01-05-2023, 08:57 PM
ভিজে ন্যাতা দিয়ে সপসপ করে ঘর মুছছিল রুমকি ! বেশ কিছুদিন হল মা ওকে এই বৌদির বাড়ি কাজে লাগিয়েছে | যদি বৌদিকে সামনে বৌদি বলা নিষেধ ! প্রথমবার এসে বৌদি বলায় গম্ভীর গলায় উত্তর এসেছিল বৌদি নয়, তুমি আমায় ম্যাডাম বলবে | মাস গেলে হাজার পাঁচেক সঙ্গে চারবেলা খাওয়া ! সকাল সাতটায় এসে রাত আটটায় বাড়ি ফেরা ! বৌদি খুব স্মার্ট | ছ'মাস কাজ করেছে রুমকি এর মধ্যে দাদাকে মোটে দু-চারদিনই দেখেছে | বৌদি তেমন একটা কথা বলে না ! চুপচাপ ! সারাক্ষণ ফোন ঘাঁটছে ! মাঝে মাঝে পরিপাটি ড্রেস করে কোথায় যেন যায় ! সেদিন রুমকির একাই এই বিরাট ফ্ল্যাটে থাকে | ইচ্ছেমত টিভি দেখে, ফ্রিজ থেকে বার করে ঠান্ডা জল খায় | রুমকির খুব ইচ্ছে করে বৌদি এত সেজেগুজে কোথায় যায় জিজ্ঞেস করতে কিন্তু ভয় করে বৌদি একেবারে অনধিকার চর্চা পছন্দ করে না | মায়ের মুখে শুনেছে বৌদির নাকি ব্যবসা আছে, বিরাট ব্যবসা | বৌদির মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি নিখুঁতভাবে সাজানো ! হাত-পায়ের চামড়া মাখনের মত, রুমকি মনে মনে ভাবে হবে না কেন ? সারাদিন শুধু ঘষছে আর ঘষছে | ঘরের একটা কাজও করে না ! আহা ! রুমকি যদি অমন একটা জীবন কাটানোর সুযোগ পেত, রুমকির চামড়াতেও চেকনাই দিত ! কিন্তু মোটর মেকানিক দিলুর কি সাধ্যি আছে রুমকির চামড়ায় চেকনাই ফোটাবে ? তবু রুমকি দিলুকে পাত্তা দেয় ! সিনেমা দেখা, রেস্টুরেন্টে খাওয়া, অ্যাপ দেখে দেখে পছন্দ করে কেনা কমদামী অথচ স্টাইলিশ জামাকাপড়, একটু অনামী ব্র্যান্ডের স্নো-পাউডার-পমেটম দিলুর পয়সায় হয়ে যায় |
আজকাল রুমকি আর ফুটপাতের জামাকাপড় পড়ে না ! কেন পড়বে ? দুমাস আগে বৌদি নিজের বাতিল করা টাচস্ক্রিন মোবাইলটা ওকেই দিয়েছে যে ! দিলুর সঙ্গে গিয়ে একটা নতুন নম্বর নিয়েছে, প্রতিমাসে দিলু ওই নম্বরে রিচার্জ করিয়ে দেয় | কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে রুমকি শপিং অ্যাপে রকমারি সাজপোশাক দ্যাখে | কসমেটিকসও দ্যাখে | কত রকমারি ব্র্যান্ড, কত তার নাম ! বৌদির ফোনেই অ্যাপগুলো ইন্সটল করা ছিল | বৌদি তো এসব অ্যাপগুলো থেকেই নিজের রকমারি জামাকাপড়, কসমেটিকস কেনে | এই আজ ড্রেস আসছে তো, কাল বয়ফেন্ড জিন্স, পরশু আবার হুডা বিউটির কসমেটিক্স ! এখন বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নাম জেনে গেছে রুমকি ! বউদির ব্যবহার করা একটা লিপস্টিকের দাম আড়াই হাজার শুনে দিলু তো পড়েই যাচ্ছিল, বেচারার দশদিনের রোজগার বলে কথা ! আজকাল তো অর্ডার করলে হোম