18-04-2023, 09:51 PM
দ্বিতীয় পার্ট
২য় পর্ব
"ওই ছেলেটা যখন আমার পায়ে হাত দিল তখন কেমন যেন একটা অদ্ভুত ফিলিংস হলো, যেন মনে হলো.."
"কি মনে হলো?"
"মনে হলো যেন খুব কাছের একজন পায়ে হাত দিয়েছে"
"কাছের একজন?"
"হ্যাঁ, যেন মনে হলো অনি আমার পায়ে হাত দিয়েছে"
"অনি মানে তোমার ওই কাজিনটি যে ঘুরতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়?"
"হ্যাঁ, জানিনা কেন মনে হলো আমার"
"দেখো আমার সাথে কখনো তোমার এই ভাইটির আলাপ হয়নি তাই আমি ওকে চিনি না, কিন্তু ও তো মারা গেছে তাহলে?"
"সেটাই তো ভাবছি"
"হয়তো এটা তোমার মনের ভুল"
"তাই কি?"
"একদমই, এবার চলো ঘুমানোর সময় হয়ে গেছে"।
সুনন্দা কিন্তু স্বামীর কথা শুনে চেয়ার ছেড়ে উঠলো না, উল্টে সে কথা বলতে শুরু করলো,
"জানো আমাদের পরিবারের অনেকেই অনিকে ব্ল্যাক শিপ বলতো"
"ব্ল্যাক শিপ?"
"হ্যাঁ, আসলে ছোটো থেকেই সবাই অরুদাকে বেশী ভালোবাসতো। অরুদা বরাবরই ভালো ছিল এবং সেটা সবকিছুতেই পড়াশোনা তো ছিলই এছাড়া কথাবার্তা, আচার ব্যবহার সবেতেই ভদ্র, শান্ত, নম্র ছিল সেইজন্যই সবাই ওকেই বেশী ভালোবাসতো, প্রশ্রয় দিত ওকে নিয়েই সবাই বেশী আলোচনা করতো, অপরদিকে অনি, ও পড়াশোনাতে খারাপ ছিল না, খেলাধুলাতেও ভালো ছিল, খুব সুন্দর ছবি আঁকতো কিন্তু শান্ত আর নম্র ছিল না, কারো মুখের উপরে সত্যি বলতে ভয় পেতো না সেটা যেই হোক"
"তার মানে অভদ্র ছিল?"
"না অভদ্র নয়, কারো সাথে কখনো অভদ্র কিছু করেনি কিন্তু কারো মন জুগিয়ে চলা ওর ধাতে ছিল না, আর প্রচণ্ড রাগী ছিল"
"শুনেছি তোমার সাথে প্রায়ই লড়াই করতো"
"ঠিক লড়াই নয় ভাইবোনের মধ্যে তো টুকটাক হয়ই সেরকমই, আমি ছোটো থেকেই মাটি বা মোম দিয়ে পুতুল, মূর্তি বানাই"
"হ্যাঁ, এখনো তুমি খুব সুন্দর বানাও"
"ছোটোবেলায় যখন আমি বানাতাম তখন অনি এসে আমাকে ডিসটার্ব করতো নয়তো ঘেটে দিত এইসব, এছাড়া আমার খুব কাছের ছিল ও আমার সাথে ঝগড়া করতো আবার আমাকে কেউ বিরক্ত করলে তার পিছনে কুকুর লেলিয়ে দিত"
"কুকুর?"
"হ্যাঁ, তুমি তো জানো এই বাড়িটা পিসেমশাইদের ছিল, এখানেই ওনারা থাকতেন"।
"হ্যা, নতুন বাড়ি করে ওনারা ওখানে চলে যান আর আমাদের বিয়ের সময় এটা তোমাকে উপহার দেন"।
"হ্যাঁ, আমি তো বেশিরভাগ সময় এখানেই থাকতাম আমি দেখতাম পাড়ার প্রায় সব কুকুর অনির ভক্ত ছিল, অনি ওদের খেতে দিত দেখভাল করতো আর কেউ ওকে বিরক্ত করলে ও কুকুরগুলোকে লেলিয়ে দিত, একবার রাস্তার কয়েকটা বখাটে ছেলে কলেজে যাওয়ার পথে আমাকে টোন কেটেছিল অনি সেটা দেখেছিল সেদিন বিকেলে ও ওর পুরো কুকুরের দল নিয়ে তাড়া করিয়ে পুরো পাড়া ওদের দৌড় করিয়েছিল"।
"খুব ডেঞ্জারাস ছিল তো?"
"শুধুমাত্র তাদেরই ও কুকুর লেলিয়ে দিত যারা ওকে বা পরিবারের কাউকে বিরক্ত করতো, এছাড়া কারো ক্ষতি করেনি কখনো, পিসির বাড়ির টোবোকে তো দেখেছো?"
"মানে ব্যানার্জী ম্যানসনের ওই কুকুরটা?"
"হ্যাঁ, ওটাকে অনিই কোথা থেকে জানি জোগাড় করে নিয়ে আসে একদম বাচ্চা অবস্থায়, নিজে হাতে ওর যত্নআত্তি করতো, কুকুর খুব পছন্দ করতো আর কুকুররাও ওকে পছন্দ করতো"।
"গুণ ছিল তার মানে?"
"হ্যাঁ, বললাম না খুব সুন্দর ছবি আঁকতো, খেলাধুলা বিশেষ করে ফুটবলে ভালো ছিল"
"মানে বলতে চাইছো এত গুণ থাকা সত্ত্বেও অরু দার ছায়ায় ঢাকা পরে যেত?"
"ওই যে অরুণাভ ব্যানার্জীর চার্ম যেটা অল্প বয়স থেকেই সবার উপরে প্রভাব ফেলেছিল,কিন্তু অরুদা ওকে কেন যেন ঠিক পছন্দ করতো না, সবসময় ওকে ভয় দেখাতো, ওর নামে বড়োদের কাছে কমপ্লেন করে বকা খাওয়াতো এমনকি ছোটোখাটো কিছু ভুলের জন্য মারও খেয়েছে অনি। তাছাড়া অনি যদি কিছু পছন্দ করে নিত যেমন কাপড় বা জুতো বা অন্য কিছু তাহলেও অরুদারও সেটা চাই নাহলে ও অনিরটা নিয়ে নিত।"
"কেউ কিছু বলতো না?"
"না, বললাম না সবাই অরুদাকে একটু বেশীই ভালোবাসতো একটু বেশি প্রশ্রয় দিত সবার চোখে অরুদা একেবারে যাকে বলে সোনার টুকরো ছেলে এবং সেটা এখনও আছে আর অনিও কাউকে খুব একটা কিছু জানাতো না"
"কেন?"
"খুব অভিমানী ছেলে ছিল, চুপ করে সব সহ্য করতো আমিই তো কত কমপ্লেন করতাম ও বকা খেতো আর তখন চুপ করে নিজের কুকুরগুলোর কাছে চলে যেত"।
"কুকুরদের কাছে যেত?"
"হ্যাঁ, ওই কুকুরগুলোই ওর সবথেকে কাছের বন্ধু ছিল ওকে সঙ্গ দিত, ওকে পাহারা দিত"
"পাহারা?"
"হ্যাঁ, এরকম অনেকদিন হয়েছে যে অরুদা বা আমার বা সুশান্তর কমপ্লেনের জন্য ও বকা খেয়েছে এমনকি পিসির কাছে তো মারও খেত তারপর কাউকে কোনো কথা না বলে চুপচাপ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যেত, ঘন্টার পর ঘন্টা বাইরে কাটাতো কুকুরদের সাথে শেষে একাই ফিরে আসতো বা কখনো পিসি বা আমি গিয়ে নিয়ে আসতাম"।
"তুমি সত্যিই ওকে বকা খাওয়াতে?"
"তখন ছোটো ছিলাম, ও আমার সাথে দুষ্টুমি করতো খুব রাগ হতো তাই পিসিকে নালিশ করতাম, ও যখন বকা খেতো তখন প্রথমে খুব মজা লাগতো কিন্তু পরে খারাপ লাগতো এমনিতে বাড়িতে খুব একটা থাকতো না কলেজ, কোচিং খেলাধুলা নিজের আলাদা একটা জগত তৈরি করে নিয়েছিল তার বাইরে আমার সাথেই মিশতো কিন্তু ওর দুষ্টুমির জন্য তখন বুঝতাম না কিন্তু এখন ওকে হারানোর পর বুঝি কি হারিয়েছি?"
"ওর কি হয়েছিল কিছু জানো?"
"না, অরুদা, আর মৌমিতা বৌদির সাথে গ্যাংটকে ঘুরতে গিয়েছিল কিন্তু হটাৎ অরুদা ফোন করে জানায় যে অনি রুমটেক মঠের পিছনে খাদে পরে গেছে"
"কিভাবে কিছু বলেনি?"
"না, বললো ওখানে সেদিন রাতে কুয়াশা ছিল ওরা মঠে ঘুরতে গিয়েছিল আর একটা কি অনুষ্ঠান ছিল সেটা দেখতে গিয়েছিল সেদিন অনি ওখানে কি করতে গিয়েছিল তা জানেনা, ওরা সেদিন মঠে কি একটা অনুষ্ঠান হচ্ছিল সেটাই দেখছিল হটাৎ একজন এসে জানায় কেউ একজন খাদে পরে গেছে তার চিৎকার শোনা গিয়েছিল, সেই শুনে সবাই যায়"
"তারপর?"
"কিছুটা নীচে অনির জামার ছেঁড়া টুকরো পাওয়া যায় যাতে রক্ত লেগে ছিলকিন্তু অনিকে পাওয়া যায়নি, রক্ত পরীক্ষা করে জানা যায় ওটা অনিরই রক্ত লেগে ছিল জামার টুকরোতে"।
"পুলিশ এনকোয়ারি করেনি?"
"করেছিল"
"কিছু সন্দেহজনক পেয়েছিল?"
"না, তুমি যা মিন করছো অর্থাৎ খুন তেমন প্রমাণ পায়নি তাই অ্যাক্সিডেন্ট বলে ক্লোজ করে দেয়"।
"তোমার কি মনে হয় ওটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিল?"
"জানিনা, তবে এটুকু জানি অনি অত অসাবধান ছিল না, যদি ধরেও নিই যে একাই খাদের ধারে গিয়েছিল তাহলেও খুব সাবধানেই চলাফেরা করার ছেলে ও"।
"ছাড়ো এই নিয়ে আর মনখারাপ কোরো না"
"আমি চাইনি কিন্তু সকালে যখন ওই ছেলেটা আমাকে প্রণাম করলো তখন.."
"সকালে যে এসেছিল সে তোমার ভাই অনি নয় ওটা তোমার মনের ভুল এখন ঘুমাতে চলো জানোই তো আমার পাশে আমার মেয়ে আর বউ না থাকলে আমার ঘুম হয়না" কথাটা বলে মৈনাক স্ত্রীকে দুহাতে কোলে তুলে বেডরুমের দিকে চলে গেল।
বাইপাস হাইওয়ে ধরে রুবির দিকে যাওয়ার আগে মুকুন্দপুর পার করে কিছুটা গিয়ে বাঁদিকে ছোটো একটা রাস্তা ধরে মিনিট তিরিশেক গিয়ে আবার একটা কাঁচা রাস্তা আছে সেটা দিয়ে কিছুদূর গিয়ে একটা অর্ধ সমাপ্ত বাড়ির সামনে একটা সিলভার রঙের হন্ডাসিটি এসে দাঁড়ালো আর তার পিছন পিছনই আরেকটা নীল রঙের মারুতি সুজুকিও এসে দাঁড়ালো, বাড়িটা কেউ তৈরি শুরু করেও শেষ করেনি অর্ধেক শেষ করে বন্ধ করে দিয়েছে বা করতে বাধ্য হয়েছে।
প্রথমটা গাড়িটা থেকে যিনি নামলেন তার পরনে সিলভার রঙের ব্লেজার ও ট্রাউজারস্, ব্লেজারের ভিতরে সাদা রঙের শার্ট, আর নীল সাদা টাই, হাতে দামী ঘড়ি, পায়ে কালো বুটটাও দামি এনাকে কলকাতার মোটামুটি সবাই চেনে বিশেষ করে ফ্যাশন দুনিয়ার সবাই চেনে ইনি অরুণাভ ব্যানার্জী, ব্যানার্জী ক্রিয়েশনস্ এর মালিক অভিরূপ ব্যানার্জীর ছেলে। আর দ্বিতীয় গাড়িটা থেকে যিনি নামলেন তাকেও প্রায় সবাই চেনে ইনি অরুণাভ ব্যানার্জীর স্ত্রী মৌমিতা ব্যানার্জী তার পরনে একটা নীল রঙের সিল্কের শাড়ি সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ, চোখে গগলস্, মাথায় চুলটা খোঁপা করে বাঁধা পায়ে উঁচু হিলওয়ালা জুতো।
এই দুজনকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে বাড়ির ভিতর থেকে আরও একজন শ্যামলা, ২৮-৩০ বছরের যুবক হাসতে হাসতে বেরিয়ে এল, "এইতো তোমরা এসে গেছো, কি ব্যাপার তোমরা আলাদা আলাদা গাড়িতে?"
