11-07-2023, 08:45 PM
ইউসুফ আর তার মায়ের কথোপকথন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে শুনতে সৈকতের নিজেকে तू कौन, मैं खामखा মনে হচ্ছিলো। তার মা রান্নাঘর থেকে জল আনতে গেলে সৈকত ইউসুফের কাছে গিয়ে খুব মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করলো, "সত্যিই কি আমাদের কলেজ নিয়ে কোনো ডকুমেন্টারি হচ্ছে? আর তুমি কি এইটার সঙ্গে যুক্ত রয়েছো? তা না হলে এই ভিডিও কি করে এলো?"
সৈকতের প্রশ্নের উত্তরে মুচকি হেসে ইউসুফ বললো, "তোর মা না হয় একজন গৃহবধূ , বেশিদূর পড়াশোনা করেনি, ঘরেই থাকে, বাইরের জগত সম্পর্কে ধারণা নেই। তাই ভিডিওটা দেখে কিছু বুঝতে পারেনি। কিন্তু তুই একজন শিক্ষিত ছেলে হয়ে এই ভুল কি করে করলি? ডকুমেন্টারি ঠিক নয়, তবে হুগলি ডিস্ট্রিক্টের বেশ কিছু কলেজের ইতিহাস এবং বর্তমান নিয়ে বছর পাঁচেক আগে একটা সংস্থার পক্ষ থেকে এই ভিডিওটা করা হয়েছিলো। কাল রাতে তোর সঙ্গে কথা বলার পর নেট থেকে সেই ভিডিওটা ডাউনলোড করে শুধু তোদের কলেজের অংশটা সফটওয়্যার দিয়ে কেটে নিয়েছি। তারপর ভিডিওটার একেবারে শেষে এসে আমার ওই ফটোটা অ্যাটাচ করে দিয়ে নতুন একটা প্যাকেজ বানিয়ে ফেললাম .. যাতে আমার ছবিটা তোর মায়ের চোখে পড়ে। তবে একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, ভিডিওটার বাঁদিকে নিচে ছোট্ট করে ডেট দেওয়া রয়েছে .. যেটা পাঁচ বছর আগেকার। এই ব্যাপারটা তোর মায়ের চোখে পড়বে না, আমি খুব ভালো করেই জানতাম।"
কথাগুলো শোনার পর ইউসুফ সম্পর্কে সৈকতের শুধু একটাই কথা মনে হলো .. 'জিনিয়াস'।
"এটা সুগার-ফ্রি মিষ্টি .. আমার হাতে মিষ্টি খেলে সেই মিষ্টির মিষ্টতা হাজারগুণ বেড়ে গেলেও আপনার সুগার হওয়ার ভয় নেই। তাই চটপট খেয়ে ফেলুন এই দুটো।" রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে একহাতে প্লেটে করে দুটো সুগার ফ্রি সন্দেশ আর অন্য হাতে একগ্লাস জল নিয়ে এসে হাসতে হাসতে বললেন বন্দনা দেবী।
- "সুগার ফ্রি মিষ্টি কেনো? আপনার কি সুগার আছে ম্যাডাম?"
- "না না, আমার ওসব কিছু নেই। ওর বাবা একজন সুগারের পেশেন্ট। তাই বাড়িতে মিষ্টি আনলে বেশিরভাগ সময় সুগার-ফ্রি আনা হয়।"
"ঠিক আছে এবার আমাকে উঠতে হবে। ওহো একটা জিনিসের কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম। কলেজের যে সাতজন স্টুডেন্টস এই প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে তাদেরকে একটা করে স্মার্টফোন দেওয়া হচ্ছে আমার মানে আমাদের সংস্থার তরফ থেকে। আপনার ছেলে যদিও বুদ্ধিমত্তার দিক দিয়েই বলুন আর ভালো রেজাল্ট করার দিক দিয়েই বলুন, কলেজের সেরা ছাত্রদের মধ্যে নেই .. এটা আপনিও ভালো করে জানেন। ও সিলেক্ট হয়েছে শুধুমাত্র আমার জন্য। যাক সে কথা, এই যে স্মার্টফোনটা।" সৈকতের মায়ের আনা মিষ্টিদুটো টপাটপ মুখের ভেতরে চালান করে দিয়ে কথাগুলো বলতে বলতে ব্যাগের ভেতর থেকে বিদেশি কোম্পানির ব্র্যান্ড নিউ ফোনের সিল করা একটা প্যাকেট বের করে বন্দনা দেবীর হাতে দিলো ইউসুফ।
"ও মা .. প্যাকেটের গায়ে তো অনেক দাম লেখা রয়েছে! এত দামী ফোন ওকে দিচ্ছেন আপনারা? কিন্তু ওকে তো আমরা এখনো এই ফোন ব্যবহার করতে দিই না। ওর বাবা অবশ্য বলেছে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করলে ওকে একটা স্মার্টফোন কিনে দেবে। ফোনটা কি ওকে দেওয়া খুব দরকার? মানে ওকে কি কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো নথি পাঠাবেন আপনারা?" ফোনের বাক্সটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন বন্দনা দেবী।
- "আপনারা যে এখনো আপনাদের ছেলেকে স্মার্টফোন ব্যবহার করতে দেন না, খুব ভালো লাগলো ম্যাডাম এই কথাটা শুনে। এখন তো দেখি ফাইভ সিক্সে পড়া বাচ্চারা নিজেদের হাতের যা দৈর্ঘ্য, তার থেকে বড় স্মার্টফোন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। না না, ওকে আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ডকুমেন্টস কি পাঠাবো আমরা? সেরকম কিছুই নয়। এটা জাস্ট একটা ফর্মালিটিজ। আচ্ছা ম্যাডাম আপনি কি স্মার্টফোন ব্যবহার করেন?"
