21-06-2023, 09:58 PM
পর্বঃ৩১
আলিফ অস্থির হয়ে আছে। তার চোখমুখ লাল। সে ঘামছে। রুদ্র ছুঁটে এসে আলিফের পাশে বসল। সে বলল, "তুই এমন করছিস কেনো? কি হয়েছে?"
আলিফ নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। তার বারবার ওই পশুদের কথা মনে পরছে। সে উত্তেজিত হয়ে রুদ্রকে বলল, "ওরা মোট পাঁচজন ছিলো, রুদ্র। কিন্তু খবরে বলছে চারজন। কেনো? কেনো?" শেষের কেনোটা একটু চিৎকার করেই বলল আলিফ।
রুদ্র কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। সে আগে আলিফকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। ঠিক সেই মুহুর্তে আলিফের মা এলো। সে আলিফকে এই অবস্থায় দেখে ছুঁটে এসে জিজ্ঞেস করল, "কি হয়েছে খোকা? তুই এমন করছিস কেনো?"
আলিফ বলল, "মা, খবরে কেনো মিথ্যে বলছে? ওরা পাঁচজন ছিলো। পাঁচজন মিলে আমাকে আর নদীকে....!" আলিফ কথাটা শেষ করতে পারলো না। সে কেঁদে দিলো। তার চোখ বেয়ে নিরব আর্তনাদ বেড়িয়ে এলো। তার অসহায় লাগছে। সে বাঁচতে চায় না। সে নদীর সামনে কিভাবে দাঁড়াবে? আলিফ কেঁদেই গেলো। তার মা এবং রুদ্র কোনো কথা বলল না। তারাও চাচ্ছে আলিফ কাঁদুক। ওর মনটা হালকা হোক।
মিনিট দশেক পরে নিরবতা ভেঙে রুদ্র বলল, "তোর কি খুব খারাপ লাগছে?"
আলিফ মুখে কিছু বলল না। তবে রুদ্রের চোখের দিকে তাকালো। রুদ্র বাকীটা নিজেই বুঝে নিলো।
রুদ্র আলিফের মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, "আন্টি আপনি টেনশন করবেন না। আমি আছি ওর পাশে। এখন ও একটু ভালো বোধ করছে।"
আলিফের মায়ের মুখ মলিন। তার চোখও ভেজা। সে কিছু না বলে বেড়িয়ে এলো। বাইরে আসতেই আলিফের বাবা মিনহাজের সাথে দেখা হলো তার।
মিনহাজ জিগ্যেস করলো, "ছেলের কি অবস্থা?"
"এখন একটু ভালো। তুমি কি অফিস থেকে সরাসরি এখানে এসেছ?"
"হ্যাঁ, মনটা অস্থির হয়ে ছিল সারাদিন। তাই ভাবলাম এসে ছেলেকে দেখে যাই।"
"ভালো করেছ। যাও দেখে এসো। তারপর একসাথে বাসায় যাই। রাতে আবার আসতে হবে।"
মিনহাজ ভেতরে ঢুকে ছেলেকে দেখে দ্রুতই বেরিয়ে এলো। রুদ্রের সাথে তার দুইএকটা কথা হলো সেই সাথে আলিফের সাথেও।
আলিফ এখন একটু স্বাভাবিক। তার শরীরটাও আগের থেকে ভালো। আলিফ বলল, "নদীর কি খবর?"
রুদ্র ঠিক কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। তবে সে আলিফকে সান্ত্বনা দিতে বলল, "আগের থেকে অনেকটা ভালো।"
"রুদ্র, আমাদের সাথেই কেনো এমটা হলো? কি এমন দোষ করেছি যে সেই দোষের শাস্তি পাচ্ছি এভাবে? আমি এখন নদীর সামনে কি মুখ নিয়ে দাঁড়াবো? আমি যে ওকে প্রচন্ড ভালোবাসি।" কথাগুলো বলাতে বলতে আলিফের চোখ বেয়ে অশ্রু বেরিয়ে এলো।
রুদ্র আলিফকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলো, "তুই কেনো বলছিস ওরা পাঁচজন ছিল? সিসিটিভি ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চারজন।"
"হ্যাঁ, ওরা প্রথমে চারজনই ছিল। চারজন মিলে আমাদের জিম্মি করে ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু পরিত্যক্ত বিল্ডিংয়ে আগে থেকেই আরেকজন ছিল।"
"আচ্ছা তুই আমাকে প্রথম থেকে সবটা খুলে বল। তারপর আমি দেখি কি করা যায়।'
আলিফ পুরো ঘটনাটা প্রথম থেকে রুদ্রকে বলতে শুরু করলো।
"তুই দ্বিতীয়বার যখন আমাকে ফোন দিস তখন আমি বাসা থেকে বের হই। আমি সবেমাত্র নিচে নেমেছি ঠিক সেই সময় নদীর মেসেজ এলো। মেসেজে লেখা ছিল, "আলিফ, আম্মার শরীরটা হটাৎ খুব খারাপ হয়ে গেছে। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। তুমি কি একটু বাসায় আসবে?"
