01-07-2023, 07:03 PM
পঞ্চষষ্টি পর্ব
“ও লো, তুই কাঁদছিস কেনো?”, অবাক হয়ে বললেন কলিবৌদি। “ও কিছু নয় গো বৌদি। ক’দিন ধরেই চোখে একটা সমস্যা হচ্ছে”, তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে ফেলে বললো সুচরিতা। “এ মা, এ তো ভাল লক্ষণ নয়। তাড়াতাড়ি একটা ডাক্তার দেখিয়ে নিস। তা হ্যাঁ রে, তোর মেয়ে তৈরী হলো?”, তাড়া লাগালেন কলিবৌদি। সত্যিই তো, অনেকক্ষণ হয়ে গেছে, ওনারা এসেছেন, জলখাবারের পালাও শেষ। অবশ্য জলখাবার বলতে প্রায় কিছুই খেলেন না ওনারা। অর্কর বাবার ব্লাডপ্রেসার, সুগার, তিনি কিছুই মুখে তুললেন না, শুধু চিনি-দুধ ছাড়া এককাপ লিকার চা। সঙ্গের দু’জন ভদ্রমহিলা, একজন অর্কর মা এবং মাসী, এরা চামচ দিয়ে কেটে আধখানা ক্ষীরের চমচম খেলেন। অথচ আয়োজন করা হয়েছিলো অনেক। ক্ষীরের চমচম ছাড়াও সন্দেশ, রসগোল্লা, রাজভোগ, রাবড়ী, সিঙ্গারা, কচুড়ি, এছাড়া বাড়িতে বানানো লুচি আর ছানার ডালনা। কিন্তু বড়লোকদের বোধহয় ক্ষিদে কম থাকে। আর বড়লোক বলতে বড়লোক, এনারা শুধু ধনীই নন, রাজনৈতিক প্রতিপত্তিও বিরাট। অর্কর বাবা তো আগের সরকারে মন্ত্রী ছিলেন। এখন সরকারে না থাকলেও, দাপট এতটুকু কমে নি। প্রায়ই টিভিতে মুখ দেখা যায়, নাকের উপর বিরাট আঁচিলটা দেখেই চিনতে পেরেছে সুচরিতা। ঝুম তো ভদ্রলোককে টিভিতে দেখলেই হাসে, বলে ”নাকে-মাছি বাবু। আর কি কপাল, সেই কি না ঝুমের শ্বশুর হতে চলেছে। ঝুমকে বলে দিতে হবে, ওঁর সামনে যেন না আসে।
ঝুম যে ভাল ছেলে পাকড়াও করেছে, তা সুচরিতা জানতো। অর্ক বলে ছেলেটি ইঞ্জিনিয়ার, ভালো চাকরি করে, বাড়ীর অবস্থা ভালো এইটুকুই জানতো সুচরিতা। কিন্তু বাবা যে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, সে কথা ঝুম তাকে জানায় নি, সে নিজেই বোধহয় জানতো না। অর্ক খুব চাপা ধরনের ছেলে, বাড়ীতে এসেছিলো তো, দেখেছে সুচরিতা। অত্যন্ত বিনয়ী, নিজের কথা ফলাও করে বলার মতো ছেলেই নয়। দেখেছে তো সুচরিতা, কাউন্সিলরের ছেলেদেরই কি ফাঁট, যেন কাউন্সিলর নয়, প্রধানমন্ত্রীর ছেলে। আর সেখানে অর্ককে দেখো, তার বাবা যে এতবড়ো একজন কেউকেটা, ঘুনাক্ষরে প্রকাশ করে নি তাদের কাছে। যেরকম স্বভাব, সেরকম রাজপুত্রের মতো দেখতে। কত্তোটা লম্বা, গায়ের রং পরিস্কার, বড়ো বড়ো চোখ, টিকোলো নাক, ঠিক যেরকমটি মেয়ের মা’রা মেয়ের জামাই চায়। মনে পড়ে যাচ্ছে কামদেব বাবার কথা, লাল্টুদার সাথে গিয়েছিলো ওনার আশ্রমে। ঝুমের হাত দেখে বলেছিলেন, এর হাতে শনির বলয় আছে। মাঝসমুদ্রে পড়ে গেলেও খড়-কুটো ধরে সে বেঁচে যাবে। চূড়ান্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও শেষ অবধি জিতে যাবে, এ মেয়ে রাজরাণী হবে। এতদিন বিশ্বাস হতো না ওনার কথা। আজ মনে হচ্ছে কামদেব বাবাই ঠিক বলেছিলেন। ঝুমের জন্মটাই তো অদ্ভুত। যে মেয়ের সরকারী হাসপাতালের ফ্রি বেডে হওয়ার কথা, তার কি না জন্ম হয়েছিলো ফাইভ স্টার নার্সিং হোমে। [যারা এই কাহিনীর প্রথমাংশ পড়েন নি বা ভুলে গেছেন, তাদের অনুরোধ করবো, সপ্তদশ পর্ব পড়ে নিতে।]
