07-04-2023, 08:41 PM
পর্ব- পনেরো
দুপুরের খাওয়াটা আজ একটু বেশিই হয়ে গিয়েছে, পেট ফুলে একদম যেন ঢোল। তাই হয়তো এখনো ঠিকমত নড়াচড়াটাও করতে পারছি না, শ্বাস ফেলতেও কষ্ট হচ্ছে। তাই এখন কাজের কাজ বসে বসে মাঝে মধ্যে বিশাল ঢেঁকুর তুলছি। রান্নার স্বাদ কেমন হয়েছে সেটা বলতে পারবো না সত্যি বলতে সেদিকে ধ্যানই দেই নি৷ তবে খাওয়া টা বেশি হয়ে গিয়েছে ওনার হাতের ছোঁয়া পেয়ে, কথা নিজ হাতেই খাইয়ে দিল আমাকে আর কাব্যকে। ওর হাতের ছোঁয়াতে এমনিতেই সবকিছুর স্বাদ দ্বিগুণ হয়ে যায়। আর সেই স্বাদের জাদুতেই আমিও হয়তো একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছিলাম। আর এখন হোটেলে বসে বসে সেটারই খেসারত দিচ্ছি, মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছে গলায় আঙুল দিলে খাবারের নাগাল পেয়ে যাবো৷ ভরা পেটে বেশি একটা নড়াচড়া করতে পারছি না। বাধ্য হয়েই কাব্যের সাথে বসে আছি হোটেল লবিতে আর সামনের খোলা জায়গাটাকে সাজাতে দেখছি। সন্ধ্যার পর ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠান হবে, সেটারই আয়োজন চলছে। কাব্য একমনে আমার মোবাইলে গেম খেলছে, আমি আশেপাশে তাকিয়ে কথা কে খুঁজতে থাকলাম। কিন্তু কোথাও দেখতে পেলাম না ওকে। ও সামনে থাকলে গেম খেলার সুযোগ টা কাব্য অবশ্যই পেতই না। তবে ও গেলো টা কোথায়! আমাকে তো কিছু বলেও গেলো না।
একটু আরামের খুঁজে দু পা ছড়িয়ে নিজেকে এলিয়ে দিলাম চেয়ারে। একটু দূরেই কজনা দল বেঁধে গুনগুন করে গান গাইছে সেটা একটু আধটু কানে বাজছে এর মাঝেই চোখ বুজে নিলাম আয়েশের জন্য৷ হঠাৎ করেই কাঁধে একটা নরম হাতের স্পর্শ অনুভব হলো, হাতের স্পর্শ টা চেনা তবুও আধো চোখ মেলে তাকাতেই দেখি কথার রাগান্বিত চোখ জোড়া কাব্যের দিকে তাকিয়ে। ওদিকে বেচারা কাব্যতো আপন মনেই আমার মোবাইলে গেম খেলছে। আমি কিছু বলবো তার আগেই কথা ঝাঁজিয়ে উঠলো,
কিরে কতক্ষণ ধরে গেম খেলা হচ্ছে শুনি! পিঠে মনে হয় পিট্টি টানছে, এমনিতেও কয়েকদিন ধরে তো পিঠে পড়ছে না।
মায়ের গলার আওয়াজ শুনতেই চোরের মত উপরের দিকে তাকায় কাব্য। মায়ের চোখ চোখ পড়তেই ঝড়ের গতিতে মোবাইল খানা আমার হাতে দিয়ে দিয়েছে,
আঙ্কেল খেলতে দিয়েছে।
যা বাবা ছেলে তো এটা বড্ড পাজি, নিজেকে বাঁচাতে বাঘিনীর হাতে আমাকে তুলে দিলো। যাই হোক ব্যাপারটা আপাতত সামলাতে তো হবে,
না মানে.... তুই ছিলি না তাই একটু খেলছিলো আর কি। বেশিক্ষণ হয় নি, গড প্রমিজ।
হয়েছে হয়েছে দোসর সাজতে হবে না, তোর আশকারাতে ও গোল্লায় যাচ্ছে। আচ্ছা যেটা বলতে এসেছি, রাতের প্রোগামে তুই কিন্তু পার্টিসিপ্যাইট করবি।
প্রোগ্রামে আমাকে পার্টিসিপ্যাইট করতে হবে শুনে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো,
আ..আ. মি আমি কি করবো। (হাত জোড় করে) না না ওসবে আমি নেই।
ওসব শুনছি না, তোকে করতেই হবে আমি তোর নাম দিয়ে দিয়েছি৷ (মুখটা একটু দুঃখী ভাব করে) তুই পার্টিসিপ্যাইট করবি না! সবার সামনে আমার আমাকে ছোট করবি তাই তো।
এ তো মহা ফ্যাসাদে পড়লাম রে বাবা,
তা কি করবো টা আমি??