আমি মেসেজটা দেখে বাসায় ব্যাগটা রেখে তাৎক্ষণিক নদীর বাসায় যাই। ওখানে গিয়ে দেখি আন্টির অবস্থা আসলেই খারাপ। প্রথমে ভেবেছিলাম প্রেসার বেড়েছে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও প্রেসার কমাতে পারছিলাম না। তার মধ্যে তুই বারবার কল দিয়েই যাচ্ছিলি। বারবার রিং বাজছিল বলে আমি ফোনটা সাইলেন্স করে রাখি। আমি মনে মনে ভেবছিলাম, আন্টির শরীরটা আগে স্বাভাবিক হোক। নদীকে এই অবস্থায় একা রেখে আমি কোথাও যেতে পারবো না। যদি আন্টি একটু সুস্থ হয় তাহলে আজকে যেতে না পারলেও কাল ভোরে গাড়িতে করে চলে আসতে পারবো। তাই যাওয়া নিয়ে চিন্তা করছিলাম না। কিন্তু এদিকে রাত যত বাড়তে থাকলো তত আন্টির শরীরটা খারাপ হতে থাকলো। আমরা বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কি করবো। পরে নদী বলল, "আলিফ, চলো কোনো ফার্মেসি থেকে ডাক্তার ডেকে আম্মাকে দেখাই। আমার খুব ভয় করছে। যদি আম্মার কিছু একটা হয়ে যায়, তখন কি হবে?" প্রথমে আমি নদীকে বলেছিলাম, "আমি একা যাই তুমি আন্টির পাশে থাকো।" নদী বলল, "ফার্মেসি তো বাসার কাছেই। চলো একসাথে যাই। সমস্যা নেই।"
আমি আর নদী ডাক্তার আনতে বাসা থেকে বের হই। নিচে নেমে দেখি প্রথম ফার্মেসিটা বন্ধ। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখি পরেরটাও বন্ধ। আমরা চিন্তাই পরে যাই। তখন নদী বলল, "একটু সামনেই আরেকটা ফার্মেসি আছে। ওখানে গিয়ে দেখি খোলা আছে কি-না।" আমি নদীকে বলি, "ওটা তো অনেক দূর। আর ওদিকটা মানুষের আনাগোনা একদম কম।" নদী আমার কথা শুনে হেসে হাত নাড়িয়ে বলে, "ভয় পাচ্ছ? ঢাকা শহরে এগারোটা কি কোনো রাত? তুমি সাথে আছ না, আমার ভয় কিসের?" আমিও জানি কোনো সমস্যা হবে না। তবুও কেনো জানি মন সায় দিচ্ছিলো না ওদিকে যাওয়ার জন্য। তবুও নদীর মুখের দিকে তাকিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। ও অনেক টেনশন করছিল আন্টির জন্য। তাই আমি ওকে বাঁধা দিলাম না। কিন্তু বিপদ তো আর জানিয়ে আসে না।"
আলিফ এটুকু বলে থামলো। ওর মুখ মলিন। রুদ্র কোনো কথা বলল না। সে জানে, কিছুটা সময় নিয়ে আলিফ নিজ থেকেই বাকীটা বলবে।
"আমরা হেঁটে যাচ্ছিলাম। প্রায় ফার্মেসির কাছে চলে এসেছিলাম। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম ফার্মেসিটা খোলা আছে। ঠিক তখনই কোথা থেকে একদল ছেলে এসে আমাদের ঘিরে ধরলো। আমরা কিছু বোঝার আগেই দুইটা ছেলে আমাদের দুইজনের গলায় ব্লেড চেপে ধরলো। আর বলল, " নড়াচড়া করলে এটা সোজা গলায় চালিয়ে দিবো।" আমি দুইবার ছোটার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। তৃতীয়বার যখন চেষ্টা করি তখন গলায় যে ছেলেটা ব্লেড চেপে ধরেছিলো সে আমার গলায় পোচ দিতেই গলা বেয়ে তাজা রক্ত বের হয়ে আমার শার্ট ভিজে গেলো মুহুর্তে। প্রচন্ড ব্যথায় আমি সম্পূর্ণ হুসে থাকলাম না। মাথাটা ঘুরছিল শুধু। আর বুঝতে পারছিলাম ওরা আমাদের নিয়ে যাচ্ছে কোনো এক জায়গায়। অন্য দিকে নদী এমনিতেই কথা বলতে পারে না। ওর কেমন লাগছিল ও-ই জানে। তবে আমি যে কয়বার ওর দিকে তাকিয়েছি সেই কয়বার দেখেছি ওর চোখ অশ্রুতে ভেজা।"
আলিফের চোখ ভিজে উঠেছে। সে কিছুটা সময় নিলো নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার। তারপর আবার বলল, "বাকীটা তো জানিস। ওরা কি করেছে আমাদের সাথে। কী নির্মম ভাবে আমাকে মেরেছে। একটা সময় পর আমার আর হুস ছিলো না৷ তবুও ওরা আমাকে মেরেছে। আর নদীকে একজনের পর একজন ইচ্ছেমতো ভোগ করেছে৷ বোমা একটা মেয়ে কিছু বলতেও পারেনি চিৎকার ও করতে পারেনি। ওরা মানুষ না, ওরা পশু, জানোয়ার। কিন্তু খবরে কেনো বলছে ওরা চারজন? ওরা মোট পাঁচজন আর বাকী যে ছিল সে ওদের লিডার। ও-ই প্রথমে নদীকে.....!" আলিফ হঠাৎ চিৎকার শুরু করলো। রাগে ক্ষোভে গালাগালি দিতে থাকলো ওদেরকে।
"একটু শান্ত হ আলিফ। আমি দেখছি কি করা যায়। আমি ইন্সপেক্টর আবিরের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে তাকে সবটা বুঝিয়ে বলছি। প্লিজ তুই এরকম পাগলামি করিস না।" রুদ্র বলল।
আলিফ চিৎকার থামিয়ে নিরবে কান্না করতে থাকলো। সে রুদ্রকে বলল, "রুদ্র, আমি একটু একা থাকতে চাচ্ছি।"
