28-03-2023, 12:01 PM
উত্তরণ
"পিউ,
কেমন আছ?
ভাবছ, এতদিন পরে কেন লিখছি?
অনেকদিন ধরেই ভেবেছি লিখব, জানো? কিন্তু পারিনি।
অপরাধবোধ হয় সেজন্য রোজ।
থাক সেসব কথা।
এখন গান করো না, পিউ?
"যেতে দাও আমায় ডেকো না" শুনেছিলাম একবার পাড়ার ফাংশানে। মায়ের একটা সবুজ শাড়ি পরেছিলে…
যাই হোক, আজ এখানেই থামি।
আবার লিখব।
ইতি,
'আমি'।
সকাল সকাল পোস্টকার্ডে চিঠিটা দেখেই অবাক হয়ে যান ইন্দ্রজিৎ। 'পিউ' মানে দিদি! দিদিকে আবার কে এমন চিঠি লিখতে পারে?
তবে চিঠিটা দেখে, ভাষা দেখে তো খুব চেনা কেউ মনে হচ্ছে! দিদির গানের কথা জানে… মায়ের শাড়ি… হুম, মায়ের শাড়ি তো দিদি পরতেই পারে…
কে ইনি?
দিদির প্রেমে পড়েছিল কেউ?
"মহুয়া, মহুয়া? এদিকে এসো…" হাঁক দিয়ে বৌকে ডাকলেন ইন্দ্রজিৎ।
"কি? সকাল সকাল এত ডাকাডাকি কেন? আমি কিন্তু এখন আর চা করতে পারব না, একবার করে চা দিয়েছি। সব কাজ তো একাই করতে হয়। মিনতিদি না আসা অব্দি বসারও চান্স পাই না।" আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বলেন মহুয়া।
সত্যি তো, বয়স তো থেমে থাকে না, তারমধ্যে এখন থেকেই মহুয়ার পায়ে আর্থারাইটিস ধরা পড়েছে। হাঁটু মুড়ে বসতে কষ্ট হয়। বাড়ির কাজ নিয়ে রেগেও থাকে প্রায় সবসময়। আজকাল কথায় কথায় 'আইবুড়ি দিদি' নিয়েও খোঁটা দেয়। অথচ বিয়ের আগে থেকেই তো জানত দিদির কথা…
"এই চিঠিটা… আজ পেলাম লেটারবক্সে।"
"কিসের চিঠি?"
"পড়েই দেখো।"
পড়তে পড়তে ভুরু কুঁচকে গেল মহুয়ার। তারপর বলল "দিদি গান করত? ফাংশানে? সে তো আদ্যিকালের কথা। এখন আবার কে এসব লিখল?"
"চেনা কেউই হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু কোনো নাম লেখেনি…"
"লুকোনো প্রেমিক! ফর্টি ফাইভ ক্রশ করল দিদি আগের বছর… আর এখন এইসব…"
"এইসব মানে? কী আশ্চর্য কথা মহুয়া!"
"দিদি বিয়ে করেনি, এই বয়সে এইসব চিঠি… দেখে তো আমিই আশ্চর্য হচ্ছি।"
"দেখো, চিঠি এসেছে ঠিকই, কিন্তু তাতে তো কোনো অশোভন কিছু লেখা নেই? তাহলে তুমি রিয়্যাক্ট কেন করছ?"
"তুমিও তো রিয়্যাক্ট করছ! তাই তো অফিস যাবার আগের এই ব্যস্ত সময়েও আমাকে ডেকে দেখালে…"
"ভুল হয়েছে! একটা চিঠি দেখে অবাক হলাম তাই শেয়ার করার জন্য ডাকলাম।"
কিছু উত্তর দেবার আগেই কলিংবেল বেজে উঠল।
"এখন আবার কে?"
