Thread Rating:
  • 16 Vote(s) - 3.31 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
ভৌতিক গল্প সংকলন (সমাপ্ত)
#11
[Image: FB-IMG-1691298029850.jpg]

|| ফাঁদ ||

কলমে :- সোমনাথ চক্রবর্তী
পোস্টার :- সম্পিতা চক্রবর্তী

জ্যৈষ্ঠ মাসের দুপুর, বেলা প্রায় সাড়ে বারোটা। বাসের জানলার ধারে বসে  ঘুমটা প্রায় এসেই গেছিল শম্ভুবাবুর। যদিও এ ঘুম আরামের ঘুম নয়। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে শম্ভুবাবুর। শম্ভুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারি স্বাস্থ্য দপ্তরের একজন মধ্য স্তরের কর্মী। তার কাজ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রত্যন্ত গ্রাম গুলিতে গিয়ে সেখানকার অধিবাসিদের স্বাস্থ্যের খোঁজ খবর নেওয়া , কোন বাড়িতে যদি কারুর জ্বর হয় তাহলে তাদের পরামর্শ দেওয়া নিকটবর্তী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে ডাক্তার দেখানোর , পরিদর্শন করা এলাকায় কোথাও জমা জল আছে কিনা , প্রয়োজন মত ওষুধ পত্র সরবারহ করা স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে  , গ্রামবাসীরা যাতে খোলা জায়গায় শৌচকর্ম না করে সে ব্যাপারে গ্রাম্ বাসীদের অবগত করা ইত্যাদি । সবশেষে কোলকাতা অফিসে গিয়ে রিপোর্ট করা তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ।  তবে এই ধরনের কাজের জন্য বন্ধু মহলে তাকে নিয়ে যে বেশ কিছুটা রঙ্গ রসিকতা চলে তা শম্ভুবাবু বেশ বোঝেন। এই তো সেদিন শম্ভু বাবু তার কাঁধের ঝলা ব্যাগ টা নিয়ে সবে বের হয়েছেন অফিস যাবেন বলে । তখনই ছোটবেলার বন্ধু ভোলা বলে উঠল
-“ব্যাগ তো বেশ ভারি মনে হচ্ছে রে , তা আজ আবার কোন গ্রামে? মাঝে মাঝেই কি আর এত হাঁটা হাঁটি পোষায় , বয়েস হচ্ছে তো নাকি ? তুই বরং একটা কাজ করনা কেন! কোন একটা গ্রমে পার্মানেন্ট ভাবে একটা ডাক্তার খানা খুলে বসে পড় আর ওষুধ বলে নকুল দানার গুড়ো চালিয়ে যা । দু দিনে ধ্ননন্তরি । শম্ভুবাবু একটা কাষ্ঠ হাসি হেসে হাঁটা লাগান। আর একদিন হরেন বলে ওঠে
- “ তা হ্যাঁরে সব লোকজন শৌচালয় ব্যবহার করছে তো? আচ্ছা তুই কি গ্রামে গিয়ে ঝোপে ঝাড়ে ওঁত পেতে বসে থাকিস ! যেই কেউ গাড়ু হাতে ঝোপে বসবে সঙ্গে সঙ্গে হারে রে রে  করে তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে শৌচালয়ে চালান করবি? অ্যাঁ ” ।
শম্ভু বাবু যথারীতি একটা কাষ্ঠ হাসি হেসে নির্বিকার ভাবে পাস কাটিয়ে চলে গেলেন । এসব টিটকিরি এখন তার গা সওয়া হয়ে গিয়েছে । শম্ভুবাবু জানেন , ওরা এসব করে তার প্রতি কিছুটা হিংসা থেকে , হাজার হলেও শম্ভুবাবু একজন সরকারী চাকুরে । তবে এই সব ব্যাপার স্যাপার দেখে এবং শুনে শম্ভুবাবু বেশ মজা পান ।  নিজের কাজ টাকে শম্ভুবাবু সত্যিই বড়ই ভালোবাসেন । এইসব প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ গুলি সত্যিই বড়ই দরিদ্র। অথচ এত দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করেও তাদের মুখের হাসিটি অবিচল । অত্যন্ত অল্প জিনিষ পেয়েও যে খুশী থাকা সম্ভব তা এদের না দেখলে বিশ্বাস করা কোঠিন । এদের সাথে মিশে শম্ভুবাবু এক অদ্ভুত আনন্দ লাভ করেন। তার মন তৃপ্ত হয়ে ওঠে যখন এই মানুষ গুলি তাকে – “ডাক্তার বাবু” বলে সম্বোধন করেন । শম্ভুবাবু বেশ কয়েকবার ওদের এই ভুল শোধরানোর চেষ্টা করেছেন যে তিনি ডাক্তার নন । কিন্তু কোন ফল হয়নি । কেন যে তাকে ওরা “ডাক্তার বাবু“ বলে ডাকে সেই ব্যাপারটা শম্ভুবাবুর কাছে এখনো ঠিক পরিস্কার নয়।
আজ শম্ভুবাবুর গন্তব্য হুগলী জেলায় মারোখানা নামের একটি গ্রাম , তার দায়িত্ব পড়েছে সেখানকার হেলথ সেন্টারটিতে অবসার্ভার হিসাবে যাওয়ার এবং তার পার্শ্ববর্তী দুটি গ্রামে সার্ভে করার যে গ্রামগুলির সার্বিক স্বাস্থ্য কিরকম। শম্ভুবাবুর ঘুমের চটকটা ভাঙ্গল বাস কনডাক্তারের ডাকে
-“ ও দাদা মারোখানা পিএইচসি যেতে হলে পরের স্টপে নামতে হবে। ”