- "নাহ্ .. আমার একটা এমনি ছোট ফোন আছে, ওটাই ব্যবহার করি।"
এমনিতেই বিনা দোষে এবং ইউসুফের চালাকির জন্য মায়ের কাছে তখন বকুনি খেয়েছে সে। তার উপর অত বড় ডেয়ারি-মিল্ক সিল্কটাও তার মায়ের জিম্মায় চলে গেছে। সে ভালো করেই জানে ক্যাডবেরি অন্তঃপ্রাণ তার মা তাকে ওখান থেকে একটা টুকরোও দেবেনা। তবে একটা ব্যাপার সে ভেবে অবাক হলো .. ইউসুফ তো তাকে বলেছিলো, ওর ব্যবহার করা পুরনো স্মার্টফোন তাকে দেবে। কিন্তু এটা তো সিল করা একটা ব্র্যান্ড নিউ ফোন! এই ছেলেটা কখন যে কি বলে, আর কি করে তার কোনো ঠিক নেই! যাইহোক, এখন যদি ফোনটাও হাতছাড়া হয়ে যায়! এই আশঙ্কায় সৈকত আমতা আমতা করে বললো, "ইউসুফ ভাই যখন ওটা আমার জন্য এনেছে, তখন আমি নিলে ক্ষতি তো কিছু নেই .."
"আছে, অবশ্যই ক্ষতি আছে। রাস্তায় আসতে আসতে তোর মুখ থেকেই শুনেছি তোর বাবা তোকে কম্পিউটার কিনে দিয়েছে, ইন্টারনেট লাগিয়ে দিয়েছে। ওটাতে যেরকম অনলাইন ক্লাস করছিস, কর। টুকটাক গেম খেলছিস, খেল। এতে পড়াশোনার কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু এই ফোনটা হাতে পেলে সারাদিন ফোন নিয়ে কুটুর কুটুর করবি। তখন পড়াশোনা মাথায় উঠবে। তাছাড়া তোর বাবা যখন বলেছে গ্রাজুয়েশন করার পর তোকে স্মার্টফোন কিনে দেবে তখন দায়িত্বটা ওনাকেই পালন করতে দেওয়া উচিৎ। আমি যদি এখন আগ বাড়িয়ে তোকে এই ফোনটা দিই, তাহলে ওনাকে অসম্মান করা হবে। আমি কিছু ভুল বললাম ম্যাডাম?" অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে অথচ দৃঢ় কন্ঠে কথাগুলো বললো ইউসুফ।
"একদম ঠিক বলেছেন আপনি। আপনাকে যত দেখছি তত অবাক হয়ে যাচ্ছি আমি। আপনার মতো এরকম একজন স্মার্ট অল্পবয়সী ছেলের মধ্যেও যে এত রুচিশীল চিন্তাধারা থাকতে পারে, এটা আমি ভাবতেও পারিনা। আচ্ছা, তাহলে কি আপনি ফোনটা ফেরত নিয়ে যাবেন?" ইউসুফের কথার তালে তাল দিয়ে নিজের বক্তব্য রাখলেন বন্দনা দেবী।
"একদমই না, এনেছি যখন ফেরত নিয়ে যাবো কেনো? তাছাড়া এটা নিয়ে গেলে আমাকে ফেলে দিতে হবে। আমার অলরেডি দুটো স্মার্টফোন রয়েছে, আমি তো আর ইউজ করতে পারবো না! তাছাড়া আজকে আপনার ছেলের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে একটা অফিসিয়াল মেসেজ করা হবে আমাদের পক্ষ থেকে। আপনাদের বাড়িতে তো কারোর স্মার্টফোন নেই শুনলাম, তাই ফোনটা একদিনের জন্য হলেও রাখতে হবে আপনাদের কাছে। আমি একটা কথা বলবো ম্যাডাম? ফোনটা আপনার কাছে রেখে দিন। আজকে রাতের দিকেই আপনার ছেলের জন্য যে মেসেজটা আসবে আমাদের সংস্থার পক্ষ থেকে, সেটা রিসিভ করে তারপর সময় সুযোগ করে ফোনটা আমাকে ফেরত দিয়ে দিলেই হবে। তবে হ্যাঁ, একটা কথা বলে দিচ্ছি আপনার ছেলের ভালোর জন্যই। ওর হাতে একদম এই ফোন দেবেন না। আপনি যে ফোনটা ব্যবহার করেন সেটা আমাকে দিন আমি ওখান থেকে সিমকার্ডটা খুলে এই ফোনে ঢুকিয়ে দিচ্ছি। এনি প্রবলেম ম্যাডাম?" বন্দনা দেবীর চোখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে কথাগুলো বললো ইউসুফ
"না, প্রবলেম কিছু নেই। নিয়ম অনুযায়ী যখন আমার ছেলেকে কি একটা মেসেজ করবেন বলছেন আপনারা, তখন তো ফোনটা রাখতেই হবে। কিন্তু আমি তো আমি তো এইসব ফোন ব্যবহার করতে পারি না। তাছাড়া ওই হোয়াটসঅ্যাপ না কি যেন বলছেন, সেটাও কি করে করতে হয় আমি জানিনা।" সোফার পাশে রাখা নিজের ছোট ফোনটা ইউসুফের হাতে দিয়ে উক্তি করলেন বন্দনা দেবী।
"হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করা, বলা ভালো স্মার্টফোন ব্যবহার করাটা এমন কিছু হাতি-ঘোড়া ব্যাপার নয়। এর থেকে আপনার রান্নাবান্না, ঘরের কাজ অনেক বেশি কঠিন। দেখি দাঁড়ান, আপনার ফোনের সিমটা আবার এই ফোনের মধ্যে ঢুকবে কিনা বুঝতে পারছি না, এটাতে তো মাইক্রো-সিম লাগে। না, হয়ে গেছে দেখছি। মনে হয় আপনার এই সিমকার্ডটা নতুন নেওয়া হয়েছে। সেইজন্য এটাতে মাইক্রো, ম্যাক্রো আর ছোট ফোনের জন্য বড় সিম .. তিনটেরই অপশন রয়েছে।" কথাগুলো বলতে বলতে নতুন স্মার্টফোনটার মধ্যে তার মায়ের পুরনো ছোট ফোন থেকে সিমটা বের করে ঢুকিয়ে দিয়ে অন করলো ইউসুফ।