রুদ্র বলল, "আমি আশেপাশেই আছি। কোনো দরকার হলে আমাকে কল দিস।"
রুদ্র বেরিয়ে এসে ঠিক করলো সবার আগে ইন্সপেক্টর আবিরের সাথে সে দেখা করবে। সে সরাসরি থানার দিকে রওনা করলো।
থানায় পৌঁছে রুদ্র জানতে পারলো, আবির থানায় নেই। বিকালেই ছুটি নিয়ে একবারে চলে গেছে। সে আবিরের ঠিকানা সংগ্রহ করলো। সে ঠিক করলো বাসায়ই তার সাথে দেখা করবে।
ইন্সপেক্টর আবিরের বাসায় পৌঁছাতে রুদ্রের অনেকটা দেরি হয়ে গেলো। দেরি হওয়ার মূল কারণ রাস্তায় জ্যাম। কিন্তু রুদ্রের মনে আশা ছিল দেরি হলেও বাসায় এসে ইন্সপেক্টর আবিরের সাথে দেখা হবে তার৷ কিন্তু সে আশাহত হলো। ইন্সপেক্টর আবির বাসায় নেই। সে বাসায়ই ফেরে নি। তাহলে ইন্সপেক্টর আবির গেলো কোথায়? তাকে কোথায় খুঁজবো? রুদ্র কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। সে উদ্দেশ্যেবিহীন ভাবে রাস্তায় হাঁটতে থাকলো। এবং নানা কিছু ভাবতে থাকলো। তার হঠাৎ সবকিছু কেমন গোলমেলে লাগছে। বিকালে হঠাৎ ইন্সপেক্টর আবিরের হাসপাতালে আসা। এই কেসটা এতো দ্রুত সমাধান হওয়া। রুদ্রের এখন মনে হচ্ছে, সবকিছু কেমন যেনো আগে থেকেই ঠিক করা। নিশ্চিত এখানে অন্য কিছু লুকিয়ে আছে। আমরা যা দেখছি তা পুরোপুরি সত্য নয়। আমরা মিথ্যের মধ্যে আছি। এবং কেউ সত্যটা সামনে আসতে দিচ্ছে না। সে চাচ্ছে দ্রুত কেসটা সমাধান হয়ে যাক। সেই কারণেই সবকিছু এতো দ্রুত ঘটছে। রুদ্রের হঠাৎ মনে হলো কেসটা আদালতে গেলে প্রথম দিনই সমাধান হয়ে যাবে। এবং কি হতে পারে রুদ্র সেটা স্পর্শ ধারনা করতে পারছে। এরকম কেসের রায় সে আগেও পত্রিকায় পড়েছে। আসামি যদি নেশাগ্রস্ত থাকে এবং সেটা প্রমানিত হয় তাহলে তার অপরাধ সেভাবে মূল্যায়ন হয় না। তাহলে আলিফ এবং নদীর সাথে যারা এরকম করেছে তাদের কি শাস্তি হবে না?
রুদ্রের রাগ হচ্ছে। ঠিক কার উপর সে জানেনা। সে এখন রিকসায়। রিকসাওয়ালাকে সে কোথায় নিয়ে যেতে বলেছে সে ভুলে গেছে। সে মনে করতে পারছে না। সে মনে করতে চায় ও না। যেখানে ইচ্ছে তাকে নিয়ে যাক। শুধু সে চায় তাকে অনেক দূরে কোথাও নিয়ে যাক। যে সমাজে ক্ষমতার জোরে জানোয়ারদের কোনো শাস্তি হয় না, সেই সমাজে সে আর থাকতে চায় না। কিন্তু সে জানে সে কোথাও পালাতে পারবে না। তাকে এই নোংরা সমাজেই থাকতে হবে। নোংরা মানুষগুলোর সাথে বাঁচতে হবে। এবং চিৎকার করে সে কিছু বলতেও পারবে না। যেভাবে বলতে পারবে না ইন্সপেক্টর আবিরও। রুদ্রের হঠাৎ মনে হলো, নদীরাই ভালো। অনন্ত বোমা সেজে অভিনয় করতে হয় না।
রিকসাওয়ালা হঠাৎ রিকসা থামালো। সে বলল, "মামা চলে এসেছি নামেন।"
রুদ্র আশেপাশে তাকালো। সে প্রথমে কিছুই চিনতে না পারলেও কিছুক্ষণ পরে সে বুঝতে পারলো সে কোথায়। সে রিকসা থেকে নেমে ভাড়া মিটিতে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রইল।
রুদ্র এখন দাঁড়িয়ে আছে রিয়ার বাসার সামনে৷ সে এখানে কেনো এসেছে? সে কি রিকসাওয়ালাকে এখানেই আসার কথা বলেছিলো? সে পুরোপুরি মনে করতে পারলো না। তাহলে কি তার অবচেতন মন এখন রিয়াকে দেখতে চাচ্ছে? রুদ্র কি করবে সিন্ধান্ত নিতে পারছে না৷ সে ঘড়ি দেখল এখন প্রায় মধ্যরাত। কিছুক্ষণ পরেই নতুন দিন শুরু হবে। সে একবার ভাবলো রিয়াকে একটা কল দিবে পরক্ষণেই ভাবলো এই সময় কল দেওয়া ঠিক হবে না। তার এমন লাগছে কেনো? বুকের মধ্যে অদ্ভুত, অন্য রকম একটা অনুভূতি হচ্ছে। সে এই মুহুর্তে নিজেকে বুঝে উঠতে পারছে না। সে এখন নিজের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত।
রুদ্র কোথাও পড়েছিল," মানুষ যখন প্রচন্ড হতাশার মধ্যে থাকে তখন অবচেতন মন তার প্রিয় মানুষটিকে খোঁজে। তার বুকে আশ্রয় নিতে চায়।" কিন্তু রিয়া কি তার প্রিয় মানুষ? সে কি রিয়াকে ভালোবাসে? রুদ্র এই প্রশ্নের উত্তর জানেনা। ঠিক তখনই তরুর কথা মনে পড়লো তার। তরুর কথা মনে পড়তেই সে অবাক হলো। অনেকদিন পর আজ হঠাৎ তরুর কথা মনে পড়েছে তার। সে কি তরুকে দিনদিন ভুলে যাচ্ছে? রুদ্র এই প্রশ্নের উত্তরও জানে না। সে আজ কিচ্ছু জানেনা। সে জানেনা সে কাকে ভালোবাসো? যাকে সে কখনো দেখেনি, শুধু তার কয়েকটা চিঠি পড়েছে কিন্তু চিঠিগুলো অন্য এক রুদ্রকে লেখা, তাকে? নাকি যে তাকে বাস্তবে প্রচন্ড ভালোবাসা, তাকে?