"প্লিজ তুমি দেখো, আমি স্নানে যাচ্ছি, নইলে দেরি হয়ে যাবে। এমনিতেই সোমবার লেট হলে অসুবিধা হয় খুব।"
"হুঁ, আমার যেন খুব সময় আছে হাতে!" গজগজ করতে করতে দরজার দিকে এগিয়ে যান মহুয়া।
দরজার কাছে যাবার আগেই দেখেন ইন্দ্রজিতের দিদি, সুমেধা দরজা খুলে কিছুর একটা ডেলিভারি নিচ্ছেন। পিছনে ঘুরে ওকে দেখতে পেয়ে হাসলেন।
আজ একটা হাল্কা গোলাপী রঙের শিফন শাড়ি পরেছেন। গলায় একছড়া মুক্তোর হার। মাথার চুল ভিজে।
"আজ একটু বেশিই সাজগোজ! কী ব্যাপার, কারো সাথে দেখা করার আছে নাকি?" না চাইতেই বেশ একটু অন্যরকম হয়ে গেল মহুয়ার গলা।
ছেচল্লিশ হতে চলল, মহুয়ার থেকে ছ বছরের বড়, তাও চিঠি আসছে বাড়িতে!
"হ্যাঁ, আজ অফিস যাব না, একটা জায়গায় যাবার আছে" হাসিমুখে বললেন সুমেধা।
"শাড়িটা নতুন গো? খুব সুন্দর।"
"হ্যাঁ, পরশুদিনই ডেলিভারি পেলাম… এই যে এখনও পিকো করা হয়নি! ভেবেছিলাম আজ পরব না, তারপর ভাবলাম পরেই ফেলি…" হাসতে হাসতে বললেন সুমেধা।
"তোমাকে আজ একদম অন্যরকম লাগছে!"
"তাই?" আবার একমুখ হাসি সুমেধার।
"দিদি, তোর একটা চিঠি এসেছে। আজ বাজার থেকে আসার পথে লেটারবক্সে পেলাম।"
"চিঠি? জানি?"
"জানিস? কে লিখেছে বুঝতে পেরেছিস?" কৌতূহলী চোখে জিজ্ঞেস করেন ইন্দ্রজিৎ।
"হ্যাঁ রে… অনেকদিন, অনেক পরিকল্পনার পরে লেখা চিঠি… জানব না?"
"তারসাথেই আজ দেখা করতে যাবে বুঝি? তাই এত্ত সাজ?"
"নাহ্, তার সঙ্গে ক'দিন আগেই দেখা হয়েছে। তাই তো আজ অফিস ছুটি নিলাম"।
"দিদি, কিছু মনে করো না, নিজের বয়সের কথাটা একবার ভেবে যা করার করো।"
"বয়সের কথা ভেবেই তো করছি গো… সব ফুরিয়ে যাবার আগেই সব ফিরে পেতে হবে…"
"দিদি, প্লিজ কোনো ভুল করিস না। তুই চাকরি করিস, বাবা চলে যাবার আগে বাড়ির দোতলাটা তোকেই লিখে দিয়েছেন… তোকে এসবের জন্যে যেন কেউ না ঠকায় রে…" অসহায় গলা ইন্দ্রজিতের।
"ঠকাবে কেন কেউ? কী যে বলিস!"
