09-04-2023, 04:24 PM
ধুম্রগড় রহস্যে বড়বৌদি
© শ্রী মহাবীর্য দেবশর্মা
৷৷ দ্বিতীয় পর্ব্বঃ শান্তিনীড়ের অশান্তি ৷৷
"নদীর সুপেয় মিষ্টি জলের সাথে যদি সাগরের নোনা জলের সঙ্গম ঘটে কোন একটি ভূ-ভাগে তবে সেখানকার জীববৈচিত্র্য হয় ভিন্নতর, আর এই অদ্ভুত বিষয়টাকে ভূগোলে নাম দেওয়া হয়েছে এসটুয়ারী! এটা মোটামুটি ইকলেজ ফাইনাল অবধি যারা ভূগোল পড়েছি তারা সবাই জানি। কিন্তু যেটা খেয়াল করি না সেটা হল এই একই জিনিস আমাদের মানুষদের মধ্যেও ঘটে থাকে। যখন দুই ভিন্ন সংস্কৃতি আর ভাষার মানুষদের মিলন ঘটে তখনও জন্ম হয় এই এসটুয়ারীর। কখনও সখনও সেটা কৃত্রিমও হতে পারে, অর্থাৎ স্বাভাবিক নিয়মে তৈরী হয় নি, তৈরী করেছে মানুষ নিজের প্রয়োজনে। যেমন বিহার আর নেপাল সীমান্তে ঘেঁষা মিথিলার মৈথিলী ভাষার সাথে বঙ্গের ভাষার মিলনে তৈরী করা হয়েছিল ব্রজবুলি ভাষা। একে অনেকে উত্তরপ্রদেশের ব্রজভাষার সাথে গুলিয়ে ফেলে, কিন্তু এ ব্রজের ভাষা নয় বরং বঙ্গের নিজস্ব সৃষ্টি যার মাধ্যমে বঙ্গবাসী বিদ্যাপতির সৃষ্টির আস্বাদ নিতে চেয়েছিল। আর একদিন যখন এই ব্রজবুলি কার্যতঃ হারিয়ে গেছে বঙ্গ থেকে, তখন এক কিশোর ওই ভাষাতেই লিখে ফেলল এক আশ্চর্য গাথা, ভানুসিংহ নাম তার, নোবেল পায়নি তখনও সে। সবাই যখন ভানুসিংহকে হারিয়ে যাওয়া এক অসীম প্রতিভাশালী কবি ভাবছিল তখনই জানা গেল সে আর কেউ না স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! ভানু অর্থে রবি আর সিংহ অর্থে ইন্দ্র বা রাজা। যার ব্রজবুলিতে লেখা 'গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে' গানটা সেদিন তুই শুনছিলি।
এতো গেল, কৃত্রিম মানব-এসটুয়ারী কিন্তু স্বাভাবিক মিথস্ক্রিয়ার নিয়মেও মানবসমাজে এসটুয়ারী তৈরী হয়, সবচাইতে ভাল উদাহরণ দুটো ভিন্ন ভাষাভাষী আর সংস্কৃতির দুটি রাজ্যের সীমানা ঘেঁষা অঞ্চলে গেলে। এখানে এলে শুদ্ধতাবাদীদের মাথায় হাত পড়ে কারণ এই সীমানাঘেঁষা অঞ্চলগুলোতে শুদ্ধ বলে কিস্যু নেই। প্রকৃষ্টতম উদাহরণ চাস? এই মুহূর্তে ট্রেনের কামরার চারদিকে তাকা, লোকজনের কথাবার্তা খেয়াল কর বুঝতে পারবি। এখানে লোকজনের জিনিসপত্র হাত থেকে পড়ে যায় না বরং সামান গিরে যায়!"
