06-05-2023, 08:31 PM
পর্ব- চৌদ্দ
এক পা দু পা করে এগিয়ে যাচ্ছে মাধুরী। লিলি ওর আগে আগেই এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু মাধুরী কেন জানি পা দুটোতে কোনরকমেই জোর পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে কিছু একটা ওর পায়ের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে শক্ত করে। যেটা নিচের মাটিটা আঁকড়ে ধরে ওকে এগোতে দিচ্ছে না। কিন্তু না আজ যেই করেই হোক মাধুরী কে যেতেই হবে, এ সুযোগ হাত ছাড়া করা যাবে না। এতোদিনে এমন একটা মূহুর্ত ধরা দিয়েছে ওর কাছে যে করেই হোক সেটাকে কাজে লাগাতেই হবে। দেখা হলে কি বলবে সেটা আরেকবার মনে মনে সাজিয়ে নিচ্ছে। কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে সবকিছু বারবার। মাথাটা বুঝি কাজ করাই বন্ধ করে দিয়েছে। অল্প দূরত্বের এই পথখানাও আজ বহু ক্রোশ দূরত্বের মনে হচ্ছে। মেইন গেটের ছোট্ট দরজা টা ঠেলে সরানোর শব্দে মাধুরী সামনের দিকে তাকায়। আর এক পা বাড়ালেই অতিথি তে প্রবেশ ঘটবে তার। এর আগেও এ আঙিনায় কতবার এসেছে ইয়ত্তা নেই তবুও আজ সবকিছু নতুন ঠেকছে নিজের কাছে। বুকের বাপাশের ধুকপুকানি টা বেড়েই চলেছে৷ থমকে দাঁড়িয়ে আছে গেটের সামনে সাহস করে আরেক পা বারবার প্রয়াশ করে চলছে কিন্তু শরীর সায় দিচ্ছে না।
লিলি পিছন ফিরে একবার দেখে বলে উঠে,
কিরে দিদি দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? চল...
লিলির কন্ঠস্বরে মাধুরী বুঝি একটু সাহস যোগাতে পারলো মনে। ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো লম্বা বারিন্দা জুড়ে বসে আছে জনা কয়েক ছেলে মেয়ে। লিলিও ততোক্ষণে সেদিকে দৌড় দিয়েছে ওর লক্ষ্য টা যেন সামনে বসার অর্থাৎ কৌশিকের কাছাকাছি থাকার। ওদিকে তাকাতেই মাধুরীর চঞ্চল চোখ জোড়া স্থির হয়ে আসলো, এক নজরে তাকিয়ে আছে বোর্ডে লিখতে থাকা সেই মানুষটার দিকে। অদৃশ্য এক আকর্ষণের টানেই মাধুরী ধীরে ধীরে এগোতে থাকে সেদিকেই। তিনটে সিঁড়ি উঠতেই আবারও দাঁড়িয়ে যায় মাধুরী। আরেক পা এগোলেই কৌশিকের নাগাল পেয়ে যাবে তবুও কেন জানি মনে হলো এ দূরত্ব টাই ভবিষ্যতে কাছে আসার প্রভাবক হবে।
কৌশিক বোর্ডে কিছু একটা লিখছিল, বোর্ডের উপর পড়া ছায়াটা আর নাকের কাছে মিষ্টি গন্ধতেই বুজতে পেরেছিল পাশে কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে। তবে সেটা যে মাধুরী হবে হয়তো কল্পনাতেও ভাবে নি যেটা পাশ ফিরতেই ওর মুখের অভিব্যক্তি টাই বলে দিচ্ছিলো। এ যেন আকাশের চাঁদ হাত ছোঁয়া কাছে চলে এসেছে, এই খুশি সবার পক্ষে ধরে রাখা কি সম্ভব? কিন্তু কৌশিকের এখানে আলাদা একটা পরিচয় আছে অবস্থান আছে সেটাও মাথায় রাখতে হয়। তাই খুশি টাকে চামড়ার মুখোশের আড়ালে রেখেই স্বভাব জাত ভঙিমায় বলে উঠে,
একি তুমি এখানে?? তোমাদের কোন ব্যাচ তো আমি পড়াই না।
হঠাৎ এমন কোন প্রশ্ন ছুটে আসবে সেটা মাধুরীর ভাবনাতে ছিল না, তাই খানিকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় সে। তবে সামলে উঠে,
না স্যার আমি তো পড়তে আসি নি। আমার ছোট বোন পড়তে আসে ওর সাথে এসেছি (লিলির দিকে ইশারা করে কথাটা বলে)
ওহ তোমার বোন সেটা জানি, তা ওকে কি পাহারা দিতে এসেছো নাকি?
