17-07-2023, 10:48 PM
![[Image: Picsart-22-12-06-20-20-08-119.jpg]](https://i.ibb.co/0BDPH2Y/Picsart-22-12-06-20-20-08-119.jpg)
দ্বিতীয় খণ্ড
২৩তম পর্ব
শুধু শ্রীতমাদেবীই নন অভিরূপবাবু এবং আদিত্য ওরফে অনিকেত বা অনিও পরস্পরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দুজনেরই মনের ভাব একই এক ছুটে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরা কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে সংযমের বাঁধনে নিজেদের বেঁধে রেখেছে অনেকক্ষণ মৌণ থাকার পর আদিত্যই প্রথম কথা বলে,
"পিউর মুখে শুনলাম আপনারা এখানে এসেছেন, এখন শরীর কেমন আছে?"
"তুমি তো আর গেলে না দেখতে?" অভিরূপবাবুও শান্তস্বরে জবাব দেন।
"ওখানে সবাই আপনাদের নিজেদের লোক ছিল ওখানে আমার কি কাজ? গেলেও ঢুকতে দিত না হয়তো তাই যাইনি আর খবরে জেনেছি আপনার সুস্থতা সম্বন্ধে"
"গিয়েই দেখতে ঢুকতে দিত কি না?"
"আসুন ভিতরে আসুন"
"আসুন না ভিতরে" পিয়ালীও আহ্বান করে অভিরূপবাবু ও শ্রীতমাদেবীকে।
অভিরূপবাবু এবং শ্রীতমাদেবীকে যে ছেলেটা নিয়ে এসেছিল সে এবার আদিত্যকে বলে,
"দাদা ওনারা তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলেন তাই অখিল জ্যেঠু পাঠিয়ে দিলেন"
"ঠিক আছে, তুমি এক কাজ করো ওনাদের জন্য যে ইভিনিং স্ন্যাকস্ টা হয়েছে সেটা এখানে পাঠিয়ে দাও কেউ কিছু বললে আমার কথা বলবে"
"ঠিক আছে দাদা" বলে ছেলেটা চলে গেল, অভিরূপবাবু এবং শ্রীতমাদেবী ঘরের ভিতরে ঢুকলেন আদিত্য ওনাদের সোফা দেখিয়ে বসতে বললেন আর পিয়ালী কিচেনে গেল একটু পরেই লেবুর শরবত এনে ওনাদের দিল।
"কত মাস চলছে?"
শ্রীতমাদেবীর আকস্মিক করা এই প্রশ্নে পিয়ালী একটু অবাক হয়েই তাকিয়ে থাকে তার দিকে, শ্রীতমাদেবী একটু হেসে বলেন "রিসর্টে শুনছিলাম যে তুমি."
"চার মাসের মতো চলছে"
"তোমাকে তুমি করেই বলছি কিছু মনে কোরো না"
"না না মনে করার কিছু নেই, তুমি করেই বলুন"
"এখানে আর কেউ থাকে না? মানে তোমাদের থেকে বড়ো এমন কেউ?"
"গ্ৰামের কেউ না কেউ সবসময়ই খবর নিয়ে যায় আর অখিল জ্যেঠু তো আছেনই"
"আর তোমার বাবা মা? মানে একটা পুরনো রীতি আছে যে মেয়ের প্রথম বাচ্চা হবার সময় সে বাপের বাড়ি যায় এখন অনেকে এটা মানে না যদিও আবার অনেকে মানে। কোনো কারণ নেই এমনিই"
"ওর বাবা মা কেউ নেই, মারা গেছেন"
পিয়ালীর হয়ে আদিত্যই উত্তরটা দেয় কিন্তু জবাবে শ্রীতমাদেবী আরেকটা প্রশ্ন করেন যেটার জন্য সে তৈরী ছিল না,
"আর তোমার বাবা মা?"
আদিত্য একটু চমকে ওঠে তারপর দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলে "সবাই আছেন"
"কোথায় তারা?"
"আমি ওনাদের সাথে থাকি না"
"কেন জানতে পারি?"
"একটা অ্যাক্সিডেন্টে আমি সবার থেকে আলাদা হয়ে যাই ওনারা জানেন আমি মৃত"
"ফিরে যাচ্ছো না কেন? গিয়ে সত্যিটা বলো"
"এখন ফিরে গেলে হয়তো ওনাদের স্বাভাবিক জীবনে ব্যাঘাতের কারণ হবো তার থেকে এই ভালো, ওনারা আমাকে ছাড়াই ভালো আছেন"
"সেটা হয়তো তোমার মনে হচ্ছে কিন্তু এটা তো ভুল ধারনাও হতে পারে?"
"এক কাজ করলে কেমন হয়?" এতক্ষণে অভিরূপবাবু কথা বলেন, "তুমি তোমার পরিবারের অ্যাড্রেসটা দাও, আমি যোগাযোগ করছি"।
উত্তরে আদিত্য কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগে বাইরে থেকে আবার ওর নাম ধরে কেউ ডাকতে থাকে "আদিত্য দা ও আদিত্য দা"। আদিত্য বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে একটু আগের ছেলেটা আবার এসেছে আর এবার ওর সাথে স্বর্ণেন্দু বাবু, সুদেষ্ণা দেবী আর সুনন্দা এসেছেন। ছেলেটা আদিত্যকে বলে " এই এনারা ওনাদের খুঁজছিলেন আমি এখানে আসার কথা বলতে ওনারাও আসতে চাইলেন তাই"
"ঠিক আছে তোমাকে যে বললাম স্ন্যাকস্টা পাঠিয়ে দিতে?"
