09-07-2023, 09:31 PM
|| সুরসম্রাট ||
সবকিছু থেকেও কেন সঙ্গীহীন, সহায়হীন, কপর্দকশূন্য হয়ে চলে গেলেন আর.ডি.বর্মন? জীবনের শেষ অধ্যায়ে বড় একাকী, বড় নিঃসঙ্গ ছিলেন আর ডি বর্মন। কাদের জন্যে জনপ্রিয়তার শিখর থেকে কাদের জন্যে সরে যেতে হয়েছিল তাঁকে? সেই নিয়ে কিছু কথা বলবো আজ।
বহু দিনের ব্যবধানে একটি ছবির কাজ পেয়েছেন আর ডি বর্মন। বিধুবিনোদ চোপড়ার ‘১৯৪২ আ লভ স্টোরি’। তখন তীব্র অনটন গ্রাস তার করছে দেহ ও মনকে। বদলে যাওয়া নিষ্ঠুর সময়ের সঙ্গে নীরব লড়াই চলছে। খারের ফ্ল্যাটে একা থাকেন তিনি। কাজের লোক এসে ঘর-ঝাড়পোঁছ, রান্নাবান্না করে যায় সময়মতো। তিনি সারাদিন ডুবে থাকেন সুরের সাম্রাজ্যে।
সেদিন তাঁর এক শুভানুধ্যায়ী এসে পৌঁছেছেন। মিউজিক রুমের দরজা ঠেলে ঢুকতেই শুনলেন তীব্র গালাগালি। ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ হজম করে নিয়েছেন। বুঝে ফেলেছেন, আরডি-র এখন 'ইউরেকা টাইম!' নিশ্চয়ই দারুণ কোনও সুর আবিষ্কার করেছেন।
আরডি তাঁর দিকে ফিরেই আবার একটি স্বভাবসিদ্ধ গালাগালি দিলেন। তারপর ঝকঝকে মন্তব্য, "বুঝবে ওরা, বুঝলি? ছবিটা একবার রিলিজ হতে দে, বুঝবে কাকে ওরা হেলাফেলা করেছিল! সবার বারোটা বাজিয়ে ছাড়ব রে!"
সবাই কারা? কাদের উপর রাগ ছিল তাঁর? আশির দশক থেকেই তো শুরু হয়ে গিয়েছে এই নিঃসঙ্গতার শতকের। সব কিংবদন্তির শেষ অধ্যায় যেভাবে কাটে। তখন রুপোলি পর্দায় রাজেশ খন্না সরে গিয়েছেন। জায়গা নিয়েছেন অ্যাংরি ইয়ং ম্যান অমিতাভ বচ্চন আর ডিস্কো ডান্সার মিঠুন। তুঙ্গে বাপ্পি লাহিড়ীর বাজার। কাজ কমে আসছে আরডি-র। চোরা পথে সেই সমস্ত কাজ চলে যাচ্ছে স্বল্পখ্যাত, মাঝারি মানের নতুনদের কাছে। কারণ পর্দায় তখন আধিপত্য দাপুটে নায়কের, তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত অন্যান্যরা। প্রেম, বিরহ, রাগ, প্রতিহিংসা সবকিছুই তাঁর নিয়ন্ত্রণে। প্রযোজকরা অত বেশি খরচা করছেন না সুরসৃষ্টির জন্য। প্রয়োজন ফুরিয়েছে আরডি বর্মনের মেলডির। রিদমের। বাপ্পি লাহিড়ীর উপর রাগটা বেশ স্পষ্ট ছিলো আরডি-র। ঘনিষ্ঠমহলে তাঁকে ব্যঙ্গ করে ডাকতেন ‘উল্লাসনগর কি আরডি বর্মন’।
তুচ্ছতাচ্ছিল্য কেন? সেও এক মজার ঘটনা। আশা ভোঁসলেকে দিয়ে গান গাওয়াচ্ছেন বাপ্পি লাহিড়ী। মিউজিক রেকর্ডিং স্টুডিয়োর সুরসংযোজনা শুনে আশাজির মন্তব্য, " ইয়ে গানা তো ম্যায়নে কুছ সাত-আট সাল পহলে রেকর্ডিং কিয়া থা, আরডিকে লিয়ে ....."