সজাগ হয়ে ওঠেন শম্ভুবাবু । সোজা হয়ে বসেন সিটে । চলন্ত বাসের জানলা দিয়ে বাইরে তাকান । সূর্যের প্রখর তাপ যেন ঝলসে দিচ্ছে চারদিক। বাসের জানলা দিয়ে যতদূর দেখা যায় , শুধু খোলা প্রান্তর ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। বাসটা চাকায় একটা ঘড় ঘড় আওয়াজ তুলে রাস্তার উত্তপ্ত ধুলো উড়িয়ে এগিয়ে চলেছে। শম্ভুবাবু পকেট থেকে রুমাল বের করে নাকে চাপা দিলেন ধুলো থেকে বাঁচার জন্য। ঠিক তখনই বাসটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল , কন্ডাক্টরের গলায় বিশেষ রকম স্বরে একটা ডাক ভেসে এল
– “ এই মারোখানা পিএইচসি ... মারোখানা পিএইচসি ... মারোখানা পিএইচসি।”
শম্ভুবাবু এবার প্রস্তুত হন বাস থেকে নামার জন্য। কাঁধের ঝোলা ব্যাগটা নামিয়ে আনেন বাসের সিটের উপরে অবস্থিত বাঙ্কের থেকে। বাসের গেটের দিকে এগিয়ে যান শম্ভুবাবু। তিনি খেয়াল করেন এই স্টপে নামার আর কোন যাত্রী নেই, একমাত্র তিনিই সিট ছেড়ে উঠেছেন নামার জন্য।কন্ডাক্টরকে জিজ্ঞেস করেন
-“ভাই মারোখানা পিএইচসির অফিস কোন দিকে হবে?” অভ্যস্ত কন্ঠে কন্ডাক্টর জবাব দেয়
-“ নেমে সোজা গিয়ে বা হাতে পড়বে”।  বলে আবার নিজের কাজে মননিবেশ করে।
বাস থেকে নেমে শম্ভুবাবু বেশ বুঝতে পারেন যে এরকম সাঙ্ঘাতিক দুপুর মনেহয় তিনি অনেকদিন দেখেননি। রাস্তা থেকে যেন আগুনের হল্কা বেরুচ্ছে। নিঃশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে প্রবেশ করছে উত্তপ্ত বাতাস। রাস্তার এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত পর্যন্ত একটি মানুষেরও দেখা নেই। শম্ভুবাবু ব্যাগ থেকে জলের বোতলটি বের করে প্রায় আধ বোতল জল নির্দ্বিধায় ঢেলে দিলেন গলায়। শরীরটা জুড়িয়ে এল যেন খানিকটা। ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে মেলে ধলেন মাথার উপরে। শম্ভুবাবুকে নামিয়ে দিয়ে বাসটি বেশ খানিকটা ধুলোর রাশি বাতাসে মিশিয়ে দিয়ে ডান দিকে মোড় নিয়ে চলে গেল নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। শম্ভুবাবুর মনে হতে থাকে তার আজকের অভিযান ছোটবেলাতে গল্পের বইয়ে পড়া বিভিন্ন এডভেঞ্চার কাহিনীর চাইতে কোন অংশে কম রোমাঞ্চকর নয়। একে মাথার উপর উত্তপ্ত রবিকিরন , তার উপর অচেনা জায়গা , তার উপর অচেনা গন্তব্যস্থল। আরও ভালো ব্যাপার রাস্তায় একটা জমনিষ্যির দেখা নেই যে কাউকে প্রাইমারি হেলথ সেন্টার এর দিক নির্দেশ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা যাবে। রাস্তার দুদিকে বিস্তৃত ধানক্ষেত , বাতাসের দোলায় সামান্য ধেউ খেলছে ধানগাছ গুলিতে। কিছুদুরে ছোট্ট পুকুরে খেলে বেড়াচ্ছে কতগুলি হাঁস। শম্ভুবাবু দুবার “দুর্গা” বলে হাঁটা লাগালেন। কন্ডাক্টর বলেছিল মারোখানা পিএইচসি সেজা গিয়ে বাঁ দিকে । বাসটি তাকে যেখানে নামাল তার একদম সোজা সোজি যে কাঁচা রাস্তাটা চলেগেছে   সেইদিক বরাবর হাঁটতে থাকেন। তার জুতোর আঘাতে রাস্তায় উত্তপ্ত ধুলার রাশি উড়তে থাকে পাক খেয়ে । একটি দৃশ্য দেখে শম্ভুবাবুর গরম বোধটা আরও বেড়ে গিয়ে তার মনে হতে থাকল যেন তিনি চারদিকের জ্বলন্ত মশালের মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলেছেন। তিনি দেখলেন দূরে কিছুটা ফাঁকা জায়গা রয়েছে তার মাঝে দাড়িয়ে আছে কি একটা গাছ । সেই গাছটার স্বল্পমাত্র ছায়াটুকুতে বসে আছে একটি কুকুর। সেই মুহূর্তে শম্ভুবাবুর মনে হল ওই কুকুরটিও তার চাইতে বেশি ভাগ্যবান, অন্তত এই প্রখর সূর্য কিরণে কুকুরটিকে অজ্ঞাত কোন গন্তব্যের দিকে পদচালনা করতে হচ্ছেনা। প্রায় মিনিট কুড়ি হাঁটার পর শম্ভুবাবু প্রায় আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন । কিছুদুরে একটা সাইন বোর্ড দেখা যাচ্ছে , তাতে বাঁ দিকে দিক নির্দেশ করে একটা তীর চিহ্ন , সেই চিহ্নের নিচে বেশ বড় অক্ষরে লেখা আছে “মারোখানা প্রাইমারি হেলথ সেন্টার” । অর্থাৎ তার গন্তব্য থেকে তিনি অল্পই দূরে। একটি নিচু একতলা টালির চালের বাড়িতে গড়ে উঠেছে এই হেলথ সেন্টারটি । সামনে খানিকটা খোলা জায়গা , সেখানে কিছু ফুল গাছ লাগান হয়েছে , যদিও যত্নের অভাবে সেগুলির অবস্থা খুব ভাল নয় । দুদিকের খোলা জায়গার মাঝখান দিয়ে মোরাম বিছানো রাস্তা পেরিয়ে হেলথ সেন্টারের বারান্দায় উঠলেন শম্ভুবাবু । দরজা খোলাই ছিল , ভিতরে একজন মধ্য বয়সী মানুষ কাজ করছেন চেয়ারে বসে, তার মাথাটা ঝুঁকে আছে সামনের টেবিলটার উপরে। একবার দরজায় টোকা দিলেন শম্ভুবাবু , চেয়ারে বসা ভদ্রলোক মাথা না তুলেই - “ আসুন” বলতে শম্ভুবাবু ভিতরে প্রবেশ করেন এবং বল্লেন