সেটা আমি বুঝবো, তুই পার্টিসিপ্যাইট করবি তো?
তোর আবদার ফেলি সেই সাধ্য আছে কি আমার! হুম করবো। খুশি তো!
খুশি খুশি খুশি অনেক খুশি... (বলতে বলতে আমাকে জড়িয়ে ধরলো)
তোর মনে আছে কলেজে থাকতে একটা প্রোগ্রামে আমরা কাব্যনাট্য মঞ্চস্থ করেছিলাম।
হুম মনে আছে, কিন্তু হঠাৎ সেই ক.... (মাথাটা আবার চক্কর দিয়ে উঠলো) তুই কি কোনভাবে আবার সেটা করার কথাই ভাবছিস না তো??
এইতো ঠিক ধরেছিস, তুই কিন্তু কথা দিয়েছিস এখন আবার তালবাহানা করবি না কিন্তু।
সেটা না হয় বুঝলাম তবে ওট তো মুখস্থ নেই করবো কিভাবে? আর দিপু দা??
সেটা তোকে ভাবতে হবে না, ওসব ম্যানেজ হয়ে গিয়েছে। তুই শুধু রেডি থাক শুরুর দিকেই আমরা পারফর্ম করবো....
খুশি মনে কথা ওদিকে কোথায় চলে গেল আর আমি বসে বসে শুকনো ঢোক গিলতে লাগলাম।
মিনিট পনের পরেই একগাদা কাগজ হাতে এসে কথা হাজির পাশেই দিপু দাও দাড়িয়ে। দিপু দাই প্রথমে বলে উঠলো
এই যে কিঞ্জল বাবু কথার মুখে তো অনেক প্রশংসা শুনলাম, আজ কিন্তু একেবারে ফাটিয়ে দিতে হবে।
আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না শুধু মাথা নাড়ালাম। কথা এগিয়ে এসে কয়েকটা কাগজ ধরিয়ে দিলো,
একবার দেখে নে।
আচ্ছা....
কয়েকটা নাচ গানের পারফরম্যান্স শেষে আমাদের নাম এনাউন্স করা হলো। আমার কিছুটা ভীতি কাজ করছিলো। অনেকদিন হয়ে গেলো এসবের সাথে যুক্ত নেই, তাছাড়া এই কাব্যের মর্মার্থের সাথে আমাদের জীবনটাও যে খানিক জড়িয়ে। পুরনো স্মৃতি গুলো যে শুধু কষ্টই বয়ে আনে আমাদের জন্য, তবে তাতে যে খানিক সুখস্মৃতিও জড়িয়ে আছে সেটা তো অস্বীকার করা যায় না। কথা আমার হাতটা চেঁপে ধরে অভয় দিলো। মঞ্চের বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি আর কথা মঞ্চের মাঝামাঝি গিয়ে দুজন দুজনার দিকে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়ালাম। হঠাৎ করেই দুটো রঙিন স্পট লাইট জ্বলে উঠলো আমাদের দিকে তাক করে। সাউন্ড সিস্টেমে বেজে উঠলো মন মাতানো আবহ সুর৷ আমার সামনে শাড়ি পরিহিত কথা দাঁড়িয়ে আছে কিছুটা ঘুমটা টেনে, কাগুজে ফুলে সাজিয়েছে নিজেকে। চোখ কাজলের রেখা টেনেছে, ভ্রূমধ্যস্থ ছোট্ট কালো টিপ। আমি চোখ সড়াতে পারছিলাম না, ওদিকে কথা বারবার তাড়া দিচ্ছিলো শুরু করার জন্য। আমি মাইক্রোফোন টা মুখের কাছে নিয়ে আসলাম, মুখাবয়ব যথেষ্ট করুণ আর কৌতূহলী করার চেষ্টা করলাম...