এমন ত্যাড়া বাঁকা প্রশ্ন শুনে মাধুরী মেজাজ গরম হতে থাকে, ওর ইচ্ছে হয় দু হাতে কৌশিকের গলাটা টিপে দিতে। তবে সাহসে কুলোয় না,
না না, এমনিতেই এসেছি...
ভালো, তাহলে এক কাজ করো এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে ভেতর থেকে আমার জন্য এক গ্লাস জল নিয়ে আসো তো।
লিলি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়,
আমি জল আনতে যাই?
লিলিকে ধমকে উঠে কৌশিক,
তোমাকে বলেছি আমি? যাকে বলেছি সে যাবে (মাধুরীর দিকে) কি ব্যাপার দাঁড়িয়ে আছো কেন?
মাধুরী মনটা খারাপ করে ভিতরের দিকে চলে যেতে থাকে, হঠাৎ মাথায় যেন কি একটা ভাবনা আসে। পিছন ফিরে জিজ্ঞেস করে,
আমাদের কি পড়াবেন স্যার?
কৌশিক মুচকি হেসে উত্তর দেয়,
দেখি সময় করতে পারি কিনা, একসময় এসে দেখা করো।
মাধুরীর মনটা আনন্দে নেচে উঠে, পড়ার বাহনা করে হলেও দিনে আরেকটাবার করে মানুষটার কাছাকাছি যে থাকা যাবে৷ মনের আনন্দে খানিক নাচের ভঙিতেই বাড়ির ভিতরের দিকে চলে যায়।
মোবাইলটা আবারও বেজে উঠেছে, কে ফোন করে সেটা জানা তবুও আরেকবার হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা চোখের সামনে ধরে নামটা দেখতেই বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠে। এর আগেও কয়েকবার ফোন এসেছে তবে রিসিভ করার মত সাহস পায় নি সে। সত্যি বলতে একটা পাপবোধ কাজ করছে মনের ভেতর, এমন ভাবে নিজের প্রিয়তমাকে নিয়ে বাজে কথা শুনতে কারই বা ভালো লাগে? দোষটা যে কিছুটা নিজেরও আছে সেটা অস্বীকার করতে পারে না অনির্বাণ। প্রথমত এমন ব্যক্তিগত মূহুর্তের ছবি তুলা ঠিক নয় তার উপর সেগুলো যথাযথ ভাবে লুকিয়ে না রাখতে পারাটাও তার ব্যর্থতার মাঝেই পড়ে। আর সেই অনুশোচনা থেকেই অনির্বাণ রুমার সাথে কথা বলতে পারছে না। আর প্রিয়তমার সাথে কথা বলতে না পারার কষ্টটা কেমন সেটা বোধহয় প্রেমিকমনের মানুষদের আলাদা করে বুঝাতে হবে না। রিং টা কেটে যেতেই মোবাইলটা পাশে রেখে অনির্বাণ নিজের মুখখানা বালিশে চেপে ধরে লুকানোর চেষ্টা করে।
মমতা দেবী কৌশিকের মা বসার ঘরেই বসে ছিল আর হাতে থাকা কাপড়ের টুকরোতে রঙিন সুতোর নকশা তুলছিলো। মাধুরী কাছে গিয়ে জল চাইতেই উপরের দিকে তাকাতেই মমতা দেবীর ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠে। এই মুখখানা যে উনি আগেও দেখছেন তবে সেটা নিজের ছেলের ক্যানভাসে। তবে আজ সামনাসামনি দেখে ছবির থেকেও আরও বেশি সুন্দর লাগছে ওকে। ছেলের পছন্দ আছে বলতে হবে। হাতের কাপড় টা পাশে রেখে বলে উঠে,
দাঁড়াও মা আমি জল এনে দিচ্ছি।
না না আন্টি আপনাকে যেতে হবে না, আমাকে বলে দিন আমি নিজেই নিয়ে নিচ্ছি।
মমতা খুশি মনেই হাতে ইশারায় জলের ফিল্টার টা দেখিয়ে দেয়। মাধুরী উচ্ছসিত মনে একটা গ্লাসে জল নিয়ে বাইরে চলে যায় কৌশিক কে দেবার জন্য। মমতা দেবী এখনো হাসছে আর ভাবছে আজ ছেলেকে চেপে ধরবে সত্যটা জানার জন্য।
স্যার আপনার জলটা...