সত্যি মিথ্যে যাচাই করার কেউ নেই, তবে মুম্বইয়ের অনতিদূরে উল্লাসনগরে তখন পাইরেটেড বিদেশি গানের ভিডিও ও অডিও ক্যাসেট পাওয়া যেত। লুকিয়ে-চুরিয়ে বিক্রি-হওয়া সেসব ক্যাসেটের অন্যতম ক্রেতা নাকি ছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী, এমনটাই লোকমুখে ফিরতো। এক স্বনামধন্য কার্টুনিস্ট সেই সময়ে এক ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছিলেন, মাথায় বোঝাই-করা ক্যাসেট নিয়ে আরডি চলেছেন খোশমেজাজে। তাঁর ঝুড়ি থেকে পড়ে-যাওয়া ক্যাসেট কুড়িয়ে নিচ্ছেন বাপ্পি লাহিড়ী!
এ শুধু সময়ের খেলা। এত অপূর্ব সব গানের ডালি উপহার পেয়েছে দর্শক, গুলজার-আরডি বর্মন জুটির কাছ থেকে। ‘ইজাজত’, ‘নমকিন’, ‘মাসুম’, ‘অঙ্গুর’। আজও কোটি কোটি সঙ্গীতপ্রেমীর সকাল শুরু হয় সে সব গানেই। অথচ, সেই আরডির পাশেই ছিলো না তাঁর একসময়ের মোসাহেবরা। তোষামোদীর দল তখন সরে গিয়েছে। সময়ের স্রোত নিয়ে চলে গিয়েছে শচীনদেব বর্মণ এবং রোশনকে। খৈয়ামও সুর করছেন কালেভদ্রে। আর আরডি? যিনি আসলে জন্ম দিয়েছেন ‘বেতাব’-এর সানি দেওলের, ‘রকি’-র সঞ্জয় দত্তের, ‘লভ স্টোরি’-র কুমার গৌরবের, তাঁকেই পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে নায়কদের দাপটে!
একবার কুমার শানুর ইন্টারভিউতে আরডির কথা উঠতেই তিনি বলেছিলেন, "মেলডি নামে শেষ যে পরিচিতি ছিলো, সেটা আরডির তিরোধানের পরেই শেষ হয়ে গিয়েছে। আমরা যে বেঁচে আছি, সেটা আরডি-র জন্যেই।" এই শানুকে যখন প্রথমবার দেখেন আরডি, সেদিনের কথা বলি। ‘কুছ না কহো’ গানটি রেকর্ড করার জন্য বহু দূর থেকে এসেছেন শানু। পরণে ময়লা শার্ট, মুখে না-কামানো দাড়ি। তিনি ঘরে ঢুকতেই বিধুবিনোদ চোপড়া সাফ বলে দিলেন আজ রেকর্ডিং হবে না। শানুর তো মাথায় বাজ! এত কষ্ট করে আসা বিফলে যাবে। অনুনয় বিনয় সত্ত্বেও মন টলল না বিধুর। শানু ব্যথিত মনে বাইরে বেরিয়ে আসছেন, তখনই রাহুল তাঁকে আলাদা করে ডাকলেন। ‘‘ওহে, এমন খোঁচা-খোঁচা দাড়ি নিয়ে সাহেবের কাছে কাজ করতে এসেছ, সাহস তো কম নয়! যাও দাড়ি-টাড়ি কামিয়ে ইস্ত্রি করা শার্ট পরে এসো।’’ সেই টোটকা কাজে লেগেছিল। কুমার শানু সারা জীবন ভোলেননি সেই কথা।
কী অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন তিনি মান্না দে-কে! একবার রামপুরহাটে শো করছেন তোচন ঘোষ। জিনাত আমন ও আরডি বর্মন আসবেন মান্না দের একক অনুষ্ঠানে। সে আমন্ত্রণ আরডির কাছে নিয়ে যেতেই তিনি মত বদলালেন। কেন? না তিনি গোঁ ধরেছেন, মান্না দের জন্য তিনি এক পায়ে তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকবেন! অর্থাৎ তিনি ঘোষকের কাজ করবেন! বিজনেস ক্লাস টিকিট কেটে কলকাতায় এলেন। সেই শো আজও ভুলতে পারেননি রামপুরহাটের দর্শক। রাহুল দেববর্মনের কথার সঙ্গতে ২৯ টা গান গেয়েছিলেন মান্না দে! মঞ্চে যেন ম্যাজিক দেখছিলেন মন্ত্রমুগ্ধ দর্শক।
অথচ সেই সময়ে বাংলা কী দিয়েছ তাকে! স্মৃতিতে ভেসে উঠলেও শিউরে উঠবেন। বাংলা ছবির তথাকথিত উচ্চমানের প্রোডিউসাররা তখন মুম্বইয়ে বাপ্পি লাহিড়ীর দরজায় কড়া নাড়ছেন। সম্ভবত দরকষাকষিতেই ঝামেলা বেধে গেলো একবার। তখন তাঁরা এলেন রাহুলদেব বর্মনের কাছে। অনেক কম পারিশ্রমিকেই রাজি করাতে বাধ্য করেছিলেন তাঁকে। তখন তিনি তো প্রায় কোণঠাসা!
