Thread Rating:
  • 15 Vote(s) - 3.33 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
আমি পদ্ম
#3
৬.

শুটিং দলের একজনও বাড়িতে নেই। সবাই কলেজে মাঠে গিয়েছে। কয়দিন ধরে নদীর ঘাটে যেতে না পেরে তৃষ্ণার্থ হয়ে উঠেছে পদ্মজা। এই সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। হেমলতার অনুমতি নিয়ে সে ঘাটে চলে আসল। ঘাটের সিঁড়িতে বসল। কয়েক সেকেন্ড পর টের পেল, গান বাজছে কোথাও। গানের সুর অনুসরণ করে কয়টা সিঁড়ি নেমে আসে। ঘাটের বাম পাশে বাঁধা নৌকায় একজন পুরুষ বসে আছে। হাতে রেডিও। গানের উৎস তাহলে এখানেই। পদ্মজা বিব্রতবোধ করল। উল্টো দিকে ঘুরে ব্যস্ত পায়ে লাহাড়ি ঘরে চলে আসে। পদ্মজা এতো দ্রুত ফিরাতে হেমলতা প্রশ্ন করেন, ‘কেউ ছিল?’

পদ্মজা মাথা নাড়াল। হেমলতা চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, ‘কিছু বলেছে? দেখতে কেমন?’

‘ না আম্মা, কিছু বলেনি। আমাকে দেখেনি। মাথার চুল ঝাঁকড়া। মুখ খেয়াল করিনি।’

‘এইটাই তো লিখন শাহ। নায়ক।’

পূর্ণা পুলকিত হয়ে বলল। হেমলতা আর কিছু বললেন না।

পূর্ণা সারাক্ষণ শুটিং দলটার আশেপাশে ঘুরঘুর করে। হেমলতা বিরক্ত হয়ে পূর্ণাকে কড়া নিষেধ দিয়েছেন, আর না যেতে। যদি যায় মার একটাও মাটিতে পড়বে না। পূর্ণা ভয় পেয়েছে। কিন্তু লিখন শাহ আর চিত্রা দেবী জুটিটা এতো ভাল লাগে তার যে শুটিং না দেখলে দম বন্ধ লাগে। তাই সে চুপিসারে টিনে একটা ছিদ্র করেছে। হেমলতা সেলাই মেশিন লাহাড়ি ঘরের পিছন বারান্দায় রেখেছেন। সারাক্ষণ সেখানেই থাকেন। সে সেময় পূর্ণা ছিদ্র দিয়ে উঁকি দেয়। শুটিং দেখে। পূর্ণাকে সবসময় দেখতে দেখে পদ্মজার আগ্রহ জাগল। সে উঁকি দিল। ঝাকড়া চুলের মানুষটা একজন অতি সুন্দরী মেয়েকে কোলে তুলে নিয়েছে। দৃষ্টি মোহময়। প্রেমময় গানের সুরধ্বনি বাড়ি জুড়ে। ক্যামেরা ধরে রেখেছেন কেউ কেউ। গানের শুটিং বোধহয়! পদ্মজা অদ্ভুত অনুভূতি অনুভব করল। লজ্জা পেল। চোখ সরিয়ে নিল।

রাতে ঝড় এসেছিল। লাহাড়ি ঘরের পিছনে তৈরি পথ বন্ধ হয়ে গেছে গাছের ভাঙা ডালপালা দিয়ে। মোর্শেদ রাতে বাড়ি ফেরেননি। হেমলতার একার পক্ষে সম্ভব নয় পথ খালি করার। তাই পদ্মজা, পূর্ণা কলেজ থেকে বাড়ির সামনে দিয়ে ফিরছিল। উঠোনে শুটিং দলের সবাই ছিল। পদ্মজা মাথা নত হয়ে থেমে থেমে কাঁপতে থাকে। পথ শেষই হচ্ছে না। মাথায় ঘোমটা টানা। অনেকের নজরে পদ্মজা চলে আসল। মিলন নামে একজন পূর্ণাকে ডাকল, 

‘এই পূর্ণা?’

পূর্ণা দাঁড়াল, সাথে পদ্মজা। পদ্মজা শুটিং দলটার দিকে তাকাচ্ছে না। মিলন পদ্মজার দিকে চোখ স্থির রেখে পূর্ণাকে প্রশ্ন করল, 

‘পাশের মেয়েটা কে? প্রথম দেখছি।’

‘আমার বড় আপা।’

‘আপন?’