ডেলিভারিতে নামীদামী রেস্টুরেন্টের খাবার পর্যন্ত দিয়ে যায় | বৌদির কাছেই রুমকি প্রথম বড় হোটেলের সুস্বাদু বিরিয়ানি খেয়েছিল | বৌদি মাঝেমধ্যে ফুড অ্যাপে অর্ডার দেয় | রুমকিও ভাগ পায় | সেদিন মাসমাইনে পেয়ে অ্যাপ থেকে অর্ডার করে রুমকি দিলুকে বিরিয়ানি খাইয়েছে | চেটে চেটে দিলু তো হাতটা খেয়ে ফেলতেই বাকি রেখেছিল | সামনে বসে রুমকির যা হাসি পাচ্ছিল |
মা সেদিন বলছিল বৌদি নাকি পাত্র-পাত্রীর ব্যবসা করে | রুমকি শুনে অবাক হয়েছে | মেয়েরা আবার ঘটকালি করে নাকি ! মা বলল ব্যপারটা ঘটকালিই বটে তবে নাকি এ কাজে বাড়ি বাড়ি ঘুরতে হয় না | সব কাজ কম্পিউটারেই হয় ! দেশ-বিদেশ থেকে যেসব ছেলেমেয়েরা কলকাতায় বিয়ে করতে আসে, বৌদি নাকি তাঁদের পছন্দমত ছেলেমেয়ে খুঁজে দেয় | বিয়েটা সেরে তারা আবার যেখানে থাকে সেখানে হুশ করে উড়ে যায় ! ঘোষবাড়ির মেয়েটা কম্পিউটার নিয়ে পড়াশোনা করে ও রুমকির মাকে এসব কথা বুঝিয়ে বলেছে | রুমকির মাথায় তেল লাগাতে লাগাতে ওর মা বলছিল তুই তো সেকেন্ড ডিভিশনে মাধ্যমিক পাশ করলি | বৌদিকে বলেছি যদি তোর জন্য একটা সাদামাটা ছেলে খুঁজে দেয় | তাহলে অন্ততঃ তোকে আর আমার মত গতর খাটাতে হয় না | দেখতে শুনতে তো তুই মন্দ নোস ! পোশাক আশাকও ভালোই পড়িস ! কথাটা শুনেই রুমকির মনটা গভীর আনন্দে ভরে গেল | সত্যি যদি বৌদি ওর জন্য একটা ছেলে দেখে দেয় | তাহলে রুমকিও সারাদিন শপিং করবে আর পা থেকে মাথার নখ অবধি নিজেকে সাজিয়ে রাখবে |
একমাস, দু'মাস কেটে যায় | রুমকির বৌদি এ ব্যপারে তেমন একটা উচ্চবাচ্য করে না | ইতিমধ্যেই রুমকির মা ওর তিন/চারটে ভালো ছবি বৌদিকে দিয়ে এসেছে | কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না | ধীরে ধীরে রুমকির আশা মরে আসছে, ও বিশ্বাস করতে শুরু করেছে ওর কপালে মোটর মেকানিক দিলুই নাচছে | বৌদির বাড়ি থেকে ফিরে ভাঙা ঘরের এক কোণে বসে রাতের রুটি পাকাচ্ছিল রুমকি হঠাৎ দেখে মা হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকল | প্রতিদিন চার-পাঁচ বাড়ির কাজ সেরে ফেরা মায়ের ক্লান্ত মুখ দেখতেই রুমকি অভ্যস্ত ! সে মুখে হঠাৎ এমন হাসি দেখে রুমকি ডাগর চোখে চাইল | বিদেশের পাত্তর তোকে পছন্দ করেছে রে পোড়ারমুখী ! বৌদি আজ আমায় ডেকেছিল | ওখান থেকেই আসছি | ছেলে পরশু তোকে দেখতে চায় ! সামনাসামনি দেখে পছন্দ হলেই বিয়ে ফাইনাল |
