20-03-2023, 10:19 PM
পর্ব:০৪
মুন্সি বাড়ির উঠুনের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে তর্নি। টিনের চালের এক তলার একটা দালান ঘর। ছয় রুমের দালানটা দেখতে বড়সড় না হলেও অনেক সুন্দর। নিজের জন্ম ঘরটা দেখে কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেলো তর্নির। কতদিন পরে বাড়ি আসলো সে। বাবা মাকে দেখার জন্য মনটা আঁকুপাঁকু করছিলো৷ আজ তাঁর বাবা মাকে দেখার সময়টা এলো। কাউকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। রাতে ফোন জানিয়ে দিয়েছে সে আসছে। তবুও কেউ তাঁর পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে নেই। কে থাকবে? বোনদের তো বিয়ে হয়ে গেছে? মা মনে হয় কাজে আছে।
তর্নি ঘরের দিকে পা বাড়ালো। দু এক কদম এগিয়ে যেতেই কানে ভেসে এলো চাপা কান্নার আওয়াজ। তর্নির বুঝতে দেরি হলোনা কে কাঁদছে বা কেন কাঁদছে। দৌড়ে চলে গেলো তাঁর মায়ের ঘরে। হ্যাঁ। সে যা ভেবেছিলো তাই-ই,তাঁর বাবা আতিকুর রহমান তাঁর মাকে মারছেন। তর্নি দৌড়ে গিয়ে তাঁর বাবার হাত ধরে আটকে মিনতি করে বলল,
_বাবা ছেড়ে দাও। মাকে মাইরো না বাবা প্লিজ।"
আতিকুর রহমান তর্নিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন। তর্নি গিয়ে খাটের সাথে ধাক্কা খায়। উনি আবার তর্নির মায়ের দিকে তেড়ে যান। তর্নি বাঁধা দিতে আসলে উনি তর্নিকে থাপ্পড় মারতে হাত উঠান। তর্নির মা তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কেঁদে বলে,
_মাইয়াটা মেলাদিন পরে আইজকা বাড়িতে আইছে৷ দয়া কইরা আমার মাইয়ারে মাইরেন না।
আতিকুর রহমান উনার টকটকে লাল চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে হুংকার দিয়ে বললেন,
_কেন মারুম না? তোর মাইয়াগুলাই তো সব নষ্টের মূল। আমার সব সম্পদ শেষ করে দিছে এই অলক্ষীরা। আমায় রাস্তার ফকির বানাইয়া দিছে তোর জারজ সন্তান গুলা।
জারজ সন্তান শুনে তর্নি রেগে গেলো। চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
_জুয়া খেলে খেলে জমিজামা যা ছিলো সব বিক্রি করে দিছো। পাঁচ হাজার দামের মদ না খেলে তোমার রাতে ঘুম আসেনা। এখন বলতেছো আমরা তোমার সম্পদ শেষ করে দিছি? আর জারজ সন্তান কাদের বলো তুমি? নিজের সন্তানদের জারজ বলতে লজ্জা করেনা?