দ্বিধান্বিত একটা জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে রুদ্র। কিন্তু সে আর দ্বিধার মধ্যে থাকতে চায় না। এটাও সত্যি সে এখনো জানে না সে কাকে ভালোবাসে! কিন্তু তার মায়া হয় তরু মেয়েটার জন্য। মেয়েটাকে সে একবার হলেও দেখতে চাই। শুধু একবার। কিন্তু তরু কোথায় আছে? কত দূর আছে? তাকে সে কোথায় খুঁজবে? রুদ্রের হঠাৎ প্রচন্ড মাথাব্যথা শুরু হলো। সে আর কিছুই ভাবতে চাচ্ছে না।
রিয়াকে এই সময় ফোন দেওয়া ঠিক হবে না ভেবে রুদ্র চলে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই পিছন থেকে রুদ্র বলে কেউ তাকে ডাকলো। কণ্ঠটা তার পরিচিত। সে জানে, পিছনে রিয়া দাঁড়িয়ে আছে।
রিয়া দৌড়ে এলো। ততক্ষণে রুদ্র পিছন ফিরে তাকিয়েছে। রিয়া তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলো, "তুমি এই সময় এখানে?"
রুদ্র এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না। রিয়াই আবার বলল, "আচ্ছা বলতে হবে না। কিন্তু যখন এলেই তখন আমাকে কল না দিয়ে কেনো চলে যাচ্ছিলে?"
"তোমাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে কি-না বুঝতে পারছিলাম না।"
"তুমি সবসময় একটু বেশি বুঝো। যদি আমি বারান্দা থেকে তোমাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে না দেখতাম তাহলে তুমি চলেই যেতে।"
"সরি!"
"সরি কেনো বলছ? আমি কি তোমাকে কিছু বলেছি?" রিয়া কিছুক্ষণ থেমে সে আবার বলল, "তোমার কি হয়েছে রুদ্র? তোমার কি মন খারাপ? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো?" রিয়া আগে কখনো রুদ্রকে এভাবে বিধ্বংসী অবস্থায় দেখেনি।
"আমার ভালো লাগছে না। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না রিয়া। মরে যেতে ইচ্ছে করছে। বুকের মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার কোথাও যাওয়ার নেই। আমি পুরোপুরি নিজেকে চিনতে পারছি না।"
রুদ্রকে এভাবে কথা বলতে রিয়া আগ কখনো দেখেনি। রিয়ার বুকের মধ্যে হঠাৎ কেমন করে উঠলো। সে নিজেই বুঝতে পারলো না তার কেনো এমন লাগছে। রুদ্রের মরে যাওয়ার কথা শুনে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এই মানুষটা না থাকলে সে বাঁচবে কি করে?
রুদ্র আকস্মিক রিয়াকে বলল, "রিয়া, আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবে? একটু, অতি সামান্য!"
রুদ্রকে আগে কখনো এভাবে কথা বলতে রিয়া দেখেনি। এই রুদ্র তার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। তবুও সে কিছু না ভেবে এগিয়ে গিয়ে রুদ্রকে জড়িয়ে ধরলো।
রিয়ার বুকের মধ্যে রুদ্র বাচ্চা শিশুর মত গুটিয়ে রইলো। সে পরম মায়ায় কিছুক্ষণ ডুবে রইলো। একটা অদ্ভুত ঘ্রাণ ক্রমশ তাকে আসক্ত করে রাখলো। সে কিছুসময়ের জন্য সব ভুলে গেলো। তার হতাশা, যন্ত্রণা, মাথাব্যথা ক্রমশ বিলীন হয়ে গেলো।
রিয়া সবকিছু ভুলে বেশকিছু সময় রুদ্রকে জড়িয়ে রাখলো তার বুকে। সে এই মুহুর্তে স্থান কাল ভুলে গেছে। সে এখনো জানে না, দূর থেকে দুটো চোখ তাকে দেখছে!
চলবে....!
