08-07-2023, 08:53 PM
পর্ব- ষোল
সময় মতোই অনুষ্ঠান শেষ হয়েছিল তবে আমি আর কথা এখনো ঐ ঘোর টা থেকে বের হতে পারছিলাম না। শুধু আমরা দুজন কেন বাকিরাও হয়তো সেটাতেই মজে ছিল। নইলে এতো গুলো পারফরম্যান্সের পরও ওটা নিয়ে আলোচনা হয়েই চলছিলো। যেটার রেশ গড়িয়েছিল ডিনারের সময় অব্দি। আমরা মানে আমি, কথা, কাব্য আর দীপু দা একটা টেবিলেই খেতে বসেছি কিন্তু খাবার খাবো কি করে! একের পর এক টেবিলের কাছে আসছে আর আমাদের কাব্য নাট্য নিয়ে কথাবার্তা বলছে। বলছে মানে কি পুরো রিভিউ দেয়া শুরু করেছে। ভদ্রতার খাতিরে মানুষের সাথে দুটো কথা তো বলতেই হয়, কিন্তু সেটা করতে গিয়ে খাবার মুখে তোলার সুযোগটাই পাচ্ছি না। মানুষের গুলোর সাথে আলাপনের ফাঁকে কথা কাব্য কে খাইয়ে দিচ্ছিলো, যদিও কাব্য এখন প্রায়ই নিজের হাতে খাবে বলে বায়না করে। কিন্তু কথা জানে কাব্য কে নিজের হাতে ছেড়ে দেয়া মানে সবকিছু উলটপালট করে ফেলা। তাই ধমকে ধামকি দিয়ে খাবার ছেলের মুখে পুড়ে দিচ্ছে। আর যাই হোক কাব্য ওর মাকে যমের মত ভয় পায়, তবে আমি সামনে থাকলে একটু আধটু সাহসী হবার চেষ্টা করে। ফলস্বরূপ আমাকে কথার বিচারের আসনের সম্মুখীন হতে হয়। ওর ভর্ৎসনা শুনতে হয় যদিও সেটা আমার কাছে ভালোই লাগে। আমি ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি আর মুচকি মুচকি হাসি। আমার মুচকি হাসিতে কথা আরও তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে, ও পারে তো আমাকে হয়তো তখনি চিবিয়ে খেয়ে নিতো।
দীপু'দার কলিগরা সাথে আবার তাদের পরিবার বা আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে আসছে আর আমাকে আর কথা কে বাহবা দিচ্ছে এতো সুন্দর একটা কাব্য নাট্যের জন্য। মাঝেমধ্যে দীপু'দার দিকে চোখ চলে গেলে মনে হয় দাদা হয়তো কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করছে চুপিসারে। কারণটা কি সেটা বুঝার চেষ্টা করছি। একটা কারণ হতে পারে খাবারের সময় এরকম ভদ্রতার উৎপাত আর নয়তো কথার সাথে বারবার আমার নাম টা উচ্চারণ হওয়া। না এতে আমার মনে খানিক কষ্ট জাগা বা খেদ নেই। কারণ দীপু দা মানুষটা খুব ভালো নইলে তার জায়গায় আমি থাকলে হয়তো এর চেয়েও বেশি রিয়্যাক্ট করতাম। আর কেই বা তার স্ত্রীয়ের সাথে অন্য একজন পুরুষের নাম বারবার উচ্চারিত হওয়াটা সহ্য করবে। না করাটাই স্বাভাবিক, আর সেই মানুষটা যদি তার স্ত্রী'র বিশেষ বন্ধু হয় তবে তো কথাই নেই। সেই স্বামী স্বভাবতই একটা ইনসিকিউরড ফিল করবে, তার মনে একটা ভয় থাকবে হারিয়ে ফেলার। যে যত বেশি ভালোবাসে তার ভয়টা ততো বেশি হয়।