"ওটা আসছে"
"এক কাজ করো, এনাদেরটাও পাঠিয়ে দিও"
"ঠিক আছে দাদা"
ছেলেটা চলে গেল আদিত্য এবার বাকিদের ডাকলো "আসুন, ওনারা ভিতরে আছেন" সবাই ভিতরে ঢুকলে পিয়ালী আবার উঠে শরবত করে নিয়ে এলো।
"তোমরা এখানে?" অভিরূপবাবু বোধহয় বাকীদের এখানে আসাটা প্রত্যাশা করেননি তাই একটু অবাক হয়েছেন, তার প্রশ্নের উত্তরটা স্বর্ণেন্দু বাবু দিলেন,
"হ্যাঁ, তোমাদের রুমে না দেখে আন্দাজ করেছিলাম যে এখানে এসেছো তাই একজনকে বলতেই ও বাড়িটা দেখিয়ে দিল"
"পিউ কোথায়?" এই প্রশ্নটা অবশ্য পিয়ালীর, উদ্দেশ্য সুনন্দা।
"ও ঘুমাচ্ছে ওর বাবার সাথে"সুনন্দার ছোট্ট জবাব।
"খুব মিষ্টি মেয়ে"
"কিন্তু এখন তোমাদের ন্যাওটা হয়েছে বিশেষ করে সুপারম্যান আঙ্কেলের"
শেষ কথাটা অবশ্য স্বর্ণেন্দু বাবুই বলেন, কিন্তু পিয়ালী ঠিক বুঝতে পারে না সে অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করে, "ন্যাওটা মানে?"
"ঘনিষ্ঠ, কাছে যা বলতে চাও" আদিত্য বুঝিয়ে দেয়। এইসময় দরজায় আবার নক হয় রিসর্ট থেকে অভিরূপবাবুদের জন্য ইভিনিং স্ন্যাকস্ এসে গেছে সাথে একটা বড়ো ফ্লাস্কে গরম কফি।
সুনন্দা কিছু বলবে বলে উসখুস করছিল এবার বলেই ফেললো, "আদিত্য থ্যাংকস"
"কিসের জন্য?"
"তুমি আমার মেয়েকে বাঁচিয়েছিলে তারজন্যও তারপরে পিসুকেও বাঁচিয়েছিলে তারজন্য। তুমি করে বলছি বলে কিছু মনে কোরো না তুমিই বলেছিলে যে আমি তোমার দিদির মতো তাই"
"ইটস্ ওকে, থ্যাংকস বলার কিছু নেই"
"তুমি কিন্তু এখনো তোমার বাড়ির অ্যাড্রেসটা দিলে না, দাও?"
অন্য কথা হলেও অভিরূপবাবু যে ঠিকানার প্রসঙ্গটা ভোলেননি সেটা বেশ বোঝা যায়, আদিত্য এবার একটু বেকায়দায় পরে আসলে সেই সময়ে স্বর্ণেন্দু বাবুরা চলে আসায় সে ভেবেছিল এই প্রসঙ্গটা চাপা পরে যাবে কিন্তু এখন দেখছে যে সে ভুল ছিল।
"কি হলো দাও, আর যদি কলকাতায় না থেকে অন্য কোনো শহরে থাকে তাহলেও দিতে পারো"
আদিত্য একটু শুকনো হাসি হেসে কথা কথাটা এড়ানোর জন্য বললো "থাক না, আমার জীবনের ইতিহাস ঘাঁটার দরকার নেই ওটা ভুলে যাওয়াই ভালো, তারা তাদের মতো ভালো থাক সুখে থাক আমি এখানেই ভালো আছি"
"তুমি বাড়ি ফিরতে চাও না?"
"ওটা আর আমার বাড়ি নেই আর তাছাড়া মৃতরা বাড়ি ফেরে না"
সবাই বেশ অবাক হয়ে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে থাকে এমনকি অভিরূপবাবুও, একটু পর তিনি বলেন,
"তোমার অভিমান হয়েছে বুঝতে পারছি হয়তো সেটাই স্বাভাবিক কিন্তু অভিমানটা একটু সরিয়ে রেখে নিজের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেই দেখো, হয়তো দেখবে তারাও তোমাকে হারিয়ে কষ্টে আছে"
"হয়তো আছে হয়তো নেই কিন্তু আমি ফিরে গেলে তারা আরও বেশি কষ্ট পাবে বা হয়তো আমি এমন কিছু দেখবো বা জানবো যেটা আমার জন্য সহ্য করা কঠিন হয়ে যাবে তার থেকে এই ভালো আছি"।
"আমি একটু ইন্টারাপ্ট করছি" স্বর্ণেন্দু বাবু মাঝখানে বলে ওঠেন " আদিত্য হতেও তো পারে যে তোমার পুরো ধারণাটাই ভুল, আফটার অল পরিবার বলে কথা"
"একদমই ঠিক কথা" এবার শ্রীতমাদেবী কথা বলেন "হয়তো তোমার মাও তোমাকে হারিয়ে কষ্টের মধ্যে আছেন, তোমার বাবাও কষ্ট পাচ্ছেন..আচ্ছা তুমি এইভাবে তাদের থেকে দূরে সরে না গিয়ে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে তো পারো,অ্যাক্সিডেন্টের পরে ফিরে যাওনি কেন? বাবা মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে দেখতে পেতে তারাও কষ্টে আছেন"
আদিত্যর ইচ্ছা করছিল চেঁচিয়ে সব সত্যি বলে দিতে কিন্তু কোনোমতে নিজেকে সামলায় তবে তার ভিতরে এত বছরের জমানো অভিমানটাকে আটকাতে পারে না সেটা বেরিয়ে আসে।
"গিয়েছিলাম"
"গিয়েছিলে? কি হয়েছিল?" শ্রীতমাদেবীর গলায় বিস্ময় আদিত্য বলতে থাকে,
"অ্যাক্সিডেন্টের একমাস পরে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে সবার আগে বাড়িতে গিয়েছিলাম গিয়ে কি দেখলাম জানেন?"
