18-06-2023, 10:03 PM
পর্বঃ২৬
"ভাইভা কেমন হলো?"
"চারবছর যেমন দিয়ে এসেছি।" ইরিনা বসতে বসতে রুদ্রকে বলল। সে আবার বলল, "তোর কেমন হয়েছে?"
"মোটামুটি, আলহামদুলিল্লাহ।" রুদ্র বলল।
"চা খাবি? নাকি খেয়েছিস?"
"খাবো। মাথাটা খুব ধরেছে। আচ্ছা তুই বস, আমি অর্ডার দিয়ে আসছি।"
"আচ্ছা।"
রুদ্র উঠে গিয়ে চায়ের অর্ডাল দিলো। একটা সিগারেট ধরালো। তারপর সে চা টা তাদের কাছে দিয়ে আসতে বলে ফিরে এলো।
"এখন বল, তোর কি খবর?" রুদ্র বসতে বসেতে ইরিনাকে জিজ্ঞেস করলো।
"কি আর খবর থাকবে। চলছে সবকিছু এলোমেলো।"
"ফাহিমের কথা জিজ্ঞেস করছি? কিছু কি হয়েছে?
"না, কি হবে?"
"তাহলে সবকিছু ঠিকঠাক?"
"হ্যাঁ, ঠিকঠাক। কি ব্যাপার? আজ হঠাৎ ফাহিমের কথা জিজ্ঞেস করছিস?"
"এমনিতেই, তোদের দেখে মনে হলো তোদের মধ্যে কোনো ঝামেলা হয়েছে। একজন আরেকজনকে এড়িয়ে চলছিস।"
ইরিনা আর কিছু বলল না। চা চলে এসেছে। সে চায়ে চুমুক দিলো।
রুদ্রও চা হাতে নিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে, সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সেটা ফেলে দিলো।
"তেমন কিছু হয় নি। গতকাল একটা বিষয় নিয়ে ঝগড়া হয়েছে। তাই আমাকে দেখলেই ফাইম এড়িয়ে চলছে।" ইরিনা চা খেতে খেতে কথাগুলো বলল।
"শেয়ার করা যাবে? যদি কোনো সমাধান দিতে পারি।" রুদ্র বলল।
"তেমন কিছু না রুদ্র। বাসায় বিয়ের কথা চলছে। আমার জন্য ছেলে দেখা হচ্ছে। সেই বিষয় নিয়ে ফাহিমের সমস্যা। কেনো আমার জন্য ছেলে দেখা হবে। কেনো আমি সেজেগুজে ছেলেদের সামনে যাবো। এই সামান্য বিষয় নিয়ে, অকারণে ফাহিম রাগ দেখাচ্ছে। কত বুঝিয়েছি কিন্তু ফাহিম বুঝতেই চাচ্ছে না। এদিকে ওকে আমি বলেছি, বাবার সাথে দেখা করার জন্য। ও সেটাও করবে না। চাকরি না পেয়ে, বাবার সাথে দেখা করবে না। সবকিছু নিয়ে আমি প্রচন্ড হতাশ। বিরক্ত!" ইরিনা রাগে ক্ষোভে কথাগুলো এক সুরে বলে গেলো রুদ্রকে।
রুদ্র মনোযোগ দিয়ে শুনলো। ইরিনার কথার মাঝে সে তাকে বিরক্ত করে নি। সে বলল, "দেখ ইরিনা, এই সময়টা এরকমই। আমাদের পড়াশোনা শেষ। এখন চাকরি পাওয়াটা খুব জরুরি। এদিকে তোদের বাবা-মা এখন চাইবে তোদের বিয়েটা দিয়ে দেওয়ার জন্য। আমাদের বাবা-মা চায়, আমরা একটা চাকরি পেলে তারা বিশ্রামে যাবে। আর বর্তমানে চাকরির বাজারে চাকরি পাওয়া অনেক কঠিন। এদিকে ইন্টারভিউ উপর ইন্টারভিউ দিয়ে যেতে হয়। এছাড়া একটা বেকার ছেলে কীভাবে তার গার্লফ্রেন্ডের বাবার সাথে দেখা করতে যেতে পারে তুই বল? তোকে বুঝতে হবে ফাহিমের বিষয়টা।"
"হ্যাঁ, আমি না-হয় বুঝলাম। কিন্তু ওকে ও তো আমার বিষয়টা বুঝতে হবে। তুই কি বলিস?"
"হ্যাঁ, অবশ্যই। একটা সম্পর্কে দুইজনকেই একে অন্যকে বুঝতে হয়। তাহলে আর কোনো সমস্যা থাকে না।"
"আমিই সবসময় বুঝে, সবকিছু মেনে নিয়ে, চুপ থেকে ঝামেলা ঠিকঠাক করি। কিন্তু ফাহিম আমাকে বুঝতেই পারে না। আমি দিনদিন বিরক্ত হয়ে উঠছি। এই রোজকার ঝগড়া, ঝামেলা, মান-অভিমান আর ভালো লাগছে না।"
"তাহলে কি করবি? ব্রেকআপ করার কথা ভাবছিল?"
"ফাহিমকে ছাড়া কীভাবে থাকবো? রাগের মাথায় মনে হয়, ব্রেকআপ করে ফেলি। কিন্তু রাগ কেটে গেলে একমুহূর্ত ওর সাথে কথা না বলে থাকতে পারি না। তুই দোয়া কর, যাতে সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে যেনো চলে যায়।"
"সেটা কি আর বলতে। আমি-তো চাই সবসময় তুই সুখে থাক, ভালো থাক।"
"আমিও চাই, তুই ভালো থাক। কিন্তু তোর সেই একটাই জেদ, তরুকে খুঁজে বের করবি! তারপর বল, তরুর কোনো খোঁজ পেলি?"
হঠাৎ তরুর প্রসঙ্গ আসতেই রুদ্রের মুখ কালো হয়ে উঠলো। সে বলল, "আশা ছেড়ে দিয়েছি। সবটা এখন ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছি।"
"মন খারাপ করিস না। তরুর নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও ভালো আছে। এখন তোর করনীয়, নিজেকে গুছিয়ে নেও। পিছুটান ছেড়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া।"
"হ্যাঁ, সেটাই করছি। তরুর বিষয়টা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছি।"
"সাব্বাশ!" রুদ্রের পিঠে আলতো করে থাপ্পড় দিয়ে ইরিনা কথাটা বলল। সে আবার বলল, "রিয়ার খবর কি?"