মানুষের চাপ একটু হালকা হতেই আমরা খাওয়া দাওয়াতে মন দিলাম। আমি মাথা নিচু করে একমনে খেয়ে যাচ্ছি, ভেতরে ভেতরে একটা অজানা আশংকা জেগে উঠেছে। কোথাও গিয়ে মনে হচ্ছে আমি কথার সুখের জীবনটাতে অনুপ্রেবেশ করছি। ও সুখে ছিল নাকি অভিনয় করে গিয়েছে সেটা ভিন্ন কথা, সেটা আবার অনেক অভিমত বের করতে চাইবে। আমি চুপচাপ খাবার চিবিয়ে যাচ্ছি আর আমার পাশে বসা কাব্য মাঝে মধ্যেই আমাকে খুঁচা দিচ্ছে। কারণ টা আমার জানা, ওকে যেন ওর মায়ের হাত থেকে একটু রক্ষে করি। কারণ আমার কাছে আসলেই ও দুষ্টুমি করার লাইসেন্স পেয়ে যায়। তবে আমি যে কাব্য কে সায় দিচ্ছি না সেটা নিশ্চয়ই কথার চোখে পড়েছে। হঠাৎ করেই কথা চাপা স্বরে খানিক ধমকের সুরে বলে উঠলো,
কিরে তুই খাচ্ছিস না কেন? ভালো লাগছে না নাকি?
ওর গলার আওয়াজে চৈতন্য ফিরে আমার। মাথা হালকা উঁচু করে,
না ভালো লাগবে না কেন, খাচ্ছি তো।( ওর চোখে চোখ মেলাতে পারলাম না)
তাড়াতাড়ি খা! খাবার গুলো ঠান্ডা হচ্ছে তো..
ওর চোখের দিকে কেন জানি তাকাতে পারলাম না, হয়তো ধরা পড়ে যাবার ভয়। আমার মনে যে সংশয় জেগে উঠেছে সেটা হয়তো মন ছাপিয়ে চোখে মুখেও ফোঁটে উঠেছে। আমি সেটাকে ধরে রাখার মতো এতোটাও শক্ত মনের নই। তাই আর কথা না বাড়িয়ে চুপি চুপি খেতে শুরু করলাম, এবার একটু তাড়াহুড়ো কাজ করছে আমার মনে। ভাবছি যত তাড়াতাড়ি খেয়ে নেবো ততো তাড়াতাড়ি ওদের থেকে দূরে যেতে পারবো। এতোটা কাল তো দূরেই ছিলাম তবে কেন আবার ওর কাছে আসতে হলো। দিব্যি তো ছিলাম আমি আমার মতো আর ও হয়তো নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিল। আমি এসে আবার সবটা উলটপালট করে দিলাম। কেন যে এলাম, নিজ থেকে তো আসিনি। সবার মন রাখতে আসতেই হলো, তবে কি আমার মনেও ইচ্ছে ছিলো না.....কোন সুপ্ত বাসনা?
আমি আর দেরি করলাম না চটপট খাওয়া শেষ করে ওদের ছাড়াই নিজের রুমে চলে আসলাম। কিছুই ভালো লাগছে না তখন থেকেই, এক জায়গায় স্থির হয়ে বসতে পারছি না। ভেতরের অস্থিরতা টাকে কোন ভাবেই সামাল দিয়ে শান্ত করতে পারছি না। রুমের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে হাঁটাহাঁটি করছি। কি করবো সেটাই বুঝতে পারছি না, ভেতরে ভেতরে একটা অপরাধ বোধ জাগছে। এটা যে আজই জাগছে তা নয়, সেটা অনেক আগেই জেগেছিল। তবে ততোদিনে অনেক কিছু হারিয়ে ফেলেছি অনেক কিছু আমার আয়ত্তের বাইরে চলে গিয়েছিল। আমার আর ক্ষমতা ছিল না সবকিছু কে আমার সাজিয়ে গুছিয়ে তোলার। সেই থেকে অপরাধ বোধ আর অনুশোচনা নিয়ে আমি চলছি। সেই অনুশোচনা আর পাপবোধের বোঝাটা খানিক কমাতেই এখানে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম সবটা না হোক কিছুটা হলেও ঠিকঠাক করে গুছিয়ে দিতে পারবো কথা কে। এখন মনে হচ্ছে আমার না আসাটাই ভালো ছিল। আমার উপস্থিতি ওর অতীত টা কে কষ্ট দিয়েছে এবার ওর বর্তমান আর ভবিষ্যৎ টাকে প্রভাবিত করবে।
