18-06-2023, 10:13 PM
পর্বঃ২৭
ঢাকার প্রধান নদী বন্দর সদরঘাট। সদরঘাট বাংলাদেশ-এর আদি ঢাকা শহরের একটি নদীবন্দর যাকে ঘিরে উনিশ শতকে একটি ব্যবসায়িক জনপদ গড়ে ওঠে। এই নদীবন্দরটি বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। একবিংশ শতকের শুরুতেও এটির গুরুত্ব অক্ষুণ্ন রয়েছে। এর সন্নিহিত এলাকা পুরান ঢাকা নামে প্রসিদ্ধ। এর অতি নিকটে রয়েছে পুস্তক প্রকাশনার ঘাঁটি বাংলাবাজার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বলধা গার্ডেন এবং আহসান মঞ্জিল এবং, সর্বোপরি, বিভিন্ন নদী পরিবাহিত পণ্য, বিশেষ করে মাছ ও ফলের সুবিশাল সব আড়ত। সারাদেশ, বিশেষ করে, দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকা শহরের নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিকেন্দ্র এই সদরঘাট।
এই মুহুর্তে রুদ্র সদরঘাটে লঞ্চের সামনে ফোন হাতে পায়চারি করছে। সে আলিফকে কম করে হলেও পনেরো বার কল দিয়েছে। কিন্তু আলিফ একবারও ফোন রিসিভ করে নি। এখন নয়টা বেজে তিরিশ। তাদের লঞ্চ ছাড়তে আর পনেরো মিনিট বাকী। রুদ্র বুঝে উঠতে পারছে না, আলিফ লঞ্চ ছাড়ার আগে এসে পৌঁছাতে পারবে কি-না!
এক ঘন্টা আগেও আলিফের সাথে রুদ্রের কথা হয়েছে। রুদ্রই ফোন দিয়েছিল। আলিফ বলেছিস, সে সময়মত সদরঘাটে পৌঁছে যাবে। রুদ্র চেয়েছিল, আলিফকে সঙ্গে করে, তারা একসাথে আসবে। কিন্তু সেই মুহুর্তে ইরিনা রুদ্রকে কল দেয়। সে বলে, তাকে এবং রিয়াকে এসে নিয়ে যেতে। তখন রুদ্র চলে যায় ইরিনার বাসায়। সে সেখান থেকে ইরিনা ও রিয়াকে নিয়ে সরাসরি চলে আসে এখানে। অবশ্য আলিফকে ফোন করে বারবার রুদ্র বলেছে, সময়মত চলে আসার জন্য। আলিফ বলেছিল, সে চলে আসবে। তাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
"আলিফ ফোন ধরছে না?" ইরিনা এসে রুদ্রের কাছে জানতে চাইলো।
"না, ও ফোন ধরছে না। কি যে হলো ওর, কে জানে? রাস্তায় আবার কোনো বিপদ হলো কি-না বুঝতে পারছি না।" রুদ্রের মধ্যে অস্থিরতা।
"আল্লাহ ভরসা।" পাশে থাকা রিয়া বলল। সে আবার বলল, "আশা করি আলিফের কিছু হয় নি। সম্ভবত, ওর ফোন সাইলেন্স।"
"লঞ্চ ছাড়ার সময় হয়ে গেছে প্রায়। ও সময়মত না এলে তো বিপদ। ওকে ছাড়া চলে যাওয়াটা কেমন হবে না?" ইরিনা বলল।
"ওকে রেখে যাওয়া মূল কথা না। কিন্তু ওর কিছু হলো কি-না সেটাই বুঝতে পারছি না। রাস্তায় কোনো বিপদ হলো কি-না সেটাও বুঝছি না।" রুদ্র হতাশ গলায় বলল।
লঞ্চ লেট করলো পনেরো মিনিট। কিন্তু আলিফ এলো না। আলিফের সাথে কেউ যোগাযোগ করতে পারলো না৷ কারো কলই রিসিভ করলো না আলিফ। সে কখনো এমন করে না।
বুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে লঞ্চ ছুটে চলেছে বরিশালের দিকে। রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে কেবিনের বাইরে। আকাশ ঘুটঘুটে কালো হয়ে আছে। রাতের অন্ধকারের কারণে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, আকাশে কতটা মেঘ জমে আছে। রুদ্র পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে জ্বালালো। গলগল করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়লো বাতাসে। মৃদু আলোয় সিগারেটের সাদা ধোঁয়াটা ভীষণ সুন্দর লাগলো রুদ্রের কাছে। সে সেই ধোঁয়ার দিকে আনমনে তাকিয়ে আছে। নদীর ঢেউয়ের মৃদু শব্দটা, রুদ্রের ভালো লাগছে। কিন্তু তার মনটা অস্থির হয়ে আছে। তারা একটা শুভ কাজে যাচ্ছে, কিন্তু যাওয়া পথেই এই বাঁধাটার কারণে তার মনে কু ডাক দিচ্ছে৷ বিপদে আশংকা করছে।
রুদ্র পাশে ফিরতেই দেখলো রিয়া দাঁড়িয়ে আছে। সে দ্রুত সিগারেটটা নদীর পানিতে ফেলে দিলো। মুখে থাকা ধোঁয়া ছেড়ে রিয়াকে জিজ্ঞেস বলল, "কখন এলে?"
"তুমি যখন সিগারেট ধরাও ঠিক তখন।" রিয়া উত্তর দিলো।
"ডাকলে না কেনো?"
"ডাকিনি কারণ দেখলাম অন্যমনস্ক আছো। কি ভাবছিলে?"
"আলিফের কথাই ভাবছিলাম। বেচারা আসতে পারলো না। আমরা কত প্লান করে রেখেছিলাম এই ট্রিপটা নিয়ে৷ সাত্যকির বিয়ে নিয়ে। কিন্তু এখন..!" রুদ্র কথা শেষ করতে পারলো না।
রিয়া বলল, "মন খারাপ করো না প্লিজ।"
"মন খারাপ করছি না। আসলে চিন্তা হচ্ছে। আলিফের কোনো বিপদ হলো কি-না সেটা ভেবেই অস্থির লাগছে। ও না এলে ফোন করে তো বলবে। এটলিস্ট ফোনটা তো রিসিভ করবে।" রুদ্রের কন্ঠে রাগ। আলিফের উপর তার এখন রাগ হচ্ছে। সে পকেট থেকে আবার সিগারেটের প্যাকেটটা বের করলো।
রিয়া বলল, "মাত্র ই তো একটা খেলে।"
রুদ্রের খেয়াল ছিলনা, রিয়ার তার সামনেই। সে ভদ্র ছেলের মত সিগারেটটা আবার প্যাকেটে রেখে, পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো।
"ধন্যবাদ।" রিয়া বলল।
"ধন্যবাদ কেনো?" রুদ্র জানতে চাইলো।
"এই যে আমার কথা রাখার জন্য।"
দুইজনে নিরবে দাঁড়িয়ে রইলো লঞ্চের এক কোনে। ঠান্ডা বাতাস বসে চলেছে। নদীর কলকল, আকাশে মেঘ ধমধমে, পরিবেশটা কেমন গুমোট করে রেখেছে।
"ক'টা বাজে?" রুদ্রের হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রিয়া জিজ্ঞেস করলো।
রিয়ার প্রশ্ন শুনে রুদ্র ঘড়ির দিকে তাকালো। সে বলল, "বারোটা"
"ভালোই রাত হয়েছে।"
"হুম।" রুদ্র কথায় সম্মতি জানালো।
রিয়া এই মুহুর্তে আর কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না। সে রুদ্রের হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। ঘড়িটা সুন্দর। সে বলল, "তোমার ঘড়িটা সুন্দর।"
রুদ্র আবার ঘড়ির দিকে তাকালো। সে বলল, "তরু দিয়েছে।" তরুর নামটা বলার সময় রুদ্রর কন্ঠ কিছুটা কেপে উঠলো।
রিয়া বলল, "আসলেই ভীষণ সুন্দর ঘড়িটা।" সে কথা শেষ করে রুদ্রের আরেকটুখানি কাছে সরে এলো। সে আবার বলল, "পরতে পারি?"