"দিদি, তোমাকে এইবয়সে কেউ সত্যিকারের ভালবাসলে তো ভালোই, কিন্তু সোসাইটি তো খুব একটা ভাল জায়গা না! অনেক লোভী মানুষ আছে। তাই তোমার ভাই বলছে…"
একটু হাসেন মহুয়া। তারপর ডাইনিং টেবিলটার একটা চেয়ার টেনে বসেন। হাতে রাখা প্যাকেটটি টেবিলের ওপর রাখেন।
"জানিস ভাই, মহুয়া, ভেবেছিলাম তোদের সঙ্গে একটা খেলা খেলব। ক'মাস ধরেই নিজেকে কেমন ফুরিয়ে গেছি বলে মনে হচ্ছিল। আমি বিয়ে করিনি, সেটা আমার ইচ্ছে ছিল, সে নিয়ে অনেকদিন কোনো আক্ষেপও ছিল না আমার। কিন্তু চল্লিশ পেরোবার পর থেকেই কষ্ট হতো… ভেবেছিলাম পেপারে বিজ্ঞাপন দেব। ভাই যা যা বললি, সেই চাকরি, বাড়ি, এসব লিখেই। কিন্তু, ভয় লাগল! তারপর… মনে হল তোরা নিজেদের জীবন নিয়ে এত ব্যস্ত, আমাকে পাত্তাও দিস না…"
"সেটা ঠিক না দিদি, তুমিও জানো…"
"জানি মহুয়া, জানি। সবাই আমরা নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। আমি বুঝি! কিন্তু মাঝে মাঝে মেঘলা দিন তো আসে, বলো? নিজেকে একা মনে হয় খুব? সেরকমই একটা দিনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এইরকমভাবে নিজেকে চিঠি লেখার! এমনকি এই শাড়িটা অর্ডার করেছিলাম…"
"নিজেকে চিঠি লেখা?" অবাক গলা ইন্দ্রজিৎ আর মহুয়ার।
"হ্যাঁ, আরও একটা চিঠি পোস্ট করেছি। তাতে আরেকটু প্রেম প্রেম ভাব। ভেবেছিলাম তোরা সেসব পড়বি। পোস্টকার্ডে তো লেখাই সেজন্য। আর আমার গুরুত্ব বাড়বে তোদের কাছে… তোরা আর ইগনোর করবি না আমাকে…"
"দিদি…"
"জানি… ভুল করছিলাম। তবু খেলাটা চালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু… কাল হঠাৎ ভাবলাম - কেন? আমি তো কোনো অন্যায় করিনি! শুধু নিজের মতো করে বাঁচতে চেয়েছি। গান করতাম, ছেড়ে দিয়েছিলাম, আবার শুরু করতে চাই। আর সেজন্য একজন কাল্পনিক অ্যাডমায়ারার তৈরি করে, তার বকলমে চিঠি লেখা, নিজের ডাকনামে… হ্যাঁ, দুজন মানুষ, যারা আমার আপনজন, তাদের কাছে গুরুত্ব পাবার জন্য এতকিছু করতে যাচ্ছিলাম আমি! আর তখনই বুঝলাম, এভাবে নিজের কাছেই গুরুত্বহীন হয়ে যাচ্ছি! তাই আজ সবটা স্বীকার করলাম রে, ভাই, মহুয়া!" হাসিমুখে, ক্লান্ত গলায় বলেন সুমেধা।
"দিদি, প্লিজ আবার গানটা শুরু কর… সত্যি তো ভাল গাইতিস, কেন ছাড়লি?"
"কেউ শুনতেই চাইত না তো আর! ক'টা আর ফাংশান হয় এখন বল? আর আমাকেই বা তারা ডাকবে কেন? সেভাবেই ভুলে গেলাম রে সব আস্তে আস্তে…"
"দিদি, এটা কি গো?" এতক্ষণে টেবিলের দিকে চোখ গেল মহুয়ার।
"এটা একটা কেক গো। আজ আমার একটা নিজের একটা নতুন দিন, এসো আমরা কেকটা কাটি…" সেই হাসিমুখ সুমেধার।
"সেসব তো বুঝলাম, কিন্তু তুই আজ কোথায় যাচ্ছিস অফিস কেটে?"
"একটা হারমোনিয়াম কিনব রে! একটা গানের কলেজে ভর্তি হব আজ।"
"দিদি…" বলে জড়িয়ে ধরল মহুয়া, সুমেধাকে।
কত বাজে কথা ভেবেছে ও! শুধু আজ নয়, আগেও। বিরক্ত ও হয়েছে। কিন্তু সেটা যে কত ভুল ছিল…
দিদি নতুন করে গান শুরু করছেন। ওর এত পায়ে ব্যথা... কতবার ভেবেছে, কিন্তু যোগাসন শুরু করেনি... 'সময় কোথায়' ভেবে কাটিয়ে দিয়েছে। অথচ... মাত্র চল্লিশ ও... শুরু তো করতেই পারে!
জড়িয়ে ধরল সুমেধাও।
আহা, আজকের দিনটা খুব ভাল! চারিদিকে কেমন একটা নতুন আলো!
ভেঙে যাচ্ছে বাঁধ… নতুন করে জোয়ার আসছে…
ভালো থাকার, ভাল রাখার ক্ষণ এসে গেছে…
"পিউ,
কেমন আছ?