একেক বার একেক চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে মন, কথা কে যে আমি কখনো অস্বীকার করতে পারবো না। ও না থাকলে আমি হয়তো কবেই হারিয়ে যেতাম বাস্তবতার হড়কাবানে। কথা একটা কথা বলতো "কেউ নাকি কারও জন্য মরে না, মরে নিজের একাকীত্ব কে ভয় পেয়ে"। তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ আমি, কতবার বলেছি তোকে না পেলে আমি মরে যাবো। কিন্তু দেখো এইতো আমি দিব্যি বেঁচে আছি বহাল তবিয়তে। তবে তার ক্রেডিট টাও ওর, ও নিজে কাছে না থাকলেও আমাকে কখনো একা হতে দেয় নি। জীবনের প্রতিটা মোড়ে কঠিন সময় গুলোতে কাউকে না কাউকে ঠিক পাশে পেয়ে গিয়েছি। আর মানুষ গুলো হঠাৎ করেই অচেনা আগুন্তকঃ হয়ে আমার সামনে এসেছে, আমাকে আগলেছে শান্ত করেছে আবার হঠাৎ করেই হারিয়ে গিয়েছে। তখন না বুঝলেও এখন বুঝি দূর থেকেও কলকাঠি একজনই নেড়েছে।
না অনেক হয়েছে এবার একটু ঘুমাতে হবে তবেই যদি মনটাকে শান্ত করতে পারি। বিছানার নরম গদিতে নিজের ভারী দেহটাকে ছুঁড়ে দিলাম। শুয়েই আগে মোবাইলের খোঁজ করলাম, ওটা ছাড়া আজকাল থাকাই হয় না। এতোক্ষণ যে ওটাকে ছাড়া কিভাবে থাকলাম কে জানে। মোবাইলের হাতে নিতেই দেখি নোটিফিকেশনের বাতি জ্বলছে, ইশশ! মোবাইলটা সাইলেন্ট ছিল বলে টেরই পেলাম না, লক খুলতেই দেখি গোটা চারেক মিসডকল আর মেসেজ। এর মাঝে কথাই তিনবার ফোন করেছিল শেষে না পেয়ে মেসেজ করেছে। মেসেজ টা খুলতেই দেখি....
অভিমান কেটে গেল
অভ্যর্থনা পেলে বের হবি হয়তো।
ভুলেরও সমাধি হয় মাঝে মাঝে,
যখনি মনের খেয়াল হয়!
একটা সময়ের পর তৃপ্তির স্বাদ নেয় মন
পোড়া মনে আমার হয়েছে যত জ্বালা!
কেউ পারেনি সম্পূর্ণ জয় করে নিতে,
ঠিক আবারও বিপরীতও হয়েছে।
তবু বলি,
আমার জন্য মন না চাইলেও
তোর জন্য আমি- অতন্দ্র প্রহরী!
তুই থাকিস
তাহলেই আমার এই দুনিয়াটা ঠিকঠাক থাকে।
ওর কথার মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝলাম না। ও কি ভুল ভাবছে আমার রিয়্যাকশনে। আমি তো ওর উপরে অভিমান করিনি, আমার যত অভিমান অভিযোগ সব তো নিজের উপর। আমার কি সাধ্য ওর উপরে অভিযোগ করি অভিমান করি। যদি পারতাম এখনি ওর কাছে ছুঁটে গিয়ে নিজের মনের এজাহার করতাম। ওকে প্রাণ খুলে বলে দিতাম তুই যা ভাবছিস তা ঠিক নয়, আমি তোর উপরে কোন অভিমান করিনি। করবোই বা কি করে তুই যে আমার...
