01-08-2023, 09:06 PM
"আচ্ছা, তখন যেন কি বলছিলে ইউসুফের সম্পর্কে তুমি?" তেপায়া স্ট্যান্ডের উপর থেকে ক্যামেরাটা খুলে নিয়ে কিছুক্ষণ আগে শ্যুট হয়ে যাওয়া দৃশ্যগুলো চেক করতে করতে বন্দনা দেবীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো রজত বণিক।
"নাচের দৃশ্যটা চলার মাঝখানে আমার কথা বলার জন্য আপনার অনেকগুলো টাকা নষ্ট হয়ে গেলো .. এটা শোনার পর থেকে খুব খারাপ লাগছে রজত দা। আসলে এর আগে কোনোদিন শ্যুটিং দেখার সুযোগ হয়নি তো, তাই বলে ফেলেছিলাম কথাগুলো।" কাঁচুমাচু মুখ করে উত্তর দিলেন বন্দনা দেবী।
"it's okay .. মানুষ মাত্রই ভুল হয়, আমি সেটার জন্য কিছু বলছি না। আমি জিজ্ঞাসা করছি .. তখন তুমি বললে না, ইউসুফ ভীষণ দুষ্টু ছেলে! ওর দুষ্টুমির প্রমাণ কি তুমি আগেও পেয়েছো? নাকি ডান্স সিকোয়েন্সের সময় ওর হরকত দেখে তোমার মনে হলো কথাটা?" ক্যামেরাটা পুনরায় তেপায়া স্ট্যান্ডের উপর রেখে দিয়ে কথাগুলো বললো সৈকতের ছোট পিসেমশাই।
"তখন বললাম না, ছোটবেলা থেকে ওকে কেউ শাসন করেনি বলে ওর সাহস এত বেড়ে গেছে। নাচের দৃশ্যে ওই অল্পবয়সী মেয়েটার সঙ্গে যে দুষ্টুমিটা ও করছিলো, সেটা তো আপনি নিজের চোখেই দেখতে পেয়েছেন। তবে শুধু ছোটদের কেনো, ওর থেকে বড় ওর মায়ের বয়সী মহিলাদের সঙ্গেও উল্টোপাল্টা ইয়ার্কি মারে ইউসুফ। আমি তো কালকেই ওকে বলেছি, আমি যদি ওর মা হতাম, তাহলে ওকে এক চড়ে সোজা করে দিতাম .." মুখ ফস্কে কথাগুলো বলে ফেলেই বন্দনা দেবী বুঝতে পারলেন ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছেন তিনি, তাই সঙ্গে সঙ্গে চুপ করে গেলেন। তার কথার সূত্র ধরে এখন যদি তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ইউসুফের থেকে বড় ওর মায়ের বয়সী মহিলাদের সঙ্গে ও আজেবাজে ইয়ার্কি করে করে, সেটা তিনি কি করে জানলেন? এবং গতকাল তাকে চড় মেরে সোজা করে দেওয়ার কথার তাৎপর্যই বা কি? তাহলে তিনি কি উত্তর দেবেন?
বন্দনা দেবীর আশঙ্কাই সত্যি হলো। তার করে ফেলা লুজ বলে সপাটে ছক্কা হাঁকাতে দ্বিধাবোধ করলো না ইউসুফ। "আছে আছে, অনেক ব্যাপার আছে গুরু। ওর ছেলেটা এখানে রয়েছে না! তাই ঝুমা লজ্জা পেয়ে চুপ করে গেলো। এই ভাই, এই! তুই এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস রে? শ্যুটিং তো শেষ হয়ে গেছে। দাঁড়া, একজনকে ডাকছি, সে তোকে সঙ্গ দেবে। খাবার দেওয়ার সময় পার্টনারের কাছ থেকে ঝাড় খেয়ে, সেই যে কোথায় বেপাত্তা হয়ে গেলো বেচারা! কতদিন বলেছি পার্টনারকে, ওইভাবে বকাঝকা করো না ছেলেটাকে .. কিন্তু, আমার কথা শুনলে তো! ঋষি, এই ঋষি .." ইউসুফের গলার আওয়াজ পেয়ে টেবিলে কাঁপা কাঁপা হাতে খাবার সার্ভ করতে গিয়ে সৈকতের মায়ের হাতে ভুল করে ছ্যাঁকা দিয়ে দেওয়া ছেলেটা এসে হাজির হলো এই ঘরে।
"কোথায় মুখ লুকিয়ে বসেছিলিস এতক্ষন তুই? খাওয়া-দাওয়া করেছিস তো? বাবার কথায় কি অভিমান করতে আছে? ভুল করলে বাবা তো শাসন করবেই। দ্যাখ, তোর বয়সী একটা ছেলে এসেছে। তোর থেকে হয়তো একটু ছোটোই হবে। ও তো তোর বন্ধুর মতো! ওকে একটু বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখা, গল্পটল্প কর ওর সঙ্গে। ওহো, আমার মাথাটাই গেছে। বন্ধু বলছি কেনো? ও তো আসলে তোর মামাতো ভাই হবে।" ইউসুফের বলা এবারকার কথাগুলোর জন্য সৈকত এবং বন্দনা দেবী .. এরা কেউই প্রস্তুত ছিলো না।
"মামাতো ভাই? তারমানে ও আপনার ছেলে, রজত দা? কই এতক্ষণ তো আপনি কিছু .. হ্যাঁ ঠিকই তো, আপনাদের ছেলের নাম তো ঋষিই ছিলো! আসলে এত বছর আগে দেখেছি তো, তাই চিনতে পারিনি। হ্যাঁ, ওর মায়ের সঙ্গে মুখের অনেক মিল রয়েছে। আমি তোমার মামী হই, তোমার মা এখন কোথায়? কেমন আছেন উনি?" কথাগুলো বলে বন্দনা দেবী ঋষি নামের ছেলেটার দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তার একটা হাত খপাত করে চেপে ধরে গুরুগম্ভীর গলায় রজত বাবু বললো, "থাক, ওকে বেশি indulgence দেওয়ার দরকার নেই। ও কিছুক্ষণ আগেই একটা অন্যায় করেছে, তার জন্য ওর অনুশোচনাই প্রাপ্য। ওর মা, মানে তোমার ছোট ননদের সব খবর আমি বলবো তোমাকে, চিন্তা নেই। দুই ভাইয়ের অনেকদিন পর দেখা হয়েছে, ওদের দু'জনকে একসঙ্গে সময় কাটাতে দাও। বড়দের কথার মাঝখানে ছোটদের না থাকাই ভালো।"
রজত বণিকের কথার পর আর কোনো কথা থাকতে পারে না। তার বাবার মুখ থেকে কথাগুলো শুনে সৈকতকে চোখের ইশারায় নিজের কাছে ডেকে নিয়ে দরজা দিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলো ঋষি। তাকে অনুসরণ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে আস্তে করে দরজাটা বন্ধ করে দিলো সৈকত।
তার ছোট পিসির অস্তিত্বের কথা জানলেও, তার ছেলের সম্পর্কে কিছুই জানতো না সৈকত। এমনিতেই তার বড় পিসি নিঃসন্তান হওয়ার জন্য এতদিন কাজিন ব্রাদার অথবা সিস্টারের অভাববোধ করে এসেছে সে। আজ হঠাৎ আপন পিসতুতো দাদার খোঁজ পেয়ে তার মনটা যেমন আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো, আবার পরক্ষণেই ওই ঘরে বন্ধ দরজার ভিতরে ইউসুফ ভাই আর তার ছোট পিসেমশায়ের উপস্থিতিতে তার মাতৃদেবী যে নিরাপদ নয় এটা ভেবে মনের ভেতর একটা চাপা আশঙ্কা হচ্ছিলো সৈকতের।
নিজের মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তি নিজের পক্ষে দেখা সম্ভব না হলেও, উল্টোদিকের ব্যক্তি যদি কিঞ্চিৎ সংবেদনশীল হয়, তবে তার পক্ষে এই মেঘ ও রৌদ্রের খেলা অনুধাবন করা সম্ভবপর হয় অনেকাংশেই। এক্ষেত্রেও সৈকতের মুখের ভাবগতিক দেখে ঋষি বুঝতে পারলো, তার মামাতো ভাইয়ের মনের মধ্যে কি চলছে!