কথাও নিজের অভিব্যক্তিতে হৃদয়ের যন্ত্রণা টা ফুটিয়ে তুলার চেষ্টা করছে, চোখ যুগল ছলছল করছে এই বুঝি অশ্রুর প্লাবন বইবে। আমি শুরু করলাম...
ওগো সখি ও মোর প্রেয়সী
একি বেশে আজি আসিয়াছ সাজি
মিলন নিশিথ রাতে।
কেন আঁখিজল করিছে টলমল
কাজল নয়ন পাতে।
ওগো সখি,কেন ও চপল নয়ন
ব্যথাতুরা উদাসী,
কেন সুকোমল মুখ পরি রাখিয়াছে ঘিরে
শরতের ঘন মেঘদল আসি?
চাহ মোর পানে,আনো সুষমা সুরভি প্রানে
এ রাতি কেন যাবে ফিরে,
দেখ চাঁদ যেতে যেতে অস্ত,অচল পথে
চাঁদনী মাখিছে দীঘির নীরে।
কেমন এ শান্ত সমির।
প্রানের গোপন বৃন্তে ফোটাইছে কলি,
শ্রান্ত কুয়াশা চুম্বন ঢালি
ভিজায়ে দিয়েছে মল্লিকা ফুলগুলি।
রাতের ডাহুকী ক্ষনকাল ধরি
ডাকিয়া মধুর রবে,
তোমার আমার মিলন বারতা
শুধাইছে একান্ত নিরবে।
তোমার আপন ছবি ভাসিয়া উঠেছে
আকাশ আর্শি পরে,
একাদশী চাঁদ বিদায় চুমেছে
অভিমানী মান করে।
আঁখিতে আঁখিতে মিশায়ে গো দেখো
কি সুধা জাগিছে পরানে,
কি উপহার তোমার লাগিয়া
জমা রহিয়াছে গোপনে।
এবার কথা ওর পঙক্তি গুলো বলা শুরু করবে। নিজের চেহারার ঢেকে রাখা ঘুমটা টা টেনে দিতেই এলোমেলো কেশ গুলো বেড়িয়ে আসছে৷ মুখমণ্ডল জুড়ে বেদনার ছাপ স্পষ্ট। চোখের জলে কাজলে মাখামাখি....
সখা তোমাতে আমাতে আর
নাহি হবে দেখা,
মোদের সকল নিরব স্বপন
শুধু মিছে হলো আঁকা।
মোর যত গান রচেছিলে তুমি
তোমার ছন্দ সুরে,
লহ সখা সকলি তোমার,
মোর যাহা দাও ফিরায়ে মোরে।
তোমার হৃদয়ে মোর যে ছবি
আঁকিয়াছ রঙ্গে রূপে,
সবি তার ওগো দিও বিসর্জন
সন্ধ্যাবরন ধুপে।
আমি তোমারি হয়ে এসেছিনু একদিন
আজিকে চলিনু ফিয়িয়া,
আপনি সাধিয়া বেঁধেছিনু মালায়
আপনি দিলাম ছিঁড়িয়া
ডেকেছিনু পাশে,বেঁধেছিনু
দিয়েছিনু গলে মালা,
তুমি হেসেছিলে,নিরব ব্যথায়
আমি কেঁদেছিনু একেলা।
সখা,তুমি তো পাওনি ব্যথা
সকল বেদনা রোদন মোর,
আমি পুড়িয়াছি,আমি মরিয়াছি
সে মোর আঁখিলোর।
হৃদয় ভাঙার যন্ত্রণাটা প্রেমিকের চেহারায় প্রতিফলিত করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। আমার জন্য মনে হয় এটা খুব বেশি কষ্টের হলো না। নিজেকে যে এটার সাথে জুড়ে দিচ্ছিলাম। এতো দিনের দেখা স্বপ্নের ইতি ঘটবে এমন কথা জানবার পড়ে কেমন প্রতিক্রিয়া হতে পারে সেটা নিজের হাবভাবে তুলে ধরতে লাগলাম। প্রেমিকাকে নিজের মনের ব্যাথা-বেদনা বুঝানোর চেষ্টা করতে হবে....