সারা রাত ধরে রুমকির ঘুম হল না | পরের দিন সকাল সকাল রুমকি বৌদির কাছে যেতেই বৌদি নিজের অল্পস্বল্প ব্যবহার করা একবাক্স কসমেটিকস ওর হাতে দিয়ে বলল, শোন এই দুদিন তোর ছুটি | নিজেকে ঘষেমেজে চকচকে কর | বিদেশে চাকরি করা ছেলের আমাদের মেয়েকে যেন অপছন্দ না হয় | বৌদির মুখে একথা শুনে রুমকি আহ্লাদে গলে গেল ! সেদিন থেকেই শুরু হল নিজেকে ঘষামাজার পালা | দুদিন বাদে নিজের বেস্ট ড্রেসটা পড়ে সেজেগুজে রুমকি যখন আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ও যেন নিজেই নিজেকে চিনতে পারে না ! কবে ও এত সুন্দরী হল ! গিয়ে দেখে ব্লু জিন্স, হোয়াইট শার্ট, রে-ব্যানের সানগ্লাস পড়া হ্যান্ডস্যাম প্রতুল রেস্টুরেন্টের সামনে মডেলের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে | আহা এ ওর বর হবে ! বৌদি আগেই ফোনে ওকে ছেলের ছবি দেখিয়েছে, বলে দিয়েছে ছেলের নাম প্রতুল রায় | রেস্টুরেন্টের আলোছায়ায় দুজনের আলাপ পরিচয় হল | রুমকি কাঁটাচামচে খেতে পারে না শুনে প্রতুল হাসল তুমি হাত দিয়েই খাও ! কোন অসুবিধা নেই | কাঁটাচামচের মধুর টুংটাংয়ের সঙ্গে প্রতুলের কাছ থেকে রুমকি উপহার হিসেবে পেল একটা দামী ব্যাগ ও একবাক্স বিদেশি চকোলেট | কথা হল এই রবিবার প্রতুলের বাবা-মা আসবেন রুমকিকে দেখতে !
বাড়ি ফিরে রুমকি তো ভয়ে মরে | এই এক চিলতে টালির ঘরে প্রতুল কোথায় বসবে ? প্রতুলের মা-বাবাই বা কোথায় বসবে ? ওদের খাওয়াবে কি ? সমস্যার সমাধান করে দিলেন বৌদি ! বললেন ওদের তিনজনকে আমার ফ্ল্যাটে আসতে বল | এখানেই রুমকির দেখাশোনা হবে | নির্দিষ্ট দিনে সপরিবারে প্রতুলরা বৌদির ফ্ল্যাটে এসে পড়ল | প্রতুলের মা-বাবার কি মিষ্টি ব্যবহার ! ছেলেও নম্র-ভদ্র | এমন ঘরে রুমকির বিয়ে হবে ? রুমকির মা আনন্দে পাগল হয়ে গেল | প্রতুলের মা আশির্বাদ করার সময় নিজের গলার বড় হারটা রুমকির গলায় পড়িয়ে দিলেন, আজ থেকে তুমি আমাদের | রুমকির হবু শ্বশুরমশাই বললেন, আমাদের ছেলের তামঝাম করে বিয়ে করা পছন্দ নয়, তাই বিয়েটা কেবল দুই পরিবারের উপস্থিতিতে হবে | বৌদিও থাকবেন নাহয় | পনেরো দিনের বাদে একটা ভালো বিয়ের দিন আছে, কথা হল সেইদিনই রুমকির সঙ্গে প্রতুলের বিয়ে হবে | বিয়ে করার দিন কয়েক বাদে প্রতুল রুমকিকে আমস্টারডামে উড়িয়ে নিয়ে যাবে | ওদের বিয়েটা আপাতত মন্দিরে হবে | প্রতুল বলল এ দেশের রেজেস্ট্রি বিয়ে তো বিদেশে গ্রাহ্য হবে না, তাই আমস্টারডামে পৌঁছে ওরা দুজন সেদেশের আইনানুসারে রেজেস্ট্রি বিয়েটা সেরে নেবে | কথা শেষ করে প্রতুলের মা-বাবা উঠে পড়লেন | আমটারডাম না কি জায়গা...অতদূরে কি রুমকির মা কখনো গেছে ? ও কেবল বৌদির দুহাত ধরে বলছিল ম্যাডাম আপনার দয়া জীবনে ভুলব না !