"কারণ আমরা আলাদা আলাদা বেরিয়েছি তাই" অরুণাভ বাবু উত্তর দেন,
"কিন্তু আমাদের গেস্ট কোথায় ভাই?" মৌমিতা এবার প্রশ্ন করে, উত্তরে সামনের যুবকটির মুখে একটা ক্রুর হাসি দেখা যায় সে বলে "ভিতরে আছে দিদি, খুব খাতিরযত্ন করেছি চল গিয়ে দেখবি"।
তিনজনে ভিতরে ঢুকলো যুবকটি দুজনকে নিয়ে একটা ফাঁকা ঘরে ঢুকলো এখানে আরও কয়েকজন গুণ্ডা প্রকৃতির লোক দাঁড়িয়ে আছে, এছাড়া আরও একজন আছে যাকে ঘরের মাঝখানে একটা চেয়ারে বেঁধে রাখা হয়েছে, ঠোঁট ফেটে রক্ত পরছে, চোখের নীচে কালশিটে দাগ এছাড়া আরো কয়েকটা আঘাতের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে, লোকটিকে যে যথেষ্ট মারধর করা হয়েছে সেটা বলে কাউকে বলে দিতে হয় না।
"শালাবাবু, তুমি তো দেখছি ভালোই যত্ন করেছো?"
লোকটার অবস্থা দেখে হেসে কথাটা বলে অরুণাভ ব্যানার্জী, বোধহয় তারই আওয়াজ শুনতে পেরে চেয়ারে থাকা লোকটা অতিকষ্টে তাকালো তারপর মুখটা ঘৃনা ও যন্ত্রনায় বিকৃত করে নীচে কিছুটা থুতু ফেললো যদিও তাতে রক্তের পরিমাণই বেশী।
"কেমন আছেন?"
অরুণাভ ব্যানার্জী ব্যাঙ্গের স্বরে লোকটাকে প্রশ্ন করলো কিন্তু লোকটা কোনো উত্তর দেয় না সে ঘৃণাভরে তাকিয়ে থাকে।
"আমাকে চিনতে পারছেন নাকি মনোজের যত্নে সেটা পারছেন না?"
এবারও লোকটা অরুণাভর কথার উত্তর না দিয়ে চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, অরুণাভ আবার কথা বলে,
"কেন আমার পিছনে লাগতে গেলেন বলুন তো?-কি ভেবেছিলেন আমার বিরুদ্ধে গিয়ে পার পেয়ে যাবেন?" আবার কথা বলেন অরুণাভ ব্যানার্জী, এবার লোকটা কথা বলে,
"আমাকে মারলেও আপনি বাঁচতে পারবেন না মিস্টার ব্যানার্জী"
"কে মারবে আমাকে?"
"কেউ না কেউ তো নিশ্চয়ই আসবে যে আপনাকে উপযুক্ত শাস্তি দেবে"।
কথাটা শুনে অরুণাভ ব্যানার্জী সহ উপস্থিত বাকিরা হো হো করে হেসে উঠলো।
"এই যেমন আপনি এসেছিলেন? আমি তো আপনার কোনো ক্ষতি করিনি তাহলে হটাৎ আমার পিছনে লাগতে গেলেন কেন?" অরুণাভ ব্যানার্জী আবার ব্যাঙ্গ করে, কিন্তু এবারে লোকটা চুপ করে থাকে। "আচ্ছা আমাদের পিছনে লাগার সাহস কোথা থেকে পেয়েছিলেন বলুন তো? মানে আপনার সাথে আর কারা আছেন?" আবার প্রশ্ন করেন অরুণাভ ব্যানার্জী কিন্তু লোকটা তাও চুপ করে থাকে, আবার কথা বলেন অরুণাভ ব্যানার্জী,
"দেখুন আপনাকে তো আমি মারবোই, তাই যাওয়ার আগে অন্তত সত্যি বলে যান"
কিন্তু লোকটা তবুও কথা বলে না শুরু ঘৃণাভরে তাকিয়ে থাকে আর আবার একটু রক্তাক্ত থুতু ফেলে। একটু পরে লোকটা মুখ খোলে,
"আজ আপনি আমাকে মেরে ফেলতেই পারেন কিন্তু যেটা মনে রাখবেন আপনিও বাঁচতে পারবেন না, আপনার আর আপনার স্ত্রীয়ের এবং আপনার শ্বশুরের অপরাধের লম্বা লিস্ট তৈরী হয়ে আছে শাস্তি আপনাদের পেতেই হবে"।
"লিস্ট তো নাহয় তৈরী করলেন কিন্তু প্রমাণ কোথায়? প্রমাণ ছাড়া আদালত শাস্তি দেয় না এটুকু জানেন না?"
"আদালত কেন? আপনার বাবা আছেন তো? একবার যদি আপনার কুকীর্তির কথা উনি জানতে পারেন তাহলে উনিই আপনাকে শাস্তি দেবেন"
"আপনার সত্যিই মনে হয় যে আমার বাবা আমার কথা বিশ্বাস না করে বাইরের লোকের কথা বিশ্বাস করবে? সেটাও আবার আমার বিরুদ্ধে?"
এই কথা শুনে প্রথমে লোকটার মুখ একটু ছোটো হয়ে এলেও পরক্ষণেই আবার শুকনো হাসি ফুটে উঠলো একবার যন্ত্রনায় মুখটা বেঁকে গেল তারপর অনেক কষ্টে বললেন,
"উনি ঈশ্বরতুল্য মানুষ, কখনো অন্যায়ের সাথে আপস করেননি, আজও করবেন না, আমাদের বিশ্বাস আছে ওনার উপরে"।
"কিন্তু ওনাকে বলবে কে? মানে আপনাকে তো আর বাঁচিয়ে রাখবো না আর আপনার সাথে যেকজন ছিল তাদেরও একে একে শেষ করে দেবো তাহলে আমার বাবাকে বলবে কে?"
অরুণাভর কথা শুনে লোকটা হতবাক হয়ে চুপ করে যায়, অরুণাভ ব্যানার্জী আবার কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তাকে হতবাক করে দিয়ে একটা ছুরি সোজা লোকটার বুকের বাঁদিকে হৃৎপিণ্ড বরাবর গেঁথে যায় আর লোকটার মুখ দিয়ে একটা আর্তনাদ বেরোনোর সাথে সাথে মাথাটা বুকের উপরে ঝুঁকে পড়ে।
অরুণাভ ব্যানার্জী অবাক হয়ে দেখেন ছুরিটা যে চালিয়েছে সে আর কেউ নয় তার স্ত্রী মৌমিতা, স্বামীর হতবাক ভাব দেখে মৌমিতা একটু ক্রুর হাসি হেসে বলে "তুমি করতে লেট করছিলে তাই আমি করে দিলাম এমনিতেও একে বেশীক্ষণ বাঁচিয়ে রেখে লাভ কি? শুধু সময় নষ্ট তাই আমি তাড়াতাড়ি করে দিলাম"।
"তুমি আর পাল্টালে না"
"আমি এরকমই, নিজেকে পাল্টানোর কোনো ইচ্ছা আমার নেই"
"এইজন্যই তোমাকে এত ভালো লাগে"
স্বামী-স্ত্রী একসাথে হেসে ওঠে কিন্তু সেখানে উপস্থিত বাকিদের হতবিহ্বল ভাবটা তখনও কাটেনি সেটা দেখেই মৌমিতা নিজের ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললো "এভাবে কি দেখছিস ভাই? আমি এরকমই এবার এই লাশটার ব্যবস্থা তুই কর আমরা আসছি"।
মৌমিতার ভাইয়ের নাম মনোজ, পুরো নাম মনোজ দত্ত সে হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে বলে,
"সেটা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না আমি ম্যানেজ করে নেবো"।
"তুমি পারবে তো শালাবাবু?"
"আজ পর্যন্ত ভুল হয়েছে?"
"না সেটা হয়নি"
"তাহলে? ভালো কথা বাবা একবার তোমাদের দুজনের সাথে দেখা করতে চেয়েছেন"
"বাবা দেখা করতে চেয়েছেন, কই উনি তো ফোন করেননি" মৌমিতা অবাক হয় ভাইয়ের কথা শুনে, অরুণাভ ব্যানার্জী ও অবাক হয়,
"কি ব্যাপারে কিছু বলেছেন শালাবাবু?"
""না, জামাইবাবু তবে তোমরা যাও না বাড়িতেই আছেন, আমিও যাচ্ছি"
"ঠিক আছে, তুমিও কাজটা সেরে চলে এসো" অরুণাভ আর মৌমিতা ব্যানার্জী বেরিয়ে যান।
মৌমিতা আর মনোজ দক্ষিণ কলকাতার একজন নামকরা প্রোমোটার মনোজিত দত্তের সন্তান। মনোজিত দত্ত একজন প্রোমোটার ঠিকই কিন্তু প্রোমোটারি ছাড়াও তার আরও অনেক ব্যাবসা আছে যআর মধ্যে আবার দুনম্বরি ব্যাবসাও আছে, সেই ব্যাবসায় তার মেয়ে আর ছেলে সমান অংশীদার। শহরের একাধিক গুণ্ডা মস্তান তার হয়ে কাজ করে, কিন্তু তার প্রধান ক্ষমতার উৎস তার জামাই অরুণাভ ব্যানার্জী।
শুধু দক্ষিণ কলকাতায় নয় পুরো কলকাতা জুড়ে এমনকি কলকাতার বাইরেও অনেক জায়গায় "ব্যানার্জী ক্রিয়েশনস্" এর নাম ছড়িয়েছে বিশেষ করে টালিগঞ্জের ফিল্ম লাইনে যাবতীয় কস্টিউম বা ফ্যাশনের জিনিস এরাই স্পন্সর করে এছাড়া শহরের বিভিন্ন ফ্যাশন ইভেন্টও এরাই করে,বলা চলে কলকাতা এবং তার পার্শ্ববর্তী বেশ কয়েকটা শহরের ফ্যাশন দুনিয়ার একচ্ছত্র অধিপতি এই "ব্যানার্জী ক্রিয়েশনস্"।
কিন্তু অরুণাভ ব্যানার্জী এতে সন্তুষ্ট নয় তার আরও চাই আর এই "আরও চাই" এর চাহিদা মেটানোর জন্যই সে অন্যান্য অনেক ব্যাবসায় জড়িয়ে পরে, ক্রমে পলিট্যিকাল লাইনেও তার ক্ষমতা বিস্তার করে যদিও নিজে সরাসরি জড়িত নয় কিন্তু যখনই দরকার পরে কোনো না কোনো পলিট্যিকাল এরিয়ার লোক ঠিক হাজির হয়ে যায়। ক্রমে নিজের শ্বশুরের দুনম্বরি ব্যাবসাতেও জড়িয়ে পরে কিন্তু রাজনৈতিক যোগাযোগের জন্যই হোক বা "ব্যানার্জী ক্রিয়েশনস্" এর মালিক অভিরূপ ব্যানার্জীর গুড উইলের জন্যই হোক এখনো আইনের জালে জড়িয়ে পরেননি তাই দিন দিন সাহস যেমন বেড়েছে তেমনি বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন আর ক্ষমতাও বাড়িয়ে নিয়েছেন।
দেশপ্রিয় পার্ক থেকে একটু দূরে আধঘন্টার হাঁটা পথের মতো দূরত্বে মনোজিত দত্তের নিজস্ব বহুতল আবাসন "দত্ত অ্যাপার্টমেন্ট যেখানে এখন মনোজিত বাবু থাকেন, এই কয়েকবছর হলো এখানে পুরনো একতলা বাড়ি কিনে সেটাকেই নতুন করে নিজের পছন্দমতো বাড়িয়ে নিয়েছেন, এর আগে তিনি ঢাকুরিয়াতেই থাকতেন অভিরূপবাবুদের বাড়ির কাছেই পরে এখানে চলে আসেন।
মনোজিত বাবুর বাড়ির নীচে ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই অরুণাভ ও মৌমিতা দুজনেই থমকে গেল কারণ সেখানে মনোজিত বাবুর সাথে আরও একজন বসে আছেন, যাকে এরা দুজন এখানে আশা করেননি। অরুণাভ এবং মৌমিতা দুজনের মুখ দেখে বোঝা যায় যে তারা যথেষ্ট অবাক এবং বিস্মিত হয়েছেন কারণ মনোজিত বাবুর সাথে বসে আছেন প্রীতম সেন যিনি সম্পর্কে অরুণাভর পিসেমশাই অর্থাৎ অভিরূপবাবুর বোন মণিমালা দেবীর স্বামী।
"এইতো তোমরা এসে গেছো, আসো বাবা অরুণাভ আয় মৌ"
জামাই আর মেয়েকে ঘরে ঢুকতে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন মনোজিত বাবু, মনোজিত বাবুর বয়স ওই ৬০ এর আশেপাশেই তবে এখনো যথেষ্ট শক্তসমর্থ চেহারা, গায়ের রঙ কালো গায়ের লোম আরো কদাকার করেছে, মুখে পরিষ্কারভাবে দাঁড়ি কামানো থাকলেও পুরুষ্ট গোঁফ, মাথার সামনে অল্প টাক পিছনে কলপ করা কালো চুল। গলায় মোটা সোনার চেন ঝোলানো আর দুহাতের দশ আঙুলের দুটো বুড়ো আঙুল আর দুটো কড়ে আঙুল বাদে বাকি সবগুলোতেই আংটি।
"ইনি এখানে কি করছেন?"
