একা সব জিনিস ঠিক নিয়ে আসতে পারবে কিনা? দ্বিধা রয়ে গেল। পুতুল কে বললাম দেখো থাকা না হয় যাবে কিন্তু সব লাগেজ নিয়ে আসতে হবে। আমি না হয় সন্ধ্যায় গিয়ে লাগেজ নিয়ে এসব তার পর পরশু সকাল হলেই এখান থেকে বেরিয়ে যাব। তাতে কারোর আপত্তি হলো না। অশ্বিনী বাবার আশ্রমে জনা দশেক লোক থাকে। তারা ভোগ আর রান্না ছাড়া পরিষ্কার করে রাখার কাজ করে। একটা ট্রাস্ট আছে দেখলাম তার অনেক মেম্বার।
একজন গেরুয়াধারী সুঠাম দীর্ঘকায় ব্যক্তি এসে প্রনাম জানালো। পুরো মুখ জুড়ে কালো একটা চশমা।সেই নাক সেইই মুখ অবিকল।১৮ বছর আগেএর একটা সাদা কালো ছবি। মনের কনে দপ করে ভেসে নিভেগেলো ছবিটা। শান্ত নির্লিপ্ত একজন সন্যাসী। "সুনলাম এখানে থাকতে চান। এখানে আপনাদের কোনো অসুবিধা হবে না। তবে এখানে আপনারা দামী হোটেলের সুখ পাবেন না।এখানে ভোগ হয়। আমরা নিজেরাও সেই ভোগ খাই আর সবাইকে খাওয়াই। মার ঘরে আমরা রোজ সন্ধ্যায় আর সকালে বসি। চা খাবার সাথে সাথে আমরা সুধু গল্প করি। আমার কোনো ধর্ম নেই। আমি কোনো ভগবানের পূজা করি নি।"
কিছুক্ষণের জন্য তাকিয়ে রইলাম। নিজেকে এই লোকটির সামনে বেশ ছোট মনে হলো। আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতে এক মহিলা এসে হাজির হলেন। মনটা আলাদা প্রশান্তিতে ভরে গেল। এত সুন্দর হয় কোনো মহিলা।কোনো ভুসন নেই শরীরে , গেরুয়া সাড়ি , আর ব্লাউস।মার্জিত বেশ ভূসা। মুখে অদ্ভূত এক আবেশ। আমি বিভোর হয়ে চেয়ে রইলাম। বয়স ৫০ হবে।কিন্তু তার চোখের চাহনি তে আমার মনের গ্লানি খুরের ধারের মত কেটে যেতে লাগলো একে একে। কি ব্যাখা হয় জীবনের। নতুন কি ব্যাখা খুঁজে পাব অশ্বিনী কুমারের কাছ থেকে। কি ভাবে যে সময় কেটে গেল বুঝতে পারলাম না। ভোগ ভোগের পর বিশ্রাম, আর তার পর অশ্বিনী কুমার আমাদের নিয়ে গেলেন আবার মায়ের ঘরে। মন চাইল অশ্বিনী কুমারের ঘরটা দেখি। বললাম "আচ্ছা আমি কি আপনার ঘর দেখতে পারি , মনে সাধ জেগেছে।" নিস্পাপ শিশুর মত অস্ফুটে বেরিয়ে আসলো সব্দ গুচ্ছ নিয়ত্রনের কোনো বাধায় মানলো না।অশ্বিনী বাবা স্মিত হাস্যে বললেন এতে আবার এত দ্বিধা কেন ? একজন একটা চাবি হাতে দিয়ে গেল। সেই চাবি হাতে নিয়ে আমায় নিয়ে আসলেন তারই ঘরের সামনে। অন্য কোয়ার্টার এর থেকে ইটা আলাদা ছিল না। ঘরে ঢুকেই প্রচন্ড আত্ম গরিমার আত্মূভিমানের ধাক্কা খেলাম। উঠে দাঁড়াবার সমর্থ ছিল না। একটা বিছানা আর কিছু বই ছাড়া ঘরে কিছুই নেই। আর ঘরের কনে সযত্নে সাজানো একটা পুরনো সেলাই মেসিন , ঢাকা দিয়ে রাখা।
