14-07-2023, 03:19 PM
|| ফাইটার ||
কার্যত আদাজল খেয়ে লিখে ফেলেছিলেন একটি উপন্যাস৷ একদিন সেই উপন্যাস জমা দিলেন 'উল্টোরথ' পত্রিকা দপ্তরে৷ ১৫০টি পাণ্ডুলিপি জমা পড়েছিল।
তারপর দীর্ঘ অপেক্ষা, এর মধ্যে তরুণ লেখক 'পরিচয়' পত্রিকায় একটি কাজও জুটিয়ে নিয়েছেন৷ নিয়মিত প্রুফ দেখেন,গল্পের প্রাথমিক বাছাইয়ের কাজও করেন। সেদিন রাত করে বাড়ি ফিরেছেন , তাঁর মা তাঁকে বললেন দু'জন ভদ্রলোক এসেছিলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করবেন৷ তিনি নাকি কি একটা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছেন৷ তিন নম্বরে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বিতীয় পূর্ণেন্দু পত্রীকে ছাপিয়ে প্রথম যিনি হয়েছিলেন তিনি সাহিত্যিক , সাংবাদিক মতি নন্দী। উপন্যাসের নাম ছিল 'ধুলো মাটি বালি'৷ পরামর্শক্রমে মতি নন্দী নামটা বদল করে রেখেছিলেন 'নক্ষত্রের রাত'৷ বেশিরভাগ বাঙালি পাঠকদের কাছে মতি নন্দীর জনপ্রিয়তা স্ট্রাইকার-স্টপার-কোনি এই তিন খেলা ভিত্তিক কিশোর উপন্যাসের লেখক হিসেবে।অনেক পাঠক আজও তাঁর 'স্ট্রাইকার' উপন্যাস পড়তে বসলে কেঁদে ফেলেন৷ সিনেমায় সাঁতারের প্রশিক্ষক ক্ষিদ্দার সেই অবিস্মরণীয় সংলাপ 'ফাইট কোনি ফাইট' অমর হয়ে আছে মুক্তির পর থেকেই।
সদ্য তরুণ মতি নন্দী তখন মনীন্দ্র কলেজের ছাত্র৷ ক্রিকেট খেলেন সঙ্গে ময়দানে নিয়মিত ক্রিকেট দেখেন৷ সাহিত্যচর্চা চলে একই স্রোতে৷ লিখছেন তবে ছাপাবার আর সাহস হয় না৷ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর খবর পেয়েছেন৷ শোকসভা হবে ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউটে৷ গুটিগুটি পায়ে সেখানে গেলেন৷ শোকসভায় সাহিত্যিকদের মেলা,বলা যেতে পারে নক্ষত্রের সমারোহ৷ সেখানে 'উল্টোরথ' পত্রিকা ঘোষণা করল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিতে একটা উপন্যাস প্রতিযোগিতা হবে৷ তিনটি পুরস্কার থাকবে এবং পুরস্কারপ্রাপ্ত তিনটি লেখা প্রকাশিত হবে৷ বলা বাহুল্য প্রথম পুরস্কার মতি নন্দী পেয়েছিলেন।
খুব বড় সত্য হল মতি নন্দীর আগে কেউ খেলার জগতের অনুপুঙ্খ নিয়ে এমন নিঁখুত গল্প রচনা করেন নি৷ নিজের হাতে উসকে দিয়েছিলেন ক্রীড়া সাংবাদিকতার সলতেটিকে৷ গল্পের ভেতরে গল্প,বস্তুত মতি নন্দীর প্রবর্তিত স্টাইল বোধহয় এখনও সংবাদপত্র মেনে চলছে৷ মতি নন্দীর হাতে ছিল সোনার কলম,সেটা কাজে লাগিয়ে তিনি রচনার বৈদগ্ধে,পরিবেশনায় মুন্সীয়ানায় এবং খেলা সম্পর্কে গভীর উপলব্ধীর টানে পাঠকবর্গের শিক্ষিত মন জয় করলেন৷ ক্রীড়া সাংবাদিকতায় যুক্ত হয়েছিল অন্য মাত্রা৷ ক্রীড়া সাংবাদিকতার সম্ভ্রম বাড়িয়েছেন৷ এক্ষেত্রে তিনি অনন্য বটে৷ ছোট গল্প হল মতি নন্দীর আসল শক্তি৷ সেখানে যে বাস্তবতা আছে তা মানুষের মর্মমূল অবধি নাড়িয়ে দেয়৷ ছোটদের নিয়ে তাঁর অসাধারণ কাজ প্রশংসা করবেন তাঁর অতিবড় সমালোচক৷ আবার ক্রিকেট বা ফুটবল ম্যাচ রিপোর্টিং-এ কঠিন শব্দ ব্যবহার না করেও লেখনীর জোরে পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করতেন৷ অনেকে তাঁকে বাংলার নেভিল কার্ডাস বলতেন৷ তবে মতি নন্দী বলতেন কার্ডাস হলেন কার্ডাস ওঁকে নকল অসম্ভব৷ ব্রাডম্যানের শেষ টেস্টে শূন্যকে ঘিরে ওই লেখা কেউ লিখতে পারবেন?
১৫-১৬বছর আনন্দবাজার পত্রিকার ক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন৷ দেখেছেন ক্ষমতার অপব্যবহার৷ দেখেছেন গরিব-মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে-মেয়েদের অপুষ্টিজনিত অসুবিধা৷ নিরন্তর সংগ্রাম করে গেলে জয় অনিবার্য এই সংবাদ তিনি কিশোর পাঠকদের বলতে চেয়েছেন। কোনও অলৌকিক রহস্য-রোমাঞ্চ দিয়ে পাঠকদের মন ভোলাতে চান নি৷ পরিশেষে একটি ইন্টারেস্টিং তথ্য সংযোজন করতে ইচ্ছা হল আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার 'শিরোনাম' বের হত প্রতি সপ্তাহে৷ সংক্ষেপে বিখ্যাত ব্যক্তিদের চমৎকার ভাবে তুলে ধরতেন নিখিল সরকার অর্থাৎ শ্রীপান্থ৷ ওই ছকে প্রদীপ ব্যানার্জিকে নিয়ে লিখলেন চিত্তরঞ্জন বিশ্বাস৷ সেদিন থেকে তিনি হলেন চিরঞ্জীব,প্রখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক৷ এই নামকরণের নেপথ্যে তিনজন মতি নন্দী,অমিতাভ চৌধুরী এবং সন্তোষকুমার ঘোষ৷
কয়েকদিন আগে মতি নন্দীর জন্মদিন গেলো, তাঁর প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি রইলো।
তথ্যসূত্রঃ- ধ্রুবতারার খোঁজে