"কি?"
"আমার ফ্যামিলি আমার মৃত্যুকে ভুলে, আমাকে ভুলে আমার দাদার বিয়ের অনুষ্ঠানের আনন্দে মেতে উঠেছে। আমার পুরো পরিবার আমাকে নিজেদের লাইফ থেকে জাস্ট ডিলিট করে দিয়েছে"
আদিত্যর কথা শুনে অভিরূপবাবু, শ্রীতমাদেবী সহ বাকীদের মুখ শুকিয়ে গেল আদিত্য বলতে থাকে, "এমনকি যখন আমার বাবার সামনে দাঁড়ালাম তখন উনি আমাকে লক্ষ্যই করলেন না বা বলা ভালো ওনার কাছে আমাকে চেনার সময় ছিল না উনি ওনার বড়ো ছেলের বিয়ে নিয়ে ব্যাস্ত"
আদিত্যর দৃষ্টি সোজা অভিরূপবাবুর দিকে অভিরূপবাবুও সোজা আদিত্যর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন, আদিত্যর ভিতরের চাপা অভিমান আর রাগটা তিনি বুঝতে পারছেন কিন্তু কোনো কথা বলতে পারছেন না, আদিত্য আবার বলতে শুরু করে,
"শুধু উনি নন যাদের আমি নিজের লোক ভাবতাম যারা আমার পরিবার ছিল তাদের কেউই তখন আমাকে চেনার মতো অবস্থায় ছিলেন না সবাই তখন বিয়ের আনন্দে ব্যাস্ত তাই আর তাদের আনন্দে ডিস্টার্ব না করে চলে আসি অবশ্য আসার আগে আরো একটা কথা জানতে পারি ওখানে বিয়েতে উপস্থিত কয়েকজন আলোচনা করছিল যে আমি নাকি ওনাদের নিজের ছেলে না এখন এটা সত্যি না মিথ্যা জানি না তবে এটা সত্যি আমি আমার বাবা মায়ের নিজের ছেলে হই বা না হই আমি ওনাদের খুব ভালোবাসি হয়তো ওনাদের কাছে আর ফিরবো না কিন্তু ওনাদের খুব ভালোবাসি"।
শেষের কথাটা আবার সোজা অভিরূপবাবুর দিকে তাকিয়ে বললো আদিত্য। এইসব কথায় পরিবেশ পরিস্থিতি যথেষ্ট গম্ভীর হয়ে উঠেছিল সেটাকে স্বাভাবিক করার জন্যই বোধহয় আদিত্য আবার একটু হেসে বললো,
"ওই দেখুন কথায় কথায় আপনাদের খাওয়াই হলো না নিন এগুলো খেয়ে নিন"।
বাকী যেটুকু সময় অভিরূপবাবুরা আদিত্যর বাড়িতে ছিলেন বেশ কথা বললেন না কেউই যদিও আদিত্য আর পিয়ালী পিউর কথা জিজ্ঞেস করছিল।
রিসর্টে ফিরে অভিরূপবাবু একদম চুপ মেরে গেলেন, রিসর্টের ভিতরে পুকুরের পাশে একটা বসার জায়গায় সবাই বসে আছে সবার মুখই গম্ভীর, শেষপর্যন্ত স্বর্ণেন্দু বাবুই মৌনতা ভঙ্গ করলেন,
"এতদিন আমার সন্দেহ থাকলেও আজ নেই, ওই আমাদের অনি। যে কথাগুলো ও বললো সেটা সব পরিবারে হয় না কিন্তু আমরা করেছিলাম তাই ও যদি সত্যিই সেইসময় ফিরে এসে থাকে তাহলে ওর মনে একটা বিরূপ ধারণা তৈরী হওয়া অসম্ভব নয়"
"কিন্তু অত তাড়াতাড়ি অরুর বিয়ে দেওয়ার একটা কারণ ছিল তুমি জানো সেটা" সুদেষ্ণা দেবী স্বামীর কথার উত্তরে বললেন, স্বর্ণেন্দু বাবুও অবশ্য তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, "কিন্তু অনি সেটা জানে না তাই ও যেটা দেখবে সেটার উপরেই ওর মনে ধারণা তৈরী হবে কিন্তু একটা জিনিস আমার মাথায় আসছে না ও যদি সত্যিই বিয়েতে এসেছিল তাহলে আমরা কেউ ওকে চিনতে পারলাম না এটা হতে পারে?"
"কারণ ওর মুখ ঢাকা ছিল আর ও একজন ভদ্রলোকের সাথে ছিল"
এতক্ষণে মুখ খুললেন অভিরূপবাবু এতক্ষণ তিনি চুপ করে চেয়ারের পিছনে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করে বসেছিলেন শুধু বসেছিলেন না প্রায় দশ বছর আগের সেই দিনটার কথা মনে করছিলেন যেদিন তার বড়ো ছেলে অরুণাভর বিয়ে ছিল।
অনেকবছর আগেকার কথা অনেক কিছুই ভুলে গিয়েছিলেন এখন চুপচাপ বসে সেগুলোর স্মৃতি পুনরুদ্ধার করতে চেষ্টা চালাচ্ছিলেন আর শেষপর্যন্ত স্মৃতিতে যেটা খুঁজছিলেন সেটা বোধহয় খুঁজে পেয়েছেন তাই স্বর্ণেন্দু বাবুর প্রশ্নের জবাবটা দেন তিনি,
"কারণ ওর মুখ ঢাকা ছিল আর ও একজন ভদ্রলোকের সাথে ছিল"
তাঁর কথা শুনে উপস্থিত সবাই চমকে উঠে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন অভিরূপবাবু এবার চেয়ারে সোজা হয়ে বসে একবার সবার দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখে নিয়ে বলেন,
"এতক্ষণ সেটাই মনে করতে চেষ্টা করছিলাম অনি যে মিথ্যা বলছে না সেটা তো জলের মতো পরিষ্কার, তাহলে এখন কথা হলো ও কখন এসেছিল?"