আতিকুর রহমান তেড়ে আসেন। তর্নির মা বাঁধা দিয়ে বলেন,
_আল্লাহর দোহাই লাগে জোয়ান মাইয়ার গায়ে আর হাত তুইলেন না।
আতিকুর রহমান উনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে গিয়ে তর্নির গলা টিপে ধরে বলেন,
_তোরা সবগুলাই জারজ৷ আমি জন্ম দিলে সব গুলা পোলা হইতো তোরা হইতি না।"
বলেই তর্নিকে নিয়ে আলমারির সাথে চেপে ধরেন। তর্নির মা আতিকুর রহমানের থেকে তর্নিকে ছাড়াতে চান, কিন্তু উনার শক্তিতে কুলিয়ে উঠে না। আতিকুর রহমানের দুটো পায়ে ধরে মেয়ের জান ভিক্ষা চান। তবুও কাজ হয়না। তর্নির চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে। চোখ দুটো যেন উল্টে যেতে চাচ্ছে। মাজেদা বেগম মেয়ের অবস্থা দেখে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আতিকুর রহমানকে একটা ধাক্কা দেন। উনি গিয়ে ছিটকে পড়েন দরজার কাছে। তর্নি জোরে জোরে শ্বাস ফেলে কাশতে লাগে। আতিকুর রহমান উঠে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে একহাতে লুঙ্গি ধরে হাঁটুর উপর লুঙ্গি তুলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এই ধাক্কার হিসাব তিনি পরে নিবেন। এখন উনাকে খেলায় যেতে হবে। নয়তো এই মা মেয়ে দুটোকে মেরে বস্তায় ভরে নদীতে ফেলে আসতেন। তর্নির পুরো শরীর কাঁপছে। গাল বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে লোনাজল। মাকে জড়িয়ে কেঁদে কেঁদে বলল,
_এতো পোড়া কপাল নিয়ে আল্লাহ আমাদের কেন জন্ম দুনিয়ায় দিলো মা? না আপুরা শান্তি মতো এখানে থাকতে পারলো না আমি পারি। আমাদের জন্মের পরপরই জ্যান্ত কবর দিলেনা কেন মা? মানুষ তাঁর মেয়েগুলোকে রাজকন্যা করে রাখে। আর আমরা তা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখি। আমরা এতো হতভাগী কেন মা?"
বলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো তর্নি। মাজেদা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
_কেন আইছস বাড়িতে? তোরে কইছিনা,আমি মইরা গেলে আইয়া আমারে দেইখা যাবি। এর আগে আইবি না।
তর্নি মায়ের বুক থেকে মাথা তুলে জল ভরা চোখে অবাক হয়ে তাকালো। এতোদিনে সে বাড়িতে এসেছে। উনিও তাকে এটা বলছেন? চোখ মুছে শক্ত গলায় বলল,
_আর আসবো না মা৷ এইবার গেলে আর আসবো না৷ যেদিন টাকার বান্ডিল এনে তোমাদের সামনে রাখতে পারবো। সেদিন আসবো।"
বলেই উঠে দরজার সামনে থেকে ব্যাগ নিয়ে নিজের ঘরে চলে আসলো তর্নি। মাকে এসব বলেই বা কি হবে? উনি তো নিজেই বিষজীবনের অধিকারি৷ সেই ছোট থেকে তর্নি দেখে আসছে। কোনো না কোনো কারণে তাঁর মায়ের গায়ে হাত তুলেন তাঁর বাবা৷ তর্নিরা পাঁচ বোন। সে সবার ছোট। ছেলের আশায় এতোগুলো মেয়ের জন্ম দিয়েছেন মাজেদা বেগম। বার বার মেয়ে জন্ম দেওয়ার কারণে স্বামীর কাছে অনেক মারধর খেতে হতো উনাকে।
