14-06-2023, 12:22 AM
পর্ব -২৩
নদী বসে আছে। আলিফ দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে৷ সে একজনের সাথে কথা বলছে৷ সে ফিরে এলে নদী বলল, "কে ছিলো?"
"এক বড় ভাই।"
"ওহ আচ্ছা।"
নদী আজ প্রথম আলিফের ক্যাম্পাসে এসেছে। আলিফ বহুবার অনুরোধ করার পর আজ নদী তার সাথে ক্যাম্পাসে আসতে রাজি হয়েছে।
এখন সন্ধ্যা। আলিফ অফিস শেষ করে নদীকে নিয়ে বের হয়েছিল। নদী আজ শাড়ি পরেছে। সেটাও অবশ্য আলিফের অনুরোধে।
নদী আজকাল আলিফের অনুরোধ ফেলতে পারে না৷ প্রথমে সে রাজি না হলেও একটা সময় সে আর না বলতে পারে না। আলিফের কথা রাখতে নদীর ভালো লাগলেও সে সেটা মুখে প্রকাশ করে না।
নদী আজকাল ক্রমশ আলিফের প্রতি দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। সে নিজেকে কোনো ভাবেই আঁটকাতে পারছে না। সে কখনোই চায় না আলিফের সাথে সিরিয়াস কোনো রিলেশনে যেতে। কিন্তু তার অনুভূতিগুলো সত্য। আলিফের প্রতি তার তীব্র একটা ভালো লাগা কাজ করে। এটা কি ভালোবাসা? মূলত আলিফের কেয়ারিং, তার প্রতি সততা, ভালোবাসা তাকেও ভালোবাসতে বাধ্য করছে। আলিফ এমন কেনো? নদী আর কিছু ভাবে না। সে কেবল ডুবে যায় অচেনা এক সমুদ্রের অতল গহ্বরে। সে কি এখান থেকে সাঁতরে পার হতে পারবে? কিন্তু তাকে জেগে উঠতেই হবে। যেভাবেই হোক সাঁতরে তাকে তীরে ফিরতে হবে। একই ভুল সে জীবনে দ্বিতীয়বার করতে চায় না। বরং এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি সে জানে। সবকিছু জেনেও সে ফিরতে পারছে না তীরে। কোনো এক মায়ার বাঁধনে সে আঁটকা পড়েছে।
আলিফের ভালোবাসার গভীরতা এতোটা যে কেউ চাইলেও ডুবে যাওয়া থেকে নিজেকে আঁটকে রাখতে পারে না। নদীও পারছে না। কিন্তু এটাই তাদের দুইজনকে ঠেলে দিচ্ছে অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতে।
"কি ভাবছো?"
আলিফের কথা শুনে নদী সম্বিত ফিরে পেলো। সে বলল, "তেমন কিছু না।"
"আমাকে বলবে না?"
"বললাম তো, তেমন কিছু না।"
"আমি সেটাই শুনতে চাই।" আলিফ জোর গলায় বলে।
"কি বলবো?" নদী হতাশ ভাবে বলে।
"এখন যা ভাবছো সেটাই।"
"আমাদের কথা ভাবছিলাম।" নদী আত্মসমর্পণ করে বলে।
"আমাদের কথা!" আলিফ খুশি হয়ে নদীর কথাটা রিপিট করে।
"হ্যাঁ।" নদী বলে।
"তা কি ভাবছিলে?"
"তেমন কিছু না।"
"আবার বলছ তেমন কিছু না। আমাকে বলতে না চাইলে থাক। আমার সাথে কথা বলতে হবে না।" আলিফ অভিমান করে মন খারাপের কন্ঠে বলে।
"মন খারাপ করছো কেনো?"
"মন খারাপ করবো কেনো? আমি কে? এছাড়া মন খারাপ হবে বা কেনো?"
"তুমিও না। একদম বাচ্চাদের মত জেদ করো।"
"আমি-তো বাচ্চাই। এইটুকু।" আলিফ হাত দিয়ে দেখিয়ে বলে।
"হ্যাঁ, হয়েছে। তুমি একটা শিশু।"
"তাই-তো। আচ্ছা এখন বলো কি ভাবছিলে?"
"শুনলে, তোমার মন খারাপ হবে। শুধু শুধু আজ এই সুন্দর একটা দিনে মন খারাপের কথা বলে সময়টা নষ্ট করতে চাই না।"
"আচ্ছা, তাহলে থাক। এখন বলতে হবে না। কিন্তু পরে অবশ্যই শুনবো।"
"আচ্ছা।"
"লক্ষীমেয়ে।" আলিফ মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে।
"হয়েছে, এতো নেকামো করা লাগবে না।"
"করা লাগবে না?" এই বলে আলিফ আরেকটু নদীর কাছে সরে এসে বসে।
"খবরদার, কাছে আসবে না। কাছে এলে আবার সেদিনের মত কিছু একটা করে বসবে।" নদী সামান্য সরে গিয়ে বলে।
"কি করবে?" আলিফ দুষ্টু সুরে বলে।
"সেবার ছাঁদে কি করতে গেছিলে মনে নেই?"
"কই কিছুইতো করি-নি। কিছু করার আগেই আমাকে এমন ভাবে ধাক্কা দিলে আমি...!" এটুকু বলে আলিফ থামে। সে কপালে হাত দিয়ে দেখিয়ে আবার বলে, "এই দেখো, এখনো দাগ রয়ে গেছে।"
"ভালো হয়েছে। একদম ঠিক কাজ করেছি।"
"তাই। আচ্ছা আবারও ঠিক কাজটাই করো। আমি কিছুই মনে করবো না।" এটা বলে আলিফ আবার নদীর আরো কাছে সরে আসে।
নদী এবার সরে যায় না। সে আর কিছু বলেও না। আলিফের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে, দূরে একটা পাখি বসে আছে তার দিকে তাকায়। তার এই মুহুর্তটা ভালো লাগে। জীবনের অন্ধকার কানাগলির পথ ভুলে সে এই মুহুর্তটা উপভোগ করতে থাকে। তার কাছে জীবন সুন্দর মনে হয়। জীবন আসলেই সুন্দর। হাজারও দুঃখ কষ্টের ভীড়ে এই সামান্য আনন্দ, ভালো লাগার মুহূর্তগুলোই জীবনকে সুন্দর করে তোলে। বেঁচে থাকার আশা জোগায়। কিন্তু এই ভালো থাকার মুহুর্ত ক্ষনস্থায়ী। তবুও মানুষ বাঁচে, আশায় বাঁচে। হোপ ইস অ্যা গুড থিংকস!
নদীর হাত ধরে আলিফ ক্যাম্পাসের রাস্তা ধরে হাঁটছিল। হঠাৎ ইরিনা আর ফাহিমের সাথে দেখা হয়ে গেলো তাদের।
"তোরা এখানে?" আলিফকে দেখেই ইরিনা বলল।
"নদীকে ক্যাম্পাস দেখাতে নিয়ে এলাম। তোরা এখানে?" আলিফ উত্তর দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে।
"অনেকদিন দেখা হয় না। আজ হঠাৎ ফাহিম বলল অফিস শেষে দেখা করার জন্য। তাই ক্যাম্পাসের দিকেই এলাম।"
"তারপর কি খবর তোর?"
"এইতো আছি। ব্যস্ততায় চলে যাচ্ছে। তোর কি খবর?"