সবাই চুপ করে শুনতে থাকে অভিরূপবাবু বলে চলেন "বিয়েতে আমাদের কারো ইচ্ছা থাকুক বা না থাকুক মনে আনন্দ নাই থাকুক বাড়িতে অতিথি এলে তাকে হাসিমুখে বরণ করাই নিয়ম আমরাও তখন সেটাই করছিলাম ওইসময় অনি যদি সেটা দেখে তাহলে ওর মনে এই ভুল ধারণা জন্মাতেই পারে যে আমরা ওকে ভুলে আনন্দে মেতে উঠেছি"
"কিন্তু তুমি বললে অনি এসেছিল তাহলে তুমি ওকে চিনতে পারলে না?" শ্রীতমাদেবী একটু ক্ষুন্ন স্বরে জিজ্ঞেস করেন, অভিরূপবাবুর স্বরে এবার অনুশোচনা,
"ওখানেই তো ভুলটা হয়ে গেছে শ্রীতমা, মন থেকে না মানলেও কিছু নিয়মকানুন ছিল যেগুলো পালন করতে হয়েছিল আর আমি চাইছিলাম সেগুলো কোনোমতে শেষ করে একটু একা থাকতে অন্য কারো দিকে মন দেবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না" তারপর নিজের কপালে হাত দিয়ে বললেন "কেন দিলাম না আমার ছেলে আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল আর আমি ওর দিকে ভালো করে তাকাইনি পর্যন্ত"
"এ তুমি কি বলছো?" শ্রীতমাদেবী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান, অভিরূপবাবু আবার বলতে শুরু করেন, "কিন্তু আমিই বা কিভাবে জানবো? আমরা তো ধরেই নিয়েছিলাম যে ও... অনি আর বেঁচে নেই"
"তাই বলে তুমি নিজের ছেলেকে দেখেও চিনতে পারবে না?" শ্রীতমাদেবীর স্বরে এখন রাগ।
"ওর মাথায় টুপি, চোখে চশমা ছিল মুখও ঢাকা ছিল কিভাবে চিনবো? ওর সাথে একজন ছিলেন উনিই ওকে নিয়ে এসেছিলেন ও তার পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল, আমি ভেবেছিলাম কোনো গেস্ট হবে ভালো করে দেখার আগে ঠাকুরমশাই ডেকে পাঠিয়েছিলেন তাই চলে যাই."
"আর আমার ছেলেটা চুপচাপ নিজের বাড়িতে এসেও কাউকে কিছু না বলে চলে যায়" শ্রীতমাদেবীর স্বরে রাগ এখন আগের থেকে বেশী। অভিরূপবাবু দুহাতে মাথা চেপে ধরে বসে থাকেন আর শ্রীতমাদেবী কাঁদতে শুরু করেন স্বর্ণেন্দু বাবু আর সুদেষ্ণা দেবী কোনোমতে দুজনকে শান্ত করেন, তিনি বলেন,
"যা হয়ে গেছে সেটা নিয়ে ভেবে এখন লাভ নেই অনির মনে আমাদের সবার জন্য রাগ আর অভিমান জমে আছে এখন কিভাবে ওর রাগ ভাঙানো যাবে সেটা ভাবতে হবে"
"তুই জানিস না? অনি কিরকম?" শ্রীতমাদেবী ভাইকে বলেন "ছোটো থেকেই রাগী আর অভিমানী কাউকে মুখে কিছু বলবে না কিন্তু নিজে দূরে সরে যাবে আর এখন তো নিজের পরিবারের থেকে আঘাত পেয়েছে ও"
"আমার একটা কথা মাঝে মাঝেই সন্দেহজনক লাগতো" স্বর্ণেন্দু বাবু বললেন, তার বলার ধরনে সবাই তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন স্বর্ণেন্দু বাবু বলে চললেন "অনির সাথে মৌমিতার বিয়ে হবার কথা ছিল এবং সেটা মৌমিতার তরফ থেকেই প্রস্তাব এসেছিল তাহলে ওর মৃত্যুর পরে এত তাড়াতাড়ি অন্য একজনকে.."
"আমার ছেলে বেঁচে আছে স্বর্ণ" শ্রীতমাদেবী ঝংকার দিয়ে ওঠেন, স্বর্ণেন্দু বাবু নিজেকে শুধরে নেন ""মানে তখন তো সবাই জানতো অনি বেঁচে নেই তাহলে এত তাড়াতাড়ি ও অন্য একজনকে বিয়ে করতে রাজী হয়ে গেল? তাও যার সাথে বিয়ে হবার কথা ছিল তারই দাদার সাথে এটা একটু কেমন লাগছে না?"