"রিয়ার খবর?" রুদ্র মুখে বিষময় ভাব ফুটে উঠলো।
"রিয়ার সাথে তো তোর প্রায়ই দেখাসাক্ষাৎ হয়। তোরা একসাথে ভালোই সময় কাটাস।"
"তেমন না, কিন্তু হ্যাঁ রিয়ার সাথে মাঝেমধ্যে সময় কাটাই। যখন তোরা সবাই ব্যস্ত ছিলি, তখন রিয়া আমাকে অনেক সময় দিয়েছে। মেয়েটা আসলে ভালো। লক্ষী একটা মেয়ে।"
"তোর মুখে রিয়ার এতো প্রসংশা? তা প্রেমে টেমে পড়ে গেলি নাকি আবার?" কথাটা বলেই ইরিনা হাসতে থাকলো।
"ধুর! রিয়া আমার খুব ভালো বন্ধু। এইটুকুই।"
"কিন্তু, রিয়া তোকে ভীষণ ভালোবাসে।"
"হ্যাঁ, সেটা বুঝতে পারি। মেয়েটাকে এভাবে কষ্ট দিতে আমারও ভালো আগে না। কিন্তু, আমি কি করবো? রিয়াকে সেভাবে কখনো দেখিনি, মানে বন্ধুর বাইরে।"
"শোন, প্রেম এমন একটা জটিল বিষয়, যে কখনো কেউ তাকে বুঝে উঠতে পারে নি। কখন কাকে ভালোবেসে ফেলি আমরা, নিজেরাই বুঝতে পারি না।"
"শেষ হইছে তোর ফিলোসোফি?"
"ওকে, আমি আর জ্ঞান দিচ্ছি না তোকে। তুই এই সব বিষয়ের উপর পিএইচডি ডিগ্রির অর্জন করে রেখেছিস। আমি তোকে আর কি বলব।"
সাত্যকিকে হেঁটে এসে পাশে দাঁড়াতে দেখে রুদ্র বলল, "ভাইভা কেমন হলো?"
"ভালো হয়েছে। তোদের কেমন হলো?" রুদ্র এবং ইরিনাকে উদ্দেশ্য করে সাত্যকি জিজ্ঞেস করলো।
"ভাইভার কথা বাদ দে। যেমন হওয়ার হয়েছে।" ইরিনা কর্কশ গলায় বলল।
"এভাবে বলছিস কেনো? তোর কি মন মেজাজ খারাপ?" ইরিনাকে জিজ্ঞেস করলো সাত্যকি।
"আরে না। ওর ভাইভা ভালো হয় নি। এদিকে আমাদের সবার ভালো হয়েছে, তাই মুড অফফ ওর।" রুদ্র বলল।
"আরে ব্যাপার না দোস্ত।" ইরিনার পাশে বসতে বসতে সাত্যকি বলল।
সবাই চুপ। হঠাৎ সাত্যকিই বলল, "তোরা সবাই বিয়েতে আসছিস তো?"
"হ্যাঁ, অবশ্যই। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে প্রথম কারো বিয়ে হচ্ছে আমরা সবাই না এলে কি হবে?" রুদ্র বলল।
"কিরে ইরিনা, সেই কখন থেকে চুপসে আছিস। সত্যি করে বল তো তোর কি হয়েছে?" ইরিনার কাঁধে ধাক্কা দিয়ে সাত্যকি জিজ্ঞেস করলো।
"ফাহিমকে দেখছিস?" ইরিনা জিজ্ঞেস করলো।
"না, দেখিনি। ভাইভা শেষ হওয়ার পরে আর দেখা হয় নি। আমি-তো ভেবেছি এখানেই থাকবে।" সাত্যকি বলল।
"আচ্ছা, তোরা আড্ডা দে। আমি আসছি।" কথা শেষ হতেই ইরিনা উঠে হাঁটা শুরু করলো।
সাত্যকি অবাক হলো কিছুটা। সে রুদ্রকে বলল, "কিরে রুদ্র, ইরিনার আবার কি হয়েছে।"
রুদ্র বলল, "ফাহিমের সাথে ঝগড়া হয়েছে।"
"ওহ আচ্ছা। এই ব্যাপার। এই জন্য মুড অফফ।"
"কি করবি এখন?" রুদ্র কথার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে সাত্যকিকে জিগ্যেস করলো।
"কি আর করবো। কেউই নেই। ভেবেছিলাম আজ জমিয়ে আড্ডা দিবো। কিন্তু...!" এটুকু বলে সাত্যকি থেকে আবার বলল, "আচ্ছা, আমি হলের দিকে যাবো। তুই কি করবি?"
"আলিফ আসতাছে। ও এলে একসাথে বাসার দিকে যাবো।"
"আচ্ছা। তাহলে আমি চললাম।"
"আচ্ছা। ওহ হ্যাঁ, তুই বাড়ি যাবি কবে?"
"কাল বা পরশুদিন। বাসা থেকে বারবার কল দিচ্ছে যাওয়ার জন্য, বিয়ের তো এক সপ্তাহ ও বাকী নেই।"
"হ্যাঁ, সেটা অবশ্য ঠিক। তাহলে একবারে বিয়েতে দেখা হচ্ছে তোর সাথে?"
"হ্যাঁ, সম্ভবত।"
"তুই চিন্তা করিস না। তোকে ঝালাতে বিয়ের আগের দিন আমরা দলবল বেধে চলে আসবো।"
"আচ্ছা আসিস। কোনো সমস্যা নেই। তোদের থাকার জন্য সকল ব্যবহার করে রাখবো।"
"তাহলে তো চিন্তাই নেই। এছাড়া * ধর্মের সকল রীতি মেনে বিয়ে হচ্ছে তোদের। এর আগে * দের বিয়ে কাছ থেকে দেখিনি। শুনেছি অনেক মজা হয়। আমি-তো খুব এক্সাইটেড।"
রুদ্রের আগ্রহ দেখে সাত্যকি হাসলো। সে বলল, "আমার তো টেনশন হচ্ছে।"
"ধুর, কিসের টেনশন। এছাড়া জয় মানুষটা খুব ভালো। তোরা তো চুটিয়ে প্রেম করেছিস এতোদিন। এখন চিন্তা কিসের? ভয় কিসের? যে মানুষটাকে তুই পুরোটা চিনিস তাকে বিয়ে করতে কিসের ভয়?"