মনের কান্না বড় কান্না। সহজে থামতে চায় না। কেমন যেন মন্ত্রের মত ঘুরে বেড়াচ্ছি। এক প্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্ত . যদি এমন একটা জায়গা পেতাম। মায়ের হল ঘরে বসে বুঝতে চেষ্টা করলাম অশ্বিনী বাবাকে। কি তার জীবন দর্শন। কে সে। কি তার পরিচয়। সত্যি কি সে ত্যাগী।কে এই মা। চায়ের গরম কাপে চুমুক দিতে দিতে পুতুল বাবার পায়ে গড়িয়ে পড়ল। মিতুল কে মা ভালো বেশে ফেলেছেন। মিতুল এমন আন্তরিক হয়ে মাকে জর্য়ে রেখেছে যে আপন হওয়া ছাড়া আমার আর রাস্তা ছিল না। বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম আচ্ছা আপনাকে এখানে যে এত ভালো বসে লোকে কেন? অশ্বিনী বাবা জবাব দিলেন না। মা জবাব দিলেন " এত ভালবাসা নয়। এত বন্ধুত্ব। বিপদে মানুষ মানুষকে ই বন্ধু ভেবে কাছে পায়। এত মানুষ কত নিরুপায় নিসহায় , আপনি তাদের পাশে দাঁড়ান, তাদের দুঃখকে আপন করে নিন তারাও আপনাকে বন্ধু ভেবে নেবে। তখন অশ্বিনী আর আপনার তো কোনো তফাত থাকবে না। " বেপরওয়া কোন ঠাসা আমার অহংকার প্রশ্ন করলো "যদি আপনারা এতই নিস্পাপ হন তাহলে আপনাকে মা বলে আর অশ্বিনী বাবা কে বাবা বলে কেন।আপনারা কি স্বামী স্ত্রী ? "
অশ্বিনী এর মুখে এতটুকু ভাবান্তর হলো না। আমার বুকের ভিতর কোনো এক পাপী আমায় চাবুক মার্চে অবিরত। অন্ধ সয়তানের মুখোশ টেনে ছিড়ে ফেলতে হবে। " স্বামী স্ত্রী কি পরিচয়ে বাঁচে ? মা প্রশ্ন করলেন?" আমায় বকর মত উত্তর দিলাম"সমাজের পরিচয়ে " আমি যে কত হীন তা বুঝতে নিজের বাকি রইলো না। মা বললেন দেখুন "স্বামী স্ত্রী বাঁচে ভালবাসার পরিচয়ে , যে ভালবাসা নির্ভেজাল। যেখানে কোনো উচ নিচের সীমানা নেই, সমাজের কোনো ব্যাখ্যা খাতে না এই ভালবাসায়, ভালো মন্দের কোনো তফাত থাকে না , এ ভালবাসা সবার উপরে , আর মানুষ হয়েই মানুষ কে ভালো বসতে হয়। সমাজ তা কে পরম পবিত্র মর্যাদা দেয়। যে মানুষটার আত্মার সাথে আমি মিশে রয়েছি , যে মানুষটা কে আমার অতীত বর্তমান ভবিস্বত সপে দিয়েছি তার কাছে স্ত্রী মর্যাদা চেয়ে হীন হব?" আমার মুখ থেকে কথা সরল না। কৌতুহল আমাকে তারা করে বেড়াল নির্মম অমানুষ হয়ে। আচ্ছা আপনি চশমা পরে থাকেন কেন? অশ্বিনী বাবা কে প্রশ্ন করলাম সরা সরি।