"আমারও একই অবস্থা। ক্যাম্পাসের লাইফটা মিস করি ভীষণ। কতদিন যে একসাথে আড্ডা দেওয়া হয় না।"
"হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিক। আগের মত আর সচারাচর একসাথে আড্ডা দেওয়া এখন হয়ে উঠবে না। ব্যস্ত লাইফে ঢুকে গেলে আর ফ্রি সময় পাওয়া যায় না। তারপর রুদ্রের কি খবর? রুদ্রতো ভুলেই গেছে সবাইকে।"
"ও আছে ওর মত। সারাদিন ঘরেই থাকে। মাঝেমধ্যে বের হয় তাও থিসিসের কাজে। অফ ডে ছাড়া আগের মত দেখা হয় না।"
"হ্যাঁ, ওর সাথে অনেকদিন দেখা হয় না। শুক্রবারে তো সবাই ফ্রি থাকি। চল, একদিন সবাই মিলে দেখা করি, আড্ডা দেই।"
"হ্যাঁ, সেটা করা যায়। আচ্ছা, আমি রুদ্রকে বলবো। তারপর, ফাহিম তোর কি খবর?"
"সবার মতই। অফিস, কাজ, ব্যস্ততা, বসের ঝাড়ি শোনা। এইতো চলে যাচ্ছে সবকিছু।" ফাহিম বলে।
ইরিনা নদীকে লক্ষ করে বলে, "কেমন আছো নদী?" ইরিনা ইশারায় বুঝাতে চেষ্টা করলো।
আলিফ বলল, "নদী এখন আমাদের কথা বুঝতে পারে। ও এখন ঠোঁট দেখেই বুঝতে পারে আমরা কি বলি। ঠোঁট ডাবিং ল্যাঙ্গুয়েজ শিখেছে।"
"বাহ, দারুণ তো।" ইরিনা অবাক হয়ে বলে।
"আমি ভালো আছি। আপনারা কেমন আছেন?" নদী সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে বলে। নদীর বলা কথা আলিফ ট্রান্সফার করে ফাহিম এবং ইরিনাকে বলে।
"আমরা সবাই ভালো আছি।" তাদের হয়ে উত্তর দেয় ইরিনা।
"এখন কোথায় যাবি?" আলিফ বলে।
"ক্যাম্পাসে কিছুক্ষণ দু'জনে হেঁটে বাসায় চলে যাবো। তোরা?" ফাহিম বলে।
"আমরা বেশকিছু সময় হলো এসেছি।" আলিফ উত্তর দেয়।
"চল, কোথাও বসে কিছু খাই।" ইরিনা বলে।
আলিফ ভেবে বলে, "আচ্ছা চল, যাই। আবার কবে দেখা হবে কে জানে।"
তারা চারজন ক্যাম্পাসের দক্ষিণ দিকে চলে আসে। এখানে কিছু টং দোকান, ফুসকা-চটপটি ছাড়াও বেশকিছু দোকান আছে। ফাঁকা একটা টেবিল দেখে তারা বসে।
"নদী।" ইরিনা ডাকে।
নদী মাথা নেড়ে সাড়া দেয়।
"তুমি কি জানো? শাড়িতে তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগে।"
নদী মুচকি হাসে। সে বলে, "ধন্যবাদ।"
"সত্যি। তোমাকে একদম পুরনো দিনের নায়কাদের মত লাগছে। আমি ছেলে হলে তোমার প্রেমে পড়ে যেতাম।" ইরিনা হাসে।
নদীর লজ্জা লাগে। সে আর কিছু বলে না।
"আলিফ অনেক ভাগ্যবান যে তোমাকে পেয়েছে।"
আলিফ এবং নদী একে অন্যের দিকে তাকায়। আলিফ বলে, "ইরিনা, সেরকম কিছু না। আমরা ভালো বন্ধু।"
নদী মাথা নেড়ে আলিফের কথায় সম্মতি প্রকাশ করে।
"নিজেদের কেনো মিথ্যে বলছিস? তোদের চোখে একে অন্যের জন্য যে ভালোবাসা আছে সেটা কেনো মিথ্যে বলে লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছিস?"
"তুই ভুল বুঝতাছিস।" আলিফ বলে।
"আমাকে আর বুঝাতে হবে না। আমি সবটা নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি। শোন...!" ইরিনা এটুকু বলে থামে। সে আবার নদীকে উদ্দেশ্য করে বলে, "শোনো, আমি জানি তোমরা একে অন্যকে ভালোবাসো। কিন্তু তোমাদের মধ্যে কি হয়েছে কিংবা কি সমস্যা সেটা আমি জানিনা। আমি জানতেও চাচ্ছি না। কিন্তু শুধু এটুকুই বলতে পারি, আলিফের মত করে তোমাকে কেউ ভালোবাসতে পারবে না। এই ভালোবাসাটা উপেক্ষা করো না। হেলায় হারিয়ে ফেলো না। এছাড়াও আমি জানি, তুমিও আলিফকে ভালোবাসো।"
নদী মনোযোগ দিয়ে ইরিনার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে থাকে। আলিফও মনোযোগ দিয়ে ইরিনার কথাগুলো শুনে। তারা কেউ কথা বলে না। দুই-একবার একে অন্যের মুখের দিকে তাকায়। কিন্তু পরক্ষণেই লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নেয়।
ইরিনা এবং ফাহিমকে বিদায় করে দিয়ে নদী এবং আলিফ আরও কিছুক্ষণ হাঁটলো। তারা নানা কথা বললেও ইরিনার বলা কথাগুলো উঠালো না। সেই বিষয়ে কেউ কাউকে কিছুই বলল না। তবুও তারা একে অন্যের মনের কথা, অনুভূতি, ভালোবাসা বুঝে নিলো রাতের ল্যাম্পপোস্টের নিয়নের আলোয়। কোনো একটা পাখি তার কন্ঠে সুর তুলে তাদের কথা একে অন্যকে বলে দিলো। এভাবে তারা একে অন্যের আরও কিছুটা কাছে চলে এলো, নিজেদের অজান্তেই। ভালোবাসা এমনই। ভালোবাসা এলে আমরা সেটাকে শত চেষ্টা করেও উপেক্ষা করতে পারি না। শুধু ভালোবাসার গভীরে ডুবে যেতে থাকি।
নদী রিকসায় বসে আছে। তার পাশে আলিফ। রিকসার হুট তোলা। বাইরে অন্ধকার। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলো আর ছুটে চলে গাড়ির হেডলাইটের আলো ছাড়া অন্ধকারই।
নদীর মুখের সামনে কিছু চুল উড়ে এলো বাতাসে। আলিফ সেদিকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে লক্ষ করলো। সে হঠাৎ হাত বাড়িয়ে চুলগুলো নদীর কানে কাছে গুজে দিলো। নদী আলিফের দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে পড়লো। কিন্তু সে কিছু বলল না। তার অবশ্য ভালো লাগলো। বুকের মধ্যে হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে উঠলেও সে সেটা ভাল ভাবে নিয়ন্ত্রণ করল। কিন্তু বাতাস আবারও চুলগুলো উড়িয়ে এনে মুখের উপর ফেলল। আলিফ এবারও আলতো করে চুলগুলো ছুঁয়ে সরিয়ে দিলো। এবার সে আগের মত দ্রুত হাত সরিয়ে নিলো না।
নদী তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। লজ্জায় আলিফের দিকে তাকাতে পারছে না। আলিফের স্পর্শে এতোটা মমতা, ভালোবাসা কেনো? নদীর রাতের অন্ধকারে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলো না।
আলিফ বসে আছে নদীর বা পাশে। নদীর ঘড়টা ঢেকে আছে চুলে। আলিফ আরো কিছুটা সরে নদীর কাছে আসার চেষ্টা করলো কিন্তু ছোট্ট রিকসার ভেতর তারা এমনিতেই অনেকটা কাছাকাছি ছিল তাই তেমন লাভ হলো না। নদীর খোলা চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। আলিফ নদীর ঘাড়টা উন্মুক্ত করে দিলো, ঘাড়ের কাছে থাকা চুলগুলো পিছনে সরিয়ে দিয়ে। তারপর সে তার অধর নামিয়ে আনলো নদীর ঘারে।