"তবুও, একটা টেনশন হয়ই। তুই বুঝবি না।"
"আচ্ছা, আমার বুঝতে হবে না।"
"হ্যাঁ! দেখ কথা বলতে বলতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি যাই। তুই থাক। আলিফকে কল দে, দেখ ও কখন আসবে।"
"আচ্ছা, তুই যা।"
"ওকে, বাই।" সাত্যকি বিদায় নিয়ে চলে গেলো।
সাত্যকি চলে যাওয়ার দশ মিনিট পরেই আলিফ এলো। সে এসে রুদ্রকে বলল, "ক্যাম্পাস লাইফ তাহলে শেষ তোর?"
"হ্যাঁ, দোস্ত। তোদের ভাইভা কবে?" রুদ্র বলল।
"পরশুদিন।"
"তাহলে তো তোর ও প্রায় শেষ এর দিকেই।"
"হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিক।"
"চল উঠি। অনেকটা সময় ধরে এখানে বসে আছি।"
"আচ্ছা চল, একবারে বাসার দিকে যাই।"
আলিফ ও রুদ্র রিকসা করে যাচ্ছিল। হঠাৎ রুদ্র জিজ্ঞেস করলো, "নদীর কি খবর? কবে অফিসিয়ালি প্রপোজ করছিস ওকে? এভাবে আর কতদিন প্রেম করবি?"
"নদীর মতিগতি আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা, রুদ্র। কোনো কোনো সময় মনে হয়, ও আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। আবার কোনো কোনো সময় মনে হয়, ও আমার সাথে কোনো সম্পর্কে জড়াতে চায় না। সবকিছু থেকে পালাতে চায়।" আলিফ হতাশ গলায় বলল।
রুদ্র কোনো কথা বলল না। আলিফ নিজেই আবার বলল, "আমিও যে নদীকে ভালোবাসি, ও সেটা বুঝে। কিন্তু আমাদের মাঝে ক্ষুদ্র একটা বালুকণা আছে। শুধু মাত্র এই একবিন্দু বালুর কারণে দুইজন সম্পূর্ণভাবে এক হতে পারছি না। আমি নদীকে বুঝে উঠতে পারছি না।"
আলিফের কাঁধে হাত রেখে রুদ্র বলল, "এতো চিন্তা করিস না। একটু সময় দে। তুই নিজেই দেখবি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। এই সামন্য বালুকণা ভালোবাসার বাতাসে দূর হয়ে যাবে। তারপর শুধু তোরা দুইজন।"
"সেটাই যেনো হয়।" আলিফ বলল।
"সেটাই হবে। চিন্তা করিস না।"
বিকালের সময়টা রুদ্র আজকাল ছাঁদে বসে থাকে। তাদের বাসার ছেলেটার সাথে তার ভাব হয়েছে। দুইজনে প্রায়ই আড্ডা দেয়। ছেলেটার নাম হাসান।
হাসানের কাছ থেকে রুদ্র অনেককিছু জানতে পারেছে। তারা যে বাসায় এখন আছে সেই বাসায় আগে রুদ্র নামে একজন ছিল। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। হাসানের কাছ থেকে সে তরুর ব্যাপারেও অনেক কিছু জানতে পেরেছে। তরু এই বাসায় প্রায়ই আসতো। হাসান তরুকে দেখেছে। সে প্রায়ই তরুর ব্যাপারে হাসনকে জিজ্ঞেস করে। তরু দেখতে কেমন? তরুর চুল গুলো কেমন? তরুর চোখ কেমন? তরুর সুন্দর নাকি কালো? তরু, তরু, তরু! তরুর সম্পর্কে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেই হাসান বিরক্ত হয়। তবুও সুযোগ পেলেই রুদ্র জিজ্ঞেস করে। হাসানের বলা বর্ণনা দিয়ে, রুদ্র তার নিজের মনের মধ্যে তরুর একটা ছবি এঁকেছে। তরুকে দেখতে ইচ্ছে করলেই সে দুই চোখ বন্ধ করে ফেলে। চোখ বন্ধ করার সাথেসাথেই তরুর একটা ছবি তার চোখের সামনে ভেবে উঠে। রুদ্র তখনই মনে মনে বলে, হ্যাঁ, এটাই তরু।
হাসানের কাছ থেকে রুদ্র যতটুকু জেনেছে, ততটুকু দিয়ে তরু বা রুদ্রকে খোঁজ সম্ভব না। কিন্তু হাসান বলেছে, রুদ্রের বাবা-মা এক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার দুই সপ্তাহ পরেই রুদ্র হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে চলে যায়। কোথায় যায় কেউ জানেনা। রুদ্রের আত্মীয় স্বজনরা রুদ্রের খোঁজে আগে প্রথম কয়েকমাস প্রায়ই এই বাসায় আসতো। বাসাটাও ওভাবেই পড়ে ছিলো দীর্ঘ কয়েকমাস। তারপর একদিন রুদ্রের মামা এসে বাসা ভাড়া মিটিয়ে বাসার মাল জিনিস সব ট্রাকে ভরে নিয়ে যায়। তারপর আর কেউ আসেনি, রুদ্রের খোঁজে। তরুও কখনো আসেনি। রুদ্র চলে যাওয়ার পরে তরুকে আর কখনো দেখেনি হাসান।
হাসানের কাছ থেকে রুদ্র এটুকু জানতে পেরে অনেক খুশি। তরুকে পাওয়া না গেলেও, তরু আছে, কোথাও না কোথাও আছে, এটাই রুদ্রের জন্য যথেষ্ট। সে এখনো আশা করে, সে একদিন ঠিকই তরুর সন্ধান পাবে।