তর্নির লজ্জা লাগে। একজন নেশাখোর জুয়াখোর পুরুষকে নিজের বাবা বলে পরিচয় দিতে। টিউশনি করে নিজের লেখাপড়া থেকে শুরু করে নিজের যাবতীয় সব খরচ চালায়। কখনো মায়ের কাছে হাত পাত্তে পারেনা কারণ সে জানে, তাঁর মা তাঁকে না বলবেন না। কিন্তু অনেক কষ্ট করে তাকে একটা জিনিস দিবেন। সেটা তর্নি চায়না। তাঁর থেকে ভালো তর্নি কষ্ট করে নিজের খরচ নিজে চালাক।
_____________
ট্রেন থেমেছে কিছুক্ষণ হলো। অনেকেই নেমে গেছে। কেউ কেউ নামছে তো কেউ নামার জন্য ব্যাগপত্র বের করছে। ফারদিন নিজের ব্যাগ নিচে নামিয়ে সুপ্তির দিকে তাকিয়ে দেখলো এখনো সে ঘুমিয়ে আছে। ঘন পাপড়ি চোখের মেয়েটাকে ঘুমন্ত অবস্থায় অনেক সুন্দর লাগছে। কয়েকটা অগোছালো চুল কপালের সাথে লেপ্টে গেছে ঘামের কারণে৷ সুলভ ফারদিনকে কিছুক্ষণ আগে বলেছে সুপ্তিকে জাগানোর জন্য ফারদিন জাগায় নি। কিন্তু এখন জাগানোটা জরুরি মনে হচ্ছে। ট্রেনের সবাই নেমে যাচ্ছে। সুপ্তিকে এভাবে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে যাওয়া ঠিক হবে না। পরে যদি কোনো দূর্ঘটনা ঘটে আরারকে কি জবাব দিবে তাঁরা? ফারদিন সুপ্তিকে দু-একবার ডাক দিলো সুপ্তি শুনলো না। সুপ্তিকে জাগাতে হাত বাড়িয়েও পিছিয়ে নিলো। ঘুমন্ত অবস্থায় কোনো নারীকে ছোঁয়া ঠিক নয়। তাও এটা আরারের গার্লফ্রেন্ড। ফারদিন সুপ্তির একগুচ্ছ চুলে ধরে টান দিলো। সাথে সাথে সুপ্তি লাফিয়ে উঠলো। তাকিয়ে যখন দেখলো ফারদিন তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে সুপ্তি দু এক না ভেবেই তাঁর পাশ থেকে পানির বোতল নিয়ে ফারদিনের উপর ছুঁড়ে মারলো। বোতলটা পড়লো ফারদিনের নাকের উপর। সে নাক ধরে অগ্নিচোখে তাকালো সুপ্তির দিকে। সুপ্তির কান্ডে সুলভ বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। ফারদিন চেঁচিয়ে বলল,
_ওই আপনি ছুঁড়া ছুঁড়ি ছাড়া কিছু জানেন না তাইনা? ম্যানারলেস গার্ল।
সুপ্তি ফারদিনের থেকে আরো গলা উঁচিয়ে বলল,
_আমি ম্যানারলেস? আপনার মাঝে যখন এতোই ম্যানার্স তাহলে ঘুমন্ত একটা মেয়ের চুল ধরে টান দেন কিভাবে?
_আমি চুল ধরে টান দিছি অন্যকেউ হলে গায়ে ছুঁয়ে দিতো। "
বলতে বলতে নাক থেকে হাত সরায় ফারদিন। তাঁর নাকের ডগা লাল হয়ে আছে। লাল নাকের কারণে ফেসটা কেমন বিশ্রী রূপ নিয়েছে। ফারদিনের নাকে চোখ পড়তেই ফিক করে হেসে দিলো সুপ্তি। হাসি দেখে ফারদিন আরো রেগে গেলো। বোতলটা তুলে সুপ্তি কিছু বুঝে উঠার আগেই বোতলের সব পানি ঢেলে দিলো সুপ্তির মাথায়। সুলভ ফারদিনকে টেনে নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে আসে। সুপ্তি তখনো শকডের উপর দিয়ে যাচ্ছিলো। সুলভ ফারদিনকে নিয়ে বাইরে আসতেই ফারদিন সুলভের হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে বলল,