একটা মন্দিরে নমঃ নমঃ করে রুমকির বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে | বর-কনে-পুরোহিত ছাড়াও রয়েছে রুমকির মা, বৌদি, প্রতুলের মা-বাবা | হঠাৎ এক দল পুলিশ মন্দিরে ঢুকে পড়ল | অফিসার সোজা বৌদির দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ম্যাডাম এই মেয়ে পাচারের ব্যবসা কতদিন ধরে চালাচ্ছেন ? বৌদির মুখ নিমেষে লাল, আপনি কি বলছেন অফিসার ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না | থানায় গিয়ে থার্ড ডিগ্ৰী দিলেই সব বুঝতে পারবেন | পুলিশ অফিসার রুমকির মাকে বললেন, এই যে ছেলেটার সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন জানেন কি এর মা-বাবা সব সাজানো, থিয়েটার থেকে ভাড়া করে আনা | রুমেলা মুখার্জির ' ম্যারেজ ডট কম ' কোম্পানিটা নারী পাচারের সঙ্গে যুক্ত | এই প্রতুল ছেলেটা রুমেলা মুখার্জির কোম্পানিতে কাজ করে | এর নাম প্রতুল নয়, এর আসল নাম রণজিৎ বিশ্বাস | এর কাজ হল বড়লোক পাত্র সেজে গরীব মেয়েদের বিয়ে করা | মন্দিরে লোকদেখানো বিয়ের পর এরা মেয়েদের দেশে-বিদেশে পাচার করে দেয় | এদের হাত অনেক লম্বা | আমরা চেষ্টা করেও নাগাল পাচ্ছিলাম না | আপনার মেয়ে ভাগ্যিস কিছু একটা আঁচ করে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছিল | হাতকড়া পড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বৌদির জ্বলন্ত দৃষ্টিটা যেন রুমকিকে ভস্ম করে দিচ্ছিল | ওদের চারজনকে পুলিশ ভ্যানে তুলে ভ্যান থানার দিকে এগিয়ে চলল |
রুমকির দিকে চেয়ে ইন্সপেক্টর বললেন, আপনার কেন সন্দেহ হল এটা একটা ট্র্যাপ ? আসলে ওদের আশির্বাদের ধরণটা দেখে মনে হল গল্পটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে ! প্রতুল কেবল মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করতে চাইল, রেজিস্ট্রি করতে চাইল না | ভারতের রেজেস্ট্রি তো সবদেশেই স্বীকৃত ! আমার তখনই সন্দেহ হয়েছিল | ক্রাইম সিরিয়ালে এমনটাই দেখায় না ! আমিও কি তবে বিদেশে পাচার হতে চলেছি ? ব্যপারটা আমায় ভাবাচ্ছিল | আমি আমার বন্ধু দিলুর সঙ্গে প্রতুলের মায়ের দেওয়া আশির্বাদী হারটা পরীক্ষা করাতে সোনার দোকানে যাই | ওরা দেখেই বলে হারটা নকল ! আমার সন্দেহ দৃঢ় হয় | তারপরই আমি দিলুর সঙ্গে থানায় যাই আর আপনাকে সব কথা খুলে বলি |
অফিসার হাসলেন, আপনি বেশ বুদ্ধিমতী কিন্তু মনে রাখবেন এদের নেটওয়ার্ক ভীষণ স্ট্রং ! তাই কদিন একটু সাবধানে থাকবেন | আর চোখকান খোলা রাখবেন | অফিসার জিপের দিকে এগিয়ে গেলেন | রুমকির মা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন তুই দিলুকে ভালোবাসিস তাই না মা ! আমি ওর সঙ্গেই তোর বিয়ে দেব | দিলু একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল | রুমকির মায়ের কথা শুনে সামনে এগিয়ে এসে নীচু হয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল | গোধুলি নামছে চরাচর জুড়ে, সেই কনে দেখা আলোয় ওরা তিনজন ধীরপায়ে অদেখা ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল |
অনিন্দিতা
আজকাল রুমকি আর ফুটপাতের জামাকাপড় পড়ে না ! কেন পড়বে ? দুমাস আগে বৌদি নিজের বাতিল করা টাচস্ক্রিন মোবাইলটা ওকেই দিয়েছে যে ! দিলুর সঙ্গে গিয়ে একটা নতুন নম্বর নিয়েছে, প্রতিমাসে দিলু ওই নম্বরে রিচার্জ করিয়ে দেয় | কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে রুমকি শপিং অ্যাপে রকমারি সাজপোশাক দ্যাখে | কসমেটিকসও দ্যাখে | কত রকমারি ব্র্যান্ড, কত তার নাম ! বৌদির ফোনেই অ্যাপগুলো ইন্সটল করা ছিল | বৌদি তো এসব অ্যাপগুলো থেকেই নিজের রকমারি জামাকাপড়, কসমেটিকস কেনে | এই আজ ড্রেস আসছে তো, কাল বয়ফেন্ড জিন্স, পরশু আবার হুডা বিউটির কসমেটিক্স ! এখন বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নাম জেনে গেছে রুমকি ! বউদির ব্যবহার করা একটা লিপস্টিকের দাম আড়াই হাজার শুনে দিলু তো পড়েই যাচ্ছিল, বেচারার দশদিনের রোজগার বলে কথা ! আজকাল তো অর্ডার করলে হোম ডেলিভারিতে নামীদামী রেস্টুরেন্টের খাবার পর্যন্ত দিয়ে যায় | বৌদির কাছেই রুমকি প্রথম বড় হোটেলের সুস্বাদু বিরিয়ানি খেয়েছিল | বৌদি মাঝেমধ্যে ফুড অ্যাপে অর্ডার দেয় | রুমকিও ভাগ পায় | সেদিন মাসমাইনে পেয়ে অ্যাপ থেকে অর্ডার করে রুমকি দিলুকে বিরিয়ানি খাইয়েছে | চেটে চেটে দিলু তো হাতটা খেয়ে ফেলতেই বাকি রেখেছিল | সামনে বসে রুমকির যা হাসি পাচ্ছিল |
মা সেদিন বলছিল বৌদি নাকি পাত্র-পাত্রীর ব্যবসা করে | রুমকি শুনে অবাক হয়েছে | মেয়েরা আবার ঘটকালি করে নাকি ! মা বলল ব্যপারটা ঘটকালিই বটে তবে নাকি এ কাজে বাড়ি বাড়ি ঘুরতে হয় না | সব কাজ কম্পিউটারেই হয় ! দেশ-বিদেশ থেকে যেসব ছেলেমেয়েরা কলকাতায় বিয়ে করতে আসে, বৌদি নাকি তাঁদের পছন্দমত ছেলেমেয়ে খুঁজে দেয় | বিয়েটা সেরে তারা আবার যেখানে থাকে সেখানে হুশ করে উড়ে যায় ! ঘোষবাড়ির মেয়েটা কম্পিউটার নিয়ে পড়াশোনা করে ও রুমকির মাকে এসব কথা বুঝিয়ে বলেছে | রুমকির মাথায় তেল লাগাতে লাগাতে ওর মা বলছিল তুই তো সেকেন্ড ডিভিশনে মাধ্যমিক পাশ করলি | বৌদিকে বলেছি যদি তোর জন্য একটা সাদামাটা ছেলে খুঁজে দেয় | তাহলে অন্ততঃ তোকে আর আমার মত গতর খাটাতে হয় না | দেখতে শুনতে তো তুই মন্দ নোস ! পোশাক আশাকও ভালোই পড়িস ! কথাটা শুনেই রুমকির মনটা গভীর আনন্দে ভরে গেল | সত্যি যদি বৌদি ওর জন্য একটা ছেলে দেখে দেয় | তাহলে রুমকিও সারাদিন শপিং করবে আর পা থেকে মাথার নখ অবধি নিজেকে সাজিয়ে রাখবে |
একমাস, দু'মাস কেটে যায় | রুমকির বৌদি এ ব্যপারে তেমন একটা উচ্চবাচ্য করে না | ইতিমধ্যেই রুমকির মা ওর তিন/চারটে ভালো ছবি বৌদিকে দিয়ে এসেছে | কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না | ধীরে ধীরে রুমকির আশা মরে আসছে, ও বিশ্বাস করতে শুরু করেছে ওর কপালে মোটর মেকানিক দিলুই নাচছে | বৌদির বাড়ি থেকে ফিরে ভাঙা ঘরের এক কোণে বসে রাতের রুটি পাকাচ্ছিল রুমকি হঠাৎ দেখে মা হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকল | প্রতিদিন চার-পাঁচ বাড়ির কাজ সেরে ফেরা মায়ের ক্লান্ত মুখ দেখতেই রুমকি অভ্যস্ত ! সে মুখে হঠাৎ এমন হাসি দেখে রুমকি ডাগর চোখে চাইল | বিদেশের পাত্তর তোকে পছন্দ করেছে রে পোড়ারমুখী ! বৌদি আজ আমায় ডেকেছিল | ওখান থেকেই আসছি | ছেলে পরশু তোকে দেখতে চায় ! সামনাসামনি দেখে পছন্দ হলেই বিয়ে ফাইনাল |