পদভারে আরক্ত পৃথিবী। আমার অনুন্নত মস্তিষ্কের কিছু ঘুমঘোর। তুই যে আমার স্বপ্নবিলাসী মন, বৃষ্টিস্নাত বেগুনী অর্কিড। তুই যে দেবদারুর ভেজা ডাল, কোকিলের অবিরাম ধ্বনি। বনদেবতা যেন নিজের হাতে সাজিয়েছেন তোকে। আমার উৎসুক মনে এলোমেলো আবেগের বাষ্প। ব্যার্থ আমি ফিরে এলাম মৃগশাবকের নিথর দেহ নিয়ে। যেখানেই যাই সেখানেই শুনি গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে তোর নামের উচ্চারণ। তাতেই মন্ত্রমুগ্ধ আমার সত্ত্বা, কার্নিশে গিয়ে বসলো আমার রাতের ঘুম কত রাত ঘুমাতে পারিনি। আমার চেতনার মন্দির জুড়ে তোর স্তব্ধতা,সকালের শিশির মাড়িয়ে আবার তোর উঠোনে আমার অবিরাম অপেক্ষা।
তুই এলেই বাতাস ধরে এলো, সাথে এলোকেশী মেঘের গর্জন। গুমোট বাতাসে তোর বুনোফুলের ঝোপ, আমি যেন কস্তূরীর গন্ধে বিভোর কোন চোরা শিকারী। মনের তূণ থেকে শর বের করে ধনুকের দিকে অগ্রগামী আমার হাত। সহসা তোর সলজ্জ চোখে চমকের অস্পষ্টতা, তুই বুঝি এই ছুটে পালালি। আমি চেয়ে রইলাম তোর সচকিত পদচারনায়, ভেসে গেলো আমার আমির যত আবেশ। আমি শূন্য হাতেই ফিরে এলাম ভীষণ অসুখ নিয়ে,তুই হীনা একাকী মনের গরম অসুখ।
আমার দিন কেটেছে অন্ধকারের বিষন্নতায়,অসুখ সাড়তে সাড়তে সাথে নিয়ে গেলো সমস্ত সুধা। পাগলপ্রায় আমি ছুটে যাই তোর মন কুটিরে ভীষণ ভারী পাগুলো নিয়ে। মনের জ্বালানিতে শরীর ছুটে চলে, বুনোফুলের গন্ধে পাগলপ্রায় আমি। দ্বিগুন উৎসাহে এগিয়ে চলি, চোখ মনের কোটরে বন্দী।
কই সেই কুটির?৷ কোথায় ঝর্নাজল? কোথায় আমার মনমন্দির? কোথায় পুস্পশোভিত লতা? কোথায় উদ্ভাসিত আলোকরেখা? মনের ভ্রম নাকি মরিচিকার মানসপুত্র, মাথায় আগুনের ফল্গুধারা। আজও খুঁজে ফিরি সেই বুনোফুল, মাদুলির অলংকার। বিষন্নতা ধেয়ে আসে আমার দিকে, তূণ থেকে উঠে আসা তীরগুলো দ্বিগুনবেগে ছুটতে থাকে। প্রানের পর প্রান স্পর্শ করে বসুমতির শীতল পরশ আবার নাকে লাগে বুনোফুলের গন্ধ। কিন্তু আমি আজও তোকেই খুঁজি, হারিয়ে ফেলেছি তোকে।
হঠাৎ দরজায় কড়াঘাতের শব্দে আমার বাস্তবতায় পদার্পণ হয়। এখনো ততোটাও স্বাভাবিক হতে পারিনি তাই ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরেই জিজ্ঞেস করলাম কে, বিপরীত থেকে রীতিমতো হুঙ্কার ছুটে আসছে যেন আমার দিকে....
ঐ কুত্তা তাড়াতাড়ি দরজাটা খোল বলছি নইলে আজ তোর মাথা ফাটাবো...