_আমি বুঝিনা এই অসভ্য মেয়েটাকে আরার কিভাবে পছন্দ করেছে। এই মেয়ের মধ্যে ভালো লাগার মতো কিছু আছে? ঝগড়াটে মহিলাদের মতো সারাক্ষণ ঝগড়ার মুডে থাকে। আমি এক্ষুনি আরারকে বলে দিবো এই মেয়ের সব কর্মকাণ্ডের কথা।"
বলতে বলতে ফোন বের করতে লাগে ফারদিন। সুলভ আরারকে থামিয়ে বলে,
_ফারদিন মাথা ঠান্ডা কর। কি বলবি তুই আরারকে? আরার যদি বলে তুই কেন সুপ্তির চুল ধরে টেনেছিস, তখন কি বলবি? যদি বলে কেন ভিজিয়ে দিয়েছিস তখন কি বলবি? আর এখন সুপ্তির নামে কিছু বলতে যাবি তো তুই আরারের দোষমন হবি৷ ভুলে যাবিনা নতুন প্রেম সাংঘাতিক। আগে দেখ সুপ্তি আরারকে কি বলে তারপর না হয় আমরা বলবো এখন এই ট্রেনের বিষয়টা আরারকে না বলাই ভালো।
_বিরক্ত লাগছে এই মেয়ের কথা আর বলবি না চল। তুই দেখিস আরার যদি এই মেয়েকে বিয়ে করে, আমি ওর বিয়েতেই যাবো না।
______________
ছাদের ডান পাশে রাখা দোলনাটায় বসে আছে আরান। তাঁর মনটা ছটফট করছে তাঁর মেঘবতীর জন্য। দুপুর হয়ে গেছে এখনো সুপ্তি একটা কল দেয়নি। সুপ্তির ফোনটাও বন্ধ দেখাচ্ছে। সে কি বাসায় পৌঁছেনি? সুপ্তির চিন্তায় কিছু খেতেও পারছে না আরার। দুপুর দুটো বাজে এখনো কিছু মুখে নেয়নি সে। যতক্ষণ না তাঁর মেঘবতীর সাথে কথা হবে ততক্ষণ কিছুই খাবে না সে। খেতেই পারবে না। সেই মায়াজড়ানো কণ্ঠস্বর একবার শুনতে চায় সে। কিন্তু মায়াবতীর যে ফোনটা বন্ধ। আশু প্লেটে করে চিড়া ভাজা নিয়ে এসে আরারের সামনে বসে খাচ্ছে। আরার অন্যদিনের মতো ঝাপটে এনে খাবে কি একবার তাকাচ্ছেও না। ভাইয়ের এমন উদ্বিগ্ন চেহারা পূর্বে কখনো দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না আশুর। প্লেটটা রেখে এসে আরারের পিছনে দাঁড়ালো৷ আরারের চুলে হাত ডুবিয়ে মুঠিবদ্ধ করলো৷ বোনের কোমল হাতের ছোঁয়ায় চোখ বন্ধ করে দিলো আরান। আশু এভাবে ভাইয়ের চুলে হাত ডুবিয়ে ডুবিয়ে আহ্লাদী গলায় বলল,
_ভাই, জানো তোমার মুখটা মলিন দেখলে তোমার বোনের খুব কান্না পায়।
_বোনের নয় বোনদের।" সিঁড়ির দিক থেকে আরু আনুর কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই সেদিকে তাকালো আশু ও আরান। আরু ও আনু দৌড়ে এসে আরানের দুপাশে বসে আরানের গলা জড়িয়ে ধরে গলায় মুখ লুকালো। আশু বলল,
_বলনা ভাই কি হয়েছে তোমার?
আনু আরানের একটা হাত ধরে বলল,
_হ্যাঁ ভাইয়া বলনা কি হইছে? তুমি সেই সকাল থেকে কিচ্ছু খাও নি।
_কিছু হয়নি রে। এমনি ভালো লাগছে না।
আরু আরানের গালে হাত রেখে ব্যথিত গলায় বলল,
_মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। কিছু তো একটা হয়েছে ভাইয়া। বলোনা কি হইছে?