"তুমি তো মৌমিতার অবস্থা দেখেছিলে?" সুদেষ্ণা দেবী স্বামীকে বলেন।
"না ব্যাপারটা অত সোজা নয়" স্বর্ণেন্দু বাবু উত্তর দেন
"তোমার কি মনে হয় বাপি" সুনন্দা জিজ্ঞেস করে, স্বর্ণেন্দু বাবু বলতে থাকেন "এটা অ্যাক্চুয়ালি তোর সুপ্রতিম আঙ্কেল বলেছিল আমাকে আমি প্রথমে অতটা গুরুত্ব দিইনি কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ওই ঠিক"
"কি?"
"অনির সাথে যেটা হয়েছিল সেটা ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটানো হয়েছিল আর তার পিছনে অরু আর মৌমিতা আছে এবং খুব সম্ভবত মনোজিৎ বাবুও"
"হোয়াট.. এসব কি বলছো বাপি?"
"এটা পুরোটাই ধারনা অনুমান সত্যি না মিথ্যা সেটা জানা নেই"
"আমারও সেটাই মনে হচ্ছে" অভিরূপবাবুর কথায় সবাই চমকে উঠলো, "অনি সেদিন পার্কে বলেছিল যে ও ফিরলে নাকি অনেকের মুখোশ খুলে যাবে আর তাতে আমরা কষ্ট পাবো তারমানে সে নিশ্চয়ই এমন কেউ যে আমাদের খুব কাছের একজন"
"অরু?" হতভম্ব শ্রীতমাদেবীর মুখ থেকে বড়ো ছেলের নামটা বেরিয়ে আসে অভিরূপবাবু বলতে থাকেন "আমিও বিশ্বাস করিনি কিন্তু সেদিন সুপ্রতিম বাবু আর পরে অনির সাথে কথা বলার পরে অনেক ভেবেছি। গ্যাংটকে কি হয়েছিল সেটা আমরা কেউ জানিনা শুধুমাত্র অরুর উপরে বিশ্বাস করে পুলিশের তদন্ত বন্ধ করিয়ে দিই"
"তুমি কি বলতে চাইছো যে অরু ওর ভাই অনিকে" শ্রীতমাদেবীর হতভম্ব ভাবটা অনেকটাই বেড়ে গেছে, অভিরূপবাবু স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলতে থাকেন, "শুনতে অবাস্তব মনে হলেও সত্যি হতেও পারে ছোটো থেকেই অরু অনিকে একটু হলেও হিংসে করতো সেটা যে বড়ো হবার সাথে বাড়েনি এটা কে বলতে পারে?"
"কিন্তু তাই বলে নিজের ভাইকে"
"অরু আর কি কি করেছে সে সম্বন্ধে তোমার কোনো ধারণা নেই শ্রীতমা, অরু আর সেই অরু নেই অনেকটাই পাল্টে গেছে, ভেবেছিলাম ও আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে কিন্তু আসলে ও আমাদের মাথা হেঁট করে দিয়েছে আর অন্যদিকে অনি ও জানে অরুকে আমরা কতটা ভালোবাসি ওর কিছু হলে আমরা কষ্ট পাবো তাই সবকিছু ছেড়ে এমনকি নিজের নাম, নিজের পরিচয় সবকিছু ছেড়ে ছেলেটা আমার স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়ে নিয়েছে"।
"কিন্তু এটাতো তোমাদের ধারণা সেটা ভুলও তো হতে পারে?" শ্রীতমাদেবী এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না যে তার বড়ো ছেলে কোনো খারাপ কাজ করতে পারে,
অভিরূপবাবু বললেন "ভুল হলে সবথেকে বেশী খুশী আমি হতাম কিন্তু সেটা নয়। অনির সাথে কি হয়েছিল সেটা হয়তো আমরা জানিনা কিন্তু মৌমিতার সাথে বিয়ের পরে আজ পর্যন্ত অরুণাভ এমন অনেক খারাপ কাজ করেছে যেগুলো আমরা কল্পনাও করতে পারি না, আমার কথা বিশ্বাস না হলে স্বর্ণেন্দুকে জিজ্ঞেস করে দেখো"
শ্রীতমাদেবী হতভম্ব ভাবে নিজের ভাইয়ের দিকে তাকালেন স্বর্ণেন্দু বাবু সম্মতিসূচক মাথা নাড়েন তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, "একটা জিনিস পরিষ্কার যদি আমরা যেটা অনুমান করছি সেটা সত্যি হয় তাহলে এই দুই ভাই আর কখনো একসাথে থাকতে পারবে না, তাই অনিকে ফেরানোর চেষ্টা করার আগে ভালো করে ভেবে দেখা উচিত"।
"এটা তুই কি বলছিস স্বর্ণ? দুজনেই তোর ভাগ্নে" শ্রীতমাদেবী ঝাঁঝিয়ে ওঠেন কিন্তু স্বর্ণেন্দু বাবু শান্ত স্বরেই বলেন, "আর আমি দুজনকেই ভালোবাসি আমার দুই ভাগ্নে একসাথে থাকলে আমিও কম খুশী হবো না কিন্তু যেটা বললাম সেটা ফ্যাক্ট"
"আমি আমার দুই ছেলেকেই চাই"
"সেটা হলে তো খুবই ভালো আমরা সবাই তাই চাই"।
"কোনোমতে সম্ভব নয়" অভিরূপবাবুর সকথায় সবাই আশ্চর্য এবং অবাক হন, "এতদিন ওর সব অপরাধ আমি ক্ষমা করে এসেছি, ব্যানার্জী পরিবারের নামের জন্য পুলিশ ওর গায়ে হাত দেয়নি কিন্তু যদি এটা জানতে পারি যে অনির সাথে যা হয়েছিল সেটার পিছনে অরু ছিল তাহলে ওকে শাস্তি পেতে হবে"
"এ তুমি কি বলছো ও আমাদের ছেলে"
"ভুলো না অনিও আমাদের ছেলে, অলরেডি ওর সাথে অনেক অন্যায় করেছি আমরা কিন্তু যদি আমাদের অনুমান সত্যি হয় তাহলে অরু পার পাবে না"।
"ওটা মিথ্যাও তো হতে পারে, তুমি এখনই খারাপটা ভাবছো কেন?"