কৌশিক মাধুরী হাত থেকে জলের গ্লাস টা নেবার সময় খানিক আঙুলে আঙুলে স্পর্শ খেলে যায়। ঐ বাতাসের মত অদৃশ্য ছোঁয়াতেই মাধুরীর মন আনন্দে নেচে উঠে। এ এক অন্যরকম অনুভূতি যা আগে কখনো অনুভব করে নি সে।
নিচু স্বরে মাধুরী বলে উঠে,
ধন্যবাদ স্যার..
কিসের জন্য? ধন্যবাদ তো আমার দেবার কথা জল খাওয়ানোর জন্য।
ঐ যে এতো সুন্দর করে আমার স্কেচ একে দেবার জন্য। ওটা আমার জীবনের সেরা গিফট।
ওহহ। খুব তাড়াতাড়ি এঁকেছিলাম তেমন একটা ভালো হয় নি তো।
না না অনেক ভালো হয়েছে। (কৌশিকের হাত থেকে গ্লাস নিয়ে) আমাকে পড়াবেন তো??
আচ্ছা দেখি যদি সময় করতে পারি।
ওসব জানি না, আমাকে পড়াতেই হবে (গলার স্বরে প্রচ্ছন্ন এক অধিকার বোধের প্রকাশ)
কথাটা বলেই মাধুরী গটগট করে ভেতরে চলে যায়। কৌশিকের মুখে ফুটে উঠা অভিব্যক্তিই বলে দেয় ওর ভিতরে ভিতরে কতটা খুশিতে আত্মহারা হয়ে আছে আজ।
অনির্বাণ বেশিক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে পারে তার আগেই টুং করে একটা মেসেজ আসে মোবাইলে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে স্ক্রিন লক খুলতেই ডিসপ্লে জুড়ে ভেসে উঠে রুমার পাঠানো ক্ষুদে বার্তা,
কি হয়েছে তোমার?? কল ধরছো না কেন? মনে হয়তো বাসায় আছো, এখনি যদি ফোন না ধরো তবে কিন্তু বাসায় চলে আসবো বলে দিলাম।
রুমার পরোক্ষ হুমকি টা চাইলেও এড়িয়ে যেতে পারে না। কারণ আর বেশি দেরি করলে হুমকি টা যে বাস্তবেও পরিণত হতে পারে সেটা তো অনির্বাণের জানা আছে। তাই আর দেরি না করে সাথে সাথেই ফোন করে রুমাকে...
হ্যালো....
এই তোমার কি হয়েছে বলো তো? ফোন ধরছো না আবার নিজেও করছো না। সমস্যা টা কি? কোন ঝামেলা হয়েছে নাকি??
না.. মা..মানে তেমন কিছু না। কিছু হয় নি তো...
কিছু তো একটা হয়েছেই, মনে সেটা বুঝতেও পারছি।
হকচকিয়ে উঠে অনির্বাণ, মনের ভেতর কুঁ ডাকছে। রুমা কিছু জেনে গেল না তো,
ক...কি..কি বুঝতে পারছো তুমি। কি হবে আবার?