আরুর কথা শেষ হতেই আরারের ফোন বেজে উঠলো৷ তড়িঘড়ি করে ফোনটা বের করলো আরান। ফোনের স্ক্রীনে স্পষ্ট ভাসছে মেঘবতী নামটা। মূহুর্তেই আরানের মুখটা খুশিতে ঝলমলে উঠলো। এইতো তাঁর মেঘবতী কল দিয়েছে।
চলবে,,,,,,,।
মুন্সি বাড়ির উঠুনের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে তর্নি। টিনের চালের এক তলার একটা দালান ঘর। ছয় রুমের দালানটা দেখতে বড়সড় না হলেও অনেক সুন্দর। নিজের জন্ম ঘরটা দেখে কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেলো তর্নির। কতদিন পরে বাড়ি আসলো সে। বাবা মাকে দেখার জন্য মনটা আঁকুপাঁকু করছিলো৷ আজ তাঁর বাবা মাকে দেখার সময়টা এলো। কাউকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। রাতে ফোন জানিয়ে দিয়েছে সে আসছে। তবুও কেউ তাঁর পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে নেই। কে থাকবে? বোনদের তো বিয়ে হয়ে গেছে? মা মনে হয় কাজে আছে।
তর্নি ঘরের দিকে পা বাড়ালো। দু এক কদম এগিয়ে যেতেই কানে ভেসে এলো চাপা কান্নার আওয়াজ। তর্নির বুঝতে দেরি হলোনা কে কাঁদছে বা কেন কাঁদছে। দৌড়ে চলে গেলো তাঁর মায়ের ঘরে। হ্যাঁ। সে যা ভেবেছিলো তাই-ই,তাঁর বাবা আতিকুর রহমান তাঁর মাকে মারছেন। তর্নি দৌড়ে গিয়ে তাঁর বাবার হাত ধরে আটকে মিনতি করে বলল,
_বাবা ছেড়ে দাও। মাকে মাইরো না বাবা প্লিজ।"
আতিকুর রহমান তর্নিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন। তর্নি গিয়ে খাটের সাথে ধাক্কা খায়। উনি আবার তর্নির মায়ের দিকে তেড়ে যান। তর্নি বাঁধা দিতে আসলে উনি তর্নিকে থাপ্পড় মারতে হাত উঠান। তর্নির মা তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কেঁদে বলে,
_মাইয়াটা মেলাদিন পরে আইজকা বাড়িতে আইছে৷ দয়া কইরা আমার মাইয়ারে মাইরেন না।
আতিকুর রহমান উনার টকটকে লাল চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে হুংকার দিয়ে বললেন,
_কেন মারুম না? তোর মাইয়াগুলাই তো সব নষ্টের মূল। আমার সব সম্পদ শেষ করে দিছে এই অলক্ষীরা। আমায় রাস্তার ফকির বানাইয়া দিছে তোর জারজ সন্তান গুলা।
জারজ সন্তান শুনে তর্নি রেগে গেলো। চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
_জুয়া খেলে খেলে জমিজামা যা ছিলো সব বিক্রি করে দিছো। পাঁচ হাজার দামের মদ না খেলে তোমার রাতে ঘুম আসেনা। এখন বলতেছো আমরা তোমার সম্পদ শেষ করে দিছি? আর জারজ সন্তান কাদের বলো তুমি? নিজের সন্তানদের জারজ বলতে লজ্জা করেনা?