রুদ্র ছাঁদে বসে একা একা তরুর কথা ভাবছিল। কিন্তু ফোনের রিংটোন তাকে বিরক্ত করলো। সে পকেট থেকে অলস ভঙ্গিতে ফোন বের করলো। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই দেখলো রিয়ার নাম্বারটা স্ক্রিনে ভেসে আছে। সে কলটা রিসিভ করবে কি করবে না চিন্তা করতে করতে কলটা কেটে গেলো। কলটা কেটে গেলে, সে ফোনটা যেই পকেটে রাখতে যাবে ঠিক তখনই আবার ফোনটা বেজে উঠলো। সে জানে, রিয়া আবার কল দিয়েছে। সে ফোনটা রিসিভ করলো।
"হ্যালো, রুদ্র।" ফোনের ওপাশ থেকে মিষ্টি কন্ঠে রিয়া বলল।
"হ্যাঁ রিয়া বলো।" রুদ্র নিষ্প্রাণ কন্ঠে বলল।
"তুমি কি একটু নিচে আসতে পারবে?" বিয়ার কন্ঠে অদ্ভুত অনন্দ। রিয়া কোনো একটা কারণে অনেক খুশি, সেটা তার কন্ঠ শুনেই বোঝা যাচ্ছে।
"তুমি কি বাসার নিচে?" রুদ্র জিজ্ঞেস করল।
"বাসার নিচে না থাকলে, তোমাকে বাসার নিচে আসতে বলব কেন? আজব প্রশ্ন কেনো করছ? তুমি দ্রুত নিচে আসো, প্লিজ!" রিয়ার কন্ঠ অনুরোধ।
"আচ্ছা আমি আসছি।" রুদ্র এই বলে ফোন কেটে দিল।
রুদ্র নিচে গিয়ে দেখল, রিয়ার হাতে একগুচ্ছ কাঠগোলাপ ফুল। রুদ্র কিছুই বুঝতে পারলো না। সে রিয়ার সামনে এসে দাড়ালো।
রিয়ার হাতে থাকা কাঠগোলাপ ফুল গুলো সে রুদ্রের দিকে বাড়িয়ে দিল। তারপর সে বলল, "এই নেও তোমার প্রিয় ফুল।"
"আমায় প্রিয় ফুল?" রুদ্র অনেকখানি অবাক হলো।
"হ্যাঁ, আজ থেকে এটাই তোমার প্রিয় ফুল।" রিয়া বলল।
"রিয়া, এরকম অদ্ভুত কথা কেনো বলছ?" রুদ্রের চোখে-মুখে কৌতুহল। সে রিয়ার কাজকর্ম বুঝে উঠতে পারছে না।
"আমি আরেকটা অদ্ভুত কথা বলবো বলেই, আগেই আরেকটা অদ্ভুত কথা বলে নিলাম। যাতে পরের কথাটা অদ্ভুত মনে না হয়।" রিয়া হাসিমুখে কথাগুলো বলল।
"কি অদ্ভুত কথা বলবে?" রুদ্র আরো অবাক হলো।
"আমি যে কথাটা বলল, সেই কথাটা তুমি জানো। তবুও আজ আমি নিজের মুখে বলতে চাই।" রিয়া বলল।
"কি কথা আমি জানি? যা আবার বলতে চাও?" রুদ্র জিজ্ঞেস করল।
"এই যে, আমি তোমাকে ভালোবাসি।" রিয়া কথাটা বলে থামলো। সে আবার বলল, "রুদ্র, আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।" রিয়ার কথাগুলো নরমাল সুরের চেয়ে অনেকটা জোরে বলল। সে চেয়েছিলো চিৎকার করে বলতে। কিন্তু শেষ মুহুর্তে গিয়ে আর বলেনি।
"কিন্তু রিয়া..!" রুদ্রকে কথা শেষ করতে দিলো না রিয়া।
রিয়া বলল, "কোনো কিন্তু নেই। তোমাকে কিছুই বলতে হবে না। আমাকে ভালোবাসতে হবেও না। এভাবে বন্ধু হয়ে পাশে থেকো।" রিয়া কথা শেষ করে হেসে দিলো।
রিয়ার হাসিটা অদ্ভুত সুন্দর। এই সন্ধ্যার সময় এমন প্রাণখোলা হাসি দেখে রুদ্র মুগ্ধ হলো। তার মনে হলো, রিয়ার হাসিটা ক্রমশ তাকে তার দিকে টানছে। সে নিজেকে আটকাতে পারছে না। আকাশ ক্রমশ মাটিতে নেমে আসছে। রুদ্রের হৃদয় তীব্র বেগে ছুটে চলেছে অজানা এক গন্তব্যের দিকে। এ কেমন অনুভূতি? রুদ্র এই অনুভূতির কাছে ক্রমশ হার মেনে যাচ্ছে। যেটা রুদ্র চায় না। কোনো কিছুতেই চায় না।
রিয়ার মুখের হাসিটা আরো দীর্ঘ হলো। সে মুখে হাসি নিয়েই, ছোট্ট পাখির মত ছুটে এসে রুদ্রকে অবাক করে দিয়ে জড়িয়ে ধরল।
এক মুহুর্তে ঘটে যাওয়া ঘটনায় রুদ্র পুরো ভেঙে পড়লো। সে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। সে রিয়াকে সরিয়ে দিতেও পারছে। কোনো এক প্রবল মায়া তাকে জড়িয়ে নিচ্ছে। তাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলছে। সে কি করবে?
সন্ধ্যা নেমে গেছে। দূর থেকে একটা পাখির ডাক ভেসে আসছে। রাস্তার পাশে থাকা সোডিয়াম লাইটগুলোতে আলো জ্বলছে। দুই একটা রিকসার টিং টং শব্দ শোনা যাচ্ছে। এই সব হাজারো শব্দের মধ্যেও রুদ্র অন্য আরেকটা শব্দ শুনতে পাচ্ছে। এটা কিসের শব্দ? কোথা থেকে আসছে? রুদ্র মনোযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতেই সে বুঝলো, রিয়ার বুকের ভেতর থেকে শব্দটা আসছে। কী শান্ত, গভীর এক মায়া জড়িয়ে আছে এই শব্দে। হৃদয়কে মুহুর্তে শীতল করে তোলে। রুদ্র এক মুহুর্তে জন্য সবকিছু ভুলে গিয়ে রিয়া নামক এক মায়ায় নিজেকে জড়িয়ে নিলো। তার এখন ভালো লাগছে। এক অদ্ভুত শান্তি তার বুকে এসে বাঁধা বেঁধেছে। এটা কি? এটাই কি ভালোবাসা? রুদ্র জানেনা!
চলবে....!