আলিফ অস্থির হয়ে আছে। তার চোখমুখ লাল। সে ঘামছে। রুদ্র ছুঁটে এসে আলিফের পাশে বসল। সে বলল, "তুই এমন করছিস কেনো? কি হয়েছে?"
আলিফ নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। তার বারবার ওই পশুদের কথা মনে পরছে। সে উত্তেজিত হয়ে রুদ্রকে বলল, "ওরা মোট পাঁচজন ছিলো, রুদ্র। কিন্তু খবরে বলছে চারজন। কেনো? কেনো?" শেষের কেনোটা একটু চিৎকার করেই বলল আলিফ।
রুদ্র কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। সে আগে আলিফকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। ঠিক সেই মুহুর্তে আলিফের মা এলো। সে আলিফকে এই অবস্থায় দেখে ছুঁটে এসে জিজ্ঞেস করল, "কি হয়েছে খোকা? তুই এমন করছিস কেনো?"
আলিফ বলল, "মা, খবরে কেনো মিথ্যে বলছে? ওরা পাঁচজন ছিলো। পাঁচজন মিলে আমাকে আর নদীকে....!" আলিফ কথাটা শেষ করতে পারলো না। সে কেঁদে দিলো। তার চোখ বেয়ে নিরব আর্তনাদ বেড়িয়ে এলো। তার অসহায় লাগছে। সে বাঁচতে চায় না। সে নদীর সামনে কিভাবে দাঁড়াবে? আলিফ কেঁদেই গেলো। তার মা এবং রুদ্র কোনো কথা বলল না। তারাও চাচ্ছে আলিফ কাঁদুক। ওর মনটা হালকা হোক।
মিনিট দশেক পরে নিরবতা ভেঙে রুদ্র বলল, "তোর কি খুব খারাপ লাগছে?"
আলিফ মুখে কিছু বলল না। তবে রুদ্রের চোখের দিকে তাকালো। রুদ্র বাকীটা নিজেই বুঝে নিলো।
রুদ্র আলিফের মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, "আন্টি আপনি টেনশন করবেন না। আমি আছি ওর পাশে। এখন ও একটু ভালো বোধ করছে।"
আলিফের মায়ের মুখ মলিন। তার চোখও ভেজা। সে কিছু না বলে বেড়িয়ে এলো। বাইরে আসতেই আলিফের বাবা মিনহাজের সাথে দেখা হলো তার।
মিনহাজ জিগ্যেস করলো, "ছেলের কি অবস্থা?"
"এখন একটু ভালো। তুমি কি অফিস থেকে সরাসরি এখানে এসেছ?"
"হ্যাঁ, মনটা অস্থির হয়ে ছিল সারাদিন। তাই ভাবলাম এসে ছেলেকে দেখে যাই।"
"ভালো করেছ। যাও দেখে এসো। তারপর একসাথে বাসায় যাই। রাতে আবার আসতে হবে।"
মিনহাজ ভেতরে ঢুকে ছেলেকে দেখে দ্রুতই বেরিয়ে এলো। রুদ্রের সাথে তার দুইএকটা কথা হলো সেই সাথে আলিফের সাথেও।
আলিফ এখন একটু স্বাভাবিক। তার শরীরটাও আগের থেকে ভালো। আলিফ বলল, "নদীর কি খবর?"
রুদ্র ঠিক কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। তবে সে আলিফকে সান্ত্বনা দিতে বলল, "আগের থেকে অনেকটা ভালো।"
"রুদ্র, আমাদের সাথেই কেনো এমটা হলো? কি এমন দোষ করেছি যে সেই দোষের শাস্তি পাচ্ছি এভাবে? আমি এখন নদীর সামনে কি মুখ নিয়ে দাঁড়াবো? আমি যে ওকে প্রচন্ড ভালোবাসি।" কথাগুলো বলাতে বলতে আলিফের চোখ বেয়ে অশ্রু বেরিয়ে এলো।
রুদ্র আলিফকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলো, "তুই কেনো বলছিস ওরা পাঁচজন ছিল? সিসিটিভি ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চারজন।"
"হ্যাঁ, ওরা প্রথমে চারজনই ছিল। চারজন মিলে আমাদের জিম্মি করে ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু পরিত্যক্ত বিল্ডিংয়ে আগে থেকেই আরেকজন ছিল।"
"আচ্ছা তুই আমাকে প্রথম থেকে সবটা খুলে বল। তারপর আমি দেখি কি করা যায়।'
আলিফ পুরো ঘটনাটা প্রথম থেকে রুদ্রকে বলতে শুরু করলো।
"তুই দ্বিতীয়বার যখন আমাকে ফোন দিস তখন আমি বাসা থেকে বের হই। আমি সবেমাত্র নিচে নেমেছি ঠিক সেই সময় নদীর মেসেজ এলো। মেসেজে লেখা ছিল, "আলিফ, আম্মার শরীরটা হটাৎ খুব খারাপ হয়ে গেছে। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। তুমি কি একটু বাসায় আসবে?"