কেমনে কহিছ সখি!
হৃদয় বেদনায় ঢাকি ভুলিয়া থাকি তোমা,
এতদিন ধরে তুমি মরিয়াছ পুড়ে
মোর প্রানে ছিল সবি জমা।
কহিও না আর তোমারে ভুলিবার,
মুছিবারে এ স্বপন মোর,
যে মালা গাঁথিয়াছ যতবার আসিয়াছ
আমি তো রুধিনি কভু দ্বার।
রহিয়াছি সারাক্ষন পথ চাহি আনমন
নিঝুম নিশিথ জাগি,
স্বপন আবেগে মধুর সোহাগে
তোমার সান্নিধ্যের লাগি।
কেমনে ভুলিব সখি,যে ছবি লয়েছি আঁকি
হৃদয় গহন পটে,
গাগরি ভরিতে জলে চলিয়াছ দুলে দুলে
শাপলা দীঘির ঘাটে।
ছায়া সরু পথ ধরি এ কি রূপ মরি মরি।
অঞ্চল উড়াইছে দক্ষিনা সমির,
দিনের অস্ত রবি করিয়া নিঝুম সবি
ঘিরিয়াছে পথবাঁক কাজল তিমির।
জোনাকীর ঘুম চোরা লোচন পাগল পারা,
উড়িয়া মাতিয়া সাজাইছে বন,
তোমার মধুময়ী ছবি হেরিয়া মরম কবি
ছন্দে ভরিছে মন।
এসেছিলে পাশে বসেছিলে হেসে
সেদিন সন্ধ্যামাধবী রাগে,
দিয়েছিলে ভরে এ হৃদয়,মোরে
বেঁধেছিলে লাজ-অনুরাগে।
তারপর সখি আসিয়াছে সাজি
বন বাসরের রাতি,
নিশিথ বিজনে হৃদয় কাননে
জাগিয়া প্রানের জ্যোতি।
তুমি কন্ঠে আমার দিয়েছ পরায়ে
বদল মালার হার,
আমি দিয়েছিনু হৃদয় ভরিয়া
বেদনার আঁখি ধার।
মোদের এই ভালবাসা,এই জানাজানি
এ হৃদয় বিনিময়,
চিরদিন কিগো জাগিয়া রহিবে
নিশিথ জাগার ব্যথায়।
প্রেমিকের প্রতিত্তোরে বলতে গেলে নিজের সাফাই জবাবে প্রেমিকার মনে জেগে উঠা অভিমান আরও চেঁপে বসে। প্রেমিক হয়তো তার যন্ত্রণার জায়গাটাই ধরতে পারলো না, সেই কষ্টেই চোখের কোণ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছে। প্রেমিকার মনে জমে থাকা ক্ষোভ এবার বুঝি আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎ্পাতের অপেক্ষায় আছে। কথার চোখে মুখে সেটার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে...
কেন এত প্রেম আজিকে তোমার
কেন এত বন্ধন মায়া?
যবে চাহিয়াছিনু তোমার পরশে
প্রানের সোহাগ ছায়া।
তখন কেন গো মিছে ছল করে
রহিয়াছিলে নিরবে দূরে
কেন গো বাঁধনি বীনা তার সুরে,
কেন গো দেখনি হৃদয় চাহিছে কারে?