মিলন ভারী আশ্চর্য হয়ে বলল। দশ দিন হলো এখানে আসার। কখনো পূর্ণা,প্রেমা ছাড়া কোনো মেয়েকে চোখে পড়ল না। কণ্ঠও শোনা যায়নি। তাই বড় বোন বলাতে সে খুব অবাক হলো। পূর্ণা হেসে বলল, 

‘হুম। আপন।’

মিলন বিড়বিড় করে বলল, 

‘চেহারার তো মিল নেই।’

‘সবাই বলে।’

‘আচ্ছা,যাও।’

দু’বোন লাহাড়ি ঘরে চলে আসল। পদ্মজা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ভেতরটা এতো কাঁপছিল। অনেক মানুষের পা দেখেছে, চোখ তুলে মানুষগুলোর মুখ দেখার সাহস হয়নি। তবে, ইচ্ছে হয়েছিল চোখ তুলে তাকাতে!

বিকেলে হাজেরা আসল। সবুর মিয়ার স্ত্রী। সবুর দিনরাত গাঁজা খেয়ে পড়ে থাকে। বউ – বাচ্চাদের খোঁজ রাখে না। হাজেরা এর বাড়ি ওর বাড়ি এটা-ওটা চেয়ে নেয়। এরপর দুই বাচ্চা নিয়ে খায়। পদ্মজার খুব মায়া হয় হাজেরার প্রতি। হাজেরা আসতেই হেমলতা পদ্মজার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, ‘লাউ গাছে কয়টা লাউ দেখেছিস?’

‘নয়টা আম্মা।’

‘পূর্ণা কই? ওরে বল দুইটা লাউ হাজেরাকে দিয়ে দিতে। কাঁচামরিচও দিতে বলবি।’

পদ্মজার মুখে কালো আঁধার নেমে আসে। হেমলতা পদ্মজার মুখ দেখে বুঝতে পারেন, পূর্ণা বাড়িতে নেই।

‘টিভি দেখতে গেছে তাই না?’

পদ্মজাকে দ্বিধাগ্রস্ত হতে দেখা গেল। বিব্রতভাবে বলল,

‘আম্মা, আমাকে ব..বলে গেছে।’

‘তুই ওর অভিভাবক? একটু শরীরটা খারাপ লাগছে বলে শুয়েছি। ওমনি সুযোগ লুটে নিছে! ‘

‘আম্মা, আমার দোষ। পূর্ণারে কিছু বলো না।’

পদ্মজার ভেজা কণ্ঠ হেমলতার রাগ উড়িয়ে দিল। তিনি অন্য দিকে মুখ করে শুয়ে বললেন, 

‘হাজেরারে নিয়ে যা। ঘোমটা টেনে যাবি। বেগুন বেশি হলে, কয়টা দিয়ে দিস।’

পদ্মজার মন ভরে গেল। তার মা এতো বেশি উদার! কখনো কাউকে ফিরিয়ে দেন না। সামর্থ্যের মধ্যে আরো বেশি কিছু দেওয়ার মতো থাকলে, তিনি কার্পণ্য করেন না। তবে, হাজেরার স্বভাব অভাবে নষ্ট হয়েছে। চুরি করার প্রবণতা আছে। তাই পদ্মজাকে যেতে বললেন।

উঠোনের এক কোণে এবং লাহাড়ি ঘরের ডান পাশে লাউয়ের মাচা। নয়টা লাউ ঝুলে রয়েছে। তরতাজা টাটকা সবুজ পাতা নজর কাড়ে। পদ্মজা বাড়ির দিকে তাকাল না। একটা লাউ হাজেরার হাতে দিয়ে বলল,

'কি দিয়ে রাঁধবা?’

‘জানি না গো পদ্ম। গিয়া দেহি মাছ মিলানি যায়নি।’

‘তোমার ছেলেটার ঠান্ডা কমছে?’

পদ্মজা কাঁচামরিচ ছিঁড়ে হাজেরার আঁচল ভরে দিল। হাজেরা গুনগুন করে কাঁদছে আর বলছে, 

‘ছেড়াডা সারাদিন মাডিত পইড়া থাহে একলা একলা। রাইত হইলে জ্বরে কাঁপে। দম ফালায়তে পারে না।’

‘ডাক্তার দেখাচ্ছ না কেন?’

‘টেহা লাগব না? কই পামু?’