বড়বৌদির কথা শেষ হতে না হতেই দেখলাম একটা লোক বলছে, "বাবু একটু হটিয়ে, আমি অগলা ইস্টেশনেই উৎরাব!" আমি হাসলাম শুনে, "সত্যিই তো খেয়াল করিনি বৌদি।" আজ সকালেই ধুম্রগড়ের ট্রেনে চেপেছি। শুরুতে কামরা রীতিমতো ফাঁকা থাকলেও যত বেলা গড়াচ্ছে তত ভীড় বাড়ছে। আরেকটা জিনিসও নজর করছিলাম ট্রেন যত পশ্চিমে যাচ্ছে চেনা ভাষার লোকগুলোও কমে যাচ্ছে, বদলে ধীরে ধীরে হিন্দী ঘেঁষা লোকজনের সংখ্যা বাড়ছে। নিজেদের মধ্যে এরা যে ভাষায় কথা বলছে সেটা ঠিক না বাংলা আর না হিন্দী, বরং বলা যায় বাংলা ঘেঁষা হিন্দী বা হিন্দীঘেঁষা বাংলা! বড়বৌদির মতে, দুটোই ঠিক। আমি জিজ্ঞেস করলাম, "এই কারণেই কী এই অঞ্চলগুলোকে বাংলা নিজেদের দাবী করে আবার বিহারও নিজেদের দাবী করে?" বড়বৌদি ঘাড় নাড়ল, "আর ঠিক এই একই কারণে বাংলাও এদের দায়ভার নিতে চায় না আর বিহারও নেয় না। এরা আমাদের হয়েও আমাদের না আবার ওদের হয়েও ওদের না। দুয়ের মাঝের এই যাঁতাকলে মানুষগুলো পিষে মরে।" আমি মাথা নাড়লাম। রেলের এইটুকু কামরার ভিতরেই রীতিমতো একটা ছোটখাটো পৃথিবী রচিত হয়েছে। কেউ গল্প করছে, কয়েকজন তাস পিটছে, কেউ আবার খৈনি ডলছে, বাচ্চার কান্না ভেসে আসছে, হকারের চিৎকার সবমিলিয়ে একেবারে হাট বসে গেছে।
হঠাৎ শুনলাম একজন বলছে, "ভাইয়া একটা গানা শুনাও না!" তাকিয়ে দেখি কয়েকজন হারমোনিয়াম তবলা নিয়ে ট্রেনে উঠেছে। হেসে ওরা ঘাড় নাড়ল। তারপর একজন হারমোনিয়াম নিয়ে সিটে বসল, দেখলাম ওই সিটের যাত্রীরা নিজেরাই জায়গা ছেড়ে দাঁড়াল। এবার লোকটা গান ধরল,
"চলতে চলতে ইউহীঁ কোই মিল গয়া থা…
সরে রাহ্ চলতে চলতে
বহীঁ থমকে রেহ্ গয়ী হ্যা
মেরী রাত ঢলতে ঢলতে…"
অপূর্ব গাইছে লোকটা। শুনতে শুনতে যেন ডুবে গেছি। যখন গান শেষ হল তারপরও যেন কানে তার রেশ রয়ে গেল বহুক্ষণ।
"য়হাঁ বেঠ সক্তা হুঁ?" কথাটা শুনে ঘাড় ফেরালাম। একজন বছর তিরিশের লোক দাঁড়িয়ে, বেশ কান্তিময় চেহারা, সৌম্য দর্শন বলা যায়, ক্লিন শেভড মুখ, থুতনির গোড়ায় হালকা একটা কাটা দাগ রয়েছে, সম্ভবতঃ ক্ষৌর কর্মের সময় ব্লেড লেগে গেছিল। দাড়ি ইদানীং আমারও হালকা গজিয়েছে, তবে আমি এখনও নিজে কাটতে শিখিনি, সেলুনই একমাত্র উপায় আমার! লোকটার পরনে ব্লু ডেনিম রঙের জিন্স আর হাফহাতা ঘিয়ে রঙের শার্ট। শার্ট ইন করা, কালো লেদার বেল্ট প্যান্টে, বেল্টের বাকল্স্ দেখে মনে হল খুব সম্ভবতঃ অ্যালেন-সুলী কোম্পানীর। হাতের কব্জিতে টাইমেক্সের কাল ডায়ালের ঘড়ি। গৌর বর্ণ গায়ের রঙ, উচ্চতা প্রায় ছয়ফুট। পায়ে ব্রাউন রঙের জুতো, ব্র্যান্ডটা খেয়াল করলাম, বাটা! শার্টের