– “ নমস্কার  আমি শম্ভুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় , কোলকাতা থেকে আসছি” ।
এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান লোকটি। সম্ভ্রমের সুরে বলেন
-“ আরে আসুন আসুন , বসুন মিস্টার ব্যানার্জি ” । চেয়ার টেনে বসেন শম্ভুবাবু , জিজ্ঞেস করেন
–“আপনি ই আনিমেষ দে !” মাথা নেড়ে সম্মতি জানান উল্টোদিকে বসে থাকা ভদ্রলোক। দেখে মনে হয় ভদ্রলোকের বয়স আন্দাজ পয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে হবে। দ্রুত কাজের কথা গুলি সেরে নেন শম্ভুবাবু , দিয়ে দেন কোলকাতা অফিস থেকে আনা বেশ কিছু প্রয়োজনীয় জিনিষ।
দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গেছিল বেশ খানিক্ষন । শম্ভুবাবু এবং অনিমেষ বাবু অফিস ঘরের টেবিলে বসেই দুপুরের খাবার খেতে খেতে কথা বলছিলেন । অনিমেষ দে বল্লেন
-“ আমি কাজে যোগ দেওয়ার পর এই প্রথম একজন  পর্যবেক্ষকের সামনে বসে আছি ।” শম্ভুবাবু জিজ্ঞেস করেন
-“কতদিন হল এখানে জয়েন করেছেন আপনি ? ”
-“এই সাড়ে আট বছর হল।” একটা স্মিত হাসি খেলে যায় শম্ভুবাবুর ঠোটে , তিনি বলেন
-“ ও আপনিও তো প্রায় আমার সঙ্গেই জয়েন করেছেন । কিন্তু একটা ব্যাপার ভারি আশ্চর্য লাগছে । এই সাড়ে আট বছরে আর কোন পর্যবেক্ষক আসেননি কেন এখানে?”  ঠোঁটের কনের স্মিত হাসিটা মিলিয়ে যায় অনিমেষ বাবুর , গম্ভীর কণ্ঠে বলেন
-“হ্যাঁ , এটা একটু আনফরচুনেট । আসলে আজ থেকে প্রায় নয় বছর আগে এই মারোখানা পিএইচসি তে সার্ভে করতে এসে এক অবসার্ভারের সাথে গ্রামবাসীদের সাংঘাতিক বচসা হয় । দুঃখের বিষয় তারপর ওনাকে আর খুজে পাওয়া যায়নি , পাঁচ দিন পর ওনার দেহ পাওয়া যায় রুপনারায়নের চরে। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হল ওনার দেহে কোথাও কোন আঘাতের চিহ্নও পাওয়া যায়নি। তার পর থেকে এখানে আর কোন অবসার্ভার আসেননি । নয় বছর পর আপনি প্রথম । তবে এই ঘটনা আমার শোনা , যখনকার ঘটনা তখন আমি জয়েন করিনি । পুলিশ তদন্ত করেছিল বেশ কিছুদিন,কিন্তু কিছুই হয়নি, মানে কোন কিনারা করা যায়নি এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর । পরে শোনা যায় উনি সুইসাইড করেছিলেন । তবে এ সবই আমার শোনা কথা , আর তখন খবরের কাগজ থেকে যে টুকু জানার জেনেছি ”।এতখানি বলে থামেন অনিমেষ দে । শম্ভুবাবু এতক্ষন কোন কথা বলেননি , চুপ করে শুনছিলেন অনিমেষবাবুর কথা গুলো। আরও খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে শম্ভুবাবু বল্লেন
-“ হ্যাঁ এরকম একটা ঘটনার কথা আমিও শুনেছি । তবে আমিও ওই লোক মুখে , এই চাকরীতে আমিও জয়েন করিনি তখন। সত্যিই খুবই আনফরচুনেট ।” এরপর আর কিছু কথা এগোয়না সেরকম। শম্ভুবাবু উঠে পড়েন , পদচালনা করেন তার পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।
দক্ষিন হস্তের কাজটা সম্পূর্ণ হওয়ার পর এই প্রখর রৌদ্র তাপে হাঁটতে কষ্টটা যেন একটু বেশিই অনুভূত হতে থাকে শম্ভুবাবুর। অনিমেষ দে এর কথা মত এখান থেকে আরও প্রায় আধঘণ্টার হাঁটা পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছতে হবে পাশের গ্রামে। অনিমেষ দে তার সাইকেলটা দিতে চেয়েছিলেন , কিন্তু শম্ভুবাবু আবার সেটা চালানোর বিদ্যেটা রপ্ত করেননি। বেশ খানিকক্ষণ সাইকেল ভ্যানের জন্য অপেক্ষা করে বুঝেছেন সে ভাগ্য তার নেই। এই গরমে কে আর এখন ভ্যান নিয়ে বেরোবে। পরবর্তী ভ্যান আসতে আসতে বাড়ি ফেরার সময় না হয়ে যায়। তাই সময় নষ্ট না করে শম্ভুবাবু হাঁটা লাগালেন তার পরবর্তী গন্ত্যব্যের দিকে।