বেশ খানিক খন নিরব থাকার পর উত্তর দিলেন। আপনার পেশা এমন যে আপনি এ প্রশ্ন না করে পারবেন না তাতে আমি দোষ দেখি না।আসলে কি জানেন " আমরা মানুষ চেনবার চেষ্টা করি মানুষের চোখ দিয়ে। ভেবে দেখুন যদি আমাদের কারোর চোখ না থাকত। কি ভাবে চিনতাম আমরা মানুষ। স্পর্শ করে কথা সুনে।কত টুকু বুঝতাম সামনের মানুষ টাকে। চোখ তো ভুল দেখায়। অন্তর দিয়ে মানুষ দেখুন আরো ভালো করে মানুষ তাকে স্পর্শ করতে পারবেন।চোখের দরকার হবে না।"কালো চশমা খুলে ফেলে বললেন " আমার চোখে দেখে আপনার কি মনে হয় ?" সেই চোখ অবিকল সে চোখ। মোহিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম সেই চোখে। মৃত্যু কে হারিয়ে আসা এমন কঠিন চোখ আমি আগে দেখিনি।সাগরের মত প্রশান্ত , উত্তেজনা নেই, নেই কোনো পাপ , মৃত্যুপুরী থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা উজ্জ্বল ধ্রুবতারার মত প্রজ্বল্যমান দ্যুতি। আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে ফিরিয়ে আনতে পারলাম না আলোক আর রুবি কে। কে বলে বাল্মিকি নেই। আমাদের মধ্যে আমাদের দৈনন্দিনে এমন অনেক বাল্মিকি নিসারে নিজেদের রামায়ন রচনা করে।আমরা উপলব্ধি করা সুযোগ টুকু পাই না।
আমার শরীরের শক্তি টুকু নিগড়ে নিচ্ছে এই অশ্বিনী। আমাকে জিততেই হবে। মা বড়। হ্যান মা এর কাছে হার মানতে হবে অশ্বিনী নামের আলোক কে। জিজ্ঞাসা করলাম আচ্ছা আপনি মায়ের নাম যে এই সভা ঘর বানিয়েছেন মা কি মা কে? মাই কি আপনার সব ? কিছু বলুন। অশ্বিনী বাবা হেঁসে বললেন "ইটা না হয় তোমাদের মা বলুক।" রুবি খিল খিল করে হেঁসে উঠলো। সেই সুন্দর রূপের ছটা, কি অদ্ভূত এদের ভালো বাসা . নিরন্তর ফল্গু নদীর মত বয়ে চলেছে। একে অপরের মধ্যে নাই বা মিশলো।"পুতুল বিরক্ত হয়ে বলল "তোমার না সবটাতে বাড়া বাড়ি। বাবা আপনি কিচু মনে করবেন না ও DIG তো জেরা না করে ওর পোষায় না।
রুবি কিছু জবাব দিল না। ভাবান্তর না করেই বলল তাতে কি . উনি যেই হন আমি তো আমার রাস্তা থেকে সরে আসতে পারব না মা।দেখুন সুশান্ত বাবু " মা হলেন একাধারে জন্মদাত্রী, আবার পালন কারিনী , সেবাময়ী , বন্ধু আবার আমনার জীবন দর্শন।মা সুধু আপনার শরীরের রক্ত মাংশের সৃষ্টি কারিনী নন উনি আপনাকে রূপ দিয়েছেন। ওনার জঠরে বড় হতে হতে অনার মনের রূপের ছটায় আপনি রূপ পেয়েছেন। তার সাথে আপনার সম্পর্ক জন্ম জন্মান্তের। স্ত্রীর উপরে মা, আর মা তিনি যিনি আপনার জীবন হরণ করতে পারেন।