এ দেশে প্রতিভা দাম পায় মৃত্যু-পরবর্তীকালে। এমনই ছিলেন আরডি। শ্রদ্ধাবোধের দীপ কখনও নিভে যেতে দেননি ঝড়বাতাসে .. বাকিটা ইতিহাস।
নিজের সাফল্য আরডি উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন সময়কেই। আর তাঁর সবচেয়ে কাছের মানুষ হিসেবে সুপরিচিত সেই সুগায়িকা কি সত্যিই তাঁর পাশে ছিলেন শেষ সময়ে? অত্যন্ত বিশ্বস্ত সূত্রের এক প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকেই শোনা, কর্মহীন আরডি-র সঙ্গে প্রায় কোনও যোগাযোগই রাখতেন না তিনি। নিজের হাতে রান্না করে খাওয়ানো তো দুরস্থান! আরডি যখন ‘১৯৪২ আ লভ স্টোরি’-র গান গাওয়াচ্ছেন কবিতা কৃষ্ণমূর্তিকে দিয়ে, তখন তিনি নাকি তুমুল আপত্তি জানিয়েছিলেন। আরডি-র সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ততদিনই ছিলো, যতদিন তাঁকে দিয়ে আরডি গান গাইয়েছেন। সময়ের খাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা সেই সব গান। তাঁকে বাদ দিয়ে যখনই আরডি নির্বাচন করেছেন আরতি মুখোপাধ্যায় বা অন্যান্য নতুন মহিলা কন্ঠশিল্পীদের, তখনই এসেছে সেই তুমূল প্রতিরোধ। নাহ্ , জীবদ্দশায় অত মোহময় ছিলো না সেই গায়িকার সঙ্গে আরডি-র সম্পর্ক!
‘১৯৪২ আ লভ স্টোরি’-র কাজ শেষ করার পরেই আর়ডির বাইপাস সার্জারি হয়। ডাক্তারের বারণ সত্ত্বেও ড্রাইভ করে ফার্মহাউসে গিয়েছিলেন আরডি। ফিরে আসার পর গিয়েছিলেন শক্তি সামন্তের বাড়ির পার্টিতে। তবে সেখানে বেশিক্ষণ থাকেননি। ক্লান্ত শরীর নিয়ে ফিরে আসেন নিজের বাড়িতে। সেই রাতই তো শেষ রাত তার জীবনে। নিজের সাফল্য আর দেখে যেতে পারলেন না। বয়ে গেলো সময়।
অন্তিম যাত্রায় পাশে দাঁড়িয়েছিলেন রাজেশ খন্না। ছিলেন শক্তি সামন্ত, প্রমোদ চক্রবর্তী।
শেষ দিনে অবশ্য আর়়.ডি.-র ফ্ল্যাটের উত্তরাধিকারী হিসেবে অনেক তথ্যই পেশ করেছিলেন সেই গায়িকা। ফলস্বরূপ ফ্ল্যাটটি এখনও তাঁরই নামে রয়েছে!
তথ্যসূত্রঃ- এবেলা