"কি?"
"কি আবার? তোমার হাতে থাকা ঘড়িটা।"
"ওহ, আচ্ছা। হ্যাঁ, অবশ্যই।" রুদ্র কথা শেষ করে হাতে থাকা ঘড়িটা খুলতে শুরু করলো।
"আমিই খুলে নিচ্ছি।" রিয়া কথাটা বলেই রুদ্রের হাত ধরে ঘড়িটা সে নিজেই খুলে নিলো।
রিয়া নিজের ডান হাতে ঘড়িটা পরলো। তার হাতে ঘড়িটা কিছুটা ঢিলাঢালা হয়েছে। ঘড়িটা ভীষণ পছন্দ হয়েছে রিয়ার।
মেঘ গর্জে হুট করে বৃষ্টি শুরু হলো। লঞ্চের সবাই ছুটাছুটি করে যারা যার কেবিনে চলে যাচ্ছে। কিন্তু রুদ্র এবং রিয়া সেই একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। দুইজনেই চুপচাপ। ক্রমশ বৃষ্টি আরো বেগ বাড়চ্ছে। রিয়া আর রুদ্র, দুইজন একে অন্যের দিকে দুই একবার তাকালেও কেউ কিছু বললো না। তারা দুইজনেই বুঝে নিয়েছে তাদের মনের কথা।
নদীর পানিতে বৃষ্টির শব্দ অদ্ভুত এক সুরের সৃষ্টি করেছে। নদীর স্রোত, বৃষ্টি, অন্ধকার রাত; সবকিছু মিলে পরিবেশটা বেশ ছমছমে হয়ে উঠেছে।
রিয়া এবং রুদ্র ধীরে ধীরে বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে। তাদের কোনো তারা নেই। কোনো চিন্তা নেই। হঠাৎ রিয়া ডাকল, "রুদ্র!"
রিয়ার ডাকে সাড়া দিলো রুদ্র, "উঁহু!"
"তোমার কি মন খারাপ?"
রুদ্র কোন উত্তর দিলো না। তবে কিছুটা সময় পরে সে মাথা নেড়ে বলল, "না!"
রিয়া এবার বলল, "তুমি কি তরুকে ভালোবাস?"
রিয়া এরকম প্রশ্ন করবে রুদ্র ভাবেনি। সে কিছুটা সময় ভেবে বলল, "ভালোবাসা কি? ভালোবাসা কি আমি ঠিক জানিনা। আর আমি তরুকে ভালোবাসি কি-না তাও জানিনা। কিন্তু এটুকু জানি, আমি মানুষটাকে একবার হলে দেখতে চাই। শুধু একবার! সে আমাকে ভালোবাসুক সেটাও চাই না। শুধু তরু নামের অসাধারণ মেয়েটার সাথে আমি একটিবার দেখা করতে চাই। আমি তাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করতে চাই। অনেককিছু!" শেষ কথাগুলো কেমন অদ্ভুত বিষাদময় শোনালো।
রিয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে রুদ্রের পাশে। বৃষ্টি এখনো হচ্ছে। তারা ইতিমধ্যে কাক ভেজা ভিজে গেছে। রিয়া আবার রুদ্রকে জিজ্ঞেস করলো, "তুমি কি আমাকে একটুও পছন্দ করো না?"