অরুণাভ ঘরে ঢুকে একটা সোফায় বসে সটান প্রীতম বাবুর দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো, অরুণাভর পাশে মৌমিতা বসলো তারও দৃষ্টি প্রীতম বাবুর উপরে। প্রীতম বাবুও তাকিয়ে আছেন অরুণাভ এবং মৌমিতার দিকে কিন্তু তার ঠোঁটে একটা মুচকি হাসি।
প্রীতম বাবুর বয়স ৫২-৫৩ হবে স্লিম ফিটফাট চেহারা, মাথায় কাঁচা পাকা মেশানো চুল ছোটো ছোটো করে ছাটা,মুখ একেবারেই ক্লিনশেভড, গায়ের রঙ পরিষ্কার তবে সবথেকে দেখার জিনিস হলো তার দুটো চোখ সবসময় ধূর্ততা আর চালাকির মিশ্রণ। এনার নিজস্ব পরিবার কেউ নেই একসময় "ব্যানার্জী ক্রিয়েশনস্" এ কাজ করতেন সেখান থেকে মণিমালা দেবীর সঙ্গে আলাপ যা ক্রমে প্রেমে রূপান্তরিত হয় তারপর বিয়ে। বিয়ের পরে অবশ্য স্ত্রীর দাদার বাড়িতেই উঠেছেন।
"কি হলো বাপি উনি এখানে কেন?"
মৌমিতার প্রশ্নের উত্তরে মনোজিত বাবু কিছু বলার আগেই প্রীতম বাবু মুখ খোলেন, ঠোঁটে একটা অদ্ভুত হাসি নিয়ে বলেন
"কেন বৌমা আমিও তো তোমাদের আপনজন আমি কি আসতে পারি না?"
"কি চান আপনি? কি দরকার আপনার?" গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করে অরুণাভ। প্রীতম বাবুর ঠোঁটের হাসিটা আরও চওড়া হয় একটু চুপ থেকে তিনি বলেন "কিছু দরকার ছাড়া কি আসতে নেই?"
"চালাকি বন্ধ করুন, আপনি যে নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই করেননা সেটা বুঝতে অন্তত আমার আর বাকি নেই" অরুণাভ রাগী স্বরে কথাটা বললো। প্রীতম বাবু কিন্তু দমে গেলেন না তিনি একইরকম হাসিমুখে বললেন "আর তুমি?"।
এইটুকু কথা শুনেই অরুণাভর মুখ একেবারে ছোটো হয়ে গেল কিন্তু তার দুচোখ দিয়ে যেন আগুন বেরোতে থাকে পারলে এখনই প্রীতম বাবুকে পুড়িয়ে মেরে ফেলে, কোনোমতে নিজের রাগটা কন্ট্রোল করে জিজ্ঞেস করে
"এখানে কেন এসেছেন? কি চান সোজাসুজি বলুন"
"মাত্র ২ লাখ আপাতত" হাসতে হাসতেই উত্তর দেন প্রীতম বাবু
"হোয়াট আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে এতগুলো টাকা দেওয়া সম্ভব নয়"
"কি বলছো তুমি এভাবে বললে হয় নাকি?"
"আপনাকে অনেক দিয়েছি কিন্তু আমি আর আপনার জুয়া, মদ আর রেসের টাকার জোগান দিতে পারবো না" দৃঢ়ভাবে কথাটা বললো অরুণাভ, কিন্তু প্রীতম বাবুও কম যান না তিনি হাসি হাসি মুখেই বললেন "ওটা বললে কি চলে? আমি তো আর রোজ রোজ চাই না চাইকি? আর ব্যানার্জী ক্রিয়েশনস্ এর হবু মালিক যদি ২ লাখ টাকাকে বেশী বলে তাহলে সেটা শুনতে খারাপ লাগে।"
"আপনি একটু আগেই আমার থেকে ১ লাখ নিয়েছেন" এতক্ষণে কথা বলেন মনোজিত বাবু, এবং তার কথা শুনে অরুণাভ এবং মৌমিতা দুজনেই অবাক হয়ে যায়।
"মনোজিত বাবু সেটা তো নিয়েছি আপনারই কাজ করার জন্য"
"তাহলে আবার কিসের টাকা?" মৌমিতা প্রশ্ন করে,
"আমার প্রাপ্য টাকা"
"আপনাকে আর একটা টাকাও দেওয়া হবে না"
"তাহলে তো আমাকে অভিরূপ ব্যানার্জীর কাছে যেতেই হচ্ছে, কি বলো অরুণাভ?"
"আপনাকে আমি.." মৌমিতা উঠে প্রীতম বাবুর দিকে তেড়ে যাচ্ছিল কিন্তু অরুণাভ তার হাত ধরে আটকায় মৌমিতা আবার সোফায় অরুণাভর পাশে বসে রাগে ফুঁসতে থাকে, এতক্ষণে প্রীতম বাবুর মুখ গম্ভীর হয়, গম্ভীরমুখে তিনি বলেন
"একদম নয় বৌমা, ঘরের বউ তুমি শান্ত থাকতে শেখো নাহলে বিপদ বাড়বে"।
এটা যে একপ্রকার হুমকি সেটা বুঝতে কারো বাকি থাকে না কিন্তু তবুও মৌমিতা শান্ত হয় না সেও তেজের সাথে বলতে থাকে,
"কি করবেন আপনি? বলুন কি করবেন?"
"মনোজিত বাবু আপনি আপনার মেয়েকে ভদ্রতা শেখাননি? কিভাবে বড়োদের সাথে কথা বলতে হয় সেটা শেখাননি?"
"পিসেমশাই... আপনি যা শুরু করেছেন সেটা ঠিক নয় বাবা যদি জানতে পারে তাহলে আপনাকে তাড়িয়ে দিতে দুবার ভাববে না"
অরুণাভর কথা শুনে মনে হলো না প্রীতম বাবু একটুও ভয় পেলেন, তিনিও পাল্টা দাবার চাল দেবার ঢঙে বললেন,
"আর তোমরা যা করেছো সেটা যদি তোমার বাবা জানতে পারেন তাহলে? আমাকে নাহয় বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে কিন্তু তোমাদের কি করবে ভেবে দেখেছো?"
এই কথা শুনে অরুণাভ আবার চুপসে গেল, সে তোতলাতে থাকে
"ম..মা..মানে?"
"আট বছর আগে, গ্যাংটকে.. রুমটেক মনাস্ট্রি এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে চলে? মানছি যে অভিরূপ ব্যানার্জী বা পরিবারের সবার কাছে বা আরও যারা আছেন তাদের সবার চোখে তুমি সোনার টুকরো ছেলে কিন্তু যদি তারা জানতে পারেন তুমি আর তোমার ওয়াইফ কি করেছো তাহলে ভেবেছো কি হবে? অভিরূপ ব্যানার্জী তোমাদের জেলে ঢোকাতে দুবার ভাববেন না আর এটা তোমার থেকে ভালো আর কে জানে যে তুমি বা তোমার শ্বশুরমশাই যতই ক্ষমতা অর্জন করে থাকো না কেন এই পুরো কলকাতা শহরে অভিরূপ ব্যানার্জীর ধারেকাছেও নেই তোমরা তাই একবার যদি কথাটা ওনার কানে যায় তাহলে.."।
"তার আগে আমরা আপনাকে শেষ করবো" রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কথাটা বললো মৌমিতা।
"ঠিক যেভাবে একটু আগেই একজনকে শেষ করে এলে?"
প্রীতম বাবুর কথা শুনে এবার শুধু অরুণাভ আর মনোজিত বাবু নন মৌমিতাও চমকে উঠে চুপসে যায়। প্রীতম বাবু ওদের ওই অবস্থায় দেখে যেন খুবই মজা পাচ্ছেন তার মুখের হাসিটা ফেরত এসেছে তিনি বলেন,
"আমাকে মেরেও কি তোমরা বেঁচে যাবে ভেবেছো? এই শহরে আমারও কিছু বিশ্বস্ত লোক আছে যাদেরকে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া আছে যদি আমার কিছু হয় তাহলে সেই সেদিনের.. সরি সেই রাতের ঘটনার প্রমাণসহ প্রথমে অভিরূপ ব্যানার্জীর কাছে আর তারপর পুলিশের কাছে যেতে, তারপর নাহয় বাকি কাজটা তারাই করবে"
প্রীতম বাবুর কথা শুনে সবাই বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে একটু পরে অরুণাভ মুখ খোলে,
"আপনার ব্ল্যাকমেলিং কিন্তু দিনের পর দিন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে"
"কি করবো বলো? আমারও তো শখ আহ্লাদ আছে নাকি? আর নিজের শখ আহ্লাদ পূরণ করার উপায় যখন আছে তখন ভাবনা কি?"
"কিন্তু আমার থেকে টাকা নেওয়ার জন্য এখানে কেন, আমি তো বাড়িতেও টাকা দিতাম"।
"সে তো বটেই কিন্তু এখানে মনোজিত বাবুর থেকে পেমেন্টটা নিতে এসেছিলাম তারপর শুনলাম তোমরা আসছো তাই থেকে গেলাম"।
"বাপি কিসের পেমেন্ট?" মৌমিতা মনোজিত বাবুকে প্রশ্নটা করে কিন্তু উত্তরটা প্রীতম বাবু দেন, "আমি বলছি বৌমা, এই যে তোমরা তোমাদের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য একজনকে সরিয়ে দিয়ে এলে তার খোঁজটা মনোজিত বাবুকে কে দিয়েছে জানতে চাইবে না?... আমি বলি? ওটা আমি দিয়েছি"
"আপনি?" মৌমিতার স্বরে একাধারে অবাক এবং অবিশ্বাস।
"হ্যাঁ, বৌমা তোমরা আমাকে শত্রু ভাবলেও আমি শত্রু নই বন্ধুই কিন্তু যদি তোমরা শত্রুতা করো তাহলে ক্ষতিটা তোমাদেরই"।
"প্রীতম বাবু ওসব ছাড়ুন, আপনি বলছিলেন কি একটা খবর দেবেন সেটা কি?" মনোজিত বাবু প্রশ্ন করেন।
"খবর একটা নয় একাধিক"
"যেমন?"
"প্রথমত যাদবপুরে যে খেলার মাঠটা দখল করে সেখানে বিল্ডিং বানাবেন বলে ভেবেছেন বা যে পুকুরটা ভরাট করে ওখানেও ফ্ল্যাট তুলবেন বলে ঠিক করেছেন ওটা এখনই করবেন না"
"কেন?"
"ওই এলাকার বেশ কয়েকজন লোকের সাথে অভিরূপ ব্যানার্জীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে এছাড়া ওনার শালা অর্থাৎ অ্যাডভোকেট স্বর্ণেন্দু মুখার্জির বেশ কয়েকজন বন্ধু থাকে ওই এলাকায় কাজেই খবরটা যদি কোনোভাবে অভিরূপ ব্যানার্জীর কানে যায় তাহলে কাজ তো বন্ধ হবেই আপনার টাকা নষ্ট এছাড়া অভিরূপ ব্যানার্জী আপনার সাথে কি করবেন সেটা কে জানে? এটা তো স্বীকার করবেন যে ওনার ক্ষমতা আপনার থেকে অনেক বেশি। তার উপরে স্বর্ণেন্দু মুখার্জি, ওনার ক্ষমতাও কম নয় আফটারঅল হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করেন"।
"তার মানে আপনি কি বলছেন ওই প্লটগুলো ছেড়ে দেবো?"
