Thread Rating:
  • 114 Vote(s) - 2.66 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
কিছু মনের সত্যি কথা
“ *শিল* *কাটাওওও* , *শিল* *কাটাওওও* ।”

দক্ষিন কলকাতার রাস্তায় সচরাচর শোনা যায় না এই আওয়াজটি। উত্তর কলকাতার ভাড়াবাড়ি ত্যাগ করে আবিররা যেদিন দক্ষিন কলকাতার দুই কামরার ফ্ল্যাট বাড়িতে আসল, তখন আবিরের পঞ্চাশোর্দ্ধ বয়সি মা সুমিতা পড়ল মহা বিপাকে। উত্তর কলকাতায় মানুষের কৌতুহলী মনোভাব, সুখে-অসুখে পাশে থাকা, এপাড়া-ওপাড়ার কুটকচালি তাকে ব্যস্ত রাখত সর্বদা। আর এখানে মানুষ অন্য মানুষের সাথে বিশেষ কোনো দিন ছাড়া কথা বলে না।
সুমিতা “শিল কাটাওওও” শুনে নিজের খুশি আর ধরে রাখতে পারল না। প্রায় একবছর হয়ে গেল শিলটা কাটানো হয়নি। স্বামী-ছেলের শতবার বলা সত্ত্বেও সুমিতা মিক্সি ব্যবহার করে না।
“শিল কাটাওওও, শিল …”
“এই শিল, একটু উপরে এসো না?”
“শিল কাটাওওও” ডাক বন্ধ হল। একজন শীর্ণ বুড়ো লোক হাতে চটের ব্যাগ ঝুলিয়ে তাকাল চারদিকে। দেখতে পেল তিনতলার বারান্দা থেকে তার ডাক পড়েছে।
সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসে বুড়োটি বসে পড়ল তিনতলায় সিঁড়ির ঠিক কাছটায়। সুমিতা তাকে অনুরোধ করে ভেতরে আসতে বললে প্রথমে সংকোচ করলেও সে সুমিতার অনুরোধ ফেলতে পারল না। সুমিতা শিল আর নোড়া এনে দিলে জল ছিটিয়ে নিপুন হাতে তাতে করতে লাগল নকশাকাটা কাজ। মনে হল লোকটা কথা বলতে জানে না, হাতেই তার কথা বেরোয়।
“এই নিন মা। দেখুন ঠিক হয়েছে কিনা।”
সুমিতা হাত বাড়িয়ে নিল সদ্য নকশাকাটা শিল আর নোড়া। বুড়ো লোকটি তার জিনিসপত্র ব্যাগে গুছিয়ে অপেক্ষা করছে টাকার জন্য। দেখতে পেল সুমিতা নিয়ে এল একটি প্লেটে করে দুটি লাল বাতাসা আর এক গ্লাস জল। একটু অবাক হল লোকটি এই ভেবে যে, তার পারিশ্রমিক যদি এটা হয় তাহলে তো তার এতক্ষণের কষ্ট বৃথা যাবে।”
“আচ্ছা, তোমার মজুরি কত?”-সুমিতা এগিয়ে দিল বাতাসার প্লেট আর জল।
আশ্বস্ত হল লোকটি। সে তার মজুরি জানিয়ে খেতে লাগল বাতাসা আর জল। মনে মনে আশীর্বাদ জানালো সুমিতাকে। সকালের জলখাবারের খরচ বেঁচে গেল তার।
মজুরি মিটিয়ে সুমিতা বলল –“আবার ঠিক তিনমাস পরে এসো। তোমার কাছেই কাটাবো কিন্তু”।
শীর্ণকায় বুড়ো লোকটি মাথা নাড়িয়ে চলে গেল।
এরপর মাঝে মাঝেই সুমিতা “শিল কাটাও, শিল কাটাও” শুনতে পায়। ডাক পেলেই বারান্দায় এসে দেখতে পায় বুড়ো লোকটিকে। শেষপর্যন্ত যতদূর দেখা যায় দেখতে থাকে। ঠিক তিনমাস পরে লোকটি নিজেই বেল বাজিয়ে শিলটা কাটিয়ে দিয়ে চলে গেল। খেয়ে গেল বাতাসা আর জল।
পরেরদিন একইভাবে সুমিতা “শিল কাটাও” ডাকের অধির অপেক্ষায় বসে থেকেও ডাকটি শুনতে পেল না। একইভাবে কেটে গেল একমাস। নাঃ, পাচ্ছে না তো সেই বিকৃত গলায় “শিল কাটাও, শিল কাটাও?” তাহলে কি কিছু হল বুড়ো মানুষটার? প্রতিদিনের শিল-নোড়ায় মশলা বাটা মনে করিয়ে দিতে লাগল তাকে মানুষটার কথা।