আশ্চর্যের বিষয় কি জানেন আপনার কাম শক্তির প্রেপনাও আসে মায়ের থেকে। তার জীবনের প্রতিরূপ আপনি। তার আশা আকাঙ্খার এক মেল বন্ধন আপনি। তার সপ্ন তার ভবিস্বত আপনি। আর দয়া তার করুনা আপনি। তার জীবনের দর্শন আপনি তপস্যাও আপনি আর সমর্পন আপনি। আপনি তাকে দেবী জ্ঞানে পূজা করেন আর আপনি তাকে স্ত্রী রূপে ভালবাসেন।আপনি তাকে কন্যা দান করেন আরাপনি তাকে ভোগ করেন। সেই মা সে সক্তি সেই জননী। সেই আপনার মনের মূলাধার আপনার জীবনী সক্তি। সেই আপনার ভালো , সেই আপনার আলো সেই আপনার আশির্বাদ।"
বাক্ বিহবল হয়ে পরলাম। পুতুল আমার দিকেতাকিয়ে নিজের চোখ মুচল। মিতুলের মন উদাস হয়ে গেছে। রুবির কলে মাথা রেখে সুয়ে আছে। রুবি মিতুলের মাথায় বিলি কেটে দিছে। এমন অন্তরঙ্গ ভালবাসা আমি দেখিনি। অশ্বিনী বাবাকে প্রনাম করতে ইচ্ছা হলো না। কিন্তু স্যালুট করতে ইচ্ছে হলো ৫০ কোটি টাকায় বেছে নেওয়া এমন জীবন স্পৃহা কে। কতোটা পথ চলতে তবে পথিক হওয়া যায়। প্রতিটা সময়ের স্তব্ধতা আমায় ম্লান করে দিল। হয়ত জীবনের মূল স্রোত থেকে ছিটকে আসা দুটো কপোত কপতি অচেনা পৃথিবী কেই আপন করে নিয়েছে। এর থেকে বড় জয় আজ মানুষ পেতে পারে না। যেখানে আইন কেও মাথা নামিয়ে সরে যেতে হয় প্রাপ্য সন্মান জানাবার ভাষায়। দুটো দিন্পেরিয়ে গেল। কোনো কিছু ই আর গোপন নেই।শেষ রাতে ভোগের পর হাসি ঠাট্টা চলতে লাগলো . কেমন ভাবে অবিনী বাবা আর মা কে আপন করে ফেলেছি সে ব্যাখা দিতে পারি নি নিজের মন কে। এই আশ্রমে করে ফিরব তাও অজানা কিন্তু লোভ হয় এমন দুটো মানুষ কে নিজের করে বন্দী করে রাখতে। এরা যে দুষ্প্রাপ, এদের কে কি কেউ কয়েদ করে রাখতে পারে।
রাতে অশ্বিনী বাবা ডাকলেন আমায়। সিগারেট আমি খাই না কিন্তু আশ্রমের বাইরে দাঁড়িয়েই একটা সিগেরেট খেতে মন চাইছিল। কিছুটা দুরে গ্রামের পাহাড়ের কল বেয়ে একটা মুদি খানা . সেখানে কম দামী সিগেরেট রাখে।তারই একটা ধরিয়ে টানতে টানতে গগন বিদারী পর্বত কুল কে দেখতে দেখতে আরষ্ট হয়ে পরলাম। কি বিশাল কি বিরাট অহংকার হীন দাড়িয়ে আছে অক্লান্ত। মানুষের হাজার সভ্যতার সোপান দেখেও মানুষ কে কাছে টেনে নিতে পিচ পা হয় না। অশ্বিনী বাবার কোয়ার্টার এ যেতেই আমায় সাগ্রহে বসতে বললেন। মা আসলেন অন্য ঘর থেকে। রাত ১০ তা হবে নিঝ্হুম। বাবা শান্ত স্বরে বলে উঠলেন " নিয়ে যেতে এসেছেন ? কোনো দিধা নেই।আমার অতীত আমাকে ক্ষমা করবে না , আর ও প্রস্তুত।" মা অশ্বিনী বাবার গায়ে একটা শাল চাপিয়ে দিলেন। এমন অনারম্বর সমর্পনে নিজেকে আরো হীন মনে হলো। যে মানুষটাকে কেউ ১৮ বছর ধরে খুঁজে পায় নি তাকে এভাবে পেয়ে এত দিন পর আমার গর্ব কম ছিল না।