"ওখানে জোরজবরদস্তি করা যাবে না, যদি প্লটগুলোর মালিক নিজে থেকে দেয় তাহলে ঠিক আছে"।
"নিজে থেকে দিচ্ছে না তো সেটাই প্রবলেম"
"তাহলে আপাতত কাজটা বন্ধ রাখাই ঠিক হবে"
"প্রশ্নই ওঠে না, অভিরূপ ব্যানার্জী এখন এমন কিই বা করবেন? আর এমনিতেও এখন ব্যানার্জীদের প্রায় পুরো বিজনেসটাই অরুণাভ সামলায় তাই.." কথাটা বললো মৌমিতা।
"যেটা জানোনা সেটা নিয়ে কথা বোলো না বৌমা, অরু তোমার বউকে বোঝাও অভিরূপ ব্যানার্জী এখনো কতটা ক্ষমতা রাখেন সেটা ভালো করে বোঝাও, শোনো বৌমা সিংহ শিকার করা ছেড়ে দিলেও সে সিংহই থাকে সেই জঙ্গলের রাজা থাকে, অভিরূপ ব্যানার্জী হলেন সেই সিংহ যিনি এখনো জঙ্গল অর্থাৎ এই কলকাতার রাজা আর তিনি কিন্তু এখনো রিটায়ার করেননি। রাজনৈতিক লাইনে তোমাদের যত যোগাযোগ তার থেকে অনেক উঁচু স্তরে ওনার যোগাযোগ এছাড়া পুলিশের অনেক বড়ো বড়ো অফিসার ওনার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর তাছাড়া এই শহরের লোক ওনাকে কেমন ভক্তিশ্রদ্ধা করে সেটা আশা করি আমাকে বলে দিতে হবে না?"।
"কিন্তু পিসেমশাই ওই প্লটগুলো আমিও দেখেছি ওগুলো ছাড়লে অনেক লস হয়ে যাবে" অরুণাভ নিজের স্ত্রীকে ইশারায় ঠান্ডা থাকতে বলে কথাটা বলে।
"এখন আপাতত ওগুলোর আশা না করাই ভালো, আর ওর থেকেও বড়ো বিপদ এখন তোমাদের সবার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে"।
"বিপদ?" অরুণাভর স্বরে অবাকভাব।
"হুমম তবে সামনে না বলে একেবারে দরজায় বলাই ঠিক হবে" প্রীতম বাবুর কথা শুনে সবাই দরজার দিকে তাকায় সেখানে মনোজ এসে দাঁড়িয়েছে।
"এসব আপনি কি বলছেন প্রীতম বাবু আমার ছেলে বিপদ হবে কেন?" মনোজিত বাবু বিস্ময়ে প্রশ্ন করেন, অরুণাভ আর মৌমিতার মুখের ভাবে বোঝা যায় যে একই প্রশ্ন ওদের মনেও উঁকি দিচ্ছে।
"আপনার ছেলে আর মেয়ে দুজনেই সমান, মেয়ে খালি লাশ ফেলতে পারে আর ছেলে সেই লাশ গায়েব করতে পারে তাও সবসময় ঠিকভাবে হয় না এছাড়া দুটোর একটারও মাথায় বুদ্ধি নেই"।
মৌমিতার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে যেকোনো সময় প্রীতম বাবুর উপর ঝাঁপিয়ে পরবে কিন্তু সেটা করলো না কোনোমতে প্রীতমবাবুর খোঁচাগুলো সহ্য করে চুপচাপ বসে রইলো, প্রীতম বাবু বলে চলেন
"আপনার ছেলে আর তার চ্যালাচামুণ্ডারা কি করেছিল ভুলে গেছেন?"
"কোনটা?"
"ওই যে একটা মেয়ের সাথে একটু ইয়ে.."
"তাতে কি ওই কেস তো মিটে গেছে"
"একদমই নয় প্রীতম বাবু একটু খোঁজখবর রাখুন.. ওই কেস নিয়ে গোপনে তদন্ত হচ্ছে মেয়েটার জবানবন্দিও নেওয়া হয়েছে"।
"কিন্তু কোর্ট তো কেস ডিসমিস করেছে আমার ছেলে আর ওর বন্ধুদের বেকসুর খালাশ করেছে কোর্ট"
"আপনার ছেলে যে বেকসুর ছিল না সেটা আপনার থেকে ভালো আর কে জানে, আর বেকসুর আলিপুর কোর্ট করেছিল হাইকোর্ট নয়"
"হাইকোর্ট?"
"ইয়েস.. কেসটি আবার কোর্টে তোলা হচ্ছে এবং হাইকোর্টে"।
"আপনি কিভাবে জানলেন? কে বললো?"।
"ব্যানার্জী পরিবারের সাথে যুক্ত হওয়ার এই একটা সুবিধা, পুলিশেও নিজের লোক রাখা যায়, ওখানকার একজন বলেছে খুব গোপনে সব হচ্ছে মেয়েটিকে খুবই গোপনীয়তার সাথে রাখা হয়েছে, একবার ভেবে দেখুন আপনার ছেলের কাজ ভিক্টিম এবং সাক্ষী দুটোকেই জ্যান্ত ছেড়ে দিয়েছে"।
"মেয়েটির হয়ে কোন উকিল লড়ছে কিছু জানেন? সেই একই লোক কি?" এতক্ষণে অরুণাভ প্রশ্ন করে।
"তুমি যা করবে বলে ভাবছো সেটা আমি অনেক আগেই করেছি অরুণাভ"
"মানে?"
"তুই ওই উকিলকে টাকা বা ভয় দেখিয়ে সরাতে চাইছো তো? ওটা আমি অনেক আগেই করেছি, আরে বাবা মনোজিত বাবুর সাথে তো আর আজ থেকে পরিচয় নয় আমার কি বলেন মনোজিত বাবু?"
"তা সেই উকিল কি কথা শুনলো না?" মনোজিত বাবু প্রশ্ন করেন।
"শুনেছে মনোজিত বাবু শুধু তাকে পঞ্চাশ হাজার ক্যাশ দিতে হয়েছে, এটুকু যদি দিয়ে দেন তাহলে ভালো নাহলে আর কি বন্ধুত্বের জন্য নাহয় নিজের পকেট থেকে যাবে"
"দিয়ে দেবো, কিন্তু যদি ওই উকিল আপনার কথা শুনে থাকে তাহলে সমস্যা কোথায়?"
"কলকাতায় একটাই উকিল আছে নাকি? অন্য একজন উকিল সেই মেয়েটার হয়ে কেস লড়বে সেই সব করছে শুনলাম সাক্ষীও জোগাড় করেছে"।
"কিন্তু আঙ্কেল সেদিন কোনো সাক্ষী ছিল না" মনোজ জোর গলায় কথাটা বলে।
"দেখলেন মনোজিত বাবু বললাম না আপনার ছেলের মাথায় একটুও বুদ্ধি নেই। মনোজ তুমি কিভাবে অত শিওর হচ্ছো যে সেদিন কোনো সাক্ষী ছিল না?"
এবারে মনোজ আর কোনো কথা বললো না চুপ করে রইলো, প্রীতম বাবু আবার বলতে শুরু করেন,
"হয়তো ছিল বা হয়তো নকল সাক্ষী"
"নকল সাক্ষী?"
"তুমি যদি নকল সাক্ষী খাড়া করে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারো তাহলে, নকল সাক্ষী এনে তোমাকে দোষী প্রমাণিত করতে অসুবিধা কোথায়? মনোজিত বাবু আগে এই কেসটা সামলান, কেসটা কোনোভাবেই হাইকোর্টে তুলতে দেওয়া যাবে না তার আগেই থামাতে হবে"
"কিন্তু কেন? আমার ভাই একবার বেকসুর খালাস পেয়েছে আবার করিয়ে আনবো"
"এবারে অত সোজা হবে না আর তাছাড়া কোনোভাবে যদি এটা স্বর্ণেন্দুর নজরে পরে আর তার থেকে অভিরূপ ব্যানার্জীর কানে যায় তখন আপনাদের জন্য বিপদ হতে পারে"।
"বাপি আমাকে বাঁচাও,আমি জেলে যেতে চাই না" এতক্ষণে মনোজ এসে মনোজিত বাবুর পায়ের কাছে বসে তার পা ধরে কান্না শুরু করলো, উত্তরে মনোজিত বাবু সপাটে দুটো থাপ্পড় ছেলের গালে বসিয়ে দিয়ে বললেন,
"কতবার বলেছি এমন কোনো কাজ করবি না যাতে আমার নাম খারাপ হয় বা করলেও পরিষ্কারভাবে করবি কিন্তু তুই..."
"পিসেমশাই এই যে উকিল এই কেসটা হ্যাণ্ডেল করছে সে কে? তার সম্পর্কে জেনেছেন? কে,কোথায় থাকে, ফ্যামিলি ব্যাকগ্ৰাউণ্ড?" অরুণাভ প্রশ্ন করে।
"তার আগে ওই ভিক্টিম মেয়েটিকে নিয়ে ভাবো কি করবে?"
"আপনার মাথায় কোনো প্ল্যান আছে মনে হচ্ছে?"
"আছে"
"কি প্ল্যান?"
"এইসব প্ল্যান কি বিনা খরচে আসে?"
"কত চান আপনি প্রীতম বাবু?" এবার মনোজিত বাবু প্রশ্ন করেন।
"সবসময় টাকা চাইবো, এতটাও লোভী নই আমি মনোজিত বাবু"
"তাহলে কি চান আপনি পিসেমশাই?"
"পার্টনারশিপ"
"পার্টনারশিপ?"
"হ্যাঁ, তোমরা শ্বশুর জামাই অনেক বিজনেসে হাত পাকিয়েছো আমি সেখানে পার্টনারশিপ চাই, অবশ্য বিনিময়ে আমিও কিছু অবশ্যই যোগদান দেবো"
"আর যদি আমরা রাজী না হই?" মৌমিতা প্রশ্ন করে। "তাহলে তোমার ভাইকে জেলে যাওয়া থেকে আটকাতে পারবে না" প্রীতম বাবু যথারীতি মুখে হাসি নিয়ে উত্তর দেন।
"কিন্তু আপনাকে যদি পার্টনার করিও তাহলে আপনি কিভাবে কেসটা সামলাবেন?"
"সেসব আমার উপরে ছেড়ে দাও"
"কিন্তু আপনি যেচে আমাদের উপকার করতে চাইছেন কেন?"
"মৌমিতা তুমি হয়তো জানোনা কিন্তু তোমার বাবার সাথে আমার আজকের পরিচয় নয়, অনেকদিনের পরিচয় কি মনোজিতবাবু মেয়েকে বলুন"।
"আগে শুনি আপনার প্ল্যান"
"এসব প্ল্যান কি সবাইকে বলা উচিত? তোমার বাবা জানেন আমি হলাম শিল্পী মানুষ আর্টিস্ট, আমার কাজ আর্টের কাজ তাই তো তোমার বাবা আমাকে কাজ দেন"
"কিন্তু উপায়টা তো বলবেন"
"ধরো যদি মেয়েটা কোর্টে পৌঁছানোর আগেই কোনো দুর্ঘটনায় মারা যায় তখন"
"কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব? আপনিই তো এক্ষুনি বললেন যে মেয়েটাকে অত্যন্ত গোপনে রাখা হয়েছে"।
"আর সেই গোপন জায়গার খোঁজ আমি জানি"।
"প্রীতমবাবু তাহলে আপনি মেয়েটাকে সামলান আর আমি কথা দিচ্ছি আপনি আমাদের ব্যাবসার পার্টনার হবেন"।
"না মনোজিত বাবু, আগে পার্টনারশিপ তারপর আমার কাজ"
"আপনি যদি কথার খেলাপ করেন?"
"আপনি আমাকে অনেকদিন ধরে চেনেন কোনোদিন কথার খেলাপ করেছি? কিন্তু আপনার সেই রেকর্ড আছে তাই আগে পার্টনারশিপ পরে মেয়েটার ব্যাবস্থা"
"কিন্তু কাগজপত্র তৈরি করতে একটু সময় লাগবে"
"তার দরকার নেই, আমি তৈরী করেই এনেছি আপনারা পড়ে সই করে দিন তাহলেই হবে"।
মনোজিত বাবু এবং অরুণাভ দুজনেই বুঝতে পারে এছাড়া আর উপায় নেই তাই তারা সই করে,আর মৌমিতাও চুপচাপ সই করে। সইপর্ব মেটার পরে অরুণাভ একটা প্রশ্ন করে,
"কিন্তু পিসেমশাই, মেয়েটার সাথে নিশ্চয়ই পুলিশের লোক আছে পাহারার জন্য"
"সেটা তো আছেই, তবে তুমি চিন্তা কোরো না"
"কি করবেন আপনি?"