‘তুমি,মাতব্বর বাড়িতে যেও। শুনছি, উনারা খুব দান-খয়রাত করেন।’

হাজেরা বাধ্যের মতো মাথা নাড়াল। বেগুন গাছ বাড়ির পিছনে। পদ্মজা বাড়ির পিছনে সাবধানে আসল। মনে মনে ভাবছে, হাজেরার ছেলে সুস্থই আছে। সকালে সে দেখেছে। হাজেরা মিথ্যা বলছে৷ মানুষের খুব অভাব পড়লে বুঝি এমনই হয়?

‘এতো সবজি আছে। টমেটো নেই? পাওয়া যাবে?’

পরিষ্কার সহজ গলায় বলা পুরুষালী কণ্ঠটি পদ্মজাকে মৃদু কাঁপিয়ে তুলল। ঘুরে তাকাল। লিখনকে দেখে বিব্রত বোধ করল। কারো সামনে নিজের অস্বস্তি প্রকাশ করা উচিত না। কথাটি হেমলতা বলেছেন। পদ্মজা হাসার চেষ্টা করল। জবাব দিল, 

‘এই বর্ষাকালে টমেটো কোথায় পাবেন?’

‘বর্ষাকালে টমেটো চাষ হয় না?’

‘টমেটো শীতকালীন ফসল।’

‘গ্রীষ্ম,বর্ষাতেও তো পাওয়া যায়।’

পদ্মজা অস্বস্তি লুকিয়ে রাখতে পারছে না। কলেজের শিক্ষক আর খুব আপন মানুষগুলো ছাড়া কোনো পর-পুরুষের সাথে তার কখনো কথা হয়নি। লিখনের সাথে কথা বলতে গিয়ে তার জবান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সে চুপচাপ বেগুন বুঝিয়ে দিল হাজেরাকে। লিখন বলল,

‘আমি তো গতবার বর্ষাকালে টমেটোর সালাদ তৈরি করেছি।’

‘হয়তো টমেটোর জাত আলাদা ছিল। সাধারণত আমাদের শীতকালেই টমেটো হয়।’

কথা শেষ করে দ্রুত লাহাড়ি ঘরে ফিরল সে। মনে হচ্ছে পর-পুরুষের সাথে কথা বলে ঘোর পাপ হয়ে গেছে।পাপ মোচন করতে হবে। ঘরে ঢুকে ঢকঢক করে দুই গ্লাস পানি খেল। হেমলতা ঘুমাচ্ছেন। নয়তো পদ্মজার মুখ দেখে নির্ঘাত বুঝে যেতেন, কিছু একটা ঘটেছে। পদ্মজা ভক্তি নিয়ে আল্লাহ তায়া’লার প্রতি শুকরিয়া আদায় করল।

হেমলতা সালোয়ার-কামিজ সেলাই করছিলেন। তখন বারান্দার সামনে একজন পুরুষ লোক এসে দাঁড়াল।

হেমলতা শাড়ির আঁচল মাথায় টেনে নেন। জিজ্ঞাসুকদৃষ্টি নিয়ে তাকান। লোকটি হেসে বলল, 

‘আমি মিলন। শুটিং দলের। ‘

হেমলতা জোরপূর্বক হাসেন। আড়চোখে ঘরের দরজার দিকে তাকান। পদ্মজা ঘুমাচ্ছে।দরজাটা লাগানো উচিত।

‘কোনো দরকার?’

‘না,এমনি। দেখতে আসলাম। কতদিন হলো আপনাদের বাড়িতে উঠলাম। আর, এদিকটায়ই আসা হয়নি।’

হেমলতা প্যাঁচিয়ে কথা বলা পছন্দ করেন না। সরাসরি বলে উঠলেন, 

‘এদিকে আসা নিষেধ। আপনাদের বলা হয়নি?’

মিলনের চোখেমুখে ছায়া নেমে আসে। সে অপমান বোধ করল। আমতা আমতা করে বলল, 

‘ইয়ে…আচ্ছা, আসছি।’

মিলন স্থান ত্যাগ করল। যাওয়ার পূর্বের তার তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি হেমলতার নজর এড়াতে পারল না। হেমলতা চোখ বুজে জীবনের হিসেব কষেন। এরপর ঘুমন্ত পদ্মজার দিকে তাকান। পূর্ণার চেয়ে পদ্মজার বেশি আগ্রহ শুটিং দেখায়। টিনের ছিদ্র আরো দু’টো করেছে। লিখন শাহকে দেখলে তাঁর মায়াময়, কোমল অনুভূতি হয়। এই অনুভূতির নাম সে জানে না। শুটিংয়ে লিখন শাহ কত ভালোবাসেন চিত্রা দেবীকে। পদ্মজার দেখতে খুব ভাল লাগে। পূর্ণা তেলের বোতল নিয়ে বলল, 