আমি মেসেজটা দেখে বাসায় ব্যাগটা রেখে তাৎক্ষণিক নদীর বাসায় যাই। ওখানে গিয়ে দেখি আন্টির অবস্থা আসলেই খারাপ। প্রথমে ভেবেছিলাম প্রেসার বেড়েছে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও প্রেসার কমাতে পারছিলাম না। তার মধ্যে তুই বারবার কল দিয়েই যাচ্ছিলি। বারবার রিং বাজছিল বলে আমি ফোনটা সাইলেন্স করে রাখি। আমি মনে মনে ভেবছিলাম, আন্টির শরীরটা আগে স্বাভাবিক হোক। নদীকে এই অবস্থায় একা রেখে আমি কোথাও যেতে পারবো না। যদি আন্টি একটু সুস্থ হয় তাহলে আজকে যেতে না পারলেও কাল ভোরে গাড়িতে করে চলে আসতে পারবো। তাই যাওয়া নিয়ে চিন্তা করছিলাম না। কিন্তু এদিকে রাত যত বাড়তে থাকলো তত আন্টির শরীরটা খারাপ হতে থাকলো। আমরা বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কি করবো। পরে নদী বলল, "আলিফ, চলো কোনো ফার্মেসি থেকে ডাক্তার ডেকে আম্মাকে দেখাই। আমার খুব ভয় করছে। যদি আম্মার কিছু একটা হয়ে যায়, তখন কি হবে?" প্রথমে আমি নদীকে বলেছিলাম, "আমি একা যাই তুমি আন্টির পাশে থাকো।" নদী বলল, "ফার্মেসি তো বাসার কাছেই। চলো একসাথে যাই। সমস্যা নেই।"
আমি আর নদী ডাক্তার আনতে বাসা থেকে বের হই। নিচে নেমে দেখি প্রথম ফার্মেসিটা বন্ধ। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখি পরেরটাও বন্ধ। আমরা চিন্তাই পরে যাই। তখন নদী বলল, "একটু সামনেই আরেকটা ফার্মেসি আছে। ওখানে গিয়ে দেখি খোলা আছে কি-না।" আমি নদীকে বলি, "ওটা তো অনেক দূর। আর ওদিকটা মানুষের আনাগোনা একদম কম।" নদী আমার কথা শুনে হেসে হাত নাড়িয়ে বলে, "ভয় পাচ্ছ? ঢাকা শহরে এগারোটা কি কোনো রাত? তুমি সাথে আছ না, আমার ভয় কিসের?" আমিও জানি কোনো সমস্যা হবে না। তবুও কেনো জানি মন সায় দিচ্ছিলো না ওদিকে যাওয়ার জন্য। তবুও নদীর মুখের দিকে তাকিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। ও অনেক টেনশন করছিল আন্টির জন্য। তাই আমি ওকে বাঁধা দিলাম না। কিন্তু বিপদ তো আর জানিয়ে আসে না।"
আলিফ এটুকু বলে থামলো। ওর মুখ মলিন। রুদ্র কোনো কথা বলল না। সে জানে, কিছুটা সময় নিয়ে আলিফ নিজ থেকেই বাকীটা বলবে।
"আমরা হেঁটে যাচ্ছিলাম। প্রায় ফার্মেসির কাছে চলে এসেছিলাম। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম ফার্মেসিটা খোলা আছে। ঠিক তখনই কোথা থেকে একদল ছেলে এসে আমাদের ঘিরে ধরলো। আমরা কিছু বোঝার আগেই দুইটা ছেলে আমাদের দুইজনের গলায় ব্লেড চেপে ধরলো। আর বলল, " নড়াচড়া করলে এটা সোজা গলায় চালিয়ে দিবো।" আমি দুইবার ছোটার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। তৃতীয়বার যখন চেষ্টা করি তখন গলায় যে ছেলেটা ব্লেড চেপে ধরেছিলো সে আমার গলায় পোচ দিতেই গলা বেয়ে তাজা রক্ত বের হয়ে আমার শার্ট ভিজে গেলো মুহুর্তে। প্রচন্ড ব্যথায় আমি সম্পূর্ণ হুসে থাকলাম না। মাথাটা ঘুরছিল শুধু। আর বুঝতে পারছিলাম ওরা আমাদের নিয়ে যাচ্ছে কোনো এক জায়গায়। অন্য দিকে নদী এমনিতেই কথা বলতে পারে না। ওর কেমন লাগছিল ও-ই জানে। তবে আমি যে কয়বার ওর দিকে তাকিয়েছি সেই কয়বার দেখেছি ওর চোখ অশ্রুতে ভেজা।"
আলিফের চোখ ভিজে উঠেছে। সে কিছুটা সময় নিলো নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার। তারপর আবার বলল, "বাকীটা তো জানিস। ওরা কি করেছে আমাদের সাথে। কী নির্মম ভাবে আমাকে মেরেছে। একটা সময় পর আমার আর হুস ছিলো না৷ তবুও ওরা আমাকে মেরেছে। আর নদীকে একজনের পর একজন ইচ্ছেমতো ভোগ করেছে৷ বোমা একটা মেয়ে কিছু বলতেও পারেনি চিৎকার ও করতে পারেনি। ওরা মানুষ না, ওরা পশু, জানোয়ার। কিন্তু খবরে কেনো বলছে ওরা চারজন? ওরা মোট পাঁচজন আর বাকী যে ছিল সে ওদের লিডার। ও-ই প্রথমে নদীকে.....!" আলিফ হঠাৎ চিৎকার শুরু করলো। রাগে ক্ষোভে গালাগালি দিতে থাকলো ওদেরকে।
"একটু শান্ত হ আলিফ। আমি দেখছি কি করা যায়। আমি ইন্সপেক্টর আবিরের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে তাকে সবটা বুঝিয়ে বলছি। প্লিজ তুই এরকম পাগলামি করিস না।" রুদ্র বলল।
আলিফ চিৎকার থামিয়ে নিরবে কান্না করতে থাকলো। সে রুদ্রকে বলল, "রুদ্র, আমি একটু একা থাকতে চাচ্ছি।"