★★★★
পরশু কাকার বিয়ে, আজ থেকেই বাড়িতে আত্মীয় স্বজনের আসা শুরু হয়ে গিয়েছে। এমনিতেও আমাদের বাসায় সবসময়ই হৈ-হুল্লোড় লেগেই থাকে তবে বাকিদের আগমনে পুরো বাসা গমগম করছে। আমার ছয় পিসিদের মাঝে দুজন কাল আসবে বাকিরা তাদের পরিবার সহ চলে এসেছে। বাবার মামা তাদের ছেলে মেয়েদের পরিবার আমার মায়ের দিকের আত্মীয় স্বজন অন্যদের আত্মীয় স্বজনদের অনেকেই এক এক করে এসে চলেছে।
পিসিদের কাছে আমি তাদের প্রাণ ভ্রমরা, চোখের মণি। তাই তো আসার পর থেকেই আমাকে পিসিদের কাছ ছাড়া হতে দেয়নি। আমার মিষ্টি সন্দেস নাড়ু খুব পছন্দের আর সেটা পিসিদের জানা তাই আমাকে সেসব খাওয়ানোর তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে। এর মাঝে মা একদুই বার এসে আমাকে বেশি খাওয়াতে বারণ করে গিয়েছে। সেটারও কারণ আছে যতই মুখের স্বাদে বেশি খেয়ে ফেলি না কেন আবার পড়ে ঠিকই অসুস্থ হয়ে পড়ি। তখন তো আবার দৌড়াদৌড়ি শুরু হয় আমাকে নিয়ে। তবে এতোদিন পর এসে পিসিদের আদর খানিক মাত্রা ছাড়াবে সেটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। আমিও সুযোগ সন্ধানী আদরের আহ্লাদী সেই সুযোগ টা একটু বেশি করেই নেই। কারণ আমি জানি এ কদিন যতো বাঁদরামি করি না কেন পিসিদের অভয়ারণ্যে জন্য হলেও মা বকাবকি করতে পারবে না। মাঝে মধ্যে যে উত্তম মাধ্যম পিটুনি যে আমার পিঠে পড়ে না তাও নয়। যখনি আমার অসহনীয় কর্মকান্ড মার সহ্যের বাঁধ ভেঙে দেয় তখন আর কারও সাধ্য নেই আমাকে বাঁচাবার। কত যে মার খেয়েছি মায়ের হাতে তার ইয়ত্তা নেই।
বিকেল নাগাদ বাসা মানুষে পূর্ণ হয়ে উঠেছে, বাকিরা আসার পর কোথায় জায়গা নিবে কে জানে। কারণ আগে যারা এসেছে তারা আগে ভাগেই নিজেদের জায়গা দখল করে নিয়েছে। তবে সেইসবের চিন্তা আমার নেই, আমি ততোক্ষণে বড় দাদা দিদিদের কাছে নিজের আবদারের ঝুলি নিয়ে বসেছি। এর মাঝে এক জামাইবাবু সবাইকে আইসক্রিম খাওয়াবে বলে কথা দিয়ে। আর আমার জন্য এক্সট্রা সারপ্রাইজ তো আছেই। আমি তো যেন আনন্দ সমুদ্রে ভেসে চলেছি। তবে ভগবানের বুঝি আমার আনন্দ বেশিক্ষণ সহ্য হয় না। তাই তো আমি যে একটু আনন্দে আছি সবার আদর পাচ্ছি সেটাতে ভাগ বসাতে একজন ঠিক চলে এসেছে।
একটা ঘরে আমরা সব ভাই বোন বোন জামাইরা আড্ডা দিচ্ছিলাম, হঠাৎ করেই একটা কন্ঠস্বরে আমার গায়ে যেন জ্বালা ধরতে শুরু করলো।
কি ব্যাপার আমাকে রেখেই সব প্ল্যান হয়ে যাচ্ছে নাকি? (ওর চিকন স্বরের মিষ্টি গলাতে সবার মন গলে গেলেও আমার কেন জানি গা জ্বালা করে)
আমি চাপা স্বরে বলে উঠলাম,
হয়ে গেল উনি চলে এসেছেন।
এতো নিচু স্বরে বলার পরেও কি ওর কানে আওয়াজ টা পৌঁছে গেল নাকি? না হলে কথা আমার কাছে এসে কেন বললো,
কিরে আমাকে কিছু বললি নাকি? মুখটাকে এমন প্যাঁচার মত করে রেখেছিস কেন?