"তোমাকে আমি ভীষণ পছন্দ করি। তুমিও খুব ভালো একজন মানুষ। তোমার সাথে না মিশলে, তোমাকে না জানলে, আমি কখনোই বুঝতাম না তুমি এতোটা অসাধারণ।"
"তুমি আমাকে কি কখনো ভালোবাসতে পারবে?" রিয়া অনেকসয় চুপ ছিলো। হঠাৎ মৌনতা ভেঙে এরকম অদ্ভুত একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো রুদ্রকে।
রিয়ার কন্ঠ কেমন অদ্ভুত শোনালো। সেই কন্ঠে কি এমন ছিল রুদ্র জানেনা। কিন্ত রুদ্রের কেবল মনে হলো, রিয়ার বুকের মধ্যে লুকানো একটা কষ্ট জমে আছে। সেই কষ্টটা কি তার দেওয়া? রুদ্র ভাবনার জগৎ এলোমেলো হয়ে গেলো মুহুর্তেই। রুদ্র ঘুরে রিয়ার দিকে তাকালো। রিয়া কি কাঁদছে। রিয়ার চোখ ভেজা। বৃষ্টির কারণে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না রিয়া কাঁদছে কি-না!
রিয়া আর কিছু বলল না। সে ভিজে যাচ্ছে একাকী। তার পাশে অবশ্য রুদ্রও ভিজছে। কিন্তু দুইজনের ভেজার মধ্যে অনেক পার্থক্য। একজন ভিজছে মন খারাপে আরেকজন ভিজছে কান্না লুকাতে।
"তুমি আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসো, তাই না?" রুদ্র এবার রিয়াকে সরাসরি ভাবেই জিগ্যেস করলো।
কিন্তু রিয়া উত্তর দিলো না। সে তাকিয়ে আছে নদীর দিকে। নদীতে টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে। নদীর বুক ক্রমশ শীতল হয়ে উঠছে। কিন্তু তার বুক? তার বুকে কেবল উত্তাপ, কষ্ট, কান্না আর যন্ত্রণা!
রুদ্র ডাকলো, "রিয়া, এই রিয়া।"
"উঁহু!" রিয়া ভেজা কন্ঠে উত্তর দিলো।
"তুমি কি কান্না করছ?"
"কান্না করবো কেনো?" কান্না জড়ানো কন্ঠে রিয়া উত্তর দিলো। সে চেষ্টা করেছে কন্ঠটা ঠিক রাখার কিন্তু পারে নি।
"কি হয়েছে? আমাকে অন্তত বলো।" রিয়াকে এভাবে দেখে রুদ্রের ভালো লাগছে না। তারও মন খারাপ করছে।
"কি হবে?" অভিমানী কন্ঠে উত্তর দিলো রিয়া।
"তাহলে কান্না করছ কেনো?"
"আমি কাঁদছি না।"
"আমাকে মিথ্যে বলবে না। আমি বুঝতাছি।"
"তুমি বুঝো আমাকে?"
"কেনো বুঝবো না?"
"তুমি যদি আমাকে বুঝতে তাহলে বুঝতে পারতে আমি তোমাকে...!" রিয়া কথাটা শেষ করতে পারলো না।
"এমন কেনো করছ?"
"কেমন?"
রুদ্র আর কিছু বলল না। সে এখন আর কথা খুঁজে পাচ্ছে না। রিয়াকে সে এভাবে কখনো দেখেনি। এতোটা ভেঙে পড়তে। রুদ্র রিয়ার হাত ধরে তার দিকে ফিরালো। রিয়া ফিরলো। রুদ্র হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ভেজা চোখের পানিটা মুঁছে দিলো। কিন্তু মুছলো কিনা সে জানেনা কারণ মুহূর্তে আবারো বৃষ্টি এসে রিয়ার দুচোখ ভিজিয়ে দিলো।
"আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবে?" রিয়া ঘোর লাগা কন্ঠে রুদ্রকে বলল।
রিয়ার কন্ঠ শুনে রুদ্র ঠিক থাকতে পারলো না। সে রিয়াকে তার বুকের ভেতর জড়িয়ে নিলো। রিয়াও বাচ্চা পাখির মত রুদ্রের ভেজা বুকের মধ্যে ওম খুঁজে নিতে থাকলো। তার চোখের পানিতে রুদ্রের শার্ট ভিজে গেলো কিন্তু রুদ্র বুঝলো না কোনটা বৃষ্টি পানি আর কোনটা রিয়ার চোখের পানি।
চলবে...!