"ও হো, একটা বিষয় তো খেয়ালই করিনি! আপনার তো দেখছি নেট প্যাক ভরা নেই। অবশ্য না থাকাটাই স্বাভাবিক। ওটা না থাকলে হোয়াটসঅ্যাপ কেন, ফোন অপারেট করাই যাবে না। ঠিক আছে চিন্তা নেই আমি এক্ষুনি এক মাসের জন্য নেট প্যাকের রিচার্জ করে দিচ্ছি।" কথাটা বলেই ইউসুফ নিজের পকেট থেকে একটার বদলে দু'টো ফোন বের করলো।
"ওহ্ , আবার রিচার্জ করতে হবে? ঠিক আছে আপনি যখন করছেন করে দিন, কত টাকার কার্ড ভরলেন বলুন, আমি দিয়ে দিচ্ছি।" কিছুটা অবাক হয়েই কথাগুলো জিজ্ঞাসা করলেন বন্দনা দেবী।
"আমি মোবাইলের দোকান চালাই না ম্যাডাম। তাই রিচার্জের টাকা আপনার থেকে নিতে পারবো না। প্লিজ এই কথাগুলো বলবেন না .. খারাপ লাগে। একটা মোবাইলে সামান্য রিচার্জ করে দিয়েছি এর বেশি তো কিছু নয় .." বন্দনা দেবীর কথায় মনক্ষুন্ন হয়েছে এইরকম একটা ভঙ্গি করে বেশ গম্ভীরভাবে কথাগুলো বললো ইউসুফ। এরপর আর কিছুই বলার থাকতে পারে না। তাই মৃদু হেসে চুপ করে গেলেন বন্দনা দেবী।
সে আঠারো বছর পেরিয়ে গিয়ে কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে উঠে গেলেও তার মুঠোফোন ব্যবহার করার অনুমতি নেই। অথচ সৈকত লক্ষ্য করলো স্মার্টফোন কি? খায় না মাথায় মাখে? এই সবকিছুর সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকা তার ঊনচল্লিশ বছর বয়সী মা কিছুক্ষণের মধ্যেই ইউসুফের প্রশিক্ষণে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ আসলে সেটা দেখা আর মেসেজ করার ব্যাপারটা বেশ ভালোভাবে রপ্ত করে নিলো। এছাড়াও ফোন অন এবং অফ করা, ফোনের আরও কয়েকটা টুকিটাকি ফাংশন সম্পর্কে জেনে নিলো তার মা।
"এতকিছু জানার বা শেখার অবশ্য দরকার ছিলো না, এটাতো কালকেই আপনাকে ফেরত দিয়ে দেবো। তবে শিখে নিয়ে এক বিষয়ে ভালোই হলো। ভবিষ্যতে যদি কোনোদিন এই ধরনের ফোন কিনি, তাহলে কাজে লেগে যাবে আজকের এই শেখাটা।" এতদিন আড়াই ইঞ্চি স্ক্রিনের ছোট মাল্টিমিডিয়া ফোন ইউজ করা বন্দনা দেবী মুখে এই কথাগুলো বললেও, বিদেশি কোম্পানির সাড়ে ছয় ইঞ্চি স্ক্রিনের স্মার্টফোনটা হাতে নিয়ে যেভাবে মুগ্ধদৃষ্টিতে ওটার দিকে তাকিয়ে ছিলো, সেটা দেখে ইউসুফ বুঝতে পারলো ফোনটার প্রেমে পড়ে গেছে সৈকতের মা। আসলে, সে তো এটাই চেয়েছিলো।
"কোন বিদ্যা কোথায় কাজে লেগে যায় সেটা কি আগে থেকে কেউ বলতে পারে? না মানে আপনার স্মার্টফোনের ব্যবহার শেখার কথা বলছিলাম। ঠিক আছে আজ তাহলে আসি! আশা রাখি, আবার নিশ্চয়ই আমাদের খুব তাড়াতাড়ি দেখা হবে।" কথাগুলো বলে তাদের বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়ার আগে সানগ্লাসটা পড়ে নিয়ে সেটা আবার চোখ থেকে নামিয়ে সৈকতের দিকে তাকিয়ে এক চোখ টিপে একটা গা জ্বালানো হাসি হেসে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে খুব আস্তে আস্তে ইউসুফ বললো, "মায়ের প্রতি কনফিডেন্সের কি ভাটা পড়িয়াছে ভাই সৈকত?"
অন্তর্জালের পাথর খুঁদে মরীচিকার হাতছানিতে যে ঝুঁকিপূর্ণ পথ সে তৈরি করেছে। এখন সেই পাথর ক্ষয়ে ক্ষয়ে নুঁড়িরা জমা হচ্ছে তারই তৈরি করা সেই উদ্দেশ্যহীন পথে। পুনরায় নুড়ি থেকে পাথর আর পাথর থেকে পাহাড় সৃষ্টি হয়ে আরো বিপদজনক হয়ে যাচ্ছে সেই পথ। কিন্তু রনে ভঙ্গ না গিয়ে বিকৃত যৌনসুখের সেই মরীচিকার হাতছানিতে ক্রমাগত একটার পর একটা পাহাড় ডিঙোনোর চেষ্টা করছে সে। আগুনের পায়ে হেঁটে যাচ্ছে আগুনের ভিতর। ক্ষণিকের সুখের আশায় এই পৃথিবীর এজলাসে একা সূর্যের মতো উঠছে, আবার আদ্যোপান্ত চক্রান্তের শিকার হয়ে অস্ত যাচ্ছে বার বার। রয়্যাল এনফিল্ডটা স্টার্ট দিয়ে তার মুখে একরাশ কালো ধোঁয়া ছেড়ে ইউসুফের বাইকটা হুশ করে বেরিয়ে যাওয়ার পর সেই দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো সৈকতের ভেতর থেকে।
সকালে কলেজের গেটের সামনে ইউসুফের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে অনেক প্রশ্ন জমে ছিলো সৈকতের মনের মধ্যে। অন্য দিনের মতো আজকেও তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে সাড়ে ন'টার সময় কম্পিউটার খুলে মেসেঞ্জার অন করে আলফা গ্রেট ওরফে ইউসুফকে "হাই" লিখে মেসেজ করলো সে। কোনো রিপ্লাই এলো না অপরপ্রান্ত থেকে। আসবে কি করে? উল্টোদিকের ব্যক্তি তো অনই হয়নি মেসেঞ্জারে!