কেন সখা আসি কহ নাই ডাকি
তুমি মোর-আমি তোমারি,
কেন দূর হতে বাসিয়া ভাল
কেন ঝরায়েছ নয়ন বারি?
প্রেমিকার মনের ক্ষোভের জানান পেয়ে প্রেমিকের বোধদয় হয়। এবার সে হয়তো ব্যাথার জায়গা খোঁজে পেয়েছে, পথ্যের ব্যবস্থা করতে হবে। গলার স্বর নিচু হয়ে আসে সঙ্গে মিশ্রিত হয় আফসোসের ভার...
বুঝিনি কখন সখি তোমায়
বাসিয়াছি এত ভালো,
কখন সখি এ প্রান জুড়িয়া তুমি
দিয়েছ ভরিয়া আলো!
কখন আমার সব স্নেহ প্রেম
উত্সারিয়াছি তোমার লাগিয়া,
কখন আমার হৃদয় মরু
শ্যামলে উঠেছে ভরিয়া!
কখন আমাতে হাসিতে খেলিতে
তুমি যে গিয়েছ হারিয়ে,
দিয়েছ কখন সব সুধা তব
নিশিথে মাধুরী সাজায়ে।
প্রেমিকের কন্ঠে এতোদিনের কাঙ্ক্ষিত সেই জবানবন্দি শুনতে পেয়ে প্রেমিকার মন হু হু করে কেঁদে উঠে। এই কান্না কষ্টের নয় এতো সুখের কান্না। প্রেমিকার মন বিগলিত হয় ধীরে ধীরে নিজের মনের গোপন বাসনা একে একে ব্যক্ত করতে থাকে নিজের প্রিয়র কাছে...
দূর হতে দেখেছিনু সুকোমল সুরভি ভরা
একটি মনোহর ফুল,সন্ধ্যা পূরবে
উদিয়াছিল সন্ধ্যা তারা!
ভাবিয়াছি কত রাতি আনিয়াছি কত গাঁথি
হৃদয়ের রঙে রাঙায়ে,
আমার গোপন বাসনা সঁপিতে তোমার পায়ে।
তবু হয় নাই মোর পুরন সে সাধ
দ্বিধা সংকোচ-লাজ-ভয়ে,
পারিনি বাঁচিতে আপনি
সে মালা তোমারে তুলিয়া দিয়ে।
কতবার গেছি তোমার দ্বারে,
নব কত শত ছল অভিসারে,
সব লাজ সংকোচ রাখিয়া দূরে,
তবু পারি নাই কহিবারে।
তোমার আঁখির পানে চাহিয়াছি যতবার
হয়ে গেছি সখা মূক,
কি এক আবেগ পুলকে মাতিয়া
কাঁপিয়া উঠেছে বুক।
মোর চঞ্চল আঁখিপাতে
এত লাজ ভয় আসি
বাঁধিয়াছে যবে জানিয়াছি সখা
আমি তোমারে যে ভালবাসি।
কথা খানিক এগিয়ে আসে আমার দিকে, আমিও এগিয়ে এলাম। প্রেমিক প্রেমিকা উভয়ের মাঝেই এখন অনেক প্রশ্নের উত্তর খোঁজার অপেক্ষা...
ওগো সখি ও মোর প্রেয়সী
কেন তবে তোমাতে আমাতে এই গান গাওয়া,
মিছে হয়ে যাবে মোর এ পথ চাওয়া!
কেন তবে এতদিন ছিনু মিছে
ছলনার আশা লয়ে,
দুজনের মাঝের লুকানো উত্তরের আশায়...
কেন সখা বেঁধেছিলে যদি যাবে
হৃদয় ব্যথা দিয়ে?
কি ছিল প্রয়োজন তবে
এ বাসর বদল মালার,
কেন তবে গেঁথেছিনু নিশিথে
স্বপনের মনিহার!
ব্যাথাতুর মনে রাগের আস্তরণ পড়েছে সেটারই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে....