নদী কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। আলিফকে বাঁধা দিলো না। সে চোখ বন্ধ করে বসে রইলো। তার বুকের ভেতর অদ্ভুত ঝড় শুরু হয়েছে। সে ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে। তার শরীর কাপছে।
আলিফের অধর নদীর ঘাড় স্পর্শ করতেই সে সরে এলো। সে নিজেকে সংবরণ করলো। নিজের আবেগ, ইচ্ছেকে দমিয়ে রেখে সে যতটা পারে সরে এসে বসল। কিন্তু তার মন নদীকে আরো কাছাকাছি চাচ্ছে। কিন্তু সে তার মনের কথা উপেক্ষা করলো।
নদীর বিরক্ত লাগছে। কেনো লাগছে সে জানেনা। তার মন কি আরো কিছু চাচ্ছে? আলিফ এভাবে সরে যাওয়াতে তার রাগ হচ্ছে। আলিফ এমন কেনো? যখন কাছে আসা দরকার নেই, তখন কাছে আসে। আর এখন তার মন তাকে কাছে যাচ্ছে কিন্তু সে দূরে সরে যাচ্ছে। নদীর রাগ হলো। তার মুখ মলিন হয়ে উঠলো। সে আলিফকে আর কিছু বলল না। আলিফের কোনো কথার উত্তর দিলো না। এই মুহুর্তে তার প্রচন্ড রাগ লাগছে।
নদীর মুখ মলিন, নদী রাগ করেছে দেখে আলিফ হতাশ হলো। সে বলল, "আমি কি কোনো ভুল করেছি? সরি। আমি আর এমন কিছু কখনোই করবো না। এই তোমাকে ছুঁয়ে কথা দিচ্ছি।"
আলিফ নদীর হাতের উপর হাত রেখেছিল। নদী সেই হাত সড়িয়ে দিলো। আলিফের কথা শুনে তার রাগ আরো বেড়ে গেলো। আলিফ কেনো কিছু বুঝে না? নদী কিছু বলল না। সে মুখ ভাড় করে বসে রইল।
আলিফের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। সে কি কোনো ভুল করেছে? নদী এভাবে রাগ করেছে কেনো? নদীকে ওভাবে দেখে সে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। তার করণী কি? সে কয়েকবার নদীকে ডাকলেও নদী সাড়া দেয় নি। সে সরি বললেও নদী কোনো কিছু বলেনি রবং তার রাগ বেড়েছে। আলিফের হাসফাস লাগছে। নদীর হঠাৎ কি হলো? সে সবসময় ভুল করে কেনো? আলিফেরও মন খারাপ হলো। ঠিক তখন দূরের আকাশে বিদ্যুৎ চমকে উঠল।
তারা পৌঁছানোর আগেই আকাশ ভেঙে ঝুম বৃষ্টি নামল। রাতের আকাশে কতটা মেঘ জমেছিল সেটা বোঝা যায় নি, বৃষ্টি আসার আগে। রিকসাওয়ালা বৃষ্টি এলেই একটা পলিথিন বের করে তাদের দিয়েছে। সেটার দুই মাথা দুইজন ধরে আছে। কিন্তু যেমন বৃষ্টি তেমন বাতাস। পলিথিন বারবার উড়ে যাচ্ছে। বাতাসের কারণে বৃষ্টির গতিপথ ঠিক থাকছে না। অল্প-অল্প করে বৃষ্টি তাদের ভেজাচ্ছে। রিকসাওয়ালা ইতিমধ্যে ভিজে একাকার। তবুও সে ক্রমশ রিকসা টেনে যাচ্ছে। ভেজা রাস্তা দিয়ে রকেট গতির মত তাদের রিকসা ছুটে চলছে। বৃষ্টি আসার আগে রিকসার যতটা গতি ছিল, এখন তারচেয়ে দ্বিগুণ।
আলিফ আবার নদীর হাতে উপর হাত রাখলো। নদী এবার ফিরে তাকালো। তবে তার চাহনি দেখে আলিফ যা বলতে চেয়েছিল তা বলতে পারলো না। শুধু ব্যর্থ একটা চেষ্টা করলো।
নদীরা যখন পৌছালো তখন বৃষ্টির গতি সর্বোচ্চ। শহরে এতোটা বৃষ্টি শেষ কবে হয়েছে ঠিক জানা নেই। আজ মনে হয় শহর ডুবিয়ে দিবে, সেরকম লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে বৃষ্টি দেখে।
রিকসাওয়ালা অবশ্য বলল, "আপনারা চাইলে রিকসায় বসে বৃষ্টি কমে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে পারেন।"
নদী তা শুনলো না। সে নেমে গেলো বৃষ্টির মধ্যে। তারপর দৌড়ে গেট দিয়ে ঢুলে গেলো ভেতরে।
আলিফ রিকসার ভাড়া মিটিয়ে, সেও দৌড়ে চলে এলো ভেতরে। সে ভেবেছিল নদী রাগ করে তাকে কিছু না বলেই চলে যাবে বাসায়। কিন্তু নদীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে যেমন খুশি হলো, তেমন কিছুটা অবাক হলো। নদী তাহলে রাগ করে নেই। আলিফ মনে মনে ভাবলো।
দৌড়ে ভেতরে আসতে যতটা সময় লেগেছে তারা ততটুকুই ভিজেছে তারা। বলতে গেলে সামান্য।
আলিফ হেঁটে এসে নদীর পাশে দাঁড়ালো। চুলগুলোতে জমে থাকা বৃষ্টিটুকু নদী হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেলে দিচ্ছে। নদীকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। চুলগুলো সামান্য ভেজা, মুখে বিন্দু বিন্দু পানি, পরনের শাড়িটাও বৃষ্টির সেচে এখানে সেখানে ভিজে গেছে। নদী শাড়ির আচল দিয়ে হঠাৎ তার মুখটা মুঁছতে থাকল। আলিফ সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। বাইরের ঝড়ের চেয়ে তীব্র একটা ঝড় তার বুকের ভেতর শুরু হলো। সে ক্রমশ এলোমেলো হয়ে যেতে থাকলো। আলিফের চোখদুটো হঠাৎ নদীর কোমরে স্থির হয়ে রইলো। সে সবকিছু ভুলে নেশাগ্রস্ত হয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে।
আলিফ কোমরের থেকে চোখ সরিয়ে নদীর দিকে তাকাতেই দেখলো নদী তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আলিফ লজ্জিত বোধ করলো এবং সেটা তার মুখে ফুটে উঠলো। সে কিছু বলতে যাবে এই মুহুর্তে নদী সিঁড়ি বাইতে শুরু করলো। আলিফও নদীকে অনুসরণ করলো।
তারা এখন দাঁড়িয়ে আছে আলিফের বাসার দরজার সামনে। আলিফ ইতিমধ্যে একবার বিদায় নিয়েছে কিন্তু নদী কিছু বলেনি বলে সে দ্বিধায় আছে সে কলিংবেল চাপবে কি-না। নদী কি তাকে কিছু বলতে চায়? নদী চলেও যাচ্ছে না, কিছু বলছেও না। আলিফের আজ সবকিছু কেমন উল্টাপাল্টা হয়ে যাচ্ছে। সে কি ভাবছে, কি করছে, তার কিছুই ঠিক নেই।
নদী একই ভাবে আলিফকে আরও কিছুসময় কৌতুহলের মধ্যে রেখে দাঁড়িয়ে রইল। সে দেখতে চাচ্ছে আলিফ কি করে।
আলিফ যখনই কলিংবেল চাপতে যাবে ওমনি নদী তার হাত ধরে তাকে থামালো। তারপর তাকে কিছু না বলে টেনে নিয়ে গেলো ছাঁদে। দীর্ঘ নিরবতা ভেঙে নদী বলল, "চলো ভিজি।"
নদীর কথায় আলিফ প্রচন্ড শক খেলো। সে বিশ্বাস করতে পারছে না, নদী এমন কিছু তাকে বলেছে। সে কৌতুহল হয়ে বলল, "এখন ভিজবে?"