হাঁটতে হাঁটতে একটু আগে শোনা কথা গুলি বারংবার নাড়া দিয়ে যায় তার অন্তঃকরনে । আজ থেকে নয় বছর আগে তাঁরই মতন একজন অবসার্ভার হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান , তার মতন একই কাজ করতে এসে, একই জায়গা থেকে। তিনিও বেশ কয়েকবার শুনেছেন বটে অফিসে এই ঘটনা টা তবে সে অনেক দিন আগে। কখনো তলিয়ে ভাবেননি , ভাবার প্রয়োজন পড়েনি। কালের নিয়মে সবাই ভুলে গেছে লোকটাকে। কখনো নামটাও জানা হয়নি সেই হতভাগ্য মানুষটির। অবশ্য তার পর থেকে এখানে কাউকে পাঠানো হয়নি ডিউটিতে । অবশ্য কাউকে না পাঠানোর কারন যে ওই ঘটনা টা তার কোন সঠিক প্রমান নেই। আজ নয় বছর পরে তিনি প্রথম। শম্ভুবাবুর কিরকম একটা মমত্ব বোধ জেগে ওঠে এই সম্পূর্ণ অদেখা, অচেনা, পরম অনাত্মীয় মানুষটির প্রতি। তার মনে হয় , আসলে যার মৃত্যু যেখানে , নিয়তি তাকে সেখানেই টেনে নিয়ে আসে। কথাটা মনে হতে এই গরমেও শম্ভুবাবু অনুভব করলেন তার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত যেন ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে। তিনিও তো আজ একই জায়গাতে এসেছেন, একই কাজে । তবে কি আজ তার পালা ? আর একটি ব্যাপারে তার মনে একটা খটকা লেগে আছে , কোনও মানুষকে যদি সুইসাইড করতেই হয়, তাহলে খামোখা এত দূরে এসে করতে যাবে কেন সেই কাজ ! আর গ্রাম বাসীদের সাথে যদি হাতাহাতি হয়ে থাকে , তাহলে বডিতে কোনও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি কেন ! এসব ভাবতে ভাবতে শম্ভুবাবু খেয়াল করেননি যে কখন তিনি চলে এসেছেন রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একটি সুউচ্চ গাছের খুব কাছাকাছি ।
এখনো বেশ অনেকটা পথ বাকি। শম্ভুবাবু গাছটির শীতল ছায়ায় বসলেন খানিকক্ষণ , শরীর মন জুড়িয়ে গেল তার। বোতল থেকে জল খেলেন খানিকটা। কিছু দূরে দেখা যাচ্ছে একটা ডোবা রয়েছে । যদিও গ্রীষ্মের প্রখর তাপে তাতে জল গিয়েছে শুকিয়ে । অনিমেষ বাবুর কথা মত ওই ডোবা টা পার করে , ডান দিকে ঘুরে আরও প্রায় মিনিট কুড়ি হাঁটা পথে পৌছতে হবে পরবর্তী গ্রামে। শম্ভুবাবু দ্বিতীয়বার বোতল থেকে আরও খানিকটা জল গলায় ঢালতে যাবেন , ঠিক তখনই তার চোখে পড়ল দৃশ্যটা । রাস্তাটা বেশ কিছুটা দূরে যেখানে ওই ডোবাটাকে পেরিয়ে চক্রাকারে ডান দিকে বাঁক নিয়েছে তার পাশেই রয়েছে একটি মাঠ । মাঠের একধারে বেশ কিছু সু উচ্চ বৃক্ষ রাজি থাকার ফলে বেশ কিছুটা অংশ ছায়াছন্ন । বিস্তীর্ণ ফাঁকা জমি সবুজ ঘাসে ঢাকা । এই ফাঁকা প্রান্তরের শেষে অনেক দূরে ছোট ছোট খড়ে ছাওয়া যে বাড়ি গুলির অবয়ব দৃষ্টি গোচর হয় , সেটাই গ্রাম , সেটাই শম্ভুবাবুর পরবর্তী গন্তব্য। শুধু দেখে মনে হয় মাঠটির মাঝামাঝি প্রায় পুরো অঞ্চল টাতেই যেন অনেক পাথর জাতীয় কোন জিনিষ রাখা রয়েছে। আশেপাশে কেউ কোথাও নেই । শম্ভুবাবুর মনটা এক অজানা আনন্দে ভরে উঠল এই ভেবে যে ওই মাঠ ধরে আড়াআড়ি ভাবে চলতে থাকলে দুরের ওই গ্রামে তিনি খুব অল্প সময়ে পৌছতে পারবেন । অতখানি ঘুর পথে তাকে আর হেঁটে যেতে হবে না এই প্রখর সূর্যের তাপে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। শম্ভুবাবু উঠে পরলেন, রাস্তাটা পার করে অপর প্রান্তে গিয়ে পিচ ঢালা রাস্তার প্রান্তের ঢালু জমি বেয়ে নেমে পড়লেন ওই বিস্তীর্ণ সবুজ তৃণ ভূমিতে ।
এবার তার  চোখে পড়ল তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন , তার ডান হাতে বেশ কিছুটা দূরে একটা বাড়ির ধ্বংসাবশেষ । না বাড়ি বললে ভুল হবে , ওটা কোন বসত বাড়ি নয় । দেখে বোঝা যায় ওটা একটা পরিত্যক্ত কারখানা। ওই যে তার চিমনিটা দেখা যাচ্ছে , যেন আকাশে গিয়ে ঠেকেছে প্রায়। মাঠটার এই দিকে বেশ কিছু সু উচ্চ বৃক্ষ সারি দিয়ে থাকার ফলে বড় রাস্তা থেকে ঠিক দৃষ্টি গোচর হয়না ওই পরিত্যক্ত কারখানার ধ্বংসাবশেষ । আর একটু ভাল করে চেয়ে দেখার চেষ্টা করলেন শম্ভুবাবু । শুধুমাত্র চিমনিটাই পুরনাঙ্গ রুপে মাথা তুলে দাড়িয়ে আছে । বাকি সবই প্রায় পরিনত হয়েছে ধ্বংসস্তুপে । শম্ভুবাবু ভাবলেন একটা সময়ে হয়ত