23-03-2023, 10:07 PM
(This post was last modified: 24-03-2023, 10:01 AM by Bumba_1. Edited 2 times in total. Edited 2 times in total.)
দুপুরের দিকে বৃষ্টি হলে রাস্তাঘাট কেমন যেন শুনশান হয়ে যায়! আকাশে ভার হয়ে ঝুলে থাকা মেঘ, ভেজা রাস্তা, দুপাশের ঘরবাড়ি, বন্ধ রাখা জানলা .. সবকিছুই যেন নিঃস্তব্ধ। একটা কাক ডেকে উঠলো কোথাও। অনেকক্ষণ ধরে কানের কাছে একটা বাঁশির মতো শব্দ শুনছিলো সঞ্জীব। আকাশের আলো অনেকটাই মরে এসেছে। আষাঢ়ের বড় বেলা, কিন্তু হলে কি হবে! আজ সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা ছিলো। সঞ্জীবের মা অঞ্জলি দেবী অনেক করে বলেছিলেন, "পড়াতে যাচ্ছিস সেই ফুলবোনাতে, ছাতাটা নিয়ে যাস মনে করে।"
কিন্তু কে কার কথা শোনে! অকারণে জেদ করেই একরকম, ছাতা ছাড়াই প্যাডেলে চাপ দিয়েছিল সে। 'মাসের দশ তারিখ হয়ে গেলো, তাও শালারা এখনও এমাসের মাইনেটা দিলো না .. এরকম করলে চলে!' কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সাইকেল চালাচ্ছিলো সঞ্জীব। এইসময় উত্তর-পশ্চিম থেকে একটা গুমগুম করে শব্দ হলো, আর বৃষ্টিটাও আর একটু চেপে এলো। সাইকেল থেকে নেমে পড়লো সে। আপাতত গোবিন্দদের বাড়ি পড়াতে যাওয়ার ভাবনাটা পাশে রেখে সে ভাবছিলো .. নাহ্ , ভাবা আর গেলো না। কারণ ফের খসখসে বাঁশির শব্দটা শুনলো সে।
আর এবার...! হ্যাঁ ঠিকই তো! একটা মিহি কণ্ঠস্বর যেন! কিন্তু এই নির্জন শেষ বিকেলে একটা পুরোনো বন্ধ দোকানঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে সে ভূতের গলা শুনবে নাকি? "হ্যাঁ ছার (পড়ুন স্যার) শুনবেন বই কি .." বেশ কষ্টে কে যেন অত্যন্ত মিহি স্বরে কথাগুলো বলে উঠলো।
এবার অবাক হওয়ার পালা সঞ্জীবের। কারণ সেই বাঁশির মতো শব্দটাও সাথে সাথে যেন শুনলো সে। "হ্যাঁ, ওই বাঁশি বাজাতে গিয়েই তো যত বিপত্তি!" সঞ্জীব আবার শুনতে পেলো সেই আওয়াজ। "তখন থেকে কইচি, ছার এট্টু আগুন দ্যান, এট্টু আগুন দ্যান, শুনতেই পান না নাকি?"
এবার সঞ্জীব বেশ রেগে যায়, "তুমি কে হে? আর আমার কাছে আগুন আছে কি নেই তুমি কি করে জানলে? সর্বোপরি আমার মনের কথাগুলো, অর্থাৎ যেগুলো আমি ভাবছি সেগুলো তুমি অবলীলায় পড়ে নিয়ে বলছো কি করে?"
"জানি ছার, আমরা সব জানি ! ইয়ে পাব্লিক হ্যায় না .. ইয়ে সব জানতা হ্যায়, শোনেন নাই?" পুনরায় শোনা গেলো কণ্ঠস্বরটি।
"বিলক্ষণ শুনেছি ! তবে তুমি কিরকম পাবলিক যে দেখা যায় না?" বিরক্তি প্রকাশ করে জিজ্ঞাসা করলো সঞ্জীব।
"আজ্ঞে ছার,আমরা তো ছায়াছবি নই যে দেকবেন! আমরা হলুম গিয়ে যাকে বলে ইয়ে .." কথাটা শুনে এবার থমকালো সঞ্জীব, "ইয়ে মানে?" তারপর কিছু একটা ভেবে গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে বললো, "তা তোমাদের তো আগুনে বড় ভয় শুনেছি, আগুন চাইছো যে বড়?"