সুখের বাসরে রহিবে তারা হয়ে জ্বলি
তাই মোর বুনো বেদনার
নাই কোন মূল্য সখি
তোমার নিকটে আর।
প্রেমিকার হৃদয় সেটা মানতে নারাজ সে যে আজ পরীক্ষা দিতে এসেছে তার ভালোবাসার...
নহে প্রান,সুখ মোর কোথা বল,
চির দিন এ-তো হয়ে রবে আঁখিজল।
কোথা আছে এমন সুখ
যাহা তুমি দিয়েছ মোরে,
এত সাধ মোর সখা
ছাড়িয়া যাইতে তোমারে!
এত সাধনার,এত বেদনার
এ মোর সাধের নয়নমনি,
কত কাল ছিনু পথ চাহি তোমা
কত দিন গেছি গুনি
প্রানে প্রানে যারে এতদিন ধরে
ফিরেছিনু খুঁজি খুঁজি,
পেয়েছিনু তারে বেঁধেছিনু তারে
বিদায় দিতেছি আজি!
একি মোর সাধ,শান্তি আমার
একি মোর তৃপ্তি বল?
সযতনে প্রানে যাহার লাগিয়া
গেঁথেছিনু ওগো সুখের কমল!
কি ব্যথা লাগে প্রানে বুঝিবে কেমনে
সখা,তুমি তার ভাষা,
তোমার লাগিয়া এতকাল মোর
জমে ছিল সব ভালোবাসা
সকলি দিয়েছি তোমা,
মোর সব প্রেম,সব ফুলদল,
রাখিয়াছি শুধু আপনার লাগি
বেদনা নয়ন জল।
প্রেমিকার অশ্রুধারা ছুটে চলেছে, সেই অশ্রু যে প্রেমিকের হৃদয় সহ্য করতে পারছে। সে ছোটে যেতে চায়, মুছিয়ে দিতে চায় তার প্রেয়সীর চোখের জল। আপন করে জড়িয়ে নিতে চায় নিজের বুকের মাঝে। তবুও কেন পারছে না। কোন এক অদৃশ্য সুতোয় বেঁধে আলাদা করে রাখা হয়েছে দুটো প্রাণ যাদের আত্মা এক। এভাবেও কি কাউকে আলাদা করা যা...
এ মোদের চাওয়া সখি নাহি হল পাওয়া,
শুধু রয়ে গেল বিধুর বেদনা
দুইটি হৃদয় ভরিয়া।
সখি যেথা যাই যতদূরে,
যেথা দুঃখ-সুখ পুরে
চিরদিন রহিব তোমার।
তুমি জানিবে,আমি জানিব
এ প্রেম শুধু তোমার আমার।
ওগো সখি ও মোর প্রেয়সী
তুমি শুধুই আমার
আমি শুধুই তোমার।
আমি আর কথা দুজন দুজনার দিকেই তাকিয়ে আছি। দুজনের গাল বেয়ে অশ্রুধারা নেমে আসছে। ইচ্ছে করছে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠি, তবে যদি যন্ত্রণার ভার কিছুটা হলেও লাঘব হয়। কিন্তু পরিবেশ আর পরিস্থিতি আমাকে আটকে রেখেছে হয়তো কথাকেও। মঞ্চের লাইট নিভে গেল, সাথে সাথেই তুমুল করতালিতে সবাই দাঁড়িয়ে আমাদের অভিবাদন জানাতে লাগলো। এই ফাঁকে আমি কথা দুজনেই চোখ মুছে নিলাম, আড়াল করে দিলাম মনের লুকানো কষ্ট গুলোকে। সবাই সুখী হোক আমাদের হাসিমুখেই দেখে।
★★★★★
চোখের পলকে সময় চলে যায় তার আপন গতিতে, আমার কিবা সাধ্য তাকে রুখি নিজের মতিতে। ইচ্ছে আমার আকাশ ছোঁয়া কিন্তু আমি নিছক খুদে বালক, খেলার ছলে কাজ আমার ধুলোয় লুটোপুটি। মন কে মানায় এমন পরশ কে বা দেয় চঞ্চলতা হাপিত্যেশ আমার হৃদয় খানি। দিন পঁচিশের পরেই বাড়িতে এতো বড় অনুষ্ঠান তাই এবার ছুটির ঘুরাঘুরি সব বন্ধ। কিন্তু এমন একটা সময়ে আমার মনকে অন্যকিছুতে ব্যস্ত রাখা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছিল। বাড়িতে আমার তেমন কোন কাজ নেই আর দোকানেও আমার যেটুকু কাজ রুটিন মাফিক। তবুও আজকাল দোকানে বসে থেকে সময় কাটাতে চেষ্টা করি, কিন্তু এভাবে সময় কাটানো যেন বড্ড কষ্টকর।