ভাবছ, এতদিন পরে কেন লিখছি?
অনেকদিন ধরেই ভেবেছি লিখব, জানো? কিন্তু পারিনি।
অপরাধবোধ হয় সেজন্য রোজ।
থাক সেসব কথা।
এখন গান করো না, পিউ?
"যেতে দাও আমায় ডেকো না" শুনেছিলাম একবার পাড়ার ফাংশানে। মায়ের একটা সবুজ শাড়ি পরেছিলে…
যাই হোক, আজ এখানেই থামি।
আবার লিখব।
ইতি,
'আমি'।
সকাল সকাল পোস্টকার্ডে চিঠিটা দেখেই অবাক হয়ে যান ইন্দ্রজিৎ। 'পিউ' মানে দিদি! দিদিকে আবার কে এমন চিঠি লিখতে পারে?
তবে চিঠিটা দেখে, ভাষা দেখে তো খুব চেনা কেউ মনে হচ্ছে! দিদির গানের কথা জানে… মায়ের শাড়ি… হুম, মায়ের শাড়ি তো দিদি পরতেই পারে…
কে ইনি?
দিদির প্রেমে পড়েছিল কেউ?
"মহুয়া, মহুয়া? এদিকে এসো…" হাঁক দিয়ে বৌকে ডাকলেন ইন্দ্রজিৎ।
"কি? সকাল সকাল এত ডাকাডাকি কেন? আমি কিন্তু এখন আর চা করতে পারব না, একবার করে চা দিয়েছি। সব কাজ তো একাই করতে হয়। মিনতিদি না আসা অব্দি বসারও চান্স পাই না।" আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বলেন মহুয়া।
সত্যি তো, বয়স তো থেমে থাকে না, তারমধ্যে এখন থেকেই মহুয়ার পায়ে আর্থারাইটিস ধরা পড়েছে। হাঁটু মুড়ে বসতে কষ্ট হয়। বাড়ির কাজ নিয়ে রেগেও থাকে প্রায় সবসময়। আজকাল কথায় কথায় 'আইবুড়ি দিদি' নিয়েও খোঁটা দেয়। অথচ বিয়ের আগে থেকেই তো জানত দিদির কথা…
"এই চিঠিটা… আজ পেলাম লেটারবক্সে।"
"কিসের চিঠি?"
"পড়েই দেখো।"
পড়তে পড়তে ভুরু কুঁচকে গেল মহুয়ার। তারপর বলল "দিদি গান করত? ফাংশানে? সে তো আদ্যিকালের কথা। এখন আবার কে এসব লিখল?"
"চেনা কেউই হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু কোনো নাম লেখেনি…"
"লুকোনো প্রেমিক! ফর্টি ফাইভ ক্রশ করল দিদি আগের বছর… আর এখন এইসব…"
"এইসব মানে? কী আশ্চর্য কথা মহুয়া!"
"দিদি বিয়ে করেনি, এই বয়সে এইসব চিঠি… দেখে তো আমিই আশ্চর্য হচ্ছি।"
"দেখো, চিঠি এসেছে ঠিকই, কিন্তু তাতে তো কোনো অশোভন কিছু লেখা নেই? তাহলে তুমি রিয়্যাক্ট কেন করছ?"
"তুমিও তো রিয়্যাক্ট করছ! তাই তো অফিস যাবার আগের এই ব্যস্ত সময়েও আমাকে ডেকে দেখালে…"
"ভুল হয়েছে! একটা চিঠি দেখে অবাক হলাম তাই শেয়ার করার জন্য ডাকলাম।"
কিছু উত্তর দেবার আগেই কলিংবেল বেজে উঠল।
"এখন আবার কে?"