"ভয় করছে ভাই?" দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে জিজ্ঞাসা করলো ঋষি।
"হ্যাঁ দাদা, ভীষণ ভয় করছে।" মৃদুস্বরে উত্তর দিলো সৈকত।
- "এখন তোমার কি করতে ইচ্ছা করছে? মনে হচ্ছে নিজের মা'কে এদের মাঝখান থেকে উড়িয়ে নিয়ে যাই? নাকি ভবিষ্যতে কি হতে চলেছে তার সম্পর্কে একটা প্রচ্ছন্ন ধারণা করে, ভেতর ভেতর নিষিদ্ধ উত্তেজনা অনুভব করছো?"
- "তোমাকে দেখে আমার কেন জানিনা মনে হচ্ছে, তোমাকে মনের কথা খুলে বলা যায়। সত্যি বলবো দাদা? তুমি যা বললে, সেই দুটোই করতে ইচ্ছে করছে আমার। একদিকে মনে হচ্ছে আমার মা'কে বাঁচাই এদের হাত থেকে! আবার অন্যদিকে, তুমি দ্বিতীয় কথাটা যেটা বললে, সেটাই। এর বেশি আমি আর বলতে পারবো না, লজ্জা করবে আমার।"
- "হুঁ , বুঝলাম .."
- "আচ্ছা দাদা, তুমি এখানে কি করছো? তোমরা কি এই বাড়িতেই থাকো?"
- "এটা মিস্টার রজত বণিকের কাজের জায়গা। স্টুডিও কাম অফিস বলতে পারো। সারাদিন তো বটেই, রাতেও আমি এখানে একা থাকি, আর কেউ থাকেনা।"
- "মিস্টার রজত বণিক? উনি তো তোমার বাবা!"
- "আমি ওনাকে নাম ধরেই ডাকি, বাবা বলি না।"
- "আচ্ছা, তারমানে উনি অন্য বাড়িতে থাকেন। আর তোমার মা?"
- "তখন থেকে 'অন্য বাড়ি' 'অন্য বাড়ি' কি করছো? উনি ওনার নিজের বাড়িতেই থাকেন। বললাম তো এটা অফিস, আমি বাড়িতে থাকি না, অফিসে থাকি। আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে বলতে হয়, এখানে আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে, বাড়িতে নয়। যদিও আমি ওই লোকটার সঙ্গে এক বাড়িতে থাকতেও চাই না।"
- "আর তোমার মা, মানে আমার ছোটপিসি কোথায় থাকে, বললে না তো?"
- "মেন্টাল এ্যাসাইলাম, রাঁচিতে .."
- "কি বলছো কি দাদা? তোমার মা পাগল হয়ে গেছেন?"
- "পাগল হয়ে যাননি, আমার মা'কে মানসিক রোগী বানিয়ে রাখা হয়েছে। তবে এতদিনে ওখানে থাকতে থাকতে উনি হয়তো সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেছেন। তবে আমার মাও মানুষ হিসেবে যে খুব একটা ভালো, তা নয়। জীবনে অনেক ভুল করেছেন তিনি। যাক সে কথা, মিস্টার রজত বণিক একজন লম্পট, চরিত্রহীন, নরপিশাচ। পৃথিবীতে এমন কোনো খারাপ কাজ নেই যে উনি করেননি। লোকটার এক্সপোর্ট ইমপোর্টের বিজনেস রয়েছে। সেখান থেকে লাখ লাখ টাকা কামিয়ে এখন ভারতীয় নীলছবি প্রযোজনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এই ব্যাপারটা মা জেনে যাওয়াতেই বিপত্তি ঘটে। পাছে উনি সবাইকে সব কিছু বলে দেন, তাই একজন অসৎ ডাক্তারকে দিয়ে মিথ্যে মেডিকেল রিপোর্ট বানিয়ে আমার মা'কে রোগী সাজিয়ে রাঁচি পাঠিয়ে দিয়েছে মিস্টার বণিক। কিন্তু বাবা সবাইকে অন্য কথা বলে। উনি বলেন আমার মা নাকি উনাকে ঠকিয়ে অন্য কোনো পুরুষের সাথে চলে গেছেন। আমি নিশ্চিত, তোমার মাকেও উনি এই গল্পটাই করবেন বা হয়তো এতক্ষণে করে ফেলেছেন। আর হতভাগ্য আমি কলেজ পাশ করার পর কিচ্ছু করতে না পেরে এরকম একজন লম্পট, দুশ্চরিত্র, নরকের কীটের অন্নে প্রতিপালিত হচ্ছি। বাড়িতে যাই না, এখানেই থাকি। টুকটাক কাজকর্ম করে দিই। তার বদলে একটা মাসোহারা পাই আর চার বেলার খাওয়া।"
- "তোমার বাবা, মানে আমার ছোট পিসেমশাই যে সাংঘাতিক লোক, সেটা ওনার সঙ্গে কথা বলেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু এখন তোমার কথাগুলো শুনে আমার পা দুটো ঠকঠক করে কাঁপছে দাদা। আমার মা তো উনার আপন শ্যালকের স্ত্রী। উনি নিশ্চয়ই আমার মায়ের কোনো ক্ষতি করবেন না, বলো?"
- "ক্ষতি বলতে, তুমি যদি প্রাণে মেরে ফেলার কথা বলো, তাহলে বলবো সেরকম কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে এর আগে যে উনি খুন করেননি সেটাও নয়, সেই দুষ্কর্মটিও উনি করে ফেলেছেন। তবে বর্তমানে উনি নীলছবির জগতের একজন প্রডিউসার, তাই এখন এরকম কিছু করার সম্ভাবনা বোধহয় নেই। যদি না তোমার মা মানে আমার মামী কোনো বেগরবাই করে!"
- "বেগরবাই করে মানে?"
- "মানে ধরো, যদি না উনি এখানে যে ঘটনাগুলো ঘটছে বা ভবিষ্যতে ঘটবে, সেগুলো বাইরে প্রকাশ করে দেন!"