সাড়ে ন'টা থেকে দশটা, দশটা থেকে সাড়ে দশটা, সাড়ে দশটা থেকে এগারোটা .. ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চললো নিজের গতিতে। তার পছন্দের পর্ন সাইটগুলোতে ঘুরে আসার ফাঁকে সৈকত একবার করে ঢুঁ মেরে যাচ্ছিলো মেসেঞ্জারে। অথচ প্রতিবারই বিফল মনোরথ হয়ে ফিরতে হচ্ছিলো তাকে। অন্যদিন হলে এতক্ষনে তার মা বারকয়েক এসে "আর পড়াশোনা করতে হবে না। অনেক রাত হয়েছে, ঘুমিয়ে পড় .." এই বলে তাকে কম্পিউটার বন্ধ করে শুয়ে পড়ার জন্য তাগাদা দিয়ে যেতো। কিন্তু আজ সে লক্ষ্য করলো, তার মা দশটা নাগাদ খেয়েদেয়ে নিজের বেডরুমে ঢোকার পর আর সেখান থেকে বেরোননি। হয়তো শরীরটা ভালো নেই তার মায়ের, তাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছে .. এটাই মনে করলো সৈকত।
ইউসুফের মেসেজের জন্য অপেক্ষা করে করে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে এগারোটার কিছু পরে কম্পিউটার অফ করতে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে সৈকতের মেসেঞ্জারে "হ্যালো .." মেসেজ ঢুকলো আলফা গ্রেট ওরফে ইউসুফের।
পার্কে প্রেমিকের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর অবশেষে প্রেমিকের আগমন ঘটলে প্রেমিকা যেমন অভিযোগের সুরে হামলে পড়ে তার ওপর! ঠিক তেমনভাবেই ইউসুফের মেসেজ দেখে, "কি করছিলে এতক্ষণ তুমি? প্রায় দু'ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছি তোমার জন্য। তোমার সেই মেয়েরূপী পুরুষ ভার্চুয়াল বন্ধুটির সঙ্গে সেক্স চ্যাট করছিলে? নাকি অন্য কিছু?" এরকম একটা ঝাঁঝালো প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দিলো তার দিকে।
- "ওলে বাবা লে .. ছেলের খুব অভিমান হয়েছে দেখছি। খুব মিস করছিলিস আমাকে, তাই না? কি আর করা যাবে? আমার সঙ্গে যাদেরই পরিচয় হয়, তারাই আমার জন্য এরকম পাগল হয়ে ওঠে। তবে তোর মতো ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে সারাদিন কম্পিউটারের সামনে বসে থাকলে তো আমার চলে না, কাজ করে খেতে হয় আমাকে। একটা এসাইনমেন্ট ছিলো, বাড়িতে ফিরতে ফিরতে পৌনে দশটা হয়ে গিয়েছে। তারপরে ফ্রেশ হয়ে ডিনার করতে করতে একজনের সঙ্গে এতক্ষণ ধরে কথা বলছিলাম। তাই আসতে একটু দেরি হয়ে গেলো। তুই এখনো জেগে রয়েছিস?"
"হ্যাঁ, কারণ তোমাকে কিছু কথা জিজ্ঞাসা করার আছে।" প্রথমে এইটুকু টাইপ করে তারপর 'ইউসুফ ভাই তো তাকে তার ব্যবহার করা পুরনো স্মার্টফোনটা দেবে বলেছিলো। কিন্তু তার বদলে সে প্রায় বারো হাজার টাকার মূল্যের একটা দামী নতুন ফোন কিনে নিয়ে এলো কেন? ফোনটা নিয়ে এলো, কিন্তু তাকে দিলো না ফোনটা। তার মা .. যিনি টেকনোলজির বিপরীত মেরুতে হেঁটে এসেছে এতদিন। সোশ্যাল মিডিয়া তো দুরস্থান, স্মার্টফোন কি করে ব্যবহার করতে হয় সেটার সম্পর্কেই তার কোনো ধারণা ছিলো না! তাকে হঠাৎ এইরকম একটা দামী ফোন দেওয়ার কি মানে থাকতে পারে!' এই সব কথাগুলো একে একে জিজ্ঞাসা করলো।
- "মিউচুয়াল ফান্ডের ফান্ডা বুঝিস? ও, তুই কি করে বুঝবি? তুই তো একটা আকাট বেকার! যাই হোক, ওখানে ইনভেস্ট করা হয় ভবিষ্যতে লং টার্মের জন্য ফল পাওয়ার আশায়। এক্ষেত্রেও তাই, তবে এটা তো কিছুই নয়। ভবিষ্যতে এর থেকে আরোও অনেক বেশি ইনভেস্টমেন্ট হবে আমার প্রোডাক্টের উপর। তবে তুইও ছুটকো-ছাটকা কিছু পাবি, চিন্তা করিস না। আরে বলেছি যখন, আমার পুরনো মোবাইলটা তোকে দেবো। আজ একটা বিশেষ কারণে তোকে দিইনি, এর পরেরদিন দিয়ে দেবো আর তার সঙ্গে কারণটাও জানাবো। ওটা কোনো ইস্যুই নয়।"
- "ইনভেস্টমেন্ট, প্রডাক্ট, লং টার্ম .. এইসব কি বলছো, কিছুই বুঝতে পারছি না।
- "পারবি পারবি এক্ষুনি বুঝতে পারবি। বেশি ভাট না বকে তোর মেসেঞ্জারে যেটা পাঠাচ্ছি, সেটা চুপচাপ দ্যাখ।"
ইউসুফ ভাই এই মেসেজটা করার মিনিটখানেকের মধ্যে সে দেখলো তার মেসেঞ্জারে একটার পর একটা ইমেজ ফাইল ঢুকতে থাকলো। সবগুলো ইমেজ ঢোকার পর প্রথম ফাইলটা ওপেন করে সৈকত দেখলো ওটা তার মা আর ইউসুফ ভাইয়ের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের স্ক্রিনশট।