"ভাইভা কেমন হলো?"
"চারবছর যেমন দিয়ে এসেছি।" ইরিনা বসতে বসতে রুদ্রকে বলল। সে আবার বলল, "তোর কেমন হয়েছে?"
"মোটামুটি, আলহামদুলিল্লাহ।" রুদ্র বলল।
"চা খাবি? নাকি খেয়েছিস?"
"খাবো। মাথাটা খুব ধরেছে। আচ্ছা তুই বস, আমি অর্ডার দিয়ে আসছি।"
"আচ্ছা।"
রুদ্র উঠে গিয়ে চায়ের অর্ডাল দিলো। একটা সিগারেট ধরালো। তারপর সে চা টা তাদের কাছে দিয়ে আসতে বলে ফিরে এলো।
"এখন বল, তোর কি খবর?" রুদ্র বসতে বসেতে ইরিনাকে জিজ্ঞেস করলো।
"কি আর খবর থাকবে। চলছে সবকিছু এলোমেলো।"
"ফাহিমের কথা জিজ্ঞেস করছি? কিছু কি হয়েছে?
"না, কি হবে?"
"তাহলে সবকিছু ঠিকঠাক?"
"হ্যাঁ, ঠিকঠাক। কি ব্যাপার? আজ হঠাৎ ফাহিমের কথা জিজ্ঞেস করছিস?"
"এমনিতেই, তোদের দেখে মনে হলো তোদের মধ্যে কোনো ঝামেলা হয়েছে। একজন আরেকজনকে এড়িয়ে চলছিস।"
ইরিনা আর কিছু বলল না। চা চলে এসেছে। সে চায়ে চুমুক দিলো।
রুদ্রও চা হাতে নিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে, সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সেটা ফেলে দিলো।
"তেমন কিছু হয় নি। গতকাল একটা বিষয় নিয়ে ঝগড়া হয়েছে। তাই আমাকে দেখলেই ফাইম এড়িয়ে চলছে।" ইরিনা চা খেতে খেতে কথাগুলো বলল।
"শেয়ার করা যাবে? যদি কোনো সমাধান দিতে পারি।" রুদ্র বলল।
"তেমন কিছু না রুদ্র। বাসায় বিয়ের কথা চলছে। আমার জন্য ছেলে দেখা হচ্ছে। সেই বিষয় নিয়ে ফাহিমের সমস্যা। কেনো আমার জন্য ছেলে দেখা হবে। কেনো আমি সেজেগুজে ছেলেদের সামনে যাবো। এই সামান্য বিষয় নিয়ে, অকারণে ফাহিম রাগ দেখাচ্ছে। কত বুঝিয়েছি কিন্তু ফাহিম বুঝতেই চাচ্ছে না। এদিকে ওকে আমি বলেছি, বাবার সাথে দেখা করার জন্য। ও সেটাও করবে না। চাকরি না পেয়ে, বাবার সাথে দেখা করবে না। সবকিছু নিয়ে আমি প্রচন্ড হতাশ। বিরক্ত!" ইরিনা রাগে ক্ষোভে কথাগুলো এক সুরে বলে গেলো রুদ্রকে।
রুদ্র মনোযোগ দিয়ে শুনলো। ইরিনার কথার মাঝে সে তাকে বিরক্ত করে নি। সে বলল, "দেখ ইরিনা, এই সময়টা এরকমই। আমাদের পড়াশোনা শেষ। এখন চাকরি পাওয়াটা খুব জরুরি। এদিকে তোদের বাবা-মা এখন চাইবে তোদের বিয়েটা দিয়ে দেওয়ার জন্য। আমাদের বাবা-মা চায়, আমরা একটা চাকরি পেলে তারা বিশ্রামে যাবে। আর বর্তমানে চাকরির বাজারে চাকরি পাওয়া অনেক কঠিন। এদিকে ইন্টারভিউ উপর ইন্টারভিউ দিয়ে যেতে হয়। এছাড়া একটা বেকার ছেলে কীভাবে তার গার্লফ্রেন্ডের বাবার সাথে দেখা করতে যেতে পারে তুই বল? তোকে বুঝতে হবে ফাহিমের বিষয়টা।"
"হ্যাঁ, আমি না-হয় বুঝলাম। কিন্তু ওকে ও তো আমার বিষয়টা বুঝতে হবে। তুই কি বলিস?"
"হ্যাঁ, অবশ্যই। একটা সম্পর্কে দুইজনকেই একে অন্যকে বুঝতে হয়। তাহলে আর কোনো সমস্যা থাকে না।"
"আমিই সবসময় বুঝে, সবকিছু মেনে নিয়ে, চুপ থেকে ঝামেলা ঠিকঠাক করি। কিন্তু ফাহিম আমাকে বুঝতেই পারে না। আমি দিনদিন বিরক্ত হয়ে উঠছি। এই রোজকার ঝগড়া, ঝামেলা, মান-অভিমান আর ভালো লাগছে না।"
"তাহলে কি করবি? ব্রেকআপ করার কথা ভাবছিল?"
"ফাহিমকে ছাড়া কীভাবে থাকবো? রাগের মাথায় মনে হয়, ব্রেকআপ করে ফেলি। কিন্তু রাগ কেটে গেলে একমুহূর্ত ওর সাথে কথা না বলে থাকতে পারি না। তুই দোয়া কর, যাতে সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে যেনো চলে যায়।"
"সেটা কি আর বলতে। আমি-তো চাই সবসময় তুই সুখে থাক, ভালো থাক।"
"আমিও চাই, তুই ভালো থাক। কিন্তু তোর সেই একটাই জেদ, তরুকে খুঁজে বের করবি! তারপর বল, তরুর কোনো খোঁজ পেলি?"
হঠাৎ তরুর প্রসঙ্গ আসতেই রুদ্রের মুখ কালো হয়ে উঠলো। সে বলল, "আশা ছেড়ে দিয়েছি। সবটা এখন ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছি।"
"মন খারাপ করিস না। তরুর নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও ভালো আছে। এখন তোর করনীয়, নিজেকে গুছিয়ে নেও। পিছুটান ছেড়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া।"
"হ্যাঁ, সেটাই করছি। তরুর বিষয়টা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছি।"
"সাব্বাশ!" রুদ্রের পিঠে আলতো করে থাপ্পড় দিয়ে ইরিনা কথাটা বলল। সে আবার বলল, "রিয়ার খবর কি?"