- "না না, সেরকম কিছু হবে না। আমরা কাউকে কিচ্ছু বলবো না। আমিও বলবো না, আমার মাও বলবে না। তাছাড়া এইটুকু সময়ের মধ্যে কিই বা হবে? আমরা তো একটু পরেই বাড়ি চলে যাবো।"
- "অচেনা জায়গা, তার উপর এখানে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চলে না। ভরসা বলতে ইউসুফ অথবা আমার বাবার প্রাইভেট কার। ঘরে উপস্থিত দুই মানুষখেকো বাঘ আর সিংহ যখন রক্তের স্বাদ পেয়ে গেছে, তখন তোমার মনে হয় ওরা আজ গাড়ি করে তোমাদেরকে বাড়ি পৌঁছে দেবে? আজকের রাতটা তোমাদের এখানেই থেকে যেতে হবে। অন্তত আমার অভিজ্ঞতা তো তাই বলে। এরকম কতো দেখলাম! তবে মিস্টার বণিকের থেকেও ডেঞ্জারাস হলো ওই ইউসুফ। ওই তো শিকার ধরে আনে, অর্থাৎ বিভিন্ন ভদ্রঘরের মহিলাদের নিজের বাহ্যিক রূপ আর কথার জালে ফাঁসিয়ে নিয়ে আসে এখানে। ব্যাস, তারপরেই কেল্লাফতে।"
- "তোমার কথা শুনে বুঝতে পারছি ইন্ডিয়ান পর্ন মুভির যেগুলো বাংলাতে হয় সেগুলো বেশিরভাগই বানায় তোমার বাবা আর ওগুলোতে অ্যাক্টিং করে ইউসুফ ভাই। তোমাকে বলতে লজ্জা নেই, আমি পর্ন সাইটের পোকা। ভারতীয় বলো কি বিদেশী, প্রায় সব ব্লু-ফিল্ম আমি দেখে নিয়েছি। কিন্তু একটা কথা আমি বুঝতে পারলাম না। আজকে যে অ্যাকট্রেস এখানে এসেছে, মানে টিনার কথা বলছি, তাকে তো আমি অনেকবার এই ধরনের ছবিতে অভিনয় করতে দেখেছি। কিন্তু ইউসুফ ভাই সেও যদি অ্যাক্টিং করে ওইসব ছবিতে, কই তাকে তো কোনোদিন কোথাও দেখিনি! তাহলে তো আমি চিনতে পারতাম!"
- "ধুর বোকা ছেলে, আমি কখন বললাম ইউসুফ অ্যাক্টিং করে? ও হচ্ছে মিস্টার বণিকের বিজনেস পার্টনার। উপরে যেটা হলো, সেটা তো তোমার মায়ের জন্য একটা আইওয়াশ। শ্যুটিং-ফুটিং কিচ্ছু হয়নি ওখানে। ওই কটা লোকে শ্যুটিং হয় নাকি? আরও টেকনিশিয়ান দরকার হয়। টিনার সঙ্গে যে মেল অ্যাক্টারটা ছিলো, তোমরা আসার কয়েক মিনিট আগেই সে বেরিয়ে গেছে। টিনাও চলে যাবে একটু পরে। আসলে রেন্ডিদের বাজারে নামানোর আগে রেন্ডিখানার মালিক যেমন তাকে পরীক্ষা করার নামে উল্টেপাল্টে ভোগ করে নেয়, এক্ষেত্রেও সেটাই হতে চলেছে। তাছাড়া তোমার মায়ের যা রূপ, যা ফিগার এবং আমার বাবা অর্থাৎ মিস্টার বণিকের তোমার মায়ের প্রতি যা ফ্যান্টাসি দেখলাম, তাতে করে খেলা যে ভয়ঙ্কর হবে, এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এর বেশি তো আমি পরিষ্কার করে কিছু বলবো না ভাই! বাকিটা তুমি বুঝে নাও।"
- "তোমার কথাগুলো শুনে আমার খুব ভয় করছে দাদা। ওটিতে একটা কঠিন অপারেশন হতে চলেছে এটা জানার পর, ওটির দরজা ভিতর থেকে বন্ধ হয়ে গেলে, ভেতরে কি হচ্ছে? তার পরিচিত মানুষটি আদৌ বাঁচবে কিনা? এই প্রশ্নগুলো যেমন এক মুহূর্তের জন্যেও শান্ত হতে দেয় না অপারেশন থিয়েটারের বাইরে অপেক্ষারত ব্যক্তিটিকে! সেই ব্যক্তির মনে হয়, ভেতরে ভালো-মন্দ যাই ঘটুক না কেন, তাকে যদি ওটির ভেতরে ঢুকিয়ে পুরো অপারেশনটা দেখতে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হতো, তাহলে বোধহয় তার এই অশান্ত মনটা কিছুটা হলেও শান্তি পেতো। বর্তমানে আমার অবস্থাও ঠিক সেইরকমই হয়েছে দাদা। তুমি তো দেখতেই পেলে, আমাকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হলো। এমতাবস্থায় দোতলার ওই ঘরটার মধ্যে বর্তমানে কি ঘটে চলেছে, সেটা প্রত্যক্ষ করতে না পারলে এক মুহূর্তের জন্যও শান্তি পাচ্ছি না মনে।"
- "বুঝতে পারছি ভাই, তোমার মনের অবস্থা। তোমার মনের এই ইচ্ছা অবশ্যই পূর্ণ করবো আমি। সত্যি কথা বলতে কি জানো তো ভাই, এখানে থাকতে থাকতে আর এইসব অশ্লীল কুকর্ম দেখতে দেখতে আমার মনটাও যে কখন বিকৃত হয়ে গেছে, সেটা আমি বুঝতেই পারিনি। এই অফিসে রাত কাটানোর বা সারাদিন অতিবাহিত করার একটা খোরাক আমি পেয়ে গেছি। আমার সেই খোরাক মেটানোর প্রক্রিয়ায় আজ সঙ্গী থাকবে তুমি। তবে সেখানে যাওয়ার আগে আমার অভিজ্ঞতা বলছে ওরা নিজেরাই কিছুক্ষণের জন্য হলেও তোমাকে অথবা আমাদের দুজনকেই উপরে ডাকবে। এর পিছনে একমাত্র কারণ হলো চারপাশে একটা পারিবারিক পরিবেশ সৃষ্টি করা। ছেলে, ছেলের বন্ধু, ননদের স্বামী, ননদের ছেলে .. এদের সকলের উপস্থিতিতে তোমার মা'কে নিরাপদ ফিল করানো।
একতলার ওয়েটিংরুমে বসে এতক্ষণ কথা বলছিলো দু'জনে। ঋষির কথা শেষ হতে না হতেই, "উপরে চার কাপ চা আর কুকিজ পাঠিয়ে দে। তোরাও চাইলে এসে জয়েন করতে পারিস এখানে .." ইউসুফের গলার আওয়াজ ভেসে এলো দোতলা থেকে।
"বলেছিলাম না একটু আগে, ওরা নিজেরাই আমাদেরকে উপরে ডাকবে ওদের নিজেদের স্বার্থে!" এইটুকু বলে ড্রাইভার অমরকে ফোনে চা আর কুকিজের অর্ডার দিয়ে সৈকতকে নিয়ে উপরে উঠে গেলো ঋষি।
দোতলার দরজাটা খোলাই ছিলো, ভেতরে ঢুকে সৈকত দেখলো ইউসুফ আর তার ছোট পিসেমশাইয়ের ঠিক মাঝখানে ওই টেপজামার মতো ফ্রকটা পড়ে সোফার উপর বসে রয়েছে টিনা। অথচ তার মা'কে কোথাও দেখতে পেলো না সে। "মা কোথায়?" ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলো সৈকত।
"আরে এত ভয় পাচ্ছিস কেনো মা কি লাডলা? তোর মা'কে আমরা খেয়ে ফেলিনি, বাথরুমে গেছে ঝুমা।" মুচকি হেসে উত্তর দিলো ইউসুফ।