এই অঞ্চলের মানুজন কাজ করত এখানে । সারাদিন গমগম করত পুরো চত্বরটা। মুখরিত হয়ে থাকত মানুষের কোলাহলে । আর আজ শুধু পড়ে আছে তার কঙ্কালসার দেহটা। আজ আর প্রহরে প্রহরে সাইরেন বাজে না । আজ আর ওই চিমনি দিয়ে কালো ধোঁয়া পাক খেয়ে উপরে উঠে জানান দেয় না তার গৌরবময় অস্তিত্বের । শম্ভুবাবুর মনে পড়ে যায় তার নিজের ছোটবেলার কথা , তার বাবার কথা। তার বাবাও এরকমই কোন কারখানায় কাজ করতেন । সেটি হঠাৎ বন্ধ হওয়ার পর শম্ভুবাবু দখেছিলেন তার সদা কর্মব্যস্ত বাবাকে কেমন গুটিয়ে যেতে। আর দেখেছিলেন কারখানা বন্ধ হওয়ার পর তার বাবাকে আরও কঠোর পরিশ্রম করতে। আরও দেখেছিলেন, দেখেছিলেন চোখের সামনে তার বাবার সুঠাম স্বাস্থ্য ওই কঠোর পরিশ্রমের ফলে ধীরে ধীরে ভেঙ্গে গিয়ে একটা কঙ্কালসার মানুষে পরিনত হতে। একটা দীর্ঘস্বাস ফেলেন শম্ভুবাবু , সে সময় কত পরিবার যে নষ্ট হয়ে গিয়েছে বিভিন্ন কল কারখানা বন্ধের কারনে , সে হিসাব কে আর রেখেছে। এইসব ভাবতে ভাবতেই সেই বিস্তীর্ণ উন্মুক্ত প্রান্তরের মাঝখান দিয়ে হাটছিলেন শম্ভুবাবু । একটা ব্যাপার বেশ আশ্চর্য করে তুলেছিল তাকে , এই গরমেও ওই পরিত্যক্ত কারখানার দিক থেকে মাঝে মাঝেই একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা এসে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল ছিল তার মুখে। জুড়িয়ে দিচ্ছিল শম্ভুবাবুর সারা শরীর।
প্রায় হঠাৎই শম্ভুবাবু খেয়াল করেন যে তিনি এসে পরেছেন প্রান্তরের মাঝের সেই জায়গাটিতে যে জায়গাটিকে দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে পাথর ফেলা রয়েছে । কিন্তু সামনে এসে বুঝলেন সেটি পাথর নয় , ছাই এর স্তুপ । এবং কিছু নোংরা আবর্জনা ফেলা রয়েছে ওখানে। শম্ভুবাবু বুঝতে পারলেন ওনাকে ওই ছাইয়ের স্তূপের উপর দিয়েই এই প্রান্তর অতিক্রম করতে হবে , কারন মাঝে পুরোটাই ওই ছাই এর স্তূপ ছড়িয়ে রয়েছে। শম্ভুবাবু তার প্যান্ট গুটিয়ে নিলেন খানিকটা এবং হাঁটতে শুরু করলেন ওই ছাইয়ের স্তূপের উপর দিয়ে। শুধুমাত্র পায়ের তলায় ছাইয়ের উপরে পা ফেলে হাঁটার খস খস শব্দ ছাড়া আর কোথাও কোন শব্দ নেই । বেশ কিছুদুরে চলে এসেছেন শম্ভুবাবু । এই পর্যন্ত এসে  শম্ভুবাবুর মনে হল পায়ের নিচে ছাইয়ের স্তূপ যেন ধীরে ধীরে নরম হতে শুরু করেছে । ঠিক যেন তার পা প্রবেশ করতে চাইছে সেই নরম ছাইয়ের স্তূপের গভীরে । এ আবার কি মুশকিল রে বাবা , আশে পাশে কোন শক্ত জিনিষও নেই যে শম্ভুবাবু সেটা ধরে এগোবেন । কিছুক্ষন এক জায়গাতে দাঁড়ালেন শম্ভুবাবু , উনি বুঝতে পারছেন তার পা দুটো ক্রমেই প্রবেশ করতে চাইছে ওই নরম স্তূপের গভীরে। কনরকমে ডান পা তুলে আরও এক পা এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন সঙ্গে সঙ্গে তার ডান পা প্রায় হাঁটু পর্যন্ত নরম ছাইয়ের স্তুপে ডুবে গেল । এবার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল তার , তিনি বুঝতে পারছেন এই মুহূর্তে তিনি সাংঘাতিক বিপদ গ্রস্ত। তার যে ঠিক কি করা উচিৎ তা তিনি বুঝতে পারছেন না। ডান পা টা তুলে নিয়ে পিছতে যাবেন এমন সময় পিছন থেকে একজন মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন শম্ভুবাবু
-“ ও দাদা , পিছনে আসবেন না । আপনার বাঁ দিকে ঠিক দুই পা মেপে সরে যান”।
আগন্তুক কে দেখার কোন উপায় এই মুহূর্তে শম্ভুবাবুর নেই। কারন কথা গুলো এসেছে তার পিছন থেকে।  আর পিছনে ঘুরে তাকানো এই মুহূর্তে সম্ভব নয় শম্ভুবাবুর পক্ষে।ততক্ষনে শম্ভুবাবুর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে ।  তার পিছন থেকে ভেসে আসা পরামর্শটা শম্ভুবাবুর কাছে তখন যেন একটা আশীর্বাদের মত মনে হল। আগন্তুকের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করলেন শম্ভুবাবু , খুব সাবধানে এবং অতি কষ্টে বাঁ পায়ের উপরে শরীরের ভর রেখে কোন ক্রমে ডান পা টেনে তুল্লেন ওই নরম পাঁকের মত ছাইয়ের গাদা থেকে ।  দুই পা বাঁ দিকে সরে দাঁড়ালেন। এবং বুঝতে পারলেন বাঁ দিকে দুই পা সরে দাঁড়িয়ে পায়ের তলার অংশে যে ছাইয়ের স্তূপ রয়েছে , তা অতটা নরম নয় । আবার আগন্তুকের কণ্ঠস্বর ভেসে এল