"কালকের পেপারে দেখে নিও হেডলাইন" কথাটা বলে প্রীতমবাবু হো হো করে হেসে ওঠেন।
"কি মনে হলো?"
"মনে হলো যেন খুব কাছের একজন পায়ে হাত দিয়েছে"
"কাছের একজন?"
"হ্যাঁ, যেন মনে হলো অনি আমার পায়ে হাত দিয়েছে"
"অনি মানে তোমার ওই কাজিনটি যে ঘুরতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়?"
"হ্যাঁ, জানিনা কেন মনে হলো আমার"
"দেখো আমার সাথে কখনো তোমার এই ভাইটির আলাপ হয়নি তাই আমি ওকে চিনি না, কিন্তু ও তো মারা গেছে তাহলে?"
"সেটাই তো ভাবছি"
"হয়তো এটা তোমার মনের ভুল"
"তাই কি?"
"একদমই, এবার চলো ঘুমানোর সময় হয়ে গেছে"।
সুনন্দা কিন্তু স্বামীর কথা শুনে চেয়ার ছেড়ে উঠলো না, উল্টে সে কথা বলতে শুরু করলো,
"জানো আমাদের পরিবারের অনেকেই অনিকে ব্ল্যাক শিপ বলতো"
"ব্ল্যাক শিপ?"
"হ্যাঁ, আসলে ছোটো থেকেই সবাই অরুদাকে বেশী ভালোবাসতো। অরুদা বরাবরই ভালো ছিল এবং সেটা সবকিছুতেই পড়াশোনা তো ছিলই এছাড়া কথাবার্তা, আচার ব্যবহার সবেতেই ভদ্র, শান্ত, নম্র ছিল সেইজন্যই সবাই ওকেই বেশী ভালোবাসতো, প্রশ্রয় দিত ওকে নিয়েই সবাই বেশী আলোচনা করতো, অপরদিকে অনি, ও পড়াশোনাতে খারাপ ছিল না, খেলাধুলাতেও ভালো ছিল, খুব সুন্দর ছবি আঁকতো কিন্তু শান্ত আর নম্র ছিল না, কারো মুখের উপরে সত্যি বলতে ভয় পেতো না সেটা যেই হোক"
"তার মানে অভদ্র ছিল?"
"না অভদ্র নয়, কারো সাথে কখনো অভদ্র কিছু করেনি কিন্তু কারো মন জুগিয়ে চলা ওর ধাতে ছিল না, আর প্রচণ্ড রাগী ছিল"
"শুনেছি তোমার সাথে প্রায়ই লড়াই করতো"
"ঠিক লড়াই নয় ভাইবোনের মধ্যে তো টুকটাক হয়ই সেরকমই, আমি ছোটো থেকেই মাটি বা মোম দিয়ে পুতুল, মূর্তি বানাই"
"হ্যাঁ, এখনো তুমি খুব সুন্দর বানাও"
"ছোটোবেলায় যখন আমি বানাতাম তখন অনি এসে আমাকে ডিসটার্ব করতো নয়তো ঘেটে দিত এইসব, এছাড়া আমার খুব কাছের ছিল ও আমার সাথে ঝগড়া করতো আবার আমাকে কেউ বিরক্ত করলে তার পিছনে কুকুর লেলিয়ে দিত"
"কুকুর?"
"হ্যাঁ, তুমি তো জানো এই বাড়িটা পিসেমশাইদের ছিল, এখানেই ওনারা থাকতেন"।
"হ্যা, নতুন বাড়ি করে ওনারা ওখানে চলে যান আর আমাদের বিয়ের সময় এটা তোমাকে উপহার দেন"।
"হ্যাঁ, আমি তো বেশিরভাগ সময় এখানেই থাকতাম আমি দেখতাম পাড়ার প্রায় সব কুকুর অনির ভক্ত ছিল, অনি ওদের খেতে দিত দেখভাল করতো আর কেউ ওকে বিরক্ত করলে ও কুকুরগুলোকে লেলিয়ে দিত, একবার রাস্তার কয়েকটা বখাটে ছেলে কলেজে যাওয়ার পথে আমাকে টোন কেটেছিল অনি সেটা দেখেছিল সেদিন বিকেলে ও ওর পুরো কুকুরের দল নিয়ে তাড়া করিয়ে পুরো পাড়া ওদের দৌড় করিয়েছিল"।
"খুব ডেঞ্জারাস ছিল তো?"
"শুধুমাত্র তাদেরই ও কুকুর লেলিয়ে দিত যারা ওকে বা পরিবারের কাউকে বিরক্ত করতো, এছাড়া কারো ক্ষতি করেনি কখনো, পিসির বাড়ির টোবোকে তো দেখেছো?"
"মানে ব্যানার্জী ম্যানসনের ওই কুকুরটা?"
"হ্যাঁ, ওটাকে অনিই কোথা থেকে জানি জোগাড় করে নিয়ে আসে একদম বাচ্চা অবস্থায়, নিজে হাতে ওর যত্নআত্তি করতো, কুকুর খুব পছন্দ করতো আর কুকুররাও ওকে পছন্দ করতো"।
"গুণ ছিল তার মানে?"
"হ্যাঁ, বললাম না খুব সুন্দর ছবি আঁকতো, খেলাধুলা বিশেষ করে ফুটবলে ভালো ছিল"
"মানে বলতে চাইছো এত গুণ থাকা সত্ত্বেও অরু দার ছায়ায় ঢাকা পরে যেত?"
"ওই যে অরুণাভ ব্যানার্জীর চার্ম যেটা অল্প বয়স থেকেই সবার উপরে প্রভাব ফেলেছিল,কিন্তু অরুদা ওকে কেন যেন ঠিক পছন্দ করতো না, সবসময় ওকে ভয় দেখাতো, ওর নামে বড়োদের কাছে কমপ্লেন করে বকা খাওয়াতো এমনকি ছোটোখাটো কিছু ভুলের জন্য মারও খেয়েছে অনি। তাছাড়া অনি যদি কিছু পছন্দ করে নিত যেমন কাপড় বা জুতো বা অন্য কিছু তাহলেও অরুদারও সেটা চাই নাহলে ও অনিরটা নিয়ে নিত।"
"কেউ কিছু বলতো না?"
"না, বললাম না সবাই অরুদাকে একটু বেশীই ভালোবাসতো একটু বেশি প্রশ্রয় দিত সবার চোখে অরুদা একেবারে যাকে বলে সোনার টুকরো ছেলে এবং সেটা এখনও আছে আর অনিও কাউকে খুব একটা কিছু জানাতো না"
"কেন?"
"খুব অভিমানী ছেলে ছিল, চুপ করে সব সহ্য করতো আমিই তো কত কমপ্লেন করতাম ও বকা খেতো আর তখন চুপ করে নিজের কুকুরগুলোর কাছে চলে যেত"।
"কুকুরদের কাছে যেত?"
"হ্যাঁ, ওই কুকুরগুলোই ওর সবথেকে কাছের বন্ধু ছিল ওকে সঙ্গ দিত, ওকে পাহারা দিত"
"পাহারা?"
"হ্যাঁ, এরকম অনেকদিন হয়েছে যে অরুদা বা আমার বা সুশান্তর কমপ্লেনের জন্য ও বকা খেয়েছে এমনকি পিসির কাছে তো মারও খেত তারপর কাউকে কোনো কথা না বলে চুপচাপ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যেত, ঘন্টার পর ঘন্টা বাইরে কাটাতো কুকুরদের সাথে শেষে একাই ফিরে আসতো বা কখনো পিসি বা আমি গিয়ে নিয়ে আসতাম"।
"তুমি সত্যিই ওকে বকা খাওয়াতে?"
"তখন ছোটো ছিলাম, ও আমার সাথে দুষ্টুমি করতো খুব রাগ হতো তাই পিসিকে নালিশ করতাম, ও যখন বকা খেতো তখন প্রথমে খুব মজা লাগতো কিন্তু পরে খারাপ লাগতো এমনিতে বাড়িতে খুব একটা থাকতো না কলেজ, কোচিং খেলাধুলা নিজের আলাদা একটা জগত তৈরি করে নিয়েছিল তার বাইরে আমার সাথেই মিশতো কিন্তু ওর দুষ্টুমির জন্য তখন বুঝতাম না কিন্তু এখন ওকে হারানোর পর বুঝি কি হারিয়েছি?"
"ওর কি হয়েছিল কিছু জানো?"
"না, অরুদা, আর মৌমিতা বৌদির সাথে গ্যাংটকে ঘুরতে গিয়েছিল কিন্তু হটাৎ অরুদা ফোন করে জানায় যে অনি রুমটেক মঠের পিছনে খাদে পরে গেছে"
"কিভাবে কিছু বলেনি?"
"না, বললো ওখানে সেদিন রাতে কুয়াশা ছিল ওরা মঠে ঘুরতে গিয়েছিল আর একটা কি অনুষ্ঠান ছিল সেটা দেখতে গিয়েছিল সেদিন অনি ওখানে কি করতে গিয়েছিল তা জানেনা, ওরা সেদিন মঠে কি একটা অনুষ্ঠান হচ্ছিল সেটাই দেখছিল হটাৎ একজন এসে জানায় কেউ একজন খাদে পরে গেছে তার চিৎকার শোনা গিয়েছিল, সেই শুনে সবাই যায়"
"তারপর?"
"কিছুটা নীচে অনির জামার ছেঁড়া টুকরো পাওয়া যায় যাতে রক্ত লেগে ছিলকিন্তু অনিকে পাওয়া যায়নি, রক্ত পরীক্ষা করে জানা যায় ওটা অনিরই রক্ত লেগে ছিল জামার টুকরোতে"।
"পুলিশ এনকোয়ারি করেনি?"
"করেছিল"
"কিছু সন্দেহজনক পেয়েছিল?"
"না, তুমি যা মিন করছো অর্থাৎ খুন তেমন প্রমাণ পায়নি তাই অ্যাক্সিডেন্ট বলে ক্লোজ করে দেয়"।
"তোমার কি মনে হয় ওটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিল?"
"জানিনা, তবে এটুকু জানি অনি অত অসাবধান ছিল না, যদি ধরেও নিই যে একাই খাদের ধারে গিয়েছিল তাহলেও খুব সাবধানেই চলাফেরা করার ছেলে ও"।
"ছাড়ো এই নিয়ে আর মনখারাপ কোরো না"
"আমি চাইনি কিন্তু সকালে যখন ওই ছেলেটা আমাকে প্রণাম করলো তখন.."
"সকালে যে এসেছিল সে তোমার ভাই অনি নয় ওটা তোমার মনের ভুল এখন ঘুমাতে চলো জানোই তো আমার পাশে আমার মেয়ে আর বউ না থাকলে আমার ঘুম হয়না" কথাটা বলে মৈনাক স্ত্রীকে দুহাতে কোলে তুলে বেডরুমের দিকে চলে গেল।
বাইপাস হাইওয়ে ধরে রুবির দিকে যাওয়ার আগে মুকুন্দপুর পার করে কিছুটা গিয়ে বাঁদিকে ছোটো একটা রাস্তা ধরে মিনিট তিরিশেক গিয়ে আবার একটা কাঁচা রাস্তা আছে সেটা দিয়ে কিছুদূর গিয়ে একটা অর্ধ সমাপ্ত বাড়ির সামনে একটা সিলভার রঙের হন্ডাসিটি এসে দাঁড়ালো আর তার পিছন পিছনই আরেকটা নীল রঙের মারুতি সুজুকিও এসে দাঁড়ালো, বাড়িটা কেউ তৈরি শুরু করেও শেষ করেনি অর্ধেক শেষ করে বন্ধ করে দিয়েছে বা করতে বাধ্য হয়েছে।
প্রথমটা গাড়িটা থেকে যিনি নামলেন তার পরনে সিলভার রঙের ব্লেজার ও ট্রাউজারস্, ব্লেজারের ভিতরে সাদা রঙের শার্ট, আর নীল সাদা টাই, হাতে দামী ঘড়ি, পায়ে কালো বুটটাও দামি এনাকে কলকাতার মোটামুটি সবাই চেনে বিশেষ করে ফ্যাশন দুনিয়ার সবাই চেনে ইনি অরুণাভ ব্যানার্জী, ব্যানার্জী ক্রিয়েশনস্ এর মালিক অভিরূপ ব্যানার্জীর ছেলে। আর দ্বিতীয় গাড়িটা থেকে যিনি নামলেন তাকেও প্রায় সবাই চেনে ইনি অরুণাভ ব্যানার্জীর স্ত্রী মৌমিতা ব্যানার্জী তার পরনে একটা নীল রঙের সিল্কের শাড়ি সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ, চোখে গগলস্, মাথায় চুলটা খোঁপা করে বাঁধা পায়ে উঁচু হিলওয়ালা জুতো।
এই দুজনকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে বাড়ির ভিতর থেকে আরও একজন শ্যামলা, ২৮-৩০ বছরের যুবক হাসতে হাসতে বেরিয়ে এল, "এইতো তোমরা এসে গেছো, কি ব্যাপার তোমরা আলাদা আলাদা গাড়িতে?"
