29-06-2023, 10:07 AM
ত্রিপঞ্চাশৎ পর্ব
এই যে কোন রেসে আপসেট রেজাল্ট হবে এবং সেই রেসে নন-ফেবারিট ঘোড়াগুলির মধ্যে, কোন বিশেষ ঘোড়াটি জিতবে, সেটা ধরতে পারলেই কেল্লা ফতেহ্। আর এটা speculation করার নামই “guesstimation” (guess+estimation = guesstimation)। কিছুটা guess অর্থ্যাৎ অনুমান এবং বাকিটা estimation অর্থ্যাৎ প্রাক্কলন-এর সমন্বয়ে এই প্রক্রিয়া অর্থনীতিতে বহুব্যবহৃত। শেয়ার বাজারে শেয়ারের দামের speculation করার জন্যও guesstimation পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। বেশ কয়েকদিন রেসের মাঠে এসে এবং একটু-আধটু রেসের বই-টই ঘেঁটে, স্বাভাবিক বুদ্ধিতে, মাঠের ঘাৎঘোৎ, শানুরও এখন জানা হয়ে গেছে। সে ধরতে চেষ্টা করে, কোন রেসে কোন ঘোড়া জিতবে। কিন্তু এই ব্যাপারে কিছু বলতে গেলেই, ছোটে মিয়া নুর নাচিয়ে বলে, “জুম্মা জুম্মা আটদিন নহী হুয়া বাবু, ইয়ে ময়দান মে আকে। পহলে সিনে মে ঘোড়ে কি লাথ খাইয়ে, ফির টিপস দেনা”। শুনে কালো কালো দাঁত বার করে, খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে থাকে বাচ্চা ঠাকুর। অপমানে কান লাল হয়ে যায় শানুর। ওদের সামনে আর মুখ খোলে না সে। কিন্তু নিজের মনে মনেই সে তার speculation-এর প্রক্রিয়া চালু রাখে। ক্রমশঃ এটা তার নেশায় পেয়ে বসে।
এই যেমন আজ। পরপর চারটে রেসে ফেবারিট ঘোড়া জেতার পরে, শানু নিশ্চিত ছিল যে, পঞ্চম রেসে আপসেট হবেই। কিন্তু ফেবারিটকে বাদ দিয়ে, বাদবাকি ঘোড়াগুলোর মধ্যে কোনটা জিতবে? লাল্টুদা একটা রেসের বই কেনে বটে, কিন্তু পড়ে না, টেবিলের উপর বইটা পড়ে থাকে। ওটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করলো শানু। পিঙ্ক অর্কিড ঘোড়াটা তার খুব মনে ধরেছে। এটা ঘোড়া নয়, ঘোড়ী। পাঁচ বছর বয়স, রেসের পক্ষে একটু বেশী। গত বছর এটা হায়দ্রাবাদ ডার্বিসহ বেশ কিছু ইভেন্ট জিতেছিলো, কিন্তু এ বছর তার ঝুলি ফাঁকা। কোনো রেসে একটা প্লেসও পায় নি। তাহলে কি পিঙ্ক অর্কিড ফুরিয়ে গেলো? হঠাৎ একটা জিনিষ লক্ষ্য করে, শানুর মাথায় চিরিক করে বিদ্যুত খেলে গেল। এই রেসের ফেবারিট ঘোড়া টার্ফ এম্পেরর এবং পিঙ্ক অর্কিডের মালিক একই – চেন্নাইয়ের রামস্বামী। তাহলে কি রামস্বামী ফেবারিট টার্ফ এম্পেররকে টেনে দিয়ে পিঙ্ক অর্কিডকে রেস জেতাবে? পিঙ্ক অর্কিডের জকি ক্রিস্টোফার খুবই অভিজ্ঞ, সে জায়গায় টার্ফ এম্পেররের জকি স্বদেশ নাইডু এখনো ট্রেণী আছে। রামস্বামীর যদি টার্ফ এম্পেররকেই জেতাতে হতো, তাহলে তো সে ক্রিস্টোফারকেই এই ঘোড়ার জকি রাখতো। তাছাড়া টার্ফ এম্পেরর আছে এক