-“হ্যাঁ , এবার পিছনে ঠিক এক পা”।
আবার অক্ষরে অক্ষরে নির্দেশ পালন করলেন শম্ভুবাবু।এবারও তার পা ওই নরম ছাই এর গাদায় ডুবে গেলনা। আবার নির্দেশ
-“ এবার আপনার পিছনে কনাকুনি দুইপা ”
আরও প্রায় তিন বারের নির্দেশ সঠিক ভাবে পালন করার পর এবার শম্ভু বাবু বুঝতে পারলেন যে তিনি ওই ঘাসে ঢাকা জমিতে অবতরন করেছেন । একটা স্বস্তির নিঃশাস ফেলে শম্ভুবাবু এবার পিছনে তাকালেন। তার চোখ পড়ল আগন্তুকের দিকে। বেঁটে খাট চেহারার একজন ভদ্রলোক। বয়েস আন্দাজ পঞ্চাশ, মাথার চুল কোঁকড়ানো , চোখে পুরু ফ্রেমের চশমা , ঠোঁটের উপরে একটি পুরু গোঁফ রয়েছে। যেটা চোখে পড়ার মত, টা হল ভদ্রলোকের বাঁ ভুরুর উপরে বেশ লম্বা একটা কাঁটা দাগ রয়েছে। ভদ্রলোক শম্ভুবাবুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছেন। শম্ভুবাবু করজোরে বলতে গেলেন
-“আপনাকে যে কি বলে... ” কথা শেষ করতে পারলেন না শম্ভুবাবু । আগন্তুক বলে উঠলেন
-“না না ধন্যবাদ দেওয়ার কোনই প্রয়োজন নেই । এটুকু যদি না করি তাহলে আর কি। দেখে তো কোলকাতার লোক বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু আপনি ওখানে গেছিলেন কি করতে? ওটা একটা মরন ফাঁদ । আসলে ওর নীচে বিরাট বড় এক দীঘি আছে । ওই যে পরিত্যক্ত কারখানা দেখছেন , ওর একটা অংশ মানে যে অংশ টা দেখা যাচ্ছে , বেশ কিছুদিন হল বন্ধ হয়ে গিয়েছে । আর যে অংশ টা চালু আছে সেই অংশের ছাই এবং নানা আবর্জনা এই দিঘিতে এসে পড়ে। তবে শুধু কারখানার দোষ দিয়ে লাভ নেই । আশ পাশের গ্রাম বাসীরাও বিভিন্ন নোংরা ফেলে যায় মাঝে মাঝে । ওই যে দেখতে পাচ্ছেন , দূর থেকে দেখে মনে হয় পাথরের ঢিপি , কিন্তু আসলে ওটা ছাইয়ের স্তূপ । ওর নীচে শান্ত ভাবে ঘুমিয়ে আছে এক বিরাট এবং গভীর দিঘী। যার ঘুম ভাঙ্গে শুধু ওর উপরে কোন মানুষ বা জন্তু জানোয়ার উঠলে । ওই নরম ছাইয়ের ভিতরে ডুবে যাওয়া যতটা সহজ , উদ্ধার পাওয়া ঠিক ততটাই কঠিন । আপনাকে যদি আর একটু পরে দেখতে পেতাম , তাহলে কি যে হত সে কহতব্য নয় ”। এই পর্যন্ত বলে একটু থামলেন আগন্তুক । শম্ভুবাবু ভাবছেন কোন নিঃসীম পাতালে তলিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি , তাকে যেন টেনে তুলেছেন এই ভলদ্রলক । আবার বলে চলেন আগন্তুক
-“ তা মশাইকে কোলকাতার মানুষ বলে মনে হচ্ছে , এখানে কি মনে করে ? আচ্ছা চলুন হাঁটতে হাঁটতে কথা বলা যাক ।  তা আপনি যাবেন কোথায় ? ” এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে থামলেন আগন্তুক । শম্ভুবাবু বল্লেন
-“ ওই দূরে যে গ্রাম টা দেখা যাচ্ছে ওখানে যাব , আসলে এই মাঠ টা দেখে ভাবলাম আড়াআড়ি ভাবে চলতে থাকলে অনেক তাড়াতাড়ি পৌঁছনো যাবে । তাই এ পথে আসা। আপনি ঠিক ই ধরেছেন , আমি কোলকাতা থেকে আসছি । কাজের সুত্রে এখানে আসা আরকি । আমি স্বাস্থ্য দপ্তরে চাকরি করি , সেই ব্যাপারে কিছু সার্ভে করার ছিল। আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেব তার কোন ভাষা খুজে পাচ্ছিনা । আপনার নাম টা জানতে পারি । ” আগন্তুক বল্লেন
-“ আমি উপেন্দ্রনাথ প্রামানিক । এখানেই থাকি । ঠিক সময়ে আপনাকে দেখতে পেয়েছিলাম মশাই । না হলে আজ একটা বিপদ ঘটতে পারত” । গম্ভীর ভাবে শম্ভু বাবু বল্লেন
-“ হ্যাঁ তা যা বলেছেন , ভাবতেই আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে । আচ্ছা ওটাকে “মরন ফাঁদ” কেন বলছেন ? ” খানিকটা নিরাসক্ত কণ্ঠে উপেন্দ্রনাথ প্রামানিক বল্লেন
-“ তা বলব না ! দুটো এরকম ঘটনা ঘটেছে তো । একবার ওই গ্রামেরই কিছু ছেলে খেলছিল এখানে , ওদের বলটা চল যায় ওই ঢিপির উপরে , একটা বারো তেরো বছরের ছেলে দৌড়ে উঠে যায় ওই ছাইয়ের ঢিপির উপরে ,সে আর ফিরে আসেনি । আর একবার , আপনারই মতন একজন সার্ভেআর এসেছিলেন কোলকাতা থেকে , উনিও শুনেছি এই কাজই করতেন । সে ও আপনার মতন এই মাঠ পার হতে গিয়ে তলিয়ে যান । দুজনেরই বডি দিন পাচেক পর পাওয়া যায় রুপনারায়নের চরে। আসলে ওই দীঘির সাথে রুপনারায়নের যোগ আছে । সাধে কি আর মরন ফাঁদ বলছি মশাই ! ”
এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন শম্ভুবাবু । মাথটা কেমন যেন ফাঁকা লাগছে তার । খানিক্ষন আগে যার কথা ভাবছিলেন মানে তার অফিসের সেই বহুল চর্চিত মানুষটি , সে তলিয়ে গেছিল ওই একই জায়গা তে ! যেখানে আর একটু হলেই শলিল সমাধি ঘটতে চলেছিল তারও । শম্ভুবাবু ধীর কণ্ঠে বল্লেন
-“ তবে যে শুনেছিলাম , গ্রাম বাসীদের সাথে তার বেশ ঝামেলা হয় এবং তার পর কে আর খুঁজে পাওয়া যায়না ? “
একটু হেসে উপেন্দ্রনাথ প্রামানিক বলেন -“ ওই অনিমেষ বলেছে তো ? ব্যাটা এক নম্বরের ধড়িবাজ । সবাইকে তাই বলে বেড়ায় , আসলে ওর শ্যালক কোলকাতায় বড় প্রমোটার , এই জমিটা ও কিনে নিয়েছে। এখন ধান্দায় আছে এক বড় ব্যবসায়ী কে বেচবে । সেই ব্যবসায়ী নাকি এক রিসোর্ট বানাবে এখানে । কিন্তু এই সব ঘটনার কথা জানলে যদি সে না কেনে তাই বিশেষ করে বাইরের , এবং যে কোন নতুন লোকের কাছে ওই কথাই রটায় । ঠিক আছে আমি চলি এবার , বেলা অনেক হল। আর আপনি নির্দ্বিধায় গ্রামে যান অখানকার মানুষেরা খুবই ভাল ।  ”
কথা বলতে বলতে প্রায় বড় রাস্তার কাছে চলে এসেছিলেন ওরা দুজনে।  ততক্ষনে শম্ভুবাবু একবার থমকে দাঁড়িয়ে ঘুরে দেখছিলেন জায়গাটাকে । বেশ খানিকটা দূরে চলে এসেছেন তিনি । দূরে দেখা যাচ্ছে গাছের ছায়াতে শান্ত ভাবে বিস্তৃত হয়ে আছে সেই “মরন ফাঁদ” একটা মূর্তিমান শয়তানের মতই যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে সবাইকে প্রখর রৌদ্র তাপে তার স্থির , শান্ত কোলে খনিকটা বিশ্রাম করার জন্য । একটু আগে যেভাবে ডেকেছিল তাকেও । পরিত্যক্ত কারখানার দিক থেকে বয়ে আসা ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা এসে লাগছে শম্ভুবাবুর মুখে । মনে হচ্ছে যেন কি এক অব্যক্ত হাহাকারের আর্তনাদ ছুটে এসে কিছু যেন বলতে চাইছে তাকে । গায়ে কাঁটা দিল শম্ভুবাবুর ।
আবার হাঁটতে শুরু করবেন বলে বড় রাস্তার দিকে ঘুরলেন । কিন্তু উপেন্দ্রনাথ প্রামানিক কে আর দেখতে পেলেন না। মনে পড়ল উনি বলছিলেন বেলা হয়েছে , বাড়ি ফিতে হবে।
সেদিন গ্রামের কাজ মিটিয়ে বাড়ি ফিরতে বেশ দেরি হল শম্ভুবাবুর । মনে মনে ভাবলেন , কি সাংঘাতিক ফাঁড়া থেকে তিনি বেঁচে ফিরেছেন আজ। মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলেন উপেন্দ্রনাথ প্রামানিককে যিনি আজ প্রায় পুনর্জীবন দান করেছেন শম্ভুবাবুকে।
পরদিন যথারীতি অফিস জয়েন করলেন শম্ভুবাবু । আগের দিনের সার্ভে রিপোর্ট তৈরি করলেন এবং তা জমা দিলেন । শুধু আগের দিনের ঘটনার ব্যাপারে কাউকে কিচ্ছু বল্লেন না । কিন্তু তার স্মৃতি থেকে ঘটনা টা মুছেও গেল না। দিন যায় , জীবন চলতে থাকে তার আপন গতিতে।
প্রায় মাস দুয়েক পর একদিন শম্ভুবাবুর থেকে প্রায় সাত বছরের সিনিয়র অফিস কলিগ কমলাকান্ত রায়ের ছোট মেয়ের বিয়েতে নিমন্ত্রন খেতে গেছেন শম্ভুবাবুদের ডিপার্টমেন্টের অনেকেই । সঙ্গে গেছেন শম্ভুবাবুও । হই , হুল্লোড় , মজা, আড্ডা তার সঙ্গে বিভিন্ন রকমের খাওয়া দাওয়া চলেছে কমলাকান্ত রায়ের নিজের বাড়িতেই । দুতলার বসার ঘরে বিয়ের ব্যবস্থা , ছাদে প্যান্ডেল করে খাওয়া দাওয়া এবং নিচের বসার ঘরে আমন্ত্রিতদের অভ্যর্থনা । এই বিয়েবাড়িতে শম্ভুবাবুর সব থেকে যেটা ভালো লাগছে তা হল কমলাকান্ত রায়ের রুচি বোধ। খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে সাজ সজ্জা সবেতেই সেই রুচির ছাপ রয়েছে । আর একটি অভিনব ব্যাপার বড় ভাল লাগছে শম্ভুবাবুর । ছোট মেয়ের বিয়েতে প্রদর্শিত হচ্ছে কমলাকান্ত রায়ের বড় মেয়ের বিয়ের ভিডিওগ্রাফি । অন্য সবার সাথে বসে শম্ভুবাবুও দেখছিলেন । সময়ের সাথে মানুষের চেহারা কিরকম পালটে যায় সেটাই ভাবছিলেন শম্ভুবাবু । প্রায় বছরদশেক আগের ভিডিও , কমলাদার তখনো মাথা ভর্তি টাক ছিলনা। পাশ থেকে সাধন সরকার বলে উঠলো
-“ আরে ও কেরে? নির্মল না? দেখো কাণ্ড , মাত্র এই কয় দিনে এত বড় ভুঁড়ি বাগালি কি করে রে?”