ঢাকার প্রধান নদী বন্দর সদরঘাট। সদরঘাট বাংলাদেশ-এর আদি ঢাকা শহরের একটি নদীবন্দর যাকে ঘিরে উনিশ শতকে একটি ব্যবসায়িক জনপদ গড়ে ওঠে। এই নদীবন্দরটি বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। একবিংশ শতকের শুরুতেও এটির গুরুত্ব অক্ষুণ্ন রয়েছে। এর সন্নিহিত এলাকা পুরান ঢাকা নামে প্রসিদ্ধ। এর অতি নিকটে রয়েছে পুস্তক প্রকাশনার ঘাঁটি বাংলাবাজার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বলধা গার্ডেন এবং আহসান মঞ্জিল এবং, সর্বোপরি, বিভিন্ন নদী পরিবাহিত পণ্য, বিশেষ করে মাছ ও ফলের সুবিশাল সব আড়ত। সারাদেশ, বিশেষ করে, দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকা শহরের নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিকেন্দ্র এই সদরঘাট।
এই মুহুর্তে রুদ্র সদরঘাটে লঞ্চের সামনে ফোন হাতে পায়চারি করছে। সে আলিফকে কম করে হলেও পনেরো বার কল দিয়েছে। কিন্তু আলিফ একবারও ফোন রিসিভ করে নি। এখন নয়টা বেজে তিরিশ। তাদের লঞ্চ ছাড়তে আর পনেরো মিনিট বাকী। রুদ্র বুঝে উঠতে পারছে না, আলিফ লঞ্চ ছাড়ার আগে এসে পৌঁছাতে পারবে কি-না!
এক ঘন্টা আগেও আলিফের সাথে রুদ্রের কথা হয়েছে। রুদ্রই ফোন দিয়েছিল। আলিফ বলেছিস, সে সময়মত সদরঘাটে পৌঁছে যাবে। রুদ্র চেয়েছিল, আলিফকে সঙ্গে করে, তারা একসাথে আসবে। কিন্তু সেই মুহুর্তে ইরিনা রুদ্রকে কল দেয়। সে বলে, তাকে এবং রিয়াকে এসে নিয়ে যেতে। তখন রুদ্র চলে যায় ইরিনার বাসায়। সে সেখান থেকে ইরিনা ও রিয়াকে নিয়ে সরাসরি চলে আসে এখানে। অবশ্য আলিফকে ফোন করে বারবার রুদ্র বলেছে, সময়মত চলে আসার জন্য। আলিফ বলেছিল, সে চলে আসবে। তাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
"আলিফ ফোন ধরছে না?" ইরিনা এসে রুদ্রের কাছে জানতে চাইলো।
"না, ও ফোন ধরছে না। কি যে হলো ওর, কে জানে? রাস্তায় আবার কোনো বিপদ হলো কি-না বুঝতে পারছি না।" রুদ্রের মধ্যে অস্থিরতা।
"আল্লাহ ভরসা।" পাশে থাকা রিয়া বলল। সে আবার বলল, "আশা করি আলিফের কিছু হয় নি। সম্ভবত, ওর ফোন সাইলেন্স।"
"লঞ্চ ছাড়ার সময় হয়ে গেছে প্রায়। ও সময়মত না এলে তো বিপদ। ওকে ছাড়া চলে যাওয়াটা কেমন হবে না?" ইরিনা বলল।
"ওকে রেখে যাওয়া মূল কথা না। কিন্তু ওর কিছু হলো কি-না সেটাই বুঝতে পারছি না। রাস্তায় কোনো বিপদ হলো কি-না সেটাও বুঝছি না।" রুদ্র হতাশ গলায় বলল।
লঞ্চ লেট করলো পনেরো মিনিট। কিন্তু আলিফ এলো না। আলিফের সাথে কেউ যোগাযোগ করতে পারলো না৷ কারো কলই রিসিভ করলো না আলিফ। সে কখনো এমন করে না।
বুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে লঞ্চ ছুটে চলেছে বরিশালের দিকে। রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে কেবিনের বাইরে। আকাশ ঘুটঘুটে কালো হয়ে আছে। রাতের অন্ধকারের কারণে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, আকাশে কতটা মেঘ জমে আছে। রুদ্র পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে জ্বালালো। গলগল করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়লো বাতাসে। মৃদু আলোয় সিগারেটের সাদা ধোঁয়াটা ভীষণ সুন্দর লাগলো রুদ্রের কাছে। সে সেই ধোঁয়ার দিকে আনমনে তাকিয়ে আছে। নদীর ঢেউয়ের মৃদু শব্দটা, রুদ্রের ভালো লাগছে। কিন্তু তার মনটা অস্থির হয়ে আছে। তারা একটা শুভ কাজে যাচ্ছে, কিন্তু যাওয়া পথেই এই বাঁধাটার কারণে তার মনে কু ডাক দিচ্ছে৷ বিপদে আশংকা করছে।
রুদ্র পাশে ফিরতেই দেখলো রিয়া দাঁড়িয়ে আছে। সে দ্রুত সিগারেটটা নদীর পানিতে ফেলে দিলো। মুখে থাকা ধোঁয়া ছেড়ে রিয়াকে জিজ্ঞেস বলল, "কখন এলে?"
"তুমি যখন সিগারেট ধরাও ঠিক তখন।" রিয়া উত্তর দিলো।
"ডাকলে না কেনো?"
"ডাকিনি কারণ দেখলাম অন্যমনস্ক আছো। কি ভাবছিলে?"
"আলিফের কথাই ভাবছিলাম। বেচারা আসতে পারলো না। আমরা কত প্লান করে রেখেছিলাম এই ট্রিপটা নিয়ে৷ সাত্যকির বিয়ে নিয়ে। কিন্তু এখন..!" রুদ্র কথা শেষ করতে পারলো না।
রিয়া বলল, "মন খারাপ করো না প্লিজ।"
"মন খারাপ করছি না। আসলে চিন্তা হচ্ছে। আলিফের কোনো বিপদ হলো কি-না সেটা ভেবেই অস্থির লাগছে। ও না এলে ফোন করে তো বলবে। এটলিস্ট ফোনটা তো রিসিভ করবে।" রুদ্রের কন্ঠে রাগ। আলিফের উপর তার এখন রাগ হচ্ছে। সে পকেট থেকে আবার সিগারেটের প্যাকেটটা বের করলো।
রিয়া বলল, "মাত্র ই তো একটা খেলে।"
রুদ্রের খেয়াল ছিলনা, রিয়ার তার সামনেই। সে ভদ্র ছেলের মত সিগারেটটা আবার প্যাকেটে রেখে, পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো।
"ধন্যবাদ।" রিয়া বলল।
"ধন্যবাদ কেনো?" রুদ্র জানতে চাইলো।
"এই যে আমার কথা রাখার জন্য।"
দুইজনে নিরবে দাঁড়িয়ে রইলো লঞ্চের এক কোনে। ঠান্ডা বাতাস বসে চলেছে। নদীর কলকল, আকাশে মেঘ ধমধমে, পরিবেশটা কেমন গুমোট করে রেখেছে।
"ক'টা বাজে?" রুদ্রের হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রিয়া জিজ্ঞেস করলো।
রিয়ার প্রশ্ন শুনে রুদ্র ঘড়ির দিকে তাকালো। সে বলল, "বারোটা"
"ভালোই রাত হয়েছে।"
"হুম।" রুদ্র কথায় সম্মতি জানালো।
রিয়া এই মুহুর্তে আর কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না। সে রুদ্রের হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। ঘড়িটা সুন্দর। সে বলল, "তোমার ঘড়িটা সুন্দর।"
রুদ্র আবার ঘড়ির দিকে তাকালো। সে বলল, "তরু দিয়েছে।" তরুর নামটা বলার সময় রুদ্রর কন্ঠ কিছুটা কেপে উঠলো।
রিয়া বলল, "আসলেই ভীষণ সুন্দর ঘড়িটা।" সে কথা শেষ করে রুদ্রের আরেকটুখানি কাছে সরে এলো। সে আবার বলল, "পরতে পারি?"