আতিকুর রহমান তেড়ে আসেন। তর্নির মা বাঁধা দিয়ে বলেন,
_আল্লাহর দোহাই লাগে জোয়ান মাইয়ার গায়ে আর হাত তুইলেন না।
আতিকুর রহমান উনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে গিয়ে তর্নির গলা টিপে ধরে বলেন,
_তোরা সবগুলাই জারজ৷ আমি জন্ম দিলে সব গুলা পোলা হইতো তোরা হইতি না।"
বলেই তর্নিকে নিয়ে আলমারির সাথে চেপে ধরেন। তর্নির মা আতিকুর রহমানের থেকে তর্নিকে ছাড়াতে চান, কিন্তু উনার শক্তিতে কুলিয়ে উঠে না। আতিকুর রহমানের দুটো পায়ে ধরে মেয়ের জান ভিক্ষা চান। তবুও কাজ হয়না। তর্নির চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে। চোখ দুটো যেন উল্টে যেতে চাচ্ছে। মাজেদা বেগম মেয়ের অবস্থা দেখে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আতিকুর রহমানকে একটা ধাক্কা দেন। উনি গিয়ে ছিটকে পড়েন দরজার কাছে। তর্নি জোরে জোরে শ্বাস ফেলে কাশতে লাগে। আতিকুর রহমান উঠে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে একহাতে লুঙ্গি ধরে হাঁটুর উপর লুঙ্গি তুলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এই ধাক্কার হিসাব তিনি পরে নিবেন। এখন উনাকে খেলায় যেতে হবে। নয়তো এই মা মেয়ে দুটোকে মেরে বস্তায় ভরে নদীতে ফেলে আসতেন। তর্নির পুরো শরীর কাঁপছে। গাল বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে লোনাজল। মাকে জড়িয়ে কেঁদে কেঁদে বলল,
_এতো পোড়া কপাল নিয়ে আল্লাহ আমাদের কেন জন্ম দুনিয়ায় দিলো মা? না আপুরা শান্তি মতো এখানে থাকতে পারলো না আমি পারি। আমাদের জন্মের পরপরই জ্যান্ত কবর দিলেনা কেন মা? মানুষ তাঁর মেয়েগুলোকে রাজকন্যা করে রাখে। আর আমরা তা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখি। আমরা এতো হতভাগী কেন মা?"
বলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো তর্নি। মাজেদা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
_কেন আইছস বাড়িতে? তোরে কইছিনা,আমি মইরা গেলে আইয়া আমারে দেইখা যাবি। এর আগে আইবি না।
তর্নি মায়ের বুক থেকে মাথা তুলে জল ভরা চোখে অবাক হয়ে তাকালো। এতোদিনে সে বাড়িতে এসেছে। উনিও তাকে এটা বলছেন? চোখ মুছে শক্ত গলায় বলল,
_আর আসবো না মা৷ এইবার গেলে আর আসবো না৷ যেদিন টাকার বান্ডিল এনে তোমাদের সামনে রাখতে পারবো। সেদিন আসবো।"
বলেই উঠে দরজার সামনে থেকে ব্যাগ নিয়ে নিজের ঘরে চলে আসলো তর্নি। মাকে এসব বলেই বা কি হবে? উনি তো নিজেই বিষজীবনের অধিকারি৷ সেই ছোট থেকে তর্নি দেখে আসছে। কোনো না কোনো কারণে তাঁর মায়ের গায়ে হাত তুলেন তাঁর বাবা৷ তর্নিরা পাঁচ বোন। সে সবার ছোট। ছেলের আশায় এতোগুলো মেয়ের জন্ম দিয়েছেন মাজেদা বেগম। বার বার মেয়ে জন্ম দেওয়ার কারণে স্বামীর কাছে অনেক মারধর খেতে হতো উনাকে।