"হ্যাঁ, কেনো কোনো সমস্যা? আমার কোনো সমস্যা নেই। যদি তোমার কোনো সমস্যা থাকে তাহলে তুমি চলে যেতে পারো।" নদী কাটাকাটা শব্দে বলল।
"আমার কোনো সমস্যা নেই।"
"আচ্ছা তাহলে ফোন মানিব্যাগ এখানে রেখে চলো ছাঁদের ভেতরে যাই।"
নদী আনন্দে ভিজতে লাগল। চারদিকে একদম অন্ধকার। বিদ্যুৎ নেই বোঝাই যাচ্ছে। ঝড়বৃষ্টির কারণে বিদ্যুৎ চলে গেছে। তবুও আবছা একটা আলো চারদিকে ছড়িয়ে আছে। স্পষ্ট না দেখা গেলেও সবকিছু বোঝা যাচ্ছে। দীর্ঘ সময় অন্ধকারে থাকলে ধীরে ধীরে আন্ধকারের ঘনত্ব ক্রমশ কমতে থাকে। আন্ধকারের মধ্যেও মানুষ দেখতে পায়।
আলিফ চুপচাপ ছাঁদের এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে। নদী মনের আনন্দে ভিজছে। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে বৃষ্টিকে। বৃষ্টি ক্রমশ নদীর সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে দিচ্ছে। মাঝেমধ্যে বিদ্যুৎ চমকালে নদীকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আলিফ। এই মানুষটা এতো সুন্দর কেনো? সে মনে মনে নিজেকে প্রশ্নটা করলেও এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করলো না। সে জানে, এই প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই।
নদীর বৃষ্টি বিলাস শেষ হলে সে আলিফের পাশে এসে দাঁড়ালো। তারা দুইজন পাশাপাশি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। নদী বলল, "এভাবে পাথরের মত হয়ে আছো কেনো?"
অন্ধকারের মধ্যেও নদীর সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে, হাত নেড়ে বলা কথাটা বুঝতে সমস্যা হলো না আলিফের। কারণ এখনে অতোটাও অন্ধকার না।
আলিফকে চুপ থাকতে দেখে নদী আবার বলল, "কি হলো?"
নদী জোর করে আলিফকে টেনে নিয়ে যেতে থাকলো ছাঁদের মাঝে। কিন্তু আলিফ হঠাৎ থেমে গেলো। নদীও থেমে গেলো। তখন আলিফ নদীকে টেনে কাছে টেনে আনলো। নদীও বাধ্য মেয়ের মত চলে এলো আলিফের কাছে। তারা দুইজনই ভিজে জবজব।
নদীকে মন ভরে দেখলো আলিফ। তার ভেজা মুখমণ্ডলের মধ্যে অদ্ভুত একটা মায়া এসে জড় হয়েছে। কিছু অবাধ্য ভেজা চুল মুখে উপর জাপ্টে আছে। আলিফ হাত বাড়িয়ে সেই চুলগুলো সরিয়ে দিলো। তারপর নদীর মুখটা দুই হাত দিয়ে আলতো করে ধরলো। ভেজা চোখ দু'টো ছুঁয়ে দিলো। ভেজা ঠোঁটের উপর হাত বুলালো। তারপর নদীকে চমকে দিয়ে সে বলল, "ভালোবাসি!"
আলিফের ঠোঁট দেখেই নদী বুঝলো আলিফ কি বলেছে। সেও ঠোঁট নেড়ে ভালোবাসি বলতে চাইলো কিন্তু তার গলার ভেতর দিয়ে কোনো শব্দ বেরুলো না। তখনই তার প্রচন্ড কষ্ট হলো। সে কখনোই তার কন্ঠে আলিফকে বলতে পারবে না সেও তাকে ভালোবাসে। প্রচন্ড ভালোবাসে।
নদী কান্না করছে। তার চোখের অশ্রু আকাশের অশ্রুতে মিশে একাকার। আলিফ কি বুঝছে, সে যে কান্না করছে? কিন্তু কেনো সে কান্না করছে? তার জীবনটা অন্য পাঁচটা মানুষের মত স্বাভাবিক না, সে সেটা জানে। তবুও তার কেনো কষ্ট হয়? তার কেনো ইচ্ছে করে, সে যাকে ভালোবাসে তাকে চিৎকার করে সেই কথাটা বলতে? আলিফ যেভাবে তাকে বলেছে, সেভাবেই তাকে বলতে।
নদী বিভিন্ন এলোমেলো কথা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ আলিফের ঠোঁট সে তার ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়ে দিলো।
আলিফের একমুহূর্তের জন্য মনে হলো সে নিশ্বাস নিতে পারছে না। সে নিশ্বাস নিতে ভুলে গেছে। সে এখনই অক্সিজেনের শূন্যতায় মারা যাবে। সে সত্যি ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছে তবে সেটা অক্সিজেনের অভাবে না। ভালোবাসার অভাবে। কিংবা অন্য কিছুর অভাবে, ঠিক কিসের অভাবে এই মুহুর্তে তার জানা নেই। সে আর কিছু ভাবতে চায় না। সেও হঠাৎ তার অধর নামিয়ে আনলো নদীর ঠোঁটে।
এই অন্ধকারে, বৃষ্টির মধ্যে, তারা একে অন্যের দুঃখ শুষে নিতে লাগলো। একে অন্যকে ভালোবাসায় ডুবিয়ে দিতে থাকলো। শুধু তারা বিহীন আকাশ সেটার সাক্ষী হয়ে রইল।
অন্য কোথাও অন্য দুটি মানুষও নদী এবং আলিফের মত একে অন্যের প্রেমে ডুবে রইল। ইরিনা এবং ফাহিমও আজ ভিজছে। একে অন্যকে ভালোবাসছে।
এই একই বৃষ্টিতে অন্য কেউ তার কষ্ট লুকিয়ে ফেলতে ব্যস্ত। রুদ্র তার চোখের অশ্রু বৃষ্টিকে উপহার দিচ্ছে। কিন্তু তার সেই সামান্য লবনাক্ত চোখের পানিটুকু কি বৃষ্টি মনে রাখবে?
অন্য দিকে বেলকনি দিয়ে বৃষ্টিকে ছুঁয়ে দিচ্ছে রিয়া। সে বৃষ্টির মাধ্যমে রুদ্রকে ছুঁয়ে দিতে চাচ্ছে। এই মুহুর্তে রুদ্রকে বৃষ্টি এসে ছুঁয়ে দিলে, রুদ্র কি বুঝবে, সে তাকে ছুঁয়ে দিয়েছে? রিয়া জানেনা, তবুও সে এই আশায় বৃষ্টিকে ছুঁয়ে দিতে থাকল।
এই একই বৃষ্টিতে হাজারো মানুষের গল্প জমা হচ্ছে। প্রতিটা গল্প ভিন্ন, একটা থেকে অন্যটা আলাদা। প্রতিটা মানুষের অনুভূতি ভিন্ন এবং আলাদা। কেউ ভালোবেসে ছুঁয়ে দিচ্ছে বৃষ্টি। কেউ ভালোবাসার মানুষকে ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য ছুঁয়ে দিচ্ছে বৃষ্টি। কেউ-বা লুকাচ্ছে চোখের অশ্রু। কেউ-বা দুঃখগুলো ভেজাতে ছুঁয়ে দিচ্ছে বৃষ্টি। কেউ-বা একে অন্যকে ভালোবাসার সাগরে ডুবিয়ে দিতে ভিজছে বৃষ্টিতে।
চলবে....