নির্মল ঘোষ বলে ওঠেন
– “দশ বছর সময়টাকে তোর মাত্র এই কয় দিন বলে মনে হচ্ছে ? নিজের পেট টার দিকে তাকিয়ে দেখ একবার।”
শম্ভু বাবু এদের থেকে বয়সে বেশ ছোট , তাই এদের ঠাট্টা ইয়ার্কির মধ্যে থাকছিলেন না খুব একটা। খানিকক্ষণ পরে আরো একবার কফির পেয়ালা আর খান তিনেক ফিশ ফিঙ্গার তুলে নিলেন শম্ভুবাবু । গরম কফিতে একবার চুমুক দিয়েছেন সবে । ঠিক তখনই শম্ভুবাবুর চোখটা আটকে গেল সোজা সুজি থাকা বড় টিভি স্ক্রীনটাতে এবং গরম কফিতে তার জিভ গেল পুড়ে। একটা দৃশ্য ফুটে উঠেছে স্ক্রীনে , চারজন মানুষ কনেকে একটা পিরিতে তুলে নিয়ে বরের চারদিকে প্রদক্ষিণ করাচ্ছেন । খুবই পরিচিত একটা দৃশ্য যেকোনো বিয়ে বাড়িতে।  কিন্তু শম্ভুবাবু ঠিক সেই দৃশ্য দেখছেন না , ওনার চোখ আটকে আছে ওই চারজন মানুষের একজনের দিকে। বেঁটে খাট চেহারা , মাথায় কোঁকড়ান চুল , চোখে বেশ মোটা ফ্রেমের চশমা আর তার বাঁ ভুরুর উপরে একটা লম্বা কাঁটা দাগ রয়েছে।শম্ভুবাবু পাশে দাঁড়ানো নির্মল ঘোষের জামার হাতাটা খামচে ধরলেন । তাকে জিজ্ঞেস করলেন
-“নির্মল দা ,ওই মাথায় কোঁকড়ান চুল ভদ্রলোক কে?” ।
গলার স্বর সামান্য নিচু করে নির্মল বাবু জবাব দেন
– “ও হল প্রামানিক , উপেন্দ্রনাথ প্রামানিক । আজ থেকে সাড়ে আট বছর আগে মারোখানা গেছিল।কিন্তু খুবই আনফরচুনেট ব্যাপার। ওখানে ও সুইসাইড করে । পাঁচদিন পরে বডি পাওয়া যায় রুপনারায়নের চরে।”
শম্ভুবাবুর চোখের সামনে পৃথিবীটা যেন আবছা হয়ে আসতে শুরু করে হঠাৎ করে। মাথাটা হঠাৎ ঘুরিয়ে যায় যেন , হাতের কফির পেয়ালাটা সশব্দে পড়ে যায় মাটিতে। শম্ভুবাবু বুঝতে পারেন তার অত্যন্ত ঘাম হচ্ছে। পাশে দাঁড়ানো নির্মল ঘোষ এবং সাধন সরকার যদি সময় মত ধরে না ফেলতেন তাহলে হয়ত মাটিতে পরেই যেতেন শম্ভুবাবু । ওনার মনে পড়েছিল মাস দুয়েক আগের একটা ঘটনা। মনে পড়েছিল ওই মানুষটিই যার মাথায় কোঁকড়া চুল, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, বাঁ ভুরুর উপরে একটা লম্বা কাঁটা দাগ বাঁচিয়েছিলেন তাকে এক নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে । ঠিক ওই একই রকম ভাবে  ইহজগৎ ত্যাগ করে চলে গেছেন ওই মানুষটিও , যার নাম উপেন্দ্রনাথ প্রামানিক। ধীরে ধীরে শম্ভুবাবুর মনে হতে থাকে চারিদিকের আলো গুলো হঠাৎ নিভেগিয়ে জায়গটা হঠাৎ কেমন যেন অন্ধকার হয়ে আসছে । কিছু নয় খানিকটা অসুস্থ হয়ে পরেছিলেন শম্ভুবাবু , সুস্থ হতে সময় লেগেছিল কিছুটা । তবে হ্যাঁ হসপিটালে থাকতে হয়েছিল তাকে কিছুদিন । পরে  এক বর্ষণমুখর ছুটির সকালে জানলার ধারে বসে ভেবেছিলেন যে মানুষটা মৃত্যুর ওপার থেকে ফিরে এসে তাকে জীবন দান করেছেন সেই তো পরম বন্ধু । যদি পরজন্ম বলে কিছু থাকে তবে শম্ভুবাবু চাইবেন ওই উপেন্দ্রনাথ প্রামানিকের বন্ধু হয়ে থাকতে , তারা একসাথে গাইবেন জীবনের জয়গান ।

|| সমাপ্ত ||

[Image: Shocked-Open-Asianpiedstarling-size-restricted.gif]

[+] 6 users Like Sanjay Sen's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: ভৌতিক গল্প সংকলন (চলছে) - by Sanjay Sen - 06-08-2023, 10:46 AM



Users browsing this thread: 1 Guest(s)