পরীক্ষা টা বুঝি আজ তেমন ভালো হয় নি তোমার, তাই মন খারাপ করে আছো।
অনির্বাণের বুকের উপর থেকে বুঝি পাথরটা নেমে যায়,
তা একটু হয়েছে। প্রশ্ন টা এবার হার্ড করেছে তো।
চিন্তা করো না পাশ করে যাবে। মোটামুটি হলেও ভালো নাম্বার পাবে।
হুম সেটাই ভাবছি।
হয়েছে হয়েছে... আর ভাবতে হবে না। বাকি পরীক্ষা গুলো ভালো করে দেবার চেষ্টা করো। আর এই বিষয়টা নিয়ে এভাবে মুখ গোমড়া করে বসে না থেকে আমাকে আরেকটু আগে বললেই পারতে। এদিকে আমি কত টেনশন করছি।
স্যরি জান। ভুল হয়ে গিয়েছে, আর এমন হবে না। লাভ ইউ সো মাচ। উম্মাহহহ
লাভ ইউ টু, উম্মাহহহ। এখন রাখি সন্ধ্যা হয়ে আসছে.. ঘর বাড়ি ঝাড়ু দিয়ে সন্ধ্যা বাতি দেখাতে হবে। আর তুমিও মন খারাপ করে বসে না থেকে পড়তে বসো।
আচ্ছা পরে কথা হবে। হুম একটু পরেই পড়তে বসবো।
বাড়িতে ফিরেই পড়নের শাড়িটা বদলে একটা আটপৌরে শাড়ি পড়ে নিয়েছে লক্ষ্মী। ভেবেছিল স্নান করেই নিবে কিন্তু দিন কয়েকদিন ধরে বিকেল হতেই হালকা কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। ঠান্ডা ঠান্ডা একটা ভাব গায়ে লাগে, হয়তো শীতের আগমনী বার্তা দিয়ে যেতে চায়। শাড়িটা বদলেই কলতলায় চলে যায় লক্ষ্মী, চিলতে টুকরা হয়ে আসা সাবান দিয়ে হাত মুখ গুলো ধুয়ে নেবার জন্য। হাত মুখ ধুতে ধুতে গুনগুনিয়ে উঠে সে, আজ অনেকদিন পর মনের ভেতর কিছু সুরের মূর্ছনায় হৃদয় মাতোয়ারা হতে চাইছে। সকালের ঐ খসখসে রুক্ষ হাতের ছোঁয়া গুলোতেই শুষ্ক মরুভূমিতেও যেন প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে। নতুন করে সবুজের সমারোহে জেগে উঠেছে প্লাবন ভূমি, রসের আগমনে সজীবতায় ভরে উঠেছে শাখা প্রশাখা। আর সেই অনূভুতি জোয়ারেরই লক্ষ্মীর মনে আজ হাওয়া লেগেছে, এই অসময়েও বসন্তের হাওয়া। আজ কেন জানি মনটা ভীষণ করে চাইছে মানুষটাকে আরেকবার দেখতে ঐ ছোঁয়া টুকু আরেকবার অনুভব করতে। তবে মনকে বুঝানোর চেষ্টা করে সবসময় সবকিছু চাইতে নেই আবার অনেক কিছু চাইলেও পাওয়া যায় না অনেক বাঁধা থাকে।
সন্ধ্যার চা আড্ডা জমে উঠেছে মাধুরীদের বাড়িতে, নিচতলার বসার ঘরে সবাই খুব জেঁকে বসেছে হালকা কিছু খেয়ে উদরপূর্তি করার জন্য। আজ মাধুরী মোড়ের দোকান থেকে গরমাগরম সবজি বড়া, সিঙ্গাড়া এনেছে সবার জন্য। যদিও খেলার নিয়ম অনুযায়ী আজ ওর এসব আনার কথা ছিল না তবুও যেহেতু এনেছে তাহলে খেতে তো দোষ নেই। বিকেলের পর থেকেই মাধুরী অনেক বেশি প্রাণবন্ত আর উচ্ছল দেখাচ্ছে। সবকাজেই আলাদা একটা উন্মাদনা নিয়ে যুক্ত হয়েছে। মায়ের চোখে মেয়ের এমন বদলে যাওয়াটা ভালো নজরে পড়লেও বাড়ির দুই লেডি গোয়েন্দা লিলি আর ঠাম্মির মনে তো অন্য কিছু ভাবনা উসকে দিচ্ছে৷ তারা বারবার দুজন দুজনার দিকে তাকাচ্ছে আর ঘটনা প্রবাহ বুঝার চেষ্টা করছে৷ তবে মাধুরীর সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই আর থাকারও কথা নয়। তার মন প্রাণ সবকিছু যে আজ অন্য কিছুতে মজে আছে। এর মাঝেই চা চলে এসেছে, মাধুরী চায়ের কাপ হাতে নিয়ে লিলি পাশে বসে পড়ে। সবজি বড়া আর সিঙ্গাড়ার প্লেট এগিয়ে দিয়ে লিলি জিজ্ঞেস করে,
কিরে দিদি ঘটনা কি বলতো...
অবাক নয়নে মাধুরী তাকায় লিলির দিকে
কিসের ঘটনা!