‘আপা, তেল দিয়ে দাও না।’

‘সোনা বোন, একটু দাঁড়া।’

পদ্মজা ছিদ্র দিয়ে লিখন শাহর হাসি, কথা বলার ভঙ্গী দেখছে। লজ্জাও পাচ্ছে খুব। সময়টাকে থামিয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে।

‘এই,আপা। পরেও তো দেখতে পারবা। দিয়ে দাও না।’

‘আরেকটু। শুটিং শুরু হচ্ছে। একটু…”

পূর্ণার বিরক্তিতে রাগ হয় খুব। কিন্তু সে তার আপাকে কিছু বলবে না। তার সব ইচ্ছের সঙ্গী, সব গোপন কথার স্বাক্ষী তার আপা। সে তার আপাকে খুব ভালোবাসে। মাঝে মাঝে মনে হয়, মায়ের চেয়েও বেশি বোধহয় সে তার আপাকেই ভালোবাসে। বা হয়তো না। পদ্মজা মিটিমিটি হাসছে। পূর্ণা তেল রেখে ছিদ্র দিয়ে উঁকি দিল। নাহ! তাঁর এখন ভাল লাগছে না এসব দেখতে। চোখ সরিয়ে নিল।

‘কিরে পদ্ম? কী দেখছিস?’

হেমলতার কন্ঠ শুনে পদ্মজা চমকে উঠল। আরক্ত হয়ে উঠল। ডাকাতি করতে গিয়ে বাড়ির মালিকের কাছে ধরা পড়লে যেমন অনুভূতি হয় তেমন অনুভূতি হচ্ছে পদ্মজার। বা আরো ভয়ংকর অনুভূতি। হেমলতার দৃষ্টি টিনের ছিদ্রে গেল। সাথে সাথে পদ্মজা অনুভব করল, তাঁর পায়ের নিচের মাটি কাঁপছে৷ পূর্ণা ভয়ার্ত চোখে একবার মাকে একবার বোনকে দেখছে। ছিদ্রের গুরু তো সে!

৭.
হেমলতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে দুই মেয়েকে দেখেন। তিনটা ছিদ্র দেখেন। এরপর দৃষ্টি শীতল করে বললেন, 
'শুটিং দেখছিলি?'
পদ্মজা বাধ্যের মতো মাথা ঝাঁকাল। হেমলতার রাগ হলো না। তিনি চৌকিতে বসে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
'ছিদ্রের বুদ্ধি পূর্ণার?' 
প্রশ্নটা শুনে পূর্ণার গলা শুকিয়ে আসল। এক ফোঁটা পানি দরকার। নয়তো দম বেরিয়ে যাবে। পদ্মজা চকিতে চোখ তুলে তাকাল। অসহায় কণ্ঠে বলল, 
'আম্মা, আর হবে না। পূর্ণাকে কিছু বলো না। ওর দোষ নাই,আমি... 
হেমলতা পদ্মজাকে কথা শেষ করতে দিলেন না। প্রেমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, 
'প্রেমা, তোর আব্বা কই?'
'উঠানে।'
'গিয়ে বল,আমি ডাকছি।'
প্রেমা ছুটে গেল। আবার ছুটে আসল। হেমলতা বারান্দা পার হয়ে চুলার দিকে এগোলেন। তখন মোর্শের আসলেন।
'কি হইছে? ডাক কেরে?'
'লাহাড়ি ঘরে একটা জানালা করে দাও। মেয়েদের চৌকির পাশে। কাঠ আছে মুরগির খোপের কাছে। '
'কী জন্যে?'
'আমি চাইছি, তাই। না পারলে বল। অন্য কাউকে ডাকব।'
'ত্যাড়া কথা কওন ছাড়।'
'আমার তোমার সাথে ভালো করে কথা বলতে ভালো লাগে না।'
'লাগব কেরে? তোমার তো আমারে পছন্দ না। তোমার পছন্দ বিলাই চোখা ব্যাঠা ছেড়ারে।'
'অহেতুক কথা বল না। মাসের পর মাস কোথায় থাকো তা আমার অজানা নয়। রোগে ধরলেই লতার কথা মনে পড়ে।'
মোর্শেদ মিনিট খানেক রাগ নিয়ে তাকিয়ে থাকলেন।
মোর্শেদ ঘন্টাখানেক সময় নিয়ে দুই ফুট উচ্চতার জানালা করলেন। পদ্মজা, পূর্ণা হতবাক। সেই সাথে খুশি। হেমলতা ছোট পর্দা টানিয়ে দেন। রুম থেকে বাহির দেখা যায়। কিন্তু  জানালার ওপাশে কে আছে বাহির থেকে দেখা যায় না।
সন্ধ্যা মুহূর্তের শুটিং শুরু হয়। পদ্মজা,পূর্ণা, প্রেমা চৌকিতে বসল চিড়া নিয়ে। তাদের চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। হেমলতা তা দেখে মৃদু হাসলেন। বড় মেয়ে দুটো কখনো মুখ ফুটে শখ আহ্লাদের কথা বলে না। না বলা সত্ত্বেও অনেকবার দুই বোনের ইচ্ছে পূরণ করেছেন তিনি। আর কিছু ইচ্ছে বুঝতে পারলেও পূরণের সামর্থ্য হয়নি হেমলতার। 