"ইউসুফ ভাই, প্লিজ একটা কথা রাখো আমার। আমাদের এখন যেতে দাও এখান থেকে, মানে আমি বলতে চাইছিলাম, আমাদেরকে গাড়িতে বাড়ি পৌঁছে দাও দয়া করে। আমি বেশ বুঝতে পারছি, এখানে থাকলে আমার মায়ের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। আমি স্বীকার করছি এই সবকিছু আমার বোকামির জন্য হয়েছে। নিজের বিকৃত মানসিকতার জন্য আমিই প্রশ্রয় দিয়েছি তোমাকে। কিন্তু জীবনটা তো চটিগল্প নয়, তাই এখনো দালাল হয়ে উঠতে পারিনি নিজের মায়ের। কিন্তু মানুষের মন তো তার নিয়ন্ত্রণে থাকে না, তাই এরপর যদি আমার মন বিট্রে করে আমাকে! সেই জন্যেই বলছি, যেতে দাও আমাদের।" ঋষি, টিনা আর তার ছোট পিসেমশাইয়ের সামনেই হুমড়ি খেয়ে ইউসুফের পায়ের উপর পড়ে কাঁদো কাঁদো গলায় আকুতি করে বললো সৈকত।
"তোর তো নিজের মায়ের প্রতি বিশাল কনফিডেন্স ছিলো! আমাকে বুক ফুলিয়ে বলেছিলিস, যাই হয়ে যাক তোর মা কখনো বিপথে যেতে পারে না। তাহলে এখন এত ভয় পাচ্ছিস কেনো? বিশ্বাস কর, আমরা এখনো তোর মায়ের শরীরে জোর করে টাচ পর্যন্ত করিনি। তোকে কথা দিচ্ছি, ভবিষ্যতেও জোর করবো না তোর মায়ের সঙ্গে। তুই ভালো করেই জানিস, আমি কাউকে কিছু কমিট করলে, সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করি। কিন্তু কথার জাদু'তো চলতেই পারে বাওয়া! এবং সেটা চলবেও। সেই কথার ছলনা ধরতে না পেরে তোর আদরের মায়ের যদি পদস্খলন হয়, তাহলে তো আমাদের কিছু করার নেই। আর যদি তোর মা সবকিছু ধরতে পেরে, সবকিছু বুঝতে পেরে কথার জাল কেটে বেরিয়ে যেতে চায়! তাহলে আমি কথা দিচ্ছি, আমি নিজে গাড়ি করে গিয়ে তোদের দু'জনকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবো। এবার বল, তৈরি আছিস আমার এই চ্যালেঞ্জটা নেওয়ার জন্য?" সোফা থেকে উঠে সৈকতের কাঁধদুটো ধরে দাঁড় করিয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কন্ঠে কথাগুলো বললো ধূর্ত ইউসুফ।
"না ভাই, রাজি হয়োনা এদের কথায়। এরা আবার তোমাকে কথার জালে ফাঁসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।" চিৎকার করে কথাগুলো বলতে ইচ্ছা করলো ঋষির। কিন্তু তার বাবার রক্তচক্ষুর দিকে তাকিয়ে গলার মধ্যেই আটকে গেলো কথাগুলো।
তখনই "আমি রাজি .." এই দুটো শব্দ বলে ফেলে তার জীবনের সব থেকে বড় ব্লান্ডার করে ফেললো সৈকত। ঠিক সেই সময বাথরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এসে বন্দনা দেবী জিজ্ঞাসা করলেন, "কি কথা হচ্ছে এখানে? কোন বিষয়ে রাজি হওয়ার কথা বলছিস তুই বাবু?"
তার মায়ের প্রশ্নের উত্তরে সৈকত কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু তার আগেই ধূর্ত শয়তান ইউসুফ বলে উঠলো, "ঋষির সঙ্গে তোমার ছেলের এতটাই বন্ধুত্ব হয়ে গেছে যে, ও এখন আমাদের কাছে এসে বায়না করছিলো আজকের রাতটা এখানেই থেকে যাওয়ার জন্য। তাই আমি ওকে বললাম, এখানে থাকতে গেলে কিন্তু রাতে ঋষির সঙ্গে একতলায় শুতে হবে! সেটা শুনে তোমার ছেলে এককথায় বললো .. ও রাজি আছে।"
ইউসুফের মুখে কথাগুলো শুনে সৈকত বুঝতে পারলো, একটু আগে রাজি হয়ে কত বড় ভুল সে করে ফেলেছে।! সত্যিই, কথার ছলনায় মানুষকে কনফিউজ করে দেওয়ার ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা রয়েছে ছেলেটার।
"ও আচ্ছা, এই কথা? বাবু বরাবরই বুদ্ধিহীন, কোথায় কি বলতে হয় জানে না। ওরে মূর্খ, আমরা শ্যুটিং দেখতে এসেছি, থাকতে নয়। সঙ্গে করে কোনো জামাকাপড় আনা হয়নি, এভাবে হুট করে কোথাও থেকে যাওয়া যায়? বাড়িতে কত কাজ হয়েছে! তাছাড়া তোর সামনে পরীক্ষা, পড়াশোনা করতে হবে তো!" ইউসুফের কথাগুলো বিশ্বাস করে নিজের ছেলেকেই দোষী সাব্যস্ত করে এইরূপ উক্তি করলেন বন্দনা দেবী।
"বাড়িতে কি রাজকার্য আছে শুনি তোমার? এখন তো আমার শালাবাবু থাকে না বাড়িতে। আর তুমি তো বললে, শাশুড়ি গেছে তোমার বড় ননদের কাছে। লোক বলতে তোমরা দু'জন। রাতের খাওয়ার নিশ্চয়ই বানিয়ে আসোনি, তাই খাবার নষ্ট হওয়ার ভয় নেই। আজ তো বিশ্বকর্মা পূজো, আজ আবার কি পড়াশোনা? আর কাল থেকে তো ওর কলেজে ছুটি পড়ে যাচ্ছে। পুজোর পর কলেজ খুলে তবে তো পরীক্ষা! একদিন না পড়লে, ও পরীক্ষায় ফেল করবে না। আর জামাকাপড় নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। বললাম না তোমার ছোট ননদ আমার সঙ্গে সম্পর্ক না রাখলেও, ওর ছেলের সঙ্গে দেখা করতে আসে প্রায়ই। আমি ফোন করে দেবো, তুমি এসেছো শুনলে তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্য ও অবশ্যই আজকে আসবে। আসার সময় সঙ্গে করে তোমার জন্য রাতে পড়ার জামাকাপড় নিয়ে আসবে। তারপর ননদ-বৌদিতে মিলে রাতে পাশের ঘরে শুয়ে খুব গল্প করো। ইউসুফ আর টিনা তো একটু পরে চলেই যাবে। আমি এই ঘরে শুয়ে পড়বো। আর নিচে শোবে তোমার ছেলে আর আমার ছেলে। এতদিন পর একটা পারিবারিক রিইউনিয়ন তৈরি হচ্ছে .. এটাকে নষ্ট করো না প্লিজ। থেকে যাও .. তাছাড়া তোমার স্ক্রিনটেস্ট তো এখনো নেওয়াই হয়নি! যদি একবার সিলেক্ট হয়ে যাও, তাহলে খুব ভালো পেমেন্ট পাবে।" গলার স্বর অনেকটা নরম করে পাউরুটির উপর যেভাবে মাখন লাগায়, ঠিক সেই ভঙ্গিতে কথাগুলো বললো রজত বণিক।
রজত বাবুর অকাট্য যুক্তির সামনে পাল্টা যুক্তি দেওয়ার কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে, ফ্যামিলি রিইউনিয়নের কথাটা অন্ধের মতো বিশ্বাস করে, এবং সর্বোপরি ভালো পেমেন্টের কথা শুনে পুরোপুরি কনফিউজড হয়ে গিয়ে, "ঠিক আছে, পরিবারের সবাই যখন থাকছে, তাহলে তো চিন্তার কোনো ব্যাপার নেই। আমরা আজ তাহলে এখানে থেকেই যাই। কতদিন পর ছোড়দির সঙ্গে দেখা হবে। আপনি তাড়াতাড়ি ফোন করে ডেকে নিন ছোড়দিকে।" এই কথাগুলো বলে নিজের জীবনের ঐতিহাসিক ভুলটা করে ফেললেন বন্দনা দেবী।