সারা রাত ধরে রুমকির ঘুম হল না | পরের দিন সকাল সকাল রুমকি বৌদির কাছে যেতেই বৌদি নিজের অল্পস্বল্প ব্যবহার করা একবাক্স কসমেটিকস ওর হাতে দিয়ে বলল, শোন এই দুদিন তোর ছুটি | নিজেকে ঘষেমেজে চকচকে কর | বিদেশে চাকরি করা ছেলের আমাদের মেয়েকে যেন অপছন্দ না হয় | বৌদির মুখে একথা শুনে রুমকি আহ্লাদে গলে গেল ! সেদিন থেকেই শুরু হল নিজেকে ঘষামাজার পালা | দুদিন বাদে নিজের বেস্ট ড্রেসটা পড়ে সেজেগুজে রুমকি যখন আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ও যেন নিজেই নিজেকে চিনতে পারে না ! কবে ও এত সুন্দরী হল ! গিয়ে দেখে ব্লু জিন্স, হোয়াইট শার্ট, রে-ব্যানের সানগ্লাস পড়া হ্যান্ডস্যাম প্রতুল রেস্টুরেন্টের সামনে মডেলের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে | আহা এ ওর বর হবে ! বৌদি আগেই ফোনে ওকে ছেলের ছবি দেখিয়েছে, বলে দিয়েছে ছেলের নাম প্রতুল রায় | রেস্টুরেন্টের আলোছায়ায় দুজনের আলাপ পরিচয় হল | রুমকি কাঁটাচামচে খেতে পারে না শুনে প্রতুল হাসল তুমি হাত দিয়েই খাও ! কোন অসুবিধা নেই | কাঁটাচামচের মধুর টুংটাংয়ের সঙ্গে প্রতুলের কাছ থেকে রুমকি উপহার হিসেবে পেল একটা দামী ব্যাগ ও একবাক্স বিদেশি চকোলেট | কথা হল এই রবিবার প্রতুলের বাবা-মা আসবেন রুমকিকে দেখতে !
বাড়ি ফিরে রুমকি তো ভয়ে মরে | এই এক চিলতে টালির ঘরে প্রতুল কোথায় বসবে ? প্রতুলের মা-বাবাই বা কোথায় বসবে ? ওদের খাওয়াবে কি ? সমস্যার সমাধান করে দিলেন বৌদি ! বললেন ওদের তিনজনকে আমার ফ্ল্যাটে আসতে বল | এখানেই রুমকির দেখাশোনা হবে | নির্দিষ্ট দিনে সপরিবারে প্রতুলরা বৌদির ফ্ল্যাটে এসে পড়ল | প্রতুলের মা-বাবার কি মিষ্টি ব্যবহার ! ছেলেও নম্র-ভদ্র | এমন ঘরে রুমকির বিয়ে হবে ? রুমকির মা আনন্দে পাগল হয়ে গেল | প্রতুলের মা আশির্বাদ করার সময় নিজের গলার বড় হারটা রুমকির গলায় পড়িয়ে দিলেন, আজ থেকে তুমি আমাদের | রুমকির হবু শ্বশুরমশাই বললেন, আমাদের ছেলের তামঝাম করে বিয়ে করা পছন্দ নয়, তাই বিয়েটা কেবল দুই পরিবারের উপস্থিতিতে হবে | বৌদিও থাকবেন নাহয় | পনেরো দিনের বাদে একটা ভালো বিয়ের দিন আছে, কথা হল সেইদিনই রুমকির সঙ্গে প্রতুলের বিয়ে হবে | বিয়ে করার দিন কয়েক বাদে প্রতুল রুমকিকে আমস্টারডামে উড়িয়ে নিয়ে যাবে | ওদের বিয়েটা আপাতত মন্দিরে হবে | প্রতুল বলল এ দেশের রেজেস্ট্রি বিয়ে তো বিদেশে গ্রাহ্য হবে না, তাই আমস্টারডামে পৌঁছে ওরা দুজন সেদেশের আইনানুসারে রেজেস্ট্রি বিয়েটা সেরে নেবে | কথা শেষ করে প্রতুলের মা-বাবা উঠে পড়লেন | আমটারডাম না কি জায়গা...অতদূরে কি রুমকির মা কখনো গেছে ? ও কেবল বৌদির দুহাত ধরে বলছিল ম্যাডাম আপনার দয়া জীবনে ভুলব না !