আরো অনেককথাই মনের মধ্যে ভীড় করে আসছে। বিশেষ করে মনে পড়ছে ঝুমের বাবার কথা। কিশোরীবেলার শেষে যৌবনে অভিষিক্তা হওয়ার সময়ে এসেছিলো সেই টগবগে যুবক। তার উদ্দাম প্রেমের বানভাসিতে ভেসে যেতো সুচরিতার কচি শরীর। সেই প্রেমের পরিনতি তাদের সন্তান ঝুম। অনেক ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে, যখন ভেবেছিলো একটু থিতু হতে পেরেছে, তখনই ভগবান তাকে কাছে টেনে নিলেন। কি যে হয়েছিলো, জানা যায় না। সালকিয়ার কোনো এক লোহার আড়ৎদারকে, লাল্টুদার পেমেন্ট করার জন্য, ব্রীফকেসে ভরে একলাখ টাকা নিয়ে যাচ্ছিলো। বাবুঘাট থেকে সালকিয়ার বাঁধাঘাটে লঞ্চে যাওয়ার সময়, হঠাৎই জলে পড়ে যায় শানু। কি ভাবে যে ঘটনাটা ঘটলো সে সম্পর্কে কেউই সঠিক করে কিছু বলতে পাবে না। কেউ বলে পা ফস্কে জলে পড়ে যায় শানু, আবার কেউ বা বলে ইচ্ছে করেই জলে ঝাঁপ দেয় সে। কেউ কেউ তো আবার এমন গল্পও ফাঁদে, যে সেদিন না কি রেসের মাঠে দেখা গিয়েছিলো শানুকে। লাল্টুদার পয়সায় রেসে বাজী ধরে, হেরে গিয়ে, ভয়ে জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে সে। যত্তোসব ফালতু কথা। লাল্টুদার সাথে রেসের মাঠে যেতো শানু, এ কথা সুচরিতা জানতো। বাড়ীতে রেসের বই পড়ে রেসের টিপস দিতো, এ কথাও সে শুনেছে। কিন্তু নিজে রেস খেলবে, তাও আবার লাল্টুদার পয়সায়, এই মানসিকতার লোকই শানু নয়। সুচরিতা শুনেছে, ছোটে মিয়া বলে একজন লাল্টুদাকে ভুলভাল টিপস দিতো। শানু রেসের বইটই পড়ে, হিসেব কষে ঠিকঠাক টিপস দিতেই, লাল্টুদা ছোটে মিয়াকে ভাগিয়ে দেয়। তারাই হয়তো শানুর প্রতি পুরনো রাগে, এইসব গল্প রটায়। তাছাড়া বাচ্চা ঠাকুরের মতো লাল্টুদার পুরনো কর্মচারীরাও, শানুর হঠাৎ করে লাল্টুদার প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠাটাকে ভালো চোখে দেখে নি। তারাও শানুর মৃত্যুর পরেও, তার চরিত্র কলুষিত করতে এই গল্প চাউর করে। লাল্টুদার কানেও নিশ্চই এই গল্প পৌঁছেছিল। উনি বিশ্বাস করতেন কি না, কে জানে, কিন্তু কখনোই সুচরিতার সঙ্গে, এই বিষয়ে আলোচনা করেন নি।
সেই দিনটা লাল্টুদা কলকাতায় ছিলেন না, পার্টির একটা সম্মেলনে যোগ দিতে বহরমপুর গিয়েছিলেন। খবর পেয়ে, সেদিন রাতেই রওনা দিয়ে, পরের দিন সকালে কলকাতা পৌঁছেছিলেন। এরপরেই পুলিশ-প্রশাসনে প্রভাব খাটিয়ে শানুর বডি উদ্ধারের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লেন। দুষ্টু লোকেরা অবশ্য বলে, শানুর বডি উদ্ধার নয়, লাল্টুদার এই তৎপরতার মূল উদ্দেশ্য ছিল, তাঁর টাকাটা উদ্ধার করা। গঙ্গায় জাল ফেলা হলো, ডুবুরি নামানো হলো, কিন্তু কোনোই লাভ হলো না। অবশেষে দিনদুয়েক পরে শানুর বডি ভেসে উঠলো বজবজের কাছে এক ঘাটে, টাকা ভর্তি ব্রিফকেসটা উদ্ধার হলো না। লাল্টুদা অবশ্য পুলিসকে এই