কিছুতেই যে সময় ফুরায় না। বাসায় এটা ওটা করতে চাই কিন্তু সেখানেও মায়ের বাঁধা। ওসব নাকি আমাকে করতে হবে না। তবুও আজকাল টুকটাক কাজ করি জোর করেই। কি করবো আমার মনের ভেতরে কি চলছে সেটা তো আর কাউকে বলতে পারছি না, আর বললে যে রক্ষে থাকবে না সেটাও তো জানাই আছে। আমিও তাই কাজ খুঁজতে মায়ের পেছন পেছন ঘুরি।
সময়টা আপন গতিতেই ছুটে চলেছে আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়েছি বিয়ের কাজে। কার্ড পছন্দ করা, বিয়ের কেনাকাটা, বাড়িতে টুকটাক মেরামত আর রঙের কাজে সাহায্য করা, বিয়েতে ভাই বোনের কি করবো সেসবের প্ল্যান করা এসবেই মেতে ছিলাম কয়েকটা দিন।
এর মাঝেই দিন দশেক বেড়ানোর পর ফিরে এসেছিল কথারা। বাড়ি ফিরিয়ে চলে এসেছিল আমাদের বাসায় কোথায় গেল, কি দেখল, কি খেলো, কি করলো সেসবের গল্প করতে। কিন্তু আমার তো আগে থেকেই ওর উপর রাগ জমে ছিল তাই ওর এসব গল্পে আমার শরীরে জ্বালা ধরাচ্ছিলো। মন চাইছিলো ওর চুল গুলো টেনে ছিঁড়ে দেই, কিন্তু সেটাতে মায়ের কাছে আমাকেই পিটুনী খেতে হবে। তাই যতটা পারি ওকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছিলাম, সেটা বোধহয় কথার নজরেও পড়েছে। সেটাও বুঝলাম মা যখন ডেকে ধমকের স্বরে বললো আমি কথার সাথে কথা বলছি না কেন, আবার কোন ঝগড়াঝাটি করেছি নাকি। আমার মেজাজটা পুরো বিগড়ে গেল ও কোথাকার কোন মহারানী যে ওর সাথে আমার ঝগড়া করতে হবে। কেন কথা বলতে যাবো আমি ওর সাথে, আমার কোন দরকার নেই। আমাকে চুপচাপ ওখান থেকে সড়ে যেতে দেখে মা খানিক বিস্মিত হলো বটে। আমি আমার মতই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম তবে মাঝেমধ্যে আড়চোখে কথার হাবভাব বুঝার চেষ্টা করলাম৷ ও মুখটাকে কোলা ব্যাঙের মত ফুলিয়ে বসে আছে আর আমাকে দেখছে। আমিও বেশি বেশি করে ওর সামনে বাকিদের সাথে হাসাহাসি করতে লাগলাম। ওর জ্বলন দেখে আমার ভেতরে ভেতরে কি যে আনন্দ হচ্ছিলো বলে বুঝাতে পারবো না।
দুপুরে খাবার খেতে বসে জানতে পারলাম একালের মহারানী ভিক্টোরিয়া খাবার না খেতে এসে ঘরে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। আর অবধারিত ভাবেই দোষটা আমার উপরেই পড়লো, বাকিদের মতামত এটাই আমিই কিছু করেছি তাই ও মন খারাপ করে বসে আছে। আমার বাবা তো তার ভাগিনির কষ্ট দেখতেই পায় না, আপন ভাগিনি হলেও একটা কথা ছিল ঐ দূর সম্পর্কের ভাগিনির জন্য এতো দরদ কেন সেটাই বুঝতে পারি না। কই আমার প্রতি তো এতো দরদ কখনো দেখায় না, রাগ হয় বাবার প্রতি। হঠাৎ বাবা আদেশ দিলো যা হয়েছে সেটা মিটমাট করে কথা কে খাবার জন্য নিয়ে আসতে। বাবার কথা তো ফেলতে পারবো না, অগত্যা আমাকে উঠে যেতে হলো মহারানীর মান ভাঙাতে। আশ্চর্য বিষয় কোথায় আমার রাগ দেখানো উচিত, চোটপাট করার কথা সেখানে উল্টো আমাকে যেতে হচ্ছে ম্যাডামের মান ভাঙাতে৷ ঘরে গিয়ে দেখি মহারানী খাটে বসে পা দুলাতে দুলাতে টিভি দেখছে, আমার মাথাটা গরম হয়ে গেল
ওই খেতে চল মা ডাকছে...