"কি?"
"কি আবার? তোমার হাতে থাকা ঘড়িটা।"
"ওহ, আচ্ছা। হ্যাঁ, অবশ্যই।" রুদ্র কথা শেষ করে হাতে থাকা ঘড়িটা খুলতে শুরু করলো।
"আমিই খুলে নিচ্ছি।" রিয়া কথাটা বলেই রুদ্রের হাত ধরে ঘড়িটা সে নিজেই খুলে নিলো।
রিয়া নিজের ডান হাতে ঘড়িটা পরলো। তার হাতে ঘড়িটা কিছুটা ঢিলাঢালা হয়েছে। ঘড়িটা ভীষণ পছন্দ হয়েছে রিয়ার।
মেঘ গর্জে হুট করে বৃষ্টি শুরু হলো। লঞ্চের সবাই ছুটাছুটি করে যারা যার কেবিনে চলে যাচ্ছে। কিন্তু রুদ্র এবং রিয়া সেই একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। দুইজনেই চুপচাপ। ক্রমশ বৃষ্টি আরো বেগ বাড়চ্ছে। রিয়া আর রুদ্র, দুইজন একে অন্যের দিকে দুই একবার তাকালেও কেউ কিছু বললো না। তারা দুইজনেই বুঝে নিয়েছে তাদের মনের কথা।
নদীর পানিতে বৃষ্টির শব্দ অদ্ভুত এক সুরের সৃষ্টি করেছে। নদীর স্রোত, বৃষ্টি, অন্ধকার রাত; সবকিছু মিলে পরিবেশটা বেশ ছমছমে হয়ে উঠেছে।
রিয়া এবং রুদ্র ধীরে ধীরে বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে। তাদের কোনো তারা নেই। কোনো চিন্তা নেই। হঠাৎ রিয়া ডাকল, "রুদ্র!"
রিয়ার ডাকে সাড়া দিলো রুদ্র, "উঁহু!"
"তোমার কি মন খারাপ?"
রুদ্র কোন উত্তর দিলো না। তবে কিছুটা সময় পরে সে মাথা নেড়ে বলল, "না!"
রিয়া এবার বলল, "তুমি কি তরুকে ভালোবাস?"
রিয়া এরকম প্রশ্ন করবে রুদ্র ভাবেনি। সে কিছুটা সময় ভেবে বলল, "ভালোবাসা কি? ভালোবাসা কি আমি ঠিক জানিনা। আর আমি তরুকে ভালোবাসি কি-না তাও জানিনা। কিন্তু এটুকু জানি, আমি মানুষটাকে একবার হলে দেখতে চাই। শুধু একবার! সে আমাকে ভালোবাসুক সেটাও চাই না। শুধু তরু নামের অসাধারণ মেয়েটার সাথে আমি একটিবার দেখা করতে চাই। আমি তাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করতে চাই। অনেককিছু!" শেষ কথাগুলো কেমন অদ্ভুত বিষাদময় শোনালো।
রিয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে রুদ্রের পাশে। বৃষ্টি এখনো হচ্ছে। তারা ইতিমধ্যে কাক ভেজা ভিজে গেছে। রিয়া আবার রুদ্রকে জিজ্ঞেস করলো, "তুমি কি আমাকে একটুও পছন্দ করো না?"