টাকাটার কথা ঘুনাক্ষরে জানান নি, কারণ এই টাকাটা ছিলো কালো টাকা। মনের দুঃখ মনেই চেপে রেখে, তিনি শানুর ডেডবডি ময়নাতদন্তের পরে সৎকারেরর ব্যবস্থা করলেন। পাথরের মূর্তির মতো স্তব্ধ সুচরিতা, তার প্রেমিক, তার স্বামীর মুখাগ্নি করলো। কোলে তার ছয়বছরের শিশু ঝুম, যে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে ছিলো, তার মৃত বাবার দিকে। ঝুম বুঝতেও পারলো না, সেদিন সে কাকে হারালো।
শানুর মৃত্যুর পর সুচরিতা লাল্টুদাকে আঁকড়ে ধরলো। তার বাপের বাড়ি থেকে ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিলো। কিন্তু জেদী সুচরিতা তাদের কাছে ফিরে যেতে চায় নি, যারা তার ভালবাসার মানুষকে অপমান করেছিলো। তার কাছে তাই শেষ অবলম্বন ছিল লাল্টুদা। অবশ্য লাল্টুদাও তার উপরে নির্ভর করতে শুরু করেছিলেন। আসলে নিজের পরিবারে, তিনি ছিলেন একা। ছেলেমেয়েরা সব বড়ো হয়ে গিয়েছিলো, বাবার পয়সায় লাটসাহেবি করতে তাদের আপত্তি নেই, কিন্তু লম্পট বাবাকে শ্রদ্ধা করতে তাদের আটকাতো। পরনারীর প্রতি আসক্তির জন্য তার স্ত্রীও তার প্রতি বিমুখ ছিলো। ফলে নিজের বাড়ীর সঙ্গে সম্পর্ক খুবইক্ষীণ হয়ে আসছিলো লাল্টুদার। খাওয়া আর শোওয়া ছাড়া বাকি সময়টুকু পার্টি অফিসে বা সুচরিতার ফ্ল্যাটেই পাওয়া যেত তাকে। আস্তে আস্তে বাড়ীতে খাওয়া-শোওয়াটাও অনিয়মিত হয়ে গেল তার। প্রথম প্রথম বাড়ীর কাজের লোক পার্টি অফিসে খাবার দিয়ে যেতো, টিফিন ক্যারিয়ারে করে। এর কিছুদিন পর, সুচরিতার বাড়ীতেই তার দুবেলার রান্না হতো, এবং রাতের শোওয়াটাও।
দলেও লাল্টুদা ক্রমঃশ কোনঠাসা হচ্ছিলেন। একজন স্বল্পশিক্ষিত লোক আঞ্চলিক নেতা হয়ে উঠলে, দলের বুদ্ধিজীবি শ্রেণীর লোকদের অস্বস্তি হয়। এই “বুদ্ধিজীবি” ব্যাপারটা কি, খায় না হেগে ছোঁচায়, সেটা লাল্টুর মাথায় ঢুকতো না। যাদের চারটে লোক জোটানোর ক্ষমতা নেই, তাদের বড় বড় জ্ঞান শুনলে তার মটকা গরম হয়ে যায়। এছাড়া পার্টি এবং ব্যবসাসূত্রে, তার রাতারাতি ফুলেফেঁপে ওঠার পার্টির “হ্যাভ নটস” শ্রেণীর মধ্যে বিক্ষোভের সঞ্চার করেছিলো। আরে বাবা, তোরাও পারলে খা না। পার্টি কি বারণ করেছে খেতে? রাজ্যটাতো আমাদের, লুটেপুটে খা। তা না করে লাল্টুর পিছনে লাগা। তবে পার্টিতেও একটু রদবদল শুরু হয়েছে। সদ্য তখন মুখ্যমন্ত্রী বদল হয়েছিলো। বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ মুখ্যমন্ত্রী শুদ্ধিকরণের ডাক দিয়েছেন। যদিও পুরোটাই ছিল আইওয়াস, বড়ো বড়ো রাঘব বোয়ালদের কিছুই হবে না। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর ছেলেই তো ল্যাম্প কোম্পানীর চারশো টাকা মাইনের কেরাণী থেকে বৃহৎ শিল্পপতি হয়ে গেছে। কিন্তু জনগণের কাছে সততার ইমেজ দেখানোর জন্য, লাল্টুর মতো দু-চারটে চুনোপুঁটি ধরা পড়তেই পাড়ে। তাই লাল্টু নিজেকে একটু গুটিয়ে নেয়। এই পরামর্শটা তাকে দিয়েছিলো সুচরিতা।
ভালবাসার ভিখারি