মধ্যে হালকা ট্রান্সপারেন্সি আছে, ফলে জামার বুকপকেটে একটা ছোট্ট নোটবুক রয়েছে সেটা বোঝা যায়, আর সোনালী রঙের পার্কারের কলম, ঝরণা কলম খুব সম্ভবতঃ। হাতে একটা ভিআইপি স্যুটকেস, মাঝারি সাইজের। যখনই কাউকে দেখি, বড়বৌদির ট্রেনিং অনুযায়ী লোকটার আগাপাশতলা লক্ষ্য করাটা এখন আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আগে অনেক সময় লাগত সবটা খেয়াল করতে কিন্তু এখন কয়েক সেকেণ্ড লাগে মাত্র। বড়বৌদি এটাকে বলে "অবজার্ভেশন স্কিল"। সোজা বাংলায়, "পর্যবেক্ষণ দক্ষতা!" সাধারণ মানুষ স্রেফ দেখে কিন্তু একজন গোয়েন্দাকে খুঁটিয়ে দেখতে হয় এবং এটা শুধু গোয়েন্দা নয় গুপ্তচরবৃত্তির লোকজনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। রবিবার দিন সাধারণত আমি সেলুনে গিয়ে দাঁড়ি গোঁফ চুল কেটে আসি, বড়বৌদির কথামত কোন ম্যাগাজিন বা নিউজপেপার নিয়ে যাই সাথে, পড়বার ভান করে সেলুনে আসা লোকজনকে অবজার্ভ করা ছিল আমার ট্রেনিংএর অঙ্গ! আবার কোন গাড়ী দেখলে সবার আগে খেয়াল করতে হবে, তার নম্বরপ্লেট, ব্র্যান্ড, মডেল এবং রঙ। গাড়ীতে কোন দাগ আছে কি না। শুরুতে খুবই বিরক্তিকর ছিল এই প্রশিক্ষণটা, বহু ভুল হত, নজর এড়িয়ে যেত। পরে পরে যত সময় যেতে লাগল, দক্ষতা বাড়তে লাগল, ব্রেন প্রায় নিজস্ব নিয়মেই কাউকে দেখলে সব খুঁটিয়ে দেখে নিতে চাইত, বুঝে নিতে চাইত। আজকে এই লোকটার ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হল না।
লোকটার কথা শুনে বড়বৌদি মৃদু হেসে বলল, "জ্বী বিলকুল! ফ্রী কান্ট্রি হ্যা! বেঠিয়ে না!" লোকটা প্রত্যুত্তরে হেসে ঘাড় ঝুঁকিয়ে আমার পাশে বসল। "বাপান একটু জলের বোতলটা দে তো?" বড়বৌদি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে জলের বোতলটা চাইতেই লোকটা বলে উঠল, "আপনারা বাঙালী?" বড়বৌদি ঘাড় নাড়তেই লোকটার মুখে পরিচিতির হাসি দেখা গেল, "আমিও! আমি সত্যজিৎ সামন্ত! আপনারা কোথায় নামবেন?" বড়বৌদি উত্তর দিল,
- আমরা ধুম্রগড়! আপনি?
- আমিও ধুম্রগড়েই নামব। কিছু মনে করবেন না, আপনাদের ধুম্রগড়ে এর আগে কোনদিন দেখেছি বলে মনে পড়ছে না! আপনারা কি এই প্রথম যাচ্ছেন?
- হ্যাঁ বলতে পারেন প্রথম বারই যাচ্ছি।
- কোন আত্মীয়ের বাড়ীতে উঠছেন কি? কিছু মনে করবেন না, আসলে আমার একটা হোটেল আছে ধুম্রগড়ে। নিজের বলে তারিফ করছি না, কিন্তু খুবই ভাল হোটেল, ভদ্রলোকের বসবাসের উপযুক্ত। বুঝতেই পারছেন পাপী পেট, তাই সম্ভাব্য কাস্টমার দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়ি আর কী! এই যে দেখুন এই আমার কার্ড!