"কারণ আমরা আলাদা আলাদা বেরিয়েছি তাই" অরুণাভ বাবু উত্তর দেন,
"কিন্তু আমাদের গেস্ট কোথায় ভাই?" মৌমিতা এবার প্রশ্ন করে, উত্তরে সামনের যুবকটির মুখে একটা ক্রুর হাসি দেখা যায় সে বলে "ভিতরে আছে দিদি, খুব খাতিরযত্ন করেছি চল গিয়ে দেখবি"।
তিনজনে ভিতরে ঢুকলো যুবকটি দুজনকে নিয়ে একটা ফাঁকা ঘরে ঢুকলো এখানে আরও কয়েকজন গুণ্ডা প্রকৃতির লোক দাঁড়িয়ে আছে, এছাড়া আরও একজন আছে যাকে ঘরের মাঝখানে একটা চেয়ারে বেঁধে রাখা হয়েছে, ঠোঁট ফেটে রক্ত পরছে, চোখের নীচে কালশিটে দাগ এছাড়া আরো কয়েকটা আঘাতের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে, লোকটিকে যে যথেষ্ট মারধর করা হয়েছে সেটা বলে কাউকে বলে দিতে হয় না।
"শালাবাবু, তুমি তো দেখছি ভালোই যত্ন করেছো?"
লোকটার অবস্থা দেখে হেসে কথাটা বলে অরুণাভ ব্যানার্জী, বোধহয় তারই আওয়াজ শুনতে পেরে চেয়ারে থাকা লোকটা অতিকষ্টে তাকালো তারপর মুখটা ঘৃনা ও যন্ত্রনায় বিকৃত করে নীচে কিছুটা থুতু ফেললো যদিও তাতে রক্তের পরিমাণই বেশী।
"কেমন আছেন?"
অরুণাভ ব্যানার্জী ব্যাঙ্গের স্বরে লোকটাকে প্রশ্ন করলো কিন্তু লোকটা কোনো উত্তর দেয় না সে ঘৃণাভরে তাকিয়ে থাকে।
"আমাকে চিনতে পারছেন নাকি মনোজের যত্নে সেটা পারছেন না?"
এবারও লোকটা অরুণাভর কথার উত্তর না দিয়ে চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, অরুণাভ আবার কথা বলে,
"কেন আমার পিছনে লাগতে গেলেন বলুন তো?-কি ভেবেছিলেন আমার বিরুদ্ধে গিয়ে পার পেয়ে যাবেন?" আবার কথা বলেন অরুণাভ ব্যানার্জী, এবার লোকটা কথা বলে,
"আমাকে মারলেও আপনি বাঁচতে পারবেন না মিস্টার ব্যানার্জী"
"কে মারবে আমাকে?"
"কেউ না কেউ তো নিশ্চয়ই আসবে যে আপনাকে উপযুক্ত শাস্তি দেবে"।
কথাটা শুনে অরুণাভ ব্যানার্জী সহ উপস্থিত বাকিরা হো হো করে হেসে উঠলো।
"এই যেমন আপনি এসেছিলেন? আমি তো আপনার কোনো ক্ষতি করিনি তাহলে হটাৎ আমার পিছনে লাগতে গেলেন কেন?" অরুণাভ ব্যানার্জী আবার ব্যাঙ্গ করে, কিন্তু এবারে লোকটা চুপ করে থাকে। "আচ্ছা আমাদের পিছনে লাগার সাহস কোথা থেকে পেয়েছিলেন বলুন তো? মানে আপনার সাথে আর কারা আছেন?" আবার প্রশ্ন করেন অরুণাভ ব্যানার্জী কিন্তু লোকটা তাও চুপ করে থাকে, আবার কথা বলেন অরুণাভ ব্যানার্জী,
"দেখুন আপনাকে তো আমি মারবোই, তাই যাওয়ার আগে অন্তত সত্যি বলে যান"
কিন্তু লোকটা তবুও কথা বলে না শুরু ঘৃণাভরে তাকিয়ে থাকে আর আবার একটু রক্তাক্ত থুতু ফেলে। একটু পরে লোকটা মুখ খোলে,
"আজ আপনি আমাকে মেরে ফেলতেই পারেন কিন্তু যেটা মনে রাখবেন আপনিও বাঁচতে পারবেন না, আপনার আর আপনার স্ত্রীয়ের এবং আপনার শ্বশুরের অপরাধের লম্বা লিস্ট তৈরী হয়ে আছে শাস্তি আপনাদের পেতেই হবে"।
"লিস্ট তো নাহয় তৈরী করলেন কিন্তু প্রমাণ কোথায়? প্রমাণ ছাড়া আদালত শাস্তি দেয় না এটুকু জানেন না?"
"আদালত কেন? আপনার বাবা আছেন তো? একবার যদি আপনার কুকীর্তির কথা উনি জানতে পারেন তাহলে উনিই আপনাকে শাস্তি দেবেন"
"আপনার সত্যিই মনে হয় যে আমার বাবা আমার কথা বিশ্বাস না করে বাইরের লোকের কথা বিশ্বাস করবে? সেটাও আবার আমার বিরুদ্ধে?"
এই কথা শুনে প্রথমে লোকটার মুখ একটু ছোটো হয়ে এলেও পরক্ষণেই আবার শুকনো হাসি ফুটে উঠলো একবার যন্ত্রনায় মুখটা বেঁকে গেল তারপর অনেক কষ্টে বললেন,
"উনি ঈশ্বরতুল্য মানুষ, কখনো অন্যায়ের সাথে আপস করেননি, আজও করবেন না, আমাদের বিশ্বাস আছে ওনার উপরে"।
"কিন্তু ওনাকে বলবে কে? মানে আপনাকে তো আর বাঁচিয়ে রাখবো না আর আপনার সাথে যেকজন ছিল তাদেরও একে একে শেষ করে দেবো তাহলে আমার বাবাকে বলবে কে?"
অরুণাভর কথা শুনে লোকটা হতবাক হয়ে চুপ করে যায়, অরুণাভ ব্যানার্জী আবার কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তাকে হতবাক করে দিয়ে একটা ছুরি সোজা লোকটার বুকের বাঁদিকে হৃৎপিণ্ড বরাবর গেঁথে যায় আর লোকটার মুখ দিয়ে একটা আর্তনাদ বেরোনোর সাথে সাথে মাথাটা বুকের উপরে ঝুঁকে পড়ে।
অরুণাভ ব্যানার্জী অবাক হয়ে দেখেন ছুরিটা যে চালিয়েছে সে আর কেউ নয় তার স্ত্রী মৌমিতা, স্বামীর হতবাক ভাব দেখে মৌমিতা একটু ক্রুর হাসি হেসে বলে "তুমি করতে লেট করছিলে তাই আমি করে দিলাম এমনিতেও একে বেশীক্ষণ বাঁচিয়ে রেখে লাভ কি? শুধু সময় নষ্ট তাই আমি তাড়াতাড়ি করে দিলাম"।
"তুমি আর পাল্টালে না"
"আমি এরকমই, নিজেকে পাল্টানোর কোনো ইচ্ছা আমার নেই"
"এইজন্যই তোমাকে এত ভালো লাগে"
স্বামী-স্ত্রী একসাথে হেসে ওঠে কিন্তু সেখানে উপস্থিত বাকিদের হতবিহ্বল ভাবটা তখনও কাটেনি সেটা দেখেই মৌমিতা নিজের ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললো "এভাবে কি দেখছিস ভাই? আমি এরকমই এবার এই লাশটার ব্যবস্থা তুই কর আমরা আসছি"।
মৌমিতার ভাইয়ের নাম মনোজ, পুরো নাম মনোজ দত্ত সে হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে বলে,
"সেটা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না আমি ম্যানেজ করে নেবো"।
"তুমি পারবে তো শালাবাবু?"
"আজ পর্যন্ত ভুল হয়েছে?"
"না সেটা হয়নি"
"তাহলে? ভালো কথা বাবা একবার তোমাদের দুজনের সাথে দেখা করতে চেয়েছেন"
"বাবা দেখা করতে চেয়েছেন, কই উনি তো ফোন করেননি" মৌমিতা অবাক হয় ভাইয়ের কথা শুনে, অরুণাভ ব্যানার্জী ও অবাক হয়,
"কি ব্যাপারে কিছু বলেছেন শালাবাবু?"
""না, জামাইবাবু তবে তোমরা যাও না বাড়িতেই আছেন, আমিও যাচ্ছি"
"ঠিক আছে, তুমিও কাজটা সেরে চলে এসো" অরুণাভ আর মৌমিতা ব্যানার্জী বেরিয়ে যান।
মৌমিতা আর মনোজ দক্ষিণ কলকাতার একজন নামকরা প্রোমোটার মনোজিত দত্তের সন্তান। মনোজিত দত্ত একজন প্রোমোটার ঠিকই কিন্তু প্রোমোটারি ছাড়াও তার আরও অনেক ব্যাবসা আছে যআর মধ্যে আবার দুনম্বরি ব্যাবসাও আছে, সেই ব্যাবসায় তার মেয়ে আর ছেলে সমান অংশীদার। শহরের একাধিক গুণ্ডা মস্তান তার হয়ে কাজ করে, কিন্তু তার প্রধান ক্ষমতার উৎস তার জামাই অরুণাভ ব্যানার্জী।
শুধু দক্ষিণ কলকাতায় নয় পুরো কলকাতা জুড়ে এমনকি কলকাতার বাইরেও অনেক জায়গায় "ব্যানার্জী ক্রিয়েশনস্" এর নাম ছড়িয়েছে বিশেষ করে টালিগঞ্জের ফিল্ম লাইনে যাবতীয় কস্টিউম বা ফ্যাশনের জিনিস এরাই স্পন্সর করে এছাড়া শহরের বিভিন্ন ফ্যাশন ইভেন্টও এরাই করে,বলা চলে কলকাতা এবং তার পার্শ্ববর্তী বেশ কয়েকটা শহরের ফ্যাশন দুনিয়ার একচ্ছত্র অধিপতি এই "ব্যানার্জী ক্রিয়েশনস্"।
কিন্তু অরুণাভ ব্যানার্জী এতে সন্তুষ্ট নয় তার আরও চাই আর এই "আরও চাই" এর চাহিদা মেটানোর জন্যই সে অন্যান্য অনেক ব্যাবসায় জড়িয়ে পরে, ক্রমে পলিট্যিকাল লাইনেও তার ক্ষমতা বিস্তার করে যদিও নিজে সরাসরি জড়িত নয় কিন্তু যখনই দরকার পরে কোনো না কোনো পলিট্যিকাল এরিয়ার লোক ঠিক হাজির হয়ে যায়। ক্রমে নিজের শ্বশুরের দুনম্বরি ব্যাবসাতেও জড়িয়ে পরে কিন্তু রাজনৈতিক যোগাযোগের জন্যই হোক বা "ব্যানার্জী ক্রিয়েশনস্" এর মালিক অভিরূপ ব্যানার্জীর গুড উইলের জন্যই হোক এখনো আইনের জালে জড়িয়ে পরেননি তাই দিন দিন সাহস যেমন বেড়েছে তেমনি বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন আর ক্ষমতাও বাড়িয়ে নিয়েছেন।
দেশপ্রিয় পার্ক থেকে একটু দূরে আধঘন্টার হাঁটা পথের মতো দূরত্বে মনোজিত দত্তের নিজস্ব বহুতল আবাসন "দত্ত অ্যাপার্টমেন্ট যেখানে এখন মনোজিত বাবু থাকেন, এই কয়েকবছর হলো এখানে পুরনো একতলা বাড়ি কিনে সেটাকেই নতুন করে নিজের পছন্দমতো বাড়িয়ে নিয়েছেন, এর আগে তিনি ঢাকুরিয়াতেই থাকতেন অভিরূপবাবুদের বাড়ির কাছেই পরে এখানে চলে আসেন।
মনোজিত বাবুর বাড়ির নীচে ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই অরুণাভ ও মৌমিতা দুজনেই থমকে গেল কারণ সেখানে মনোজিত বাবুর সাথে আরও একজন বসে আছেন, যাকে এরা দুজন এখানে আশা করেননি। অরুণাভ এবং মৌমিতা দুজনের মুখ দেখে বোঝা যায় যে তারা যথেষ্ট অবাক এবং বিস্মিত হয়েছেন কারণ মনোজিত বাবুর সাথে বসে আছেন প্রীতম সেন যিনি সম্পর্কে অরুণাভর পিসেমশাই অর্থাৎ অভিরূপবাবুর বোন মণিমালা দেবীর স্বামী।
"এইতো তোমরা এসে গেছো, আসো বাবা অরুণাভ আয় মৌ"
জামাই আর মেয়েকে ঘরে ঢুকতে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন মনোজিত বাবু, মনোজিত বাবুর বয়স ওই ৬০ এর আশেপাশেই তবে এখনো যথেষ্ট শক্তসমর্থ চেহারা, গায়ের রঙ কালো গায়ের লোম আরো কদাকার করেছে, মুখে পরিষ্কারভাবে দাঁড়ি কামানো থাকলেও পুরুষ্ট গোঁফ, মাথার সামনে অল্প টাক পিছনে কলপ করা কালো চুল। গলায় মোটা সোনার চেন ঝোলানো আর দুহাতের দশ আঙুলের দুটো বুড়ো আঙুল আর দুটো কড়ে আঙুল বাদে বাকি সবগুলোতেই আংটি।
"ইনি এখানে কি করছেন?"