তর্নির লজ্জা লাগে। একজন নেশাখোর জুয়াখোর পুরুষকে নিজের বাবা বলে পরিচয় দিতে। টিউশনি করে নিজের লেখাপড়া থেকে শুরু করে নিজের যাবতীয় সব খরচ চালায়। কখনো মায়ের কাছে হাত পাত্তে পারেনা কারণ সে জানে, তাঁর মা তাঁকে না বলবেন না। কিন্তু অনেক কষ্ট করে তাকে একটা জিনিস দিবেন। সেটা তর্নি চায়না। তাঁর থেকে ভালো তর্নি কষ্ট করে নিজের খরচ নিজে চালাক।
_____________
ট্রেন থেমেছে কিছুক্ষণ হলো। অনেকেই নেমে গেছে। কেউ কেউ নামছে তো কেউ নামার জন্য ব্যাগপত্র বের করছে। ফারদিন নিজের ব্যাগ নিচে নামিয়ে সুপ্তির দিকে তাকিয়ে দেখলো এখনো সে ঘুমিয়ে আছে। ঘন পাপড়ি চোখের মেয়েটাকে ঘুমন্ত অবস্থায় অনেক সুন্দর লাগছে। কয়েকটা অগোছালো চুল কপালের সাথে লেপ্টে গেছে ঘামের কারণে৷ সুলভ ফারদিনকে কিছুক্ষণ আগে বলেছে সুপ্তিকে জাগানোর জন্য ফারদিন জাগায় নি। কিন্তু এখন জাগানোটা জরুরি মনে হচ্ছে। ট্রেনের সবাই নেমে যাচ্ছে। সুপ্তিকে এভাবে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে যাওয়া ঠিক হবে না। পরে যদি কোনো দূর্ঘটনা ঘটে আরারকে কি জবাব দিবে তাঁরা? ফারদিন সুপ্তিকে দু-একবার ডাক দিলো সুপ্তি শুনলো না। সুপ্তিকে জাগাতে হাত বাড়িয়েও পিছিয়ে নিলো। ঘুমন্ত অবস্থায় কোনো নারীকে ছোঁয়া ঠিক নয়। তাও এটা আরারের গার্লফ্রেন্ড। ফারদিন সুপ্তির একগুচ্ছ চুলে ধরে টান দিলো। সাথে সাথে সুপ্তি লাফিয়ে উঠলো। তাকিয়ে যখন দেখলো ফারদিন তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে সুপ্তি দু এক না ভেবেই তাঁর পাশ থেকে পানির বোতল নিয়ে ফারদিনের উপর ছুঁড়ে মারলো। বোতলটা পড়লো ফারদিনের নাকের উপর। সে নাক ধরে অগ্নিচোখে তাকালো সুপ্তির দিকে। সুপ্তির কান্ডে সুলভ বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। ফারদিন চেঁচিয়ে বলল,
_ওই আপনি ছুঁড়া ছুঁড়ি ছাড়া কিছু জানেন না তাইনা? ম্যানারলেস গার্ল।
সুপ্তি ফারদিনের থেকে আরো গলা উঁচিয়ে বলল,
_আমি ম্যানারলেস? আপনার মাঝে যখন এতোই ম্যানার্স তাহলে ঘুমন্ত একটা মেয়ের চুল ধরে টান দেন কিভাবে?
_আমি চুল ধরে টান দিছি অন্যকেউ হলে গায়ে ছুঁয়ে দিতো। "
বলতে বলতে নাক থেকে হাত সরায় ফারদিন। তাঁর নাকের ডগা লাল হয়ে আছে। লাল নাকের কারণে ফেসটা কেমন বিশ্রী রূপ নিয়েছে। ফারদিনের নাকে চোখ পড়তেই ফিক করে হেসে দিলো সুপ্তি। হাসি দেখে ফারদিন আরো রেগে গেলো। বোতলটা তুলে সুপ্তি কিছু বুঝে উঠার আগেই বোতলের সব পানি ঢেলে দিলো সুপ্তির মাথায়। সুলভ ফারদিনকে টেনে নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে আসে। সুপ্তি তখনো শকডের উপর দিয়ে যাচ্ছিলো। সুলভ ফারদিনকে নিয়ে বাইরে আসতেই ফারদিন সুলভের হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে বলল,
_আমি বুঝিনা এই অসভ্য মেয়েটাকে আরার কিভাবে পছন্দ করেছে। এই মেয়ের মধ্যে ভালো লাগার মতো কিছু আছে? ঝগড়াটে মহিলাদের মতো সারাক্ষণ ঝগড়ার মুডে থাকে। আমি এক্ষুনি আরারকে বলে দিবো এই মেয়ের সব কর্মকাণ্ডের কথা।"