"নাচের দৃশ্যটা চলার মাঝখানে আমার কথা বলার জন্য আপনার অনেকগুলো টাকা নষ্ট হয়ে গেলো .. এটা শোনার পর থেকে খুব খারাপ লাগছে রজত দা। আসলে এর আগে কোনোদিন শ্যুটিং দেখার সুযোগ হয়নি তো, তাই বলে ফেলেছিলাম কথাগুলো।" কাঁচুমাচু মুখ করে উত্তর দিলেন বন্দনা দেবী।
"it's okay .. মানুষ মাত্রই ভুল হয়, আমি সেটার জন্য কিছু বলছি না। আমি জিজ্ঞাসা করছি .. তখন তুমি বললে না, ইউসুফ ভীষণ দুষ্টু ছেলে! ওর দুষ্টুমির প্রমাণ কি তুমি আগেও পেয়েছো? নাকি ডান্স সিকোয়েন্সের সময় ওর হরকত দেখে তোমার মনে হলো কথাটা?" ক্যামেরাটা পুনরায় তেপায়া স্ট্যান্ডের উপর রেখে দিয়ে কথাগুলো বললো সৈকতের ছোট পিসেমশাই।
"তখন বললাম না, ছোটবেলা থেকে ওকে কেউ শাসন করেনি বলে ওর সাহস এত বেড়ে গেছে। নাচের দৃশ্যে ওই অল্পবয়সী মেয়েটার সঙ্গে যে দুষ্টুমিটা ও করছিলো, সেটা তো আপনি নিজের চোখেই দেখতে পেয়েছেন। তবে শুধু ছোটদের কেনো, ওর থেকে বড় ওর মায়ের বয়সী মহিলাদের সঙ্গেও উল্টোপাল্টা ইয়ার্কি মারে ইউসুফ। আমি তো কালকেই ওকে বলেছি, আমি যদি ওর মা হতাম, তাহলে ওকে এক চড়ে সোজা করে দিতাম .." মুখ ফস্কে কথাগুলো বলে ফেলেই বন্দনা দেবী বুঝতে পারলেন ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছেন তিনি, তাই সঙ্গে সঙ্গে চুপ করে গেলেন। তার কথার সূত্র ধরে এখন যদি তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ইউসুফের থেকে বড় ওর মায়ের বয়সী মহিলাদের সঙ্গে ও আজেবাজে ইয়ার্কি করে করে, সেটা তিনি কি করে জানলেন? এবং গতকাল তাকে চড় মেরে সোজা করে দেওয়ার কথার তাৎপর্যই বা কি? তাহলে তিনি কি উত্তর দেবেন?
বন্দনা দেবীর আশঙ্কাই সত্যি হলো। তার করে ফেলা লুজ বলে সপাটে ছক্কা হাঁকাতে দ্বিধাবোধ করলো না ইউসুফ। "আছে আছে, অনেক ব্যাপার আছে গুরু। ওর ছেলেটা এখানে রয়েছে না! তাই ঝুমা লজ্জা পেয়ে চুপ করে গেলো। এই ভাই, এই! তুই এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস রে? শ্যুটিং তো শেষ হয়ে গেছে। দাঁড়া, একজনকে ডাকছি, সে তোকে সঙ্গ দেবে। খাবার দেওয়ার সময় পার্টনারের কাছ থেকে ঝাড় খেয়ে, সেই যে কোথায় বেপাত্তা হয়ে গেলো বেচারা! কতদিন বলেছি পার্টনারকে, ওইভাবে বকাঝকা করো না ছেলেটাকে .. কিন্তু, আমার কথা শুনলে তো! ঋষি, এই ঋষি .." ইউসুফের গলার আওয়াজ পেয়ে টেবিলে কাঁপা কাঁপা হাতে খাবার সার্ভ করতে গিয়ে সৈকতের মায়ের হাতে ভুল করে ছ্যাঁকা দিয়ে দেওয়া ছেলেটা এসে হাজির হলো এই ঘরে।
"কোথায় মুখ লুকিয়ে বসেছিলিস এতক্ষন তুই? খাওয়া-দাওয়া করেছিস তো? বাবার কথায় কি অভিমান করতে আছে? ভুল করলে বাবা তো শাসন করবেই। দ্যাখ, তোর বয়সী একটা ছেলে এসেছে। তোর থেকে হয়তো একটু ছোটোই হবে। ও তো তোর বন্ধুর মতো! ওকে একটু বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখা, গল্পটল্প কর ওর সঙ্গে। ওহো, আমার মাথাটাই গেছে। বন্ধু বলছি কেনো? ও তো আসলে তোর মামাতো ভাই হবে।" ইউসুফের বলা এবারকার কথাগুলোর জন্য সৈকত এবং বন্দনা দেবী .. এরা কেউই প্রস্তুত ছিলো না।
"মামাতো ভাই? তারমানে ও আপনার ছেলে, রজত দা? কই এতক্ষণ তো আপনি কিছু .. হ্যাঁ ঠিকই তো, আপনাদের ছেলের নাম তো ঋষিই ছিলো! আসলে এত বছর আগে দেখেছি তো, তাই চিনতে পারিনি। হ্যাঁ, ওর মায়ের সঙ্গে মুখের অনেক মিল রয়েছে। আমি তোমার মামী হই, তোমার মা এখন কোথায়? কেমন আছেন উনি?" কথাগুলো বলে বন্দনা দেবী ঋষি নামের ছেলেটার দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তার একটা হাত খপাত করে চেপে ধরে গুরুগম্ভীর গলায় রজত বাবু বললো, "থাক, ওকে বেশি indulgence দেওয়ার দরকার নেই। ও কিছুক্ষণ আগেই একটা অন্যায় করেছে, তার জন্য ওর অনুশোচনাই প্রাপ্য। ওর মা, মানে তোমার ছোট ননদের সব খবর আমি বলবো তোমাকে, চিন্তা নেই। দুই ভাইয়ের অনেকদিন পর দেখা হয়েছে, ওদের দু'জনকে একসঙ্গে সময় কাটাতে দাও। বড়দের কথার মাঝখানে ছোটদের না থাকাই ভালো।"
রজত বণিকের কথার পর আর কোনো কথা থাকতে পারে না। তার বাবার মুখ থেকে কথাগুলো শুনে সৈকতকে চোখের ইশারায় নিজের কাছে ডেকে নিয়ে দরজা দিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলো ঋষি। তাকে অনুসরণ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে আস্তে করে দরজাটা বন্ধ করে দিলো সৈকত।
★★★★
তার ছোট পিসির অস্তিত্বের কথা জানলেও, তার ছেলের সম্পর্কে কিছুই জানতো না সৈকত। এমনিতেই তার বড় পিসি নিঃসন্তান হওয়ার জন্য এতদিন কাজিন ব্রাদার অথবা সিস্টারের অভাববোধ করে এসেছে সে। আজ হঠাৎ আপন পিসতুতো দাদার খোঁজ পেয়ে তার মনটা যেমন আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো, আবার পরক্ষণেই ওই ঘরে বন্ধ দরজার ভিতরে ইউসুফ ভাই আর তার ছোট পিসেমশায়ের উপস্থিতিতে তার মাতৃদেবী যে নিরাপদ নয় এটা ভেবে মনের ভেতর একটা চাপা আশঙ্কা হচ্ছিলো সৈকতের।
নিজের মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তি নিজের পক্ষে দেখা সম্ভব না হলেও, উল্টোদিকের ব্যক্তি যদি কিঞ্চিৎ সংবেদনশীল হয়, তবে তার পক্ষে এই মেঘ ও রৌদ্রের খেলা অনুধাবন করা সম্ভবপর হয় অনেকাংশেই। এক্ষেত্রেও সৈকতের মুখের ভাবগতিক দেখে ঋষি বুঝতে পারলো, তার মামাতো ভাইয়ের মনের মধ্যে কি চলছে!