কথাটা বলে নিজের মানিব্যাগ বের করে সত্যজিৎ কার্ডটা ধরিয়ে দিল বড়বৌদির হাতে, "আপনাদের মা-ছেলের জন্য কিন্তু আদর্শ হোটেল। বড় কামরা আছে, নরম বিছানা, বড় বড় জানালা দিয়ে বাইরের ভিউ ভাল পাবেন। বিদ্যুৎ এবং পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা তো আছেই পাশাপাশি নিজস্ব বাথরুমও পেয়ে যাবেন। ফুডিং এরও ব্যবস্থা আছে। মাছ মাংস সবই মোটামুটি পেয়ে যাবেন। আর সিকিউরিটি ব্যবস্থাও ভাল, দুজন দারোয়ান আছে, একজন চৌকিদার আছে।" সত্যজিৎ নিজের ব্যবসার গুণগান গাইতে কোনরকম কসুর করল না। বড়বৌদি কার্ডটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল, "শান্তিনীড়! বড় সুন্দর নাম আপনার হোটেলের সত্যজিৎ বাবু। তবে আপনার একটু ভুল হল, আমরা ঠিক মা-ছেলে নই। বাপান আমার ছেলের মত হলেও, আদতে আমি ওর বড়বৌদি।" সত্যজিতের মুখে হাসি দেখা গেল, "বাহ! অবশ্য বাড়ীর বড়বৌদি মায়ের সমানই হয়।" বড়বৌদি নিজের ভ্যানিটি ব্যাগে কার্ডটা চালান করতে করতে বলল, "আমাদের যদিও ধুম্রগড় ঘুরতে যাওয়াই উদ্দেশ্য। তাই আপনার অফারটা নিলে মন্দ হয় না যদিও এটা দেখতে হবে আমরা সেই হোটেল অ্যাফোর্ড করতে পারবো কি না!" সত্যজিৎ সাথে সাথে বলে উঠল, "আরে না না, এমন কোন ফাইভ স্টার হোটেল নয় আমার যে সাধ্যের বাইরে দাম হবে। তারপর আপনারা বাঙালী আপনাদের কাছে বেশী দাম কি নেওয়া যায় বলুন! ঠিক আছে আপনারা না হয় হাফ দাম দেবেন! ফুডিং লজিং দুয়েরই হাফ দাম। এবার নিশ্চয়ই আপত্তি থাকার কথা নয়?" বড়বৌদি ঘাড় হেলাল, "বেশ চলুন তবে আপনার হোটেলেই নাহয় উঠবো!" সত্যজিতের মুখে ডিল পাকা করার হাসি দেখা গেল। "ধন্যবাদ!" এরপর এটা-সেটা নিয়ে বিভিন্ন গল্প হতে লাগল। সত্যজিতবাবুর মুখেই জানলাম, ধুম্রগড়ে নাকি এই সেদিন পর্যন্ত রীতিমতো জঙ্গল-রাজ চলত। প্রায় প্রতিদিন খুন-জখম-ডাকাতি-;., এসব লেগেই থাকত, দুনম্বরী কার্যকলাপে ছেয়ে গেছিল ধুম্রগড়! তবে সম্প্রতি নতুন যে পুলিশ অফিসার এসেছে, সে নাকি বেজায় কঠিন লোক। রীতিমতো কঠোর হাতে সব দমন করায় পূর্বের চেয়ে অবস্থা এখন যথেষ্ট ভাল। অন্তত বউ-বাচ্চা নিয়ে থাকা যায়। পাহাড় ঘেরা পরিবেশ বলে পর্যটকের আনাগোনা হচ্ছে, যদিও খুবই স্বল্প তবুও সত্যজিতের মত লোকেরা একটু ব্যবসাপত্তর করে বেঁচেবর্তে আছে। কথা প্রসঙ্গে পোদ্দার পরিবার প্রসঙ্গ এল। দেখলাম সত্যজিতের চোখে রীতিমতো ঘৃণা ফুটে উঠলো, "ওরাই ধুম্রগড়কে শেষ করে দিয়ে চলে গেছে। যত বাজে কাজ করে এটাকে দুর্বৃত্তদের স্বর্গ বানিয়ে দিয়ে নিজেরা এখান থেকে বিদায় নিয়েছে।" বুঝতে পারলাম ধুম্রগড়ের লোকজন এত বছর পরও ক্ষমা করেনি পোদ্দার পরিবারকে। আরও বহু কিছু নিয়ে গল্প হতে হতে আমাদের ইস্টিশন চলে এল। সত্যজিৎ দেখলাম খুবই অমায়িক ভদ্রলোক, আমাদের মালপত্তর তুলতেই দিল না, নিজেই সব মোটঘাঁট নিয়ে একটা রিকশা ডেকে আমাদের তুলে রিকশাকে শান্তিনীড়ের ঠিকানা বুঝিয়ে দিল। অন্য একটা রিকশায় নিজে চাপল।