একটা মন্দিরে নমঃ নমঃ করে রুমকির বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে | বর-কনে-পুরোহিত ছাড়াও রয়েছে রুমকির মা, বৌদি, প্রতুলের মা-বাবা | হঠাৎ এক দল পুলিশ মন্দিরে ঢুকে পড়ল | অফিসার সোজা বৌদির দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ম্যাডাম এই মেয়ে পাচারের ব্যবসা কতদিন ধরে চালাচ্ছেন ? বৌদির মুখ নিমেষে লাল, আপনি কি বলছেন অফিসার ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না | থানায় গিয়ে থার্ড ডিগ্ৰী দিলেই সব বুঝতে পারবেন | পুলিশ অফিসার রুমকির মাকে বললেন, এই যে ছেলেটার সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন জানেন কি এর মা-বাবা সব সাজানো, থিয়েটার থেকে ভাড়া করে আনা | রুমেলা মুখার্জির ' ম্যারেজ ডট কম ' কোম্পানিটা নারী পাচারের সঙ্গে যুক্ত | এই প্রতুল ছেলেটা রুমেলা মুখার্জির কোম্পানিতে কাজ করে | এর নাম প্রতুল নয়, এর আসল নাম রণজিৎ বিশ্বাস | এর কাজ হল বড়লোক পাত্র সেজে গরীব মেয়েদের বিয়ে করা | মন্দিরে লোকদেখানো বিয়ের পর এরা মেয়েদের দেশে-বিদেশে পাচার করে দেয় | এদের হাত অনেক লম্বা | আমরা চেষ্টা করেও নাগাল পাচ্ছিলাম না | আপনার মেয়ে ভাগ্যিস কিছু একটা আঁচ করে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছিল | হাতকড়া পড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বৌদির জ্বলন্ত দৃষ্টিটা যেন রুমকিকে ভস্ম করে দিচ্ছিল | ওদের চারজনকে পুলিশ ভ্যানে তুলে ভ্যান থানার দিকে এগিয়ে চলল |
রুমকির দিকে চেয়ে ইন্সপেক্টর বললেন, আপনার কেন সন্দেহ হল এটা একটা ট্র্যাপ ? আসলে ওদের আশির্বাদের ধরণটা দেখে মনে হল গল্পটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে ! প্রতুল কেবল মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করতে চাইল, রেজিস্ট্রি করতে চাইল না | ভারতের রেজেস্ট্রি তো সবদেশেই স্বীকৃত ! আমার তখনই সন্দেহ হয়েছিল | ক্রাইম সিরিয়ালে এমনটাই দেখায় না ! আমিও কি তবে বিদেশে পাচার হতে চলেছি ? ব্যপারটা আমায় ভাবাচ্ছিল | আমি আমার বন্ধু দিলুর সঙ্গে প্রতুলের মায়ের দেওয়া আশির্বাদী হারটা পরীক্ষা করাতে সোনার দোকানে যাই | ওরা দেখেই বলে হারটা নকল ! আমার সন্দেহ দৃঢ় হয় | তারপরই আমি দিলুর সঙ্গে থানায় যাই আর আপনাকে সব কথা খুলে বলি |
অফিসার হাসলেন, আপনি বেশ বুদ্ধিমতী কিন্তু মনে রাখবেন এদের নেটওয়ার্ক ভীষণ স্ট্রং ! তাই কদিন একটু সাবধানে থাকবেন | আর চোখকান খোলা রাখবেন | অফিসার জিপের দিকে এগিয়ে গেলেন | রুমকির মা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন তুই দিলুকে ভালোবাসিস তাই না মা ! আমি ওর সঙ্গেই তোর বিয়ে দেব | দিলু একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল | রুমকির মায়ের কথা শুনে সামনে এগিয়ে এসে নীচু হয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল | গোধুলি নামছে চরাচর জুড়ে, সেই কনে দেখা আলোয় ওরা তিনজন ধীরপায়ে অদেখা ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল |
অনিন্দিতা