সেটাও কি আমার বলে দিতে হবে নাকি, সেটা তো বলবি তুই। বিকেল থেকেই দেখছি পাখি উড়ো উড়ো করছে.. তাই না ঠাম্মি
মাধুরীর চোখে মুখে ধরা পড়ে যাবার ভয়
কি যা তা বলছিস, আজকাল দেখি তোর মুখের বুলি বড্ড বেড়েছে।
এসব বলে কাজ হবে না আমার আর ঠাম্মির চোখ ফাঁকি দেয়া এত সহজ নয়।
ফাঁকি দিতে যাবো কেন? আর কিছু হলে তোকে আর ঠাম্মি কেই বলবো সবার আগে।( মাধুরী পরিস্থিতি সামাল দেবার যথাসাধ্য চেষ্টা করে)
আচ্ছা মেনে নিলাম, বাকিটা মনে থাকে যেন।
মাধুরী যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো, সবাই আবার চা সিঙ্গাড়াতে মনোনিবেশ করলো।
একটা জীর্ণশীর্ণ মাদুর পেতে তাতে বসা পচুই বইয়ের রঙিন ছবিতে মজে আছে। মন দিয়ে দেখে যাচ্ছে হরেক রকমের রঙের বিভিন্ন পাখি, মাছ, পশু আর ফলের ছবি। একেকবার একেকটা করে ছবি দেখছে আর সেটার নাম কি জানার জন্য মায়ের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে। লক্ষ্মীর যেগুলো চেনা আছে সেগুলোর উত্তরই দিতে পারছে বাকি গুলো এড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পচুই তো নাছোড়বান্দা তার সবগুলোর নাম জানা চাই, সেটা নিয়েই মায়ের সাথে হালকা বিবাদ হচ্ছে। লক্ষ্মীরই বা কি করার আছে তার দৌড় যে অব্দি সেটুকু সে চলে এসেছে, কিন্তু ছেলেকে বুঝ দিবে কি করে?
হঠাৎ করেই একটা পুরুষকন্ঠে চমকে উঠে মা ছেলে দুজনেই,
ওগুলার নাম আমি কইয়ে দেব।
আধখোলা দরজার কাছেই নিখিল দাঁড়িয়ে আছে। ডানহাতে ঝুলতে থাকা ছোট্ট স্বচ্ছ পলিথিনে বাদাম দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে যে কোটি টাকার জিনিসের চেয়েও দশ টাকার বাদাম মেয়েদের মন ভুলাতে যথেষ্ট সেটা নিখিলের বুঝি ভালো করেই জানা।
ঘরে আইতে কইবা না?
নিখিলের ডাকে লক্ষ্মী সম্বিত ফিরে, মাথা ঝাকিয়ে বলে উঠে
আয়েন।
ঘরে ঢুকেই বুক পকেট থেকে গুটি কয়েক লজেন্স বের করে পচুইয়ের হাতে দিয়ে দেয়। ছোট্ট বাচ্চা লজেন্স গুলো পেয়ে অনেক খুশি সেটা ওর হাত পা ছুড়া দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
তোমার জন্য বাদাম আনলাম (লক্ষ্মীর দিকে এগিয়ে দেয় নিখিল)
খুব সন্তপর্ণে নিখিলের ছোঁয়া এড়িয়ে বাদাম গুলো নিয়ে নেয়,
এইতা আনবার কইছে কেডা (লাজুকতা লক্ষ্মীর কন্ঠে)
তোমার লাইগা আনছি কেডা কইবো আবার।
খাটের তলা থেকে মোড়া খানা এগিয়ে দেয় নিখিলের দিকে। নিখিল যেন ইচ্ছে করেই লক্ষ্মী গা ঘেষে ওর পাশেই বসলো। যতই এড়িয়ে যেতে চাইছে ততই সব যেন আরও ওর কাছে চলে আসছে। অনেকদিন পর এতো কাছ থেকে পুরুষালী গন্ধ লক্ষ্মীর শরীরের হরমোনের দৌরাত্ম্য বাড়াছে, দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। শরীরের লোম গুলো জাড়িয়ে উঠেছে উত্তেজনার পারদে। শ্বাস গুলো একটু একটু