হেমলতা ঘরের বাইরে যেতেই পূর্ণা বলল, 
'আমাদের মায়ের মতো সেরা মা আর কেউ না। তাই না আপা?'
'মায়ের মতো কেউ হয় না। সবার কাছে সবার মা সেরা। আমাদের মা আমাদের কাছে সেরা। লাবণ্যর মা লাবণ্য আর ওর ভাইদের কাছে সেরা। মনির মা মনির কাছে সেরা।'
'ওরা বলছে?'
'বোকা! এসব বলতে হয় না।'
'না, আমাদের আম্মাই সবচেয়ে ভালো মা। এমন মা আর একটাও নেই।'
হেমলতার কানে প্রতিটি কথা আসে। পূর্ণা সবার অনুভূতি অনুভব করতে জানে না। পদ্মজা জানে। 
'আমাদের আম্মা সত্যি সেরা। আলাদা।'
পদ্মজা হেসে বলল।
 পূর্ণা জানালার বাইরে চোখ রেখে প্রশ্ন করল, 
'আপা, চিত্রা দিদিরে কেমন লাগে?'
পদ্মজা চিত্রার দিকে তাকাল। ছাইরঙা শাড়ি পরা। হাতে কালো রঙের ঘড়ি। ফুলহাতা ব্লাউজ। শালীন তবে সর্বাঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়া। নাকে সাদা পাথরের নাকফুল। লম্বা চুল বেণি করে রেখেছে। মুখে খুব মায়া।স্নিগ্ধ একটা মুখ। যেন শরৎ-এর শুভ্র এক টুকরো মেঘ। পদ্মজা বলল, 
'আমার দেখা দ্বিতীয় সুন্দর মেয়েমানুষ চিত্রা দিদি।'
পূর্ণা আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল, 
'প্রথম কে?'
পদ্মজা কণ্ঠ খাদে নামিয়ে মোহময় কণ্ঠে বলল, 
'আমাদের আম্মা।'
হেমলতার বুক শীতল, স্নিগ্ধ, কোমল অনুভূতিতে ছেয়ে গেল। পদ্মজা এতো সুন্দর করে 'আমাদের আম্মা' বলেছে! হেমলতা প্রথম...এই প্রথম শুনলেন, তিনি সুন্দর! ভূবন মোহিনী রূপসীর মুখে শুনলেন। এই আনন্দ কোথায় রাখবেন তিনি। কেন ছেলেমানুষী অনুভূতিতে তলিয়ে যাচ্ছেন তিনি! প্রেমা অবাক স্বরে বলল, 
'আম্মা তো কালো। চিত্রা দিদির চেয়ে সুন্দর কীভাবে?'
'এভাবে বলছিস কেন প্রেমা? তুই ফর্সা হয়ে গেছিস বলে কালোকে ভালো মনে হয় না?'
পূর্ণা গমগম করে উঠল। প্রেমা ভয় পেল। পদ্মজা বলল, 
'পূর্ণা, বকছিস কেন? প্রেমা কত ছোট। ও কী সুন্দরের গভীরতা বুঝে? ও খালি চোখে ফর্সা, কালোর তফাৎ দেখে।'
'সুন্দরের গভীরতা তো আমিও বুঝি না।'
পূর্ণার কণ্ঠ ভারী নিষ্পাপ শোনাল। পদ্মজা এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল হেমলতার উপস্থিতি। এরপর বলল, 'আম্মার রং কালো। কিন্তু সৌন্দর্যের কমতি নেই। আম্মাকে কখনো এক মনে দেখিস,বুঝবি। আমাদের আম্মার চোখ দুটি গভীর,বড়,বড়। পাতলা,মসৃণ ঠোঁট। আম্মার ঘন চুলের খোঁপায় এক আকাশ কালো মেঘ। আম্মার শাড়ির কুচির ভাজে আভিজাত্য লুকোনো। আম্মা যখন তীক্ষ্ণ চোখে আমাদের দিকে তাকান, তখন মনে হয়, বিরাট বড় রাজত্বের রানী তাঁর পূর্বপুরুষের ক্ষমতা প্রকাশ করছেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে। এতকিছু থাকা সত্ত্বেও ও কী আম্মা আমাদের দেখা প্রথম সুন্দর মানুষ হতে পারেন না?'
পদ্মজার প্রতিটি কথা পূর্ণার উপর ভীষণ ভাবে প্রভাব ফেলল। প্রেমা চোখ পিটপিট করে কিছু ভাবছে। পূর্ণা বলল,
 'হতে পারে। কাল থেকে আমি আম্মাকে দেখব মন দিয়ে। '
'আমিও।' প্রেমা পূর্ণার দলে ঢুকল। 
হেমলতার চোখ বেয়ে দু'ফোটা  জল গড়িয়ে পড়ল। এই কালো রঙের জন্য ছোট থেকে সমাজে তুচ্ছতাচ্ছিল্য হয়ে এসেছেন। কত লুকিয়ে কাঁদা হয়েছে। কত করে চাওয়া হয়েছে, কেউ সুন্দর বলুক। কিন্তু সেই কপাল কখনো হয়নি। আর আজ, এই বয়সে এসে শুনলেন, তিনি কুৎসিত নন। তার মাঝেও সৌন্দর্য আছে। জন্মদাত্রী মা কালো রঙের জন্য গরম চামচ দিয়ে পোড়া দাগ করেছিলেন ঘাড়ে। আর গর্ভের সন্তান আজ সেই অনুচিত কাজের জবাব দিল। আল্লাহর সৃষ্টি কেউ অসুন্দর নয়। সবার মধ্যেই সৌন্দর্য আছে। যা ধরা পড়ে শুধুমাত্র সুন্দর একজোড়া চোখে। 