নদী বসে আছে। আলিফ দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে৷ সে একজনের সাথে কথা বলছে৷ সে ফিরে এলে নদী বলল, "কে ছিলো?"
"এক বড় ভাই।"
"ওহ আচ্ছা।"
নদী আজ প্রথম আলিফের ক্যাম্পাসে এসেছে। আলিফ বহুবার অনুরোধ করার পর আজ নদী তার সাথে ক্যাম্পাসে আসতে রাজি হয়েছে।
এখন সন্ধ্যা। আলিফ অফিস শেষ করে নদীকে নিয়ে বের হয়েছিল। নদী আজ শাড়ি পরেছে। সেটাও অবশ্য আলিফের অনুরোধে।
নদী আজকাল আলিফের অনুরোধ ফেলতে পারে না৷ প্রথমে সে রাজি না হলেও একটা সময় সে আর না বলতে পারে না। আলিফের কথা রাখতে নদীর ভালো লাগলেও সে সেটা মুখে প্রকাশ করে না।
নদী আজকাল ক্রমশ আলিফের প্রতি দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। সে নিজেকে কোনো ভাবেই আঁটকাতে পারছে না। সে কখনোই চায় না আলিফের সাথে সিরিয়াস কোনো রিলেশনে যেতে। কিন্তু তার অনুভূতিগুলো সত্য। আলিফের প্রতি তার তীব্র একটা ভালো লাগা কাজ করে। এটা কি ভালোবাসা? মূলত আলিফের কেয়ারিং, তার প্রতি সততা, ভালোবাসা তাকেও ভালোবাসতে বাধ্য করছে। আলিফ এমন কেনো? নদী আর কিছু ভাবে না। সে কেবল ডুবে যায় অচেনা এক সমুদ্রের অতল গহ্বরে। সে কি এখান থেকে সাঁতরে পার হতে পারবে? কিন্তু তাকে জেগে উঠতেই হবে। যেভাবেই হোক সাঁতরে তাকে তীরে ফিরতে হবে। একই ভুল সে জীবনে দ্বিতীয়বার করতে চায় না। বরং এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি সে জানে। সবকিছু জেনেও সে ফিরতে পারছে না তীরে। কোনো এক মায়ার বাঁধনে সে আঁটকা পড়েছে।
আলিফের ভালোবাসার গভীরতা এতোটা যে কেউ চাইলেও ডুবে যাওয়া থেকে নিজেকে আঁটকে রাখতে পারে না। নদীও পারছে না। কিন্তু এটাই তাদের দুইজনকে ঠেলে দিচ্ছে অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতে।
"কি ভাবছো?"
আলিফের কথা শুনে নদী সম্বিত ফিরে পেলো। সে বলল, "তেমন কিছু না।"
"আমাকে বলবে না?"
"বললাম তো, তেমন কিছু না।"
"আমি সেটাই শুনতে চাই।" আলিফ জোর গলায় বলে।
"কি বলবো?" নদী হতাশ ভাবে বলে।
"এখন যা ভাবছো সেটাই।"
"আমাদের কথা ভাবছিলাম।" নদী আত্মসমর্পণ করে বলে।
"আমাদের কথা!" আলিফ খুশি হয়ে নদীর কথাটা রিপিট করে।
"হ্যাঁ।" নদী বলে।
"তা কি ভাবছিলে?"
"তেমন কিছু না।"
"আবার বলছ তেমন কিছু না। আমাকে বলতে না চাইলে থাক। আমার সাথে কথা বলতে হবে না।" আলিফ অভিমান করে মন খারাপের কন্ঠে বলে।
"মন খারাপ করছো কেনো?"
"মন খারাপ করবো কেনো? আমি কে? এছাড়া মন খারাপ হবে বা কেনো?"
"তুমিও না। একদম বাচ্চাদের মত জেদ করো।"
"আমি-তো বাচ্চাই। এইটুকু।" আলিফ হাত দিয়ে দেখিয়ে বলে।
"হ্যাঁ, হয়েছে। তুমি একটা শিশু।"
"তাই-তো। আচ্ছা এখন বলো কি ভাবছিলে?"
"শুনলে, তোমার মন খারাপ হবে। শুধু শুধু আজ এই সুন্দর একটা দিনে মন খারাপের কথা বলে সময়টা নষ্ট করতে চাই না।"
"আচ্ছা, তাহলে থাক। এখন বলতে হবে না। কিন্তু পরে অবশ্যই শুনবো।"
"আচ্ছা।"
"লক্ষীমেয়ে।" আলিফ মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে।
"হয়েছে, এতো নেকামো করা লাগবে না।"
"করা লাগবে না?" এই বলে আলিফ আরেকটু নদীর কাছে সরে এসে বসে।
"খবরদার, কাছে আসবে না। কাছে এলে আবার সেদিনের মত কিছু একটা করে বসবে।" নদী সামান্য সরে গিয়ে বলে।
"কি করবে?" আলিফ দুষ্টু সুরে বলে।
"সেবার ছাঁদে কি করতে গেছিলে মনে নেই?"
"কই কিছুইতো করি-নি। কিছু করার আগেই আমাকে এমন ভাবে ধাক্কা দিলে আমি...!" এটুকু বলে আলিফ থামে। সে কপালে হাত দিয়ে দেখিয়ে আবার বলে, "এই দেখো, এখনো দাগ রয়ে গেছে।"
"ভালো হয়েছে। একদম ঠিক কাজ করেছি।"
"তাই। আচ্ছা আবারও ঠিক কাজটাই করো। আমি কিছুই মনে করবো না।" এটা বলে আলিফ আবার নদীর আরো কাছে সরে আসে।
নদী এবার সরে যায় না। সে আর কিছু বলেও না। আলিফের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে, দূরে একটা পাখি বসে আছে তার দিকে তাকায়। তার এই মুহুর্তটা ভালো লাগে। জীবনের অন্ধকার কানাগলির পথ ভুলে সে এই মুহুর্তটা উপভোগ করতে থাকে। তার কাছে জীবন সুন্দর মনে হয়। জীবন আসলেই সুন্দর। হাজারও দুঃখ কষ্টের ভীড়ে এই সামান্য আনন্দ, ভালো লাগার মুহূর্তগুলোই জীবনকে সুন্দর করে তোলে। বেঁচে থাকার আশা জোগায়। কিন্তু এই ভালো থাকার মুহুর্ত ক্ষনস্থায়ী। তবুও মানুষ বাঁচে, আশায় বাঁচে। হোপ ইস অ্যা গুড থিংকস!
নদীর হাত ধরে আলিফ ক্যাম্পাসের রাস্তা ধরে হাঁটছিল। হঠাৎ ইরিনা আর ফাহিমের সাথে দেখা হয়ে গেলো তাদের।
"তোরা এখানে?" আলিফকে দেখেই ইরিনা বলল।
"নদীকে ক্যাম্পাস দেখাতে নিয়ে এলাম। তোরা এখানে?" আলিফ উত্তর দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে।
"অনেকদিন দেখা হয় না। আজ হঠাৎ ফাহিম বলল অফিস শেষে দেখা করার জন্য। তাই ক্যাম্পাসের দিকেই এলাম।"
"তারপর কি খবর তোর?"
"এইতো আছি। ব্যস্ততায় চলে যাচ্ছে। তোর কি খবর?"