সৈকতের প্রশ্নের উত্তরে মুচকি হেসে ইউসুফ বললো, "তোর মা না হয় একজন গৃহবধূ , বেশিদূর পড়াশোনা করেনি, ঘরেই থাকে, বাইরের জগত সম্পর্কে ধারণা নেই। তাই ভিডিওটা দেখে কিছু বুঝতে পারেনি। কিন্তু তুই একজন শিক্ষিত ছেলে হয়ে এই ভুল কি করে করলি? ডকুমেন্টারি ঠিক নয়, তবে হুগলি ডিস্ট্রিক্টের বেশ কিছু কলেজের ইতিহাস এবং বর্তমান নিয়ে বছর পাঁচেক আগে একটা সংস্থার পক্ষ থেকে এই ভিডিওটা করা হয়েছিলো। কাল রাতে তোর সঙ্গে কথা বলার পর নেট থেকে সেই ভিডিওটা ডাউনলোড করে শুধু তোদের কলেজের অংশটা সফটওয়্যার দিয়ে কেটে নিয়েছি। তারপর ভিডিওটার একেবারে শেষে এসে আমার ওই ফটোটা অ্যাটাচ করে দিয়ে নতুন একটা প্যাকেজ বানিয়ে ফেললাম .. যাতে আমার ছবিটা তোর মায়ের চোখে পড়ে। তবে একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, ভিডিওটার বাঁদিকে নিচে ছোট্ট করে ডেট দেওয়া রয়েছে .. যেটা পাঁচ বছর আগেকার। এই ব্যাপারটা তোর মায়ের চোখে পড়বে না, আমি খুব ভালো করেই জানতাম।"
কথাগুলো শোনার পর ইউসুফ সম্পর্কে সৈকতের শুধু একটাই কথা মনে হলো .. 'জিনিয়াস'।
"এটা সুগার-ফ্রি মিষ্টি .. আমার হাতে মিষ্টি খেলে সেই মিষ্টির মিষ্টতা হাজারগুণ বেড়ে গেলেও আপনার সুগার হওয়ার ভয় নেই। তাই চটপট খেয়ে ফেলুন এই দুটো।" রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে একহাতে প্লেটে করে দুটো সুগার ফ্রি সন্দেশ আর অন্য হাতে একগ্লাস জল নিয়ে এসে হাসতে হাসতে বললেন বন্দনা দেবী।
- "সুগার ফ্রি মিষ্টি কেনো? আপনার কি সুগার আছে ম্যাডাম?"
- "না না, আমার ওসব কিছু নেই। ওর বাবা একজন সুগারের পেশেন্ট। তাই বাড়িতে মিষ্টি আনলে বেশিরভাগ সময় সুগার-ফ্রি আনা হয়।"
"ঠিক আছে এবার আমাকে উঠতে হবে। ওহো একটা জিনিসের কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম। কলেজের যে সাতজন স্টুডেন্টস এই প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে তাদেরকে একটা করে স্মার্টফোন দেওয়া হচ্ছে আমার মানে আমাদের সংস্থার তরফ থেকে। আপনার ছেলে যদিও বুদ্ধিমত্তার দিক দিয়েই বলুন আর ভালো রেজাল্ট করার দিক দিয়েই বলুন, কলেজের সেরা ছাত্রদের মধ্যে নেই .. এটা আপনিও ভালো করে জানেন। ও সিলেক্ট হয়েছে শুধুমাত্র আমার জন্য। যাক সে কথা, এই যে স্মার্টফোনটা।" সৈকতের মায়ের আনা মিষ্টিদুটো টপাটপ মুখের ভেতরে চালান করে দিয়ে কথাগুলো বলতে বলতে ব্যাগের ভেতর থেকে বিদেশি কোম্পানির ব্র্যান্ড নিউ ফোনের সিল করা একটা প্যাকেট বের করে বন্দনা দেবীর হাতে দিলো ইউসুফ।
"ও মা .. প্যাকেটের গায়ে তো অনেক দাম লেখা রয়েছে! এত দামী ফোন ওকে দিচ্ছেন আপনারা? কিন্তু ওকে তো আমরা এখনো এই ফোন ব্যবহার করতে দিই না। ওর বাবা অবশ্য বলেছে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করলে ওকে একটা স্মার্টফোন কিনে দেবে। ফোনটা কি ওকে দেওয়া খুব দরকার? মানে ওকে কি কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো নথি পাঠাবেন আপনারা?" ফোনের বাক্সটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন বন্দনা দেবী।
- "আপনারা যে এখনো আপনাদের ছেলেকে স্মার্টফোন ব্যবহার করতে দেন না, খুব ভালো লাগলো ম্যাডাম এই কথাটা শুনে। এখন তো দেখি ফাইভ সিক্সে পড়া বাচ্চারা নিজেদের হাতের যা দৈর্ঘ্য, তার থেকে বড় স্মার্টফোন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। না না, ওকে আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ডকুমেন্টস কি পাঠাবো আমরা? সেরকম কিছুই নয়। এটা জাস্ট একটা ফর্মালিটিজ। আচ্ছা ম্যাডাম আপনি কি স্মার্টফোন ব্যবহার করেন?"
- "নাহ্ .. আমার একটা এমনি ছোট ফোন আছে, ওটাই ব্যবহার করি।"
★★★★
এমনিতেই বিনা দোষে এবং ইউসুফের চালাকির জন্য মায়ের কাছে তখন বকুনি খেয়েছে সে। তার উপর অত বড় ডেয়ারি-মিল্ক সিল্কটাও তার মায়ের জিম্মায় চলে গেছে। সে ভালো করেই জানে ক্যাডবেরি অন্তঃপ্রাণ তার মা তাকে ওখান থেকে একটা টুকরোও দেবেনা। তবে একটা ব্যাপার সে ভেবে অবাক হলো .. ইউসুফ তো তাকে বলেছিলো, ওর ব্যবহার করা পুরনো স্মার্টফোন তাকে দেবে। কিন্তু এটা তো সিল করা একটা ব্র্যান্ড নিউ ফোন! এই ছেলেটা কখন যে কি বলে, আর কি করে তার কোনো ঠিক নেই! যাইহোক, এখন যদি ফোনটাও হাতছাড়া হয়ে যায়! এই আশঙ্কায় সৈকত আমতা আমতা করে বললো, "ইউসুফ ভাই যখন ওটা আমার জন্য এনেছে, তখন আমি নিলে ক্ষতি তো কিছু নেই .."