নিশুতি রাত। চারিদিকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। হেমলতা চোখ খুলেন। হুট করে ঘুমটা ভেঙে গেল। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ইঙ্গিত করছে কোনো ষড়যন্ত্রের। লাহাড়ি ঘরের ডান পাশে দু'জোড়া পায়ের আওয়াজ। হেমলতার বুক কেঁপে উঠল। তিনি দ্রুত উঠে বসেন। দুই চৌকির মাঝের পর্দা সরিয়ে দেখেন পদ্মজার অবস্থান। পদ্মজাকে ঘুমাতে দেখে আটকে যাওয়া নিঃশ্বাস ছাড়েন। পায়ের আওয়াজ  একদম পাশে শোনা যাচ্ছে। হেমলতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে ডান পাশে তাকান। গাঢ় অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। তবুও তিনি তাকিয়ে আছেন। দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে, অদৃশ্য গোপন শত্রুকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন। 
'কে ওখানে?'
হেমলতার ঝাঁঝালো কণ্ঠে পায়ের আওয়াজ থেমে গেল। সেকেন্ড কয়েক পর দুই'জোড়া পা যেন ছুটে পালাল।
[+] 2 users Like blooddiamon509's post
Like Reply


Messages In This Thread
আমি পদ্ম - by blooddiamon509 - 01-06-2023, 01:58 AM
RE: আমি পদ্ম - by blooddiamon509 - 04-06-2023, 12:16 AM
RE: আমি পদ্ম - by blooddiamon509 - 04-06-2023, 12:32 AM
RE: আমি পদ্ম - by Bangla Golpo - 04-06-2023, 12:47 AM
RE: আমি পদ্ম - by blooddiamon509 - 04-06-2023, 02:30 AM
RE: আমি পদ্ম - by blooddiamon509 - 14-06-2023, 01:00 AM
RE: আমি পদ্ম - by blooddiamon509 - 14-06-2023, 01:18 AM
RE: আমি পদ্ম - by Bangla Golpo - 14-06-2023, 11:36 PM
RE: আমি পদ্ম - by blooddiamon509 - 15-06-2023, 11:54 PM



Users browsing this thread: 1 Guest(s)