বলতে বলতে ফোন বের করতে লাগে ফারদিন। সুলভ আরারকে থামিয়ে বলে,
_ফারদিন মাথা ঠান্ডা কর। কি বলবি তুই আরারকে? আরার যদি বলে তুই কেন সুপ্তির চুল ধরে টেনেছিস, তখন কি বলবি? যদি বলে কেন ভিজিয়ে দিয়েছিস তখন কি বলবি? আর এখন সুপ্তির নামে কিছু বলতে যাবি তো তুই আরারের দোষমন হবি৷ ভুলে যাবিনা নতুন প্রেম সাংঘাতিক। আগে দেখ সুপ্তি আরারকে কি বলে তারপর না হয় আমরা বলবো এখন এই ট্রেনের বিষয়টা আরারকে না বলাই ভালো।
_বিরক্ত লাগছে এই মেয়ের কথা আর বলবি না চল। তুই দেখিস আরার যদি এই মেয়েকে বিয়ে করে, আমি ওর বিয়েতেই যাবো না।
______________
ছাদের ডান পাশে রাখা দোলনাটায় বসে আছে আরান। তাঁর মনটা ছটফট করছে তাঁর মেঘবতীর জন্য। দুপুর হয়ে গেছে এখনো সুপ্তি একটা কল দেয়নি। সুপ্তির ফোনটাও বন্ধ দেখাচ্ছে। সে কি বাসায় পৌঁছেনি? সুপ্তির চিন্তায় কিছু খেতেও পারছে না আরার। দুপুর দুটো বাজে এখনো কিছু মুখে নেয়নি সে। যতক্ষণ না তাঁর মেঘবতীর সাথে কথা হবে ততক্ষণ কিছুই খাবে না সে। খেতেই পারবে না। সেই মায়াজড়ানো কণ্ঠস্বর একবার শুনতে চায় সে। কিন্তু মায়াবতীর যে ফোনটা বন্ধ। আশু প্লেটে করে চিড়া ভাজা নিয়ে এসে আরারের সামনে বসে খাচ্ছে। আরার অন্যদিনের মতো ঝাপটে এনে খাবে কি একবার তাকাচ্ছেও না। ভাইয়ের এমন উদ্বিগ্ন চেহারা পূর্বে কখনো দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না আশুর। প্লেটটা রেখে এসে আরারের পিছনে দাঁড়ালো৷ আরারের চুলে হাত ডুবিয়ে মুঠিবদ্ধ করলো৷ বোনের কোমল হাতের ছোঁয়ায় চোখ বন্ধ করে দিলো আরান। আশু এভাবে ভাইয়ের চুলে হাত ডুবিয়ে ডুবিয়ে আহ্লাদী গলায় বলল,
_ভাই, জানো তোমার মুখটা মলিন দেখলে তোমার বোনের খুব কান্না পায়।
_বোনের নয় বোনদের।" সিঁড়ির দিক থেকে আরু আনুর কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই সেদিকে তাকালো আশু ও আরান। আরু ও আনু দৌড়ে এসে আরানের দুপাশে বসে আরানের গলা জড়িয়ে ধরে গলায় মুখ লুকালো। আশু বলল,
_বলনা ভাই কি হয়েছে তোমার?
আনু আরানের একটা হাত ধরে বলল,
_হ্যাঁ ভাইয়া বলনা কি হইছে? তুমি সেই সকাল থেকে কিচ্ছু খাও নি।
_কিছু হয়নি রে। এমনি ভালো লাগছে না।
আরু আরানের গালে হাত রেখে ব্যথিত গলায় বলল,
_মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। কিছু তো একটা হয়েছে ভাইয়া। বলোনা কি হইছে?
আরুর কথা শেষ হতেই আরারের ফোন বেজে উঠলো৷ তড়িঘড়ি করে ফোনটা বের করলো আরান। ফোনের স্ক্রীনে স্পষ্ট ভাসছে মেঘবতী নামটা। মূহুর্তেই আরানের মুখটা খুশিতে ঝলমলে উঠলো। এইতো তাঁর মেঘবতী কল দিয়েছে।
চলবে,,,,,,,।
===========================
পড়তে থাকুন চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।
Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.
( Post By- Kam Pagol)