"প্লিজ তুমি দেখো, আমি স্নানে যাচ্ছি, নইলে দেরি হয়ে যাবে। এমনিতেই সোমবার লেট হলে অসুবিধা হয় খুব।"
"হুঁ, আমার যেন খুব সময় আছে হাতে!" গজগজ করতে করতে দরজার দিকে এগিয়ে যান মহুয়া।
দরজার কাছে যাবার আগেই দেখেন ইন্দ্রজিতের দিদি, সুমেধা দরজা খুলে কিছুর একটা ডেলিভারি নিচ্ছেন। পিছনে ঘুরে ওকে দেখতে পেয়ে হাসলেন।
আজ একটা হাল্কা গোলাপী রঙের শিফন শাড়ি পরেছেন। গলায় একছড়া মুক্তোর হার। মাথার চুল ভিজে।
"আজ একটু বেশিই সাজগোজ! কী ব্যাপার, কারো সাথে দেখা করার আছে নাকি?" না চাইতেই বেশ একটু অন্যরকম হয়ে গেল মহুয়ার গলা।
ছেচল্লিশ হতে চলল, মহুয়ার থেকে ছ বছরের বড়, তাও চিঠি আসছে বাড়িতে!
"হ্যাঁ, আজ অফিস যাব না, একটা জায়গায় যাবার আছে" হাসিমুখে বললেন সুমেধা।
"শাড়িটা নতুন গো? খুব সুন্দর।"
"হ্যাঁ, পরশুদিনই ডেলিভারি পেলাম… এই যে এখনও পিকো করা হয়নি! ভেবেছিলাম আজ পরব না, তারপর ভাবলাম পরেই ফেলি…" হাসতে হাসতে বললেন সুমেধা।
"তোমাকে আজ একদম অন্যরকম লাগছে!"
"তাই?" আবার একমুখ হাসি সুমেধার।
"দিদি, তোর একটা চিঠি এসেছে। আজ বাজার থেকে আসার পথে লেটারবক্সে পেলাম।"
"চিঠি? জানি?"
"জানিস? কে লিখেছে বুঝতে পেরেছিস?" কৌতূহলী চোখে জিজ্ঞেস করেন ইন্দ্রজিৎ।
"হ্যাঁ রে… অনেকদিন, অনেক পরিকল্পনার পরে লেখা চিঠি… জানব না?"
"তারসাথেই আজ দেখা করতে যাবে বুঝি? তাই এত্ত সাজ?"
"নাহ্, তার সঙ্গে ক'দিন আগেই দেখা হয়েছে। তাই তো আজ অফিস ছুটি নিলাম"।
"দিদি, কিছু মনে করো না, নিজের বয়সের কথাটা একবার ভেবে যা করার করো।"
"বয়সের কথা ভেবেই তো করছি গো… সব ফুরিয়ে যাবার আগেই সব ফিরে পেতে হবে…"
"দিদি, প্লিজ কোনো ভুল করিস না। তুই চাকরি করিস, বাবা চলে যাবার আগে বাড়ির দোতলাটা তোকেই লিখে দিয়েছেন… তোকে এসবের জন্যে যেন কেউ না ঠকায় রে…" অসহায় গলা ইন্দ্রজিতের।
"ঠকাবে কেন কেউ? কী যে বলিস!"