রুদ্র বলল, "আমি আশেপাশেই আছি। কোনো দরকার হলে আমাকে কল দিস।"
রুদ্র বেরিয়ে এসে ঠিক করলো সবার আগে ইন্সপেক্টর আবিরের সাথে সে দেখা করবে। সে সরাসরি থানার দিকে রওনা করলো।
থানায় পৌঁছে রুদ্র জানতে পারলো, আবির থানায় নেই। বিকালেই ছুটি নিয়ে একবারে চলে গেছে। সে আবিরের ঠিকানা সংগ্রহ করলো। সে ঠিক করলো বাসায়ই তার সাথে দেখা করবে।
ইন্সপেক্টর আবিরের বাসায় পৌঁছাতে রুদ্রের অনেকটা দেরি হয়ে গেলো। দেরি হওয়ার মূল কারণ রাস্তায় জ্যাম। কিন্তু রুদ্রের মনে আশা ছিল দেরি হলেও বাসায় এসে ইন্সপেক্টর আবিরের সাথে দেখা হবে তার৷ কিন্তু সে আশাহত হলো। ইন্সপেক্টর আবির বাসায় নেই। সে বাসায়ই ফেরে নি। তাহলে ইন্সপেক্টর আবির গেলো কোথায়? তাকে কোথায় খুঁজবো? রুদ্র কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। সে উদ্দেশ্যেবিহীন ভাবে রাস্তায় হাঁটতে থাকলো। এবং নানা কিছু ভাবতে থাকলো। তার হঠাৎ সবকিছু কেমন গোলমেলে লাগছে। বিকালে হঠাৎ ইন্সপেক্টর আবিরের হাসপাতালে আসা। এই কেসটা এতো দ্রুত সমাধান হওয়া। রুদ্রের এখন মনে হচ্ছে, সবকিছু কেমন যেনো আগে থেকেই ঠিক করা। নিশ্চিত এখানে অন্য কিছু লুকিয়ে আছে। আমরা যা দেখছি তা পুরোপুরি সত্য নয়। আমরা মিথ্যের মধ্যে আছি। এবং কেউ সত্যটা সামনে আসতে দিচ্ছে না। সে চাচ্ছে দ্রুত কেসটা সমাধান হয়ে যাক। সেই কারণেই সবকিছু এতো দ্রুত ঘটছে। রুদ্রের হঠাৎ মনে হলো কেসটা আদালতে গেলে প্রথম দিনই সমাধান হয়ে যাবে। এবং কি হতে পারে রুদ্র সেটা স্পর্শ ধারনা করতে পারছে। এরকম কেসের রায় সে আগেও পত্রিকায় পড়েছে। আসামি যদি নেশাগ্রস্ত থাকে এবং সেটা প্রমানিত হয় তাহলে তার অপরাধ সেভাবে মূল্যায়ন হয় না। তাহলে আলিফ এবং নদীর সাথে যারা এরকম করেছে তাদের কি শাস্তি হবে না?
রুদ্রের রাগ হচ্ছে। ঠিক কার উপর সে জানেনা। সে এখন রিকসায়। রিকসাওয়ালাকে সে কোথায় নিয়ে যেতে বলেছে সে ভুলে গেছে। সে মনে করতে পারছে না। সে মনে করতে চায় ও না। যেখানে ইচ্ছে তাকে নিয়ে যাক। শুধু সে চায় তাকে অনেক দূরে কোথাও নিয়ে যাক। যে সমাজে ক্ষমতার জোরে জানোয়ারদের কোনো শাস্তি হয় না, সেই সমাজে সে আর থাকতে চায় না। কিন্তু সে জানে সে কোথাও পালাতে পারবে না। তাকে এই নোংরা সমাজেই থাকতে হবে। নোংরা মানুষগুলোর সাথে বাঁচতে হবে। এবং চিৎকার করে সে কিছু বলতেও পারবে না। যেভাবে বলতে পারবে না ইন্সপেক্টর আবিরও। রুদ্রের হঠাৎ মনে হলো, নদীরাই ভালো। অনন্ত বোমা সেজে অভিনয় করতে হয় না।
রিকসাওয়ালা হঠাৎ রিকসা থামালো। সে বলল, "মামা চলে এসেছি নামেন।"
রুদ্র আশেপাশে তাকালো। সে প্রথমে কিছুই চিনতে না পারলেও কিছুক্ষণ পরে সে বুঝতে পারলো সে কোথায়। সে রিকসা থেকে নেমে ভাড়া মিটিতে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রইল।
রুদ্র এখন দাঁড়িয়ে আছে রিয়ার বাসার সামনে৷ সে এখানে কেনো এসেছে? সে কি রিকসাওয়ালাকে এখানেই আসার কথা বলেছিলো? সে পুরোপুরি মনে করতে পারলো না। তাহলে কি তার অবচেতন মন এখন রিয়াকে দেখতে চাচ্ছে? রুদ্র কি করবে সিন্ধান্ত নিতে পারছে না৷ সে ঘড়ি দেখল এখন প্রায় মধ্যরাত। কিছুক্ষণ পরেই নতুন দিন শুরু হবে। সে একবার ভাবলো রিয়াকে একটা কল দিবে পরক্ষণেই ভাবলো এই সময় কল দেওয়া ঠিক হবে না। তার এমন লাগছে কেনো? বুকের মধ্যে অদ্ভুত, অন্য রকম একটা অনুভূতি হচ্ছে। সে এই মুহুর্তে নিজেকে বুঝে উঠতে পারছে না। সে এখন নিজের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত।
রুদ্র কোথাও পড়েছিল," মানুষ যখন প্রচন্ড হতাশার মধ্যে থাকে তখন অবচেতন মন তার প্রিয় মানুষটিকে খোঁজে। তার বুকে আশ্রয় নিতে চায়।" কিন্তু রিয়া কি তার প্রিয় মানুষ? সে কি রিয়াকে ভালোবাসে? রুদ্র এই প্রশ্নের উত্তর জানেনা। ঠিক তখনই তরুর কথা মনে পড়লো তার। তরুর কথা মনে পড়তেই সে অবাক হলো। অনেকদিন পর আজ হঠাৎ তরুর কথা মনে পড়েছে তার। সে কি তরুকে দিনদিন ভুলে যাচ্ছে? রুদ্র এই প্রশ্নের উত্তরও জানে না। সে আজ কিচ্ছু জানেনা। সে জানেনা সে কাকে ভালোবাসো? যাকে সে কখনো দেখেনি, শুধু তার কয়েকটা চিঠি পড়েছে কিন্তু চিঠিগুলো অন্য এক রুদ্রকে লেখা, তাকে? নাকি যে তাকে বাস্তবে প্রচন্ড ভালোবাসা, তাকে?