"তোমাকে আমি ভীষণ পছন্দ করি। তুমিও খুব ভালো একজন মানুষ। তোমার সাথে না মিশলে, তোমাকে না জানলে, আমি কখনোই বুঝতাম না তুমি এতোটা অসাধারণ।"
"তুমি আমাকে কি কখনো ভালোবাসতে পারবে?" রিয়া অনেকসয় চুপ ছিলো। হঠাৎ মৌনতা ভেঙে এরকম অদ্ভুত একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো রুদ্রকে।
রিয়ার কন্ঠ কেমন অদ্ভুত শোনালো। সেই কন্ঠে কি এমন ছিল রুদ্র জানেনা। কিন্ত রুদ্রের কেবল মনে হলো, রিয়ার বুকের মধ্যে লুকানো একটা কষ্ট জমে আছে। সেই কষ্টটা কি তার দেওয়া? রুদ্র ভাবনার জগৎ এলোমেলো হয়ে গেলো মুহুর্তেই। রুদ্র ঘুরে রিয়ার দিকে তাকালো। রিয়া কি কাঁদছে। রিয়ার চোখ ভেজা। বৃষ্টির কারণে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না রিয়া কাঁদছে কি-না!
রিয়া আর কিছু বলল না। সে ভিজে যাচ্ছে একাকী। তার পাশে অবশ্য রুদ্রও ভিজছে। কিন্তু দুইজনের ভেজার মধ্যে অনেক পার্থক্য। একজন ভিজছে মন খারাপে আরেকজন ভিজছে কান্না লুকাতে।
"তুমি আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসো, তাই না?" রুদ্র এবার রিয়াকে সরাসরি ভাবেই জিগ্যেস করলো।
কিন্তু রিয়া উত্তর দিলো না। সে তাকিয়ে আছে নদীর দিকে। নদীতে টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে। নদীর বুক ক্রমশ শীতল হয়ে উঠছে। কিন্তু তার বুক? তার বুকে কেবল উত্তাপ, কষ্ট, কান্না আর যন্ত্রণা!
রুদ্র ডাকলো, "রিয়া, এই রিয়া।"
"উঁহু!" রিয়া ভেজা কন্ঠে উত্তর দিলো।
"তুমি কি কান্না করছ?"
"কান্না করবো কেনো?" কান্না জড়ানো কন্ঠে রিয়া উত্তর দিলো। সে চেষ্টা করেছে কন্ঠটা ঠিক রাখার কিন্তু পারে নি।
"কি হয়েছে? আমাকে অন্তত বলো।" রিয়াকে এভাবে দেখে রুদ্রের ভালো লাগছে না। তারও মন খারাপ করছে।
"কি হবে?" অভিমানী কন্ঠে উত্তর দিলো রিয়া।
"তাহলে কান্না করছ কেনো?"
"আমি কাঁদছি না।"
"আমাকে মিথ্যে বলবে না। আমি বুঝতাছি।"
"তুমি বুঝো আমাকে?"
"কেনো বুঝবো না?"
"তুমি যদি আমাকে বুঝতে তাহলে বুঝতে পারতে আমি তোমাকে...!" রিয়া কথাটা শেষ করতে পারলো না।
"এমন কেনো করছ?"
"কেমন?"
রুদ্র আর কিছু বলল না। সে এখন আর কথা খুঁজে পাচ্ছে না। রিয়াকে সে এভাবে কখনো দেখেনি। এতোটা ভেঙে পড়তে। রুদ্র রিয়ার হাত ধরে তার দিকে ফিরালো। রিয়া ফিরলো। রুদ্র হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ভেজা চোখের পানিটা মুঁছে দিলো। কিন্তু মুছলো কিনা সে জানেনা কারণ মুহূর্তে আবারো বৃষ্টি এসে রিয়ার দুচোখ ভিজিয়ে দিলো।
"আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবে?" রিয়া ঘোর লাগা কন্ঠে রুদ্রকে বলল।
রিয়ার কন্ঠ শুনে রুদ্র ঠিক থাকতে পারলো না। সে রিয়াকে তার বুকের ভেতর জড়িয়ে নিলো। রিয়াও বাচ্চা পাখির মত রুদ্রের ভেজা বুকের মধ্যে ওম খুঁজে নিতে থাকলো। তার চোখের পানিতে রুদ্রের শার্ট ভিজে গেলো কিন্তু রুদ্র বুঝলো না কোনটা বৃষ্টি পানি আর কোনটা রিয়ার চোখের পানি।
চলবে...!
===========================
পড়তে থাকুন চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।
Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.
( Post By- Kam Pagol)