নাহ! আমি খাবো না। আন্টিকে বলেছি তো..
খাবি না কেন? মা তোকে নিয়ে যেতে বলেছে।
এমনি ইচ্ছা হচ্ছে না। আমার খিদে নেই, তুই যা তোর খিদে পেলে তুই গিয়ে খা।
সেটা তুই গিয়ে মা কে বলে দে না আমি বেঁচে যাই, তোর নেকামির জন্য আমাকে বকা খেতে হচ্ছে।
তুই আমার সাথে এমন করে কথা বলবি না আমি কিন্তু কেঁদে দেব বলে দিলাম। তুই সবসময় আমার সাথে কেন এমন করিস।
বারে আমি আবার কি করলাম, যত দোষ সব নন্দ ঘোষ!
বিছানা ছেড়ে উঠে এসে আমার জামা খামচে ধরে নিলো,
তুই আমার সাথে কথা বলছিস না কেন? তুই কথা না বললে আমার কষ্ট হয় জানিস না।
তোর উপর রাগ হয়েছে তাই..
কেন আমি কি করেছি?
আমাকে না বলে বেড়াতে চলে গেলি কেন? একটা বারও বললি না যে বেড়াতে যাবি, আমি এখানে একা একা....
এর জন্য এতো রাগ করতে হয়? আমি কি তোকে না বলে কখনো কোথাও গিয়েছি? হঠাৎ করেই চলে গিয়েছিলাম আমার যাবার কথা ছিল না।
সেটা না হয় মানলাম, ওখানে গিয়েও তো ফোন করে বলতে পারতি৷ সেটাও তো করিস নি, রাগ করবো না তো কি করবো?
সত্যি বলছি অনেকবার ফোন করতে চেয়েছি কিন্তু ওখানে একদম নেট থাকে না। তোর সাথে কথা বলতে না পেরে আমারও কি কষ্ট কম হয়েছে! তাই তো বাসায় ফিরেই এখানে চলে এলাম তোকে সব বলবো বলে। আর তুই এখানে রাগ করে বসে আছিস আমার সাথে কথা বলছিস না।
হুম বুঝেছি এখন চলেন মহারানী দয়া করে খেয়ে নিবেন। না হলে আবার আমাকে খেতে দিবে না।
কথার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠেছে, যেন অনেক প্রতীক্ষার পর শান্তির দেখা পেয়েছে। কথা কে আমার সাথে আসতে দেখে বাকিরাও খুশি। ওদের এমন ভাব যেন আমি না খেলেও চলবে কিন্তু ওর খেতেও হবে। বাবা তার আদরের ভাগিনি কে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগলো। বারে আমি যে ওকে খাবার খেতে নিয়ে আসলাম সেটার কৃতিত্ব দেবার দেখি কেউ নেই সবাই ওকে নিয়ে ব্যস্ত। একেই বলে ফ্যামিলি পলিটিক্স....