"রিয়ার খবর?" রুদ্র মুখে বিষময় ভাব ফুটে উঠলো।
"রিয়ার সাথে তো তোর প্রায়ই দেখাসাক্ষাৎ হয়। তোরা একসাথে ভালোই সময় কাটাস।"
"তেমন না, কিন্তু হ্যাঁ রিয়ার সাথে মাঝেমধ্যে সময় কাটাই। যখন তোরা সবাই ব্যস্ত ছিলি, তখন রিয়া আমাকে অনেক সময় দিয়েছে। মেয়েটা আসলে ভালো। লক্ষী একটা মেয়ে।"
"তোর মুখে রিয়ার এতো প্রসংশা? তা প্রেমে টেমে পড়ে গেলি নাকি আবার?" কথাটা বলেই ইরিনা হাসতে থাকলো।
"ধুর! রিয়া আমার খুব ভালো বন্ধু। এইটুকুই।"
"কিন্তু, রিয়া তোকে ভীষণ ভালোবাসে।"
"হ্যাঁ, সেটা বুঝতে পারি। মেয়েটাকে এভাবে কষ্ট দিতে আমারও ভালো আগে না। কিন্তু, আমি কি করবো? রিয়াকে সেভাবে কখনো দেখিনি, মানে বন্ধুর বাইরে।"
"শোন, প্রেম এমন একটা জটিল বিষয়, যে কখনো কেউ তাকে বুঝে উঠতে পারে নি। কখন কাকে ভালোবেসে ফেলি আমরা, নিজেরাই বুঝতে পারি না।"
"শেষ হইছে তোর ফিলোসোফি?"
"ওকে, আমি আর জ্ঞান দিচ্ছি না তোকে। তুই এই সব বিষয়ের উপর পিএইচডি ডিগ্রির অর্জন করে রেখেছিস। আমি তোকে আর কি বলব।"
সাত্যকিকে হেঁটে এসে পাশে দাঁড়াতে দেখে রুদ্র বলল, "ভাইভা কেমন হলো?"
"ভালো হয়েছে। তোদের কেমন হলো?" রুদ্র এবং ইরিনাকে উদ্দেশ্য করে সাত্যকি জিজ্ঞেস করলো।
"ভাইভার কথা বাদ দে। যেমন হওয়ার হয়েছে।" ইরিনা কর্কশ গলায় বলল।
"এভাবে বলছিস কেনো? তোর কি মন মেজাজ খারাপ?" ইরিনাকে জিজ্ঞেস করলো সাত্যকি।
"আরে না। ওর ভাইভা ভালো হয় নি। এদিকে আমাদের সবার ভালো হয়েছে, তাই মুড অফফ ওর।" রুদ্র বলল।
"আরে ব্যাপার না দোস্ত।" ইরিনার পাশে বসতে বসতে সাত্যকি বলল।
সবাই চুপ। হঠাৎ সাত্যকিই বলল, "তোরা সবাই বিয়েতে আসছিস তো?"
"হ্যাঁ, অবশ্যই। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে প্রথম কারো বিয়ে হচ্ছে আমরা সবাই না এলে কি হবে?" রুদ্র বলল।
"কিরে ইরিনা, সেই কখন থেকে চুপসে আছিস। সত্যি করে বল তো তোর কি হয়েছে?" ইরিনার কাঁধে ধাক্কা দিয়ে সাত্যকি জিজ্ঞেস করলো।
"ফাহিমকে দেখছিস?" ইরিনা জিজ্ঞেস করলো।
"না, দেখিনি। ভাইভা শেষ হওয়ার পরে আর দেখা হয় নি। আমি-তো ভেবেছি এখানেই থাকবে।" সাত্যকি বলল।
"আচ্ছা, তোরা আড্ডা দে। আমি আসছি।" কথা শেষ হতেই ইরিনা উঠে হাঁটা শুরু করলো।
সাত্যকি অবাক হলো কিছুটা। সে রুদ্রকে বলল, "কিরে রুদ্র, ইরিনার আবার কি হয়েছে।"
রুদ্র বলল, "ফাহিমের সাথে ঝগড়া হয়েছে।"
"ওহ আচ্ছা। এই ব্যাপার। এই জন্য মুড অফফ।"
"কি করবি এখন?" রুদ্র কথার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে সাত্যকিকে জিগ্যেস করলো।
"কি আর করবো। কেউই নেই। ভেবেছিলাম আজ জমিয়ে আড্ডা দিবো। কিন্তু...!" এটুকু বলে সাত্যকি থেকে আবার বলল, "আচ্ছা, আমি হলের দিকে যাবো। তুই কি করবি?"
"আলিফ আসতাছে। ও এলে একসাথে বাসার দিকে যাবো।"
"আচ্ছা। তাহলে আমি চললাম।"
"আচ্ছা। ওহ হ্যাঁ, তুই বাড়ি যাবি কবে?"
"কাল বা পরশুদিন। বাসা থেকে বারবার কল দিচ্ছে যাওয়ার জন্য, বিয়ের তো এক সপ্তাহ ও বাকী নেই।"
"হ্যাঁ, সেটা অবশ্য ঠিক। তাহলে একবারে বিয়েতে দেখা হচ্ছে তোর সাথে?"
"হ্যাঁ, সম্ভবত।"
"তুই চিন্তা করিস না। তোকে ঝালাতে বিয়ের আগের দিন আমরা দলবল বেধে চলে আসবো।"
"আচ্ছা আসিস। কোনো সমস্যা নেই। তোদের থাকার জন্য সকল ব্যবহার করে রাখবো।"
"তাহলে তো চিন্তাই নেই। এছাড়া * ধর্মের সকল রীতি মেনে বিয়ে হচ্ছে তোদের। এর আগে * দের বিয়ে কাছ থেকে দেখিনি। শুনেছি অনেক মজা হয়। আমি-তো খুব এক্সাইটেড।"
রুদ্রের আগ্রহ দেখে সাত্যকি হাসলো। সে বলল, "আমার তো টেনশন হচ্ছে।"
"ধুর, কিসের টেনশন। এছাড়া জয় মানুষটা খুব ভালো। তোরা তো চুটিয়ে প্রেম করেছিস এতোদিন। এখন চিন্তা কিসের? ভয় কিসের? যে মানুষটাকে তুই পুরোটা চিনিস তাকে বিয়ে করতে কিসের ভয়?"