রিকশায় চড়ে যেতে যেতে ধুম্রগড়ের অনবদ্য দৃশ্য দেখতে লাগলাম। চারিদিকে পাহাড় ঘেরা, মাঝে মাঝে সবুজের ছড়াছড়ি। বেশকিছু পাকা ঘর রয়েছে, তবে অনেক কাঁচা ঘর আছে। রাস্তায় লোকজন বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত আছে, একটা চায়ের দোকানও আছে দেখলাম। কাঁচা রাস্তা। রয়েছে ঘন জঙ্গল। আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, জঙ্গলের গাছগুলোতে ক্যানোপী রয়েছে! অনেক উঁচু আর লম্বা গাছ, প্রায় ছাতার মত বিস্তৃতি। পাহাড়ী অঞ্চল বলেই মনে হয়, উষ্ণতা অনেক কম। তবে একটা স্যাঁতস্যাঁতে ভাবও আছে আর্দ্রতা এবং শৈত্যের এমন মিশেল অভূতপূর্ব! আর যে জিনিসটা ইস্টিশনে নামার পর থেকেই চোখে পড়েছে সেটা হল ধুম্রগড়ের নাম-সার্থকতা! চারিদিকে একটা ধোঁয়া ধোঁয়া ভাব। সবই যেন বড় অস্পষ্ট!
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা শান্তিনীড়ে পৌঁছে গেলাম। দেখলাম নামেই হোটেল, আদতে বাংলো টাইপের দোতলা বাড়ী। উপর নীচে মিলিয়ে গোটা আষ্টেক কামরা রয়েছে, তবে বেশ বড় বড় কামরা। আমাদের রিকশাকে আসতে দেখেই মনে হয় একজন বেরিয়ে এল, পুরুষমানুষ, বয়েস বেশী নয় ওই তিরিশ-বত্রিশ বছর বয়স হবে। যদিও ঘোর কৃষ্ণাঙ্গ কিন্তু খুবই বলিষ্ঠ আর শক্তিশালী চেহারা। রীতিমতো পেটানো পেশীবহুল শরীর, লম্বায় প্রায় ফুট ছয়েক, মুখে দাড়ি-গোঁফ আছে। একটা চোখ ছোট। পরনে খাটো পাঞ্জাবী আর খুঁট গোঁজা ধুতি। হাতে একটা মোটা লাঠি। প্রথম দেখায় মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়া চেহারা, ভদ্রলোক কম গুণ্ডা বেশী মনে হয়। গলার স্বরও গুরুগম্ভীর পুরুষালি, "আইয়ে মেমসাহেব!" মেঘমন্দ্র স্বর শুনে যেন কেঁপে উঠলাম হালকা! সত্যজিৎ পিছন পিছন রিকশা নিয়ে নামল, "আরে রামু ই মেমসাব আউর ছোটাবাবু কা সামান অন্দর লে কে যাও, আউর শুনো উ যো উপরমে দকষিন্ দিশা মে কামরা হ্যা না বড়া বালা উসিমে ইন লোগো কী সামান রাখ দিও। আউর থোড়া পানি-বানী কা ইন্তেজাম করো, ই মেমসাহেব আউর বাবুজি বহুত দূর সে আয়ে হ্যা।" রামু নিজের ঘাড় নাড়িয়ে উত্তর দিল "জ্বী বাবুজী!" বলে আমাদের মাল পত্তর নিয়ে ভিতরে গেল। সত্যজিৎ হাঁক দিল, "আউর শুনো উ ধর্মাকো জরা কেহ দেনা মেমসাহেব আউর বাবুজিকে লিয়ে কোই আচ্ছা সা খানা পাকানেকো!" রামু ঘাড় নেড়ে চলে