আমি কি উত্তর দেব সেটা নিয়ে আমতা আমতা করার মাঝেই ও বাকিদের সাথে মিশে গেল। আর আমাদের বাসার সব অনুষ্ঠানে ওদের আসা যাওয়া থাকেই তাই ওকে মোটামুটি সবাই চেনে৷ সেই সুবাদে বাকিদের সাথে মিশে যেতে কথার তেমন একটা সময় লাগে না। তাতে আমার কোন আপত্তি নেই কিংবা থাকার কথাও না। কিন্তু ওকে নিয়ে আমার সমস্যা আছে কঠিন সমস্যা। কারণ ও এ বাড়িতে আসা মানে আমার আদরে আবদারে ভাগ বসানো। আমার নিজের মা বাবা থেকে শুরু করে সবার আদরে ওর যেন ভাগ বসানো চাই-ই চাই। আর আমার পিসিদের ওকে নিয়ে করা আদিখ্যেতা টা আমার কেন জানি সহ্য হয় না। এই যেমন আসতে না আসতেই দাদাবাবুকে ঠিক নিজের দলে টেনে নিল শাঁকচুন্নি টা। ফিসফিস করে কি যেন বলছে আর হাসাহাসি করছে, আমার যে একদম সহ্য হয় না।
কথার সাথে কথা না বলে আমি থাকতে পারি না, মাঝে মাঝে মনে হয় ও আর আমি যেন এক অস্তিত্ব। কিন্তু ও কে নিয়ে সবাই যে মাতামাতি টা করে সেটাও কেন জানি সহ্য করতে পারি না৷ ও বাসায় এলো মানে সবার নয়নের মণি হয়ে উঠা। কেন ওকে নিয়ে এতো সবার আগ্রহ সেটাই বুঝি না, কই আমার বেলায় তো তা হয় না। আমার মনের কোণে সুপ্ত রাগ জন্মাতে থাকে, আর ভালো লাগছে না সেখানে তাই তো উঠে চলে আসলাম নিজের ঘরে।
আমার পড়ার টেবিলে বসে আছি তবে পড়তে বসিনি সেটা একশত ভাগ সত্য। খাতায় আকিঁবুকিঁ করছি আর বিড়বিড় করে যাচ্ছি,
থাক সবাই ওকে নিয়ে, ওই পেত্নিটাই সবার আপন আমি তো কেউ না। আমিও আর যাবো না ওখানে, দরকার নেই আমার আইসক্রিমের।
আচমকাই আমার কানের সামনে ফিসফিস করে কেউ বলে উঠলো,
আন্টি কে গিয়ে কি বলবো যে তুই আমাকে পেত্নি ডাকিস।
হঠাৎ করেই আওয়াজ টা পেয়ে আমি ভয়ে আতকে উঠি, বুকটা ধড়ফড় করতে থাকে। পাশ ফিরে কথাকে মুচকি হাসতে দেখে আমার রাগ যেন আরও দ্বিগুণ হয়ে উঠলো। কিন্তু যে করেই হোক নিজেকে বশ করতে হবে। না হলে ও কাঁদো কাঁদো মুখে মাকে যা বলবে সেটাই বিশ্বাস করবে। তাই রাগটাকে আড়াল করার চেষ্টা করলাম,
তোকে পেত্নী বলবো কেন? আর এখানে তো তুই ছিলিস না তাহলে তোকে কেন বলতে যাবো?
তাহলে কাকে বললি? আমাকে ছেড়ে যদি অন্য কাউকে বলতে যাস তবে কিন্তু তোকে মেরেই ফেলবো।
আমি যে কি বলবো সেটাই বুঝতে পারছি না,
হুহ বুঝলাম।
এতো বুঝে কাজ নেই, আন্টি ডাকছে সবাইকে বড় ঘরে। চল আমার সাথে..