“শিল কাটাওও, শিল কাটাওওও”।
আরো প্রায় দুমাস পর সুমিতা শুনতে পেল এই ডাক। ছুটে গেল বারান্দায়। খুঁজে পেল না হাতে চটের ব্যাগ নিয়ে চলা বুড়ো লোকটাকে। রাস্তার এদিক-ওদিক খেয়াল করার পর দেখল একটি ত্রিশ-বত্রিশ বছর বয়সি ভালো স্বাস্থ্যের ছেলে “শিল কাটাও” ডাক দিতে দিতে যাচ্ছে। সুমিতা তাকে ডাকবে মনস্থির করতেই দেখতে পেল সেই ছেলেটি ঢুকছে তাদের বিল্ডিংএর গেট দিয়ে। ফ্ল্যাটের বেল বাজার পরে সুমিতা দরজা খুলতেই শুনতে পেল হাসি হাসি মুখ করে ছেলেটি তাকে বলছে “মা, আপনার শিল কাটানোর সময় হয়ে গেছে না?”
একটু অবাক হল সুমিতা। বলল- “হ্যাঁ, কিন্তু আমার শিল-নোড়া তো একজন বয়স্ক মানুষ কেটে দিয়ে যায়। অনেকদিন আসছে না।”
“মা, আমি তারই ছেলে। বাবা তো আর আসবে না?”
বুকটা একটু ধড়াস করে উঠল সুমিতার। বলল –“কেন? কি হয়েছে তার?”
হাসল ছেলেটি। বলল-“কিছু হয়নি মা। আমার বাবা কাজ থেকে ছুটি নিয়েছে।
সুমিতার মনটা দমে গেল একটু। বলল –“ওঃ, তার বদলে তুমি কাজ করবে?”
“না মা। শুধুই আপনার বাড়িটা করব। আজকাল আর কতজন শিল-নোড়া কাটে? কিন্তু, বাবা বলল আপনি নাকি ভালোবাসেন শিল-নোড়াকে। তাই শুধু আপনারটাই করে দেব। আর সেদিন যদি আর কেউ ডাকে তো তাদেরটাও করে দেব।”
সুমিতা একটু অবাক হল। বলল –“তাতে তোমার, বাবার চলবে কি করে?”
ছেলেটি আবার হেসে ফেলল - “শিল-নোড়া কেটেই বাবা সংসার চালাত আর মা লোকের বাড়ি কাজ করে। নিজেরা কিছু না খেয়ে আমার মুখে খাবার তুলে দিত যাতে আমি পড়াশোনা করে মানুষ হতে পারি। গ্রামের পৈত্রিক ভিটে *বিক্রি* করে আমাকে *মাস্টার* *ডিগ্রি* পর্যন্ত পড়াল। আমি কিছুমাস আগেই রেলে চাকরি পেয়েছি। এতবছর যাদের চোখের সামনে মুখে রক্ত তুলে খাটতে দেখেছি, তাদের কি আবার এত পরিশ্রমের কাজ করতে দেখলে ভালো লাগে? আর এখন তো তাদের বিশ্রামের সময়।”
সুমিতা ছেলেটিকে ঘরে ডাকল। ছেলেটি বসে পড়ল দোরগোড়ায় ঠিক তার বাবার মতন। সুমিতা শিল আর নোড়া এনে দিলে টের পেল রক্ত কথা বলছে। কাজ শেষ হয়ে গেলে সুমিতা তাকেও একটি প্লেটে বাতাসা আর এক গ্লাস জল এগিয়ে দিলে সে ঠিক তার বাবার মতন আয়েশ করে বাতাসা খেয়ে ঢকঢক করে জল খেয়ে নিল।
যাওয়ার আগে বলল –“তাহলে মা আসি? আবার ঠিক তিনমাস পরে আসব।”
সুমিতা বলল –“তুমি রেলে চাকরি পেয়েও শিল কাটছ কেন? এতে তো তোমার সম্মানে লাগতে পারে।”
“মা, এই *শিল* *কাটানোটাই* তো *আমাকে* *পড়িয়েছে* , *রেলে* *চাকরি* দিয়েছে। আর রেলে তো আমরা সরকারের চাকর। সেখানে সরকার আমাদের শুধু টাকা দেয়। আর আপনি টাকাও দিলেন আবার ভালোবাসাও দিলেন। তাহলে কোনটা সম্মানের বলুন মা? আর বাবা বলে, শিল কাটানোটা বাঙালি রন্ধনশিল্পের ঐতিহ্য। মশলা পাথরের সঙ্গে মিশে একটি অপূর্ব গন্ধ তৈরী করে যা রান্নার গুণ আরো বাড়িয়ে দেয়। তাই আপনার মতন কিছু মানুষ যতদিন আছেন ততদিন আমরাও আছি। আর বাবার শিল্পী গুণকে মর্যাদা ছেলে ছাড়া আর কে দেবে বলুন?”
মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল সুমিতা। ছেলেটি আজ্ঞা নিয়ে দ্রুতপায়ে নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে। দরজা বন্ধ করে সুমিতা ধীরপায়ে গেল বারান্দার দিকে।
“শিল কাটাওওও, শিল কাটাওও, শীল কাটাওওও, শীল কাটাওওও” ডাকটা কি আর বাঙ্গালী শুনতে পাবে আর কিছু বছর পরেও?’
[+] 1 user Likes আমিও_মানুষ's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: কিছু মনের সত্যি কথা - by আমিও_মানুষ - 25-04-2023, 08:35 PM



Users browsing this thread: 17 Guest(s)