গেল ভিতরে। আমরা বাইরে থেকে বাংলোটা দেখছিলাম। বড়বৌদি বলল, "এরকম জায়গায় এত খরচ করে বাংলো বানিয়ে হোটেল ব্যবসায় লাগিয়েছেন। আপনার টাকা তুলতেই তো অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে।" সত্যজিৎ হেসে বলল, "আসলে এটা আমার বাড়ী বলতে পারেন। পৈতৃক বাড়ী ছিল সেটাকেই সামান্য রিনোভেট করিয়ে দিয়েছি। আমি যেহেতু এখনও বিয়ে থা করিনি তাই এটাকে টুকটাক হোটেল হিসেবে ব্যবহার করি, কিছু টাকা হাতে চলে আসে। নইলে আমার মূল ব্যবসা কিন্তু গাছের। চিন্তা করবেন না, লাইসেন্স আছে সেটার। তবে হ্যাঁ হোটেলের অনুজ্ঞাপত্র নেই। কালে-কস্মিনে এক-আধজন থাকতে আসে, তারজন্য লাইসেন্স করানোর কোন মানে হয় না!" বড়বৌদি হাসল, কিছু বলল না। সত্যজিৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, "আরে বাপরে! দেড়টা বাজতে চলল, চলুন চলুন স্নান করে ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নেবেন, সকাল থেকে তো ট্রেনে মনে হয় কিছু খাওয়া হয় নি, চলুন ভিতরে যাওয়া যাক!" আমরা ভিতরে ঢুকলাম। দেখলাম সত্যিই বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে। উপরের দোতলার সিঁড়িও বেশ প্রশস্ত। উপরে ঢুকেই বাঁদিকে তিন নম্বর কামরাটা আমাদের জন্য বরাদ্দ হয়েছে। নিজস্ব চাবিও দিয়েছে, যদিও দরজায় হাল ফ্যাশনের ইন-বিল্ট তালা নেই তবে গোদরেজ কোম্পানির একটা নবতাল বড় তালা ঝুলছে। কাঠের মজবুত পোক্ত দরজা। ভিতরে দেখলাম নরম গদিআঁটা ডবল বেডের বিছানা, তার উপর পরিষ্কার ধবধবে চাদর পাতা, চারটে বালিশও রাখা আছে বিছানায়। বিছানার ঠিক উপরে সিলিং ফ্যান আছে। কামরার ভিতরে দেওয়াল ঘেঁষে একটা কাঠের আলনা, ড্রেসিং টেবিল, ড্রেসিং টেবিলের ঠিক সোজাসুজি উপরে দেওয়ালে একটা বাল্ব লাগানো আছে, নাইট বাল্বও আছে। বিছানার পাশের দেওয়াল ঘেঁষা একটা টু-সিটার সোফা, তার সামনে ফোল্ডিং হুইল লাগানো নীল রঙের টি-টেবিল, উপরে খালি অ্যাশট্রে রাখা। বিছানার পাশে দুটো গ্রিল দেওয়া বড় জানালা। এককোণে একটা ছোট্ট বাথরুম, বাথরুমে বড় বড় বালতিতে জল আর মগ রাখা আছে। নতুন লাক্স সাবান আর দশটা ছোট ছোট ক্লিনিক প্লাস শ্যাম্পুর প্যাকেট আছে। পাশের হ্যাঙ্গারে ধবধবে তোয়ালে ঝুলছে। স্নানাগারের সাথেই টয়লেট ব্যবস্থা রয়েছে, তবে অবাক লাগল ইউরোপীয় ঘরানার কমোড সিস্টেম দেখে। এসব জায়গাতে সচরাচর বাংলা প্যান ব্যবহার হয়। মানতেই হবে সত্যজিৎ বাবুকে, শৌখিনতা শুধু তার পোশাক-আশাকে নয় প্রায় সর্বত্র ফুটে আছে। সব মিলিয়ে দেখলাম এখানে থাকার সিদ্ধান্ত খুব একটা ভুল নয়, যদিও পরে বুঝতে পেরেছি কি মারাত্মক ভুল ছিল এই সিদ্ধান্ত!