অরুণাভ ঘরে ঢুকে একটা সোফায় বসে সটান প্রীতম বাবুর দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো, অরুণাভর পাশে মৌমিতা বসলো তারও দৃষ্টি প্রীতম বাবুর উপরে। প্রীতম বাবুও তাকিয়ে আছেন অরুণাভ এবং মৌমিতার দিকে কিন্তু তার ঠোঁটে একটা মুচকি হাসি।
প্রীতম বাবুর বয়স ৫২-৫৩ হবে স্লিম ফিটফাট চেহারা, মাথায় কাঁচা পাকা মেশানো চুল ছোটো ছোটো করে ছাটা,মুখ একেবারেই ক্লিনশেভড, গায়ের রঙ পরিষ্কার তবে সবথেকে দেখার জিনিস হলো তার দুটো চোখ সবসময় ধূর্ততা আর চালাকির মিশ্রণ। এনার নিজস্ব পরিবার কেউ নেই একসময় "ব্যানার্জী ক্রিয়েশনস্" এ কাজ করতেন সেখান থেকে মণিমালা দেবীর সঙ্গে আলাপ যা ক্রমে প্রেমে রূপান্তরিত হয় তারপর বিয়ে। বিয়ের পরে অবশ্য স্ত্রীর দাদার বাড়িতেই উঠেছেন।
"কি হলো বাপি উনি এখানে কেন?"
মৌমিতার প্রশ্নের উত্তরে মনোজিত বাবু কিছু বলার আগেই প্রীতম বাবু মুখ খোলেন, ঠোঁটে একটা অদ্ভুত হাসি নিয়ে বলেন
"কেন বৌমা আমিও তো তোমাদের আপনজন আমি কি আসতে পারি না?"
"কি চান আপনি? কি দরকার আপনার?" গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করে অরুণাভ। প্রীতম বাবুর ঠোঁটের হাসিটা আরও চওড়া হয় একটু চুপ থেকে তিনি বলেন "কিছু দরকার ছাড়া কি আসতে নেই?"
"চালাকি বন্ধ করুন, আপনি যে নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই করেননা সেটা বুঝতে অন্তত আমার আর বাকি নেই" অরুণাভ রাগী স্বরে কথাটা বললো। প্রীতম বাবু কিন্তু দমে গেলেন না তিনি একইরকম হাসিমুখে বললেন "আর তুমি?"।
এইটুকু কথা শুনেই অরুণাভর মুখ একেবারে ছোটো হয়ে গেল কিন্তু তার দুচোখ দিয়ে যেন আগুন বেরোতে থাকে পারলে এখনই প্রীতম বাবুকে পুড়িয়ে মেরে ফেলে, কোনোমতে নিজের রাগটা কন্ট্রোল করে জিজ্ঞেস করে
"এখানে কেন এসেছেন? কি চান সোজাসুজি বলুন"
"মাত্র ২ লাখ আপাতত" হাসতে হাসতেই উত্তর দেন প্রীতম বাবু
"হোয়াট আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে এতগুলো টাকা দেওয়া সম্ভব নয়"
"কি বলছো তুমি এভাবে বললে হয় নাকি?"
"আপনাকে অনেক দিয়েছি কিন্তু আমি আর আপনার জুয়া, মদ আর রেসের টাকার জোগান দিতে পারবো না" দৃঢ়ভাবে কথাটা বললো অরুণাভ, কিন্তু প্রীতম বাবুও কম যান না তিনি হাসি হাসি মুখেই বললেন "ওটা বললে কি চলে? আমি তো আর রোজ রোজ চাই না চাইকি? আর ব্যানার্জী ক্রিয়েশনস্ এর হবু মালিক যদি ২ লাখ টাকাকে বেশী বলে তাহলে সেটা শুনতে খারাপ লাগে।"
"আপনি একটু আগেই আমার থেকে ১ লাখ নিয়েছেন" এতক্ষণে কথা বলেন মনোজিত বাবু, এবং তার কথা শুনে অরুণাভ এবং মৌমিতা দুজনেই অবাক হয়ে যায়।
"মনোজিত বাবু সেটা তো নিয়েছি আপনারই কাজ করার জন্য"
"তাহলে আবার কিসের টাকা?" মৌমিতা প্রশ্ন করে,
"আমার প্রাপ্য টাকা"
"আপনাকে আর একটা টাকাও দেওয়া হবে না"
"তাহলে তো আমাকে অভিরূপ ব্যানার্জীর কাছে যেতেই হচ্ছে, কি বলো অরুণাভ?"
"আপনাকে আমি.." মৌমিতা উঠে প্রীতম বাবুর দিকে তেড়ে যাচ্ছিল কিন্তু অরুণাভ তার হাত ধরে আটকায় মৌমিতা আবার সোফায় অরুণাভর পাশে বসে রাগে ফুঁসতে থাকে, এতক্ষণে প্রীতম বাবুর মুখ গম্ভীর হয়, গম্ভীরমুখে তিনি বলেন
"একদম নয় বৌমা, ঘরের বউ তুমি শান্ত থাকতে শেখো নাহলে বিপদ বাড়বে"।
এটা যে একপ্রকার হুমকি সেটা বুঝতে কারো বাকি থাকে না কিন্তু তবুও মৌমিতা শান্ত হয় না সেও তেজের সাথে বলতে থাকে,
"কি করবেন আপনি? বলুন কি করবেন?"
"মনোজিত বাবু আপনি আপনার মেয়েকে ভদ্রতা শেখাননি? কিভাবে বড়োদের সাথে কথা বলতে হয় সেটা শেখাননি?"
"পিসেমশাই... আপনি যা শুরু করেছেন সেটা ঠিক নয় বাবা যদি জানতে পারে তাহলে আপনাকে তাড়িয়ে দিতে দুবার ভাববে না"
অরুণাভর কথা শুনে মনে হলো না প্রীতম বাবু একটুও ভয় পেলেন, তিনিও পাল্টা দাবার চাল দেবার ঢঙে বললেন,
"আর তোমরা যা করেছো সেটা যদি তোমার বাবা জানতে পারেন তাহলে? আমাকে নাহয় বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে কিন্তু তোমাদের কি করবে ভেবে দেখেছো?"
এই কথা শুনে অরুণাভ আবার চুপসে গেল, সে তোতলাতে থাকে
"ম..মা..মানে?"
"আট বছর আগে, গ্যাংটকে.. রুমটেক মনাস্ট্রি এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে চলে? মানছি যে অভিরূপ ব্যানার্জী বা পরিবারের সবার কাছে বা আরও যারা আছেন তাদের সবার চোখে তুমি সোনার টুকরো ছেলে কিন্তু যদি তারা জানতে পারেন তুমি আর তোমার ওয়াইফ কি করেছো তাহলে ভেবেছো কি হবে? অভিরূপ ব্যানার্জী তোমাদের জেলে ঢোকাতে দুবার ভাববেন না আর এটা তোমার থেকে ভালো আর কে জানে যে তুমি বা তোমার শ্বশুরমশাই যতই ক্ষমতা অর্জন করে থাকো না কেন এই পুরো কলকাতা শহরে অভিরূপ ব্যানার্জীর ধারেকাছেও নেই তোমরা তাই একবার যদি কথাটা ওনার কানে যায় তাহলে.."।
"তার আগে আমরা আপনাকে শেষ করবো" রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কথাটা বললো মৌমিতা।
"ঠিক যেভাবে একটু আগেই একজনকে শেষ করে এলে?"
প্রীতম বাবুর কথা শুনে এবার শুধু অরুণাভ আর মনোজিত বাবু নন মৌমিতাও চমকে উঠে চুপসে যায়। প্রীতম বাবু ওদের ওই অবস্থায় দেখে যেন খুবই মজা পাচ্ছেন তার মুখের হাসিটা ফেরত এসেছে তিনি বলেন,
"আমাকে মেরেও কি তোমরা বেঁচে যাবে ভেবেছো? এই শহরে আমারও কিছু বিশ্বস্ত লোক আছে যাদেরকে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া আছে যদি আমার কিছু হয় তাহলে সেই সেদিনের.. সরি সেই রাতের ঘটনার প্রমাণসহ প্রথমে অভিরূপ ব্যানার্জীর কাছে আর তারপর পুলিশের কাছে যেতে, তারপর নাহয় বাকি কাজটা তারাই করবে"
প্রীতম বাবুর কথা শুনে সবাই বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে একটু পরে অরুণাভ মুখ খোলে,
"আপনার ব্ল্যাকমেলিং কিন্তু দিনের পর দিন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে"
"কি করবো বলো? আমারও তো শখ আহ্লাদ আছে নাকি? আর নিজের শখ আহ্লাদ পূরণ করার উপায় যখন আছে তখন ভাবনা কি?"
"কিন্তু আমার থেকে টাকা নেওয়ার জন্য এখানে কেন, আমি তো বাড়িতেও টাকা দিতাম"।
"সে তো বটেই কিন্তু এখানে মনোজিত বাবুর থেকে পেমেন্টটা নিতে এসেছিলাম তারপর শুনলাম তোমরা আসছো তাই থেকে গেলাম"।
"বাপি কিসের পেমেন্ট?" মৌমিতা মনোজিত বাবুকে প্রশ্নটা করে কিন্তু উত্তরটা প্রীতম বাবু দেন, "আমি বলছি বৌমা, এই যে তোমরা তোমাদের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য একজনকে সরিয়ে দিয়ে এলে তার খোঁজটা মনোজিত বাবুকে কে দিয়েছে জানতে চাইবে না?... আমি বলি? ওটা আমি দিয়েছি"
"আপনি?" মৌমিতার স্বরে একাধারে অবাক এবং অবিশ্বাস।
"হ্যাঁ, বৌমা তোমরা আমাকে শত্রু ভাবলেও আমি শত্রু নই বন্ধুই কিন্তু যদি তোমরা শত্রুতা করো তাহলে ক্ষতিটা তোমাদেরই"।
"প্রীতম বাবু ওসব ছাড়ুন, আপনি বলছিলেন কি একটা খবর দেবেন সেটা কি?" মনোজিত বাবু প্রশ্ন করেন।
"খবর একটা নয় একাধিক"
"যেমন?"
"প্রথমত যাদবপুরে যে খেলার মাঠটা দখল করে সেখানে বিল্ডিং বানাবেন বলে ভেবেছেন বা যে পুকুরটা ভরাট করে ওখানেও ফ্ল্যাট তুলবেন বলে ঠিক করেছেন ওটা এখনই করবেন না"
"কেন?"
"ওই এলাকার বেশ কয়েকজন লোকের সাথে অভিরূপ ব্যানার্জীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে এছাড়া ওনার শালা অর্থাৎ অ্যাডভোকেট স্বর্ণেন্দু মুখার্জির বেশ কয়েকজন বন্ধু থাকে ওই এলাকায় কাজেই খবরটা যদি কোনোভাবে অভিরূপ ব্যানার্জীর কানে যায় তাহলে কাজ তো বন্ধ হবেই আপনার টাকা নষ্ট এছাড়া অভিরূপ ব্যানার্জী আপনার সাথে কি করবেন সেটা কে জানে? এটা তো স্বীকার করবেন যে ওনার ক্ষমতা আপনার থেকে অনেক বেশি। তার উপরে স্বর্ণেন্দু মুখার্জি, ওনার ক্ষমতাও কম নয় আফটারঅল হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করেন"।
"তার মানে আপনি কি বলছেন ওই প্লটগুলো ছেড়ে দেবো?"