"আছে, অবশ্যই ক্ষতি আছে। রাস্তায় আসতে আসতে তোর মুখ থেকেই শুনেছি তোর বাবা তোকে কম্পিউটার কিনে দিয়েছে, ইন্টারনেট লাগিয়ে দিয়েছে। ওটাতে যেরকম অনলাইন ক্লাস করছিস, কর। টুকটাক গেম খেলছিস, খেল। এতে পড়াশোনার কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু এই ফোনটা হাতে পেলে সারাদিন ফোন নিয়ে কুটুর কুটুর করবি। তখন পড়াশোনা মাথায় উঠবে। তাছাড়া তোর বাবা যখন বলেছে গ্রাজুয়েশন করার পর তোকে স্মার্টফোন কিনে দেবে তখন দায়িত্বটা ওনাকেই পালন করতে দেওয়া উচিৎ। আমি যদি এখন আগ বাড়িয়ে তোকে এই ফোনটা দিই, তাহলে ওনাকে অসম্মান করা হবে। আমি কিছু ভুল বললাম ম্যাডাম?" অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে অথচ দৃঢ় কন্ঠে কথাগুলো বললো ইউসুফ।
"একদম ঠিক বলেছেন আপনি। আপনাকে যত দেখছি তত অবাক হয়ে যাচ্ছি আমি। আপনার মতো এরকম একজন স্মার্ট অল্পবয়সী ছেলের মধ্যেও যে এত রুচিশীল চিন্তাধারা থাকতে পারে, এটা আমি ভাবতেও পারিনা। আচ্ছা, তাহলে কি আপনি ফোনটা ফেরত নিয়ে যাবেন?" ইউসুফের কথার তালে তাল দিয়ে নিজের বক্তব্য রাখলেন বন্দনা দেবী।
"একদমই না, এনেছি যখন ফেরত নিয়ে যাবো কেনো? তাছাড়া এটা নিয়ে গেলে আমাকে ফেলে দিতে হবে। আমার অলরেডি দুটো স্মার্টফোন রয়েছে, আমি তো আর ইউজ করতে পারবো না! তাছাড়া আজকে আপনার ছেলের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে একটা অফিসিয়াল মেসেজ করা হবে আমাদের পক্ষ থেকে। আপনাদের বাড়িতে তো কারোর স্মার্টফোন নেই শুনলাম, তাই ফোনটা একদিনের জন্য হলেও রাখতে হবে আপনাদের কাছে। আমি একটা কথা বলবো ম্যাডাম? ফোনটা আপনার কাছে রেখে দিন। আজকে রাতের দিকেই আপনার ছেলের জন্য যে মেসেজটা আসবে আমাদের সংস্থার পক্ষ থেকে, সেটা রিসিভ করে তারপর সময় সুযোগ করে ফোনটা আমাকে ফেরত দিয়ে দিলেই হবে। তবে হ্যাঁ, একটা কথা বলে দিচ্ছি আপনার ছেলের ভালোর জন্যই। ওর হাতে একদম এই ফোন দেবেন না। আপনি যে ফোনটা ব্যবহার করেন সেটা আমাকে দিন আমি ওখান থেকে সিমকার্ডটা খুলে এই ফোনে ঢুকিয়ে দিচ্ছি। এনি প্রবলেম ম্যাডাম?" বন্দনা দেবীর চোখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে কথাগুলো বললো ইউসুফ
"না, প্রবলেম কিছু নেই। নিয়ম অনুযায়ী যখন আমার ছেলেকে কি একটা মেসেজ করবেন বলছেন আপনারা, তখন তো ফোনটা রাখতেই হবে। কিন্তু আমি তো আমি তো এইসব ফোন ব্যবহার করতে পারি না। তাছাড়া ওই হোয়াটসঅ্যাপ না কি যেন বলছেন, সেটাও কি করে করতে হয় আমি জানিনা।" সোফার পাশে রাখা নিজের ছোট ফোনটা ইউসুফের হাতে দিয়ে উক্তি করলেন বন্দনা দেবী।
"হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করা, বলা ভালো স্মার্টফোন ব্যবহার করাটা এমন কিছু হাতি-ঘোড়া ব্যাপার নয়। এর থেকে আপনার রান্নাবান্না, ঘরের কাজ অনেক বেশি কঠিন। দেখি দাঁড়ান, আপনার ফোনের সিমটা আবার এই ফোনের মধ্যে ঢুকবে কিনা বুঝতে পারছি না, এটাতে তো মাইক্রো-সিম লাগে। না, হয়ে গেছে দেখছি। মনে হয় আপনার এই সিমকার্ডটা নতুন নেওয়া হয়েছে। সেইজন্য এটাতে মাইক্রো, ম্যাক্রো আর ছোট ফোনের জন্য বড় সিম .. তিনটেরই অপশন রয়েছে।" কথাগুলো বলতে বলতে নতুন স্মার্টফোনটার মধ্যে তার মায়ের পুরনো ছোট ফোন থেকে সিমটা বের করে ঢুকিয়ে দিয়ে অন করলো ইউসুফ।
"ও হো, একটা বিষয় তো খেয়ালই করিনি! আপনার তো দেখছি নেট প্যাক ভরা নেই। অবশ্য না থাকাটাই স্বাভাবিক। ওটা না থাকলে হোয়াটসঅ্যাপ কেন, ফোন অপারেট করাই যাবে না। ঠিক আছে চিন্তা নেই আমি এক্ষুনি এক মাসের জন্য নেট প্যাকের রিচার্জ করে দিচ্ছি।" কথাটা বলেই ইউসুফ নিজের পকেট থেকে একটার বদলে দু'টো ফোন বের করলো।
"ওহ্ , আবার রিচার্জ করতে হবে? ঠিক আছে আপনি যখন করছেন করে দিন, কত টাকার কার্ড ভরলেন বলুন, আমি দিয়ে দিচ্ছি।" কিছুটা অবাক হয়েই কথাগুলো জিজ্ঞাসা করলেন বন্দনা দেবী।