"আমারও একই অবস্থা। ক্যাম্পাসের লাইফটা মিস করি ভীষণ। কতদিন যে একসাথে আড্ডা দেওয়া হয় না।"
"হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিক। আগের মত আর সচারাচর একসাথে আড্ডা দেওয়া এখন হয়ে উঠবে না। ব্যস্ত লাইফে ঢুকে গেলে আর ফ্রি সময় পাওয়া যায় না। তারপর রুদ্রের কি খবর? রুদ্রতো ভুলেই গেছে সবাইকে।"
"ও আছে ওর মত। সারাদিন ঘরেই থাকে। মাঝেমধ্যে বের হয় তাও থিসিসের কাজে। অফ ডে ছাড়া আগের মত দেখা হয় না।"
"হ্যাঁ, ওর সাথে অনেকদিন দেখা হয় না। শুক্রবারে তো সবাই ফ্রি থাকি। চল, একদিন সবাই মিলে দেখা করি, আড্ডা দেই।"
"হ্যাঁ, সেটা করা যায়। আচ্ছা, আমি রুদ্রকে বলবো। তারপর, ফাহিম তোর কি খবর?"
"সবার মতই। অফিস, কাজ, ব্যস্ততা, বসের ঝাড়ি শোনা। এইতো চলে যাচ্ছে সবকিছু।" ফাহিম বলে।
ইরিনা নদীকে লক্ষ করে বলে, "কেমন আছো নদী?" ইরিনা ইশারায় বুঝাতে চেষ্টা করলো।
আলিফ বলল, "নদী এখন আমাদের কথা বুঝতে পারে। ও এখন ঠোঁট দেখেই বুঝতে পারে আমরা কি বলি। ঠোঁট ডাবিং ল্যাঙ্গুয়েজ শিখেছে।"
"বাহ, দারুণ তো।" ইরিনা অবাক হয়ে বলে।
"আমি ভালো আছি। আপনারা কেমন আছেন?" নদী সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে বলে। নদীর বলা কথা আলিফ ট্রান্সফার করে ফাহিম এবং ইরিনাকে বলে।
"আমরা সবাই ভালো আছি।" তাদের হয়ে উত্তর দেয় ইরিনা।
"এখন কোথায় যাবি?" আলিফ বলে।
"ক্যাম্পাসে কিছুক্ষণ দু'জনে হেঁটে বাসায় চলে যাবো। তোরা?" ফাহিম বলে।
"আমরা বেশকিছু সময় হলো এসেছি।" আলিফ উত্তর দেয়।
"চল, কোথাও বসে কিছু খাই।" ইরিনা বলে।
আলিফ ভেবে বলে, "আচ্ছা চল, যাই। আবার কবে দেখা হবে কে জানে।"
তারা চারজন ক্যাম্পাসের দক্ষিণ দিকে চলে আসে। এখানে কিছু টং দোকান, ফুসকা-চটপটি ছাড়াও বেশকিছু দোকান আছে। ফাঁকা একটা টেবিল দেখে তারা বসে।
"নদী।" ইরিনা ডাকে।
নদী মাথা নেড়ে সাড়া দেয়।
"তুমি কি জানো? শাড়িতে তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগে।"
নদী মুচকি হাসে। সে বলে, "ধন্যবাদ।"
"সত্যি। তোমাকে একদম পুরনো দিনের নায়কাদের মত লাগছে। আমি ছেলে হলে তোমার প্রেমে পড়ে যেতাম।" ইরিনা হাসে।
নদীর লজ্জা লাগে। সে আর কিছু বলে না।
"আলিফ অনেক ভাগ্যবান যে তোমাকে পেয়েছে।"
আলিফ এবং নদী একে অন্যের দিকে তাকায়। আলিফ বলে, "ইরিনা, সেরকম কিছু না। আমরা ভালো বন্ধু।"
নদী মাথা নেড়ে আলিফের কথায় সম্মতি প্রকাশ করে।
"নিজেদের কেনো মিথ্যে বলছিস? তোদের চোখে একে অন্যের জন্য যে ভালোবাসা আছে সেটা কেনো মিথ্যে বলে লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছিস?"
"তুই ভুল বুঝতাছিস।" আলিফ বলে।
"আমাকে আর বুঝাতে হবে না। আমি সবটা নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি। শোন...!" ইরিনা এটুকু বলে থামে। সে আবার নদীকে উদ্দেশ্য করে বলে, "শোনো, আমি জানি তোমরা একে অন্যকে ভালোবাসো। কিন্তু তোমাদের মধ্যে কি হয়েছে কিংবা কি সমস্যা সেটা আমি জানিনা। আমি জানতেও চাচ্ছি না। কিন্তু শুধু এটুকুই বলতে পারি, আলিফের মত করে তোমাকে কেউ ভালোবাসতে পারবে না। এই ভালোবাসাটা উপেক্ষা করো না। হেলায় হারিয়ে ফেলো না। এছাড়াও আমি জানি, তুমিও আলিফকে ভালোবাসো।"
নদী মনোযোগ দিয়ে ইরিনার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে থাকে। আলিফও মনোযোগ দিয়ে ইরিনার কথাগুলো শুনে। তারা কেউ কথা বলে না। দুই-একবার একে অন্যের মুখের দিকে তাকায়। কিন্তু পরক্ষণেই লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নেয়।
ইরিনা এবং ফাহিমকে বিদায় করে দিয়ে নদী এবং আলিফ আরও কিছুক্ষণ হাঁটলো। তারা নানা কথা বললেও ইরিনার বলা কথাগুলো উঠালো না। সেই বিষয়ে কেউ কাউকে কিছুই বলল না। তবুও তারা একে অন্যের মনের কথা, অনুভূতি, ভালোবাসা বুঝে নিলো রাতের ল্যাম্পপোস্টের নিয়নের আলোয়। কোনো একটা পাখি তার কন্ঠে সুর তুলে তাদের কথা একে অন্যকে বলে দিলো। এভাবে তারা একে অন্যের আরও কিছুটা কাছে চলে এলো, নিজেদের অজান্তেই। ভালোবাসা এমনই। ভালোবাসা এলে আমরা সেটাকে শত চেষ্টা করেও উপেক্ষা করতে পারি না। শুধু ভালোবাসার গভীরে ডুবে যেতে থাকি।
নদী রিকসায় বসে আছে। তার পাশে আলিফ। রিকসার হুট তোলা। বাইরে অন্ধকার। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলো আর ছুটে চলে গাড়ির হেডলাইটের আলো ছাড়া অন্ধকারই।
নদীর মুখের সামনে কিছু চুল উড়ে এলো বাতাসে। আলিফ সেদিকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে লক্ষ করলো। সে হঠাৎ হাত বাড়িয়ে চুলগুলো নদীর কানে কাছে গুজে দিলো। নদী আলিফের দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে পড়লো। কিন্তু সে কিছু বলল না। তার অবশ্য ভালো লাগলো। বুকের মধ্যে হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে উঠলেও সে সেটা ভাল ভাবে নিয়ন্ত্রণ করল। কিন্তু বাতাস আবারও চুলগুলো উড়িয়ে এনে মুখের উপর ফেলল। আলিফ এবারও আলতো করে চুলগুলো ছুঁয়ে সরিয়ে দিলো। এবার সে আগের মত দ্রুত হাত সরিয়ে নিলো না।
নদী তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। লজ্জায় আলিফের দিকে তাকাতে পারছে না। আলিফের স্পর্শে এতোটা মমতা, ভালোবাসা কেনো? নদীর রাতের অন্ধকারে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলো না।
আলিফ বসে আছে নদীর বা পাশে। নদীর ঘড়টা ঢেকে আছে চুলে। আলিফ আরো কিছুটা সরে নদীর কাছে আসার চেষ্টা করলো কিন্তু ছোট্ট রিকসার ভেতর তারা এমনিতেই অনেকটা কাছাকাছি ছিল তাই তেমন লাভ হলো না। নদীর খোলা চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। আলিফ নদীর ঘাড়টা উন্মুক্ত করে দিলো, ঘাড়ের কাছে থাকা চুলগুলো পিছনে সরিয়ে দিয়ে। তারপর সে তার অধর নামিয়ে আনলো নদীর ঘারে।