"মিথ্যাই যেন হয় শ্রীতমা মিথ্যাই যেন হয়"।
আনন্দ নিকেতন রিসর্টে মূলত বিশ্রাম নিতে এসেছিলেন অভিরূপবাবু কিন্তু এখন চাইলেও বিশ্রাম নিতে পারছেন না খালি একটা কথাই মনে হচ্ছে তার ছেলের কথা যে কাছে থেকেও কাছে নেই দূরে চলে গেছে চেষ্টা করেও না তাকে কাছে আনতে পারছেন আর না তার কাছে যেতে পারছেন। ঈশ্বরের কাছে এখন দুটো প্রার্থনা তার, এক যে করেই হোক অনিকেতের অভিমান ভাঙানো আর দুই দুই ভাই যেন আবার একসাথে মিলে মিশে থাকে।
ভাবতে ভাবতেই একসময় চোখ ঘুমে বন্ধ হয়ে যায় বোধহয় ডাক্তারের দেওয়া ঘুমের ওষুধের এফেক্ট। একটু বেলাতেই ঘুম ভাঙলো তার এখানে কোনো তাড়া নেই তাই শ্রীতমা দেবী ডাকেননি, ঘুম ভাঙতেই আবার একই চিন্তা একই ভাবনা, শ্রীতমাদেবী ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলেন তার দিকে চোখ পরতেই অভিরূপবাবু বুঝতে পারলেন তার স্ত্রী কাঁদছিলেন কিন্তু এক্ষেত্রে তার সত্যিই কিছু করার নেই তিনি অপারগ মুখে যাই বলুন যাই প্রার্থনা করুন তিনি ভালো ভাবেই বুঝতে পারছেন যে তারা তাদের দুই ছেলের সাথে একসঙ্গে থাকতে পারবেন না এক ছেলেকে কাছে পেতে গেলে আরেকজনকে হারাতে হবে এটাই সত্যি, তেঁতো হলেও সত্যি।
বাকিরা এখনও কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি দেখে অভিরূপবাবু ও শ্রীতমাদেবী এক কাপ করে চা অর্ডার করে সেটা খেয়ে একটু পায়চারী করতে বেরোলেন তবে রিসর্টের বাইরে নয় ভিতরের এরিয়াতেই। সকালের হাওয়া বেশ লাগছিল দুজনের হঠাৎই দুজনেই থমকে দাঁড়িয়ে পরলেন তাদের সামনে কিছুটা দূরে আদিত্য বা অনিকেত দাঁড়িয়ে আছে আসলে ওর সঙ্গে আরেকজন আছে তাকে কিছু একটা বলছে।
এবার আদিত্যও অভিরূপবাবু ও শ্রীতমাদেবীকে দেখতে পেল এবং লোকটাকে ছেড়ে তাদের কাছে এলো,
"ভালোই হলো দেখা হয়ে আমি আপনাদের কাছেই যাবো ভাবছিলাম"
"কেন, কিছু বলবে?" অভিরূপবাবু জিজ্ঞেস করেন।
"আসলে আমি ক্ষমা চাইতে চাই"
"ক্ষমা কিসের জন্য?"
"কাল আমি এমন কিছু কথা বলে ফেলেছি যেগুলো আমার বলা উচিত হয়নি আমাকে ক্ষমা করে দিন" আদিত্য হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলো।
"তুমি ক্ষমা চাওয়ার মতো কিছু বলোনি, তবে এখন একটা সত্যি কথা বলবে?"
"কি?"
"তোমার বাড়ি থেকে দূরে চলে আসার পিছনে কি নিজের কারো হাত রয়েছে বা বলা ভালো বিশেষ কারো জন্যই কি তুমি তোমার বাড়ি ফিরে যাচ্ছো না?"
অভিরূপবাবুর প্রশ্ন শুনে আদিত্য ক্ষণিকের জন্য চমকে উঠলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নিল একটু কাষ্ঠ হাসি হেসে বললো, "পুরনো কথা মনে করে কি লাভ? তার থেকে বর্তমানেই বাঁচা ভালো আমি সেটাই করছি পুরনো কথা আর মনে করতে চাই না"
"তার মানে বলবে না?"