"ভয় করছে ভাই?" দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে জিজ্ঞাসা করলো ঋষি।
"হ্যাঁ দাদা, ভীষণ ভয় করছে।" মৃদুস্বরে উত্তর দিলো সৈকত।
- "এখন তোমার কি করতে ইচ্ছা করছে? মনে হচ্ছে নিজের মা'কে এদের মাঝখান থেকে উড়িয়ে নিয়ে যাই? নাকি ভবিষ্যতে কি হতে চলেছে তার সম্পর্কে একটা প্রচ্ছন্ন ধারণা করে, ভেতর ভেতর নিষিদ্ধ উত্তেজনা অনুভব করছো?"
- "তোমাকে দেখে আমার কেন জানিনা মনে হচ্ছে, তোমাকে মনের কথা খুলে বলা যায়। সত্যি বলবো দাদা? তুমি যা বললে, সেই দুটোই করতে ইচ্ছে করছে আমার। একদিকে মনে হচ্ছে আমার মা'কে বাঁচাই এদের হাত থেকে! আবার অন্যদিকে, তুমি দ্বিতীয় কথাটা যেটা বললে, সেটাই। এর বেশি আমি আর বলতে পারবো না, লজ্জা করবে আমার।"
- "হুঁ , বুঝলাম .."
- "আচ্ছা দাদা, তুমি এখানে কি করছো? তোমরা কি এই বাড়িতেই থাকো?"
- "এটা মিস্টার রজত বণিকের কাজের জায়গা। স্টুডিও কাম অফিস বলতে পারো। সারাদিন তো বটেই, রাতেও আমি এখানে একা থাকি, আর কেউ থাকেনা।"
- "মিস্টার রজত বণিক? উনি তো তোমার বাবা!"
- "আমি ওনাকে নাম ধরেই ডাকি, বাবা বলি না।"
- "আচ্ছা, তারমানে উনি অন্য বাড়িতে থাকেন। আর তোমার মা?"
- "তখন থেকে 'অন্য বাড়ি' 'অন্য বাড়ি' কি করছো? উনি ওনার নিজের বাড়িতেই থাকেন। বললাম তো এটা অফিস, আমি বাড়িতে থাকি না, অফিসে থাকি। আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে বলতে হয়, এখানে আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে, বাড়িতে নয়। যদিও আমি ওই লোকটার সঙ্গে এক বাড়িতে থাকতেও চাই না।"
- "আর তোমার মা, মানে আমার ছোটপিসি কোথায় থাকে, বললে না তো?"
- "মেন্টাল এ্যাসাইলাম, রাঁচিতে .."
- "কি বলছো কি দাদা? তোমার মা পাগল হয়ে গেছেন?"
- "পাগল হয়ে যাননি, আমার মা'কে মানসিক রোগী বানিয়ে রাখা হয়েছে। তবে এতদিনে ওখানে থাকতে থাকতে উনি হয়তো সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেছেন। তবে আমার মাও মানুষ হিসেবে যে খুব একটা ভালো, তা নয়। জীবনে অনেক ভুল করেছেন তিনি। যাক সে কথা, মিস্টার রজত বণিক একজন লম্পট, চরিত্রহীন, নরপিশাচ। পৃথিবীতে এমন কোনো খারাপ কাজ নেই যে উনি করেননি। লোকটার এক্সপোর্ট ইমপোর্টের বিজনেস রয়েছে। সেখান থেকে লাখ লাখ টাকা কামিয়ে এখন ভারতীয় নীলছবি প্রযোজনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এই ব্যাপারটা মা জেনে যাওয়াতেই বিপত্তি ঘটে। পাছে উনি সবাইকে সব কিছু বলে দেন, তাই একজন অসৎ ডাক্তারকে দিয়ে মিথ্যে মেডিকেল রিপোর্ট বানিয়ে আমার মা'কে রোগী সাজিয়ে রাঁচি পাঠিয়ে দিয়েছে মিস্টার বণিক। কিন্তু বাবা সবাইকে অন্য কথা বলে। উনি বলেন আমার মা নাকি উনাকে ঠকিয়ে অন্য কোনো পুরুষের সাথে চলে গেছেন। আমি নিশ্চিত, তোমার মাকেও উনি এই গল্পটাই করবেন বা হয়তো এতক্ষণে করে ফেলেছেন। আর হতভাগ্য আমি কলেজ পাশ করার পর কিচ্ছু করতে না পেরে এরকম একজন লম্পট, দুশ্চরিত্র, নরকের কীটের অন্নে প্রতিপালিত হচ্ছি। বাড়িতে যাই না, এখানেই থাকি। টুকটাক কাজকর্ম করে দিই। তার বদলে একটা মাসোহারা পাই আর চার বেলার খাওয়া।"
- "তোমার বাবা, মানে আমার ছোট পিসেমশাই যে সাংঘাতিক লোক, সেটা ওনার সঙ্গে কথা বলেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু এখন তোমার কথাগুলো শুনে আমার পা দুটো ঠকঠক করে কাঁপছে দাদা। আমার মা তো উনার আপন শ্যালকের স্ত্রী। উনি নিশ্চয়ই আমার মায়ের কোনো ক্ষতি করবেন না, বলো?"
- "ক্ষতি বলতে, তুমি যদি প্রাণে মেরে ফেলার কথা বলো, তাহলে বলবো সেরকম কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে এর আগে যে উনি খুন করেননি সেটাও নয়, সেই দুষ্কর্মটিও উনি করে ফেলেছেন। তবে বর্তমানে উনি নীলছবির জগতের একজন প্রডিউসার, তাই এখন এরকম কিছু করার সম্ভাবনা বোধহয় নেই। যদি না তোমার মা মানে আমার মামী কোনো বেগরবাই করে!"
- "বেগরবাই করে মানে?"
- "মানে ধরো, যদি না উনি এখানে যে ঘটনাগুলো ঘটছে বা ভবিষ্যতে ঘটবে, সেগুলো বাইরে প্রকাশ করে দেন!"
- "না না, সেরকম কিছু হবে না। আমরা কাউকে কিচ্ছু বলবো না। আমিও বলবো না, আমার মাও বলবে না। তাছাড়া এইটুকু সময়ের মধ্যে কিই বা হবে? আমরা তো একটু পরেই বাড়ি চলে যাবো।"
- "অচেনা জায়গা, তার উপর এখানে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চলে না। ভরসা বলতে ইউসুফ অথবা আমার বাবার প্রাইভেট কার। ঘরে উপস্থিত দুই মানুষখেকো বাঘ আর সিংহ যখন রক্তের স্বাদ পেয়ে গেছে, তখন তোমার মনে হয় ওরা আজ গাড়ি করে তোমাদেরকে বাড়ি পৌঁছে দেবে? আজকের রাতটা তোমাদের এখানেই থেকে যেতে হবে। অন্তত আমার অভিজ্ঞতা তো তাই বলে। এরকম কতো দেখলাম! তবে মিস্টার বণিকের থেকেও ডেঞ্জারাস হলো ওই ইউসুফ। ওই তো শিকার ধরে আনে, অর্থাৎ বিভিন্ন ভদ্রঘরের মহিলাদের নিজের বাহ্যিক রূপ আর কথার জালে ফাঁসিয়ে নিয়ে আসে এখানে। ব্যাস, তারপরেই কেল্লাফতে।"
- "তোমার কথা শুনে বুঝতে পারছি ইন্ডিয়ান পর্ন মুভির যেগুলো বাংলাতে হয় সেগুলো বেশিরভাগই বানায় তোমার বাবা আর ওগুলোতে অ্যাক্টিং করে ইউসুফ ভাই। তোমাকে বলতে লজ্জা নেই, আমি পর্ন সাইটের পোকা। ভারতীয় বলো কি বিদেশী, প্রায় সব ব্লু-ফিল্ম আমি দেখে নিয়েছি। কিন্তু একটা কথা আমি বুঝতে পারলাম না। আজকে যে অ্যাকট্রেস এখানে এসেছে, মানে টিনার কথা বলছি, তাকে তো আমি অনেকবার এই ধরনের ছবিতে অভিনয় করতে দেখেছি। কিন্তু ইউসুফ ভাই সেও যদি অ্যাক্টিং করে ওইসব ছবিতে, কই তাকে তো কোনোদিন কোথাও দেখিনি! তাহলে তো আমি চিনতে পারতাম!"