নদী কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। আলিফকে বাঁধা দিলো না। সে চোখ বন্ধ করে বসে রইলো। তার বুকের ভেতর অদ্ভুত ঝড় শুরু হয়েছে। সে ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে। তার শরীর কাপছে।
আলিফের অধর নদীর ঘাড় স্পর্শ করতেই সে সরে এলো। সে নিজেকে সংবরণ করলো। নিজের আবেগ, ইচ্ছেকে দমিয়ে রেখে সে যতটা পারে সরে এসে বসল। কিন্তু তার মন নদীকে আরো কাছাকাছি চাচ্ছে। কিন্তু সে তার মনের কথা উপেক্ষা করলো।
নদীর বিরক্ত লাগছে। কেনো লাগছে সে জানেনা। তার মন কি আরো কিছু চাচ্ছে? আলিফ এভাবে সরে যাওয়াতে তার রাগ হচ্ছে। আলিফ এমন কেনো? যখন কাছে আসা দরকার নেই, তখন কাছে আসে। আর এখন তার মন তাকে কাছে যাচ্ছে কিন্তু সে দূরে সরে যাচ্ছে। নদীর রাগ হলো। তার মুখ মলিন হয়ে উঠলো। সে আলিফকে আর কিছু বলল না। আলিফের কোনো কথার উত্তর দিলো না। এই মুহুর্তে তার প্রচন্ড রাগ লাগছে।
নদীর মুখ মলিন, নদী রাগ করেছে দেখে আলিফ হতাশ হলো। সে বলল, "আমি কি কোনো ভুল করেছি? সরি। আমি আর এমন কিছু কখনোই করবো না। এই তোমাকে ছুঁয়ে কথা দিচ্ছি।"
আলিফ নদীর হাতের উপর হাত রেখেছিল। নদী সেই হাত সড়িয়ে দিলো। আলিফের কথা শুনে তার রাগ আরো বেড়ে গেলো। আলিফ কেনো কিছু বুঝে না? নদী কিছু বলল না। সে মুখ ভাড় করে বসে রইল।
আলিফের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। সে কি কোনো ভুল করেছে? নদী এভাবে রাগ করেছে কেনো? নদীকে ওভাবে দেখে সে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। তার করণী কি? সে কয়েকবার নদীকে ডাকলেও নদী সাড়া দেয় নি। সে সরি বললেও নদী কোনো কিছু বলেনি রবং তার রাগ বেড়েছে। আলিফের হাসফাস লাগছে। নদীর হঠাৎ কি হলো? সে সবসময় ভুল করে কেনো? আলিফেরও মন খারাপ হলো। ঠিক তখন দূরের আকাশে বিদ্যুৎ চমকে উঠল।
তারা পৌঁছানোর আগেই আকাশ ভেঙে ঝুম বৃষ্টি নামল। রাতের আকাশে কতটা মেঘ জমেছিল সেটা বোঝা যায় নি, বৃষ্টি আসার আগে। রিকসাওয়ালা বৃষ্টি এলেই একটা পলিথিন বের করে তাদের দিয়েছে। সেটার দুই মাথা দুইজন ধরে আছে। কিন্তু যেমন বৃষ্টি তেমন বাতাস। পলিথিন বারবার উড়ে যাচ্ছে। বাতাসের কারণে বৃষ্টির গতিপথ ঠিক থাকছে না। অল্প-অল্প করে বৃষ্টি তাদের ভেজাচ্ছে। রিকসাওয়ালা ইতিমধ্যে ভিজে একাকার। তবুও সে ক্রমশ রিকসা টেনে যাচ্ছে। ভেজা রাস্তা দিয়ে রকেট গতির মত তাদের রিকসা ছুটে চলছে। বৃষ্টি আসার আগে রিকসার যতটা গতি ছিল, এখন তারচেয়ে দ্বিগুণ।
আলিফ আবার নদীর হাতে উপর হাত রাখলো। নদী এবার ফিরে তাকালো। তবে তার চাহনি দেখে আলিফ যা বলতে চেয়েছিল তা বলতে পারলো না। শুধু ব্যর্থ একটা চেষ্টা করলো।
নদীরা যখন পৌছালো তখন বৃষ্টির গতি সর্বোচ্চ। শহরে এতোটা বৃষ্টি শেষ কবে হয়েছে ঠিক জানা নেই। আজ মনে হয় শহর ডুবিয়ে দিবে, সেরকম লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে বৃষ্টি দেখে।
রিকসাওয়ালা অবশ্য বলল, "আপনারা চাইলে রিকসায় বসে বৃষ্টি কমে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে পারেন।"
নদী তা শুনলো না। সে নেমে গেলো বৃষ্টির মধ্যে। তারপর দৌড়ে গেট দিয়ে ঢুলে গেলো ভেতরে।
আলিফ রিকসার ভাড়া মিটিয়ে, সেও দৌড়ে চলে এলো ভেতরে। সে ভেবেছিল নদী রাগ করে তাকে কিছু না বলেই চলে যাবে বাসায়। কিন্তু নদীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে যেমন খুশি হলো, তেমন কিছুটা অবাক হলো। নদী তাহলে রাগ করে নেই। আলিফ মনে মনে ভাবলো।
দৌড়ে ভেতরে আসতে যতটা সময় লেগেছে তারা ততটুকুই ভিজেছে তারা। বলতে গেলে সামান্য।
আলিফ হেঁটে এসে নদীর পাশে দাঁড়ালো। চুলগুলোতে জমে থাকা বৃষ্টিটুকু নদী হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেলে দিচ্ছে। নদীকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। চুলগুলো সামান্য ভেজা, মুখে বিন্দু বিন্দু পানি, পরনের শাড়িটাও বৃষ্টির সেচে এখানে সেখানে ভিজে গেছে। নদী শাড়ির আচল দিয়ে হঠাৎ তার মুখটা মুঁছতে থাকল। আলিফ সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। বাইরের ঝড়ের চেয়ে তীব্র একটা ঝড় তার বুকের ভেতর শুরু হলো। সে ক্রমশ এলোমেলো হয়ে যেতে থাকলো। আলিফের চোখদুটো হঠাৎ নদীর কোমরে স্থির হয়ে রইলো। সে সবকিছু ভুলে নেশাগ্রস্ত হয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে।
আলিফ কোমরের থেকে চোখ সরিয়ে নদীর দিকে তাকাতেই দেখলো নদী তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আলিফ লজ্জিত বোধ করলো এবং সেটা তার মুখে ফুটে উঠলো। সে কিছু বলতে যাবে এই মুহুর্তে নদী সিঁড়ি বাইতে শুরু করলো। আলিফও নদীকে অনুসরণ করলো।
তারা এখন দাঁড়িয়ে আছে আলিফের বাসার দরজার সামনে। আলিফ ইতিমধ্যে একবার বিদায় নিয়েছে কিন্তু নদী কিছু বলেনি বলে সে দ্বিধায় আছে সে কলিংবেল চাপবে কি-না। নদী কি তাকে কিছু বলতে চায়? নদী চলেও যাচ্ছে না, কিছু বলছেও না। আলিফের আজ সবকিছু কেমন উল্টাপাল্টা হয়ে যাচ্ছে। সে কি ভাবছে, কি করছে, তার কিছুই ঠিক নেই।
নদী একই ভাবে আলিফকে আরও কিছুসময় কৌতুহলের মধ্যে রেখে দাঁড়িয়ে রইল। সে দেখতে চাচ্ছে আলিফ কি করে।
আলিফ যখনই কলিংবেল চাপতে যাবে ওমনি নদী তার হাত ধরে তাকে থামালো। তারপর তাকে কিছু না বলে টেনে নিয়ে গেলো ছাঁদে। দীর্ঘ নিরবতা ভেঙে নদী বলল, "চলো ভিজি।"
নদীর কথায় আলিফ প্রচন্ড শক খেলো। সে বিশ্বাস করতে পারছে না, নদী এমন কিছু তাকে বলেছে। সে কৌতুহল হয়ে বলল, "এখন ভিজবে?"