করে ভারী হয়ে উঠছে। ওদিকে নিখিলের কোন খেয়াল নেই। সে আপন মনে বাদামের খোসা ছাড়াচ্ছে আর পচুইকে ছবি গুলোর সাথে পরিচিত করছে। নিখিলের মুখাবয়বে কিছুটা খুশির ছটা, ও হয়তো আজ লক্ষ্মীকে খানিক খেলিয়ে নেবার ধান্ধাতেই আছে। এর মাঝেই এক দুবার খোসা ছাড়ানো বাদাম দেবার অজুহাতে লক্ষ্মীর কোমল হাতের সাথে নিজের পরশ বুলিয়ে দিয়েছে। আড় চোখে লক্ষ্মীকে পর্যবেক্ষণ করেছে বুঝার চেষ্টা করেছে ওর হাবভাব। প্রথম বার দুয়েক লক্ষ্মী তড়িৎ গতিতে নিজের হাত সরিয়ে নিলেও এরপর থেকে আর তেমনটা করে নি। সেই সুযোগে নিখিলও খানিক বেশিটা সময়ই লাগাচ্ছিলো বাদাম বিনিময়ে। লক্ষ্মীও বোধহয় আজ খুব করে স্পর্শ টা পেতে চাইছিলো, আজ ওর মন আর শরীর দুটোই বুঝি সায় দিয়েছে।
বসার ভঙ্গিমা পরিবর্তন করতে গিয়ে লক্ষ্মী যেন আরও নিখিলের কাছাকাছি চলে এসেছে। হালকা নড়াচড়াতেও দুজনের বাহু ঘসা লাগছিলো বারংবার। আর দুটি চার্জিত বস্তু নিজেদের মাঝে সংঘর্ষ ঘটালে কি উৎপন্ন হয়? শক্তি! আর সেটার উপজাত হিসেবে আসে উত্তাপ। সেটাও ঘটে চলেছিল দুজন নরনারী মাঝে। পচুইকে বাদাম এগোতে দেবার জন্য সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকতেই নিখিলের কনুইটা হালকা ধাক্কা খায় লক্ষ্মীর নরম কোমল মোলায়েম দুধের সাথে। সাথে সাথেই যেন লক্ষ্মীর শরীরে হাজার ভোল্টের ঝটকা লাগলো, ওর হতবাক হয়ে থাকা মুখটার দিকে তাকাতেই নিখিল খানিকটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তবে খানিক বাদেই ধাতস্থ হতেই লক্ষ্মীর মুখ জুড়ের লজ্জার আভা নিখিল কে খানিকটা নিশ্চিন্ত করে। এবার নিজেকে একটু সরিয়ে নিয়ে আসে সে আর এমন ভাবখানা করে যেন আগের ঘটনাটা হঠাৎ ঘটে গিয়েছে। লক্ষ্মী হয়তো এমন ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিল না তাই বুঝি লজ্জায় মাথা নিচের দিকে দিয়ে বসে আছে।
নিখিল আজ একটু বেশিই সাহসী হয়ে উঠেছে, লক্ষ্মীকে ওমন করে বসে থাকতে দেখে নিজেই কয়েকটা খোসা ছাড়ানো বাদাম লক্ষ্মীর মুঠিতে পুড়ে দেয়। ওমন রুক্ষ খসখসে হাতের শক্ত ছোঁয়াতে সারা দেহে শিরশিরানি শুরু হয়ে যায়। ঘনঘন নিঃশ্বাসে ওর বুকের উঠানামা বাড়তে থাকে, ভারী দুধের ওমন উঠানামা নিখিলের নজর এড়ায় না। আটপৌরে শাড়ি খানার ফাঁক গলে বুকের উপর জেঁকে থাকা দুই পর্বত মধ্য গিরিখাতের আবছায়া দর্শন পেয়ে যায় নিখিল। ওমন আকর্ষণীয় অঙ্গের শোভা দেখে নিখিলের শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বইতে থাকে সেই সাথে বাড়তে থাকে উষ্ণ নিঃশ্বাসের গতি। খানিকটা সরে এসে লক্ষ্মীর দিকে ফিরে বসে সে আরও খানিক সৌন্দর্য দেখে নেবার অভিলাষে। ওদিকে নিজের মুঠিতে তে লক্ষ্মীর হাতটা বন্দী হয়ে আছে সে দিকে খেয়ালই যেন নেই। লক্ষ্মী নিজের