নম্বর লেনে; sharp bend ঘুরে ঘোড়াকে স্টেডী রাখতেই ট্রেণী জকি স্বদেশ নাইডু হিমসিম খেয়ে যাবে, উইন করা তো পরের কথা। সে জায়গায় পিঙ্ক অর্কিড আছে চার নম্বর লেনে, অভিজ্ঞ জকি ক্রিস্টোফারের হাতে, সব থেকে স্মুথলি বেন্ড ঘুরতে পারবে সে। এছাড়া এ বছর পিঙ্ক অর্কিডের পারফর্ম্যান্স ক্রমাগত খারাপ হওয়ায়, তার হ্যান্ডিক্যাপও অনেক কম, এটাও তার একটা advantage. তাহলে আজ কি তার দিন? আজই কি পিঙ্ক অর্কিড ঘুরে দাড়াবে? ছোটে মিয়ার কাছ থেকে শানু শুনেছে, এ রকম ঘটনা রেসের মাঠে আকছার হয়।
মনে মনে গোটা অঙ্কটা কষে নেওয়ার পর, শানু নিঃসন্দেহ হয়ে গেলো যে পিঙ্ক অর্কিডেই এই রেসের ব্ল্যাক হর্স। লাল্টুদা যথারীতি ছোটে মিয়ার পরামর্শ মতো টার্ফ এম্পেররই খেলবেন। সঙ্গে সেকেন্ড এবং থার্ড ফেবারিটকে নিয়ে কুইনালা এবং টানালা। একবার ভাবলো লাল্টুদাকে তার স্পেকিউলেশনের ব্যাপারটা বলবে। তারপরই মনে হলো, কি দরকার তার, না মিললে ফালতু খোরাক হয়ে যাবে। এই ভেবে শানু চুপ করে রইলো। বাচ্চা ঠাকুরকে তিরিশ হাজার টাকা গুনে দিয়ে, শানু স্ট্যান্ড থেকে বেরিয়ে এলো। টিকিট কাউন্টারের সামনে এসে একটা সিগারেট ধরালো। টোটেতে কুইনালা – টানালার টিকিট কেটে, বাচ্চা ঠাকুর বুকিদের স্টলের দিকে গেলো, উইনের পরচি কাটতে। রেস শুরু হতে আর মাত্র মিনিট পাঁচেক বাকি আছে। হঠাৎ কি মনে হলো, সিগারেটটা ফেলে দিয়ে, পা দিয়ে পিষে, টোটের টিকিটের লাইনে দাড়িয়ে গেলো সে।
বেশ লম্বা লাইন পড়েছে, টিকিট পাওয়ার চান্স কম। তার নিজের কাছে মাত্র দশটা টাকা পড়ে আছে, ও দিয়ে এক টিকিট খেলা যাবে। একটু ইতঃস্তত করে, লাল্টুদার ফোলিও ব্যাগ থেকে একটা একশ টাকার নোট বার করে হাতের মুঠোয় রাখলো। মনটা একটু খচখচ করছে। না বলে লাল্টুদার ব্যাগ থেকে টাকা নেওয়া হলো। যদি না জেতে, তাহলে হিসাব দেবে কি করে? লাল্টুদা অবশ্য এতো ছোটখাটো আ্যমাউন্টের হিসাব নিয়ে মাথা ঘামান না, কিন্তু তার accountant ধূর্জটিবাবুকে পাইপয়সার হিসাব বুঝিয়ে দিতে হয়। কতো টাকা নিয়ে এসেছে, কতো টাকার খেলা হয়েছে, কোনো প্রাইজ মানি পেয়েছে কি না, সব বুঝিয়ে দিয়ে, বাকি টাকা ফেরত দিয়ে তবে সে রেহাই পায়। এখন একশো টাকা কম পড়ে গেলে, হিসাব মেলাবে কি করে? একবার ভাবলো লাইন থেকে বেরিয়ে যায়। তখনই কেমন যেন জেদ চেপে গেলো তার। ধূর্জটিবাবুকে বলবে, টাকাটা হারিয়ে গেছে, তার মাইনে থেকে কেটে নেওয়া হোক। দাঁতে দাঁত চিপে, টাকা ধরা হাতের মুঠোটা পিষে ধরলো সে। তার সামনে আরমাত্র দুজন, কিন্তু রেস শুরু হতে আর এক মিনিটও বাকি নেই। টিকিট কি আদৌ সে পাবে?
ভালবাসার ভিখারি