"জেনেও কোনো লাভ নেই, ওসব কথা থাক আপনার এখন রেস্টের দরকার অন্য কোনো চিন্তা মাথায় জায়গা দেবেন না ,চলুন আপনাদের জায়গাটা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছি"
আদিত্য অভিরূপবাবু আর শ্রীতমাদেবীকে নিয়ে রিসর্টের চারিপাশ ঘুরে দেখাতে লাগলো রিসর্টের ভিতরের অনেকটা জায়গা জুড়ে বিভিন্ন রকম ফুলগাছ লাগানো আছে ফুলের বাগান বলা চলে সেগুলো ঘুরিয়ে দেখালো তারপর ফলের বাগান। ফলের বাগানের একটা পেয়ারা গাছ থেকে দুটো বড়ো পেয়ারা নিয়ে দুজনকে খেতে দিল কথাবার্তা হাসি ঠাট্টা চললো যেন সত্যিই এক পরিবারের তিনজন একসাথে ঘুরছে দেখতে দেখতে অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেল চোখের নিমেষে।
রিসর্টের মেইন এরিয়ায় ফিরে অভিরূপবাবুরা দেখলেন বাকীরা উঠে পরেছেন তাদের জন্য অপেক্ষা করছেন ব্রেকফাস্ট টেবিলে, আদিত্য সবার থেকে বিদায় নিয়ে নিজের কাজে চলে গেল।
ব্রেকফাস্টের পরে অভিরূপবাবুরা আবার বেরোলেন অভিরূপবাবুরা মানে অভিরূপবাবু শ্রীতমাদেবী স্বর্ণেন্দু বাবু বাকীরা রিসর্টেই রয়ে গেলেন।
অভিরূপবাবুরা বেরোলেন ঠিকই তবে এবার ঘুরতে নয় মোড়লের বাড়িতে,
"আরে আসুন আসুন নমস্কার" মোড়ল তাদের দেখে ব্যাস্ত হয়ে পরলো তিনি তখন তার বাড়ির উঠোনে অন্য কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন অভিরূপবাবুরা প্রতি নমস্কার করে বললেন "আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল, আপনি আপনার কাজটা সেরে নিন আমরা অপেক্ষা করছি"।
কিন্তু মোড়ল তৎক্ষণাৎ সঙ্গের লোকগুলোকে বিদায় করে অভিরূপবাবুদের নিয়ে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলেন, একটু পরে মোড়ল গিন্নী প্রথমে চা তার একটু পরে গরম গরম পরোটা ও তরকারী নিয়ে এলো, যদিও অভিরূপবাবুরা বারণ করলেন যে রিসর্ট থেকে খেয়েই বেরিয়েছেন কিন্তু কে শোনে কার কথা? বোঝাই যায় এই গ্ৰামের লোকেরা আতিথেয়তায় ত্রুটি রাখে না।
"বলুন আমার সঙ্গে কি কথা" মোড়ল প্রশ্ন করলেন, অভিরূপবাবু একটু গলাটা পরিষ্কার করে বললেন, "অখিল বাবু কি আপনাকে কিছু বলেছে?"
"কি ব্যাপারে বলুন তো? আপনারা মাছ ধরতে চান সেই ব্যাপারে?"
"না, ওটা ঠিক নয়"
"তাহলে?"
"আসলে আমাদের এই গ্ৰামটা খুব পছন্দ হয়েছে, এখানে যদি কোনো জমি পাওয়া যায়, অল্প হলেও চলে যাবে তাহলে একটা ছোট্ট বাড়ি বানিয়ে আমরা থাকতাম"
"আপনারা শহুরে মানুষ এই গণ্ডগ্ৰামে থাকতে পারবেন?"
"কেন অসুবিধার কি আছে?
"অসুবিধা কি একটা যে মুখে মুখে বলবো? অবশ্য আমাদের এতেই চলে যায় কিন্তু আপনারা?"
"আমাদের তো ভালোই লাগছে"
"সে আপনারা ঘুরতে এসেছেন তাই, দুদিন থাকলেই হয়তো হাঁফিয়ে উঠবেন। একটা কথা অবশ্য না বললেই নয় আস্তে আস্তে গ্ৰামের উন্নতি হচ্ছে কিছুটা ডাক্তারবাবু করে গিয়েছিলেন আর এখন আদিত্য বাবা চেষ্টা করছে"
"আদিত্য?"
"হ্যাঁ, ওই তো যার কাছে আপনার নাতনি চলে গিয়েছিল"
"হ্যাঁ, সেটা জানি কিন্তু ও উন্নতি করছে মানে?"
"সে অনেক ব্যাপার গ্ৰামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রটাকে আরও উন্নত করা, সবাই মিলে চাঁদা তুলে চাপকল বসানো, রাস্তাঘাট ঠিক করা, কলেজটা আরও বড়ো করা আরও অনেক, ভারী ভালো ছেলে ডাক্তারবাবু যখন চলে গেলেন আমরা তো ভেবেছিলাম এবার ভেসেই যাবো কিন্তু তখন কি জানতাম যে উনি আমাদের জন্য আগেই আদিত্যকে এনে রেখেছেন"।
ছেলের সুখ্যাতি শুনে গর্বে অভিরূপবাবুর বুক ফুলে উঠতে থাকে মোড়লমশাই আরো কিছুক্ষণ আদিত্যর সুখ্যাতি করে তারপর আসল কথায় এলেন, "এখানে জমি আছে একটা, জমির যে বর্তমান মালিক সে এখানে থাকে না বাইরে থাকে আমাকে বলেছে বকে যে খদ্দের পেলে বিক্রি করে দেবে"
"বেশ তো তাহলে আমিই কিনবো, আপনি কথা বলুন"
"আপনারা আগে দেখে নিন জমিটা, এখন যেতে পারবেন?"
"কেন নয়? আমাদের তো এখন শুধু সময় আর সময়"
"তাহলে চলুন বেশী দূরে নয় আদিত্যর বাড়ির পাশেই ওকেও ডেকে নেওয়া যাবে"
মোড়লমশাই এর কথা শুনে অভিরূপবাবুর মুখে হাসি ফুটে উঠলো তিনি মনে মনে ঠিক করলেন ওই জমিটাই কিনবেন হাজার হোক ছেলের কাছে থাকতে পারবেন।
মোড়লমশাই জমিটা দেখালে সেটা অভিরূপবাবুদের পছন্দ হলো অবশ্য তিনি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছেন যে এটা কিনবেন কারণ এতে আদিত্যর কাছে থাকা যাবে, জমিটা একেবারে আদিত্যর বাড়ির পাশে না হলেও কাছেই।
"আপনি এখানে থাকবেন আপনার ফ্যামিলির বাকীরা এখানে আসবে?"