"তবুও, একটা টেনশন হয়ই। তুই বুঝবি না।"
"আচ্ছা, আমার বুঝতে হবে না।"
"হ্যাঁ! দেখ কথা বলতে বলতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি যাই। তুই থাক। আলিফকে কল দে, দেখ ও কখন আসবে।"
"আচ্ছা, তুই যা।"
"ওকে, বাই।" সাত্যকি বিদায় নিয়ে চলে গেলো।
সাত্যকি চলে যাওয়ার দশ মিনিট পরেই আলিফ এলো। সে এসে রুদ্রকে বলল, "ক্যাম্পাস লাইফ তাহলে শেষ তোর?"
"হ্যাঁ, দোস্ত। তোদের ভাইভা কবে?" রুদ্র বলল।
"পরশুদিন।"
"তাহলে তো তোর ও প্রায় শেষ এর দিকেই।"
"হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিক।"
"চল উঠি। অনেকটা সময় ধরে এখানে বসে আছি।"
"আচ্ছা চল, একবারে বাসার দিকে যাই।"
আলিফ ও রুদ্র রিকসা করে যাচ্ছিল। হঠাৎ রুদ্র জিজ্ঞেস করলো, "নদীর কি খবর? কবে অফিসিয়ালি প্রপোজ করছিস ওকে? এভাবে আর কতদিন প্রেম করবি?"
"নদীর মতিগতি আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা, রুদ্র। কোনো কোনো সময় মনে হয়, ও আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। আবার কোনো কোনো সময় মনে হয়, ও আমার সাথে কোনো সম্পর্কে জড়াতে চায় না। সবকিছু থেকে পালাতে চায়।" আলিফ হতাশ গলায় বলল।
রুদ্র কোনো কথা বলল না। আলিফ নিজেই আবার বলল, "আমিও যে নদীকে ভালোবাসি, ও সেটা বুঝে। কিন্তু আমাদের মাঝে ক্ষুদ্র একটা বালুকণা আছে। শুধু মাত্র এই একবিন্দু বালুর কারণে দুইজন সম্পূর্ণভাবে এক হতে পারছি না। আমি নদীকে বুঝে উঠতে পারছি না।"
আলিফের কাঁধে হাত রেখে রুদ্র বলল, "এতো চিন্তা করিস না। একটু সময় দে। তুই নিজেই দেখবি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। এই সামন্য বালুকণা ভালোবাসার বাতাসে দূর হয়ে যাবে। তারপর শুধু তোরা দুইজন।"
"সেটাই যেনো হয়।" আলিফ বলল।
"সেটাই হবে। চিন্তা করিস না।"
বিকালের সময়টা রুদ্র আজকাল ছাঁদে বসে থাকে। তাদের বাসার ছেলেটার সাথে তার ভাব হয়েছে। দুইজনে প্রায়ই আড্ডা দেয়। ছেলেটার নাম হাসান।
হাসানের কাছ থেকে রুদ্র অনেককিছু জানতে পারেছে। তারা যে বাসায় এখন আছে সেই বাসায় আগে রুদ্র নামে একজন ছিল। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। হাসানের কাছ থেকে সে তরুর ব্যাপারেও অনেক কিছু জানতে পেরেছে। তরু এই বাসায় প্রায়ই আসতো। হাসান তরুকে দেখেছে। সে প্রায়ই তরুর ব্যাপারে হাসনকে জিজ্ঞেস করে। তরু দেখতে কেমন? তরুর চুল গুলো কেমন? তরুর চোখ কেমন? তরুর সুন্দর নাকি কালো? তরু, তরু, তরু! তরুর সম্পর্কে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেই হাসান বিরক্ত হয়। তবুও সুযোগ পেলেই রুদ্র জিজ্ঞেস করে। হাসানের বলা বর্ণনা দিয়ে, রুদ্র তার নিজের মনের মধ্যে তরুর একটা ছবি এঁকেছে। তরুকে দেখতে ইচ্ছে করলেই সে দুই চোখ বন্ধ করে ফেলে। চোখ বন্ধ করার সাথেসাথেই তরুর একটা ছবি তার চোখের সামনে ভেবে উঠে। রুদ্র তখনই মনে মনে বলে, হ্যাঁ, এটাই তরু।
হাসানের কাছ থেকে রুদ্র যতটুকু জেনেছে, ততটুকু দিয়ে তরু বা রুদ্রকে খোঁজ সম্ভব না। কিন্তু হাসান বলেছে, রুদ্রের বাবা-মা এক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার দুই সপ্তাহ পরেই রুদ্র হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে চলে যায়। কোথায় যায় কেউ জানেনা। রুদ্রের আত্মীয় স্বজনরা রুদ্রের খোঁজে আগে প্রথম কয়েকমাস প্রায়ই এই বাসায় আসতো। বাসাটাও ওভাবেই পড়ে ছিলো দীর্ঘ কয়েকমাস। তারপর একদিন রুদ্রের মামা এসে বাসা ভাড়া মিটিয়ে বাসার মাল জিনিস সব ট্রাকে ভরে নিয়ে যায়। তারপর আর কেউ আসেনি, রুদ্রের খোঁজে। তরুও কখনো আসেনি। রুদ্র চলে যাওয়ার পরে তরুকে আর কখনো দেখেনি হাসান।
হাসানের কাছ থেকে রুদ্র এটুকু জানতে পেরে অনেক খুশি। তরুকে পাওয়া না গেলেও, তরু আছে, কোথাও না কোথাও আছে, এটাই রুদ্রের জন্য যথেষ্ট। সে এখনো আশা করে, সে একদিন ঠিকই তরুর সন্ধান পাবে।