- "ধুর বোকা ছেলে, আমি কখন বললাম ইউসুফ অ্যাক্টিং করে? ও হচ্ছে মিস্টার বণিকের বিজনেস পার্টনার। উপরে যেটা হলো, সেটা তো তোমার মায়ের জন্য একটা আইওয়াশ। শ্যুটিং-ফুটিং কিচ্ছু হয়নি ওখানে। ওই কটা লোকে শ্যুটিং হয় নাকি? আরও টেকনিশিয়ান দরকার হয়। টিনার সঙ্গে যে মেল অ্যাক্টারটা ছিলো, তোমরা আসার কয়েক মিনিট আগেই সে বেরিয়ে গেছে। টিনাও চলে যাবে একটু পরে। আসলে রেন্ডিদের বাজারে নামানোর আগে রেন্ডিখানার মালিক যেমন তাকে পরীক্ষা করার নামে উল্টেপাল্টে ভোগ করে নেয়, এক্ষেত্রেও সেটাই হতে চলেছে। তাছাড়া তোমার মায়ের যা রূপ, যা ফিগার এবং আমার বাবা অর্থাৎ মিস্টার বণিকের তোমার মায়ের প্রতি যা ফ্যান্টাসি দেখলাম, তাতে করে খেলা যে ভয়ঙ্কর হবে, এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এর বেশি তো আমি পরিষ্কার করে কিছু বলবো না ভাই! বাকিটা তুমি বুঝে নাও।"
- "তোমার কথাগুলো শুনে আমার খুব ভয় করছে দাদা। ওটিতে একটা কঠিন অপারেশন হতে চলেছে এটা জানার পর, ওটির দরজা ভিতর থেকে বন্ধ হয়ে গেলে, ভেতরে কি হচ্ছে? তার পরিচিত মানুষটি আদৌ বাঁচবে কিনা? এই প্রশ্নগুলো যেমন এক মুহূর্তের জন্যেও শান্ত হতে দেয় না অপারেশন থিয়েটারের বাইরে অপেক্ষারত ব্যক্তিটিকে! সেই ব্যক্তির মনে হয়, ভেতরে ভালো-মন্দ যাই ঘটুক না কেন, তাকে যদি ওটির ভেতরে ঢুকিয়ে পুরো অপারেশনটা দেখতে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হতো, তাহলে বোধহয় তার এই অশান্ত মনটা কিছুটা হলেও শান্তি পেতো। বর্তমানে আমার অবস্থাও ঠিক সেইরকমই হয়েছে দাদা। তুমি তো দেখতেই পেলে, আমাকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হলো। এমতাবস্থায় দোতলার ওই ঘরটার মধ্যে বর্তমানে কি ঘটে চলেছে, সেটা প্রত্যক্ষ করতে না পারলে এক মুহূর্তের জন্যও শান্তি পাচ্ছি না মনে।"
- "বুঝতে পারছি ভাই, তোমার মনের অবস্থা। তোমার মনের এই ইচ্ছা অবশ্যই পূর্ণ করবো আমি। সত্যি কথা বলতে কি জানো তো ভাই, এখানে থাকতে থাকতে আর এইসব অশ্লীল কুকর্ম দেখতে দেখতে আমার মনটাও যে কখন বিকৃত হয়ে গেছে, সেটা আমি বুঝতেই পারিনি। এই অফিসে রাত কাটানোর বা সারাদিন অতিবাহিত করার একটা খোরাক আমি পেয়ে গেছি। আমার সেই খোরাক মেটানোর প্রক্রিয়ায় আজ সঙ্গী থাকবে তুমি। তবে সেখানে যাওয়ার আগে আমার অভিজ্ঞতা বলছে ওরা নিজেরাই কিছুক্ষণের জন্য হলেও তোমাকে অথবা আমাদের দুজনকেই উপরে ডাকবে। এর পিছনে একমাত্র কারণ হলো চারপাশে একটা পারিবারিক পরিবেশ সৃষ্টি করা। ছেলে, ছেলের বন্ধু, ননদের স্বামী, ননদের ছেলে .. এদের সকলের উপস্থিতিতে তোমার মা'কে নিরাপদ ফিল করানো।
★★★★
একতলার ওয়েটিংরুমে বসে এতক্ষণ কথা বলছিলো দু'জনে। ঋষির কথা শেষ হতে না হতেই, "উপরে চার কাপ চা আর কুকিজ পাঠিয়ে দে। তোরাও চাইলে এসে জয়েন করতে পারিস এখানে .." ইউসুফের গলার আওয়াজ ভেসে এলো দোতলা থেকে।
"বলেছিলাম না একটু আগে, ওরা নিজেরাই আমাদেরকে উপরে ডাকবে ওদের নিজেদের স্বার্থে!" এইটুকু বলে ড্রাইভার অমরকে ফোনে চা আর কুকিজের অর্ডার দিয়ে সৈকতকে নিয়ে উপরে উঠে গেলো ঋষি।
দোতলার দরজাটা খোলাই ছিলো, ভেতরে ঢুকে সৈকত দেখলো ইউসুফ আর তার ছোট পিসেমশাইয়ের ঠিক মাঝখানে ওই টেপজামার মতো ফ্রকটা পড়ে সোফার উপর বসে রয়েছে টিনা। অথচ তার মা'কে কোথাও দেখতে পেলো না সে। "মা কোথায়?" ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলো সৈকত।
"আরে এত ভয় পাচ্ছিস কেনো মা কি লাডলা? তোর মা'কে আমরা খেয়ে ফেলিনি, বাথরুমে গেছে ঝুমা।" মুচকি হেসে উত্তর দিলো ইউসুফ।
"ইউসুফ ভাই, প্লিজ একটা কথা রাখো আমার। আমাদের এখন যেতে দাও এখান থেকে, মানে আমি বলতে চাইছিলাম, আমাদেরকে গাড়িতে বাড়ি পৌঁছে দাও দয়া করে। আমি বেশ বুঝতে পারছি, এখানে থাকলে আমার মায়ের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। আমি স্বীকার করছি এই সবকিছু আমার বোকামির জন্য হয়েছে। নিজের বিকৃত মানসিকতার জন্য আমিই প্রশ্রয় দিয়েছি তোমাকে। কিন্তু জীবনটা তো চটিগল্প নয়, তাই এখনো দালাল হয়ে উঠতে পারিনি নিজের মায়ের। কিন্তু মানুষের মন তো তার নিয়ন্ত্রণে থাকে না, তাই এরপর যদি আমার মন বিট্রে করে আমাকে! সেই জন্যেই বলছি, যেতে দাও আমাদের।" ঋষি, টিনা আর তার ছোট পিসেমশাইয়ের সামনেই হুমড়ি খেয়ে ইউসুফের পায়ের উপর পড়ে কাঁদো কাঁদো গলায় আকুতি করে বললো সৈকত।