বড়বৌদি বলল, "আমি আগে স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে নিই তারপর তুই যাস। পুরো ঘেমে নেয়ে একশেষ হয়ে আছি।" আমি ঘাড় নাড়লাম। বৌদি শাড়ি ব্লাউজ ব্যাগ থেকে বের করে বাথরুমে ঢুকল। আমি জানালার কাছে গিয়ে নীচের দৃশ্য দেখছি। খোলা অবারিত স্থান হওয়ায় বহুদূর অবধি দেখা যাচ্ছে, পাখির কিচির-মিচির ভেসে আসছে। হঠাৎ মনে হল বেশ তেষ্টা পেয়েছে, সাথে যে জলের বোতল ছিল সেটা তো ট্রেনেই শেষ। কামরার চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম খাবার জল রেখে যায় নি আর রামুকে ডাকার জন্য কোন বৈদ্যুতিক স্যুইচও নেই দেখলাম। নীচে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। আমি খালি বোতলটা নিয়ে জল আনতে নীচে গেলাম। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ কথোপকথন শুনতে পেলাম, গলা শুনে মনে হল সত্যজিৎ আর রামু তবে আরেকজন কেউ আছে মনে হয়। হয়তো নিজেরা গল্প করছে, কিন্তু হঠাৎ কানে টুকরো কথা ভেসে আসতেই ভিতরটা ঠাণ্ডা হয়ে গেল, কোনমতে নিজেকে সিঁড়ির রেলিংটা ধরে সামলে নিলাম। ঝট করে সিঁড়ির বাঁকটায় বসে পড়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম কথাগুলো,
-কিতনা বড়া বড়া চুঁচি হ্যা বাবুজী! মেরে তো হোঁশ হী উড গয়ে থে পাহলিবার দেখ কে!
-হাহাহা! সচ বলেছিস। গাঁড়টাও কিন্তু হেব্বি বড়ো আছে। চুত কেমন হবে সেটাই দেখার।
- হাঁ বাবুজী। উপরসে বাঙালী আউরাত। মুঝসে তো অব সবর নহীঁ হোতা বাবুজী। আজ রাত কো হী একবার কোশিষ করতে হ্যা না বাবুজী!"
-"পাগল! আরে ইতনা উতলা হওয়ার কুনো জরুরৎ নাই। বিধবা আউরাত আছে, আর এইরকম হুসন! চাপ মৎ লে রামু। আগে এক-দো দিন দেখে নিই, আগার বাত বনি তো ঠিক আছে, নইলে ওই রাস্তা তো খোলা আছেই।
- ওর ছেলেটাও তো আছে সাথে। ওটা কিন্তু বেশ সমস্যার। অবশ্য উম্র একদম কম আছে। সামাল দিতে পারা যাবে তাই না সতু ভাইয়া। (এই গলাটা একদম অচেনা)
-ওটা ওর ছেলে নয় হরিয়া, ওর দেবর আছে। রাণ্ডিটা বিধবা মনে হয় ওর পতি বাচ্চা পয়দা করতে পারার আগেই শায়দ উপরে চলে গেছে।
-হেহেহে! ক্যায়া মালুম। লেকিন এইসব শহরী বাঙ্গালন কী বাত হি আলগ হ্যায় বাবুজী। সচ মে একবার শালী মিল যায়ে তো জিন্দাগি সোনা পে সুহাগা বন যায়ে হ্যা কি নহীঁ হরিয়া।
-চুপ কর রামু। উ লোগ নীচে উৎরা তো বহুত মুশকিলে পড়ে যাব। যা হবে রাতমে হবে। অভি যা, যা যাকে ধর্মা কো দেখ, খানা এখনও তৈয়ার হয় নি নাকি?
-জ্বী বাবুজী।
-হরিয়া তু উপরমে যা, গিয়ে দেখ কুছ লাগবে কি না ওদের?
-জ্বী সতু ভাইয়া, উ জেনারেটরের পানি আছে কিনা দেখেই যাচ্ছি অভি।
-হুঁ।
কথোপকথন শুনে আমার মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। এ কোন বিপদে পড়লাম আমরা! হে ভগবান!এরা তো আমার বড়বৌদিকে! না না এখনই বড়বৌদিকে জানাতে হবে সব। এক্ষুণি এই ভয়ঙ্কর জায়গা ছাড়তে হবে! পা টিপে দৌড় লাগালাম আমি উপরের দিকে…
(ক্রমশঃ)
প্রথম প্রকাশঃ ২৫শে চৈত্র্য, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