কেন আবার কি করলাম?
কিছু করিস নি তো। মামার বিয়ের মঙ্গলাচরণে জিনিস গুলো দেখার জন্য সবাই কে ডাকছে।
ওহহ, আমি তো ভাবলাম.. চল যাই।
এতোক্ষণ পড়ে আমার মাথায় আবার বিয়ের ব্যাপার টা নাড়া দিলো, না মানে বিয়েটা নয় তবে এটার সাথে জড়িত একটা নাম। বাসায় মানুষের ভীড়ে আমার অবচেতন মন আর মস্তিষ্কে সেই নাম টা প্রচ্ছন্ন ছায়ায় ঢেকে গিয়েছিল। এখনি যেন আবার সেটা নতুন করে মাথা জাগিয়ে মন প্রকোষ্ঠ ভেদ করে সামনে চলে আসলো।
সবার মন, চোখের দৃষ্টি সামনে পাতা মাদুরে রাখা লাগেজে নিবন্ধ হলেও আমার মনে সেই একজনের রাজত্ব চলছে। আর সেটা হলো রাশি। ইশশ! সময় এতো ধীরে চলছে কেন? আজকের রাতটা পার হলেই কাল গায়ে হলুদ তারপরদিন বিয়ে৷ এখনো গোটা দুটো দিনের অপেক্ষা। কিন্তু রাশি কে এক নজর দেখার জন্য আমার মন যেভাবে ছটফট করছে তাতে এই দুদিন অপেক্ষা করা যে বড়ই দুষ্কর। চোখ বন্ধ করতেই যেন চশমার আড়ালে থাকা ওর চোখ দুটি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে। ওর ঠোঁটের কোণে হাসি আমার বাল্য হৃদয়ে ঢেউ খেলিয়ে যায়৷ ব্যাকুল অন্তরে শান্তির পরশ বোলাতে ওকে এক নজর দেখা যে আমার চাই-ই চাই। কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব? অতএব আমাকে অপেক্ষা করতে হবে বিয়ের দিন পর্যন্তই।
জানি না কেন এমন হয়? কিসের যেন এতটা উচাটন হয়ে উঠে মন? কিসের তরে এতো ব্যাকুলতা? যাকে আমি ঠিকমত চিনি না জানি না, একদিনের দেখাতেই এতো উৎসুক হয়ে উঠলো কেন মন? কেন ওর কথা ভাবলেই মনে খুশির জোয়ার আসে, অদ্ভুত এক অনুভূতি কাজ করে সমস্ত শরীর জুড়ে। মূহুর্তের জন্য মনে হয় আমার পুরো দুনিয়া জুড়ে বুঝি ওর একার রাজত্ব। ভাবতে ভালো লাগে যতসব অলীকত্বে পূর্ণ কল্পনা। সুখের পরশে হৃদয় সতেজ হয়ে উঠে, যেন আমার সকল পরিপূর্ণতা ওর মাঝেই নির্বন্ধিত। রাশি হঠাৎ করেই আমার এতোটা জুড়ে বিস্তার কিভাবে করলো? আমি তো এমন করে কখনো ভাবিই নি, ঐদিনের কিছু মুহূর্তের দেখাতেই এতোটা এগিয়ে গেলাম কি করে?
কিরে ওমন করে কি ভাবছিস? আমার উপর রেগে আছিস?
কথার ডাকে আমি ওর দিকে তাকাই কোন ফাঁকে যেন আমার পাশে এসে বসেছে। আগে তো এদিকে ছিল না.....
তোর উপর রাগ করবো কেন?
তাহলে আমার সাথে ঠিক করে কথা বলছিস না কেন? জানিস তো তুই রাগ করে থাকলে আমার কিছুই ভালো লাগে না।
জানি তো... আমি রাগ করিনি তোর উপর...
(হয়তো নিশ্চিন্ত হতে পারলো তাইতো কথা আমার গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাকে, অনেক দিনের অভ্যাস...)