"হ্যাঁ, কেনো কোনো সমস্যা? আমার কোনো সমস্যা নেই। যদি তোমার কোনো সমস্যা থাকে তাহলে তুমি চলে যেতে পারো।" নদী কাটাকাটা শব্দে বলল।
"আমার কোনো সমস্যা নেই।"
"আচ্ছা তাহলে ফোন মানিব্যাগ এখানে রেখে চলো ছাঁদের ভেতরে যাই।"
নদী আনন্দে ভিজতে লাগল। চারদিকে একদম অন্ধকার। বিদ্যুৎ নেই বোঝাই যাচ্ছে। ঝড়বৃষ্টির কারণে বিদ্যুৎ চলে গেছে। তবুও আবছা একটা আলো চারদিকে ছড়িয়ে আছে। স্পষ্ট না দেখা গেলেও সবকিছু বোঝা যাচ্ছে। দীর্ঘ সময় অন্ধকারে থাকলে ধীরে ধীরে আন্ধকারের ঘনত্ব ক্রমশ কমতে থাকে। আন্ধকারের মধ্যেও মানুষ দেখতে পায়।
আলিফ চুপচাপ ছাঁদের এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে। নদী মনের আনন্দে ভিজছে। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে বৃষ্টিকে। বৃষ্টি ক্রমশ নদীর সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে দিচ্ছে। মাঝেমধ্যে বিদ্যুৎ চমকালে নদীকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আলিফ। এই মানুষটা এতো সুন্দর কেনো? সে মনে মনে নিজেকে প্রশ্নটা করলেও এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করলো না। সে জানে, এই প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই।
নদীর বৃষ্টি বিলাস শেষ হলে সে আলিফের পাশে এসে দাঁড়ালো। তারা দুইজন পাশাপাশি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। নদী বলল, "এভাবে পাথরের মত হয়ে আছো কেনো?"
অন্ধকারের মধ্যেও নদীর সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে, হাত নেড়ে বলা কথাটা বুঝতে সমস্যা হলো না আলিফের। কারণ এখনে অতোটাও অন্ধকার না।
আলিফকে চুপ থাকতে দেখে নদী আবার বলল, "কি হলো?"
নদী জোর করে আলিফকে টেনে নিয়ে যেতে থাকলো ছাঁদের মাঝে। কিন্তু আলিফ হঠাৎ থেমে গেলো। নদীও থেমে গেলো। তখন আলিফ নদীকে টেনে কাছে টেনে আনলো। নদীও বাধ্য মেয়ের মত চলে এলো আলিফের কাছে। তারা দুইজনই ভিজে জবজব।
নদীকে মন ভরে দেখলো আলিফ। তার ভেজা মুখমণ্ডলের মধ্যে অদ্ভুত একটা মায়া এসে জড় হয়েছে। কিছু অবাধ্য ভেজা চুল মুখে উপর জাপ্টে আছে। আলিফ হাত বাড়িয়ে সেই চুলগুলো সরিয়ে দিলো। তারপর নদীর মুখটা দুই হাত দিয়ে আলতো করে ধরলো। ভেজা চোখ দু'টো ছুঁয়ে দিলো। ভেজা ঠোঁটের উপর হাত বুলালো। তারপর নদীকে চমকে দিয়ে সে বলল, "ভালোবাসি!"
আলিফের ঠোঁট দেখেই নদী বুঝলো আলিফ কি বলেছে। সেও ঠোঁট নেড়ে ভালোবাসি বলতে চাইলো কিন্তু তার গলার ভেতর দিয়ে কোনো শব্দ বেরুলো না। তখনই তার প্রচন্ড কষ্ট হলো। সে কখনোই তার কন্ঠে আলিফকে বলতে পারবে না সেও তাকে ভালোবাসে। প্রচন্ড ভালোবাসে।
নদী কান্না করছে। তার চোখের অশ্রু আকাশের অশ্রুতে মিশে একাকার। আলিফ কি বুঝছে, সে যে কান্না করছে? কিন্তু কেনো সে কান্না করছে? তার জীবনটা অন্য পাঁচটা মানুষের মত স্বাভাবিক না, সে সেটা জানে। তবুও তার কেনো কষ্ট হয়? তার কেনো ইচ্ছে করে, সে যাকে ভালোবাসে তাকে চিৎকার করে সেই কথাটা বলতে? আলিফ যেভাবে তাকে বলেছে, সেভাবেই তাকে বলতে।
নদী বিভিন্ন এলোমেলো কথা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ আলিফের ঠোঁট সে তার ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়ে দিলো।
আলিফের একমুহূর্তের জন্য মনে হলো সে নিশ্বাস নিতে পারছে না। সে নিশ্বাস নিতে ভুলে গেছে। সে এখনই অক্সিজেনের শূন্যতায় মারা যাবে। সে সত্যি ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছে তবে সেটা অক্সিজেনের অভাবে না। ভালোবাসার অভাবে। কিংবা অন্য কিছুর অভাবে, ঠিক কিসের অভাবে এই মুহুর্তে তার জানা নেই। সে আর কিছু ভাবতে চায় না। সেও হঠাৎ তার অধর নামিয়ে আনলো নদীর ঠোঁটে।
এই অন্ধকারে, বৃষ্টির মধ্যে, তারা একে অন্যের দুঃখ শুষে নিতে লাগলো। একে অন্যকে ভালোবাসায় ডুবিয়ে দিতে থাকলো। শুধু তারা বিহীন আকাশ সেটার সাক্ষী হয়ে রইল।
অন্য কোথাও অন্য দুটি মানুষও নদী এবং আলিফের মত একে অন্যের প্রেমে ডুবে রইল। ইরিনা এবং ফাহিমও আজ ভিজছে। একে অন্যকে ভালোবাসছে।
এই একই বৃষ্টিতে অন্য কেউ তার কষ্ট লুকিয়ে ফেলতে ব্যস্ত। রুদ্র তার চোখের অশ্রু বৃষ্টিকে উপহার দিচ্ছে। কিন্তু তার সেই সামান্য লবনাক্ত চোখের পানিটুকু কি বৃষ্টি মনে রাখবে?
অন্য দিকে বেলকনি দিয়ে বৃষ্টিকে ছুঁয়ে দিচ্ছে রিয়া। সে বৃষ্টির মাধ্যমে রুদ্রকে ছুঁয়ে দিতে চাচ্ছে। এই মুহুর্তে রুদ্রকে বৃষ্টি এসে ছুঁয়ে দিলে, রুদ্র কি বুঝবে, সে তাকে ছুঁয়ে দিয়েছে? রিয়া জানেনা, তবুও সে এই আশায় বৃষ্টিকে ছুঁয়ে দিতে থাকল।
এই একই বৃষ্টিতে হাজারো মানুষের গল্প জমা হচ্ছে। প্রতিটা গল্প ভিন্ন, একটা থেকে অন্যটা আলাদা। প্রতিটা মানুষের অনুভূতি ভিন্ন এবং আলাদা। কেউ ভালোবেসে ছুঁয়ে দিচ্ছে বৃষ্টি। কেউ ভালোবাসার মানুষকে ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য ছুঁয়ে দিচ্ছে বৃষ্টি। কেউ-বা লুকাচ্ছে চোখের অশ্রু। কেউ-বা দুঃখগুলো ভেজাতে ছুঁয়ে দিচ্ছে বৃষ্টি। কেউ-বা একে অন্যকে ভালোবাসার সাগরে ডুবিয়ে দিতে ভিজছে বৃষ্টিতে।
চলবে....
===========================
পড়তে থাকুন চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।
Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.
( Post By- Kam Pagol)