"দিদি, তোমাকে এইবয়সে কেউ সত্যিকারের ভালবাসলে তো ভালোই, কিন্তু সোসাইটি তো খুব একটা ভাল জায়গা না! অনেক লোভী মানুষ আছে। তাই তোমার ভাই বলছে…"
একটু হাসেন মহুয়া। তারপর ডাইনিং টেবিলটার একটা চেয়ার টেনে বসেন। হাতে রাখা প্যাকেটটি টেবিলের ওপর রাখেন।
"জানিস ভাই, মহুয়া, ভেবেছিলাম তোদের সঙ্গে একটা খেলা খেলব। ক'মাস ধরেই নিজেকে কেমন ফুরিয়ে গেছি বলে মনে হচ্ছিল। আমি বিয়ে করিনি, সেটা আমার ইচ্ছে ছিল, সে নিয়ে অনেকদিন কোনো আক্ষেপও ছিল না আমার। কিন্তু চল্লিশ পেরোবার পর থেকেই কষ্ট হতো… ভেবেছিলাম পেপারে বিজ্ঞাপন দেব। ভাই যা যা বললি, সেই চাকরি, বাড়ি, এসব লিখেই। কিন্তু, ভয় লাগল! তারপর… মনে হল তোরা নিজেদের জীবন নিয়ে এত ব্যস্ত, আমাকে পাত্তাও দিস না…"
"সেটা ঠিক না দিদি, তুমিও জানো…"
"জানি মহুয়া, জানি। সবাই আমরা নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। আমি বুঝি! কিন্তু মাঝে মাঝে মেঘলা দিন তো আসে, বলো? নিজেকে একা মনে হয় খুব? সেরকমই একটা দিনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এইরকমভাবে নিজেকে চিঠি লেখার! এমনকি এই শাড়িটা অর্ডার করেছিলাম…"
"নিজেকে চিঠি লেখা?" অবাক গলা ইন্দ্রজিৎ আর মহুয়ার।
"হ্যাঁ, আরও একটা চিঠি পোস্ট করেছি। তাতে আরেকটু প্রেম প্রেম ভাব। ভেবেছিলাম তোরা সেসব পড়বি। পোস্টকার্ডে তো লেখাই সেজন্য। আর আমার গুরুত্ব বাড়বে তোদের কাছে… তোরা আর ইগনোর করবি না আমাকে…"
"দিদি…"
"জানি… ভুল করছিলাম। তবু খেলাটা চালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু… কাল হঠাৎ ভাবলাম - কেন? আমি তো কোনো অন্যায় করিনি! শুধু নিজের মতো করে বাঁচতে চেয়েছি। গান করতাম, ছেড়ে দিয়েছিলাম, আবার শুরু করতে চাই। আর সেজন্য একজন কাল্পনিক অ্যাডমায়ারার তৈরি করে, তার বকলমে চিঠি লেখা, নিজের ডাকনামে… হ্যাঁ, দুজন মানুষ, যারা আমার আপনজন, তাদের কাছে গুরুত্ব পাবার জন্য এতকিছু করতে যাচ্ছিলাম আমি! আর তখনই বুঝলাম, এভাবে নিজের কাছেই গুরুত্বহীন হয়ে যাচ্ছি! তাই আজ সবটা স্বীকার করলাম রে, ভাই, মহুয়া!" হাসিমুখে, ক্লান্ত গলায় বলেন সুমেধা।
"দিদি, প্লিজ আবার গানটা শুরু কর… সত্যি তো ভাল গাইতিস, কেন ছাড়লি?"
"কেউ শুনতেই চাইত না তো আর! ক'টা আর ফাংশান হয় এখন বল? আর আমাকেই বা তারা ডাকবে কেন? সেভাবেই ভুলে গেলাম রে সব আস্তে আস্তে…"
"দিদি, এটা কি গো?" এতক্ষণে টেবিলের দিকে চোখ গেল মহুয়ার।
"এটা একটা কেক গো। আজ আমার একটা নিজের একটা নতুন দিন, এসো আমরা কেকটা কাটি…" সেই হাসিমুখ সুমেধার।
"সেসব তো বুঝলাম, কিন্তু তুই আজ কোথায় যাচ্ছিস অফিস কেটে?"
"একটা হারমোনিয়াম কিনব রে! একটা গানের কলেজে ভর্তি হব আজ।"
"দিদি…" বলে জড়িয়ে ধরল মহুয়া, সুমেধাকে।
কত বাজে কথা ভেবেছে ও! শুধু আজ নয়, আগেও। বিরক্ত ও হয়েছে। কিন্তু সেটা যে কত ভুল ছিল…
দিদি নতুন করে গান শুরু করছেন। ওর এত পায়ে ব্যথা... কতবার ভেবেছে, কিন্তু যোগাসন শুরু করেনি... 'সময় কোথায়' ভেবে কাটিয়ে দিয়েছে। অথচ... মাত্র চল্লিশ ও... শুরু তো করতেই পারে!
জড়িয়ে ধরল সুমেধাও।
আহা, আজকের দিনটা খুব ভাল! চারিদিকে কেমন একটা নতুন আলো!
ভেঙে যাচ্ছে বাঁধ… নতুন করে জোয়ার আসছে…
ভালো থাকার, ভাল রাখার ক্ষণ এসে গেছে…