"তোর তো নিজের মায়ের প্রতি বিশাল কনফিডেন্স ছিলো! আমাকে বুক ফুলিয়ে বলেছিলিস, যাই হয়ে যাক তোর মা কখনো বিপথে যেতে পারে না। তাহলে এখন এত ভয় পাচ্ছিস কেনো? বিশ্বাস কর, আমরা এখনো তোর মায়ের শরীরে জোর করে টাচ পর্যন্ত করিনি। তোকে কথা দিচ্ছি, ভবিষ্যতেও জোর করবো না তোর মায়ের সঙ্গে। তুই ভালো করেই জানিস, আমি কাউকে কিছু কমিট করলে, সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করি। কিন্তু কথার জাদু'তো চলতেই পারে বাওয়া! এবং সেটা চলবেও। সেই কথার ছলনা ধরতে না পেরে তোর আদরের মায়ের যদি পদস্খলন হয়, তাহলে তো আমাদের কিছু করার নেই। আর যদি তোর মা সবকিছু ধরতে পেরে, সবকিছু বুঝতে পেরে কথার জাল কেটে বেরিয়ে যেতে চায়! তাহলে আমি কথা দিচ্ছি, আমি নিজে গাড়ি করে গিয়ে তোদের দু'জনকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবো। এবার বল, তৈরি আছিস আমার এই চ্যালেঞ্জটা নেওয়ার জন্য?" সোফা থেকে উঠে সৈকতের কাঁধদুটো ধরে দাঁড় করিয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কন্ঠে কথাগুলো বললো ধূর্ত ইউসুফ।
"না ভাই, রাজি হয়োনা এদের কথায়। এরা আবার তোমাকে কথার জালে ফাঁসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।" চিৎকার করে কথাগুলো বলতে ইচ্ছা করলো ঋষির। কিন্তু তার বাবার রক্তচক্ষুর দিকে তাকিয়ে গলার মধ্যেই আটকে গেলো কথাগুলো।
তখনই "আমি রাজি .." এই দুটো শব্দ বলে ফেলে তার জীবনের সব থেকে বড় ব্লান্ডার করে ফেললো সৈকত। ঠিক সেই সময বাথরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এসে বন্দনা দেবী জিজ্ঞাসা করলেন, "কি কথা হচ্ছে এখানে? কোন বিষয়ে রাজি হওয়ার কথা বলছিস তুই বাবু?"
তার মায়ের প্রশ্নের উত্তরে সৈকত কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু তার আগেই ধূর্ত শয়তান ইউসুফ বলে উঠলো, "ঋষির সঙ্গে তোমার ছেলের এতটাই বন্ধুত্ব হয়ে গেছে যে, ও এখন আমাদের কাছে এসে বায়না করছিলো আজকের রাতটা এখানেই থেকে যাওয়ার জন্য। তাই আমি ওকে বললাম, এখানে থাকতে গেলে কিন্তু রাতে ঋষির সঙ্গে একতলায় শুতে হবে! সেটা শুনে তোমার ছেলে এককথায় বললো .. ও রাজি আছে।"
ইউসুফের মুখে কথাগুলো শুনে সৈকত বুঝতে পারলো, একটু আগে রাজি হয়ে কত বড় ভুল সে করে ফেলেছে।! সত্যিই, কথার ছলনায় মানুষকে কনফিউজ করে দেওয়ার ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা রয়েছে ছেলেটার।
"ও আচ্ছা, এই কথা? বাবু বরাবরই বুদ্ধিহীন, কোথায় কি বলতে হয় জানে না। ওরে মূর্খ, আমরা শ্যুটিং দেখতে এসেছি, থাকতে নয়। সঙ্গে করে কোনো জামাকাপড় আনা হয়নি, এভাবে হুট করে কোথাও থেকে যাওয়া যায়? বাড়িতে কত কাজ হয়েছে! তাছাড়া তোর সামনে পরীক্ষা, পড়াশোনা করতে হবে তো!" ইউসুফের কথাগুলো বিশ্বাস করে নিজের ছেলেকেই দোষী সাব্যস্ত করে এইরূপ উক্তি করলেন বন্দনা দেবী।
"বাড়িতে কি রাজকার্য আছে শুনি তোমার? এখন তো আমার শালাবাবু থাকে না বাড়িতে। আর তুমি তো বললে, শাশুড়ি গেছে তোমার বড় ননদের কাছে। লোক বলতে তোমরা দু'জন। রাতের খাওয়ার নিশ্চয়ই বানিয়ে আসোনি, তাই খাবার নষ্ট হওয়ার ভয় নেই। আজ তো বিশ্বকর্মা পূজো, আজ আবার কি পড়াশোনা? আর কাল থেকে তো ওর কলেজে ছুটি পড়ে যাচ্ছে। পুজোর পর কলেজ খুলে তবে তো পরীক্ষা! একদিন না পড়লে, ও পরীক্ষায় ফেল করবে না। আর জামাকাপড় নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। বললাম না তোমার ছোট ননদ আমার সঙ্গে সম্পর্ক না রাখলেও, ওর ছেলের সঙ্গে দেখা করতে আসে প্রায়ই। আমি ফোন করে দেবো, তুমি এসেছো শুনলে তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্য ও অবশ্যই আজকে আসবে। আসার সময় সঙ্গে করে তোমার জন্য রাতে পড়ার জামাকাপড় নিয়ে আসবে। তারপর ননদ-বৌদিতে মিলে রাতে পাশের ঘরে শুয়ে খুব গল্প করো। ইউসুফ আর টিনা তো একটু পরে চলেই যাবে। আমি এই ঘরে শুয়ে পড়বো। আর নিচে শোবে তোমার ছেলে আর আমার ছেলে। এতদিন পর একটা পারিবারিক রিইউনিয়ন তৈরি হচ্ছে .. এটাকে নষ্ট করো না প্লিজ। থেকে যাও .. তাছাড়া তোমার স্ক্রিনটেস্ট তো এখনো নেওয়াই হয়নি! যদি একবার সিলেক্ট হয়ে যাও, তাহলে খুব ভালো পেমেন্ট পাবে।" গলার স্বর অনেকটা নরম করে পাউরুটির উপর যেভাবে মাখন লাগায়, ঠিক সেই ভঙ্গিতে কথাগুলো বললো রজত বণিক।
রজত বাবুর অকাট্য যুক্তির সামনে পাল্টা যুক্তি দেওয়ার কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে, ফ্যামিলি রিইউনিয়নের কথাটা অন্ধের মতো বিশ্বাস করে, এবং সর্বোপরি ভালো পেমেন্টের কথা শুনে পুরোপুরি কনফিউজড হয়ে গিয়ে, "ঠিক আছে, পরিবারের সবাই যখন থাকছে, তাহলে তো চিন্তার কোনো ব্যাপার নেই। আমরা আজ তাহলে এখানে থেকেই যাই। কতদিন পর ছোড়দির সঙ্গে দেখা হবে। আপনি তাড়াতাড়ি ফোন করে ডেকে নিন ছোড়দিকে।" এই কথাগুলো বলে নিজের জীবনের ঐতিহাসিক ভুলটা করে ফেললেন বন্দনা দেবী।
ভালো লাগলে আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাবেন
লাইক এবং রেপু দিয়ে উৎসাহিত করবেন