"আমি মোবাইলের দোকান চালাই না ম্যাডাম। তাই রিচার্জের টাকা আপনার থেকে নিতে পারবো না। প্লিজ এই কথাগুলো বলবেন না .. খারাপ লাগে। একটা মোবাইলে সামান্য রিচার্জ করে দিয়েছি এর বেশি তো কিছু নয় .." বন্দনা দেবীর কথায় মনক্ষুন্ন হয়েছে এইরকম একটা ভঙ্গি করে বেশ গম্ভীরভাবে কথাগুলো বললো ইউসুফ। এরপর আর কিছুই বলার থাকতে পারে না। তাই মৃদু হেসে চুপ করে গেলেন বন্দনা দেবী।
সে আঠারো বছর পেরিয়ে গিয়ে কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে উঠে গেলেও তার মুঠোফোন ব্যবহার করার অনুমতি নেই। অথচ সৈকত লক্ষ্য করলো স্মার্টফোন কি? খায় না মাথায় মাখে? এই সবকিছুর সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকা তার ঊনচল্লিশ বছর বয়সী মা কিছুক্ষণের মধ্যেই ইউসুফের প্রশিক্ষণে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ আসলে সেটা দেখা আর মেসেজ করার ব্যাপারটা বেশ ভালোভাবে রপ্ত করে নিলো। এছাড়াও ফোন অন এবং অফ করা, ফোনের আরও কয়েকটা টুকিটাকি ফাংশন সম্পর্কে জেনে নিলো তার মা।
"এতকিছু জানার বা শেখার অবশ্য দরকার ছিলো না, এটাতো কালকেই আপনাকে ফেরত দিয়ে দেবো। তবে শিখে নিয়ে এক বিষয়ে ভালোই হলো। ভবিষ্যতে যদি কোনোদিন এই ধরনের ফোন কিনি, তাহলে কাজে লেগে যাবে আজকের এই শেখাটা।" এতদিন আড়াই ইঞ্চি স্ক্রিনের ছোট মাল্টিমিডিয়া ফোন ইউজ করা বন্দনা দেবী মুখে এই কথাগুলো বললেও, বিদেশি কোম্পানির সাড়ে ছয় ইঞ্চি স্ক্রিনের স্মার্টফোনটা হাতে নিয়ে যেভাবে মুগ্ধদৃষ্টিতে ওটার দিকে তাকিয়ে ছিলো, সেটা দেখে ইউসুফ বুঝতে পারলো ফোনটার প্রেমে পড়ে গেছে সৈকতের মা। আসলে, সে তো এটাই চেয়েছিলো।
"কোন বিদ্যা কোথায় কাজে লেগে যায় সেটা কি আগে থেকে কেউ বলতে পারে? না মানে আপনার স্মার্টফোনের ব্যবহার শেখার কথা বলছিলাম। ঠিক আছে আজ তাহলে আসি! আশা রাখি, আবার নিশ্চয়ই আমাদের খুব তাড়াতাড়ি দেখা হবে।" কথাগুলো বলে তাদের বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়ার আগে সানগ্লাসটা পড়ে নিয়ে সেটা আবার চোখ থেকে নামিয়ে সৈকতের দিকে তাকিয়ে এক চোখ টিপে একটা গা জ্বালানো হাসি হেসে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে খুব আস্তে আস্তে ইউসুফ বললো, "মায়ের প্রতি কনফিডেন্সের কি ভাটা পড়িয়াছে ভাই সৈকত?"
অন্তর্জালের পাথর খুঁদে মরীচিকার হাতছানিতে যে ঝুঁকিপূর্ণ পথ সে তৈরি করেছে। এখন সেই পাথর ক্ষয়ে ক্ষয়ে নুঁড়িরা জমা হচ্ছে তারই তৈরি করা সেই উদ্দেশ্যহীন পথে। পুনরায় নুড়ি থেকে পাথর আর পাথর থেকে পাহাড় সৃষ্টি হয়ে আরো বিপদজনক হয়ে যাচ্ছে সেই পথ। কিন্তু রনে ভঙ্গ না গিয়ে বিকৃত যৌনসুখের সেই মরীচিকার হাতছানিতে ক্রমাগত একটার পর একটা পাহাড় ডিঙোনোর চেষ্টা করছে সে। আগুনের পায়ে হেঁটে যাচ্ছে আগুনের ভিতর। ক্ষণিকের সুখের আশায় এই পৃথিবীর এজলাসে একা সূর্যের মতো উঠছে, আবার আদ্যোপান্ত চক্রান্তের শিকার হয়ে অস্ত যাচ্ছে বার বার। রয়্যাল এনফিল্ডটা স্টার্ট দিয়ে তার মুখে একরাশ কালো ধোঁয়া ছেড়ে ইউসুফের বাইকটা হুশ করে বেরিয়ে যাওয়ার পর সেই দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো সৈকতের ভেতর থেকে।
★★★★
সকালে কলেজের গেটের সামনে ইউসুফের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে অনেক প্রশ্ন জমে ছিলো সৈকতের মনের মধ্যে। অন্য দিনের মতো আজকেও তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে সাড়ে ন'টার সময় কম্পিউটার খুলে মেসেঞ্জার অন করে আলফা গ্রেট ওরফে ইউসুফকে "হাই" লিখে মেসেজ করলো সে। কোনো রিপ্লাই এলো না অপরপ্রান্ত থেকে। আসবে কি করে? উল্টোদিকের ব্যক্তি তো অনই হয়নি মেসেঞ্জারে!