হয়ত প্রমোশন তা পাকা হয়ে যেত। মিতুলের ভবিস্বত অনেক অনেক বেশি উজ্বল হয়ে উঠত। কিন্তু পারতাম কি মিতুল কে এমন শিক্ষা দিতে। যারা জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের জীবনের গতি বদলে দেয়, মানুষ কে মানুষ বলে ভালবাসতে সেখায় যারা , দুখ সুখের বাইরে বরিয়ে এসে আলাদা পৃথিবী গড়ে তুলতে পারে তাদের যোগ্য স্থান দেবার অধিকারী আমার ছিল না। মুখ নিচু করে বেরিয়ে আসলাম বাবার ঘর থেকে।
অন্ধকার থাকতে থাকতেই আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।দেহরাদূন থেকে ট্রেন ধরব। অনেকটা পথ। দিনেশ্ বাবা কে ভক্তি ভরে প্রনাম করে আমাদের লাগেজ গাড়িতে তুলতে লাগলো। মিতুল মামনি বলে রুবি কে জড়িয়ে ধরল। রুবির চোখে জল থেকে আশ্চর্য হয়ে গেলআম . ঘন বেদনার বাস্প আমার বুক চিরে গলা টাকে চেপে ধরল। পুতুল বাবা কে প্রনাম করলো। দেখলাম আলোক আমার দিকে তাকিয়ে নিস্পলক। শান্ত , জীবনের কঠিন থেকে কঠিনতম লড়াই কে পাঠ্যে বীরের মত এগিয়ে চলেছে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে। সেটাই আমাদের শেষ গন্তব্য।ভয়হীন এমন চরিত্র কে শ্রধ্যা করতে কুন্ঠা হলো না। আশ্রম পেরিয়ে মন্দাকিনীর কাচা কচি আসতেই শান্ত স্নিগ্ধ বাতাস ঝাপটা মারতে লাগলো মুখে। অনেক খন আগলে রাখা অন্ধ সয়তানের ফাইলটা কোল ভার করে বসে ছিল।পুতুল আমার কাধে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলো "আর কি এটার দরকার আছে?" আমি ওদের দিকে না তাকিয়ে ফাইল হাতে নিয়ে গাড়ির জানলা থেকে ছুড়ে দিলাম মন্দাকিনীর জলরাশির গভীর খাদে। দিনেশ জিজ্ঞাসা করলো " কি হলো স্যার?" আমি বললাম কিছু না "জঞ্জাল "
ঘন কুয়াশা মাখা রাস্তায় গাড়ির আলোর সাথে খেলতে খেলতে হারিয়ে গেলাম এক অনজন পৃথিবীতে। হয় আবার সুযোগ আসবে। হয়ত আবার কৌসানি তে ফিরে আসবো। হয়ত অন্ধ সয়তানের পাপের রাজ্যে এমনঅনেক পদ্মফুল ফুটবে। রুবি মুখটা মনে পরে গেল। যদি এই গ্রামেরই একটা ঘরের মালিক হতাম আমি। যদি পৃথিবীর ধুলো মাখা সহুরে বিষাক্ত হওয়া থেকে স্বাদিহতা পেতাম মুক্তির।ব্যাঙ্কের জমানো টাকার দিকে না তাকিয়ে মনের রাজা হতে পারতাম আলোকের মত।হালকা নিশ্বাস হয়ত ছুয়ে ফেল পুতুলের মনের অন্তসত্বায়। আমার কাঁধে মাথা রেখে পুর্তুল আমার বা হাথ তা জড়িয়ে চোখ বুজিয়ে দিল।
সমাপ্ত