দ্বিধান্বিত একটা জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে রুদ্র। কিন্তু সে আর দ্বিধার মধ্যে থাকতে চায় না। এটাও সত্যি সে এখনো জানে না সে কাকে ভালোবাসে! কিন্তু তার মায়া হয় তরু মেয়েটার জন্য। মেয়েটাকে সে একবার হলেও দেখতে চাই। শুধু একবার। কিন্তু তরু কোথায় আছে? কত দূর আছে? তাকে সে কোথায় খুঁজবে? রুদ্রের হঠাৎ প্রচন্ড মাথাব্যথা শুরু হলো। সে আর কিছুই ভাবতে চাচ্ছে না।
রিয়াকে এই সময় ফোন দেওয়া ঠিক হবে না ভেবে রুদ্র চলে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই পিছন থেকে রুদ্র বলে কেউ তাকে ডাকলো। কণ্ঠটা তার পরিচিত। সে জানে, পিছনে রিয়া দাঁড়িয়ে আছে।
রিয়া দৌড়ে এলো। ততক্ষণে রুদ্র পিছন ফিরে তাকিয়েছে। রিয়া তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলো, "তুমি এই সময় এখানে?"
রুদ্র এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না। রিয়াই আবার বলল, "আচ্ছা বলতে হবে না। কিন্তু যখন এলেই তখন আমাকে কল না দিয়ে কেনো চলে যাচ্ছিলে?"
"তোমাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে কি-না বুঝতে পারছিলাম না।"
"তুমি সবসময় একটু বেশি বুঝো। যদি আমি বারান্দা থেকে তোমাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে না দেখতাম তাহলে তুমি চলেই যেতে।"
"সরি!"
"সরি কেনো বলছ? আমি কি তোমাকে কিছু বলেছি?" রিয়া কিছুক্ষণ থেমে সে আবার বলল, "তোমার কি হয়েছে রুদ্র? তোমার কি মন খারাপ? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো?" রিয়া আগে কখনো রুদ্রকে এভাবে বিধ্বংসী অবস্থায় দেখেনি।
"আমার ভালো লাগছে না। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না রিয়া। মরে যেতে ইচ্ছে করছে। বুকের মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার কোথাও যাওয়ার নেই। আমি পুরোপুরি নিজেকে চিনতে পারছি না।"
রুদ্রকে এভাবে কথা বলতে রিয়া আগ কখনো দেখেনি। রিয়ার বুকের মধ্যে হঠাৎ কেমন করে উঠলো। সে নিজেই বুঝতে পারলো না তার কেনো এমন লাগছে। রুদ্রের মরে যাওয়ার কথা শুনে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এই মানুষটা না থাকলে সে বাঁচবে কি করে?
রুদ্র আকস্মিক রিয়াকে বলল, "রিয়া, আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবে? একটু, অতি সামান্য!"
রুদ্রকে আগে কখনো এভাবে কথা বলতে রিয়া দেখেনি। এই রুদ্র তার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। তবুও সে কিছু না ভেবে এগিয়ে গিয়ে রুদ্রকে জড়িয়ে ধরলো।
রিয়ার বুকের মধ্যে রুদ্র বাচ্চা শিশুর মত গুটিয়ে রইলো। সে পরম মায়ায় কিছুক্ষণ ডুবে রইলো। একটা অদ্ভুত ঘ্রাণ ক্রমশ তাকে আসক্ত করে রাখলো। সে কিছুসময়ের জন্য সব ভুলে গেলো। তার হতাশা, যন্ত্রণা, মাথাব্যথা ক্রমশ বিলীন হয়ে গেলো।
রিয়া সবকিছু ভুলে বেশকিছু সময় রুদ্রকে জড়িয়ে রাখলো তার বুকে। সে এই মুহুর্তে স্থান কাল ভুলে গেছে। সে এখনো জানে না, দূর থেকে দুটো চোখ তাকে দেখছে!
চলবে....!
===========================
পড়তে থাকুন চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।
Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.
( Post By- Kam Pagol)