সাড়ে ন'টা থেকে দশটা, দশটা থেকে সাড়ে দশটা, সাড়ে দশটা থেকে এগারোটা .. ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চললো নিজের গতিতে। তার পছন্দের পর্ন সাইটগুলোতে ঘুরে আসার ফাঁকে সৈকত একবার করে ঢুঁ মেরে যাচ্ছিলো মেসেঞ্জারে। অথচ প্রতিবারই বিফল মনোরথ হয়ে ফিরতে হচ্ছিলো তাকে। অন্যদিন হলে এতক্ষনে তার মা বারকয়েক এসে "আর পড়াশোনা করতে হবে না। অনেক রাত হয়েছে, ঘুমিয়ে পড় .." এই বলে তাকে কম্পিউটার বন্ধ করে শুয়ে পড়ার জন্য তাগাদা দিয়ে যেতো। কিন্তু আজ সে লক্ষ্য করলো, তার মা দশটা নাগাদ খেয়েদেয়ে নিজের বেডরুমে ঢোকার পর আর সেখান থেকে বেরোননি। হয়তো শরীরটা ভালো নেই তার মায়ের, তাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছে .. এটাই মনে করলো সৈকত।
ইউসুফের মেসেজের জন্য অপেক্ষা করে করে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে এগারোটার কিছু পরে কম্পিউটার অফ করতে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে সৈকতের মেসেঞ্জারে "হ্যালো .." মেসেজ ঢুকলো আলফা গ্রেট ওরফে ইউসুফের।
পার্কে প্রেমিকের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর অবশেষে প্রেমিকের আগমন ঘটলে প্রেমিকা যেমন অভিযোগের সুরে হামলে পড়ে তার ওপর! ঠিক তেমনভাবেই ইউসুফের মেসেজ দেখে, "কি করছিলে এতক্ষণ তুমি? প্রায় দু'ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছি তোমার জন্য। তোমার সেই মেয়েরূপী পুরুষ ভার্চুয়াল বন্ধুটির সঙ্গে সেক্স চ্যাট করছিলে? নাকি অন্য কিছু?" এরকম একটা ঝাঁঝালো প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দিলো তার দিকে।
- "ওলে বাবা লে .. ছেলের খুব অভিমান হয়েছে দেখছি। খুব মিস করছিলিস আমাকে, তাই না? কি আর করা যাবে? আমার সঙ্গে যাদেরই পরিচয় হয়, তারাই আমার জন্য এরকম পাগল হয়ে ওঠে। তবে তোর মতো ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে সারাদিন কম্পিউটারের সামনে বসে থাকলে তো আমার চলে না, কাজ করে খেতে হয় আমাকে। একটা এসাইনমেন্ট ছিলো, বাড়িতে ফিরতে ফিরতে পৌনে দশটা হয়ে গিয়েছে। তারপরে ফ্রেশ হয়ে ডিনার করতে করতে একজনের সঙ্গে এতক্ষণ ধরে কথা বলছিলাম। তাই আসতে একটু দেরি হয়ে গেলো। তুই এখনো জেগে রয়েছিস?"
"হ্যাঁ, কারণ তোমাকে কিছু কথা জিজ্ঞাসা করার আছে।" প্রথমে এইটুকু টাইপ করে তারপর 'ইউসুফ ভাই তো তাকে তার ব্যবহার করা পুরনো স্মার্টফোনটা দেবে বলেছিলো। কিন্তু তার বদলে সে প্রায় বারো হাজার টাকার মূল্যের একটা দামী নতুন ফোন কিনে নিয়ে এলো কেন? ফোনটা নিয়ে এলো, কিন্তু তাকে দিলো না ফোনটা। তার মা .. যিনি টেকনোলজির বিপরীত মেরুতে হেঁটে এসেছে এতদিন। সোশ্যাল মিডিয়া তো দুরস্থান, স্মার্টফোন কি করে ব্যবহার করতে হয় সেটার সম্পর্কেই তার কোনো ধারণা ছিলো না! তাকে হঠাৎ এইরকম একটা দামী ফোন দেওয়ার কি মানে থাকতে পারে!' এই সব কথাগুলো একে একে জিজ্ঞাসা করলো।
- "মিউচুয়াল ফান্ডের ফান্ডা বুঝিস? ও, তুই কি করে বুঝবি? তুই তো একটা আকাট বেকার! যাই হোক, ওখানে ইনভেস্ট করা হয় ভবিষ্যতে লং টার্মের জন্য ফল পাওয়ার আশায়। এক্ষেত্রেও তাই, তবে এটা তো কিছুই নয়। ভবিষ্যতে এর থেকে আরোও অনেক বেশি ইনভেস্টমেন্ট হবে আমার প্রোডাক্টের উপর। তবে তুইও ছুটকো-ছাটকা কিছু পাবি, চিন্তা করিস না। আরে বলেছি যখন, আমার পুরনো মোবাইলটা তোকে দেবো। আজ একটা বিশেষ কারণে তোকে দিইনি, এর পরেরদিন দিয়ে দেবো আর তার সঙ্গে কারণটাও জানাবো। ওটা কোনো ইস্যুই নয়।"
- "ইনভেস্টমেন্ট, প্রডাক্ট, লং টার্ম .. এইসব কি বলছো, কিছুই বুঝতে পারছি না।
- "পারবি পারবি এক্ষুনি বুঝতে পারবি। বেশি ভাট না বকে তোর মেসেঞ্জারে যেটা পাঠাচ্ছি, সেটা চুপচাপ দ্যাখ।"
ইউসুফ ভাই এই মেসেজটা করার মিনিটখানেকের মধ্যে সে দেখলো তার মেসেঞ্জারে একটার পর একটা ইমেজ ফাইল ঢুকতে থাকলো। সবগুলো ইমেজ ঢোকার পর প্রথম ফাইলটা ওপেন করে সৈকত দেখলো ওটা তার মা আর ইউসুফ ভাইয়ের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের স্ক্রিনশট।
ভালো লাগলে আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাবেন
লাইক এবং রেপু দিয়ে উৎসাহিত করবেন