আদিত্য প্রশ্ন করে অভিরূপবাবুকে মোড়লমশাই ফোন করে ডেকে নিয়েছিলেন ওকে, আদিত্যও ঘুরে ঘুরে দেখছিল এবং একসময় প্রশ্নটা করলো তাতে অভিরূপবাবু শান্ত স্বরে বলেন "এটা শুধুমাত্র আমরা বুড়ো বুড়ির জন্য, আর এই স্বর্ণেন্দু আর সুদেষ্ণা মানে চার বুড়ো বুড়ির জন্য আর কারো জন্য নয়"
"কেন? যতদূর আমি জানি আপনার অনেক বড়ো পরিবার তাহলে সবাইকে ছেড়ে এই গ্ৰামে কেন?"
"তোমার কোনো আপত্তি আছে? তাহলে বলো"
"আমার আপত্তি থাকবে কেন? এই গ্ৰামে কারো আসায় বা থাকায় কারো কোনো আপত্তি থাকে না। কিন্তু কলকাতায় আমার যাতায়াত আছে সেই সূত্রে কিছু কথা জানতে পেরেছি আপনাদের সম্পর্কে এটা জানি যে আপনি এবং আপনার ছেলে পরস্পরের খুব ঘনিষ্ঠ তাই জিজ্ঞেস করলাম যে ওনাকে ছাড়া এখানে থাকবেন"
"ছেলে এখন বড়ো হয়েছে ওর নিজের সংসার হয়েছে ওকে ওর নিজের মতো থাকতে দেওয়াই ভালো"
"তাই বলে এখানে একা একা থাকবেন?"
"কি করবো বলো? সবই ভাগ্য এইসময় আমার ছোটো ছেলেটা যদি সাথে থাকতো"
"আপনার ছোটো ছেলে? ও হ্যাঁ মনে পরেছে আপনি বলেছিলেন বটে যে সে একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে"
"কে বলতে পারে হয়তো বেঁচে আছে কিন্তু আমাদের উপর কোনো কারনে রেগে আছে তাই বাবা মায়ের কাছে আসছে না"
অভিরূপবাবুর কথা শুনে আদিত্য থমকে গেল তার দৃষ্টি সোজা অভিরূপবাবুর দিকে, অভিরূপবাবুও সোজা তার দিকে তাকিয়ে আছেন কিছুক্ষণ কারো মুখে কোনো কথা নেই কিন্তু দুজনেই যেন নিঃশব্দে অনেক কথা বলে নিল।
জমি দেখা শেষে অভিরূপবাবু মোড়লমশাইকে জানিয়ে দিলেন যে এই জমি তার পছন্দ তিনি কিনতে চান, রিসর্টে ফিরে যেতে যেতে আদিত্য অভিরূপবাবুদের নিজের বাড়িতে লাঞ্চে নিমন্ত্রণ করলো,
"যদি অসুবিধা না থাকে তাহলে আপনারা সবাই আজ দুপুরের খাওয়াটা আমার বাড়িতে আমার আর পিয়ালীর সাথে খাবেন?খাবারটা অবশ্য রিসর্ট থেকেই আসবে কারণ এখানকার সবাই পিয়ালীকে এখন রান্না করতে বারণ করেছে আর আমি রান্না পারি না তাই আমাদের খাবারও রিসর্ট থেকেই আসে"
"তুমি কি রিসর্টের সব গেস্টকেই নিজের বাড়িতে ইনভাইট করো?" অভিরূপবাবু জিজ্ঞেস করলেন,
"না সেটা করি না সবাই তো আর আমার বাড়িতে এসে পরিচয় করে যায় না, তাদের সঙ্গে আমার সরাসরি কোনো যোগাযোগ থাকেও না"।
"বেশ তাই হবে"
"থ্যাংকস, আসুন"।
এরপর যেকটা দিন অভিরূপবাবুরা রিসর্টে ছিলেন আদিত্যদের সঙ্গে বেশিরভাগ সময় কাটাতেন, শ্রীতমাদেবী পিয়ালীকে তার বর্তমান অবস্থায় উপযোগী অনেক পরামর্শ দিলেন দেখে মনে হচ্ছি যেন একটা সুখী পরিবার। তবে ঝামেলা হচ্ছিল পিউ আর টোবোকে নিয়ে পিউ এখন তার সুপারম্যান আঙ্কেল আর আন্টিকে ছেড়ে যেতে চায় না আর অপরদিকে টোবোও আদিত্যর পায়ে পায়ে ঘোরে তার সাথে খেলতে চায় এটা দেখে বাদশা আবার রেগে গর্জন করতে থাকে সে তার মালিকের আশেপাশে অন্য কোনো স্বজাতিকে ঘেঁষতে দিতে নারাজ শেষপর্যন্ত আদিত্যই কোনোমতে বুঝিয়ে ঠাণ্ডা করে।
কদিন পরে অভিরূপবাবুরা চলে গেলে আদিত্য আর পিয়ালী আবার আগের নিস্তরঙ্গ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায় এতে পিয়ালীর কিছুটা মনখারাপ হয়ে গেল আদিত্য ওকে কোনোমতে বুঝিয়ে খুশী রাখার চেষ্টা করে যদিও তার নিজেরও কম কষ্ট হচ্ছে না। অভিরূপবাবু যাবার আগে মোড়লকে বারবার বলে গেছেন জমিটা তিনি কিনবেন নেহাত যদি এটা না বিক্রি হয় তাহলে গ্ৰামের অন্য জমি দেখে দিতে মোটকথা তিনি এখানে বাড়ি বানিয়ে থাকবেন।
I'm the King of Dark
&
I rule over all Devils