রুদ্র ছাঁদে বসে একা একা তরুর কথা ভাবছিল। কিন্তু ফোনের রিংটোন তাকে বিরক্ত করলো। সে পকেট থেকে অলস ভঙ্গিতে ফোন বের করলো। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই দেখলো রিয়ার নাম্বারটা স্ক্রিনে ভেসে আছে। সে কলটা রিসিভ করবে কি করবে না চিন্তা করতে করতে কলটা কেটে গেলো। কলটা কেটে গেলে, সে ফোনটা যেই পকেটে রাখতে যাবে ঠিক তখনই আবার ফোনটা বেজে উঠলো। সে জানে, রিয়া আবার কল দিয়েছে। সে ফোনটা রিসিভ করলো।
"হ্যালো, রুদ্র।" ফোনের ওপাশ থেকে মিষ্টি কন্ঠে রিয়া বলল।
"হ্যাঁ রিয়া বলো।" রুদ্র নিষ্প্রাণ কন্ঠে বলল।
"তুমি কি একটু নিচে আসতে পারবে?" বিয়ার কন্ঠে অদ্ভুত অনন্দ। রিয়া কোনো একটা কারণে অনেক খুশি, সেটা তার কন্ঠ শুনেই বোঝা যাচ্ছে।
"তুমি কি বাসার নিচে?" রুদ্র জিজ্ঞেস করল।
"বাসার নিচে না থাকলে, তোমাকে বাসার নিচে আসতে বলব কেন? আজব প্রশ্ন কেনো করছ? তুমি দ্রুত নিচে আসো, প্লিজ!" রিয়ার কন্ঠ অনুরোধ।
"আচ্ছা আমি আসছি।" রুদ্র এই বলে ফোন কেটে দিল।
রুদ্র নিচে গিয়ে দেখল, রিয়ার হাতে একগুচ্ছ কাঠগোলাপ ফুল। রুদ্র কিছুই বুঝতে পারলো না। সে রিয়ার সামনে এসে দাড়ালো।
রিয়ার হাতে থাকা কাঠগোলাপ ফুল গুলো সে রুদ্রের দিকে বাড়িয়ে দিল। তারপর সে বলল, "এই নেও তোমার প্রিয় ফুল।"
"আমায় প্রিয় ফুল?" রুদ্র অনেকখানি অবাক হলো।
"হ্যাঁ, আজ থেকে এটাই তোমার প্রিয় ফুল।" রিয়া বলল।
"রিয়া, এরকম অদ্ভুত কথা কেনো বলছ?" রুদ্রের চোখে-মুখে কৌতুহল। সে রিয়ার কাজকর্ম বুঝে উঠতে পারছে না।
"আমি আরেকটা অদ্ভুত কথা বলবো বলেই, আগেই আরেকটা অদ্ভুত কথা বলে নিলাম। যাতে পরের কথাটা অদ্ভুত মনে না হয়।" রিয়া হাসিমুখে কথাগুলো বলল।
"কি অদ্ভুত কথা বলবে?" রুদ্র আরো অবাক হলো।
"আমি যে কথাটা বলল, সেই কথাটা তুমি জানো। তবুও আজ আমি নিজের মুখে বলতে চাই।" রিয়া বলল।
"কি কথা আমি জানি? যা আবার বলতে চাও?" রুদ্র জিজ্ঞেস করল।
"এই যে, আমি তোমাকে ভালোবাসি।" রিয়া কথাটা বলে থামলো। সে আবার বলল, "রুদ্র, আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।" রিয়ার কথাগুলো নরমাল সুরের চেয়ে অনেকটা জোরে বলল। সে চেয়েছিলো চিৎকার করে বলতে। কিন্তু শেষ মুহুর্তে গিয়ে আর বলেনি।
"কিন্তু রিয়া..!" রুদ্রকে কথা শেষ করতে দিলো না রিয়া।
রিয়া বলল, "কোনো কিন্তু নেই। তোমাকে কিছুই বলতে হবে না। আমাকে ভালোবাসতে হবেও না। এভাবে বন্ধু হয়ে পাশে থেকো।" রিয়া কথা শেষ করে হেসে দিলো।
রিয়ার হাসিটা অদ্ভুত সুন্দর। এই সন্ধ্যার সময় এমন প্রাণখোলা হাসি দেখে রুদ্র মুগ্ধ হলো। তার মনে হলো, রিয়ার হাসিটা ক্রমশ তাকে তার দিকে টানছে। সে নিজেকে আটকাতে পারছে না। আকাশ ক্রমশ মাটিতে নেমে আসছে। রুদ্রের হৃদয় তীব্র বেগে ছুটে চলেছে অজানা এক গন্তব্যের দিকে। এ কেমন অনুভূতি? রুদ্র এই অনুভূতির কাছে ক্রমশ হার মেনে যাচ্ছে। যেটা রুদ্র চায় না। কোনো কিছুতেই চায় না।
রিয়ার মুখের হাসিটা আরো দীর্ঘ হলো। সে মুখে হাসি নিয়েই, ছোট্ট পাখির মত ছুটে এসে রুদ্রকে অবাক করে দিয়ে জড়িয়ে ধরল।
এক মুহুর্তে ঘটে যাওয়া ঘটনায় রুদ্র পুরো ভেঙে পড়লো। সে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। সে রিয়াকে সরিয়ে দিতেও পারছে। কোনো এক প্রবল মায়া তাকে জড়িয়ে নিচ্ছে। তাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলছে। সে কি করবে?
সন্ধ্যা নেমে গেছে। দূর থেকে একটা পাখির ডাক ভেসে আসছে। রাস্তার পাশে থাকা সোডিয়াম লাইটগুলোতে আলো জ্বলছে। দুই একটা রিকসার টিং টং শব্দ শোনা যাচ্ছে। এই সব হাজারো শব্দের মধ্যেও রুদ্র অন্য আরেকটা শব্দ শুনতে পাচ্ছে। এটা কিসের শব্দ? কোথা থেকে আসছে? রুদ্র মনোযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতেই সে বুঝলো, রিয়ার বুকের ভেতর থেকে শব্দটা আসছে। কী শান্ত, গভীর এক মায়া জড়িয়ে আছে এই শব্দে। হৃদয়কে মুহুর্তে শীতল করে তোলে। রুদ্র এক মুহুর্তে জন্য সবকিছু ভুলে গিয়ে রিয়া নামক এক মায়ায় নিজেকে জড়িয়ে নিলো। তার এখন ভালো লাগছে। এক অদ্ভুত শান্তি তার বুকে এসে বাঁধা বেঁধেছে। এটা কি? এটাই কি ভালোবাসা? রুদ্র জানেনা!
চলবে....!
===========================
পড়তে থাকুন চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।
Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.
( Post By- Kam Pagol)