হাতখানা ছাড়িয়ে নেবার আশায় কিঞ্চিৎ জোর প্রয়োগ করে তবে তাতে লাভ হয় না। নিখিল আরও বেশি করে নিজের কাছে নিয়ে আসে ওর হাত খানা, লক্ষ্মীর ঠোঁটের কোনের মিষ্টি হাসিটা বলে দেয় ওমন জোর করাতে ও খুশিই হয়েছে। এতকিছুর মাঝেও লক্ষ্মীর সজাগ দৃষ্টি ছেলের দিকে আর আধখোলা দরজা পানে বারবার তাকাচ্ছে। শতহোক মনের কোণে খানিক ভয় তো জেগেই থাকে। হঠাৎ নিখিলের চোখের দৃষ্টিটা কোন দিকে সেটা বুঝতে পেরে নিজের বুকের আঁচল টা আরেকটু টেনে দিয়ে পবর্তদ্বয়ের গিরিখাত আড়াল করতে চায়। এই কার্যে যে নিখিল যথেষ্ট অখুশি সেটা তো মুখে বলে দিতে হয় না। তবে সেটা আড়াল করেই হালকা হাসি ছুড়ে দেয়।
প্রকৃতির কি খেয়াল সেটা প্রকৃতি স্বয়ং মাঝে মাঝে ভুলে যায় হয়তো, নইলে এমন মূহুর্তে কি বিদ্যুৎ চলে যেতে হয়!! অসময়ের লোডশেডিং এ ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। এতো কাছে বসে থেকেও কেউ কাউকে দেখতে পারছে না শুধু অনুভব করে যাচ্ছে শরীরের উপর আছড়ে পড়া গরম নিঃশ্বাস গুলো। অদ্ভুত এক নীরবতায় গ্রাস করে নিয়েছে সবকিছু, যদিও এর আগে পচুইয়ের কন্ঠস্বর ছাড়া তেমন কোন আওয়াজ হচ্ছিলো না। তাই বুঝি এখন এই ভূতুড়ে নীরবতায় ঘনঘন শ্বাস পড়ার শব্দটাই বেশ ভালো করেই কানে বাজছে৷ মূহুর্তের কালক্ষেপণে লক্ষ্মী যেন নিজেকে কারো বাহুপাশে আবিষ্কার করলো, নিখিল অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে লক্ষ্মী কে জড়িয়ে ধরেছে নিজের বুকে।
নিখিলের প্রশস্ত বুকে বাঁধা পড়েই নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে থাকে লক্ষ্মী কিন্তু তেঁতে থাকা দুটো বিপরীত লিঙ্গের শরীর যেন আরও উতপ্ত হয়ে উঠেছে প্রকৃতির নিয়মে। সময় যেন গুলির বেগে ছুটে চলছে সেই সাথে বাড়ছে বুকের ভেতরের সদা গতিমান হৃদপিণ্ড ধুকপুকানি। অন্ধকারেই আন্দাজ করে নিখিলের উষ্ণ ঠোঁট জোড়া এগিয়ে যায় লক্ষ্মীর দিকে আজ যেন সব বাঁধ ভাঙার শপথ করে নিয়েছে সে।
মা ও মা বাতি কই আমার ডর লাগে তো
পচুইয়ের ভীত কন্ঠস্বরে কেঁপে উঠে লক্ষ্মী শরীর সাথে হয়তো মাতৃ মন।
আম্মার সাথে ঘরের কাছে হাত লাগিয়েছে আলেয়া, কৌশিকের সাথে কোচিং এ জয়েন করার পর থেকে সন্ধ্যার টিউশনি টা ছেড়ে দিয়েছে সে। তাই এখন এ সময়টাতে আম্মার কাজে সাহায্য করে, মনে খেয়াল এসেছে টুকটাক রান্না শেখার৷ কৌশিকের মা মমতা দেবী আজ ফিশ চপ খাইয়েছিল, ও সেটা কিভাবে বানায় সেটা দেখে শিখে এসেছে। সব মশলা পাতি ওদের ঘরে নেই সেগুলো ব্যবস্থা করতে হবে আগে। হঠাৎ করেই খানিক দূরে থাকা আলেয়ার মোবাইলটা একবার বেজে উঠে৷ হাতের কাজ টা সেরে মোবাইলটা হাতে নিতেই দেখে সুমনের একটা মেসেজ এসেছে, সেটা খুলতেই ডিসপ্লে জুড়ে ভেসে উঠে লেখাটা
আজ একটা জিনিস চাইবো, দিবে?