"ওখানে জোরজবরদস্তি করা যাবে না, যদি প্লটগুলোর মালিক নিজে থেকে দেয় তাহলে ঠিক আছে"।
"নিজে থেকে দিচ্ছে না তো সেটাই প্রবলেম"
"তাহলে আপাতত কাজটা বন্ধ রাখাই ঠিক হবে"
"প্রশ্নই ওঠে না, অভিরূপ ব্যানার্জী এখন এমন কিই বা করবেন? আর এমনিতেও এখন ব্যানার্জীদের প্রায় পুরো বিজনেসটাই অরুণাভ সামলায় তাই.." কথাটা বললো মৌমিতা।
"যেটা জানোনা সেটা নিয়ে কথা বোলো না বৌমা, অরু তোমার বউকে বোঝাও অভিরূপ ব্যানার্জী এখনো কতটা ক্ষমতা রাখেন সেটা ভালো করে বোঝাও, শোনো বৌমা সিংহ শিকার করা ছেড়ে দিলেও সে সিংহই থাকে সেই জঙ্গলের রাজা থাকে, অভিরূপ ব্যানার্জী হলেন সেই সিংহ যিনি এখনো জঙ্গল অর্থাৎ এই কলকাতার রাজা আর তিনি কিন্তু এখনো রিটায়ার করেননি। রাজনৈতিক লাইনে তোমাদের যত যোগাযোগ তার থেকে অনেক উঁচু স্তরে ওনার যোগাযোগ এছাড়া পুলিশের অনেক বড়ো বড়ো অফিসার ওনার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর তাছাড়া এই শহরের লোক ওনাকে কেমন ভক্তিশ্রদ্ধা করে সেটা আশা করি আমাকে বলে দিতে হবে না?"।
"কিন্তু পিসেমশাই ওই প্লটগুলো আমিও দেখেছি ওগুলো ছাড়লে অনেক লস হয়ে যাবে" অরুণাভ নিজের স্ত্রীকে ইশারায় ঠান্ডা থাকতে বলে কথাটা বলে।
"এখন আপাতত ওগুলোর আশা না করাই ভালো, আর ওর থেকেও বড়ো বিপদ এখন তোমাদের সবার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে"।
"বিপদ?" অরুণাভর স্বরে অবাকভাব।
"হুমম তবে সামনে না বলে একেবারে দরজায় বলাই ঠিক হবে" প্রীতম বাবুর কথা শুনে সবাই দরজার দিকে তাকায় সেখানে মনোজ এসে দাঁড়িয়েছে।
"এসব আপনি কি বলছেন প্রীতম বাবু আমার ছেলে বিপদ হবে কেন?" মনোজিত বাবু বিস্ময়ে প্রশ্ন করেন, অরুণাভ আর মৌমিতার মুখের ভাবে বোঝা যায় যে একই প্রশ্ন ওদের মনেও উঁকি দিচ্ছে।
"আপনার ছেলে আর মেয়ে দুজনেই সমান, মেয়ে খালি লাশ ফেলতে পারে আর ছেলে সেই লাশ গায়েব করতে পারে তাও সবসময় ঠিকভাবে হয় না এছাড়া দুটোর একটারও মাথায় বুদ্ধি নেই"।
মৌমিতার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে যেকোনো সময় প্রীতম বাবুর উপর ঝাঁপিয়ে পরবে কিন্তু সেটা করলো না কোনোমতে প্রীতমবাবুর খোঁচাগুলো সহ্য করে চুপচাপ বসে রইলো, প্রীতম বাবু বলে চলেন
"আপনার ছেলে আর তার চ্যালাচামুণ্ডারা কি করেছিল ভুলে গেছেন?"
"কোনটা?"
"ওই যে একটা মেয়ের সাথে একটু ইয়ে.."
"তাতে কি ওই কেস তো মিটে গেছে"
"একদমই নয় প্রীতম বাবু একটু খোঁজখবর রাখুন.. ওই কেস নিয়ে গোপনে তদন্ত হচ্ছে মেয়েটার জবানবন্দিও নেওয়া হয়েছে"।
"কিন্তু কোর্ট তো কেস ডিসমিস করেছে আমার ছেলে আর ওর বন্ধুদের বেকসুর খালাশ করেছে কোর্ট"
"আপনার ছেলে যে বেকসুর ছিল না সেটা আপনার থেকে ভালো আর কে জানে, আর বেকসুর আলিপুর কোর্ট করেছিল হাইকোর্ট নয়"
"হাইকোর্ট?"
"ইয়েস.. কেসটি আবার কোর্টে তোলা হচ্ছে এবং হাইকোর্টে"।
"আপনি কিভাবে জানলেন? কে বললো?"।
"ব্যানার্জী পরিবারের সাথে যুক্ত হওয়ার এই একটা সুবিধা, পুলিশেও নিজের লোক রাখা যায়, ওখানকার একজন বলেছে খুব গোপনে সব হচ্ছে মেয়েটিকে খুবই গোপনীয়তার সাথে রাখা হয়েছে, একবার ভেবে দেখুন আপনার ছেলের কাজ ভিক্টিম এবং সাক্ষী দুটোকেই জ্যান্ত ছেড়ে দিয়েছে"।
"মেয়েটির হয়ে কোন উকিল লড়ছে কিছু জানেন? সেই একই লোক কি?" এতক্ষণে অরুণাভ প্রশ্ন করে।
"তুমি যা করবে বলে ভাবছো সেটা আমি অনেক আগেই করেছি অরুণাভ"
"মানে?"
"তুই ওই উকিলকে টাকা বা ভয় দেখিয়ে সরাতে চাইছো তো? ওটা আমি অনেক আগেই করেছি, আরে বাবা মনোজিত বাবুর সাথে তো আর আজ থেকে পরিচয় নয় আমার কি বলেন মনোজিত বাবু?"
"তা সেই উকিল কি কথা শুনলো না?" মনোজিত বাবু প্রশ্ন করেন।
"শুনেছে মনোজিত বাবু শুধু তাকে পঞ্চাশ হাজার ক্যাশ দিতে হয়েছে, এটুকু যদি দিয়ে দেন তাহলে ভালো নাহলে আর কি বন্ধুত্বের জন্য নাহয় নিজের পকেট থেকে যাবে"
"দিয়ে দেবো, কিন্তু যদি ওই উকিল আপনার কথা শুনে থাকে তাহলে সমস্যা কোথায়?"
"কলকাতায় একটাই উকিল আছে নাকি? অন্য একজন উকিল সেই মেয়েটার হয়ে কেস লড়বে সেই সব করছে শুনলাম সাক্ষীও জোগাড় করেছে"।
"কিন্তু আঙ্কেল সেদিন কোনো সাক্ষী ছিল না" মনোজ জোর গলায় কথাটা বলে।
"দেখলেন মনোজিত বাবু বললাম না আপনার ছেলের মাথায় একটুও বুদ্ধি নেই। মনোজ তুমি কিভাবে অত শিওর হচ্ছো যে সেদিন কোনো সাক্ষী ছিল না?"
এবারে মনোজ আর কোনো কথা বললো না চুপ করে রইলো, প্রীতম বাবু আবার বলতে শুরু করেন,
"হয়তো ছিল বা হয়তো নকল সাক্ষী"
"নকল সাক্ষী?"
"তুমি যদি নকল সাক্ষী খাড়া করে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারো তাহলে, নকল সাক্ষী এনে তোমাকে দোষী প্রমাণিত করতে অসুবিধা কোথায়? মনোজিত বাবু আগে এই কেসটা সামলান, কেসটা কোনোভাবেই হাইকোর্টে তুলতে দেওয়া যাবে না তার আগেই থামাতে হবে"
"কিন্তু কেন? আমার ভাই একবার বেকসুর খালাস পেয়েছে আবার করিয়ে আনবো"
"এবারে অত সোজা হবে না আর তাছাড়া কোনোভাবে যদি এটা স্বর্ণেন্দুর নজরে পরে আর তার থেকে অভিরূপ ব্যানার্জীর কানে যায় তখন আপনাদের জন্য বিপদ হতে পারে"।
"বাপি আমাকে বাঁচাও,আমি জেলে যেতে চাই না" এতক্ষণে মনোজ এসে মনোজিত বাবুর পায়ের কাছে বসে তার পা ধরে কান্না শুরু করলো, উত্তরে মনোজিত বাবু সপাটে দুটো থাপ্পড় ছেলের গালে বসিয়ে দিয়ে বললেন,
"কতবার বলেছি এমন কোনো কাজ করবি না যাতে আমার নাম খারাপ হয় বা করলেও পরিষ্কারভাবে করবি কিন্তু তুই..."
"পিসেমশাই এই যে উকিল এই কেসটা হ্যাণ্ডেল করছে সে কে? তার সম্পর্কে জেনেছেন? কে,কোথায় থাকে, ফ্যামিলি ব্যাকগ্ৰাউণ্ড?" অরুণাভ প্রশ্ন করে।
"তার আগে ওই ভিক্টিম মেয়েটিকে নিয়ে ভাবো কি করবে?"
"আপনার মাথায় কোনো প্ল্যান আছে মনে হচ্ছে?"
"আছে"
"কি প্ল্যান?"
"এইসব প্ল্যান কি বিনা খরচে আসে?"
"কত চান আপনি প্রীতম বাবু?" এবার মনোজিত বাবু প্রশ্ন করেন।
"সবসময় টাকা চাইবো, এতটাও লোভী নই আমি মনোজিত বাবু"
"তাহলে কি চান আপনি পিসেমশাই?"
"পার্টনারশিপ"
"পার্টনারশিপ?"
"হ্যাঁ, তোমরা শ্বশুর জামাই অনেক বিজনেসে হাত পাকিয়েছো আমি সেখানে পার্টনারশিপ চাই, অবশ্য বিনিময়ে আমিও কিছু অবশ্যই যোগদান দেবো"
"আর যদি আমরা রাজী না হই?" মৌমিতা প্রশ্ন করে। "তাহলে তোমার ভাইকে জেলে যাওয়া থেকে আটকাতে পারবে না" প্রীতম বাবু যথারীতি মুখে হাসি নিয়ে উত্তর দেন।
"কিন্তু আপনাকে যদি পার্টনার করিও তাহলে আপনি কিভাবে কেসটা সামলাবেন?"
"সেসব আমার উপরে ছেড়ে দাও"
"কিন্তু আপনি যেচে আমাদের উপকার করতে চাইছেন কেন?"
"মৌমিতা তুমি হয়তো জানোনা কিন্তু তোমার বাবার সাথে আমার আজকের পরিচয় নয়, অনেকদিনের পরিচয় কি মনোজিতবাবু মেয়েকে বলুন"।
"আগে শুনি আপনার প্ল্যান"
"এসব প্ল্যান কি সবাইকে বলা উচিত? তোমার বাবা জানেন আমি হলাম শিল্পী মানুষ আর্টিস্ট, আমার কাজ আর্টের কাজ তাই তো তোমার বাবা আমাকে কাজ দেন"
"কিন্তু উপায়টা তো বলবেন"
"ধরো যদি মেয়েটা কোর্টে পৌঁছানোর আগেই কোনো দুর্ঘটনায় মারা যায় তখন"
"কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব? আপনিই তো এক্ষুনি বললেন যে মেয়েটাকে অত্যন্ত গোপনে রাখা হয়েছে"।
"আর সেই গোপন জায়গার খোঁজ আমি জানি"।
"প্রীতমবাবু তাহলে আপনি মেয়েটাকে সামলান আর আমি কথা দিচ্ছি আপনি আমাদের ব্যাবসার পার্টনার হবেন"।
"না মনোজিত বাবু, আগে পার্টনারশিপ তারপর আমার কাজ"
"আপনি যদি কথার খেলাপ করেন?"
"আপনি আমাকে অনেকদিন ধরে চেনেন কোনোদিন কথার খেলাপ করেছি? কিন্তু আপনার সেই রেকর্ড আছে তাই আগে পার্টনারশিপ পরে মেয়েটার ব্যাবস্থা"
"কিন্তু কাগজপত্র তৈরি করতে একটু সময় লাগবে"
"তার দরকার নেই, আমি তৈরী করেই এনেছি আপনারা পড়ে সই করে দিন তাহলেই হবে"।
মনোজিত বাবু এবং অরুণাভ দুজনেই বুঝতে পারে এছাড়া আর উপায় নেই তাই তারা সই করে,আর মৌমিতাও চুপচাপ সই করে। সইপর্ব মেটার পরে অরুণাভ একটা প্রশ্ন করে,
"কিন্তু পিসেমশাই, মেয়েটার সাথে নিশ্চয়ই পুলিশের লোক আছে পাহারার জন্য"
"সেটা তো আছেই, তবে তুমি চিন্তা কোরো না"
"কি করবেন আপনি?"
"কালকের পেপারে দেখে নিও হেডলাইন" কথাটা বলে প্রীতমবাবু হো হো করে হেসে ওঠেন।
I'm the King of Dark
&
I rule over all Devils