দু'বার বাঁশি ফুক ফুক করে উঠলো। সঞ্জীব বুঝতে পারলো অশরীরীটি হাসলো বোধহয়! ফের শোনা গেলো "একটা সিগ্রেট খাবো ছার, এখন আমরা বিড়ি-সিগ্রেট সব খাই, আগুনে কিস্যু হয় না"
"বটে?" বিস্ময় প্রকাশ করে উঠলো সঞ্জীব। "হ্যাঁ ছার, এখন তো দেশে সবাই উল্টো নিয়মে চলছে, তা আমরাই বা কমতি কিসে?" উত্তর দিলো অশরীরী।
দেশের কথা, রাজ্যের কথা, রাজনীতির কথা .. পাছে অন্যদিকে ব্যাপারটা ঘুরে যায়, তাই অগত্যা ব্যাগ হাতড়ে লাইটারটা জ্বালালো সঞ্জীব। তারপর অবাক হয়ে দেখলো, আগুন থেকে একটা ফুলকি যেন বেরিয়ে গিয়ে একটু তফাতে গিয়ে স্থির হলো, তারপর মাঝে মাঝে ধোঁয়া উড়তে লাগলো।
এদিকে বৃষ্টি থামেনি এখনও। উপরি পাওনা সন্ধ্যে নামছে দ্রুত। লোকজন সে এরমধ্যে কাছেপিঠে দেখেও নি। ভয় ঠিক নয়, বরং একধরণের অস্বস্তি কাজ করছিলো সঞ্জীবের ভেতর। কয়েকহাত দূরে এইরকম পরিবেশে যদি এমন একজন মনের সুখে সিগারেট খায়, যার শরীর দৃষ্টিগোচর হয় না! তবে সেটা আর যাই হোক, সুখকর হতে পারে না কারও কাছে।
"একটা কথা বলি ছার ?" কণ্ঠস্বরটি শুনে কিছুটা চমকে উঠলো সঞ্জীব। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললো "বলো.."
"বাদলাটা ঠিক সহ্যি হয় না ছার তাই সিগ্রেটখান ধরালাম .. " ভূতের আবার বৃষ্টি-বাদল সহ্য হয় না! আরোও কত কিই যে দেখতে হবে! হাসি চেপে যতটা পারা যায় গম্ভীর হয়ে সঞ্জীব বললো, "এটা তো আসল কথা নয়! ঝেড়ে কাশো দেখি!"
কণ্ঠ বলতে থাকে " নদী পেরিয়ে পাশের জেলাতে আমার বাড়ি ছার। বৌ মরেছে আঁতুড়ে ছেলেটাকে রেখেই। গেরামের নেতাদের ন্যাজধরা হয়ে ঘুরতুম আর ভোটের সময় ডিউটি ছিলো বাঁধাধরা.."
কথা ফের অন্যদিকে ঘুরে যায় মনে করে সঞ্জীব বললো, "সে না হয় হলো, তারপর?"
অশরীরী বলতে শুরু করলো, " দাঁড়ান ছার, অত তাড়াহুড়ো করলে চলে ? যাই হোক ছার, ওই ডিউটি করতে গিয়েই তো পরাণ বেরিয়ে গেলো। অপোজিছন ছেলেরা ডিউটি দেখতে পেয়ে জানলা দিয়ে গুলি ছুঁড়লো। গলার সাঁকি ফুটো হয়ে গেলো। সেই থেকে হাওয়া হয়ে ঘুরছি .."
বাঁশির আওয়াজের রহস্যটা এতক্ষণে পরিষ্কার হলো সঞ্জীবের কাছে। বৃষ্টির বেগ কমছে, এখানে আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা যাবে না। "থেমে গেলে যে বড়?" তাড়া দেয় সঞ্জীব।
"ছেলেটার কথা ভেবে কষ্ট হয় ছার, সামনের ভাদ্রে ছ'য়ে পড়বে। একলা দিদিমার কাছে থাকে। নেকাপড়া মোটে করে না ছার ! খালি গুলতানি .." এইটুকু বলে আবার থেমে যায় কণ্ঠ।
"তো আমি কি করবো?" বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে সঞ্জীব।
"বলছিলাম কি ছার, ছেলের আমার মাতা ভালো" বাঁশিকণ্ঠে যেন দ্বিধা জড়ায়। ইঙ্গিতটা কিছুটা পরিষ্কার হয় সঞ্জীবের কাছে। কণ্ঠ এবার বলে ওঠে "ছেলেটাকে পড়ান ছার, এটুকুই বলতে চাইচি। দিদিমাটা মরে গেলে কি হবে জানি না। তবে যদ্দিন আচে নেকাপড়াটা তো করুক। ওই পাশের গেরাম ফুলবোনাতেই আমার শ্বশুরবাড়ি, ওকেনেই তারা থাকে।"
কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায় সঞ্জীব। অশরীরী বলতে থাকে, " ছেলেটা বক্কেশ্বর হলে কি হবে .. বুদ্দি আছে। ওর মায়ের বেরেনটা পেয়েচে কিনা! একটা গরিব ছেলেকে বিনি পয়সায় না হয় এট্টু সাহায্যিই করলেন! আমি কতা দিচ্চি ওকে নেকাপড়া করাতে আপনার ভালোই লাগবে। আপনার সোন্দর মুকখান জ্বলজ্বল করবে .."
ছেলেমেয়ের জন্য বাবা-মা যে মরেও শান্তি পায় না, কথাগুলো শোনার পর সেটা উপলব্ধি করতে পারে সঞ্জীব। ঠিক সেই মুহূর্তে পিতৃমাতৃহীন অসহায় ছেলেটির প্রতি একটা অজানা টান অনুভব করে সে। "ঠিক আছে .. পড়াবো।" মুচকি হেসে এইটুকু বলে বাঁশিকণ্ঠকে আশ্বাস দিয়ে সন্ধ্যের অন্ধকারে প্যাডেলে চাপ দিলো সঞ্জীব। আকাশে এখন অনেক তারা। ফুলবোনাতে পৌঁছাতে মিনিট দশ-পনেরো লাগবে।